1 of 2

কার পাপে – অপরূপ

কার পাপে – অপরূপ

চা-বাগানের কাজ নিয়ে এসেছে দেবাশিস। নির্জনতা ভালো লাগে ওর। এ ছাড়া আর উপায়ও ছিল না। শহরের কোলাহল ভুলেই গিয়েছে বলা চলে। ভুলতে হয়েছে বাধ্য হয়ে, কেন না ও প্রায় দীর্ঘ ছ’বছর শুয়েছিল হাসপাতালে। জীবনের একটা অধ্যায় কাটিয়ে দিল যাদবপুর যক্ষ্মা হাসপাতালে। কারও বিরুদ্ধে নালিশ নেই দেবাশিসের। বরং শুয়ে-শুয়ে দুঃখ পেত। ওর নিজের জন্য নয়, মায়ের কথা

ভেবে-ভেবে। বেচারি মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো আর কেউ রইল না বুঝি। এমন অনেকদিন গেছে, দেবাশিস ঘুমুতে পারেনি। মায়ের করুণ মুখখানি ভেসে উঠত দেবাশিসের চোখে। পাশের বেডে সুব্রত মাঝে-মাঝে ককিয়ে উঠত—বিড়বিড় করে বলত, উঃ মাগো! যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও। আমাকে বাঁচতে দাও। দেবাশিস ব্যথা পেত। ওয়ার্ডের বাইরে বাঁধানো একটা নিম গাছ। নীচে জড়োকরা অন্ধকার। দেবাশিস তাকিয়ে থাকত প্রায়ই। ওয়ার্ডের বাতি নেভার সঙ্গে-সঙ্গে ওই ছায়াগুলো গাঢ় হয়ে যেত। ক্রমশ হামাগুড়ি দিয়ে সমস্ত ওয়ার্ডটা দখল করে নিত। ভয়ে শরীরটা শিরশির করে উঠত দেবাশিসের। অন্ধকারে ওয়ার্ডের কতকগুলো প্রেতাত্মার শ্বাস-প্রশ্বাসের গন্ধ ভেসে বেড়াত। বাবাকে স্পষ্ট মনে পড়ে দেবাশিসের। যৌবনে তখনও পদার্পণ করেনি দেবাশিস। বাবা বাইরে কাজ করতেন। দার্জিলিং-এর কাছাকাছি কোনও চা-বাগানের ডাক্তার ছিলেন নাকি। উচ্চ মধ্যবিত্ত ছিল ওরা এককথায় বলা চলে। মা আর দেবাশিস থাকত কলকাতায়। বাবা মাঝে-মাঝে ছুটিতে আসতেন। বাবাকে ভয় পেত দেবাশিস। মাকে বাবা খুব ভালোবাসতেন, কখনও-কখনও আদর করতেন। বড় গম্ভীর ছিলেন বলেই দেবাশিস কাছে বড় বেশি একটা এগুত না। দেবাশিস জানে, কতবার দেখেছে বাবাকে। তাই কিছুতেই বিশ্বাস হয় না দেবাশিসের, বাবা নাকি ভীষণ প্রহার করেছিলেন মাকে একবার। এ-কথা শচির মামা বলেছে দেবাশিসকে।

 না—না, কিছুতেই না। অবিশ্বাস্য। এ হতে পারে না। না—না! —আর্তনাদ করে উঠত দেবাশিস। টর্চের আলো এসে পড়ত দেবাশিসের চোখে। সিস্টার সেবা এগিয়ে আসত কাছে, মাথার চুলে হাত বোলাতে-বোলাতে বলত, একটু ঘুমুতে চেষ্টা করুন।

কী যেন জাদু জানত সিস্টার সেন। দেবাশিস অন্ধকারে চোখ দুটোকে ভাসিয়ে দিয়ে চুপ করে যেত।

পাশের বেডে সুব্রতর সঙ্গে অনেক কথা হত দেবাশিসের। সুব্রত ভেঙে পড়ত মাঝে-মাঝে, আর বলত দেবু, জীবনকে পেলাম না বোধহয়।

সান্ত্বনা দিতে গিয়ে দেবাশিস আঁতকে উঠত। কালো হয়ে আছে রক্তের দাগ সুব্রতর দু-গালের ঠোঁটের ফাঁকে। আলতো স্পর্শ করত দেবাশিস নিজের ঠোঁটের দু-পাশে। বোধহয় গতরাতে ব্লিডিং হয়েছে সুব্রতর।

সেই সুব্রত জীবনকে আর পায়নি। স্বচক্ষে দেখেছে দেবাশিস। বাঁচতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল বেচারি। সমস্ত বিছানাটা রক্তে মাখামাখি ছিল। দেখলে মনে হয় কেউ খুন করে গেছে ওকে। বাঁ-হাতটা বালিশের তলায় দিয়ে ডানহাতের শক্ত মুঠোয় আঁকড়ে ধরে রেখেছিল বালিশটা। ঠোঁটটা কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে ছিল, আর রক্ত গড়াচ্ছিল।

সকালে লাশ সরানোর সময় দেবাশিস মুখ ঢেকে কেঁদেছিল। ওয়ার্ডার দুটোর চোখ এড়ায়নি। শুনতে পেয়েছিল দেবাশিস, একজন বলছে, ১৭ নম্বর লোকটা কাঁদছে রে। শালার ভীষণ ভয় ধরে গেছে, বুঝলি!

অপরটা নিচু গলায় বলল, শালা, তুই চুপ কর দিকিনি! শুনতে পেলে ওটাও অজ্ঞান হয়ে যাবে। তুই বরং খরচের খাতায় আর-একটা দাগ দিয়ে রাখিস।

সিস্টার সেন টেম্পারেচার নিতে এসে দেবাশিসের কাঁধে আলতো স্পর্শ করে জিগ্যেস করেছিল, খুব খারাপ লাগছে মনটা, তাই না?

—সিস্টার!

—অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারলুম না, দেবাশিসবাবু। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে—। —আর আত্মসংবরণ করতে পারলেন না সিস্টার সেন। কান্না মেশানো কণ্ঠে বললেন শুধু, এবার আমার ছুটি। আমাকে চলে যেতে হবে এখান থেকে। আপনার অজানা কিছুই তো নেই, দেবাশিসবাবু। এখানে আর একদণ্ড থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব নির্ঘাত।

—কিন্তু সিস্টার! —সিস্টার সেনের চোখে চোখ রাখে দেবাশিস।

—ভালোবেসেছিলাম শুধু সুব্রতকে। —ঘনায়মান স্বপ্ন-ছাওয়া দু-চোখ মেলে ক্লান্ত সুরে বলল সিস্টার সেবা সেন, সুব্রতর বাঁচার আকাঙ্ক্ষা ছিল, দেবাশিসবাবু। সে একমাত্র আমার…।

অল্পক্ষণের জন্য চুপ করে থাকে সেবা। যেন দশ বছরের পুরু যবনিকা তুলতে সময় লাগে ওর। তারপর ক্ষীণ স্বরে বলে উঠল আবার, সুব্রতকে আর বাঁচাতে পারব না যেদিন জানলাম, সেদিন আমি একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাম। আর তা ছাড়া সুব্রত প্রায়ই বলত, করুণভাবে বলত, ‘আমাকে পারো না কি মেরে ফেলতে, সেবা? আমার জন্যে দীর্ঘ এতগুলো বছর ধরে মিছিমিছি পরিশ্রম করছ। রোগের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও, সেবা—আমার ভারি কষ্ট হচ্ছে।’

—সুব্রতর তখনকার অবস্থা ভেবে, তার ঝিমিয়ে পড়া কথাগুলো শুনে আশ্চর্য হইনি, দেবাশিসবাবু। বরং মায়া হল। সেদিনের সেই ক্ষিপ্ততা আমার মনের শয়তানটাকে জাগিয়ে তুলবে তা কি তখন ভেবেছিলাম!—বলতে-বলতে খিলখিল করে হেসে উঠল সিস্টার সেন।

দেবাশিস ডাকল, সিস্টার।

তারপর হতাশভাবে দেবাশিসের পাশে একটা চেয়ারে বসে পড়েছিল ধপ করে। বলেছিল, শেষপর্যন্ত খাওয়ার ওষুধের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিয়েছি। আমার জীবনের সব সাধ আর কামনায় চিরকালের জন্যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছি, দেবাশিসবাবু। আচ্ছা, নমস্কার। —বলেই বিদ্যুতের মতো উঠে দাঁড়িয়ে ঝড়ের মতো বেরিয়ে গিয়েছিল সিস্টার।

দিনদুই পরে সিস্টার সেনের মৃতদেহটা উদ্ধার করা হয়েছিল হাসপাতালের সংলগ্ন ঝিল থেকে। পচে উঠে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল সমস্ত বাতাসে।

ছুটি পেল দেবাশিস তার তিনদিন পরেই। ভালো হয়েছে ও। সিস্টার সেবা সেন আর নেই। সুব্রতর বেডে আর-একটি প্রৌঢ় লোক এসেছে। তবু সেবার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চাপা ফিসফিসে আলোচনার শেষ হয়নি। সেসব তীক্ষ্ন বাণ থেকে দেবাশিসও নিস্তার পায়নি। প্রতিবাদ করেনি, কেন না দেবাশিসের অজানা কিছুই ছিল না। সুব্রতও বলেছিল অনেক…অনেক কথা।

মায়ের কোলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে দেবাশিস। কিন্তু দুঃখ পেয়েছিল একটা কথা মনে পড়তেই। সুব্রত বলেছিল, দেবু তুমি ভালো হয়ে যাবে জানি…মাকে কাছে পাবে। মা তোমায় আদর করবে। কিন্তু আমি! আমার তো আর মা নেই, তাই বুঝি মরে মায়ের আদর পাব।

দেবাশিস কপট ভর্ৎসনা করে বলেছিল, ছিঃ, সুব্রত! ভেঙে পোড়ো না নিজে। সাহস রাখো মনে। তুমিও ভালো হয়ে যাবে, সুব্রত। দুজনে একসঙ্গে মায়ের কাছে ফিরে যাব। আমার মা-ও তো তোমার মা।

প্রত্যুত্তরে সুব্রত খানিকটা শুকনো হাসি হেসেছিল মাত্র।

মায়ের কাছে বেশিদিন থাকতে পারেনি দেবাশিস। হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়ার সময় ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিলেন চেঞ্জে যেতে। দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। ছোট একটা কাজের সংস্থান নিয়ে ও চলে আসে দার্জিলিং-এর শৈলাবাসে। চাকরিটা খুব একটা পরিশ্রমের ছিল না। আপিসে হিসাব-রক্ষকের কাজ করতে হত বসে-বসে। আসার দিন বাবার বড় অয়েল পেইন্টিংটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে কী যেন ভেবেছিল দেবাশিস। তারপর মাকে প্রণাম করে উঠতেই বুকে টেনে নিয়েছিলেন মা। আশীর্বাদ করতে-করতে বলেছিলেন তিনি, খোকা, বাবাকে ভুলতে চেষ্টা করিস। আমি যে তোর পানেই তাকিয়ে রয়েছি, বাবা।

মায়ের কথা স্মরণে আছে দেবাশিসের। কিন্তু বাবাকে মুছে ফেলতে পারেনি কিছুতেই। দেবাশিসের কাছে বাবার সব কথাই চেপে গেছেন মা। তবে মাকে প্রহার করে সেই যে বেরিয়ে গেছেন আর ফেরেননি নাকি বাবা। কিছুদিন পর খবর এসেছিল, বাবা নাকি ঘোড়া থেকে পড়ে পাহাড়ের খাদে মারা গিয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুসংবাদের সময় দেবাশিস মায়ের কাছেই ছিল। মা কিন্তু একটুও কাঁদেননি, বরং খুব খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু কেন? কী রহস্য! সে-কথা জানতে পারেনি দেবাশিস। তাই এই চা-বাগান বাবার স্মৃতিকে স্মরণ করিয়ে দেয় সবসময়।

প্রায় দিনের মতো সেদিনও একটু বেড়াতে বেরিয়েছিল দেবাশিস। প্রত্যেকটি চা-গাছে তখন নতুন কচিপাতা অনেক এসেছে। দুটি পাতা আর একটি কুঁড়ি। এগুলোকে তুলে নিয়ে কালো চা-তে পরিণত করে বিদেশে চালান দেওয়া হয়। অনেক পয়সা এতে। বহু লোকের জীবিকা এই চা-গাছগুলো। দেখে দেবাশিসের মনে খুশির জোয়ার খেলে যায়। একহাতে ওদের নরম পাতা স্পর্শ করে পথ চলে দেবাশিস। চড়াই-উতরাই ভেঙে-ভেঙে অনেকটা পথ নীচে নেমে এসেছে ও। দেবাশিসের খেয়াল হল সন্ধ্যা হতেই। আস্তে-আস্তে ফেরার পথ ধরে আবার। খানিকটা উঠে একটু বিশ্রাম করে নেয় দেবাশিস। পায়ে চলার সঙ্গে-সঙ্গে পাথরের শব্দ হচ্ছিল পিছনে। মনে হয় কেউ অনুসরণ করছে দেবাশিসকে।

হঠাৎ খিলখিল শব্দে পিছনে ফিরে তাকায় দেবাশিস। দ্যাখে—একটা কুলি মেয়ে, পিঠে একটা বেতের ঝুড়ি, তাতে খানকয়েক শুকনো গাছের ডাল। কুড়িয়ে এনেছে নিজেদের রোজকার ব্যবহারের জন্য।

আবছা আলোয় দেবাশিস চিনতে পারে মেয়েটাকে। অনেকদিন দেখেছে ওকে। দেবাশিসের দিকে মেয়েটা প্রায়ই তাকিয়ে থাকত। চারিদিকে দৃষ্টি ফ্যালে দেবাশিস—না, কাছে-পিঠে কেউ নেই। চিন্তিত হয়ে পড়ে দেবাশিস। কেউ কুৎসা রটাতে পারে এই নির্জনতার সুযোগ নিয়ে। নির্বাক থেকে নিজের পথ ধরে। আবার হাসি। একটানা হেসেই চলেছে মেয়েটা। পাহাড়ে-পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ওর হাসি। বিরক্ত হয় দেবাশিস। হাওয়ায় বৃত্ত এঁকে দাঁড়াল একেবারে মুখোমুখি। জিগ্যেস করে, এ কী, ফুলমায়া! হাসছ কেন?

ফুলমায়া তখনও হাসি থামায়নি।

ধমকে উঠল দেবাশিস, কী হয়েছে তোমার!

হাসতে-হাসতে ফুলমায়া বলে উঠল, বাবু! ডর লাগদাই না তিমরো?

—কেন! কিসের ভয়!—দেবাশিস চমকায়।

—বাঘ বন্দেলকো!—টুকরো-টুকরো হাসে ফুলমায়া।

—এসময় কি বাঘ, শুয়োর বেরোয়!—নিঃশ্বাস নেয় দেবাশিস খানিকটা। অবশেষে ঘুরে দাঁড়ায়। আবছা অন্ধকার হয়ে গেছে তখন। বুনো মুরগিগুলো পাখা ঝাপটায় আশেপাশের ঝোপে ঝাড়ে। পিছু থেকে হঠাৎ অদ্ভূত আওয়াজ করে ওঠে ফুলমায়া।

—বাবু। উ—খুন!—বলতে বলতে দেবাশিসের পায়ের কাছে ধপ করে ধসে পড়ে। দেবাশিস লক্ষ করে তার বাঁ-পায়ের মধ্যমা দিয়ে রক্ত ঝরছে। বাঁধা দেওয়ার আগেই ফুলমায়া দেবাশিসের পা শক্ত করে ধরে ফেলেছে। অপর হাতে নিজের ওড়নার খানিকটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে ক্ষতস্থান বেঁধে দিতে-দিতে বলে উঠল, ঘড় মা গায়েরে দাওয়াই দিনু, বাবু। ল!

লজ্জিত হয়ে পড়ে দেবাশিস। মৃদু গলায় বলল, আজ আর ওষুধ দিতে পারব না ফুলমায়া।

—কিনো?—সোজা হয়ে দাঁড়ায় ফুলমায়া।

—দাওয়াইখানার চাবি তো আমার কাছে থাকে না তাই।

ফুলমায়া যেন বুঝতে পেরেছে কারণটা, তাই সাবধান করে দেয় অন্ত পানি ন লামানু, বাবু।

দেবাশিসের পা টা ভারি হয়ে গিয়েছে বলে মনে হল। খুব জোরে বেঁধেছে মেয়েটা। অনেকটা উঠে এসেছে দেবাশিস। ফুলমায়া পিছু-পিছু আসছিল, দু-জোড়া পায়ের ঝুপঝাপ শব্দ হচ্ছিল কেবল।

দেবাশিস হাঁপিয়ে ওঠে। কামারশালার হাপরের মতো বুকটা ওঠা-নামা করে দেবাশিসের। ক্লান্ত, খুব ক্লান্ত ও। একটা পাথরের ওপর বসে খানিকটা বিশ্রাম নেয়। ফুলমায়া পাশে এসে দাঁড়ায়। ঝুড়িটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখে। দেবাশিস তাকায় আকাশের দিকে। চাঁদ উঠেছে পাহাড়ের মাথায়। ফুলমায়ার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে নিল। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখে দেবাশিস, এক-একটা প্রকাণ্ড কচ্ছপের পিঠের খোলের মতো দেখাচ্ছে গায়ে-গায়ে নিদ্রালসতাপূর্ণ পাহাড়গুলোকে। কারও মুখে কোনও কথা নেই। দুজনেই ক্লান্ত আজ। অনেকক্ষণ কেটে গিয়েছে, রাতও বেশ হয়ে গিয়েছে। নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে বলে উঠল দেবাশিস, ফুলমায়া, তুমি বাড়ি যাবে না?

এমন ধরনের কোনও প্রশ্নের আশায় ছিল বোধহয় ফুলমায়া, সুতরাং সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দিল, জ্বালানি পায়ো না ভনে, মেরো মরদলে ঘর না পশনু দিন্দাইনী, বাবু।

দেবাশিস হাসল কেন? তোমার মরদ নিজে জ্বালানি জোগাড় করতে বেরোয় না কেন?

ফুলমায়া অন্তরে আঘাত পেল। প্রত্যুত্তরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল।

—কই, কিছু বলছ না যে, ফুলমায়া!

—কী বলব, বাবু। তোমাদের মেয়েদের যে মর্যাদা দেওয়া হয় আমাদের বেলায় তা কোনওদিন হবে না।

আশ্চর্য হয়ে যায় দেবাশিস। পরিষ্কার বাংলা বলছে মেয়েটা।

অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ফুলমায়ার দিকে।

খিলখিল শব্দে ছোট ঝরনার মতো হাসতে-হাসতে বলে ফুলমায়া, অবাক হচ্ছ তাই না, বাবু! তোমাদের ভাষা বলছি বলে?

—ফুলমায়া!—কৌতুহল জাগে দেবাশিসের।

—বাবু।

—তোমার আসল পরিচয় কী? কোথায় তোমার জন্ম? কেমন করেই বা এত পরিষ্কার বাংলা শিখেছ?

—অতগুলো প্রশ্নের জবাব একসঙ্গে কি দেওয়া যায়!

—হ্যাঁ, দিতে হবে তোমাকে।—দেবাশিস ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

ফুলমায়া হাসে তখনও, বলে, একে-একে তোমার প্রশ্নের জবাব দেব, বাবু। তবে কাউকে বলতে পারবে না, কথা দাও।

কথা দেয় দেবাশিস। আরও ঘন হয়ে বসে ফুলমায়া দেবাশিসের পাশে। বুনো মুরগিগুলো ডেকে ওঠে একসঙ্গে। পাখা ঝাপটাতে থাকে অনবরত। দেবাশিস ভয় পায়। ফুলমায়া অভয় দিয়ে ওঠে।

—ওগুলো বসার জায়গা নিয়ে মারামারি করছে বোধহয়।

দেবাশিস চঞ্চল হয়ে পড়ে। একমুঠো শীতল বাতাস মাতলামি করতে থাকে। দেবাশিসের শীত-শীত করে ওঠে।

—বাবু,—মৃদু ডাকে ফুলমায়া।

দেবাশিস নড়ে বসে বলো ফুলমায়া তোমার কথা।

ফুলমায়া বলতে শুরু করে।

—আমার বাবা ছিলেন বাঙ্গালি আর মা নেপালি।

দেবাশিসের উৎকণ্ঠা জাগে। বুকটা আবার ব্যথা করছে দেবাশিসের। বাধা দেয় না ফুলমায়াকে।

—সাধারণত আমার মাতৃভাষা নেপালি হওয়াই উচিত, তাই না বাবু?

—হুঁ।

—কিন্তু বাবার কাছে আমার শিক্ষাদীক্ষা। বাঙ্গালি স্কুলে আমাকে পড়াশুনা করতে হত। একটু বড় হতেই বাবা তার মেয়েকে পাঠিয়ে দেন কলকাতায়। হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা শুরু করি আমি। বাঙ্গালির পরিবেশে থাকতে-থাকতে খাঁটি বাংলা ভাষা আয়ত্ত করে নিয়েছিলাম অতি সহজে। বাবাকে ঘিরেই আমার সব প্রেরণা, কেন না বাবাকে আমি খুব ভালোবাসতাম।

একটু থেমে কী যেন চিন্তা করল ফুলমায়া।

দেবাশিস তাড়া দিয়ে ওঠে, তারপর!

—তারপর…হ্যাঁ, বাবার পেশাটাই তোমাকে বলা হল না, বাবু।

—কী করতেন তোমার বাবা, ফুলমায়া?—জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অস্পষ্ট ফুলমায়ার দিকে তাকায় দেবাশিস।

—বাবা ছিলেন কার্শিয়াং-এর এক চা-বাগানের ডাক্তার।

দেবাশিস চমকাল। মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। মনে হতে লাগল এক্ষুনি বুঝি রক্তক্ষরণ হবে। নিজেকে সামলে নেয় দেবাশিস।

—তোমার বাবা ডাক্তার ছিলেন বুঝি, ফুলমায়া?

—হ্যাঁ, বাবু। বাবা যে বড় ডাক্তার ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। কলকাতায় বাড়ি ছিল বাবার। বাবা নাকি আর-একটা বিয়েও করেছিলেন প্রথম।

দেবাশিস অন্ধকার দেখল সমস্ত চোখে। পা-দুটো ভীষণ কাঁপছে, বোধহয় মূর্ছা যাবে। মৃদু গলায় তবু বলে দেবাশিস, শেষ করে যাও তোমার কথা, ফুলমায়া।

—বাবা ওই চা-বাগানেরই হাসপাতালে একটি গরিব পাহাড়ি মেয়েকে কঠিন রোগের হাত থেকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন। পরে তাকেই বিয়ে করেছিলেন। মা ছিলেন সেই বাগানের এক ওপরওয়ালার বড় মেয়ে। বিনা দ্বিধায় বাবা আমার মাকে স্ত্রী বলে মেনে নিয়েছিলেন।

দেবাশিস আবার নড়ে বসল। সমস্ত অন্তর ঘৃণায় রি-রি করে উঠল। কঠিন হয়ে গেল দেবাশিস। গাঢ় স্বরে জিগ্যেস করে, তোমার বাবার প্রথম স্ত্রীকে দেখেছিলে তুমি, ফুলমায়া?

—হ্যাঁ, একবার কিছুক্ষণের জন্যে দেখেছিলাম। শান্ত স্নিগ্ধ মূর্তি যেন, সেই মা আমার।

দেবাশিস দাঁতে দাঁত ঘষে এই সামান্য মেয়েটার ‘মা’ সম্বোধনে।

জিভের ডগা দিয়ে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নেয় দেবাশিস। শান্ত হয়ে আবার জিগ্যেস করল, কেমন করে প্রথম ভদ্রমহিলাকে চিনতে পারলে?

—সেই চেনা এক তাজ্জব ঘটনা, বাবু। বাবার খোঁজে একবার আমাদের বাগানে এসেছিলেন, কিন্তু….।

—কী? কী কিন্তু, ফুলমায়া! লুকিয়ো না আমায়। জানতে দাও তারপর কী হয়েছিল?

দেবাশিসের কঠিন স্বরে ভয় পেয়ে ফুলমায়া অনুমান করতে চেষ্টা করে কারণটা।

—চুপ করে গেলে কেন? কই, তোমার কথা বলো। সেই ভদ্রমহিলার কথা, তোমার বাবার কথা,—দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলে দেবাশিস।

বাবু! কী হয়েছে তোমার!

নিজের রুক্ষ স্বর কানে বাজে দেবাশিসের। লজ্জা পায়, নিচু গলায় বলে আবার, তোমার প্রথম মা কিছু বলেনি তোমাকে!

—বলার সময় পেলেন কই! আমার মা কী যেন বোঝাচ্ছিলেন নেপালি আর ভাঙা-ভাঙা বাংলা ভাষায়। বাবা একটা কোণে চেয়ারে বসেছিলেন। ঘন-ঘন সিগারেট খাচ্ছিলেন। প্রথম মা আমার মায়ের দিকে ভুলেও তাকালেন না। বরং হঠাৎ বাবার কাছে দৌড়ে গেলেন। জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন, আর বলেছিলেন, ‘আমার কী অপরাধ বলো। কেন আমায় এত কষ্ট দিলে? ছেলে জানতে চাইলে কী বলব তাকে?’ বাবা ফ্যালফ্যাল করে প্রথম মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মা তখনও কাঁদছিলেন, বলেছিলেন, ‘চুপ করে থেকো না। খোকা প্রায়ই জানতে চায় তার বাবা কবে আসবে বাড়িতে।’ আমি তখন জানতে পারলাম, আমার একটি দাদা আছে। বাবা সেই যে বোবা হয়ে রইলেন, আর একটিও কথা বললেন না। তেমনি কাঁদতে-কাঁদতে মা চলে গেলেন। আর দেখিনি। তবে শুনেছি, বাবা বলতেন, আমার দাদা আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়।

দেবাশিস বড় করে নিঃশ্বাস নিল। এক অব্যক্ত ব্যথায় বুকটা টনটন করে উঠল। খুকখুক করে কেশে উঠল দেবাশিস। মাথার যন্ত্রণা তখনও সারেনি। মাকে মনে পড়ে যায় দেবাশিসের।

মা বলতেন, খোকা আমার। তুই আমার একমাত্র সম্বল। আমি তো কোনও অপরাধ করিনি, বাবা। তবু ভগবান আমায় অমৃত থেকে বঞ্চিত করেছেন কেন জানি না।

কাঁদতেন তিনি। অঝোরে অশ্রু ঝরে পড়ত দু-চোখ বেয়ে। মায়ের চোখে জল দেখে দেবাশিসও ডুকরে কেঁদে উঠত। মা ছেলেকে বুকে জাপটে ধরে রাখতেন।

আবার বারদুই কাশল দেবাশিস। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বড় করে কাশতে চেষ্টা করে দেবাশিস। খুক-খুক-খুক….কাশির শেষে কী যেন বেরিয়ে এল মুখ থেকে। জ্যোৎস্নার আলোয় দেখে আঁতকে ওঠে দেবাশিস। মৃদু স্বরে বলে ওঠে, আবার কালরোগ?

—বাবু! তোমার ঠান্ডা লেগেছে। বাড়ি ফিরে যাও। —ফুলমায়া বলে।

—তুমি যাবে না, ফুলমায়া! —দেবাশিস নিশ্বাস নিতে-নিতে বলে।

ঝুড়িটা কাঁধে নেয় ফুলমায়া, বলে, ডঁহু, আমি কাঠ কুড়িয়ে যাব। তুমি চলে যাও!

—সে কী! এত রাতে কাঠ কুড়োতে কোথায় যাবে তুমি?

ফুলমায়া কথার মোড় ঘুরিয়ে দিতে-দিতে বলে, তোমাকে যে শেষ কথাটা বলা হল না, বাবু।

—কী!

—বাবা কেমন করে হারিয়ে গেলেন আমাদের কাছ থেকে!

দেবাশিস প্রচণ্ড ধাক্কা খায় আবার। তাইতো, বাবা কোথায় গেলেন কিছুই জানা হল না। এ-রহস্যের শেষটুকু শুনতে হবে তাকে। আগ্রহ জানায় দেবাশিস শেষটুকু শোনার।

বলতে থাকে ফুলমায়া অবশেষে।

—বাবা একদিন রুগি দেখে নির্জন পথে ঘোড়ায় চড়ে ফিরে আসছিলেন। এক শয়তান চুপি-চুপি বাবাকে পেছন থেকে ছুরি মারে। বাবা আর্তনাদ করে উঠলেন। ওরা তখন বাবাকে ছুড়ে ফেলে দেয় পাহাড়ের খাদে, অনেক নীচে।—বলতে-বলতে কেঁদে ওঠে ফুলমায়া।

দেবাশিস চিৎকার করে বলে, থেমো না, ফুলমায়া। বলো, কারা ওই শয়তান! কী অপরাধে বাবাকে শাস্তি দিল?

এবার পাষাণ হয়ে যায় ফুলমায়া।

—শুনবে, বাবু! কী অপরাধে ওরা বাবাকে সরিয়ে দিয়েছে পৃথিবী থেকে? তবে শোনো। আমার মা, অর্থাৎ, বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী প্রথমেই বাগদত্তা ছিলেন। দাদামশায় প্রচুর টাকা দিয়ে মাকে বিক্রি করেছিলেন সেই বাগানের কালু তামাং সর্দারের কাছে। এটা আমাদের বরাবরের রেওয়াজ, বাবু। তাই বলছিলাম, তোমাদের মেয়েদের মতো আমাদের মেয়েদের মর্যাদা দেওয়া হয় না। বাবাকে অবিশ্যি জানতে দেওয়া হয়নি…বা দাদামশায় গোপন রেখেছিলেন কথাটা। সমস্ত আক্রোশ তাই বাবার ওপর পড়েছিল। দাদামশাইয়ের অপরাধে নির্দোষ আমার বাবাকে হঠাৎ আক্রমণ করেছিল দস্যুরা।

এক নিঃশ্বাসে শেষের কথাগুলো বলেই দ্রুত পথ ধরল ফুলমায়া।

দেবাশিস ডাকে ফুলমায়া।

—তুমি বাড়ি চলে যাও, বাবু।—ততক্ষণে অনেকটা নীচে নেমে গিয়েছে ফুলমায়া।

দেবাশিস আরও একটু বড় করে ডাকে ফুলমায়া! শোনো! চলে যেয়ো না।

অস্পষ্ট উত্তর ভেসে আসে : আমার অপেক্ষায় তুমি দাঁড়িয়ে থেকো না, বাবু, চলে যাও।

আবার কাশি ওঠে দেবাশিসের। তার সঙ্গে দলা-দলা রক্তও পড়ে। চিৎকার করে ডেকে ওঠে দেবাশিস : ফু…ল…মা…য়া…!

গাঢ় অন্ধকার নেমে আসে চা-বাগানে। ঝটকা হাওয়া এসে দেবাশিসের কাতর চিৎকার ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

সমস্ত শক্তি ঢেলে দিয়ে ডেকে ওঠে দেবাশিস। আবার যেন ডাকতে চায়। কিন্তু তার কণ্ঠে শক্তি নেই। কেমন এক অস্পষ্ট শব্দে বলে ফুলমায়া—লক্ষী-বোন আমার—শুনে যাও…..। একবার শুনে যাও।

চারপাশের পাহাড়ের পাঁচিলগুলো যেন অন্ধকার ঠেলে নিয়ে এসে জাপটে ধরে দেবাশিসকে।

তদন্ত রহস্য

মার্চ, ১৯৬৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *