চতুষ্কোণ – পঞ্চানন ঘোষাল
কিছুকাল সুখে-দুঃখে আমাদের কেটে গিয়েছে। এইদিন ক্ষুণ্ণ মনে কোয়ার্টারে ফিরে আমি যুদ্ধের খবর শুনছিলাম। ইতিমধ্যে জাপান ব্রিটিশের তথা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। রেডিয়োতে শুনলাম, এরা কোহিমার নিকট এসে গিয়েছে। ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এসে সহকারী সুরেনবাবুকে বললাম, ‘সর্বনাশ! একেবারে যে এরা ঘরের কাছে এসে গিয়েছে।’ সহকারী এই সংবাদ শুনে নির্বিকার চিত্তে উত্তর করল, ‘তাতে আর হয়েছে কী, স্যার! মোগল পিরিয়ডে বাম থেকে আমরা ডানে লিখেছি, ব্রিটিশ অধিকারে আমরা ডান থেকে বামে লিখেছি, এবার না হয় ওপর হতে নীচে লিখতে শুরু করব। আমাদের বেকাদায় ফেলা এত সহজ নয়। এ ছাড়া এই ডামাডোলের মধ্যে পড়ে আমরা আবার স্বাধীন হয়েও যেতে পারি।’ এমনি হাস্য-পরিহাসের মধ্যে আরও কিছুক্ষণ সময় হয়তো অতিবাহিত হয়ে যেত, কিন্তু তা আর হয়ে উঠল না। পাশের ঘর থেকে অপর এক সহকারী ছুটে এসে বলে উঠলেন, ‘স্যার! কড়েয়ার ফাঁড়িতে এখনই একদল সান্ত্রি পাঠানো দরকার। সেখানে এক ভীষণ কাণ্ড বেধে গিয়েছে। সেখানকার সার্জেন্ট সাহেব এক মাতাল আমেরিকান সৈন্যকে হাজতে পুরে দিয়েছিল। এই খবর পেয়ে এক টাক মাতাল আমেরিকান ফৌজ ফাঁড়িতে এসে ড্রাম বাজিয়ে জানাচ্ছে যে, আমেরিকা ডিক্লেয়ার্স ওয়ার অন কড়েয়া থানা।
আমি এতক্ষণে আশ্বস্ত হয়ে সহকারীকে বললাম, ‘তা আমি আর এতে কী করব! আমেরিকান মিলিটারি পুলিশে এখুনি তুমি ফোন করে দাও। ওরা এক্ষুনি এসে এইসব যুদ্ধ বন্ধ করে যাবে-এখন।’
সহকারী অফিসারের কথায় আসাম রেলওয়ের এক পুরোনো কাহিনি আমার মনে পড়ে গেল। সবেমাত্র জঙ্গলের মধ্যে রেললাইন পেতে কয়েকটা স্টেশন তৈরি করা হয়েছে। হঠাৎ একদিন এক স্টেশন মাস্টার সদরের অফিসে টেলিগ্রাম করে উপদেশ চেয়েছিলেন, ‘টাইগার অন দ্য প্ল্যাটফরম, অ্যওয়েটিং ইনস্ট্রাকশন। এর উত্তরে ওই রেলওয়ের কর্মকর্তা শুধু জানিয়েছিলেন, ‘ইয়োর সার্ভিস ইজ নো লঙ্গার রিকোয়ার্ড।’ সহযোগী অফিসারকে কিন্তু আমি এইদিন এতটা রূঢ় কথা শোনাতে পারিনি। তাঁকে আমি তাঁর করণীয় কার্যের ব্যাপারে শুধু যথাযোগ্য উপদেশই দিয়েছিলাম।
এ-কাজ ও-কাজ সে-কাজ—চারিদিকেই শুধু কাজ। কোন কাজটা আগে করব তার ঠিক পাই না। সারাটা দিন শুধু তাল সামলাতেই কেটে গেল। কাজের-কাজ একটাও শেষ করতে পারিনি। অথচ সারাদিন ধরে শুধু কাজই করেছি। এগুলো এমন সব কাজ যেগুলো কাজের হিসেবের মধ্যে বাঁধা পড়ে না। ধীরে-ধীরে বেলা গড়িয়ে চলেছে। একটু পরে এইদিনের দিনটিও শেষ হয়ে যাবে। এমন সময় আমার চিন্তার যোগসূত্র ছিন্ন করে দিয়ে সহকারী সুরেনবাবু ঘুরে ঢুকে বললেন, ‘আপনার ওই ঘুঁড়িওয়ালা-ওয়ালিদের মামলা আদালতে শেষ নিষ্পত্তি হয়ে গেল।’ সহকারী সুরেনবাবুর মুখে শোনা ওইদিনের চমকপ্রদ বিচার-কাহিনি আজও আমার সুস্পষ্ট মনে আছে। একজন গোঁড়া প্রাচীনপন্থী অনারারি হাকিমের এজলাসে এই মামলাটি উঠেছিল। এই চাঞ্চল্যকর নারী-হরণের মামলা শুনবার জন্যে আদালতে এইদিন তিলধারণেরও স্থান নেই। হঠাৎ চশমার কাচ মুছতে-মুছতে হাকিমবাহাদুর মেয়েটিকে বললেন, ‘হুঁ, গঙ্গায় ডুবে মরতে গিয়েছিলে না?’
‘হ্যাঁ, তা তো গিয়েছিলাম,’ উত্তরে মেয়েটি বলেছিল, ‘কিন্তু মরা হল কই? গঙ্গায় যে সেদিন বড্ড বেশি জল। আপনাদের এসব কথা জেনেই বা কী হবে? আপনারা বিচারের নামে একটি ছেলেকে চোর-ছ্যাঁচোড় ও একটি মেয়েকে পতিতা তৈরি করতে চান। আপনারা ভালো করেই জানেন যে, বর্তমান সমাজব্যবস্থায় আমাকে পিতৃকুল ও স্বামীকুল—কোনও কুলই আর গৃহে স্থান দেবে না। এইসব জেনে-শুনে এই ছেলেটিকে জেলে পাঠিয়ে আমাকে আপনারা নিরাশ্রয় করতে চান। যে-আইন সমাজের প্রকৃত সমস্যার সমাধান না করে সমস্যা আরও জটিল করে তোলে, সে-আইন নিশ্চয়ই শ্রেয়ের আইন নয়। আমার বয়েস হয়তো অপ্রাপ্তবয়স্কার সীমার অব্যবহিত নীচে আছে। কিন্তু আমার মনের প্রাচুর্যের কথাও তো এই সম্পর্কে আপনাদের ভাবা উচিত।’
আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে, আইনানুযায়ী শুধু ছেলেরাই মেয়েদের নিয়ে পালাতে পারে, কিন্তু মেয়েরা ছেলেকে ভুলিয়ে নিয়ে গেলে তাতেও অপরাধ হয় মাত্র ছেলেদের। হয়তো এর মধ্যে সমাজ ও দেহ-বিজ্ঞানের কোনও মূল তত্ত্ব নিহিত আছে। তবে এই বিষয়ে পুরুষালি মেয়েদের কথাও বিবেচনা করা উচিত হবে। এই ধরনের মেয়েদের খপ্পরে পড়ে অনেক নিরীহ ছেলেদেরও প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
‘হুঁ, বুঝলাম সব,’ একটু চিন্তা করে আমি সহকারী অফিসারকে জিগ্যেস করলাম, ‘তা এত সহজে এই মামলার নিষ্পত্তি হল কী করে?’
‘মামলায় ওই মেয়েটি স্বামীর সঙ্গে মামলা মিটিয়ে নিলে, স্যার,’ প্রত্যুত্তরে সহকারী অফিসার আমাকে জানালেন, ‘অপহরণের মামলা টেকেনি। তবে ব্যভিচারের মামলাটা প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু মেয়েটির স্বামী একহাজার টাকার বিনিময়ে মামলাটি তুলে নিল। কিন্তু এইখানেও মেয়েটা আদালতসুদ্ধ লোককে হকচকিয়ে দিয়ে এমন একটা সিন ক্রিয়েট করলে যে—।’
‘সে আবার কী হে? মিটমাট হয়ে যাওয়ার পরেও এত কাণ্ড?’ আমি কৌতূহলী হয়ে উঠে সহকারীকে জিগ্যেস করলাম, ‘ওখানে কী গণ্ডগোল করল আবার মেয়েটা? এইরকম বেপরোয়া মেয়ে ইতিপূর্বে আমিও কখনও দেখিনি। মেয়েটা বোধহয় জীবনধর্মী। নিজের ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী সে জীবনটাকে পুরোপুরি ভোগ করতে চেয়েছে। যাক এখন ওসব কথা। এখন বলো, তারপর কী হল।’
‘স্যার! সে এক তাজ্জব কাণ্ড,’ একটু সলজ্জভাব প্রকাশ করে সহকারী উত্তর করলে, ‘আসামীর উকিলই ক্ষতিপূরণের টাকা ক’টা আপনার ওই জীবনধর্মী মেয়েটির স্বামীকে দিতে যাচ্ছিল। এমন সময় মেয়েটি ছুটে এসে ছোঁ মেরে নোট ক’টা কেড়ে নিয়ে নিজের হাতে সেগুলো তার বাতিল স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে বলে উঠল, ”নে-নে, তোর বউয়ের দাম নে। এইজন্যে তাহলে তুই মামলা এনেছিলি!” ‘
এই মেয়েটির স্বামীকে আমিই ডাকিয়ে আনিয়ে এই মামলার একজন পার্টি করে নিয়েছিলাম। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাকে আমি এই নিদারুণ অপমানের হাত হতে রক্ষা করতে পারিনি। ওই হতভাগ্য স্বামীটি কিছুকালের মধ্যে নিশ্চয়ই পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জীবনে সুখী হওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু এই মামলায় পাওয়া ওই ক্ষতিপূরণের টাকা ক’টা নিয়ে সে এখন করবে কী? আর যাই সে তা দিয়ে করুক ক্ষতি নেই, কিন্তু ওই টাকা দিয়ে তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর কোনও অলঙ্কার সে গড়িয়ে দেবে না তো?
মাসিক রহস্য পত্রিকা
পুজো সংখ্যা, ১৯৬১