সাহিত্যচিন্তা
নিসন্দেহে জীবনের বাইরের কিছুকে আমরা আমাদের লেখার বিষয়বস্তু করতে অপারগ। অর্থাৎ আমাদের সকলেরই লেখার বিষয়বস্তু জীবন— যা-কিছু নিয়ে জীবন এবং জীবনকে নিয়ে যা-কিছু তাই। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই যে লেখকের স্বাতন্ত্র কিংবা বৈচিত্র নির্ভর করছে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির উপর। ব্যাপক অর্থে সব লেখকেরই বিষয়বস্তু এক কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারনেই একজন লেখক আর একজন লেখক থেকে আলাদা হয়ে ওঠে।
সাম্প্রতিক কবিদের অধিকাংশই এসেছেন মধ্যবিত্ত শ্রেনী থেকে। শ্রেনীগত কারনেই তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এক ধরনের মিল থাকা স্বাভাবিক, সেটি পাঠকের কাছে একঘেঁয়ে মনে হতে পারে। কিন্তু তাই বোলে এই অভিযোগ করা সঙ্গত নয় যে কবিতার বিষয়বস্তু একঘেঁয়ে হয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য করলে দ্যাখা যাবে কোনো সময়েই সকলে শক্তিশালী কবি হয় না। এক একজন বড়ো কবির আশেপাশে, তাঁর ছায়ায় আরো কিছু কবি বেড়ে ওঠে এবং তাঁরা তাঁর ছায়ার সীমার বাইরে যেতে পারে না। এখানে অভিযোগ করার কিছুই নেই— কারন প্রত্যেক মানুষের একটি নিজস্ব চূড়ান্ত সীমানা আছে, তাকে অতিক্রম করা যায় না।
তবে একটি বিষয়ের কথা আমি বলবো তা হচ্ছে সততার কথা। নিজের আত্মার সাথে, নিজের অনুভবের সাথে যারা প্রতারনা করে তাঁরা কেউ কবি নয়— তাঁরা কেউ শিল্পী নয়। শিল্পকে যারা ফ্যাশন মনে করে কিংবা তাকে রাজনৈতিক বা অন্য যে কোনো সুবিধে আদায়ের জন্যে ব্যবহার করে তাদের আমি লম্পট বলতে ভালোবাসি। আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে এখন এই দুই ধরনের লম্পটদের উপদ্রব বিরাজ করছে। আপনারা সে-সব বিষয় তুলে ধরতে চেষ্টা করুন। বিষয়বস্তু একঘেঁয়ে কিনা এটা খুব বড়ো ব্যাপার নয়।
আপনারা কি দেখছেন জানি না— আমি খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি কিছু সৎ দায়িত্ববান রক্তাক্ত তরুন অশ্বত্থ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে আমাদের শিল্পের উঠোনে
আমরা কেন কষ্টের কবিতা লিখবো। আমরা কেন হত্যার কবিতা লিখবো। আমরা কেন রক্তপাতের কথা লিখবো। কেন, কেন দুর্ভিক্ষের কথা লিখবো। আমরা কেন রোগে কাতর পুষ্টিহীন শিশুর কথা লিখবো। আমরা কেন একজন যক্ষাগ্রস্ত চাষির কথা লিখবো। কেন, কেন, কেন, কেন আমরা মৃত্যু আর মর্ম যাতনার কথা লিখবো। কেন কান্নার কথা, দীর্ঘশ্বাসের কথা, অশ্রুর কথা লিখবো।
আমরা তো এক সুন্দর পৃথিবীর কথা লিখতে চাই। আমরা তো এক অপরূপ পৃথিবীর স্তবগান লিখতে চাই। আমরা তো ওই মেঘ, ওই বিকেলের সোনালি আলোর নিচে রেশমের মতো ঝিলমিল মেঘের সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে চাই। আমরা তো মত্ত গর্জনময় পৌরুষ সাগরের স্তব করতে চাই। আমরা তো শস্যের ডগায় একটা সোনালি ফড়িং-এর অপরূপ ডানার কারুকাজের প্রশংসা করতে চাই। আমরা তো পৃথিবীর সেই সুন্দর নারীর নাকের ডগার মিহি লোমে দূরতম স্বাতি নক্ষত্রের ঝ’রে পড়ার সুষমা জানাতে চাই। আমরা তো এক তরুন তরুনীর উদ্দাম স্বপ্নময়তার ছবি লিখতে চাই। আমরা তো একটি স্বাস্থ্যবান লাবন্যময় শিশুর কথা লিখতে চাই। চাই এক সুস্থ সবল কৃষকের কথা লিখতে। যে কবি গানের আসরে বোসে ভাতের কথা ভাবে না— গানের সৌন্দর্যর কথা ভাবে। আমরা তো সেই সুখি মেয়েটির কথা লিখতে চাই যে ভালোবেসে প্রিয় মানুষের কাছে গেছে।