সম্পাদকীয়-৩ : প্রবেশক
জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আমরা স্পষ্টতই অনুভব করছি আমাদের উৎসমূল ও ভিত্তিভূমি সম্পর্কে স্ফটিক-স্বচ্ছ ধারনার অভাব। বৃক্ষকে বিকাশের জন্যে যেমন মাটির উপর দাঁড়াতে হয়, শিকড় বিস্তার করতে হয় মাটির গভীরে এবং তাকে বেঁচে থাকার জন্যে ঐ মাটির গভীর থেকেই আহরন করতে হয় প্রানরস, ঠিক তেমনি একটি জাতির বিকাশের যাত্রাপথে তাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হয় তার জাতিসত্তা, তার ইতিহাস, তার সামাজিক শরীর কাঠমো, তার দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য— তার প্রেরনাময় ঐতিহ্য। এসব বিষয়ের মীমাংসা ও ঋজুরেখ সিদ্ধান্ত নির্মানের জন্যে আমরা আমাদের অগ্রজ বুদ্ধিজীবীদের উপর বহুদিন নির্ভর কোরে থেকেছি। তাঁরা যে উপরোক্ত বিষয়ের মীমাংসার চেষ্টা করেননি তা নয়। কিন্তু তাঁদের আবিষ্কৃত সত্য ও নির্মিত মীমাংসাকে আমরা সর্বক্ষেত্রে সঠিক, নির্মোহ এবং পক্ষপাত-মুক্ত মনে করি না। কখনো রাজশক্তির চাপে, কখনো আত্মবিক্রয়ের ফলে, আবার কখনোবা দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারনে তা সর্বক্ষেত্রে একটি ‘অনুসরনীয়’ বিষয় হয়ে ওঠেনি। এই কারনেই আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা। কিন্তু আমাদের এই প্রচেষ্টাতেই যে আমার সর্ববিষয়ে একটি সঠিক লক্ষ্যে এবং মীমাংসায় পৌঁছেছি এরকম বলা বোধহয় মূর্খতা হবে। প্রকৃতপক্ষে আমরা চাই এইসব বিষয়ে একটি ব্যাপক, গভীর ও অনুপুংখ আলোচনা,গবেষনা ও চিন্তা-ভাবনার সূত্রপাত। আর এ থেকেই আমরা আশা করি একটি সঠিক গন্তব্য ও ভিত্তিভূমি অবশ্যই আমরা খুঁজে পাবো।
আত্মবিশ্লেষনের প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে আমদের অগ্রজ বুদ্ধিজীবীদের যাত্রা শুরু হয়েছিলো উনিশ শতকের গোড়াতে, নবজাগরনের মধ্য দিয়ে। এই প্রচেষ্টার ফলে সুদূর পুরাকাল থেকে উনিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত বিস্তৃত দীর্ঘ সময়ের অপরিবর্তিত ভারতীয় সমাজ-ব্যবস্থায় নাড়া পড়লেও তার শক্তি এতো প্রবল ছিলো না যে তা অচলায়তন সমাজ-ব্যবস্থাকে ভেঙে একটি নতুন সমাজ-কাঠামোর জন্ম দেয়। কেননা সমাজের যে শ্রেনীর মধ্য থেকে এই আন্দোলনের জন্ম হয়েছিলো সে শ্রেনী ব্যাপক জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন, চরিত্রের দিক থেকে আপোসমুখি ও দোদুল্যমান। সর্বোপরি উৎপাদন-সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন সুবিধাভোগী শহরবাসী স্বার্থবাদী এই শ্রেনীর জন্ম হয়েছিলো রাজানুগত প্রভাবশালী শ্রেনী হিসেবে রাজস্বার্থ রক্ষার তাগিদে, কোনো- ক্রমেই জনস্বার্থের সপক্ষে কাজ করবার জন্যে নয়। আর সে কারনেই এই আন্দোলন এক পর্যায়ে এসে নেতৃেত্বের দোদুল্যমানতা ও আপোস-মুখিতার কারনে স্তব্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাঙালি জাতির এই প্রথম জাগরন ও আত্মানুসন্ধান প্রচেষ্টার ব্যর্থতার কারন অনুসন্ধান করতে গেলে তার নেতৃত্বে আসীন শ্রেনীটির উৎস ও চরিত্র অনুসন্ধান অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে একটি রাজানুগত কিন্তু প্রভাবশালী ও সচ্ছল শ্রেনীর জাগরন ঘটেছিলো— এদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর সেটিই প্রথম অঙ্কুরোদগম। উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে শহরবাসী এই শ্রেনীর আত্মসচেতনতার আস্বাদে আত্মানুসন্ধান ও আত্ম-বিশ্লেষনের দুরূহ ও কন্টকিত পথে যাত্রা করলো। যে বৃটিশ শাসকদের অনুগত থাকবার জন্যে এই শ্রেনীর জন্ম হয়েছিলো তাঁদের সাথেই স্বার্থের সংঘাত তীব্র হয়ে উঠলো। যে বৃটিশরা “স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোকে ভেঙ্গে দিয়ে, স্থানীয় শিল্পকে উন্মুলিত করে এবং স্থানীয় সমাজে যা কিছু মহৎ ও উন্নত ছিল তাকে সমতল করে দিয়ে” সমগ্র ভারতীয় সভ্যতাকে ধংশ করেছিলো যাদের “অভিজাত শ্রেণী চেয়েছিলো জয় করতে, ধনপতিরা চেয়েছিলেন লুণ্ঠন এবং মিল-তন্ত্রীরা চেয়েছিলো শস্তায় বেচে বাজার দখল” তাদের অনুগত মধ্যবিত্ত শ্রেনীই ইংরেজী শিক্ষার প্রসারে নব- মানবতাবাদের আলোতে স্নান করে উঠেছিলো, গনতন্ত্রের ধারনার সাথে সচেতনতাই তাঁদেরকে টেনে এনেছিলো স্বরূপ-অন্বেষার বন্ধুর ও রক্তাক্ত পথে। কলকাতাবাসী হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের এই প্রয়াস আন্তরিকতাসিগ্ধ ছিলো ঠিকই কিন্তু তাঁদের চারিত্রিক দোদুল্যমানতার কারনে তাঁরা জনগনের সমীপবর্তী হয়েছেন মানুষের কল্যান কামনায়, অন্য সময় রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদারিত্বের লোভে সরে গেছেন জনগন থেকে দূরে। তাঁদের সংহতি ভারতের রাজনৈতিক ঐক্যকে সংহত ও দূর প্রসারিত করার বদলে শ্রেনী স্বার্থ উদ্ধারের প্রয়োজনে সাম্প্রদায়িকতার ঘৃন্য পথে পরিচালিত হয়েছে। রাজনৈতিক লক্ষ্যে তাঁরা যখন শাসকদের সাথে সংঘাতের মুখোমুখি হয়েছে তখন জেগে উঠেছে মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ। কিন্তু আলীগড়-কেন্দ্রিক সেই আত্মসচেতনতার আন্দোলনের স্রোত বাংলাদেশে আসতে আসতে মূল চারিত্রচ্যুত হয়ে ঘৃন্য সাম্প্রদায়িকতার লেবাসে পরিনত হয়েছে। এই দুই প্রচেষ্টাই শেষাবধি গোষ্ঠী-স্বার্থ উদ্ধারের চোরাগলিতে প্রবিষ্ট হয়েছে, স্বরূপ-অন্বেষার লক্ষ্যে বিস্তৃত হতে পারেনি, পরিনত হতে পারেনি ব্যাপক জনগনের স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে। পরবর্তী পর্যায়ে ভারতীয় রাজনীতির দ্বি-ধারাস্রোত ভারতের রাজনৈতিক ঐক্যকে সুদূরপরাহত করার সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেনীর হাতে সমগ্র দেশের ভবিষ্যৎ সমর্পন কোরে দেয় এবং এ যাবৎকাল অবধি তারই জের চলেছে— রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, দর্শন, বিজ্ঞান সর্বত্র।
ভিন্ন সময়ে জন্ম নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষায় পরিপুষ্ট হলেও এই দুই মধ্যবিত্ত সমাজের অভ্যন্তরীন সংকট বিচ্ছিন্ন বা আলাদা নয় বরং সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে তা একই বলা যায়। হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের জন্ম হয়েছিলো রাজানুগ্রহে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে। তাঁদের পরিপুষ্টি ঘটেছে ইংরেজি শিক্ষায়। তাঁদের জন্মের ক্ষেত্রে এই রাজানুগ্রহ তাঁদেরকে ব্যাপক জনগোষ্ঠী থেকে বিছিন্ন একটি সুবিধাভোগী আয়েসী শ্রেনীতে পরিনত করেছে। তাঁদের ইংরেজি শিক্ষা তাঁদেরকে বিত্ত-নির্ভর বিদ্যায় লালায়িত করেছে। ফলে মুক্তচিন্তা, অতীতাশ্রয়ী দৃষ্টিভঙ্গি, নির্মোহ প্রাজ্ঞতার বদলে এসেছে অনুকরনপ্রিয়তা, সুবিধা লাভের সরল পথ অনুসন্ধানের স্পৃহা। শিক্ষিত হয়ে ‘জীবন্ত মনুষ্য’ হবার বদলে ‘ডিগ্রীধারী পুত্তলিকা’ হয়ে তাঁরা দেশের কল্যান-প্রচেষ্টা থেকে দূরে সরে গেছেন। অন্যদিকে মুসুলমান মধ্যবিত্ত সমাজ বৃটিশ সরকারের ‘ডিভাইড এ্যান্ড রুলে’র উদ্দেশ্যপ্রনোদিত প্রচেষ্টারই ফসল। তাঁদের শিক্ষার ক্ষেত্র আলীগড় বা দেওবন্দ। উভয়ই শিক্ষা দিয়েছে ধর্মীয় সংকীর্নতার— হয় তা ধর্মীয় নবজাগরনের পোশাকে নতুবা শ্রেনী-স্বার্থরক্ষার কথা বোলে। হিন্দু ও মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের শিক্ষার এই অভ্যন্তরীন দুর্বলতাই মুক্ত মননের চর্চাকে বিঘ্নিত করেছে, বৈজ্ঞানিকতা ও প্রগতিশীলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সনাতন অনুশাসনের প্রতি ব্যক্তিকে অনুরক্ত করেছে এবং পূর্ন মানবীয় জাগরনের সম্ভাবনাকে ধূলিসাৎ কোরে দিয়েছে। আমাদের বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শাসিত সমাজের শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান নৈরাজ্যের প্রেক্ষাপট বোধকরি এখানেই নিহিত।
বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজে মুক্ত মননের চর্চা, নির্মোহ প্রাজ্ঞতার সম্ভাবনা ও ধর্মনিরপেক্ষ উদার মানসিকতার উদ্বোধনও ঘটেছিলো এক পর্যায়ে; সেটি হলো বিশ শতকের তিরিশের দশকে। ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ-এর কতিপয় স্পর্ধী তরুন অন্বেষন ও পর্যবেক্ষনের শানিত দৃষ্টি, বিশ্লেষনের মানসিকতা নিয়ে সমাজ সংস্কারের যে দুরূহ কার্যে নিয়োজিত হয়েছিলেন তা আমাদের সমাজের অনেক দুর্বলতাকেই প্রকটিত কোরে দিয়েছিলো। কিন্তু সেই দ্রোহী চেতনা পূর্ন মানবীয় জাগরনের ক্ষেত্র সম্পূর্নভাবে তৈরি করতে পারেনি, আর তারই ফলে আত্মানুসন্ধানের এই প্রয়াসও শেষাবধি লক্ষ্যে সমুপস্থিত হতে ব্যর্থ হয়। তবে তা স্বরূপ-অন্বেষার একটি প্রক্রিয়া প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলো, যার লালন ও সম্প্রসারন হয়তো বা আমাদেরকে সেই পথে নিয়ে যেতে পারতো।
সাতচল্লিশের দেশ বিভাগ মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজকে যেমন বিকাশের পথ কোরে দিয়েছিলো তেমনি তা রুদ্ধ কোরে দিয়েছিলো বাঙালি কোরে দিয়েছিলো বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আত্মানুসন্ধানের সমস্ত পথ। তাৎক্ষনিকতা ও সমকালীন সময়ের দাবি মেটানো তথা অস্তিত্ব রক্ষার রক্তাক্ত লড়াইয়ে সার্বক্ষনিকভাবে নিয়োজিত থাকলেও আমাদের সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান, দর্শন প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁদের দৌর্দন্ড প্রতাপ একচ্ছত্রভাবে বহাল ছিলো। জাতিসত্তা বিকাশের প্রশ্নে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অঙ্কুরোগম হয়েছিলো উনিশ শতকের বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেনীর উদ্ভবের সাথে সাথে, তারই পুনর্জাগরন ঘটলো সাতচল্লিশোত্তরকালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বাঙালি মধ্যবিত্তের অংশীদারিত্বের দাবিতে। সমাজ-কাঠামোয় বিরাজমান অসঙ্গতির কারনে যে অসন্তুষ্টি সমাজের প্রতিটি শ্রেনীর ভেতরে জন্ম নিয়েছিলো তাকেই বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ গোষ্ঠী-স্বার্থ উদ্ধার ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার প্রয়াসে পরিনত করলেন। প্রধান দ্বন্দ্বের অবস্থান ঔপনিবেশিক শাসনে না ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদে— তা নিয়ে মত-পার্থক্যে আমাদের বামপন্থী নেতৃবৃন্দ পরোক্ষভাবে এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীর গোষ্ঠী-স্বার্থকেই জোরদার করেছে। অন্যপক্ষে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তা যে সুদৃঢ় রাজনৈতিক ঐক্যকে প্রতিষ্ঠা করেছিলো তা-ই বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে প্রসারিত করেছে।
মধ্যবিত্ত শ্রেনীর এই অগ্রযাত্রা ষাটের দশকের প্রথমাংশ পর্যন্ত প্রায় সমতলভাবেই এগিয়েছে। কিন্তু ষাটের দশকে এসে সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজির অবাধ অনুপ্রবেশ ও ব্যাপক শিল্পায়ন, সামন্তবাদী শাসনের ওপর হামলা, নগরায়ন ইত্যাদি মধ্যবিত্ত সমাজে অবক্ষয়ের সূচনা কোরে দেয়। এদের ভেতর থেকে একটি শ্রেনী (উচ্চ মধ্যবিত্ত) রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদারিত্বের লোভ ও বিত্তের সন্ধানে জাতীয় বুর্জোয়ার রূপ নেয় এবং পাকিস্তানি শাসন-শোষনকে দীর্ঘজীবী করার ঘৃন্য প্রয়াসে মেতে ওঠে। তাঁদের এই আত্মবিক্রয়ের পাশাপাশি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাও সঞ্চয় কোরে নিচ্ছিলো অপরিমেয় শক্তি। মধ্যবিত্ত শ্রেনীর এই অবক্ষয়েরই প্রতিভাস আমাদের সমাজের শাশ্বত মূল্যবোধগুলোর অবক্ষয়ে।
মধ্যবিত্তের এই নেতৃত্ব স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করা গেছে। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাথমিক অবস্থায় সমাজ কাঠামোর-সম্ভাব্য পরিবর্তনের মুখে মধ্যবিত্ত সমাজের এই নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতা জন্ম নিতে থাকে। আমাদের বামপন্থী নেতৃবৃন্দ আত্মকলহে, দলীয় সংকীর্নতায় বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাবে বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত হয়ে থাকার ফলে শ্রেনী সচেতনতা প্রসারের এই সমূহ সুযোগ অবহেলায়, অবজ্ঞায় অতিক্রান্ত হয়ে যায়। তবু সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রেরনা বাঙালি জাতির প্রত্যন্ত প্রদেশে প্রবিষ্ট হলে শ্রেনী-সচেতনতাবোধ সম্প্রসারিত হয়। সর্বহারা শ্রেনীর জাগরনের সম্ভাবনা হয়ে ওঠে তীব্র। ষাটের দশকে মূল্যবোধের ক্ষেত্রে যে অবক্ষয়ের সূচনা হয়েছিলো তা-ই স্বাধীনতা-উত্তরকালে পরিনত হয়েছিলো মূল্যবোধ সংকটে। স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধ আমাদের সমাজ-কাঠামো, সমাজ-সম্পর্ক, ও উৎপাদন- সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্ত পুরোনো রীতিনীতিকে ভেঙে দেয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় নতুন মূল্যবোধ জেগে উঠতে পারেনি, বাঁধভাঙা জল লোকালয় জনপদকে বিনাশ কোরে এগিয়ে গেছে। আমাদের রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা এই মূল্যবোধ গঠনের দায়-দায়িত্ব ও প্রতিপালনে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যে দায়িত্ব পালন করুক এই কুহকিনী আশায় তাঁরা পরস্পর মত্ত থেকেছেন ব্যক্তিক বিবরে।
রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার পেছনেও একটি বিরাট কারন ছিলো, তা হলো : বিচ্ছিন্নতা (alienation)। স্বাধীনতাযুদ্ধ-পূর্বকালে যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিলো তারই প্রভাবে ব্যক্তি সমাজ থেকে, শ্রমিক উৎপাদিত সামগ্রী থেকে, কৃষক উৎপাদনের হাতিয়ার থেকে, সরকারী আমলারা প্রশাসনযন্ত্র থেকে আলাদা হয়ে যেতে থাকেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সমগ্র সমাজ-কাঠামো ও উৎপাদন- সম্পর্কের পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিলো এই বিছিন্নতাকে অপসারন কোরে সেখানে একটি আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেনীর বিত্তসন্ধানী একটি অংশ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীনতা-উত্তরকালে, ফলে তাঁদের শ্রেনী চরিত্রের কারনে ভেঙে পড়া মূল্যবোধের ওপর দন্ডায়মান সমাজের ভেতর-কাঠামো পরির্তনের কোনো চেষ্টাই তাঁদের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। উৎপাদন সম্পর্কের ভেতর-মহলে বিচ্ছিন্নতার সংহার-বীজ ঢুকে পড়েছিলো তাকে বাইরের চাকচিক্যে আপাত ঢেকে রাখা সম্ভব হলেও তার কর্মকান্ড তাতে থেমে থাকেনি— ভেতরে কুরে কুরে খেয়ে জরাজীর্ন কোরে ফেলেছিলো।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে আমদের স্বরূপ-অন্বেষার সমূহ সুযোগ সৃষ্টি হলেও রাষ্ট্র- ক্ষমতায় উপবিষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেনীর আত্মস্বার্থ রক্ষার প্রয়াস তাকে বানচাল কোরে দিয়েছে। পরম অসহিষ্ণুতার প্রভাবেই দেশ গঠনের সার্বজনীন ভূমিকাকে তারা ভেবেছেন দলীয় দায়িত্ব। ফলে যে বিচ্ছিন্নতা সুপ্ত ছিল তাই বিকশিত হয়েছে, অপসারিত হয়নি। আমরা এ সমাজের সাথে একাত্মবোধ করিনি। আত্মানুসন্ধান, আত্মবিশ্লেষন, আত্মসমীক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে, বাস্তবায়িত হয়নি। পঁচাত্তুরের রাষ্ট্রক্ষমতার উপরিতলে পরিবর্তন আপাত দৃষ্টিতে পরিবর্তন মনে হলেও চারিত্রিক বিচারে তা তেমন উল্লেযোগ্য বিষয় নয়। উপরন্তু মীমাংসিত বিষয়ে তর্ক তুলে, অতিক্রান্ত পথ পুনর্ব্যবহার কোরে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে পেছনের দিকে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহন কোরে অগ্রসর যাত্রায় দেশকে নিয়ে যাওয়া হয়নি। আর এসবই সম্ভব হয়েছে আমাদের লক্ষ্যহীনতার কারনে, আমাদের প্রেরনাময় ঐতিহ্য অনুসন্ধানের ব্যর্থতার কারনে, সর্বোপরি স্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারনে। আমাদের আগামী সমাজ- বিপ্লবের ভূমি প্রস্তুত করতে হলে এইসব দুর্বলতাকে কাটাতেই হবে, অন্যথায় ভিন্ন দেশের সমাজ বিপ্লবের পদ্ধতি ব্যবহারের ভুল রীতি আজকের মতো আগামীতেও আমাদের সামাজিক মুক্তিকে করবে সুদূর পরাহত।
আমরা বিশ্বাস করি যে, একটি সমাজের সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্কই উপরি-কাঠামো অর্থাৎ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রন করে; তবে মূল কাঠামোকে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উপরি-কাঠামোই আবার অগ্রনী ভূমিকা পালন কোরে থাকে। কাজেই, এ মুহূর্তে আমরা বুদ্ধিজীবীদের কাছে আশা করবো বস্তুনিষ্ঠ, সৎ এবং উদার সচেতনতা। যে কোনো পক্ষেই, সংকীর্ন মানসিকতা সব সময় অমঙ্গল বয়ে আনে এবং তা প্রগতি-বিরোধী ভূমিকা পালন করতে বাধ্য। জানালা দিয়ে আকাশ দ্যাখার প্রবনতা মধ্যবিত্তের চিরকালের স্বভাব; স্বভাবের এই সংকীর্নতাকে অতিক্রম করা আজ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। এদশের লেখকবৃন্দ প্রধানত এই মধ্যবিত্ত শ্রেনী থেকে আগত। তাদের মানসিক কাঠামোয় এই সংকীর্নতা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু প্রয়োজনে অনেক স্বাভাবিককেই অস্বাভাবিক কোরে তুলতে হয়।
আমাদের চারিপাশে এক অপ্রকৃতিস্থ সময় এখন বিরাজমান। গানহীন, সুরহীন, ভাষাহীন এই নির্মম সময়। যে-গান আমরা গাইছি সে গান আমাদের নয়, এ-সময়ের নয়। ভাষার ভেতরে যে-কথা যে-উচ্চারন তা আমাদের প্রানের কথা নয়। আমরা কিছু বলতে চাইছি, ভেতরে আকুলতা, কিন্তু সে-অব্যক্ত কথাকে কেউই বলতে পারছে না বা বলতে চাইছে না। তাহলে কি আমাদের প্রানের কথা আমরা কোনোদিনই বলবো না, বলতে পারবো না? আমাদের উত্তর— পারবো। উজ্জ্বল, তেজি, রক্তিম, ঋজু, তরুন শব্দ-শ্রমিকেরা, শিল্প-কৃষানেরা এই বন্ধা সময় চ’ষে অবশ্যই তুলে আনবে ফসল, অবশ্যই তাদের রক্তাক্ত হাত নির্মান করবে আমাদের নোতুন বসতবাড়ির ভিত্তিভূমি। আসুন আমরা সেই প্রত্যাশায় উষ্ণ হয়ে উঠি, সৎ ও উদার হয়ে উঠি
স্বরূপ অন্বেষা, তিতাশ প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৭৮