গ্রন্থভূক্ত কবিতা (কাব্যগ্রন্থ)
গান
অগ্রন্থিত কবিতা
গল্প
চলচ্চিত্র কাহিনী ও চিত্রনাট্য
সম্পাদকীয়, গদ্য ও বক্তৃতা
সাক্ষাৎকার
1 of 2

ভিন্নস্বর অন্যমত

ভিন্নস্বর অন্যমত

গত ১৫-০২-৯৮ তারিখ সংবাদ-এর সাময়িকী পাতায় সৈয়দ শামসুল হক-এর ‘হৃৎকলমের টানে’ কলামে ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ’ সম্পর্কে লেখা হয়েছে। লেখাটি পড়ে মনে হলো, তিনি যেন নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আমাদের সবার ব্যর্থতাকে জায়েজ করার যুক্তি খুঁজছেন। সমস্যার সঠিক জায়গার উন্মোচন না কোরে তাকে যেন আড়াল করার এক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। ‘গর্বের সাথে স্মরণ করি, এই পরিষদ ও উৎসবের পরিকল্পনায় সেদিন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল তরুণ কবিরা, এই তরুণরাই অগ্রজ কবিদের সেদিন সংগঠিত করেছিলো।’ অগ্রজ সৈয়দ হকের এই উক্তি সর্বাংশে সত্য। কিন্তু এখন আমাকে কষ্টভেজা আক্ষেপের সাথে বলতে হচ্ছে— তরুনরাই ‘কবিতা পরিষদ’-এর জন্ম দিয়েছিলো, আর তা ভেঙ্গে দিলেন অগ্রজেরা, বৃদ্ধেরা।

‘এরশাদে পতনের পর জাতীয় কবিতা পরিষদ টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে কি?’ এই প্রশ্ন নিয়ে শুধু সৈয়দ হক নন, সেদিন নির্বাহী পরিষদের সভায় (০২-০২- ৯১ইং) নির্মলেন্দু গুণ, বেলাল চৌধুরী, মহাদেব সাহা এবং আরো কয়েকজন তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। ভাবখানা এরকম যেন আমরা শুধুমাত্র এরশাদকে হটানোর জন্যে কবিতা পরিষদ গঠন করেছিলাম। স্বৈরাচারী এরশাদ একটি ইস্যুমাত্র ছিলো তখন আমাদের কাছে। আসলে আমরা চেয়েছিলাম এদেশে কবিদের একটি জাতীয় প্লাটফর্ম তৈরি হোক, যেখানে প্রগতিশীল কবিরা একত্রিত হবে। আমরা সফলও হয়েছিলাম। দেশের সকল কবি (দু’একটি দালাল ছাড়া) শরিক হয়েছিলেন কবিতা পরিষদের কর্মকান্ডে। তবে এ কথাও সত্যি যে, অনেক তরুন কবিযশোপ্রার্থী এখানে ভিড় জমিয়েছিলেন এবং কবিতা লেখার চেয়ে কবিতা পরিষদের সদস্য হওয়ার প্রতি বেশি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু সৈয়দ হক যে আদোলে সমস্যাটি দেখাতে চেয়েছেন তা মেনে নেয়া যায় না।

‘৯১-এর কাউন্সিলের অনেক কথাই বলা যাবে না। তাতে অনেক অগ্রজেরই ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত হবে। সৈয়দ হক ওই কাউন্সিলের পরিষদ বিলুপ্ত করা এবং একই অবস্থায় টিকিয়ে রাখা— এই দু’টি পক্ষের কথা শুধু উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেদিন আমার যে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ছিলো তিনি ঘুনাক্ষরেও তা প্রকাশ করেননি। আমার প্রস্তাব ছিলো— স্বৈরাচারমুক্ত দেশে কবিতা পরিষদের মতো সংগঠনের দায়িত্ব অপরিসীম এবং কাজ করার জন্যে এখনই উপযুক্ত সময়। কবিতা পরিষদকে ঢেলে সাজিয়ে প্রকৃত কবিদের এখানে স্থান কোরে দিতে হবে। এখন কবিতা পরিষদ হবে পেশাভিত্তিক সংগঠন। প্রকৃত কবি যারা, যারা লিখেছেন, লিখছেন, যারা পরীক্ষিত এবং যারা লিখে যাবেন, কেবল তারাই হতে পারবেন কবিতা পরিষদের সদস্য। আর বাৎসরিক যে উৎসব সেখানে যোগ দিতে পারবেন সকলেই— একটি কবিতা যিনি লিখেছেন, তিনিও। আমাদের পত্রপত্রিকাগুলো লেখকের সম্মানী নিয়ে নানারকম টালবাহানা করে, কেউ কেউ সম্মানীই দিতে চায় না। প্রচুর লেখক আছেন যারা প্রকাশকের কাছ থেকে প্রাপ্য টাকা আদায় করতে পারছেন না। দেশে বই-এর কোনো ভালো বিপনন ব্যবস্থা নেই, নেই কোনো উল্লেখ করার মতো সাহিত্যের কাগজ। বেতার ও টিভিতে লেখকদের নিয়মিত অংশগ্রহনের কোনো ব্যবস্থা নেই, নেই জাতীয় গ্রন্থনীতি, সারাদেশে লেখকদের বসার মতো একটা ৮x৮ ঘরও নেই। আর এইসব কাজ কখনোই ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্ভব নয়। তার জন্যে মিলিত সাংগঠনিক প্রচেষ্টা দরকার। একজন লেখক যাতে তার পুরোটা সময় লেখার জন্যে দিতে পারে, লেখক হিসেবে সামাজিক মর্যাদাসহ বেঁচে থাকতে পারে— কবিতা পরিষদ এখন এসব জরুরি বিষয় নিয়ে কাজ করবে। কিন্তু সেদিন বিষয়টি কারো মাথাতেই ঢুকাতে পারিনি। নির্বাহী পরিষদ, কবিতা পরিষদ থাকবে কি থাকবে না, এই নিয়ে এতোটাই মত্ত হয়ে পড়েছিলো, এতোটাই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো যে, কোনোভাবেই তারা বাস্তব অবস্থাটা বুঝতে পারছিলো না।

যাহোক— শেষমেশ ১১-৯ ভোটে ‘পরিষদ থাকবে’—পক্ষ জিতে গেলো। ভোটদানে বিরত থাকলেন কয়েকজন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। কাউন্সিল চলাকালে সভাপতি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এমনিতেই তিনি অসুস্থ ছিলেন। তার ওপর সেই দুপুর থেকে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত বোসে থেকে নানা স্কেলের চিৎকার শোনা দুঃসহই বটে- ‘তিনি ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হন’।

কিন্তু তার পিছু পিছু কি কারনে নির্বাহী পরিষদের অধিকাংশ সদস্য বেরিয়ে গিয়েছিলেন? সারাদেশ থেকে আগত পরিষদের কাউন্সিলারদের বসিয়ে রেখে, কোনোরকম বক্তব্য ছাড়া, ঘোষনা ছাড়া কিভাবে নির্বাহী পরিষদের সদস্যরা বেরিয়ে গেলেন? কমপক্ষে ৪ জন সভাপতিমন্ডলীর সদস্য উপস্থিত ছিলেন, অসুস্থ সভাপতিকে বাসায় পাঠিয়ে কেন অন্য একজন সভাপতিত্ব করলেন না? কাউন্সিল চালিয়ে গেলেন না? আছে, কোনো জবাব আছে এর?

আজ সৈয়দ হক বলছেন, “জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রয়োজন এখন আর নেই।’ কিন্তু নির্বাহী পরিষদে এই পক্ষ ১১-৯ ভোটে পরাজিত হয়েছিলো। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যে কবিতা পরিষদ স্মরনীয় ভূমিকা রেখেছিলো, স্বৈরাচারমুক্ত দেশে নিজেই সেই পরিষদ গনতন্ত্রের প্রতি, অধিকাংশের মতের প্রতি মনোরম বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করলো।

অসুস্থ সভাপতির সঙ্গে নির্বাহী পরিষদের অধিকাংশ সদস্য বেরিয়ে যাবার পর বিমূঢ়, বিস্মিত ও বিক্ষুব্ধ কাউন্সিল এক নতুন সংকটে পতিত হলো। ভাগ্যিস সে মুহূর্তে অগ্রজ আবু বকর সিদ্দিক, আসাদ চৌধুরী, সমুদ্র গুপ্ত এবং আমরা দু’একজন তরুন অভাবিত এই পরিস্থিতিতে কাউন্সিলারদের শান্ত করতে সমর্থ হই। তাদের বলা হয় যে, ৩রা মে ‘৯১ তারিখ বিশেষ কাউন্সিল ডেকে গঠনতন্ত্র অনুমোদন এবং নতুন কমিটি গঠন করা হবে। পাঁচ বছরের মধ্যে গঠনতন্ত্র অনুমোদিত হয়নি, ব্যাপারটা বিস্ময়কর নয়! যাহোক, অপেক্ষায় থাকলাম— কিন্তু সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকের সাথে কয়েকবার আলাপের পর নিশ্চিত হলাম যে, তারা নির্বাহী পরিষদের সভা ডাকবেন না। অথচ ৩রা মে যদি বিশেষ কাউন্সিল ডাকতে হয় তাহলে প্রস্তুতির জন্যে আগেই নির্বাহী পরিষদের সভা করা দরকার, গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করা দরকার। আমি তলবি সভার জন্যে নির্বাহী পরিষদের সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করলাম। ৪৩ জনের মধ্যে ১৬ জন স্বাক্ষর করলেন। সবার সাথে যোগাযোগ করাও সম্ভব হলো না স্বল্প সময়ের জন্যে। অনেকে দেশের এবং ঢাকার বাইরে ছিলেন। ২৯ এপ্রিল তলবি সভায় উপস্থিত হলেন জন মাত্র। ফোরাম হলো না। এ পর্যায়ে কাউন্সিলারদের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি আমরা রক্ষা করতে ব্যর্থ হলাম। ‘কবিতা পরিষদ প্রয়োজন নেই’— এর পক্ষে সৈয়দ হক যে ক’জনের নাম উল্লেখ করেছেন তারা কিন্তু কেউই কবিতা পরিষদ গঠন করেননি।

এরশাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে যে স্বৈরাচারের পতন ঘটেনি তা তো আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। হয়তো আরো দেখতে হবে। স্বৈরাচারের সমস্ত যন্তর-মন্তর এখনো বহাল তবিয়তেই বিরাজ করছে। সংগঠিত থাকার কারনে কবিরা যেটুকু সামাজিক মর্যাদা এবং গুরুত্ব অর্জন করেছিলেন, ইতিমধ্যেই তাতে কালিমা লেগেছে। আর ইতিহাসের বিচার? সে ইতিহাসই সময় মতো করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *