এক রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার – শিবরাম চক্রবর্তী
একটা অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস লিখলে হয়।
আমার জীবনে এই ধরনের একটা অ্যামবিশন অনেক দিন ধরেই ছিল। কিন্তু কী করে যে ওই সব লিখি, গল্পচ্ছলেই যদিও, যাতে করে অদ্ভুত আর বিচ্ছিরি যত কাণ্ড—যার মাথা নেই, মুন্ডু নেই—একটার পর একটা ঘটে যায়—পরিচ্ছেদের পর পরিচ্ছেদ ঘটতে থাকে—কৌতূহল আর অনিদ্রা সমান তালে জাগিয়ে রাখা যায় ধারাবাহিকভাবে, কিছুতেই আমি ভেবে উঠতে পারিনি। সত্যি, ভাবতে গেলে, আশ্চর্য নয় কি? প্রত্যেক পরিচ্ছেদের শেষে এসেই নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ো। এর পরে, এরও পরে আরও কী দুর্ঘটনা ঘটবে, ঘটতে পারে, ধারণা করতেই তোমার মাথা ঘুরবে—এবং পরের পরিচ্ছেদের গোড়াতেই যখন ব্যাপারটা আরও একটু খোলসা হবে, তখন আবার আপনমনেই বলবে হয়তো, ‘দুর-দুর! এই! এর জন্যেই এত!’ বলতে কী, সমস্ত বইটা শেষ করতে পারলে, অবশেষে, বইটাকে দূরীভূত করতেই ইচ্ছা জাগে—এবং বলা বাহুল্য, দেরিও বিশেষ হয় না। কেউ না কেউ এসে—ছেলেপিলেরাই সচরাচর—বইটাকে বাগিয়ে নিয়ে চলে যায়, এবং সে-বই, সেই বিদূরিত অ্যাডভেঞ্চারের বই, আর কখনও ফেরত আসে না। নিজের অ্যাডভেঞ্চারের পথেই বেরিয়ে পড়ে বোধহয়।
কিন্তু সে যাই হোক, অ্যাডভেঞ্চারের একটা বই লেখার দুরাকাঙ্ক্ষা, দুরূহ আকাঙ্ক্ষা, আমারও ছিল। কিন্তু কী করে যে মাথা খাটিয়ে ওইরকমের একটা গল্প ফাঁদা যায় কিছুতেই ঠাওর করে উঠতে পারছিলাম না।
সেই আমারই জীবনে যে এমন এক রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার ঘটবে কে জানত! একেবারে সতিকারের অ্যাডভেঞ্চার, গল্পের বইয়ে ঠিক যেমন-যেমনটি ঘটে, মাথামুন্ডুহীন নিখুঁত রকমের হুবহু! কেন যে হল, কী জন্যে যে হল, এমনকী, কী যে হল তার কিছুই আমি খুঁটিয়ে বলতে পারব না। কোথায় যে হল তাও আমার কাছে ধোঁয়াটে।
সেই অ্যাডভেঞ্চারের কেবল একটি পরিচ্ছেদই আমি জানি। সেইটাই আমি এখানে বিবৃত করব। তার আগে কী ঘটেছে এবং পরেই বা কী ঘটিতব্য—জানা নেই আমার। জানার বাসনাও নেই। এই একটি-মাত্র পরিচ্ছেদই আমার জীবনে ঘটেছিল, অথবা, সেই ক্রমশ প্রকাশ্য অ্যাডভেঞ্চারের এই পরিচ্ছেদটি যখন ঘটছিল, সেই অশুভ মুহূর্তে, আমার জীবন নিয়ে আমি হঠাৎ তার মধ্যে গিয়ে পড়েছিলাম—এবং সুখের কথা যে, জীবন নিয়েই ফিরতে পেরেছি।
বেশিদিন আগের কথা নয়, বিশেষ এক জরুরি কাজে ডায়মন্ডহারবার-এ যেতে হয়েছিল। ইচ্ছে করেই লাস্ট বাস-এ চেপেছিলাম, যতই ঢিমে তেতালায় চলুক, রাত দুটো-তিনটে নাগাদ গিয়ে পৌঁছতে পারব। মনে-মনে একটু অ্যাডভেঞ্চারের দুরভিসন্ধিও যে না ছিল তা নয়! কলকাতার বাইরে তো কখনও পা বাড়াই নে। রাত-দুপুরের পর ডায়মন্ডহারবারের মতো এক অচেনা জায়গায় পৌঁছে, বন্ধুর বাড়ি খুঁজে বের করে চৌকিদার-পুলিশ ইত্যাদির সন্দেহ এড়িয়ে, কড়া নাড়ানাড়ি করে কিংবা দরজা ভেঙেই, বন্ধুকে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে তোলা—একটুখানি অ্যাডভেঞ্চারই বইকি!
বাসে আমি একাই যাত্রী।
হুস-হুস করে বাস চলেছে। কলকাতা পেরিয়ে অনেক দূর এসেছি বেশ বোঝা যায়। অন্ধকার রাতের ভেতর দিয়ে উত্তাল হাওয়ায় পাড়াগেঁয়ে মেঠো গন্ধ ভেসে আসছে। দু-ধারে কোথাও আমবাগান, কোথাও বা বাঁশঝাড়, কোথাও চষা খেত, কোথাও বা খড়ো-ঘরের বসতি—আবছায়ার মতো চোখে এসে লাগে। এরই মাঝখান দিয়ে যেতে-যেতে ভীষণ এক ঝাঁকুনি দিয়ে বাসটা থেমে গেল হঠাৎ।
কল বিগড়েছে, গাড়ি আর চলবে না, জানা গেল। আজকের মতো এখানেই নিশ্চিন্দি।
নিশ্চিন্দি? বলতে কী, বেশ একটু ভয়ই করতে লাগল আমার। অজানা জায়গায়, নির্জন নিশুতিতে কেবলমাত্র ড্রাইভার আর ওই কন্ডাক্টর—ওদের কন্ডাক্ট অকস্মাৎ কী দাঁড়াবে কে বলবে? ওধারে ষণ্ডা-ষণ্ডা ওই দুজন আর এধারে নামমাত্র আমি—আমার রীতিমতো হৃৎকম্প শুরু হল।
অবিশ্যি, নিজেকে আশ্বাস দিতেও কসুর করলাম না। তেমন ভয়ের কিছু না, সত্যিই হয়তো কল বিগড়েছে। বেগড়াতেও তো পারে। বেগড়ায় না কি? পথে-ঘাটে আকছারই তো মোটরের কল বেগড়ায়—না বলে-কয়েই বিগড়ে যায়। কেবল স্থান-কাল-পাত্র তেমন সুবিধের নয়, আমার মনের মতো নয় বলেই কি আর মোটরের কল বেগড়াবে না? বেশ তো আমার আবদার!
তা ছাড়া, এমনও তো হতে পারে যে, ড্রাইভারের বেজায় ঘুম পাচ্ছে, গাড়ি টানতে আর রাজি নয়—এবং ঘুম পায় না কি মানুষের? মোটর চালাতে গেলেও ঘুম পেতে পারে।
কিংবা সবচেয়ে যেটা বেশি সম্ভব, একজনমাত্র আরোহীকে এতটা পেটল খরচ করে ডায়মন্ডহারবার পর্যন্ত বয়ে নিয়ে গেলে মজুরি পোষাবে না, তা ভেবেই মোটরের কল বিগড়েছে হয়তো—।
গাড়ি ফের চলবে কখন? জিগ্যেস করতেই, আমার শেষের আশঙ্কাটাই যে সত্য, সেই মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম।
জবাব এল ‘সেই কাল সাতটা-আটটায়। সকাল না হলে কোনখানকার কল বিগড়েছে জানব কী করে?’
‘এই রাত্রে—এত রাত্রে তাহলে তো ভারি মুশকিল!’
‘কাছে একটা বেসরকারি বাংলো আছে। সেইখানে গিয়ে শুয়ে থাকুন—গেলেই শুতে দেবে। আর রাতও তেমন অন্ধকার নয়। চাঁদও উঠে গেছে এতক্ষণে।’ কন্ডাক্টরটা জানাল।
চাঁদ উঠেছে বটে। সরু একফালি চাঁদ। অন্ধকারও অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে দেখলাম।
‘কোন ধারে বাংলোটা? যাব কোন দিক দিয়ে?’
‘রাস্তা থেকে নেমে, চষা খেতের ওপর দিয়ে চলে যান। আল ধরে-ধরে যান চলে। একটু গিয়ে, সামনের ওই বাগানটার আড়ালেই বাংলোটা। বাবুর্চিকে ডাকবেন। লোকটা ভালো—বকশিস পেলে এত রাত্রেও উঠে রেঁধে দেবে। বাংলোর মালিকও খুব ভদ্রলোক—তাঁর সঙ্গেও দেখা হতে পারে।’
কেবল শোওয়ার জায়গাই নয়, খাওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। বাসের কল বিগড়ে ভালোই হয়েছে বলতে হবে।
একেই বলে বরাত! না চাইতেই বর পাওয়া!
যাক, বাস থেকে নেমে রওনা তো দিলাম। চষা জমির ওপর দিয়ে, খানাখন্দে না পড়ে, হাত-পা না ভেঙে, আল এবং টাল সামলে, কোনও গতিকে, কেবলমাত্র আকাশের চাঁদের সাহায্যে সেই বাগান-ঘেঁষা বাংলোয় তো গিয়ে পৌঁছলাম।
ভেবে কাহিল হচ্ছিলাম, অনেক ডাকাডাকি করতে হবে, বন্ধুর জন্যে যে-প্ল্যান আঁটা ছিল, বাবুর্চির ওপরেই প্রয়োগ করতে হবে হয়তো। কিন্তু না, কাছাকাছি হতেই বাংলোর একটা ঘরে আলো জ্বলছে এবং দরজাটাও খোলা দিব্যি চোখে পড়ল!
আস্তে-আস্তে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি—গলাখাঁকারি দেব কি না ভাবছি—এমন সময়ে—ও মা!
ভয়ানক এক দৃশ্য আমার চোখের সামনে উদঘাটিত হল!
ঘরের মাঝখানে, খাটে বসে সেই বাংলোর মালিকই হয়তো, হৃষ্টপুষ্ট একজন মানুষ, যেমন লম্বা তেমনি চওড়া—পাক্কা তিন মনের কম নয়। শুধু একটি চুল বাদে সারা মাথায় তার টাক—সেই চুলটিই কেবল খাড়া হয়ে আছে। তার ডান চোখের ওপরে কালো একটা ছোপ এবং ডান হাতের পিঠে সবুজ উলকি দিয়ে হরতনের টেক্কা আঁকা।
এবং তারই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আর-একটা মুশকো লোক, তার হাতে রিভলভার। দোরগোড়াতেই দাঁড়িয়ে।
আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম দরজার আড়ালেই। চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়লাম বলাই ঠিক। মাটিতে হঠাৎ এঁটে গেলাম যেন।
সেই তিনমনি লোকটা বলছিল, ‘দ্যাখো, আমাকে মারাটা তোমার ভালো হচ্ছে কি? আমায় মেরো না। এখনও আমার বয়েস আছে, দাঁতও রয়েছে। খুব বুড়ো হয়ে পড়িনি এখনও, এখনও আমায় বাতে ধরেনি। চোখে ছানি না পড়তেই মারা পড়ব, সেটা কি ভালো? বলো, তুমি তামাশা করছ, ঠাট্টা করছ, বলো? সত্যি-সত্যি মারছ না আমায়? অ্যাঁ।’
পিস্তল হাতে লোকটি খকখক করে একটু হাসল—হাসল কী কাশল বলা শক্ত ‘হাঁ, মারব না। তাই বইকি! এত কাণ্ড করে এত কষ্ট করে শেষটায় তোমাকে না মেরেই চলে যাই আর কী!”অমাবস্যার আর্তনাদ” বইটা তুমি পড়োনি তাই এই কথা বলছ! ”ধরো আর মারো”—সেই বইটাও তোমার না পড়াই রয়ে গেছে মনে হচ্ছে। কী করব, এ-জীবনে তুমি আর পড়বার ফুরসত পাবে না, আমি নাচার—নাও, প্রস্তুত হও।’
এই বলে তিনমনি লোকটাকে প্রস্তুত হওয়ার, কিংবা দ্বিতীয় কোনও কথা বলবার অবকাশ না দিয়েই…।
‘গুড়ুম! গুড়ুম! গুম!’
সেই মুশকো লোকটার হাতের পিস্তলটা বাক্যব্যয় করতে শুরু করল।
তিনমনি লোকটার মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। এবং আমিও ধুপ করে বসে পড়লাম, সেইখানেই।
পিস্তলহস্ত লোকটার নজর আমার দিকে পড়ল এবার।
‘কে হে? তুমি আবার কে এসে জুটলে এখানে? গোয়েন্দা-টোয়েন্দা নও তো?’
‘আজ্ঞে না।’ ভয়ে-ভয়ে বলি সবিনয়েই, ‘এমনি এসে পড়েছি। একেবারেই দৈবাৎ! এমনি এসে পড়ে না কি মানুষ? গল্পের বইয়েও তো এসে পড়ে—আপনার ওই বই দুটোতেও কতবার এসেছে দেখতে পাবেন। তবে যদি বলেন, অনুমতি করেন যদি, তাহলে এখান থেকে চলে যেতেও আমি নিতান্ত অনিচ্ছুক নই—’ বলতে-বলতে আমি উঠে পড়ি।
‘উঁহু, সেটি হচ্ছে না। যখন এসেই পড়েছ তখন—।’
তার অঙ্গুলি-হেলনে—পিস্তল-হেলনে বললেই যথার্থ হবে, আবার বসে পড়তে হয়।
‘তাহলে যদি আপনার অভিরুচি হয়, নেহাত অনিচ্ছা না থাকে—’ আবার শুরু হয় আমার, ‘আপনি আমাকে মারতেও পারেন। ওই পিস্তল দিয়েই মারতে পারেন, আমার তেমন খুব আপত্তি নেই। যদিও আমার দাঁত পড়েনি—তবে বাত ধরেছে কি না বলতে পারব না। তবু যে-কারণেই হোক, বাঁচতে আমার আর লালসা নেই। বেঁচে কী হবে? বেঁচে লাভ? আপনার উল্লিখিত ওই বই দুটো আমি পড়েছি। এই সেদিনই তো পড়লাম। তাই পড়বার পর থেকেই আমার বাঁচবার স্পৃহা লোপ পেয়েছে। সেই বই থেকে জানা যায়, এরকম স্থান-কালে মারাই উচিত, এবং মরাটাই বাঞ্ছনীয়। এরকম সুযোগ ফসকাতে দেওয়া ঠিক নয়। আপনারও না, আমারও না। এ রকম অবস্থায় মরলে, মরতে পারলে, কেউ-না-কেউ আমাদের এই অ্যাডভেঞ্চার লিখে ফেলবেই, আর, মরে অমর হতে কে না চায়? এবং মেরে হতে পারলে তো কথাই নেই!’
‘উঁহু, মরা অত সহজ নয় হে, ফাজিল ছোকরা! অমর হওয়া অত সস্তা না। ইয়ার্কি পেয়েছ নাকি? যেখানে আছ সেইখানে চুপটি করে বসে থাকো। আমাকে আগে ভাবতে দাও। এক রাত্রে একটা খুনই যথেষ্ট কি না, ভেবে দেখি। যদি মনে হয় আরও একটা হলে মন্দ হয় না তখন না হয় তোমাকে দেখা যাবে। ”হত্যা-হাহাকার” বইটা তুমি পড়েছ নাকি? ওটাতে এক রাত্রে ক’টা খুন ছিল? ও-বইটা আমি অনেক খুঁজেছি, পাইনি বাজারে, কার লেখা তাও জানি নে। কার লেখা?’
‘আজ্ঞে, আমি লিখিনি। অ্যাডভেঞ্চার আমার বড় আসে না।’
‘ফের বাজে কথা! অমন করলে, কথার ওপর কথা বললে—ওরকম বাজে বকলে, খুন না করেই—হ্যাঁ, বলে দিচ্ছি, খুন না করেই গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেব তোমায়—সোজা তাড়িয়ে দেব, মনে থাকে যেন। অমর হওয়ার পথ চিরদিনের মতো রুদ্ধ করব, হুঁ।’
ভয় পেয়ে আমি চুপ মেরে গেলাম। অনেকক্ষণ চুপচাপ।
মুশকো লোকটা আপনমনেই বলতে থাকে হঠাৎ, ‘আচ্ছা, এক কাজ করলে কেমন হয়? এর মুন্ডুটা কেটে নিয়ে সেই কাটা মুন্ডুটা ম্যাজিস্ট্রেটকে গিয়ে প্রেজেন্ট করলে কেমন হয়? স্ট্রেট একেবারে ম্যাজিস্ট্রেটকে? কোনও অ্যাডভেঞ্চারের বইয়ে এরকমটা ঘটেছে কি? ওহে—ও! পড়েছ নাকি হে কোনও বইয়ে?’
আমাকে উদ্দেশ করেই হাঁক পড়ে, বেশ বুঝতে পারি। অগত্যা বলতে হয়, ‘ঘটা আর বিচিত্র কী! এরকম ঘটেই থাকে। না পড়লেও, বলে দিতে পারি।’
‘আঃ, বড্ড তুমি বাজে বকো। বলছি না যে, আমায় বকিয়ো না। ভাবতে দাও আমায়।’
এরপর সেই হত্যাকারী ভদ্রলোক একেবারেই ভাবনা-সাগরে নিমগ্ন হলেন।
ভেসে উঠলেন সেই ভোরবেলার দিকে। বাবুর্চি এসে পড়তেই ভেসে উঠতে হল। বাবুর্চির হাতে ব্রেকফাস্টের ট্রে, তাতে রুটি, মাখন, চা, ডিম—হৃষ্টপুষ্ট লোকটির জন্যেই আনা হয়েছিল বেশ বোঝা যায়। দরজার বাইরে ওইভাবে-বসানো আমাকে এবং দরজার ভিতরে সেই মুশকো লোকটিকে দেখেই বাবুর্চির মুশকিল ঠেকেছিল। তারও পরে, অস্ত্রশস্ত্র, খুনখারাপি ইত্যাদির আমদানি দেখে চায়ের ট্রে ফেলে দিয়ে পিঠটান দেওয়াই সমীচীন হবে কি না চিন্তা করছে বেচারা। এমন সময়ে সেই হত্যাকারী হঠাৎ হাহাকার করে ওঠে, ‘হয়েছে, হয়েছে, ইউরেকা! নিয়ে এসো।’
পিস্তলচালিত হয়ে বাবুর্চি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ব্রেকফাস্টের ট্রে মুশকো লোকটির সম্মুখে ধরে দেয়, এবং নিজে এগিয়ে ধরাশায়ী সেই তিনমনির পাশে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
‘এই কথাই ভাবছিলাম। এই টোস্ট-রুটির কথাই! খুন তো করলাম, কিন্তু তার পরে কী করা যায়, এতক্ষণ ধরে সেই কথাই ভাবছিলাম। এই তো চমৎকার হাতের কাজ রয়ে গেছে! বাঃ-বাঃ! বেশ বানিয়েছ তো টোস্টগুলো। ডিমসেদ্ধও নেহাত মন্দ করোনি তো!’
বাম হস্তে পিস্তল ধারণ করে সেই মারখুনে লোকটা ডানহাতের সদ্ব্যবহার শুরু করে দেয়।
আমিও সে-তালে একটু ফাঁক পেতেই সরে পড়ি সেখান থেকে।
ছুট! ছুট! ছুট! একেবারে সেই বড়রাস্তায়—ডায়মন্ডহারবার রোডে। কিন্তু কোথায় বা সেই বাস! কা কস্য পরিবেদনা! সদ্য উত্থিত একজন প্রাতঃকৃত্যকারীর কাছ থেকে থানাটা কোন দিকে জেনে নিয়ে আবার দৌড় লাগাই।
মাইলদেড়েক দৌড়ে পৌঁছলাম গিয়ে থানায়। একছুটেই উঠলাম গিয়ে থানার উঠোনে।
বাংলোর মালিককে বাংলোর মধ্যেই খুন করে রেখেছে, এক্ষুনি দারোগাকে খবরটা জানানো দরকার। হন্তদন্ত হয়ে, এখুনি গেলে—এখনও গেলে, হাতে-নাতে খুনেটাকে পাকড়ানো যায় হয়তো।
‘পাহারোলা’র ইঙ্গিতে বুঝলাম, দারোগাবাবু ভেতরে আপিসঘরেই।
একলাফে ধাপ ক’টা টপকে দরজা ঠেলে আপিসঘরে ঢুকলাম।
ঢুকে কী দেখলাম? দেখলাম কী?
দেখলাম দারোগাবাবুটি যেমন লম্বা তেমনি চওড়া—বেশ হৃষ্টপুষ্ট মানুষ—পাকা তিনমনের কম যান না—পেল্লায় পরিধি নিয়ে তাঁর চেয়ারে বসে রয়েছেন। তাঁর ডান চোখের কাছটায় কালো ছোপ, এবং ডানহাতের পেছনে সবুজ উলকিতে হরতনের টেক্কা। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার, ভদ্রলোকের দেহে প্রাণ নেই—পিস্তল দিয়েই তাঁকে খুন করেছে স্পষ্টই বোঝা যায়। সোজা তাঁর বুকের ভেতর দিয়ে গুলি চলে গেছে সটান।
হ্যাঁ, তাঁরও সারা মাথায় ঝাড়া টাক, শুধু একটিমাত্র চুল খাড়া দাঁড়িয়ে।
অন্তরালে
পুজো সংখ্যা, ১৯৬৫