কুসুমের কীট – কমলবরণ মুখোপাধ্যায়
উঃ, বড় অন্ধকার। দু-চোখ মেলে এ-অন্ধকার আমি সহ্য করছি না। চাপ-চাপ অন্ধকার এসে চারদিক থেকে আমাকে চেপে ধরেছে। এই নিটোল-নিশ্ছিদ্র তামসগহ্বরে আমি কি সমাধিস্থ হয়ে যাব? তবে কি আমার সমস্ত চেতনা আষাঢের অশ্রান্ত বর্ষণে ভেসে যাবে বিস্মৃতির মহাসমুদ্রে? তবে কি মানুষের কাছে আমার দাবি, আমার দান সবই শেষ হয়ে গেছে? আমার নিঃশ্বাস গ্রহণের পথ কি কেউ দু-আঙুলে সজোরে রোধ করে আছে?
বাইরে আর-একবার বিদ্যুৎ চমকাল।
আমি সেই আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম এই অন্ধকারের শাসনের মধ্যেও মনোতোষ নির্লিপ্তের মতন হাসছে। অবাক হলাম। ও হাসছে! কিন্তু কী করে?
উঃ! আলো জ্বালো, মনোতোষ।—মাথার দুপাশের শিরা দুটি সজোরে চেপে ধরে বললাম। ও হাসল কি? না আমাকে বিদ্রপ করল?
বলল, খুবই কি খারাপ লাগছে? থাক না। সমাজে আলো জ্বালতেই তো আমরা এসেছি। আলো জ্বালার চেষ্টাও করছি। কিন্তু তার আগে অন্ধকারের সঙ্গে একটু পরিচিত না হলে কী করে বুঝব যে, অন্ধকারেরও একটি স্বরূপ আছে—আছে তার একটি প্রকৃত আকৃতি!
এই অন্ধকারের মধ্যেও আমার সুমুখের চেয়ারে উপবিষ্ট মনোতোষকে আর-একবার দেখতে চেষ্টা করলাম। মনোতোষ অন্ধকারের স্বরূপ দেখতে চায়। কী আশ্চর্য! ওর কবি হওয়াই উচিত ছিল। হাসি পেল আমার। কিন্তু হাসতে পারলাম না। মনে হল এই অন্ধকারের আকৃতি গড়বার পেছনে হয়তো আমারও কিছু অংশ আছে। সকলেরই থাকে? তাই আমি হাসব না, হাসতে পারলাম না।
মনোতোষ বলে চলল, তেতোর আস্বাদ না জানতে পেলে যেমন মিষ্টির কথা মনে পড়ে না, আলোর জন্যে অন্ধকারও তো তেমনই!… আমরা আলো জ্বালতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু ক’টি বাতি জ্বালতে পেরেছি, দেবাশিস? শান্তি-রক্ষণের উচ্চপদস্থ কর্মচারি আমরা, কিন্তু ক’ জায়গায় আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠিত করেছি? এই অশান্তি আর অন্ধকারের অস্তিত্ব আদিকাল থেকেই পৃথিবীতে আছে। মানবশিশুর প্রথম পরিচয় অন্ধকারের সঙ্গেই—মাতৃ-জঠরে। তাই নয় কি? সেই সহজাত বা আদি পরিচিত রিপুকে না জানলে কী করে তার বিপরীতকে জানব?
মনোতোষ আলো জ্বালল না। বলল, এই তো বেশ! কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না, অথচ চেতনায় একটি সাড়া জাগছে, আমরা আছি—আছি দু-মনের কাছে-কাছেই। কত গভীর করে বুঝতে পারছি আমাদের প্রশ্বাসেরও একটি স্পন্দন আছে, আছে একটি নৈর্ব্যক্তিক ভাষাও!—মনেতোষ থামল একটু। তারপর আবার বলল, আচ্ছা দেবাশিস, বর্তমান সমাজের সঙ্গে পুরোনো সমাজের একটি বিরাট পার্থক্য তুমি কি বুঝতে পারো? না কি তোমার মনে হয় আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে?
আমি যেন চমকে উঠলাম। এর জন্যে তো প্রস্তুত ছিলাম না। আমি তো দেখতে চাইনি, আমার সমাজের আমার পৃথিবীর কোথাও পচন ধরেছে! কিন্ত অতীতের দর্শনের ছাত্র মনোতোষ তার দুটিমাত্র চোখের তীক্ষ্নতায় সমস্ত বিশ্বকে দেখতে চায়। ভাবতে চায় সমাজের কথা। একটু কেশে বললাম, আমি ভাবিনি, মনোতোষ।
ও বলল, ভাবা উচিত ছিল দেবাশিস। বিশেষ করে তুমি যখন গোয়েন্দা বিভাগের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। কিন্তু আমি ভেবেছি। আমি দেখেছি, আমরা অনেক নীচে নেমে গেছি। আমাদের চারপাশ অন্যায়, অত্যাচার, ব্যভিচারে ভরে আছে। কিন্তু সেই অতীতের কথা ভাবো তো! দেখবে সেদিন একটি প্রকৃত স্নিগ্ধতা ছিল যা আজকে নেই। তাই আজ প্রতি তিন থেকে পাঁচটি লোকের পেছনে একটি করে পুলিশের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। কিন্তু কে দমন করবে এই অন্যায়কে? আসলে যে রক্ষক সে-ই তো ভক্ষক! হয়তো তুমি-আমিও কোনওদিন কোনও ব্যভিচারে লিপ্ত ছিলাম বা লিপ্ত হতে পারি। তাই নয় কি?
সে কী! আমি শান্তি রক্ষক… আমি…আমিও কি…? ধমক দিয়ে বললাম, থামো তুমি, মনোতোষ। তোমার মন্তব্য অসহ্য লাগছে আমার।
মনোতোষের হাসির শব্দ শুনলাম। শহরতলির থানায় আমাদের নির্দিষ্ট ঘরে বসে মনোতোষ বলছে, হিউম্যান মাইন্ড। আমরা কেউই অ্যাবনর্মাল নই। মনের গতি যে কখন কোনদিকে যায় তা কি আমরা কেউ বলতে পারি?
বাইরে আবার বিদ্যুৎ চমকাল। আর সঙ্গে-সঙ্গে আমার কী হল, এ প্রশ্নের উত্তর আছে ছোট্ট একটি শব্দে! না। কিন্তু আমি তা বলব না। আমার আজ কোনও কিছুই ভালো লাগছে না।
মনে হল মনোতোষ যেন এবার উঠল। হ্যাঁ, আমাকে জিগ্যেস করছে আলো জ্বালবে কি না? আমি কি বলব, না? না কি জিগ্যেস করব, আলোর কি প্রয়োজন আছে?
কিন্তু তার আর প্রয়োজন হল না। বাইরে পুলিশ-ভ্যান থামবার শব্দ হল। অশ্রান্ত বৃষ্টির শব্দের অন্ধকারে এতক্ষণ ওর আগমন-বার্তা পাইনি। শেষবার একটি ভয়ঙ্কর শব্দ করে থামল। নড়েচড়ে বসলাম। ভাবলাম উঠব কি না? কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই ডাক এল ভ্যান থেকে মুখার্জি, তাড়াতাড়ি আসুন। একটি নতুন জিনিস অপেক্ষা করে আছে।—কথা শেষ করেই হো-হো করে হেসে উঠলেন এই থানার ও. সি. অটলবিহারী তালুকদার।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। মনোতোষ মুহূর্তে জ্বালল আলোটি। বলল, চলো, দেখা যাক।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে মিঃ তালুকদার ওয়াটারপ্রুফ কোটটি খুলছেন। দুটি পুরুষ্টু ঠোঁটের মাঝখানে চেপে ধরেছেন একটি জ্বলন্ত বর্মা চুরুটকে। তার অপরিচিত গন্ধে জায়গাটি ভরে গিয়েছে যেন। আমাকে দেখেই চুরুট চেপে ধরেই বলতে লাগলেন, খুন নয়, জখম নয়, অ্যাঁ! একটি জলজ্যান্ত…। আর কিছুক্ষণ এই বৃষ্টির মধ্যে পড়ে থাকলেই মারা যেত। এর চেয়ে খুন করাও তো ভালো। সমাজ যে কোথায় চলেছে, কে জানে?—শেষের দিকে মিঃ তালুকদারের স্বর যেন কেমন অস্পষ্ট হয়ে এল। তারপর হাঁক দিয়ে বললেন, বের করে নিয়ে এসো, হরিধন!
দুরন্ত বৃষ্টির মধ্যে নিশ্চল ভ্যান থেকে কুঁজো হয়ে বেরিয়ে এল হরিধন। বুকের কাছে দু-হাতে শক্ত করে ধরা একটি কাঁথার পুঁটলি। মিঃ তালুকদার চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। আমার কপালটি কুঁচকে উঠল। বললাম, কী এ?
বারান্দার খালি টেবিলটির ওপরে আস্তে-আস্তে নামাল হরিধন পুঁটলিটি। তারপর কাঁথার আবরণ কিছুটা অপসারণ করতেই চমকে উঠলাম। মুখ থেকে একটি দুর্বোধ্য শব্দ বেরিয়ে এল আমার। তালুকদার একটি নিশ্বাস ফেলে বললেন, পশুসম নরশিশু। যারা আসে, কিন্তু কোনও পরিচয়ের দাবি করতে পারে না, এও তাদেরই একজন। অত ঠান্ডায় অজ্ঞান হয়ে গেছে।
মনোতোষ এগিয়ে গেল। বলল, মনে হচ্ছে, মাত্র কয়েকঘণ্টা হল জন্মেছে। তাই নয় কি, মিঃ তালুকদার?
তালুকদার আস্তে বললেন, হ্যাঁ! যাচ্ছিলাম উল্টোডাঙ্গা স্টেশনের কাছ থেকে। তখন মাত্র দুটো। পকেট হাতড়ে সিগারেট না পেয়ে গাড়ি থামিয়ে সামনের একটি ঝাঁপ খোলা বিড়ির দোকানের কাছে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ দূর থেকে ডাক শুনতে পেয়ে ফিরে দাঁড়ালাম। দেখলাম ছাতা মাথায় একটি লোক এগিয়ে আসছে ভ্যানের দিকে। মনে প্রশ্ন জাগল, ব্যাপার কী?
কিন্তু উত্তর পাওয়ার আগেই লোকটি কাছে এসে জানালেন যে, তিনি ওই স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। বিপদে পড়েছেন। বিকেল পাঁচটা নাগাদ কে একজন এসে টিকিট কাটবার অছিলায় একটি রেশনের থলি রেখে গেছে কাউন্টারের সামনে। বৃষ্টির জন্যে কেউ আর আসছে না দেখে ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে থলেটা দেখতে পেয়ে একটু ফাঁক করে দেখেই তো অস্থির হয়ে পড়েছেন। আমার দেখা পেয়ে যেন একটু শান্তি পেলেন ভদ্রলোক। বললেন, ভাবছিলাম থানায় ফোন করব। কিন্ত আপনাকে যখন পেয়েই গেলাম তখন আর…।
তার পরের বৃত্তান্ত এমন কিছুই নয়। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ, তারপর নিয়ে আসা। হ্যাঁ, ভদ্রলোক বলেছেন যে, যে-লোকটি থলেটি রেখে গেছে তাকে দেখলেই চিনতে পারবেন তিনি। কোনওদিন যদি দেখা পান তবে জানাবেন।
তালুকদার থামলেন। আমি বললাম, বাঁচবে তো?
তালুকদার হাসলেন, বললেন, ওরা মরে না, লাঞ্ছনা ভোগ করে। ডাক্তার আশ্বাস দিয়েছেন, বাঁচবে।—তারপর একটু থেমে বললেন, হয়তো আপনারা অন্য কিছু ভাবছেন। হ্যাঁ, বলতে পারেন, এ আর এমন কী! কথাটি খুবই সত্যি। কিন্তু সেটা ইওরোপ-আমেরিকার জন্যে, কারণ ওখানে এসব হামেশাই ঘটছে। কিন্তু আমাদের সমাজে এ কি ব্যভিচার নয়? যতদিন এই অন্যায় সমূলে বিনষ্ট না হবে ততদিন সমাজ সুস্থ হবে না, মুখার্জি। আমাদের আর অবহেলা করলে চলবে না। এর একটি জোর তদন্ত করতে হবে। আমাদের বার করতেই হবে কারা এই হতভাগ্য শিশুটির মা-বাবা? হ্যাঁ, এ ভার আপনাকেই নিতে হবে। আপনি ঠিক পারবেন।
আমি কিছু বলতে চাইলাম। কিন্তু মনোতোষ বাধা দিল। চেঁচিয়ে বলল, কী সুন্দর! এমন শিশুকেও কেউ ফ্যালে নাকি?
আমি এগিয়ে গেলাম। দু-চোখের দৃষ্টিকে কেন্দ্রীভূত করলাম শিশুটির মুখে। চোখ বুজে পড়ে আছে। গলার কাছের একটি নালি কাঁপছে। কী আশ্চর্য গঠন। নবজাত শিশুর এমন সুন্দর গঠন এর আগে কি আমার চোখে পড়েছে কোনওদিন? মাথা ভরতি কালো চুল বৃষ্টিতে ভিজে লেপটে আছে। সবচেয়ে আশ্চর্য…।
মনোতোষ এগিয়ে এসে আস্তে-আস্তে বলল, কী আশ্চর্য! একটি কথা না বলে পারছি না, দেবাশিস। মনে হয় এ যেন তোমারই সন্তান।
চমকে উঠলাম আমি। মাথার ভেতরটা হঠাৎ যেন ঘুরে গেল। চোখের দৃষ্টি কি ক্ষীণ হয়ে যাবে নাকি? তবুও তাকালাম মনোতোষের দিকে। ও হাসছে। বলছে, অবিকল তোমার মুখ। কিন্তু তুমি তো বিয়ে করোনি।
হ্যাঁ, মনোতোষ ঠিক বলেছে, আমি বিয়ে করিনি। এ আমার সন্তান নয়। একরকম দেখতে কি দুজন বিরল এই পৃথিবীতে? প্রশ্ন করলাম নিজেকে।
তালুকদার বললেন, আজকে আমাদের এখানেই থাক। কাল শিশু-হাসপাতালে দেওয়া যাবে।
উঃ, বড় অন্ধকার। চাপ-চাপ অন্ধকার সমস্ত বিশ্বজগৎকে চেপে ধরেছে। এর মধ্যে কোথাও একটু আলোর উৎস কি নেই! মাথাটা ধরে এল। কেমন অস্বস্তি লাগছে। এখনই শুয়ে পড়া দরকার। কিন্তু ওই যে শিশুটি—আমারই মতো যাকে দেখতে, আমারই সন্তান বলে ভুল হয় যাকে, সে কি আমাকে চেনে? না-না। মিথ্যে, এ মিথ্যে। ওর পরিচয় আমি জানি না।
ও-ও আমাকে জানে না। হায় শিশু! নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে জন্মেছে, অন্ধকারেই ওর ভবিষ্যৎ লুপ্ত হয়ে গেছে। যে প্রলয়ের সঙ্গে এল, হয়তো সমস্ত জীবন প্রলয়ের সঙ্গেই লড়বে। শ্রান্ত হবে। শেষে একদিন হয়তো…হয়তো…।
আমি কীসব ভাবছি? ও কে? আর আমিই বা কে? একটু শক্ত হলাম। হরিধন ভেতরে নিয়ে গেল ওকে। সেই দিকে তাকিয়ে থেকেই মনোতোষকে বললাম, মাথাটা ধরেছে। বাড়ি যাব না। শুয়ে পড়লাম।
মনোতোষ হাসল। বলল, এত দুর্বল?
কোনও কথা বললাম না। ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম জানলার ধারের খাটে। আমি জানি মনোতোষও আসবে। বাড়ি যেতে ও-ও পারবে না। তাই আসবে। এসে হয়তো সমাজের ব্যভিচারের কথা বলবে। ধিক্কার দেবে শিশুটিকে। কিন্তু ও কী করেছে, যার জন্যে মনোতোষ ওকে ধিকৃত করবে? ওর কী দোষ?
আমি জানি না, অবিবাহিত নর-নারীরা তাদের সাময়িক ভুল বা আবেগে—আনন্দের মধ্যে যে-শিশুর জন্ম দেয় তারা, তাকে কেন গ্রহণ করতে পারে না। তাকে কেন পরিচিত করতে বাধে? সাতপাকের বন্ধনের পরে যেভাবে নরশিশুর জন্ম হয়, সেই ভাবেই তো এরাও জন্মায়। তবে এদের বেলায় কেন এই বিধান? আজ অনেকদিন পরে পম্পার কথা মনে পড়ে। ও একদিন বলেছিল, শিশুরা কোনও দোষ করে না। কিন্তু এ শিশু কী দোষ করেছিল? হ্যাঁ, দোষ—দোষ, কেন ও জন্মেছে?
বেলা বারোটার সময় শিশু হাসপাতালের নার্স এলেন একজন। শিশুটিকে দু-হাতে তুলে নিয়ে আন্দাজ করতে চেষ্টা করলেন কতটা ওজন ওর। তারপর হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন চমকেই উঠলেন। ভয় পেলেন নাকি? না, ভয় নয়, বিস্ময়।
একবার শিশুটির দিকে তাকিয়ে আমাকে আবার দেখলেন। বিব্রত বোধ করলাম আমি। একটু কেশে গাম্ভীর্য আনার চেষ্টা করলাম। নার্স ইতস্তত করে বললেন, দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্রলোকের সন্তানই বটে। তবে অবৈধ। না হলে ফেলে দেবে কেন?
তালুকদার শুধু একটি শব্দই করলেন, হুঁ।—তারপর আবার বললেন, তদন্ত আমরা চালাব এবং এর বাবা-মাকে খুঁজে বের করবই। ততদিন আপনাদের কাছেই থাকবে। পরে তাদের হাতেই ফিরিয়ে দেব। বুঝলেন?
নার্স ঘাড় নাড়লেন। মনোতোষ ইংরেজি দৈনিকটা দেখতে-দেখতে বলল, দেবাশিস, তবে আজ থেকেই ফিল্ডে নামা যাক, কী বলো?
আমি নড়েচড়ে বসলাম। বললাম, আমাকে মাপ করো, ভাই। তুমি নিজেই কাজ শুরু করো।
তালুকদার ঘাড় নাড়লেন। বললেন, তা কি হয়, মুখার্জি? দুজনকেই চেষ্টা করতে হবে।
ও যে আপনাদের সোশ্যাল ডিউটি।
নার্স চলে গেছেন।
ওঁরা আমাকে ছাড়বেন না। কিন্তু এই তুচ্ছ ব্যাপারে এত আয়োজন…অর্থাৎ আমাকে কেন? সে-কথা কেউ শুনবে না। কেননা, আমিই যে লোকের কথা একের পর এক শুনে যাই। শোনাই তো আমার অভ্যাস, বলা নয়। তবুও…আমার ভালো লাগছে না। আপাতত কয়েকদিনের জন্যে ছুটি নেব আমি।
ওপর থেকে আদেশ এসেছে—আই. জি.-র আদেশ। আমাকে তাঁরা ছুটি দেবেন না। উপরন্তু আমাকেই কাজ করতে হবে এ-ঘটনার। অটলবাবু বলেছেন এটা আমাদের সোশ্যাল ডিউটি। হ্যাঁ, ওকে ওর মা-বাবার হাতে তুলে দিতেই হবে। যেমন করেই হোক ওর ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে লীন হতে দেব না। কিন্তু আমার এত অসুস্থ বোধ হচ্ছে কেন? কে জানে! হয়তো, হ্যাঁ, ওকে দেখামাত্রই আমি শান্তি পাই না। কেন? ও কে? কীসের জন্যে আমার সমস্ত চেতনাকে ও আচ্ছন্ন করে আছে?
স্টেশন মাস্টারকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন মনে করে উপস্থিত হলাম তাঁর ওখানে। কী আশ্চর্য! লোকটি আমাকে বললেন, স্যার, সমাজের কথা আর বলবেন না। যত সব অসভ্যের দল এইসব কাণ্ড করে মাঝখানে নিরীহ আমাদের জড়িয়ে রেখে যায়। তা ছেলেটি সুস্থ আছে তো? দেখে মনে হয়েছে ভদ্রলোকেরই সন্তান!
অবাক না হয়ে পারলাম না। এই ভদ্রলোকও শিশুটির কুশল কামনা করছেন। তবে কি সমাজে-সভ্যতায় ওদেরও বাঁচবার অধিকার আছে? বললাম, হ্যাঁ, ভালোই আছে। আচ্ছা, যে-লোকটি থলেটি রেখে গেছে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিশেষ কোনও চিহ্ন কি আপনার মনে আছে?
ভদ্রলোক একটু ভাবলেন। তারপর সোৎসাহে বললেন, হ্যাঁ, আছে বটে। তার হাতের কড়ে আঙুলটার অর্ধেক নেই। তা ছাড়া নাকের কাছটায়, অর্থাৎ, ঠোঁটে শ্বেতীর দাগ রয়েছে। দেখে মনে হয়েছে যেন নিচু-স্তরের…অর্থাৎ চাকর-টাকর হবে।
আগে দেখেছেন?
না। তবে…হ্যাঁ, আমি লক্ষ রাখব। এলেই আপনাকে খবর দেব।
একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। হঠাৎ কাউন্টারের কাছে প্রায়-পরিচিত মেয়েলি কণ্ঠের আলোড়নে তাকালাম সেদিকে। এবং সঙ্গে-সঙ্গেই যেন চমকে উঠলাম। অনেকদিন পরে…। বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। যেন বিরাট একটা উন্মেষের সঙ্গেই বললাম একী, পম্পা, তুমি?
চমকে তাকাল ও। তারপর মুখের দিকে চেয়ে হাসল একটু। বলল, হ্যাঁ, আমিই।
অনেকদিন পরে দেখা, তাই না?
হ্যাঁ, আট মাস পরে।
এতদিন কোথায় ছিলে?
বারাকপুর।—হেসে বলল সে।
কেন?
ওখানেই বাসা পালটেছি। এবং এখন ওখানেই যাব। তুমি ভালো আছ তো?—করুণ চোখে তাকাল পম্পা।
উত্তর দিলাম না। বললাম, এতদিন আমাকে তোমার মনে পড়েনি?
তোমার পড়েছিল কি?—তীক্ষ্ন দৃষ্টির সঙ্গে আমার দিকে তাকাল পম্পা।
এর উত্তর কী দেব আমি! বলব, হ্যাঁ। কিন্তু মনে পড়লেও ওর খোঁজ নিতে চেষ্টা করেছি কি? বললাম না সে-কথা। শুধু বললাম, এখন কী করছ?
কী আর করব? আমাদের মতো হতভাগ্য মেয়েরা তোমাদের কাছে, তোমাদের সমাজে, কী করবার দাবি নিয়ে আসতে পারে? বলো?
পম্পা যেন দুরন্ত হয়ে উঠছে। বললাম, মানে?
মানে?—আস্তে-আস্তে বলল, তোমাকে কোনওদিন ভুলব না—সেই তোমারই কওয়া কথাটা কি ভুলে গেছ, দেবাশিস?
এ কী? পম্পা কি আমাকে আঘাত দেওয়ার জন্যেই আজ এখানে এসেছে? হারানো অতীতকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যেই এসেছে ও! রাগ হল। ভাবলাম ধমক দিই একটা। কিন্তু পারলাম না। একদা যার কাছে আমার প্রতিটি দুষ্টুমির বদলে ধমক খেয়েছি আজ তাকেই সেটা ফিরিয়ে দেওয়ার শক্তি আমার নেই। আস্তে-আস্তে একটু আর্দ্র কণ্ঠেই বললাম, সে-কথা থাক, পম্পা। কিন্তু তুমি…তোমার শরীর এত খারাপ হয়ে গেছে! আশ্চর্য!
গৌরী শিবের আরাধনা করে কৃপা পেয়েছিলেন, আমিও শিবের আরাধনা করেছিলাম। তাই আমারও এই পরিণতি। হায়, ট্রেনের সময় হয়ে এসেছে। তা ছাড়া তুমি পুলিশের লোক, আজ যেন তোমাকে আমার ভয় করছে। তুমি আর সেই—আমার সেই দেবাশিস নও। —থামল ও। তারপর হাসল। বলল, চলি। যদি কোনওদিন দেখা হয়, তবে এ-কথাগুলোর উত্তর দিয়ো। আর বোলো, কী অপরাধ আমি করেছিলাম।
তারপর দু-মাস কেটে গেছে। রহস্যের কোনওই সন্ধান করতে পারিনি। পারবও না হয়তো। আমি তো হাল ছেড়েই বসে আছি। কিন্তু মনোতোষ নাছোড়। অত সহজে ছাড়বে না সে। বলল, তুমি না পারো, আমি করব, দেবাশিস। ছেলেটাকে যথাস্থানে পৌঁছতেই হবে।
কিন্তু যথাস্থান কোথায়? কারওরই তো খোঁজ পাইনি আমরা!
ঠিক এমনই দিনে ফোনে ডাকলেন স্টেশন মাস্টার। বললেন, ঠিক সেইরকমই একটি লোক স্টেশনে আছে। এইমাত্র টিকিট কিনল। তাড়াতাড়ি আসুন।
মনোতোষের মাথাটা আনন্দে দুলে উঠল। বলল, নৌকো এবার তীরে ভিড়বে, দেবাশিস।
হ্যাঁ, সেই লোকটি বটে। দুটো ধমক খেয়েই সত্যি কথা ফাঁস করেছে। কাজ করে এক বাবুর বাড়ি। তার-ই কলেজে পড়া অবিবাহিতা মেয়ের গর্ভে জন্মেছে শিশুটি। লোকলজ্জার ভয়ে, এবং যে এই শিশুটির পিতা তার কোনও খোঁজ না পাওয়ায়, বাধ্য হয়ে ফেলে দিতে হয়েছে।
লোকটা বলল, পঞ্চাশ টাকা দিয়েছে আমাকে। বলেছিল আরও দেবে। কেউ জানে না, হুজুর। কিন্তু সত্য কি চাপা আছে?
যে-বাড়িতে তুমি কাজ করো, সেখানে নিয়ে যেতে হবে, নইলে তো বোঝোই।—শাসালেন অটলবাবু।
নিয়ে যাব, হুজুর, দেখিয়েও দেব তার মা-কে।—লোকটা প্রায় কেঁদেই ফেলল।
উল্টোডাঙ্গা স্টেশনে এসেছিলে কেন আজ?
আত্মীয়-বাড়ি হুজুর।—বলল লোকটা।
অটলবাবুর সঙ্গে মনোতোষ চলে গেল শিশুটির মায়ের খোঁজে। শরীরটা ভালো লাগছে না। আমি যাইনি। ইচ্ছে করেই যাইনি আমি। মনে হয়েছে, লজ্জার ভয়ে যেখানে মা তার সন্তানকে বিসর্জন দিতে পারে, সেখানে আমি আর নাই-বা গেলাম। তাতে কি কোনও ক্ষতি আছে? উত্তর কে দেবে? আমার সমাজ? না, সে বোবা হয়ে গেছে। উত্তর দেবে মানুষ, উত্তর দেবে তাদেরই জৈবক্ষুধা।
দু-ঘণ্টা পরে ফিরল মনোতোষরা। আমি একান্তে নির্লিপ্ত হয়েই বসে ছিলাম। ওদের ডাকে হুঁশ হল। এবং সঙ্গে-সঙ্গেই বজ্রাহতের মতো চমকে উঠলাম। অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলাম, এ কী, পম্পা, তুমি?
একটু হাসল ও। বলল, ক্ষতি কী? হ্যাঁ আমিই।
আপনার স্বামী?—অটলবাবু প্রশ্ন করলেন।
মারা গেছে।
কবে?
যেদিন ও পেটে এল, সেদিনই।
আপনি বিধবা?
না, বিয়ে হয়নি।
আমার বাকশক্তি রহিত হয়ে গেছে কি? না, আমাকে কথা বলতেই হবে! যেমন করে হোক। চেঁচিয়ে বললাম, মনোতোষ, ও যে আমারই সন্তান…।
পম্পা কাঁদল এবার। ভেঙে পড়ে বলল, দেবাশিস, তুমি আমাকে ভোলোনি? ওকে স্বীকৃতি দিয়েছ, এবার সমাজে বাঁচতে দাও।
পম্পাকে আমি ভালোবাসতাম—আজও ভালোবাসি। কিন্তু বিয়ে করতে পারিনি। আজ করব। মনোতোষের দিকে তাকিয়ে থেকে আমি বললাম, তুমি বোসো, পম্পা। সব অপরাধ যে আমারই। বিচার হবে আমার।
না-না…।—কাঁদল পম্পা, তোমার যশ, তোমার প্রতিষ্ঠা…সব…সব যে নষ্ট হয়ে যাবে, দেবাশিস।
যাক,—দৃঢ় কণ্ঠে বললাম আমি। হতভম্ব অটলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমাকে অ্যারেস্ট করুন, অটলবাবু।
মনোতোষ এতক্ষণে যেন প্রাণ ফিরে পেল। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, কুসুমে এত বিষাক্ত কীট থাকে, জানতাম না, দেবাশিস।—আর কিছু বলতে পারে না সে।
আমার ইচ্ছে হল, হাসি। হো-হো করে হাসি। কিন্তু পারলাম না। মাথাটা বড্ড ধরেছে। আর মনে হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত চাপ-চাপ অন্ধকার আমাকে ঘিরে ধরেছে। আমি আর বাঁচব না। আমার সমস্ত চেতনা একটি সূর্যের ধ্যানে অন্ধকারে লীন হয়ে গেছে।
মাসিক গোয়েন্দা
মে-জুন, ১৯৬৪