সাপুড়ের গল্প – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
সাপ নিয়ে যারা কারবার করে তারাই সাপুড়ে। সাপ নিয়ে কারবার অনেকেই করে—বামুন, কায়স্থ, বৈদ্য, সদগোপ প্রভৃতি; নবশাকদের মধ্যেও অনেকে করে। ও-কারবারের যেন একটা নেশা আছে। এবং ওই নেশায় নেশাখোরের যে-চেহারা দাঁড়ায় সেটা বন্য ও বাউণ্ডুলে। গাঁজা খায়, মদ খায়, ঘর-সংসারে মন বসে না, এককথায় খেপে ওঠে, আবার ভালোবাসলে প্রাণ ঢেলে দিয়ে দেউলে হয়ে গ্রীষ্মের জলহীন নদীর মতো হা-হা করে। খাঁটি এবং খাস সাপুড়ে-জাতের যারা—তাদের তো কথাই নাই। খাল-বিলের কাছে—পতিত প্রান্তরে সেই আরণ্য যুগের ঘর-দুয়ারে বাস করে; খাওয়া-দাওয়া, আচার-আচরণ, নাচ-গান, ভিতর-বাহির, দেহ-মনও তাই। সেই আদিম এবং আরণ্য। চেহারায় পর্যন্ত সেই ছাপ। পৃথিবীর বয়সের সঙ্গে মানুষের মনে-দেহে কত না পালটাপালটি, কত না চাঁছাই-ছোলাই হয়েছে—কিন্তু ওদের হয়নি। দেহের মিশমিশে কালো রঙে—করকরে ঘন চুলে, নাক-মুখ-চোখের গড়নে সে-সত্য দিনের আলোয় কালো সাপের মতো স্পষ্ট। গ্রামে আসে, ভিক্ষে করে, সাপ নাচায়—মানুষের সঙ্গে হাসিখুশিতে বাঁশির সুরে সাপের হেলে-দুলে নাচার মতো মনোরম ভঙ্গিতে মন রেখে কথা বলে, আবার খোঁচা খেলেই ছপ করে ছোবল মারতে চেষ্টা করে এবং দিনেরবেলা ক্ষুধার জ্বালায় বেরিয়ে পড়া সাপের মতো যত শিগগির পারে ভিক্ষের ঝুলি বোঝাই করে গ্রাম থেকে বেরিয়ে চলে যায় ডেরার দিকে। ডেরা ওরা ঘরের ভিতরে কিছুতেই বাঁধবে না। বাঁধবে বাইরে—হয় আমবাগানে, নয় বটগাছতলায়। পুরুষের চেয়ে মেয়েগুলো আশ্চর্য। অবশ্য তার কারণ আছে। দুনিয়ায় রাজত্বিটা পুরুষের। তাই ভিক্ষার কারবারে পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের পাতা-হাতই ভরে ওঠে বেশি। উপচেও পড়ে। এবং অন্দরের দরজায় পুরুষের পাহারা—সে-পাহারা পার হয়ে মেয়েরা সহজে যেতে পারে। মেয়েরা ছলতে পারে, মিষ্টি গলায় বলতেপারে, হেলতে পারে, দুলতে পারে। তাই মেয়েরা আশ্চর্য। সেই মেয়েদের মধ্যেও আশ্চর্য এই মেয়েটা। মেয়েটা তরুণী নয়, যুবতী—কিন্তু দেখতে যেন ষোলো-সতেরো বছরের মেয়ে। ছিপছিপে চেহারা, মিশমিশে কালো রং, ঠোঁট দুটো আরও কালো, তারও চেয়ে কালো রুক্ষু কালোচুলের রাশি। সে অল্প নয়, একরাশ। ওদের দলের কাছেও ও বিচিত্র। তিন-তিনবার বিয়ে করে স্বামী ছেড়েছে। আচারে-বিচারেও ওর অনেক স্বেচ্ছাচারিতা। কিন্তু তবু ওকে সহ্য করে চলে দলের লোক। ওর যত সাহস, তত বুদ্ধি। বাবুভাই, দারোগা, জমাদার—এদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে ও একেবারে উকিল-মোক্তার। তার ওপরে মোহিনী জানে। পুরুষেরা ওকে পছন্দ করে না, কিন্তু না মেনে পারে না। মেয়েরা ওকে একবাক্যে মনে-প্রাণে ভালোবাসে; ও যাই হোক, যাই করুক, কারুর বাড়া ভাতে হাত বাড়ায় না; কারুর ঘর ভাঙে না। মাগনে অর্থাৎ ভিক্ষেয় বেরিয়ে ও ঘোরে-ফেরে একা। পুরুষেরা মনে-মনে বলে—পাপ। কিন্তু মুখে সে-কথা ফোটে না। মেয়েরা মুখ মুচকে হেসে কটাক্ষ হেনে বলে—ভালোয়-ভালোয় ঘুরে এসো! ভাগ দিয়ো। একা সব খেয়ো না।
মেয়েটা বলে, মিঠাই পেলে ভাগ দিব, মদের চেয়ো না। তারপরেই হাতের বিষম ঢাকিতে ঘা মেরে হাঁক দেয় : সাপার নাচন। সাপার মাথার আঁটুলি। মাদুলি করে হাতে বাঁধলে রাজা হয়। লিবা গো!
অবলীলাক্রমে ঘুরে মাগন সেরে সবচেয়ে বেশি ভিক্ষে নিয়ে ডেরায় ফিরে বসে—খিলখিল করে হাসে আর গ্রামের রসিক ছোকরা-বাবুদের কথা গল্প করে সঙ্গিনীদের কাছে। তারপর একটা ঝাঁপি একটু খুলে বাঁ হাত পুরে দেয়; শব্দ ওঠে ক্যাঁক—ক্যাঁক। বের করে আনে ব্যাঙ; ওই ঘোরাফেরার ফাঁকেই পুকুর-ডোবা থেকে সংগ্রহ করেছে। ব্যাঙটা বের করে এনে বড় ঝাঁপিটা খুলে একটা জোয়ান গোখুরা বের করে তাকে ছেড়ে দেয় এবং ব্যাঙটাকে ছেড়ে দিয়ে বলে—খাও বঁধু। ওইটে ওর বঁধু। সাপটা গেলে, ও দেখে। খাওয়া শেষ হলে পূর্ণোদর সাপটাকে মালার মতো গলায় জড়িয়ে আদর করে।
অ—কালীনাগ! তুমি নাগ হইলে ক্যানে? নাগর হইলে না? অঙ্গে-অঙ্গে জড়াইয়া অঙ্গ জুড়াইতাম। তুমি নাগ হইলা ক্যানে? কালীনাগ? সাপের ঝাঁপিটার ওপর কাপড় পাট করে রেখে ঘুমোয়। এ-সাপটার ওপর বহুজনের হিংসে। বিশ্বাস নেই।
সাপটা হঠাৎ মরল। বিচিত্র ঘটনা : দেশদেশান্তর ঘুরে বেড়ায় সাপুড়ের দল। মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান, মেদিনীপুর পর্যন্ত। বাঁকুড়ায় শুশুনিয়া পাহাড়ের কাছে এক গ্রামে ফেলেছিল ডেরা। শুশুনিয়া পাহাড় ওদের না-জানা জায়গা নয়। এখানে ওরা সাবধান! ‘ভোরবেলার আগে কেউ বাইরিবা না। দিদিমণি চাকিতে থাকতি-থাকতি ডেরায় ফিরবা। সিঁধেল চোর লয় রে মানিক, ডাকাত আছে ওত পেত্যা।’ মানে সাপ নয়, বাঘ। সাপ সিঁধেল চোর, বাঘা ডাকাত। ‘আঁধার নামলেই বন থেকে লাল গামছা মাথায় বেঁধ্যা পথের ধারে বস্যা হাঁই তুলবে, এই লম্বা জিব বার কর্যা আপন মুখ চাটবে।’ ‘শিয়াল ডাকিলে পরে—বেদেরা লিবে না ঘরে’; ঘরে না নিলে পথ থাকে; চলে যাও যেদিকে দু-চোখ যায়। এখানে কিন্তু শিয়াল ডাকে না, ফেউ ডাকে, ফেউ ডাকলে কেউ নাই, আছে বাঘা ডাকাত; সকল পথের শেষ সাবধান।
এই শুশুনিয়া পাহাড়ের পাশ দিয়ে হনহন করে ফিরছিল কালী। মেয়েটার নাম কালী। বেলা তখনও আছে। তেষ্টা পেয়েছিল। দারুণ তৃষ্ণা। পাহাড়ের কোলে একটা ঝরনা আছে, সেই ঝরনায় গেল খেতে। ঝরনার গায়ে দেবতার স্থান। জল খেয়ে উঠছে কালী—হঠাৎ হি-হি করে হেসে কে বললে, বেদেনী!
কালী চমকে উঠে মুখ তুললে। এক সন্ন্যাসী। লম্বা চওড়া শাহি চেহারা, গাঁটপড়া শালের গুঁড়ির মতো। মুখে দাড়ি-গোঁফ, মাথায় রুখু চুল, তাতে দু-চারগাছায় পাক ধরেছে। সন্ন্যাসী আবার হেসে বলে, কী সাপ আছে রে ঝাঁপিতে?
কালী মুখ মুচকে হেসে বললে, সাপ নয়, সাপা গোঁসাই। ছেড়ে দিলে মাথা তুললে ছাতিতে ডংশাবে। লাল চোখ ঘোলা হয়ে যাবে।
হি-হি করে হেসে উঠল গোঁসাই।—যদি মাথা না তোলে।
—মাথা তুলবে না?
—না।—সন্ন্যাসী একেবারে কাছে এসে বললে, খোল ঝাঁপি। দেখি তোর সাপা!
—তার আগে বল, ডংশালে মোর নাম দোষ নাই। কামানের সময় হইছে। কামাই নাই।
—নাই তোর নাম দোষ। কিন্তু তুই বল যদি মাথা না তুলে!
—মাথা না তুললে সাপার মাথা ছেঁচ্যা দোব।
—আমাকে কী দিবি?
—থাকবার মধ্যি থাকবে তো জাতিকুল আর সাপের খালি ঝাঁপি। লিবা? সন্ন্যাসীর জপতপ-ভাসায়ে ঝাঁপ দিবা বেদে যুবতীর দহে। গো-খাপুরিতে? (গাম্দদে) লিলে দিব।
—দেখিস?
—হ্যাঁ।
—খোল তবে ঝাঁপি।
সাপার ঝাঁপিটা খুলে একটা নিষ্ঠুর খোঁচা দিয়ে ইচ্ছে করেই সরে দাঁড়াল কালী। প্রকাণ্ড সাপটা উঠল মাথা নিয়ে, কিন্তু সন্ন্যাসী তার আগেই ঝুলিতে হাত পুরে কী একমুঠো বের করে রেখেছিল—ফাং গঙ্গারাম—ব্যোম শঙ্কর!—বলে চিৎকার করে সে সেই মুঠোর ধুলোর মতো বস্তুটুকু দিলে সাপটার মুখে-চোখে-ফণায় ছিটিয়ে। সঙ্গে-সঙ্গে আশ্চর্য কাণ্ড! সাপটা মাথা নুইয়ে একেবারে কেঁচোর মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে গুটিয়ে গেল। সন্ন্যাসী হি-হি করে হাসতে লাগল। ছুটে এগিয়ে এল কালী : কী হল? কী দিলা?
—ধুলো পড়া।
—না, ওষুদ! কী ওষুদ দিলা? সাপ মের্যা দিলা আমার? আমার সাপ?—কেঁদে ফেলল মেয়েটা। সে একেবারে ঝরঝর করে কান্না; সে-কান্না দেখে সন্ন্যাসী একটু যেন অপ্রস্তুত হল। বললে, সাপ তোকে আমি দিচ্ছি। ওই দেখ, হাঁড়ি করে গাছের ডালে টাঙানো রয়েছে। যেটা খুশি নিয়ে যা।
অবাক কাণ্ড—সত্যিই কালো পোড়া হাঁড়ি টাঙানো রয়েছে। একটা দুটো তিনটে—ওই দুটো, ওই একটা। বেদের মেয়ে উঠল। নামালে হাঁড়িগুলো। সত্যি সাপ গর্জাচ্ছে। কিন্তু—।
—কিন্তু—কী?—সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করলে।
—ই সাপ নিয়ে কী করব?
—কেন?
—আমার উটা সাপা ছিল। সাপা কই?
হা-হা অট্টহাস্যে ভেঙে পড়ল সন্ন্যাসী।—সাপা!
—হাসছ কেন? সাপা আমার পয়মন্ত। সাপার বিক্কমে আর এই মাদীগুলোর বিক্কমে? ইয়ারা পায়ের তলা থেকে কুটুস করে কামড় দিয়া ল্যাজ কাটা দিয়া পালাতে পারে। সাপা অ্যাই ফণা তুলে। তুমি হাসছ ক্যানে?
হি-হি হাসি সন্ন্যাসীর ফুরোয় না।
হাসতে-হাসতে বলে, আমার ভৈরবী হবি? বাজিতে তুই হেরেছিস। তোর জাতকুল-ঝাঁপি আমার। আমার সঙ্গে চল; উড়িষ্যাতে তোকে শঙ্খচূড়ের সাপা ধরে দোব। এই সাপা! সে-সাপা তুই চোখে দেখিস নাই।
মেয়েটা সর্বনাশী। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইল সন্ন্যাসীর দিকে। আপাদমস্তক লেহন করছে দৃষ্টি দিয়ে। সন্ন্যাসী বললে, দেখছিস কী? যাবি?
—এখুনি যাবা? উই গাঁয়ে আমাদের দল। এখুনি ইখান থেকে যাও তো চলো। যাবা?
—চলো।
—আমাকে শঙ্খচূড় সাপা দিবা? এই সাপা?—আপন মাথার ওপর হাত তুলে সে সাপের আকার দেখাল।
—দোব।
—তিনবার বলো। তিনসত্যি করো।
হা-হা শব্দে হেসে উঠল সন্ন্যাসী : দোব। দোব। দোব।
মাস পাঁচেক পর। খণ্ডগিরি-উদয়গিরি থেকে ভুবনেশ্বরের পথের ধারে। গাছের তলায় ভৈরব আর ভৈরবী। ভৈরব গাঁজা খাচ্ছে। ভৈরবী স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছে। মাথার ওপর গাছের ডালে ঝুলানো বিরাট একটা হাঁড়ি। সাপের গর্জন শোনা যাচ্ছে।
—নে খা।—ভৈরব গাঁজার কলকে ভৈরবীর দিকে এগিয়ে দিল। হাতটা ঠেলে দিয়ে ভৈরবী বললে, না।
—কী হল তোর?
—কিছু না। দেহ ভালো লাগছে না।
—তবে মদ খা। দেহ ভালো হবে।
—তু খা।
ভৈরব মদের বোতল বার করে মদ খেয়ে বোতলটা ওকে দিলে খা। খা বলছি। তোকে যা বলেছিলাম আজ তাই দিয়েছি, শঙ্খচূড়ের সাপা। তবু তুর ই কী? এমন তো ছিলি না।
এবার মদের বোতলটা তুলে মুখে খানিকটা ঢেলে দিয়ে গিলে ফেললে ভৈরবী। বুকে হাত বুলিয়ে বললে, হল? লে, এবার তু খা। খা।
—দে।—আবার খানিকটা গলগল করে গিলে ভৈরব বললে, লে আর-এক ঢোক খা।
—দে। এই লে। বাকিটা তু একঢোকে খা দেখি। লে।—সে নিজেই হাঁটু গেড়ে উবু হয়ে বসে তার মুখে বোতলটা ঢেলে দিয়ে হি-হি করে হাসতে লাগল। মদের নেশা লাগল। ভৈরবীর উদাস ভাব কেটে যাচ্ছে। সে মুহূর্তে-মুহূর্তে জাগছে। ফুলে-ভরা লতার বাতাসে দোল খাওয়ার মতো ভৈরবের গায়ে দুলে আছাড় খেয়ে পড়ছে। ভৈরব দু-হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে টেনে নিল। বললে, কাল তুকে সেই ওষুদ দিব। না বললে শুনব না। খেতে হবে। হ্যাঁ। ভৈরব-ভৈরবীর সন্তান—।
—চুপ!—ভৈরবী তার বাকরোধ করে দিলে।
—উঃ!—বলে উঠল সন্ন্যাসী।
খিলখিল করে হেসে উঠল ভৈরবী। ঠোঁটে হাত দিয়ে মুছে নিয়ে দেখে ভৈরব বললে, রক্ত বার করেছিস?
—সাপিনীর কামড় যি।—আবার খিলখিল করে হেসে উঠল ভৈরবী। ভৈরব শিউরে ওঠে সে-হাসিতে।
—দে, মদ দে! নেশাটা জমছে না।
—লে।—আবার নতুন মদের বোতল বের করলে ভৈরবী।
মদের নেশায় অচেতনের মতো পড়ে আছে ভৈরব। একটা গাঁটওয়ালা শালগাছের গুঁড়ি যেন। ভৈরবীর চোখে ঘুম নেই। রাত্রির অন্ধকার থমথম করছে চারিদিকে। তারই মধ্যে একটা হাতছানি ঝিলমিল করছে। মাথার ওপর গাছের ডালে শঙ্খচূড়ের সাপা গর্জাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে—ওটাকে গলায় জড়িয়ে গান গায়।
ও কালীনাগ গ! তুমি নাগ হইলে ক্যানে? নাগর হইলে না?
‘সাপার নাচন! সাপার মাথার আঁটুলি। মাদুলি করি ধারণ করলি মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়!’ হাঁক দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। চঞ্চল হয়ে উঠেছে জাত সাপুড়ের মেয়ে! হাঁড়িটাকে নামিয়ে সাপটাকে বের করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু না। ভৈরব সাপা নয়, বাঘা। বাঘা জেগে উঠবে। তা ছাড়া, সাপটার বিষ আজই সবে গালা হয়েছে। বিষ তো কম নয়। প্রায় আধ ঝিনুক। কোথায় সে ঝিনুকটা? উঠল সে। সন্তর্পণে বের করে আনলে ভৈরবের ঝুলি থেকে। ভৈরব বিষ সংগ্রহ করে রাখে। গাঁজার সঙ্গে খায়। মদের অভাব হলে একটু ঢেলে নিয়ে চেটে খেয়ে ফেলে—তারপর সারাটা দিন বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে। বিশাল শালগুঁড়ির মতো পড়ে আছে। নাক ডাকছে ঝড়ের গোঙানির মতো। ঝুঁকে পড়ল সাপুড়ের মেয়ে। ঠোঁটের ওপর এই তো কাটা দাগটা! দেশলাই জ্বাললে। এখনও কাঁচা রক্ত জমে রয়েছে একটি কুঁচফুলের মতো! আঙুল দিয়ে খসিয়ে দিলে। আবার রক্ত বের হচ্ছে। ঝিনুকটা উপুড় করে দিলে তার ওপর। গাছের ডালের হাঁড়িটা নামিয়ে নিলে মাথায়, কাঁধে ঝোলালে ভৈরবের ঝোলাটা। তারপর সাপিনীর মতো শনশন করে চলল।
হঠাৎ এক জায়গায় বসল। গা বমি-বমি করছে। দেহখানা বড় ক্লান্ত মনে হচ্ছে। পেটের ওপর হাত রেখে সে যেন কিছু অনুভব করতে চাইলে। হ্যাঁ। পারছে অনুভব করতে। অনেক—অনেক—অনেক দূরের কান্নার মতো কী শুনতেও পাচ্ছে সে। হঠাৎ সে ধড়মড় করে উঠল। পাশে রাখা হাঁড়ির ভিতর থেকে সাপটা অকস্মাৎ কী কারণে নিষ্ঠুরভাবে গর্জে উঠছে। গোঙাচ্ছে। সে-গোঙানি শুনে হঠাৎ রাগ হল তার।
শয়তান! ঘেন্না জন্মাচ্ছে! রাগ হচ্ছে। যত বিষ তত রাগ, তত হিংসে।
ভৈরবের ঝুলি থেকে একটা কৌটো বের করে খুললে। ওষুধের গুঁড়ো! এই গুঁড়োর ধুলো পড়ায়—তার সেই সাপটা মরেছিল। কটু গন্ধ উঠছে।
সাপের হাঁড়িটার মুখের সরাটায় একটা পাথর দিয়ে ভেঙে একটু ছিদ্র করে একটু গুঁড়ো ঢেলে দিলে। নি—গর্জা। গর্জা। হুঁ।
খিলখিল করে হেসে উঠল জাত সাপুড়ের মেয়ে। গর্জন থেমে গেছে। হুঁ।
—নে, আরও নে। নে। খা, আরও খা!—ঢেলে দিলে সে অনেকটা গুঁড়ো।
—এই, গর্জা! নে গর্জা!
আর গর্জায় না! ব্যস! নিশ্চিন্ত! এইবার ছোট একটি আশ্রয়! মাস কতকের জন্যে। না চিরকালের জন্যে!
চুপ করে শুল সে। আকাশে চাঁদ উঠছে।
‘আয় চাঁদ আয় চাঁদ আয় চাঁদ-আ-রে! আয় আয় আ-রে।
চাঁদের কপালে চাঁদ চিত দিয়ে যা-রে!’
মাসিক রোমাঞ্চ
পুজো সংখ্যা, ১৯৫৮