গ্রন্থভূক্ত কবিতা (কাব্যগ্রন্থ)
গান
অগ্রন্থিত কবিতা
গল্প
চলচ্চিত্র কাহিনী ও চিত্রনাট্য
সম্পাদকীয়, গদ্য ও বক্তৃতা
সাক্ষাৎকার
1 of 2

নব্য জসীমিজম ও বহমান লোককাব্যধারা

‘নব্য জসীমিজম’ ও বহমান লোককাব্যধারা

১. জসীমিজম কী?

কবিতাপত্র ‘একবিংশ’ মে ১৯৮৭ তৃতীয় সংখ্যায় রাশেদ মিনহাজের ‘কবিতায় নব্য জসীমিজম’ লেখাটি পড়ে একই সাথে ভালো লাগা এবং বিরক্ত এই দুটি বোধে আক্রান্ত হয়েছি। ভালো লাগার কারন, আলেকজান্ডার উচ্চারিত ‘সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!’-এর সাহিত্য বিষয়ে বরাবরই পিঠ চুলকানো কিংবা পিঠ খামচানোর রেওয়াজটি চলে আসছে। কোনো ভালো লেখা প্রসঙ্গেও কেউ মুক্ত মনে লেখেন না, আবার মন্দ লেখার ব্যাপারে কারো তেমন নিন্দার গরজও লক্ষ্য করা যায় না। এরকম একটি বিটকেলে পরিবেশে মিনহাজের লেখাটি আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। আনন্দিত হয়েছি। কারন কবিতায় নোতুন যে কাজটি আমি করেছি বলে দাবি করছি ( অবশ্য তার বিচার করবে সময়— মহাকাল) সে ব্যাপারে একজন তরুনের অত্যন্ত সুচিন্তিত এবং অংশত আবেগ-বর্জিত মতামত লেখাটিতে উপস্থাপিত হয়েছে।

এবার বিরক্তির ব্যাপারটির বিষয়ে বলা যাক— রাশেদ মিনহাজের লেখাটির শিরোনাম ‘নব্য জসীমিজম’। কিন্তু আপত্তির বিষয়টি হলো ‘জসীমিজম’ বস্তুটি যে কী তা তাঁর সমগ্র লেখার কোথাও পষ্ট কোরে উল্লেখ করা হয়নি। কাব্যিক সরলতা কিংবা অজটিল অনুভূতির প্রকাশকেই অথবা গ্রামীন জীবনের অকপট রূপায়নকেই যদি জসীমিজম নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে তবে রবীন্দ্রনাথ সত্যেনদত্ত মোহিতলাল এমন কি নজরুল বা জীবনানন্দ দাশের প্রচুর কবিতা থেকে এর অঢেল উদাহরন দেয়া যাবে। এবং এ জাতীয় কবিতা ও কবির তালিকা আরো বাড়ানো যাবে। গবেষনামূলক মনোভঙ্গি নিয়ে লিখছি না বোলে উদাহরন দিয়ে লেখাটিকে কন্টকিত করতে চাচ্ছি না। কিন্তু পরবর্তীতে যদি রচয়িতা দাবি করেন কখন বাধ্য হয়েই সমারূঢ় অধ্যাপকের মতো উদাহরনগুলো উল্লেখ করতে হবে।

২. আধুনিকতা কি আপেক্ষিক নয়?

মিনহাজ তাঁর প্রথম বাক্যটি এইভাবে শুরু করেছেন—’আধুনিক কবিতার আলোচনায় জসীমউদদীন একজন বহির্বাসী, একটি অপাঙক্তেয় ও সযত্নে পরিহার্য নাম। এই মতটির ব্যাপারে আমার প্রচন্ড আপত্তি আছে।

আধুনিকতার নামে তিরিশের কবিরা যেভাবে স্বদেশ, স্ব-ঐতিহ্য ও স্বভাষা এবং স্বসমাজের শিকড় থেকে কষ্টকল্পিত আহ্লাদে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছেন এবং একই সাথে বিচ্ছিন্ন করেছেন বাংলা কবিতাকে, তার অপরিমেয় জের হিশেবে অর্ধ-বিকশিত অপুষ্ট শরীর নিয়ে আজ অব্দি কালাতিপাত করতে হচ্ছে আমাদের কবিতাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে পশ্চিমে মূল্যবোধের যে অবক্ষয় এবং যা থেকে সৃষ্ট তথাকথিত আধুনিকতার ঠুলি আঁটা অন্ধ অনুকরন কোরে তিরিশের কবিরা রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকারের চেষ্টা পেয়েছিলেন, তা এক কথায় ‘হনুমানের লাফ’ ছাড়া কিছুই নয়।

এই কবিদের না ছিলো চলমান সমাজ জীবনের সাথে সম্পৃক্তি, না ছিলো আধুনিক মার্কসীয় মননের চর্চা (কতিপয় ব্যতিক্রম ছাড়া)। আধুনিকতার নামে তারা এক অন্ধ বিবরে আবর্তিত হয়েছেন আর তাছাড়া আধুনিকতার ধারনা তো সেই আদ্যিকাল থেকেই আপেক্ষিকতার মোহনীয় অভিধায় নিজেকে উপস্থাপিত রেখেছে।

রবীন্দ্র-উত্তর তিরিশের অনুকরনপ্রীতির ডামাডোলে জসীমউদদীনের কাব্যসারল্য এবং জনজীবনের ছলনাহীন উপস্থাপনাই আমার দৃষ্টিতে আধুনিকতার দিকে প্রকৃত যাত্রা মনে হয়েছে। কিন্তু জসীমউদদীনের কাব্য বা কাহিনীকাব্যের পাত্র-পাত্রী সমকালীন রাজনীতি ও জীবন থেকে দূরবর্তী অতীতের বাসিন্দা। আধুনিকতা চিরকালই আপেক্ষিক। এক সময়ে আধুনিক মাইকেল বা রবীন্দ্রনাথকেও আমরা অনাধুনিকতার আক্রমনে আক্রান্ত হতে দেখেছি— দেখছি।

৩. বাংলার জনজীবন বাংলা কাব্যে অবহেলিত

মিনহাজ এক স্থানে বলেছেন ‘বৃহত্তর জনগোষ্ঠী গ্রামবাসী বলে এবং তাদের দারিদ্র- পীড়িত এবং শোষিত জীবনধারাই বাংলাদেশের প্রায় একক প্রাণস্রোত বলে গ্রামীণ জীবনের রূপায়ণ অবশ্যই কবিতার একটি মহৎ অভিপ্রায় হতে পারে এবং হওয়াই যুক্তিসঙ্গত, অভিপ্রেত’। দুঃখের বিষয়, তা হয় নি।

আরো দুঃখের বিষয় মিনহাজ নিজেই তাঁর উপরোক্ত মতের সাথে তাঁর রচনার বিভিন্ন স্থানে বিরোধিতা করেছেন।

বাংলার কবিতায় প্রধান জনগোষ্ঠীর জীবন অনুপস্থিতি থাকার প্রধান কারন হলো তিরিশের কবিদের কচ্ছপ ভূমিকা। আধুনিকতার নামে তাঁরা জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। কাব্যরুচির দোহাই দিয়ে তাঁরা অধিকাংশ মানুষের জীবনকে অস্বীকার করেছেন, পলায়ন করেছেন উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে। মিনহাজের উপরোক্ত মতের সাথে আমি একমত। আরো বেশি কোরে বল্লে মিনহাজ যা বলেছেন তারই প্রতিধ্বনি করতে হয় ‘কবিতা শিয়ামিজ বেড়ালের মতো নাগরিক এ্যভিনু এবং ড্রয়িংরুমে হেঁটেছে। বহুলাংশে আরোপিত কষ্টকল্পিত ও কল্পিত কষ্টের ধ্বনিপুঞ্জ ধারণ করেছে শরীরে। শ্রমজীবী এবং সংগ্রামী মানুষের যন্ত্রণার অভিক্ষেপও এসেছে কবিতায় তবে তা বহুলাংশে শাহরিক সভ্যতা উৎক্ষিপ্ত।

আল মাহমুদের কবিতায় (সোনালী কাবিন) প্রথম ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায় লোকজ শব্দের ব্যবহার। এর আগে আহসান হাবীব এবং সৈয়দ আলী আহসান ছাড়াও আরো অনেকে লোকজ শব্দের ব্যবহার করেছেন তাঁদের কবিতায়। তবে তা কখনোই ব্যাপকভাবে নয়।

লক্ষনীয়, মাহমুদ তাঁর লোকজীবন ও লোকজ শব্দগুলোর মূলে পটভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছেন নরনারীর দৈহিক কামজ বাসনা এবং কদাচিৎ সাম্যবাদের অবৈজ্ঞানিক আবেগতাড়িত অনুভব। অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর সংগ্রামী এবং দারিদ্রপীড়িত জীবনের স্বপ্ন বা স্বপ্নভঙ্গের বেদনা কিংবা ক্ষোভ ও ক্রোধ তাঁর কাব্যশরীরের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সৈয়দ শামসুল হক আবার এক কাঠি সরেস। তিনি একেবারেই আঞ্চলিক প্রেমের কবিতা নাম দিয়েই তাঁর কাব্যখানা (পরানের গহীন ভিতর) রচনা করেছেন। তাঁর কবিতার পাত্রপাত্রীরা মস্তিষ্কের অব্যাখ্যাত কার্যকলাপ যা হৃদয় নামে পরিচিত তাই নিয়েই আবিষ্ট, পীড়িত অথবা তাড়িত। সমাজজীবনের কোনো আলোড়ন বা আন্দোলন সেখানে অনুপস্থিত। যেন তার নায়ক-নায়িকারা দূরতম কোনো গ্রহ থেকে এই লোকবাংলায় এসে কবিকে ধন্য করেছেন।

৪. অনুপ্রেরনার ধারনাটি ভুল

মিনহাজ লিখেছেন, ‘আল মাহমুদ যে পথ অনুসরণ করেছিলেন রুদ্র তারই অনুসারী’। উক্তিটি সম্পূর্ন সত্য নয়। লোকজ শব্দ ব্যবহার কোরে আঞ্চলিক ক্রিয়াপদ বর্জনের যে- পথ মাহমুদ বেছে নিয়েছিলেন আমার প্রচেষ্টাও তাই ছিল। কিন্তু মাহমুদের কাব্যপ্রচেষ্টার ভেতর নাগরিক লালিত্য ও আভিজাত্য ফুটিয়ে তোলার যে কৃত্রিম প্রবনতা লক্ষ্য করা গেছে, আমি অত্যন্ত সচেতনভাবে তা পরিহার করার চেষ্টা করেছি। হয়তো সর্বত্র সফল হতে পারি নি।

আর একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই যে, ‘মানুষের মানচিত্রে’র চরিত্রগুলো সবাই নিগৃহীত, নির্যাতিত জীবনের এক-একটি প্রতীক। সোনালী কাবিন বা পরানের গহীন ভিতর-এ প্রধানত যা দেহজ কামনার অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ।

এ-কথাটি ঠিক যে অবিকল আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লিখতে শুরু করলে এক ব্যাপক সাহিত্যিক অরাজকতার সৃষ্টি হবে। পাঠক একটু ভাবলেই ব্যাপারটির গুরুত্ব বুঝতে পারবেন। সে কারনেই সৈয়দ হকের গ্রন্থে আঞ্চলিক ক্রিয়াপদ ব্যবহারের বিপক্ষে আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলাম। দু’একটি অত্যন্ত পরিচিত আঞ্চলিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার এক কথা আর অবিকল যাবতীয় আঞ্চলিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার নিসন্দেহ মারাত্মক বোলে আমার মনে হয়েছে।

মিনহাজ একটি ভুল তথ্য পরিবেশন করেছেন— ‘কাল পরস্পরার বিচারে মনে হয় মানুষের মানচিত্রের প্রাথমিক অনুপ্রেরণা ও প্রাণস্পন্দন প্রথমোক্ত গ্রন্থ (পরানের গহীন ভিতর) থেকেই আহৃত।’ নবী মুনশির কবিতা নামে সাপ্তাহিক সন্ধানী পত্রিকায় যখন সৈয়দ হকের এই গ্রন্থভুক্ত একগুচ্ছ সনেট ছাপা হয় তার প্রায় কয়েক বছর আগে থেকেই আমি এ-প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এ ব্যাপারে আমার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’ দ্রষ্টব্য। এবং তৃতীয় গ্রন্থে ‘মানুষের মানচিত্রে’র প্রত্যেকটি কবিতার নিচে দেয়া রচনার তারিখ মিনহাজ পরানের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন।

৫. আবহমান লোকধারা

মিনহাজের একটি ধারনা এবং একটি শব্দের ব্যবহার অত্যন্ত আপত্তিকর এবং অমার্জনীয়— তা হলো ‘জসীমিজম’। প্রকৃত অর্থে জসীমউদদীনের কবিতার যে সরলতা এবং নিষ্পাপ সৌরভ তা হাজার বছরের বাংলা লোককাব্যধারই খন্ডিত রূপ। শত শত লোককবির মৌখিক রচনায় কখনো বা লিখিত রচনায় এই ধারার যে বেগবান স্রোতটি বাংলার জনজীবনের অন্তরে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, জসীমউদদীন তার সামান্য কনামা তথাকথিত সাহিত্য-এলাকায় প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। এর মহাসমুদ্রটি আজো অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর অন্তর-জীবনে প্রবহমান। কাজেই ‘জসীমিজম’ বোলে এই মহান গৌরবের বিষয়টি হেয় করা আশা করি রাশেদ মিনহাজের মতো তরুন লেখকের পক্ষে অনুচিত হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *