এক দশকের কবিতা
ষাট দশকের কবিতা অবক্ষয়, বিকার, যৌনতা, স্থূলতা, নৈরাজ্য, আত্মগ্লানি, ব্যক্তিক দ্বিধা, পাপ এবং পচনে স্পষ্টভাবেই নিজেকে চিহ্নিত করেছে। রাজনৈতিক অব্যবস্থা, সামাজিক অসন্তোষ এবং সর্বোপরি রোগাক্রান্ত সনাতন চিন্তা বা বোধ অতিক্রম করার দুঃসাহসে দীপ্ত কিছু তরুনের আপাত ব্যর্থতা এই দশকের প্রারম্ভেরও কিছু আগে থেকেই ক্রমশ প্রবলভাবে সংক্রামিত কোরে চলেছিলো সমাজজীবন। এবং এরই ক্ষতচিহ্ন ধারন কোরে বেরিয়ে আসে ষাট দশকের একদল উষ্ণ তরুন। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত ‘এক দশকের কবিতা’ ষাট দশকের এই সনিষ্ঠ, প্রেমিক, যন্ত্রনাকাতর, যৌনতাপৃষ্ট, রক্তাক্ত কবিদের কবিতা সংকলন। তিরিশের রবীন্দ্র-অতিক্রমের অভ্যুত্থানের পর কবিতাঙ্গনে এমন কিছু উল্লেখযোগ্য সংযোজন হয়েছে বোলে মনে করার যথেষ্ট কারন নেই। যেটুকু হয়েছে তা সম্পূর্নভাবে খন্ডিত, বিচ্ছিন্নতায় আড়ষ্ট, অতি সচেতনতায় সৃষ্ট উন্নাসিক, অসম্পূর্ন এবং যোগাযোগরহিত, অহংমুখী। কবিতায় ঐতিহ্যগত চরিত্রের দিক থেকে রবীন্দ্রোত্তরসূরিরা একপ্রকার বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করেছেন। শিল্পের যে-কোনো শাখায় একপক্ষীয় কোনো ব্যাপার নেই। উৎপাদক ও গ্রহীতা এই দুইপক্ষের মধ্যে সবসময়ই একটি বোঝাবুঝির প্রয়োজন আছে এবং বোঝাবুঝির সুসমতার মাধ্যমেই এই শিল্প অগ্রগতি লাভ করে। উৎপাদকের উৎপন্ন ফসল গ্রহীতার বহনের পক্ষে সাধ্যাতীত হলে তা খুব একটা প্রয়োজনীয় বা অর্থকরী হয়েছে বোলে মনে করার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। ষাটের কবিরাও সেই অভিযোগ থেকে মুক্ত নন বোলেই মনে হয়।
ষাটের কবিদের অধিকাংশই সচেতনতাহীন আবেগে মোহে জর্জরিত, আত্ম- কেন্দ্রিকতায় এবং ব্যক্তিক বিবর-বৃত্তে বিদ্যমান। গতির পরিবর্তে তাঁরা গতিহীন কষ্টকল্পিত পাশ্চত্য যান্ত্রিক যন্ত্রনার ধারক-বাহক এবং উদ্গারক। তাঁদের (অবশ্য সবার নয়) কবিতায় যে যন্ত্রনা মূর্ত হয়ে উঠেছে তা এই জলবায়ু-ভূমি-ভূগোলের নয়। ষাটের যন্ত্রনার উৎস খুঁজলে দেখা যাবে তাতে যন্ত্রের যন্ত্রনা নয় বরং নাগরিকতা এবং নৈসর্গিকতা— এই দুয়ের বিরুদ্ধে চেতনাজাত বৈপরীত্যে দ্বিধাগ্রস্ত মধ্যবিত্ত মানসিকতার অবক্ষয়ই প্রধান। কাজেই, যদি সত্যি সত্যিই কবিতায় বাস্তবতা এসে থাকে তবে তা অবশ্যম্ভাবীরূপে এই যন্ত্রনা, অবক্ষয় বা আশা থেকেই আসা উচিত ছিলো। কিন্তু তা কতোটুকু এসেছে?
‘কখনো জুরিখে তুমি, বনে, কিয়োটোতে, বামতীরে,
গ্রীনিচ পল্লীতে কিম্বা রোমে প’ড়ে থাকো। কখনো
যোগ দাও পোর্ট সৈয়দের নোংরা বেলেল্লাপনায়।’
এ-জাতীয় অভিব্যক্তিতে কবিতা কতোটুকু জীবনের কাছে, যন্ত্রনার কাছে এসেছে! এই আক্ষেপ কি এ-জলভূমির? নিসর্গ এবং আধা-নাগরিকতা যেখানে প্রধান উপজীব্য সেখানে পরাবাস্তববাদের মতো অযৌক্তিক বিষয় নিয়ে কেউ কেউ প্রবাসিত হয়েছেন এবং এই গ্রন্থের সম্পাদক তাঁদেরকে নতুন কিছু উদ্ভাবনের জন্য উৎসাহসহ অকারন প্রশংসা করতে কার্পন্য করেননি।
এখন প্রশ্ন আসে; এ জাতীয় খন্ডিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উৎসাহিত কোরে সম্পাদক কি কবিতাঙ্গনে একটি স্থবির ব্যামোকে স্থায়ী সাহায্য করেননি? প্রকৃতপক্ষে কবিতা কার জন্যে! যদি তা মানুষের জন্যে, জীবনের জন্যে হয় তবে তাকে জীবন থেকে, বাস্তব থেকে প্রেত-সৌরে টেনে নেয়ার পেছনে আর যে উদ্দেশ্যই থাক, সেটা কোনোভাবে সৎ কবিতা নির্মানের উদ্দেশ্য নয়।
আলোচনার প্রথমে উদ্ধৃত উক্তিটিতে আবু সায়ীদ ইঙ্গিত করেছেন যে ‘বিশুদ্ধ কবিতার অস্তিত্বে তিনি বিশ্বাসী নন’। কিন্তু প্রশ্ন থাকে, বিশুদ্ধ কবিতা বলতে তিনি কোন কবিতাকে বোঝাচ্ছেন। নন্দনবাদীদের মতে, বিশুদ্ধ কবিতা যদি জীবনস্পর্শী কবিতা হয় তবে তার সাথে কোনোভাবেই একমত হওয়া সম্ভব নয়। আর যদি বিশুদ্ধ কবিতা বলতে তিনি ছন্দের কলাকানুনে সংযত, বুদ্ধির শানিত সম্পাতে উচ্চকিত কিছু শব্দের সংকলন বুঝিয়ে থাকেন তবে একমত হতে আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি যে ‘অশুদ্ধ কবিতা’-কে সমর্থন কোরে ষাট দশককে মোহন এবং উর্বর সময় বোলে মুখরিত হয়েছেন তা যদি ঐ শ্রেনীর পরাবাস্তব-শিল্পহীন-জীবনবিহীন শব্দের ঝনঝনানি হয়, তবে কোনোক্রমেই তাঁর মতের পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। নতুন কিছু সংযোজনের নামে যদি কবিতা ও জীবনের মাঝখানে ফাটল তৈরি হয় তবে তাকে স্বীকার করতে দ্বিধা থাকে বৈকি!
মোট আটত্রিশজন কবির সাতাত্তরটি কবিতা-সম্বলিত এ-গ্রন্থে কিছু অত্যন্ত দুর্বল কবিতা অনাবশ্যক-অর্থহীনভাবে গ্রন্থিত হয়েছে। তাদের মধ্যে জিনাত রফিকের ‘অজ্ঞতা’, মনজুরে মওলার ‘রবীন্দ্রনাথ’, আসাদ চৌধুরীর ‘আমার বাবা’ উল্লেখ্য। মাকিদ হায়দার, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মিলন মাহমুদ, শিহাব সরকার, আলতাফ হোসেন এবং রাজীব আহসান চৌধুরীর এরকম দুর্বল কবিতাকে সংযোজিত করা অসংগত মনে হয়েছে।
এখানে একটা কথা বলা উচিত, তা হলো— ষাট দশকের এই যে অভ্যুত্থান এবং এই অভ্যুত্থানের যাঁরা নায়ক, যাঁরা সেই সময়ে আমুন্ড গ্রাস করা স্থবিরতা, অনুর্বরতা ও মোড়লিয়ানাকে অগ্রাহ্য কোরে বিস্ফোরিত হয়েছিলেন তাঁরা নিসন্দেহে একটি নতুন সর্গের জন্মদাতা। এবং তাঁদের এই দুর্দমনীয় উদগারন বাংলা কবিতার জীবনে একটি অভাবনীয় উত্তরন; কিন্তু যতোটুকু উচ্চতা এবং উদ্ভাস এই অভ্যুত্থানের পেছনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলো ঠিক ততোটুকু সংযম, দূরদৃষ্টি এবং সচেতনতা এতে ছিলো না, যার ফলে এই সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলা কবিতার চরিত্র ও স্থায়িত্ব নিয়ে এক উচ্ছৃংখল কাতরতা। অথচ ষাটের কবিদের এ- বিষয়ে শুরু থেকেই নিজেদের কাছে নিজেদের স্পষ্ট এবং মূর্ত হওয়া উচিত ছিলো। অবশ্য একথাও ঠিক সেই প্লাবনের মুহূর্তে এতোটা সতর্ক সংসারী হওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব ছিলো না। তবে যে-কথা স্বীকার না-করলে সত্যকে উপেক্ষা করা হবে তা হচ্ছে— ষাট দশকের এই অভাবনীয়, অসংযমী, উদ্বেলিত উচ্চারনই আজ এই সব নতুন প্রশ্ন ও বিবেচনার পথকে সুগম ও সুনির্দিষ্ট করেছে। আমার বিশ্বাস ষাট দশকের এই রক্তাক্ত প্রেমিকদের কেউ কেউ সচেতনতা ও আত্ম-উন্মোচনের স্পর্শে স্থায়িত্বের সুনীল শিখরে উপনীত হবে।
গ্রন্থে সংকলিত সুন্দর কবিতাগুলোর মধ্যে মান্নান সৈয়দের ‘জীবনানন্দের কাক’ রফিক আজাদের ‘জন্মদিনের জর্নাল’, মোহাম্মদ রফিকের ‘সংঘাত’, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘প্রতিশোধে হ্যামলেট’, আসাদ চৌধুরীর ‘তর্কাতীত’, আবুল হাসানের ‘ব্লেড’, মহাদেব সাহার ‘আমার এ ভয় অন্যরকম’, হুমায়ুন কবিরের ‘পার্শ্ববর্তিনী সহপাঠিনীকে’ এবং মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘দূরে যাচ্ছো’ অন্যতম। এ-ছাড়াও আরো কিছু কবিতা ভালো লাগার শরীর স্পর্শ করে। অনেক কবিরই একাধিক কবিতা এতে রয়েছে, কারো কারো অপ্রয়োজনীয়ভাবে।