ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম – রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
উৎসর্গ
বিশ্বাসের তাঁতে আজ আবার বুনতে চাই
জীবনের দগ্ধ মসলিন
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ ॥ প্রকাশক : দ্রাবিড় প্রকাশনী, ঢাকা
হাড়েরও ঘরখানি
১.
মানুষের প্রিয় প্রিয় মানুষের প্রাণে
মানুষের হাড়ে রক্তে বানানো ঘর
এই ঘর আজো আগুনে পোড়ে না কেন?
ঘুনপোকা কাটে সে-ঘরের মূল-খুঁটি
আনাচে কানাচে পরগাছা ওঠে। বেড়ে,
সদর মহলে ডাকাত পড়েছে ভর দুপুরের বেলা
প্রহরীরা কই? কোথায় পাহারাদার?
ছেনাল সময় উরুত দ্যাখায়ে নাচে
নপুংশকেরা খুশিতে আত্মহারা।
বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
রাজনীতিকের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের পাপ
বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ
বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
জাতির তরুন রক্তে পুষেছে নিবীর্যের সাপ—
উদোম জীবন উল্টে রয়েছে মাঠে কাছিমের মতো।
২.
কোনো কথা নেই–কেউ বলে না, কোনো কথা নেই— কেউ চলে না,
কোনো কথা নেই–কেউ টলে না, কোনো কথা নেই–কেউ জুলে না—
কেউ বলে না, কেউ চলে না, কেউ টলে না, কেউ জ্বলে না।
যেন অন্ধ, চোখ বন্ধ, যেন খঞ্জ, হাত বান্ধা,
ভালোবাসাহীন, বুক ঘৃনাহীন, ভয়াহব ঋন
ঘাড়ে চাপানো— শুধু হাঁপানো, শুধু ফাঁপানো কথা কপচায়—
জলে হাতড়ায়, শোকে কাতরায় অতিমাত্রায় তবু জুলে না।
লোহু ঝরাবে, সব হারাবে— জাল ছিঁড়বে না ষড়যন্ত্রের?
বুক ফাটাবে, ক্ষত টাটাবে–জাল ছিঁড়বে না ষড়যন্ত্রের?
৩.
আমি টের পাই, মাঝ রাত্তিরে আমাকে জাগায় স্মৃতি—
নিরপরাধ শিশুটির মুখ আমাকে জাগায়ে রাখে
নিরপরাধ বৃদ্ধটি তার রেখাহীন করতল
আমাকে জাগায়ে রাখে।
মনে পড়ে বট? রাজপথ, পিচ? মনে পড়ে ইতিহাস?
যেন সাগরের উতলানো জল নেমেছে পিচের পথে
নুষের ঢেউ আছড়ে পড়েছে ভাঙা জীবনের কুলে?
মনে কি পড়ে না, মনে কি পড়ে না, মনে কি পড়ে না কারো?
কী বিশাল সেই তাজা তরুনের মুষ্টিবদ্ধ হাত
যেন ছিঁড়ে নেবে গ্লোব থেকে তার নিজস্ব ভূমিটুকু!
মনে কি পড়ে না ঘন বটমূল, রমনার উদ্যান
একটি কণ্ঠে বেজে উঠেছিলো জাতির কণ্ঠস্বর?
শত বছরের কারাগার থেকে শত পরাধীন ভাষা
একটি প্রতীক কণ্ঠে সেদিন বেজেছিলো স্বাধীনতা।
হাতিয়ারহীন, প্রস্তুতি নেই, এলো যুদ্ধের ডাক,
এলো মৃত্যুর, এলো ধংশের রক্ত মাখানো চিঠি।
গ্রাম থেকে গ্রামে, মাঠ থেকে মাঠে, গঞ্জের সুবাতাসে
সে-চিঠি ছড়ায় রক্ত-খবর, সে-চিঠি ঝরায় খুন,
স্বজনের হাড়ে করোটিতে জুলে সে-চিঠির সে-আগুন।
৪.
ভরা হাট ভেঙে গেল।
মাই থেকে শিশু তুলে নিলো মুখ সহসা সন্দিহান,
থেমে গেল দূরে রাখালের বাঁশি, পাখিরা থামালো গান,
শ্মশান নগরী, খাঁ-খাঁ রাজপথে কাকেরা ভুললো ডাক।
প’ড়ে রলো পাছে সাত পুরুষের শত স্মৃতিময় ভিটে,
প’ড়ে রলো ঘর, স্বজনের লাশ, উনুনে ভাতের হাঁড়ি,
ভেঙে পড়ে রলো জীবনের মানে জ্বলন্ত জনপদে—
নাড়ি-ছেঁড়া উন্মুল মানুষের সন্ত্রাসে কাঁপা স্রোত
জীবনের টানে পার হয়ে গেল মানচিত্রের সীমা।
৫.
মনে কি পড়ে না, মনে কি পড়ে না, মনে কি পড়ে না তবু?
গোরামের সেই শান্ত ছেলেটি কী রোষে পড়েছে ফেটে
বন্ধুর লাশ কাঁধে নিয়ে ফেরা সেই বিভীষিকা রাত
সেই ধর্ষিতা বোনের দেহটি শকুনে খেয়েছে ছিঁড়ে—
মনে কি পড়ে না হাতে গ্রেনেডের লুকোনো বিস্ফোরন?
তারও চেয়ে বেশি বিস্ফোরনের জ্বালা জুলন্ত বুকে
গর্জে উঠেছে শত গ্রেনেডের শত শব্দের মতো।
গোরামের পর গেরাম উজাড় উঠোনে উঠেছে ঘাস,
হাইতনের পরে ম’রে পড়ে আছে পালিত বিড়াল ছানা,
কেউ নেই, শুধু তেমাথায় একা ব্যথিত কুকুর কাঁদে।
আর রাত্রির কালো মাটি খুঁড়ে আলোর গেরিলা আসে–
৬.
ঝোপে জঙ্গলে আসে দঙ্গলে আসে গেরিলার দল,
হাতিয়ার হাতে চমকায়। হাতে ঝলসায়
রোষ প্ৰতিশোধ। শোধ রক্তের নেবে, তখতের
নেবে অধিকার। নামে ঝনঝায়–যদি জান যায়
যাক, ক্ষতি নেই; ওঠে গর্জন, করে অর্জন মহা ক্ষমতার,
দিন আসবেই, দিন আসবেই, দিন সমতার।
৭.
দিন তো এলো না!
পৃথিবীর মানচিত্রের থেকে ছিঁড়ে নেয়া সেই ভূমি
দুর্ভিক্ষের খরায় সেখানে মন্বন্তর এলো।
হত্যায় আর সন্ত্রাসে আর দুঃশাসনের ঝড়ে
উবে গেল সাধ বেওয়ারিশ লাশে শাদা কাফনের ভিড়ে,
তীরের তরীকে ড়ুবালো নাবিক অচেতন ইচ্ছায়।
৮.
আবার নামলো ঢল মানুষের
আবার ডাকলো বান মানুষের
আবার উঠলো ঝড় মানুষের
৯.
গ্রাম থেকে উঠে এলো ক্ষেতের মানুষ
খরায় চামড়া-পোড়া মাটির নাহান,
গতরে ক্ষুধার চিন্ মলিন বেবাক,
শিকড় শুদ্ধ গ্রাম উঠে এলো পথে।
অভাবের ঝড়ে-ভাঙা মানুষের গাছ
আছড়ে পড়লো এসে পিচের শহরে।
সোনার যৈবন ছিলো নিওল শরীরে
নওল ভাতার ঘরে হাউসের ঘর,
আহারে নিঠুর বিধি কেড়ে নিলো সব—
সোনার শরীরে বেচে সোনার দোসর।
দারুন উজানি মাঝি বাঘের পাঞ্জা
চওড়া সিনায় যেন ঠ্যাকাবে তুফান।
আঁধার গতর জেলে, দরিয়ার পুত
বুকের মধ্যে শোনে গাঙের উথাল।
তাদের অচেনা লাশ চিনলো না কেউ
ঝাঁক ঝাঁক মাছি শুধু জানালো খবর।
বেওয়ারিশ কাকে বলো, কার পরিচয়?
বাংলার আকাশ চেনে, চেনে ওই জল
আমার সাকিন জানে নিশুতির তারা
চরের পাখিরা জানে পাড়-ভাঙা নদী
আমি এই খুনমাখা মাটির ওয়ারিশ।
১০.
স্বপ্ন হারানো মানুষের ঢল রাজপথে আসে নেমে
স্বজন হারানো মানুষের ঢল রাজপথে আসে নেমে
ক্ষুধায় কাতর মানুষের ঢল রাজপথে আসে নেমে
পোড়ায় নগরী, ভাঙে ইমারত, মুখোশের মুখ ছেড়ে ছিঁড়ে
নিতে চায় পরাধীন আলো প্রচন্ড আক্ৰোশে।
১১.
আমি কি চেয়ে এতো রক্তের দামে
এতো কষ্টের, এতো মৃত্যুর, এতো জখমের দামে
বিভ্ৰান্তির অপচয়ে ভরা এই ভাঙা ঘরখানি?
আমি কি চেয়েছি কুমির তাড়ায়ে বাঘের কবলে যেতে?
আর কতো চাস? আর কতো দেবো কতো রক্তের বলী?
প্রতিটি ইঞ্চি মাটিতে কি তোর লাগেনি লোহুর তাপ?
এখনো কি তোর পরান ভেজেনি নোনা রক্তের জলে?
ঝড়ে বন্যায় অনাহার। আর ক্ষুধা মন্বন্তরে
পুষ্টিহীনতা, জুলুমে জখমে দিয়েছি তো কোটি প্রান—
তবুও আসে না মমতার দিন, সমতা আসে না আজো।
১২.
হাজার সিরাজ মরে
হাজার মুজিব মরে
হাজার তাহের মরে
বেঁচে থাকে চাটুকার, পা-চাটা কুকুর,
বেঁচে থাকে ঘুনপোকা, বেঁচে থাকে সাপ।
১৩.
খুনের দোহাই লাগে, দোহাই ধানের
দোহাই মেঘের আর বৃষ্টি জলের
দোহাই, গর্ভবতী নারীর দোহাই
এ-মাটিতে মৃত্যুর অপচয় থামা।
আসুক সরল আলো, আসুক জীবন
চারিদিকে শত ফুল ফুটুক এবার।
১৪.
জাতির রক্তে ফের অনাবিল মমতা আসুক
জাতির রক্তে ফের সুকঠোর সততা আসুক
আসুক জাতির প্রানে সমতার সঠিক বাসনা।।
১৭ জোষ্টি ১৩৮৭ মিঠেখালি মোংলা
পৌরানিক চাষা
পতিত জমিনে যদি কোনোদিন দ্যাখা হয়
ওলো নারী, তখন বলিস ডেকে : আটকুড়ে, শিথিল মরদ—
আমি সব মাথা পেতে নেবো।
চাষের চৌষট্টি কলা শিখেছে শরীর।
আমি সেই পৌরানিক কিষান-আদম
গন্দমের আছে অভিজ্ঞতা,
আছে জানা খরা-জল, অনাবৃষ্টি, মেঘের গতিক—
ভয় নেই ওলো নারী, চাষাবাদ আমিও শিখেছি।
আমিও শিখেছি নারী লাঙলের জটিল নিয়ম,
মানুষের কতোটুকু মাটি আর কতোটা জলীয়
কতোটুকু পশু থাকে একজন রমনীর দেহে—
বৈশাখের রাতে কেন সোমত্ত শরীর জুড়ে
শ্রাবনের বেনোজল ডাকে।
ওলো নারী, সহজে খুলি না তনু, খুলি না জবান।
নিশিথে নিশির ডাক শুনে যদি শিথিল হয়েছে শাড়ি
তবে আর দ্বিধা কেন?
কাঁকরের রাঙা মাটি অপরূপ শয্যা হবে
চন্দনের ঘ্রান হবে শরীরের উষ্ণতম ঘাম-
ওলো নারী ভয় নেই, চাষের চৌষট্টি কলা আমিও শিখেছি,
আমিও শিখেছি নারী আবাদের মাতৃভাষা সঠিক শৃঙ্গার ॥
২৮ বৈশাখ ১৩৮৫ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা
কাচের গেলাশে উপচানো মদ
বদলে যাচ্ছে এই গ্রামখানি. নদীটির তীর
কপালের নিচে সরল চক্ষু বদলে যাচ্ছে।
কিশোরীর ঝাঁক দল বেঁধে আর খেলতে আসে না।
হাতের ভেতরে মমতার হাত, স্বাতির পৃথিবী
বদলে যাচ্ছে— বদলে যাচ্ছে— বদলে যাচ্ছে।
ঘড়িতে এখন মধ্যরাত্রি
স্নায়ুতে আমার না-পাওয়া সুখের ব্যথিত অনল
তুমিও ক্রমশ বদলে যাচ্ছো— বদলে যাচ্ছো।
আমার দুপাশে ভাঙছে পৃথিবী
পদ্মার চর, রাজনীতি আর রম্য গনিকা।
সব বনভূমি হচ্ছে এখানে সভ্য নগরী
গ্রাম থেকে আসা মানুষের ঢেউ ভাঙছে মড়কে।
বদলে যাচ্ছে. পৃথিবী আমার বদলে যাচ্ছে,
বধির একটা বুনো মহিষের ক্ষুধার মতোন
আমার ভেতরে নিসঙ্গতাই বেড়ে ওঠে শুধু।
সুস্থতা চাও, সুস্থতা চাও আমি তো পারি না,
কাচের গেলাশে উপচানো মদ আমার রক্ত
পান কোরে আমি ধুয়ে দিতে চাই রুগ্নতাগুলো,
ব্যর্থ পৃথিবী মুছে দিতে চাই— আমি তো পারি না।
কষ্ট আমার স্নায়ুর ভেতরে, চোখের সকেটে,
কষ্ট আমার হাড়ের ভেতরে জ্বলে চন্দন
নিভৃতি চাও, নিভৃতি চাও— আমি তো পারি না।
কাচের গেলাশে উপচানো মদ তোমাদের প্রেম
পান কোরে আমি ধুয়ে দিতে চাই কষ্ট আমার।
আমার দুদিক চতুর্পার্শ্ব বদলে যাচ্ছে,
সোনার হরিন আমি তো খুঁজি না শ্রীমতি জীবন
আমি তো ডাকি না ব্যাকুল দুহাতে খ্যাতির শিখর।
শুধু আমি এই কষ্ট আমার মুছে নিতে চাই,
নগরের রুখো গ্রাস থেকে সেই গ্রামখানি মোর
দুধভাত, মিঠে, রূপশালি ধান সেই গ্রামখানি
কেড়ে নিতে চাই, কেড়ে নিতে চাই, কেড়ে নিতে চাই।
কাচের গেলাশে উপচানো মদ হারানো সে-প্রেম
পান কোরে আমি ধুয়ে দিতে চাই কষ্ট আমার।
আমার গ্রামের নদীটির মতো তোমার দুচোখে
কেন বালুচর জেগে ওঠে স্বাতি, কেন শূন্যতা?
সুস্থতা চাও— কোথায় স্বস্তি, কোথায় সলিল?
এইটুকু মদ গরল পানীয় পারে কি ভেজাতে
পৃথিবীর চেয়ে আরো বড়ো এক পোড়া মরুভূমি?
বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে—
রূপশালি ধান গ্রামটিরে আমি বাঁচাতে পারি না,
আঙুলের ফাঁক গ’লে নেমে যায় বাসনার জল
রাখতে পারি না করপুটে প্রিয় স্বপ্ন আমার।
কষ্ট আমার বুকের পাঁজরে, রোমকূপে, নোখে
কষ্ট আমার নিদ্রাবিহীন চোখের তারায়।
ব্যর্থতা আমি মুছে দিতে চাই, মুছে দিতে চাই,
কাচের গেলাশে উপচানো মদ ব্যথিত জীবন
পান কোরে আমি ধুয়ে দিতে চাই কষ্ট আমার।।
২৩ ফাল্গুন ১৩৮৪ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা
হারাই হরিনপুর
যে পায় সে পেয়ে যায়— সকলে পায় না।
কাকে বলো? অভিমান, কার সাথে তবে?
অমনই হবে. হয়. ভেঙে তছনছ
পুড়ে পুড়ে খাক হও বিষণ্ন অঙ্গার
কিছুই পাবে না তবু–
যে পায় সে পেয়ে যায়— বাকিরা হারায়।
কে যায় হরিনপুর? কতোজন? কারা?
একজন হাসে শুধু দখিনার হাসি,
ভালোবাসি— বোলে তারে যেখানে জড়াই
সে তো শুধু মাংশ, হাড়. হিয়ার উপমা-
তাকে কি হৃদয় বলে? বক্ষস্থিত প্রান?
কে তারে পেয়েছে কবে, কতোজন, কারা?
যে পায় সে পেয়ে যাবে— আমার হবে না,
রবে না জলের চিহ্ন রোদের কপালে।
আমি শুধু চাষ হবো, হবো না ফসল?
বনভূমি কেটে শুধু নগর বানাবো?
কে গেল হরিনপুর, কতোটা বয়স
কতোটা অঘ্রান তার হৃদয়ের আয়ু
হয় নাই জানা—
দেখি তার দেহখানা বেড়ে ওঠে রোদে,
আঁধার কেটেছে যারা শীতার্ত অঘনে
তারা থাকে স্বপ্নহীন অমার খাঁচায়।
যে পায় সে পেয়ে যায়— সকলে পায় না তারে ॥
২৪ জোষ্টি ১৩৮৬ মিঠেখালি মোংলা
অকর্ষিত হিয়া
প্রস্তুত ছিলো প্রেম, তুমি শুধু হাত তুলে ডেকেছো তারে—
যজ্ঞের জোগাড় শেষে তুমি শুভ্র এলে পুরোহিত,
চুম্বন সাজানো ছিলো, তুমি এসে ছোঁয়ালে অধর
অধরের ‘পরে।
সমস্ত পরান জুড়ে যে-অঘ্রান ফলভারে নত
তুমি তার ঘ্রান পেয়ে এলে যেন শ্যামল কিষান,
এলে মাটির মরমে রেখে মনোরম মৌন ক্ষত।
তৃষ্ণার তিমিরে জেগে ভালোবাসা বুনেছি একাকি,
আজ তার ভাঙা ম্লান দিনগুলো মুছে যায় দ্রুত
নীড়ের নিবিড় কোলে ফিরে আসে স্বপ্নময় পাখি।
লাবন্য-লতার মতো চোখে নামে সবুজাভ স্নেহ,
কিসের আড়ালে ছিলো এতোদিন এই ব্যথা-সুখ
এই মুগ্ধ মৌন বোধ, ভালোবাসা. অনাবাদি দেহ?
কিসের আড়ালে ছিলো,
কিসের আড়ালে ছিলো এই তনু, অকর্ষিত হিয়া!
আঁধারে প্রস্তুত ছিলো অপরূপ স্নিগ্ধ অন্ধ প্ৰেম
শ্যামল কিষান তুমি খুলে দিলে দেহের শিকল,
হৃদয়ের রাত ছিঁড়ে এলো রোদ. ভালোবাসা. মুগ্ধ বোধ
ফসলের হেম!
১৬ শ্রাবন ১৩৮৫ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা
পরিচয়
এতো যে ভাঙন. ধংশ. রক্ত—
মনে আমার বয়স হয় না।
এতো যে হাওয়ায় ওড়ায় স্মৃতি
এতো যে নদী ভাঙছে দুকূল
মনে আমার বয়স হয় না।
বাইরে এবং বুকের মধ্যে
হিয়ার ভেতর— হিয়ার মধ্যে
হারানো এক হলদে পাখি উড়ছে বসছে
দুলছে, যেন শৈশবে সেই দোলনা খেলা—
হায়রে আমার বয়স হয় না!
বন্ধুরা সব বিত্তে বাড়ে, চিত্তে বাড়ে
বাড়ে শনৈ গৃহস্থালি,
আমার তবু বয়স হয় না, বুদ্ধি হয় না।
একটি নোতুন ভাষার খোঁজে
একটি ভালোবাসার খোঁজে
যায় কেটে দিন….
নোখে এবং দাঁতে সবাই শান দিয়ে নেয়,
আমি আমার নিরীহ নোখ ছাঁটছি কেবল
সবুজ মাজন কিনছি আমার দাঁতের জন্যে।
হায়রে আমার বয়স হয় না, সংসারী-মন পোক্ত হয় না—
অন্ধকারে শরীর ঢেকে সাবধানে সব হাঁটছে যখন
আমি তখন ভেতর বাহির খোলা রেখেছি,
আলোর সামনে খুলে রেখেছি।
আজো আমার বোধ হলো না
ভেতরে নীল ক্রোধ হলো না
পরান-গলা রোধ হলো না—
পাথর এবং পাখির মাঝের ফারাক বুঝতে সময় লাগে,
বৃক্ষ এবং লতার মানে আজো আমি সবুজ বুঝি ॥
১৯ ভাদ্র ১৩৮৬ মিঠেখালি মোংলা
ও মন আমি আর পারি না
পরান দুলে উঠলো হাওয়ায়—
বনে কি মৌশুম এসেছে?
এই কি উদাস হবার সময়?
ও মন-মাঝি…
পালে কি তোর বাও লাগে না
টের পাস না জলের উজান?
মন-মাঝি রে— আমি কি তোর বৈঠা নেবো!
ঝুলন্ত এই সাঁকোর ‘পরে
আর পারি না।
জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই
ধংশও নেই, সৃষ্টিও নেই—
কেবল জোড়াতালির ‘পরে, কেবল করতালির ‘পরে
আর পারি না।
ও মন, আমি আর পারি না….
বাঘের থাবায় হরিন ঘায়েল,
হায়রে আমি হাত-পা বাঁধা
ঠিক সাঁকোটির মধ্যিখানে
দুই দিকে দাঁত, দুই দিকে নোখ,
দুই দিকে দুই বন্য শুয়োর এবং ঘৃনা
শুধুই ঘৃনা—
ও মন, শুধু ঘৃনায় কি আর শস্য ফলে!
মাটির জন্যে মমতা কৈ?
ভালোবাসার জন্যে সে-লাল আগুন কোথায়?
ওই যে নুলো, আঁতুড়. ভীরু. আধমরাটা
তারও তো চাই সামান্য রোদ
সে-রোদ কোথায়?
হাতটি তারে ছোঁয়ালেই কি যন্ত্র বাজে!
বেলা যে যায় ও মন-মাঝি-
নিষ্ফলা এই মাটির ভার কি সারা জনম বইতে হবে
কইতে হবে নিজের কাছে নিজের ভালোবাসার কথা?
ও মন, আমি আর পারি না…
২৬ ভাদ্র ১৩৮৬ মিঠেখালি মোংলা
একজোড়া অন্ধ আঁখি
কতোটুকু পরিচয় হলো আজো মানুষে মানুষে
আমি তো নিজের দিকে চেয়ে চেয়ে চিরকাল থমকে থেকেছি;
গহন অরন্য-পথে যেন এক হারানো পথিক,
চিনতে পারিনি।
চিনতে পারি না—
তাকালেই দেখি যারে সে-যে এক কুয়াশা-মানুষ
বিদেশ বিভূঁই সে-যে, চিরকাল দূরের আকাশ।
আঁখির ভেতর থেকে যে-দ্যাখে তাকিয়ে
কথার ভেতরে থাকে যার কথাগুলো,
প্রানের ভেতরে যার প্রানখানি বাজে নিশিদিন
তাকে তো দেখি না—
যে-চোখ তাকিয়ে দ্যাখে, তারে আমি কোন চোখে দেখি?
কতোটুকু চেনা-জানা হলো আজো মানুষে মানুষে!
আমি তো শত্রুর মুখে আজো দেখি স্বজনের রেখা,
আজো দেখি ভালোবাসা ফিরে যায় ঘৃনার ছোবলে
রক্তাক্ত অধরে তার মানুষের ভ্রান্তিগুলো কাঁদে।
ঘৃনা কি বেদনা তুমি হাসিতে লুকাও,
আমি তারে প্রেম ভাবি, ভাবি মুগ্ধ প্রানের প্রকাশ—
নিয়তির চোখ হাসে, হাসে সত্য সুচতুর দুজনার মাঝে।
বেলা যায়— দিন তবু দিনে-দিনে বাড়ে
মানুষের ঘর বাড়ে ঘরের ভেতর,
হয়তোবা বৃক্ষ ভেবে বুকে রাখি চিরকাল সাপের শরীর
বুঝতে পারি না—
মানুষের বেঁচে-থাকা এই ভাবে বেঁচে থাকে ঘোর কুয়াশায় ॥
২৫ বৈশাখ ১৩৮৬ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা
পরাজিত প্রেম
পরাজিত প্রেম তোমাকে দেবো না স্বাতি
এই উন্মুল জীবনের বোনা স্বপ্নের ছেঁড়া তাঁত
তোমাকে দেবো না, তোমাকে দেবো না স্বাতি,
পরাজিত প্রেম তোমাকে দেবো না প্রিয়।
শিথানে আমার ধূপে চন্দনে পাপ,
রক্তে আমার কালো সময়ের ক্লেদ
নষ্ট চাঁদের পুন্নিমাহীন নিষ্ফলা প্রান্তর-
নষ্ট জীবন তোমাকে দেবো না প্রিয়,
বন্ধা বাসনা দেবো না তোমারে স্বাতি।
জন্ম যেমন জননীর দেহ জানে
সন্তান শুধু জানে জীবনের শুভ্র সম্ভাষন,
আমিও তেম্নি যন্ত্রনা পাপ পুষে রাখি অন্তরে-
আমার যে-প্রেম কখনো সে তার জানে না জন্ম-স্মৃতি।
পরাজিত প্রেম তোমাকে দেবো না প্রিয়,
কষ্ট আমাতে বাড়ুক নদীর ভাঙনের মতো শোকে
অসুখি বাতাস অন্ধ করুক হৃদয়ের খোলা আঁখি,
ধংশ আমার মজ্জায় এসে জ্বলুক শ্মশানে চিতা—
তবু এই প্রেম, পরাজিত প্রেম তোমাকে দেবো না স্বাতি,
রুগ্ন সকাল তোমাকে দেবো না প্রিয়।
ভাঙনের ক্ষত বুকে রেখে দেবো আমি,
আমার উত্তরাধিকারী যেন দ্বীপখানি পায় ফিরে।
ব্যথার শ্মশানে প’ড়ে থাক প্রিয় মন
চিতার আগুনে পুড়ুক আমার নষ্ট বুকের হেম,
পুড়ুক ব্যর্থ তিমিরে আমার হৃদয়ের নীল ব্যথা—
আমি এই প্রেম, পরাজিত প্রেম তোমাকে দেবো না প্ৰিয় ॥
৩০ ফাল্গুন ১৩৮৪ খুলনা
দুটি চোখ মনে আছে
১.
দুটি চোখ মনে আছে, আর কিছু নেই…
হুইসেল বাজিয়ে যায় মাঝরাতে সুদূরের ট্রেন,
ভেতরে কোথায় যেন খাঁ-খাঁ করে শূন্য এক নদী
জলহীন। আমি শুধু একজোড়া চোখের ভেতর
ক্লান্তিহীন চেয়ে থেকে জীবনের ভাঙাগড়া দেখি,
যেনবা সে ইতিহাস, সভ্যতার ক্রমবিকাশের—
চোখের ভেতরে চোখ চেয়ে থাকি স্মৃতির ভাষায়,
তবু যেন স্মৃতি নয়, স্বপ্ন নয়—
বোধের অতীত কিছু
দৃষ্টিরও অতীত কিছু
আমি তারে কোনো নামে, কোনো চিহ্নে বোঝাতে পারি না।
২.
দুটি চোখে মনে আছে, আর কিছু নেই…
লিলুয়া বাতাসে ঝরে এলোমেলো হলুদিয়া-পাতা,
আমি যে আউলা-হিয়া বেদনার নিঝুম বায়ে
ঝ’রে পড়ি। আমারে কি সেই চোখ রেখেছে গো মনে?
সেই দুটি চোখ যেন অঘনের সোনালিমা ক্ষেত
আমারে গড়ায় ভাঙে সারা বেলা স্বপ্নের সংশয়ে।
চোখের ভেতরে চোখ, চেয়ে থাকি পরানের চোখে,
তবু যে মেটে না সাধ, পোড়া মন
পুড়ে সে পোড়ায় হিয়া,
লো নিঠুর দরদিয়া
হয়েছো গোপন ঘুন, শাঁস কাটো লুকায়ে ভেতরে-
পুড়ে মরি, কেমনে গো আমি তারে বাইরে দ্যাখাবো!
৩০ আশ্বিন ১৩৮৬ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা
ও পরবাসীয়া
চিবুকে চুম্বন চিহ্ন আমি ফিরে যাচ্ছি
চোখে টলোমলো নদী আমি ফিরে যাচ্ছি।
ফিরে যাচ্ছি সন্ধা। ফিরে যাচ্ছি মাধবীলতার ফুল
খুব বেদনায় নুয়ে থাকা একজোড়া চোখ
ফিরে যাচ্ছি।
ফিরে যাচ্ছি, ললাটে চুম্বন চিহ্ন আমি ফিরে যাচ্ছি—
ফিরে যাচ্ছি হিয়া, ফিরে যাচ্ছি আঁখি, ফিরে যাচ্ছি প্রেম,
কন্ঠলগ্ন দিন, বক্ষলগ্ন দিন, প্রিয়দিন ফিরে যাচ্ছি।
বুকের ভেতরে গাঢ় পরবাস নিয়ে
হাড়ের ভেতরে এক অন্ধকার নিয়ে
চোখের সকেটে শান্ত সমুদ্রকে নিয়ে
ফিরে যাচ্ছি অমল বিরহ।
ফিরে যাচ্ছি
ফিরে যাচ্ছি
ফিরে যাচ্ছি
পেছনে কাঁদছে হিয়া, দেবদারু, সন্ধার আকাশ,
ভাসায়ে বিরহ-নাও ভালোবাসা পরবাসে যায়
হৃদয়ে চুম্বন রেখে ভালোবাসা পরবাসে যায়…
পরবাসে যাই
হৃদয়ে রক্তের চিহ্ন. গাঢ় লাল. পরবাসে যাই,
স্বপ্নের আঁধার পার হয়ে যাই আলোর উঠোনে ॥
০৪ জোষ্টি ১৩৮৬ চানখার পুল ঢাকা
বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা
একবার বৃষ্টি হোক, অবিরল বৃষ্টি হোক
উষর জমিনে,
নিরীহ রক্তের দাগ মুছে নিক জলের প্লাবন,
মুছে নিক পরাজিত ব্যর্থ বাসনার গান, গ্লানির পৃথিবী।
তুমি যদি বনস্পতি তবে প্ররোচনা দাও বৃষ্টি হোক—
বনভূমি, বৃক্ষময় হাত তবে প্রসারিত করো,
মেঘের জরায়ু ছিঁড়ে নামুক জলের শিশু
জন্মের চিৎকারে ভ’রে দিক অজন্মা ভুবন।
বরষা-মঙ্গল গান আজ আর কে গাবে এখানে!
ধংশেরও তবু কিছু অবশেষ থাকে, চিহ্ন থাকে
আমাদের তা-ও নেই— স্মৃতি নেই, চিহ্ন নেই, শূন্য গৃহাঙ্গন।
কতিপয় রক্তপায়ী জীব
কতিপয় জন্মভুক প্রানী
রক্তের উৎসব খ্যালে আমাদের প্রানের উঠোনে।
বৃষ্টি হোক, একবার বৃষ্টি হোক—
দ্বিধার আকাশ ছিঁড়ে ঝরুক প্রেরনা-আর্দ্র জল।
প্রানের মন্দিরা আজ বাজাতে বাজাতে যাবো মাটির নিকটে,
যে-মাটি উদোম গায়ে শুয়ে আছে অজন্মা-আঁধার
যে-মাটি তামাটে তনু. ইতিহাস লেখে তার বুকের কাগজে,
একাকি উড়ায় ধুলো, বিশাল বিক্ষোভে জ্বালে বেদনার শিখা—
ভালোবেসে প্রিয় সেই মাটির শিথানে যদি রেখেছি হৃদয়
তবে আজ বৃষ্টি হোক, অবিরল বৃষ্টি হোক উষর জীবনে,
ধুয়ে যাক জমাট রক্তের দাগ. পরাজয়. গ্লানির পৃথিবী ॥
১৫ বৈশাখ ১৩৮৫ ঢাকা
নিখিলের অনন্ত অঙ্গন
১.
হারানো অতীত ছাড়া, ক্রমাগত ভবিষ্যৎ ছাড়া
মোর কোনো বর্তমান নেই,
মোর কোনো মধ্যভাগ নেই।
প্রতিটি মুহূর্ত এসে ভেঙে পড়ে অতীতের জলে,
প্রতিটি আগামী এসে ধ’সে পড়ে অতীতের খাদে।
ওগো নদী— অতীতের খাদ, ওগো জল. গভীর গহ্বর
আমার জন্মের ধ্বনি, আমার মৃত্যুর বাঁশি. যদি তুমি মনে রাখো
যদি তুমি নিবিড় স্মৃতির মতো বুকে রাখো তারে-
বুকে তুমি রাখবেই জানি,
আমি তবে আরো এক ভবিষ্যৎ গ’ড়ে তুলি বুকের জমিনে।
আগামী, অতীত ছাড়া মোর কোনো বর্তমান নেই,
শিকড়, প্রশাখা ছাড়া মোর কোনো মধ্যভাগ নেই—
একটি মুহূর্ত তুলে নিতে গেলে সময়ের বৃক্ষ থেকে ছিঁড়ে
দ্বিতীয় মুহূর্ত এসে হাতে ঠ্যাকে, প্রথমা হারায়ে যায়
অতীতের জলে।
কিছুই থাকে না হাতে, ছুঁয়ে থাকা যায় না কিছুই,
আকাংখায় ডেকে এনে শুধু তারে অতীতে হারানো—
যেইখানে শুরু তার, শেষ তার সেখানেই শুরু।
২.
আমি এই বর্তমানহীন মুহূর্তের সাঁকো বেয়ে
ভবিষ্যৎ ছোঁবো বোলে ছুটে যাই সমগ্র জীবন,
অতীত মুঠোয় আসে শুধু
ভবিষ্যৎ থাকে তার অ-ধরা. অ-ছোঁয়া দূর ভবিষ্যতে।
৩.
মুহূর্তের চূর্ন পরমানু ডেকে বলে : ওই দ্যাখ রে অবোধ
ওই তোর হারানো অতীত, ওই তোর পরানের ভূমি।
কিছু তুই চাষাবাদ শেখ, শিখে রাখ জমিনের ভাষা,
গর্ভিনী রমনী তোর এই ক্ষেতে বুনেছিলো ফসলের বীজ
এই ক্ষেতে রমনীর তামাটে শরীর আর সুকল্যান বাহু
একদিন শস্যের সুগন্ধ মেখে ফিরে গেছে অঙনের নীড়।
ওই নদী, ধলা জল. আঁকাবাঁকা বিশাল উদোম
রোদ্দুরে শুকায় তনু, বর্ষায় ফেনায়ে ওঠে উতলানো দুধ—
একদিন বেহুলার দুরন্ত বিশ্বাস ভেসেছিলো ওই জল
ওই নদী, ওই মত্ত ডাকাত তুফানে।
আন্ধার-দরিয়া তোর ঘিরে আছে জীবনের এপার ওপার,
তোর সে-বিশ্বাস কই, বেহুলার মতো তোর বেদনার ভেলা
কেন আজো ভাসে নাই তুফান-তিমিরে?
কেন আজো শংখ, খোল, করতালে বাজে নাই হৃদয়ের বানী?
অবোধ যে সে-ই খোঁজে অপরের দূরতম সুখের ঠিকানা।
চামড়ার পরতে পরতে তোর জ’মে আছে লবনের স্বাদ
পলির সুগন্ধ ঘন জীবনের উর্বরতা—
তুই তবু কিছু তার চিনলি না, কিছু তার নিলি না জীবনে,
জোস্নাকে রোদ্দুর ভেবে হারালি চাঁদের স্বাদ, দিনের সুষমা।
৪.
সময় গড়ায়ে পড়ে— অতীতের শান্ত জলে উথালি পাথাল
গরজে উঠতে চায় ব্যর্থ বাসনা সকল, ব্যর্থ রক্তপাত
মুখোশের জটিল লেবাস দুহাতে ছিঁড়তে চায়
পারে না সে।
ছিঁড়তে পারে না, ফিরতে পারে না শুধু শোচনায় ফুরায় প্রহর
আক্ষেপে হারায় কাল বয়সের বিভা।
মুহূর্তের ‘পরে বোসে
বোধিবৃক্ষ কথা কয়, কথা কয়
স্মৃতির ভেতর থেকে কেউ যেন কথা ক’য়ে ওঠে,
কেউ যেন চিৎকারে মাতায় দেশ. ব্রহ্মান্ড, পৃথিবী
সাগর. অরন্যভূমি. জনপদ জুড়ে তার কন্ঠস্বর বাজে।
আমার না-বলা কথা, ব্যর্থ বাসনার গান
তার কণ্ঠে বেজে ওঠে আমার স্বপ্নের ভাষা।
৫.
জন্মের গন্ধের কথা মনে রেখো হে মাটি. মৃত্তিকা. ধুলো,
হে প্ৰান অচিন পাখি
এই ঘর মাটির মন্দির ছেড়ে যতোদূরে যাও
সাড়ে তিন হাত ঘরে তোর র’য়ে যাবে প্রানের পৃথিবী।
আমাদের বিগত গৌরবগুলো, প্রশান্তিগুলো
ওইখানে ঢাকা প’ড়ে আছে সব ধুলো আর কাঁকরের প্রচুর নিচেয়
অতীতের মাটি খুঁড়ে কে আজ খুঁজবে সেই প্রেরনার পরম ফসিল?
৬.
অনন্ত নিখিল সব কথা জেনেছে আমার
উদোম অরন্য বীথি শুধু তারা জেনেছে আমায়।
আমার স্বপ্নের কথা মানুষেরও চে’ বেশি নক্ষত্ৰ জেনেছে,
আমার বেদনাগুলো আমার চে’ বেশি জেনেছে পাখিরা—
৭.
সত্যের লাঙলে চিরে এই পোড়া বুকের জমিন
আমিও ফসল হবো, হবো আমি শস্য ভরা ক্ষেত,
সোনালি অঘনে তুমি আঁটি আঁটি ধান তুলে নিও।
আবার নবান্ন কোরো, অতিথিরে নারায়ন জেনে
শাকান্ন. শিঙির ঝোল. আমসত্ব, খেজুর-পাটালি
কাঁসার থালায় এনে খেতে দিও শীতল পাটিতে।
জলের আর্শিতে মুখ দেখে আবার সিঁদুর এঁকো সতনু-সিঁথায়,
কবিগান শুনে-ফেরা রাত জাগা ক্লান্ত চোখে
আদোরের বকুনি বুলিয়ে তুমি ডেকে নিও বুকের আড়ালে,
দিবসের ক্লান্তিগুলো খুলে খুলে রেখো তুমি রাতের শয্যায়।
৮.
আমার সন্তান এসে যেই গান শোনাবে তোমায়
আমার রক্ত. ঘাম. বেদনা দিয়ে
আমি আজ সেই গান লিখে যাবো মাটির কাগজে।
০৭ বৈশাখ ১৩৮৫ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা
মনে করো তাম্রলিপ্তি
আকাশ মেঘলা নয়-
মনে করো তুমি আর… না. তুমি একাই যাচ্ছো।
ঘ্রান নিচ্ছো সবুজের, হাতে নিচ্ছো তুচ্ছ ঘাস,
কোনো তাড়া নেই যেন, যেন কোনো ব্যস্ততা নেই তোমার।
তোমার দক্ষিনে সাগর, উত্তরে পাহাড় আর… না. আর কিছু নয়,
তোমার পেছনে ইতিহাস— তোমার সামনে?
মনে করো তুমি যাচ্ছো, তুমি একা—
তোমার হাতে আঙুলের মতো শিকড়, যেন তা আঙুল
তোমার হাড়ে সঙ্গীতের মতো ধ্বনি, যেন তা মজ্জা
তোমার ত্বকে অনার্যের শোভা মসৃন আর তামাটে—
তুমি যাচ্ছো, মনে করো তুমি দুই হাজার বছর ধ’রে হেঁটে যাচ্ছো।
তোমার পিতার হত্যাকারী একজন আর্য
তোমার ভাইকে হত্যা করেছে একজন মোঘল
একজন ইংরেজ তোমার সর্বস্ব লুট করেছে–
তুমি যাচ্ছো, তুমি একা, তুমি দুই হাজার বছর ধ’রে হেঁটে যাচ্ছো।
তোমার দক্ষিনে শবযাত্রা, তোমার উত্তরে মৃত্যু-চিহ্ন,
তোমার পেছনে পরাজয় আর গ্লানি— তোমার সামনে?
তুমি যাচ্ছো, না-না তুমি একা নও, তুমি আর ইতিহাস-
মনে করো তাম্রলিপ্তি থেকে নৌ-বহর ছাড়ছে তোমার,
মনে করো ঘরে ঘরে তাঁতকল, আর তার নির্মানের শব্দ
শুনতে শুনতে তুমি যাচ্ছো ভাটির এলাকা মহুয়ার দেশে,
মনে করো পালাগানের আসর, মনে করো সেই শ্যামল রমনী
তোমার বুকের কাছে নত চোখ, থরো থরো রক্তিম অধর-
তুমি যাচ্ছো, দুই হাজার বছর ধ’রে হেঁটে যাচ্ছো তুমি….
তোমার ডাইনে রক্ত, তোমার বাঁদিকে রক্ত
তোমার পেছনে রক্ত, রক্ত আর পরাজয়— তোমার সামনে?
১৬ আষাঢ় ১৩৮৭ মিঠেখালি মোংলা
পক্ষপাত
তোমার হাতে আনন্দ ফুল, আমার হাতে গ্রেনেড।
ভাঙবো বোলে থমকে এখন দাঁড়িয়ে আছি রুক্ষ পথে,
ভাঙবো বোলে ভাঙছি প্রথম নিজের সীমা-গন্ডি,
তোমার চোখে শ্যামল সোহাগ, আমার চোখে অগ্নি।
প্রয়োজনে আজ গুঁড়িয়ে দিলাম একান্ত সব স্বপ্নগুলো,
প্রয়োজনে আজ বুকে নিলাম পথের যতো কষ্ট।
তোমরা বলো ভুল করেছি, আমার সবি নষ্ট।
বাজায় যারা বাজাক বীনা, করুক যারা করছে ঘৃনা-
আমি আমার পথ চিনেছি আমার পথে চলবো।
নাইবা র’লো সুস্বাগতম এসব কথাই বলবো :
মানুষ তুমি ভুল কোরো না,
সাহস তোমার জ্বালাও শিখা, বুকের মাঝে সত্য—
তোমার র’লো সুখি মানুষ, আমার র’লো আর্ত ॥
২৭ মাঘ ১৩৮৩ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা
পুড়িয়ে দেবো নীল কারুকাজ
বুকের ভিতর লুকিয়ে আছে তীব্র আগুন
পুড়িয়ে দেবো, পুড়িয়ে দেবো, সতর্ক হও।
রুপেল পালক গুটাও এখন
কৃত্রিমতার নীল কারুকাজ
জঠর জ্বালায় পুড়িয়ে দেবো, সতর্ক হও।
স্বপ্ন-বিলাস ছড়িয়ে আছো চতুর্দিকে,
ফসল ক্ষেতে খেলছে তোমার সোনার মৃগ,
অবক্ষয়ের ধূসর পোশাক অঙ্গে আমার
অন্ধকারের বিরাট পাখায় আড়াল-করা গেরস্থালি,
উঠোন জুড়ে উজান হাওয়ার দীর্ঘনিশাস।
সাপের ফনায় হাত রেখেছো
হাত রেখেছো বাঘের গায়ে—
ঘরে তোমার লালিত সুখ. আজন্ম সাধ
পুড়িয়ে দেবো, পুড়িয়ে দেবো, সতর্ক হও।
মাটির প্রতি অনুর্বরা আঙুল রেখে
মেঘের অর্থ অনাবৃষ্টি বুঝালে হায়।
শীতার্ত বুক, শীতল শোনিত,
রোদ্দুরকে বল্লে তোমরা জটিল আঁধার।
মাটিতে এক মাতাল যুবক আগুন হাতে
ভীষন খেলায় মত্ত এখন খামখেয়ালি
উল্টো হাতে ঘোরাচ্ছে তার তীব্র লাটিম-
সুখের বাগান, যুক্তিবিহীন খেলনা পুতুল
রেশমি আদোল, মেদাবৃত নিতম্বদ্বয়
হলুদ রাতে ন্যাংটা উরুর খেমটাপনা,
পুড়িয়ে দেবো, পুড়িয়ে দেবো, সতর্ক হও।
বুক পকেটে আতপ চালের সোঁদা গন্ধ
কোথায় যাবে— নহলি ধান টানছে তোমায়।
কাকের পালক, গঙ্গা ফড়িং, বাউল বাতাস
হরগাজাবন গেরস্থালি,
চোখের ভেতর লোনা সাগর, খয়রি শালিক
মাছরাঙার বিচিত্র বঙ— কোথায় যাবে?
আঙ্গিনাতে লাউয়ের জাংলা টানছে তোমায়।
রুপেল পালক গুটাও এখন
গুটাও কৃত্রিমতার ফানুস, নীল কারুকাজ
পুড়িয়ে দেবো, পুড়িয়ে দেবো,সতর্ক হও ॥
০৯ বৈশাখ ১৩৮২ লালবাগ ঢাকা
মুখোমুখি দাঁড়াবার দিন
মুখোমুখি দাঁড়াবার এইতো সময়,
শত্রু কে চিনে গেছে অমিত মানুষ,
হৃদয় জেনেছে ঠিক কতোটা পচন—
মুখোমুখি দাঁড়াবার এইতো সময়।
বুঝেছে জীবন তার কোথায় খলন
কোন সেই ভুল ছিলো বিশ্বাসে. বোধে,
কোন সেই প্রতারক ছিলো তার প্রভু–
মুখোমুখি দাঁড়াবার এইতো সময়।
ফুলের ঘাতক খোঁজে ফুলের পোশাক
মাংশাশী পাখি তার লুকোয় নখর,
লাঙল জেনেছে তার শ্রমে কার লাভ
রাজপথ জেনে গেছে কারা কাঁদে রাতে—
পোড়া ভিতে পোড়ে কোন নিস্ব জীবন।
পিষ্ট পৃথিবী তোলে পাথরের ভার,
কর্কশ হাত টানে সময়ের রশি।
কালো-ম্লান মানুষেরা জাগে দরোজায়
মুখোমুখি দাঁড়াবার এইতো সময় ॥
৩০ পৌষ ১৩৮৩ মিঠেখালি মোংলা
হাউসের তালা
এক জনমের এই রুপোলিয়া তালা
কোন চাবি দিয়ে তারে খুলি?
বিহান গড়ায়ে যায়, দুপুর গড়ায়ে যায়, নামে নিশি. বিষের রাত্তির,
জীবন গড়ায়ে যায়, জীবনের ফুল-পাতা, না-ফোটা মুকুল।
গোনের নৌকোর মাঝি, ভাটিয়ালি গেয়ে যাও— জানো তুমি?
তুমি জানো. যব-ডুমুরের গাছে আউলা-বাউলা-মন মাছরাঙা পাখি?
তুমি জানো? ও মেঘ, ও অঘনের পোয়াতি প্রান্তর. জানো তুমি?
সুখ দিয়ে খোলে না সে, খোলে না সে বেদনায়ও,
আমার সাধের তালা কোন চাবি দিয়ে তারে খুলি?
বৈশাখের ডাকাতিয়া ঝড়, তুমি জানো? গাঁয়ের হালোট. তুমি জানো?
ও লাঙল, ও মাটি, ও কিশোরীর প্রথম প্রনয়. তুমি জানো?
জ্বলন্ত উনুনে ভাত দারুচিনি আর কাঁচা বিহানের রোদ
দুধের থালের পাশে ভন্ ভন্ নীল মাছি. তুমি জানো? বৃষ্টি. তুমি জানো?
তুমি জানো. দিগন্তে আঁচল মেলে শুয়ে থাকা নিধুয়া পাথার?
আলো দিয়ে খোলে না সে, খোলে না সে আঁধারেও
আমার সাধের তালা, কোন চাবি দিয়ে তারে খুলি!
ঘৃনাতেও খোলে না সে, ভালোবাসা. তুমি পারো?
১৫ জোষ্টি ১৩৮৭ মিঠেখালি মোংলা
গহিন গাঙের জল
গহিন গাঙের ঘোলা নোনাজল উথালি পাথালি নাচে
ফনা তুলে আসে তুফানের সাপ কাফনের মতো শাদা
পরানের ‘পরে পড়ে আছড়ায়ে বিশাল জলের ক্রোধ—
যেন উপকূল ভিটে মাটি ঘর টেনে নিয়ে যাবে ছিঁড়ে।
বাঘের পায়ের চিহ্নের মাঝে জ’মে আছে রুপো-জল,
মরা হরিনের চোখের মতোন ঘোর নিরজন রাতে
নায়ের গলুয়ে তামাটে কিশোর
বাঁশিতে বাজায় কথা,
বিজন রাত্রি ভেঙে পড়ে সেই ব্যাকুল বাঁশির টানে
ফুলে ফুলে ওঠে সোমত্ত জলে জোস্নার যৌবন।
রোদ্দুরে পোড়া জোস্নায় ভেজা প্লাবনে ভাসানো মাটি,
চারিপাশে তার রুক্ষ হা-মুখো হাভাতে হাঙর-জল।
উজানি মাঝির পাঞ্জায় তবু বিদ্যুৎ জ্ব’লে ওঠে
জ্ব’লে ওঠে তাজা বারুদ-বহ্নি দরিয়ার সম্ভোগ—
উপদ্রুত এ-উপকূলে তবু জীবনের বাঁশি বাজে।
তেজি কব্জায় জমি চ’ষে আমি ঘরে তুলে নিই ব্যথা,
ঘরে তুলে নিই হাহাকারে ভরা অনাহারী দিনমান
যে-ফসল ক্ষেতে করেছি লালন কষ্টে. রক্তে, ঘামে
আমার অঙনে সে-ধান ওঠে না
ওঠে শস্যের ঋন
বুকের রক্ত. কষ্টের দামে আমি কিনে নিই শোক
আমি কিনে নিই ক্ষুধার্ত দেশ নিরন্ন লোকালয়।
বুকের মধ্যে থেমে আসে গান, চিৎকার জ’মে ওঠে,
ভেঙে ফেলি বাঁশি, ফুলের বাগান, তছনছ করি নারী,
গহন রক্তে জেগে ওঠে জল গহিন গাঙের ফনা—
বুনো শুয়োরের বন্যতা নাচে মগজে পেশীতে দেহে,
গজরায় যেন অজগর-রোষে পাঁজরের তাজা হাড়।
এ-ধান আমার।
আমার অস্থি মজ্জায় তার গন্ধ রয়েছে মিশে।
আমার লাঙল যে-নারীকে চ’ষে জঠরে বুনেছে বীজ
ভাতার না-হোই আমি তবু তার শিশুর জনক হবো।
গহিন গাঙের নোনাজল ফোটে টগবগ কোরে বুকে
ভেঙে পড়ে পাড় বিশাল বৃক্ষ প্রপিতামহের ভিটে-
আসে জল, আসে বারুদ-প্লাবন দরিয়ার বিক্ষোভ।
বিজন রাত্রি তছনছ ছোটে ভীত হরিনের ঝাঁক
খুরের শব্দে কাঁপে মর্মর বুনো বৃক্ষের তনু,
চরের মাটিতে স্বজনের হাড়ে
দূরের বাতাস কাঁদে
জনপদে জ্বলে শোকের মলিন চিতা।
সারা রাত্রির নির্ঘুম শকুনেরা
সকালের লাল সূর্যকে ছেঁড়ে বেদনার বাঁকা ঠোঁটে।
অধিকারহীন পরাধীন ভোর উঠোনে ঝিমোয় প’ড়ে,
দরিয়ার জল তবুও ধোয়ায় দুঃস্বপ্নের ক্ষত।
তবুও কিশোর. তামাটে কিশোর বাঁশিতে বাজায় কথা
জনপদ জুড়ে সেই সুর লেখে বেদনার নিরবতা।
বক্ষের ’পরে রাখো ওই দুটি মেহেদি খচিত হাত, নকশি কাঁথাটি বুকের উপরে আলতো জড়ায়ে রাখো। বুকের মধ্যে দামাল দরিয়া নেচে ওঠে আজ
কি জানি কিসের টানে—
ফেটে পড়ে পাকা পেয়ারার মতো চাঁদের হলুদ কনা।
ডাকে চর আয়
আয়— আয়— আয় ডাকে দরিয়ার উতলানো নোনাজল।
মৃত হরিনের চোখের মতোন ঘোর নিরজন রাতে,
কে জানি বাজায় বাঁশিটি আজকে ভিন্ন আরেক সুরে—
ডাকে জল আয়, ডাকে বাঁশি আয় প্লাবনের প্রান্তরে ॥
১৬ বৈশাখ ১৩৮৫ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা
চাষারা ঘুমায়ে আছে
কেমন সুরত সই, ওলো সই কেমন সে-তনু
পরান উথলে ওঠে বলা তারে যায় না ভাষায়,
কি কোরে বুঝাই তোরে ওলো সই কোন উপমায়!
সমুদ্র দিয়েছে নুন তার হাড়ে নোনা ভালোবাসা,
সেগুনের মতো দেহ অপরূপ গভীর শ্যামল-
সবুজ আঙুল আহা তার দুধের সরের মতো নোখ
মাঝরাতে খুঁড়ে তোলে পরানের গোপন খোয়াব।
শুটকির গন্ধে রাত ভ’রে ওঠে কানায় কানায়,
লো সই বুঝাই তারে : শুয়ে থাক, সময় আসেনি,
এখনো গাঙের জলে আসে নাই চূড়ান্ত জোয়ার।
চাষারা ঘুমায়ে আছে সারাদিন বেদনাকে চ’ষে
ঘরের মাগির মাই মুঠে পুরে রয়েছে বেঘোর।
শুধু এক তন্দ্রাহীন তামাটে কিশোর
স্বপ্নের শিথানে বোসে বাজায় গোপন এক আগামীর বাঁশি…..
আমি বলি : জেগে থাক, কিছুক্ষন জেগে থাক, আসেনি সময়।
জেগে সে আকাশ দ্যাখে, পাঁজরের বেদনাকে দ্যাখে,
সঙ্গমে ক্লান্ত চাষার অসহায় মুখ আর বাহুখানা দ্যাখে—
সহসা চিৎকার কোরে ওঠে : কতোদিন, আর… কতো… দিন?
এখনো গাঙের জলে আসে নাই চূড়ান্ত জোয়ার
চাষারা ঘুমায়ে আছে সারাদিন অন্ধকার চ’ষে।।
১৭ ভাদ্র ১৩৮৫ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা
তামাটে রাখাল
বার বার বাঁশি তো বাজে না, বাঁশি শুধু একবারই বাজে।
তামাটে কিশোর তুই সারারাত বাজালি নিশিথ,
বাজালি ব্যথার হাড়. প্রিয় বুক. হিমেল-খোয়াব
রজনী পোহায়ে এলো, ঢ’লে পড়ে নিঘুম-শিশির,
আলোর করাত কাটে ফালি ফালি তিমিরের তনু
তবু তোর বাঁশি তো বাজে না।
হাড়ের পাঁজর বাজে
বাজে হিয়া, রক্ত-মাংশ, চরাচর. নিখিলের নীড়,
হৃদয়ের স্বপ্ন বাজে— তবু কেন বাঁশিটি বাজে না?
তামাটে রাখাল তুই সারাদিন বাজালি বাতাস
বিরান বিলের বুকে নিসঙ্গতা বাজালিরে তোর।
কবে কোন উদাসিন বাউলের একতারাখানি
যেইভাবে বেজেছিলো— যেইভাবে বাজে প্রান, বাজে দেহ,
সেই সুর হারালি কোথায় তুই তামাটে রাখাল?
বাঁশি তো বাজে না তোর!
তামাটে রাখাল তোর বাঁশিটি বাজে না কেন?
বাজে তোর নিসঙ্গতা, বাজে তনু. ব্যথিত খোয়াব,
গহন সুরের মতো বাজে তোর দিবস রজনী-
তবু কেন বাঁশিটি বাজে না?
একবার বেজেছিলো বাঁশি— বাঁশি শুধু একবারই বাজে?
১৬ আশ্বিন ১৩৮৫ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা
খামার
আজ আর বৃষ্টি নেই— রোদের রঙিন চিল
ডানার পালক তার মেলে দিছে আকাশের তলে।
উদ্ভিদের দেহ দ্যাখো কি-শ্যামল চেকনাই
আহা কি মাটির ঘ্রান, সোঁদা ঘ্রান— মাটিও কি ফুল?
ব্রহ্মান্ডের শূন্য ডালে ফুটে-থাকা এই রুক্ষ তামাটে কুসুম
সূর্যহীন জোস্নাহীন কবে কোন অন্ধকারে ফুটে উঠেছিলো
কবে কোন কিষানেরা অন্ধকার চ’ষে
এই মাঠে বুনেছিলো প্ৰেম
মনে নেই—
মনে নেই কবে এই অনন্ত বৃষ্টি মেঘ
পৃথিবীর তিন ভাগ রোদনের মতো ঝ’রে পড়েছিলো।
আজ আর বৃষ্টি নেই
খামারে এসেছে নেমে সভ্যতার নহলি কিষান,
পুরোনো পায়ের চিহ্ন খুঁজে খুঁজে বরষার জলে
তাকে ফের যেতে হবে, পুনর্বার ফিরে যেতে হবে
জন্মের আন্ধার ঘরে পুনর্বার…
একদা প্রস্তর-দিন তারপর তামা ও লোহায়
সভ্যতা বেড়েছে তার অন্তরের গাঢ় প্রয়োজনে।
করোটির ঘাম আর পাঁজরের বাঁকা ঋদ্ধ হাড়ে
মানুষের চর্ম. অস্থি. ঘর্মময় শ্রমের ভাষায়
জীবন লিখেছে নাম নিখিলের অমর কাগজে।
আজ আর বৃষ্টি নেই— আজ শুধু জ’মে আছে মেঘ
জীবন বিরোধী মেঘ,
অরন্য-জীবন নেই আজ আছে জীবনে অরন্য-
পশুরা গিয়েছে বনে সে-ভূমিকা নিয়েছে মানুষ ॥
০৬ বৈশাখ ১৩৮৬ মিঠেখালি মোংলা
বৈশাখি ছেনাল রোদ
বৈশাখি ছেনাল রোদ. ঘরখানা পোড়ালি আমার।
আমার সবুজ মাঠ. নধর ফসল
আমার অঙন. ভিটে. তরমুজ, রাই,
আমার দুধেল গাই. অন্নদানা. গাভিন ঘরনি
বৈশাখি ছেনাল রোদ সর্বনাশা পোড়ালি সকল।
গগনে গভীর মেঘ জলের জরুল
বনভূমি বৃক্ষময় শ্যামলিম ছায়া
তবু তারা ফিরে গেল, খরদাহ নেভালো না কেউ,
জেগে র’লো সারা বুকে ক্ষত চিহ্ন. রোদের আঘাত।
কারে আমি ডেকে বলি সুহৃদ স্বজন
কার ছায়া তবে সত্য, বাসযোগ্য ভূমি!
কার হাতে হাত রেখে চিতাভস্মে জীবন সাজাবো
এনে দেবো কার বুকে স্বপ্ন-ধোয়া প্রেরনার সাধ!
বৈশাখি ছেনাল খরা হিয়াখানি পোড়ালি আমার—
আমারে বানালি বিধি বিষাদের খেয়া,
তবু যদি সত্যি হয় এই জন্ম নেয়া
তাহলে জীবন ঘ’ষে পুনর্বার জ্বালাবো আগুন,
পুনর্বার প্রেম ছোঁবো, ছোঁবো স্বপ্ন. মাটির পাঁজর ॥
০৬ জোষ্টি ১৩৮৫ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা
সাত পুরুষের ভাঙা নৌকো
এইতো রে সেই জীবন-তরী
বাইতে বাইতে জনম গেল টের পেলি না।
এইতো রে সেই জীবন-তরু
চাষ আবাদে ফুরোলো দিন ফল পেলি না,
বাইতে বাইতে জনম গেল টের পেলি না।
এই হলো সেই সময় নদী, এইতো সে-কূল, এই কিনারা,
এইখানে তোর পাল ছিঁড়েছে, ভাঙা নায়ে জল নিয়েছে।
এইখানে বাঁক নেবার কথা
ছিলো, কিন্তু পথ হারালি,
হারালি তোর দিক-নিশানা—
বাইতে বাইতে জনম গেল টের পেলি না।
আহারে আন্ধারের মাঝি
উজানে তোর নাও চলে না,
সাত পুরুষের ভাঙা নৌকো
আজো সে নাও বাঁক নিলো না, কূল নিলো না।
সামনে কারা মেঘ দ্যাখালো
দুঃখ দিয়ে গাঙ সাজালো,
কারা তোর এই ভাঙা নায়ে খোঁজ পেলি না।
চাপিয়ে দিলো হাজার বোঝা
সাত পুরুষের ভাঙা নৌকো
বাইতে বাইতে জনম গেল টের পেলি না ॥
২২ জোষ্টি ১৩৮৭ মিঠেখালি মোংলা
রাস্তার কবিতা
বন্দনা করি
বন্দনা করি এদেশেরই অনার্য পিতার
শ্যাম চামড়ার শ্যামল মানুষ মাটি শ্যামলার,
খাঁটি মানুষ যারা ২ রক্তধারা দিয়েছে মিশায়ে
এদেশেরই মাটি জলে নওল নোনা বায়ে,
যারা মাটির ছেলে ২ কৃষক জেলে শ্রমিক সর্বহারা
এই জাতির রক্তে দিছে শক্ত শ্রমের ধারা,
যারা গাঁয়ে থাকে ২ গায়ে মাখে বৃষ্টি রোদের প্রেম
আষাঢ় মাসের কাদায় বোনে শস্য-সুখের হেম,
বোনে দুঃখ জরা ২ রক্ত-ঝরা জীবন যুদ্ধের গান,
যাদের হাড়ে মাংশে ফোটে আন্দোলনের ধান।
বাজান করতালি, ২ সবকে বলি. পদ্য আমার শুরু
প্রনতি জানাতাম যদি থাকতো কোনো গুরু
কিন্তু হতভাগ্য, ২ দুরারোগ্য ব্যারাম সারাদেশে
কোনো তথ্যে, কোনো পথ্যে সারে না সে-ব্যাধি।
দ্যাখো চতুর্দিকে, ২ নিচ্ছে শিখে ছেলে. বুড়ো. নারী,
তেল মালিশের নানা কৌশল নানা ছল-চাতুরি।
এবার সুদিন এলো, ২ পাওয়া গেল পানির নিচে গ্যাস,
সাগরে ভাই পাওয়া যাবে আরো তেলের রাশ।
বলো মারহাবা, ২ তেল পাইবা, পাইবা তেলের পা,
দরকার মতো সেই পায়েতে তেল লাগাইয়া যা।
কোনো চিন্তা নেই, ২ ধেই ধেই নাচো দিয়ে কাছা
মামা ভাগ্নে নাইবা র’লো আছে আইনের চাচা।
আমরা হাঁদা-হাবা, ২ মার বাবা বেঁধে হাত ও পা,
চিরকালই খাবো আমরা ফরেন লাঠির ঘা।
বড়ো কষ্ট মনে, ২ এ-অরন্যে বাঁচা ভীষন দায়
রাজার হাতি ছাইড়া দিছে সকল কিছু খায়,
কোনো বিচার হয় না, ২ আছে জানা আইনের সব ফাঁক,
আইন তৈরি করেন যারা তাদের সবি মাফ।
আহা বঙ্গদেশ, ২ রঙ্গ বেশ কতো রঙ্গের খেলা,
তন্ত্রে মন্ত্রে যুদ্ধ চলছে, চলছে শিল্প-মেলা।
আমরা চুনোপুঁটি, ২ গুটিশুটি থাকি ঘরের কোনে,
রুই বোয়ালের বড়ো বুদ্ধি বড়ো যে তার মানে।
তবু যেটুক বুঝি, ২ তাই পুঁজি, তা-ও হয় যে মিস্,
গাছপালা কাইটা ঢাকার বানাইছে প্যারিস!
বড়ো ভালো চিন্তা, ২ নাচো ধিতা, ধিতা ধিনা ধিনা,
বাংলাদেশে প্যারিস পেলে মজার নেই তো সীমা।
‘ওরা নষ্ট লোক, ২ করে শোক গেরাম গেরাম বোলে
বাংলাদেশকে ঢোকাবো ভাই রাজধানীর খোলে—’
বলেন চিন্তাবিদ, ২ দিকবিদিক জ্ঞানের মধ্যে পোকা,
নামের শেষে নানা হরফ মানুষকে দ্যায় ধোকা।
করে বুদ্ধি বন্টন, ২ হাতে লণ্ঠন, দিবালোকের চোর
ডলার রুবেল দিনার পেয়ে কাটে না আর ঘোর।
আমরা সবি জানি, ২ কতোখানি কারা কোথায় আছে,
কে কতোটা জলে. তলে. কে কতোটা গাছে।
কারা ছদ্মবেশী, ২ বাইরে দেশি, বিদেশি ভেতরে
সময় মতো মুখোশ খোলে, সময় মতো পরে।
এরাই মূল শত্রু, ২ পাপের গুরু সমাজের জীবানু,
মনের মধ্যে ক্ষত এদের বাইরে সুশ্রী তনু।
ভাইরে বিশ্বাস করো, ২ বুকে বড়ো ব্যথার আগুন জ্বলে,
আর্ত মানুষ পিষে ওরা সুখের দালান তোলে।
দেশে নানা শ্রেনী, ২ বাড়ায় গ্লানি, হিংসা ও বিদ্বেষ
সব কথার গোড়ার কথা বলছি আমি শেষ
মানুষ সচেতন হও, ২ মুখোশ হটাও, ভাঙো শ্রেনীভেদ
দেশের মাংশে পচন তারে করতে হবে ছেদ।
বাজাও খোল করতাল, ২ আর কতোকাল মুখোশ প’রে রবে,
বুকের স্বপ্ন বাজাও এবার জাগরনের রবে।
ফেরো নিজের ঘরে, ২ নিজ সংসারে স্বজনের উঠোনে,
সমান ভাবে ভাগ কোরে নাও বেঁচে থাকার মানে।
মানুষ কষ্টে আছে, ২ কষ্টে বাঁচে হাজার গ্রামের লোক,
স্বপ্নবিহীন জীবন তাদের হৃদয় ভরা শোক।
তাদের বন্দনা গাই, ২ বুকে সাজাই সময়ের ইতিহাস
এই জাতির আনন্দ. সুখ. দুঃখ. দীর্ঘশ্বাস।
পরাজয়ের গ্লানি, ২ টানছি ঘানি আজো জানি তার,
আলোর ঘায়ে খুললো না কেউ অন্ধকারের দ্বার।
ছিলো শক্ত পেশী, ২ যে বিশ্বাসী সমুন্নত হাত
ছিঁড়লো না সে রক্ত-চোষা অবিচারের রাত।
ছিলো নিজস্ব গান, ২ নিজের পরান, নিজের বাড়ি ঘর
মাল মশলা নিজের ছিলো নিজের কারিগর।
ছিলো নদীর ভাষা, ২ ভালোবাসা বেহুলার সাম্পান
তবু লখিন্দরে আজো পেলো না পরান।
যতো বিজ্ঞজনে, ২ আয়োজনে ব্যস্ত যে শহরে
নিজের সুখের ঘর গড়তে দুখী মাইষের হাড়ে।
তাদের বলি শোনো, ২ যদি কোনো না-করো উপায়
হাজার মানুষ ভাঙবে ও-সুখ হাজার হাতের ঘায়।
কোনো নিষ্কৃতি নাই, ২ আমি জানাই শোনো স্বার্থপর—
আর্ত মানুষ কেড়ে নেবে তাদের অধিকার।
তারা জেগে উঠছে, ২ ছুটে আসছে, বুকে সত্য আলো,
তাদের আগমনের বার্তা রুদ্র বইলা গেল।
আমার পদ্য শেষ, ২ এই দেশ, এ মাটির বাঙালি,
আমার ভালোবাসার অস্ত্রে সাহস ওঠে জ্বলি।
ওঠে রনবাদ্য, ২ যা আরাধ্য, প্রার্থনা যা মনে
সমস্ত আরতি আমার বিশ্বাসের চরনে –
তুমি শক্তি দিও।।
০৬ ফাল্গুন ১৩৮৩ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা
স্বপ্ন-জাগানিয়া
আমারে বানাও ফের তোমার নাহান
তোমার নাহান ঋজু স্বাস্থ্যবান হিয়া,
আমারে বানাও শুদ্ধ— স্বপ্ন-জাগানিয়া।
এই যে বিনীত মাথা. গোলামের ঘাড়
পুনর্বার করো তারে স্বভাবে স্বাধীন,
কারো তারে শব্দময়, নিরবতাহীন।
মানুষের মানবিক ভাষা ও স্বভাবে
যতোখানি ঘৃনা থাকে. থাকা স্বাভাবিক,
আমারে বানাও ঠিক ততোখানি প্রেম—
ততোটা বানাও লোহা যতোটুকু হেম।
আমারে বানাও ফের আগুনের শিখা,
আমারে বানাও ফের জলবতী মেঘ।
আমারে বানাও ফের শস্যময় ভূমি
যতোটা সাহসী হাত. যতোটুকু তুমি।
০৮ মাঘ ১৩৮৬ বাজুয়া খুলনা
হারানো আঙুল
নেই। কেউ নেই—
ইতিহাস জেগে আছে শুধু একা অতন্দ্ৰ দুচোখ।
যেন এক মৃত মানুষের পাঁজরের জীর্ন হাড়
বিগত জন্মের স্মৃতিকথা বুকে নিয়ে নিরবে রয়েছে প’ড়ে
ধুলো-জমা লতাগুল্ম. তূনের ভেতর।
নেই। সেইসব তাঁতের হৃদয় থেকে বেজে-ওঠা শ্রমের সঙ্গীত
নেই। স্বপ্নের সেইসব শিল্পীর হাত থেমে গেছে অনেক অতীতে,
এখন ক্লান্তির মতো জীবনের স্মৃতিচিহ্ন প’ড়ে আছে ব্যথিত পাঁজর।
কোনো গান শুনবো বোলে কি এই পথে আসা?
হারানো উত্তাপ আমি খুঁজতে খুঁজতে কেন ওই জীবনের হাড়
লতাগুল্ম. ভাঙা ইট. কেন ওই দেয়ালের পাথর সরাই!
কেন শুধু মসলিন মসলিন বোলে কেঁদে উঠি বুকের ভেতরে?
ভাঙা ইট. ওই হাড়— ও-তো শুধু বেদনার ব্যর্থ অবশেষ,
আমি তবু সেই ধুলো খুঁড়ে খুঁড়ে শুঁকে দেখি ভেতরের মাটি।
কেন দেখি? কেন সেই শিল্পীর কাটা-আঙুল খুঁজে পেতে চাই?
পেতে চাই তাঁতের হৃদয় থেকে বেজে-ওঠা শ্রমের সঙ্গীত
ঘরে ঘরে রেশমের গন্ধমাখা আশ্বাসের মসৃন বাতাস।
হারানো শিল্পের ভাষা
হারানো শ্রমের পেশী
হারানো উত্তাপ আমি খুঁজতে খুঁজতে কেন ওই বুড়ো অশথের নিচে
বাঁধানো দিঘির ঘাট. ওই ভাঙা দেয়ালের কাছে এসে থমকে দাঁড়াই।
কেন শুধু জীবনের হাড় থেকে ধুলো. বালি, ক্লান্তি. ঘাম, ব্যর্থতা সরাই?
এখানে জীবন ঘিরে যে-বাতাস বুকে নিতো তাঁতের শীৎকার
ঘামের গন্ধ আর বধুদের স্বপ্নময় বুকের উত্তাপ
আজ আর সে-বাতাস নেই…
যে-আকাশ দেখেছিলো রেশমের তন্তু-মুগ্ধ শিল্পীর আঙুল
আজ আর সে-আকাশ নেই…
যে-চাঁদ. নীলিমা, রাত্রি শুনেছিলো ঘুঙুরের গল্প-লেখা-গান
সে-চাঁদ, নীলিমা রাত ধুলোর অনেক নিচে গিয়েছে হারায়ে।
রেশমের তন্তু-মুগ্ধ এক নোতুন আঙুল
বিশ্বাসের তাঁতে আজ আবার বুনতে চাই জীবনের দগ্ধ মসলিন।
এই ধুলো. ক্লান্তি. ভুল. ব্যর্থ রক্তগুলো খুঁড়ে খুঁড়ে গভীর মাটিতে
এই ইট. ঘুনপোকা. জীর্ন দুঃখগুলো খুলে খুলে গভীর হৃদয়ে
ফিরে যাবো— যে রকম গৃহে ফেরে নীড়ভ্রষ্ট নিরুদ্দেশ পাখি,
যে রকম কূলে ফেরে কালো জলে দিশেহারা নিখোঁজ নাবিক।
হারানো শিল্পের কাছে
হারানো প্রানের কাছে প্রয়োজনে নতজানু হবো,
হারানো শিল্পীর কাছে পুনরায় নতজানু হবো।
এই ধুলো. ক্লান্তি. ভুল. জীর্ন দুঃখগুলো ছিঁড়ে খুঁড়ে ফিরে যাবো স্বর্নগ্রামে।।
২১ ফাল্গুন ১৩৮৪ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা