বিড়ি – সুজিত ধর
মনে করেছিলাম চোর-ছেঁচড়ের পেছনে আর ছুটব না। জীবনের শেষ সময়টা সাহিত্য আর ধর্মচর্চা করে কাটাব। তা আর হল কই? আমি না চাইলেও একটা অদৃশ্য শক্তি আমাকে টেনে নামিয়েছে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ফিরিয়ে এনেছে আবার সুন্দর হলুদ রোদ্দুর আর বড়-বড় ঘাসের দেশে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও আমি মরিনি।
মাটির দেওয়াল আর টিনের ছাদওয়ালা ঘরটায় আমাদের গাঁজার আড্ডা বসত। সন্ধে হলেই আমরা মাকড়সার জাল আর চামচিকে বাদুড় ভরতি ঘরটায় জড়ো হতাম। গল্প করতাম। তাস, পাশা খেলতাম। শেষে গাঁজার পীতাভ ধোঁয়া গিলে একটা সুস্বাদু সম্মোহনে আবিষ্ট হয়ে বাড়ি ফিরতাম। সেদিন সবে ছাতাটা বগলে পুরেছি। চৌকাঠে পা দেওয়ার আগেই হীরালাল ডেকে ওঠে : ওস্তাদ, একটু শোনো।
আমি ঘুরে দাঁড়ালাম : কিছু বলবে নাকি, হীরালাল?
চকিতে হীরালাল চার-পাশটায় দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে আমার কাছে এল। কানের কাছে মুখটা এনে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ওস্তাদ, তুমি কি কাঞ্জিলালের নাম শুনেছ?
আমি মাথা নাড়লুম।
কাঞ্জিলালের নাম আমি অনেকদিন ধরেই শুনেছি। বড় নির্মম এই কাঞ্জিলাল। দুজন নিরীহ লোকের চোখের ভিতর গুলি চালিয়ে খুন করেছে। তা ছাড়া আফিং আর গাঁজার চোরাই বিজনেস করে বেশ টু পাইস কামিয়েছে। কলকাতা শহর থেকে একটু দূরে দুটো বাড়িও হাঁকিয়েছে। কাঞ্জিলাল হচ্ছে এসব লাইনের উস্তাদোঁ কা উস্তাদ।
আমি শুকনো ঠোঁটের ওপর সজল জিভটা বুলিয়ে নিয়ে বলি, কেন, কী হয়েছে, হীরালাল?
হীরালাল তার কালো-কালো দাঁত বের করে হাসল : উ শ্লা মনে হয় টেঁসে যাবে। মদ খেয়ে-খেয়ে ওর লিভারটা পাংচার হয়ে গেছে। তিনদিন ধরে বাড়িতে পড়ে আছে। আজ তুমি ওকে অ্যারেস্ট করতে পারো।
হীরালাল আমার বিশ্বস্ত শাগরেদ। সময়ে-অসময়ে নানারকম খবর-খবরাদি দেয়। হীরালালের মুখে কাঞ্জিলালের নামটা শোনার পর থেকেই মাথার ভিতর শক্ত খোলাওয়ালা পোকাটা যেন মগজটাকে কুরে-কুরে খেতে লাগল। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে-কাঁপতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ডিপার্টমেন্টকে ফোন করলাম।
অফিসার বললেন, তুমি স্টার্ট করো। সাদা ড্রেসের কয়েকজন পুলিশ পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আমি যখন কাঞ্জিলালের বাড়ি পৌঁছুলুম তখন রাত্রি দশটা। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। ঘরের ভিতর পনেরো ওয়াটের লালচে ক্ষীণ আলোটা যেন চারপাশের অন্ধকারকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কাঞ্জিলালের ডেরা কলকাতা থেকে একটু দূরে। এখানে এখনও ঝিঁঝিঁ আর শেয়ালের ডাক শোনা যায়। আমার কেমন ভয়-ভয় করতে লাগল। হৃৎপিণ্ডটা যেন মাথার ভিতর উঠে গিয়ে ধুকপুক করতে থাকে।
দরজার কড়া নেড়ে ডাক দিলাম, কাঞ্জিলাল—কাঞ্জিলাল আছ?
ঘরের ভিতর নিস্তব্ধ। বিচিত্র প্রশান্ততায় থমথম করছে। শুধু আমার ভরাট কণ্ঠস্বর নিরেট দেওয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে বিশাল এক মূর্ছনা হয়ে ঝরে পড়ে।
হঠাৎ দরজাটা খুলে যায়। ইস্পাত-কঠিন মুখওয়ালা একটা লোক অ্যাটেনশানের ভঙ্গিতে সামনে এসে দাঁড়াল। আমি হাঁ করে লোকটার চওড়া বুক আর ইয়া মোটা হাতের কবজির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
—এখানে কাঞ্জিলাল আছে?
লোকটা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথাটা নাড়িয়ে ইশারা করল।
ঘরের ভিতর ঢুকতেই দরজার খিল তুলে দিয়ে আমাকে নিয়ে এগিয়ে চলল।
—এখানে এত অন্ধকার কেন?—ভয়ে-ভয়ে প্রশ্ন করলাম।
লোকটা কোনও উত্তর না দিয়ে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দরজাটা দেখিয়ে বলল—যান ভিতরে যান। কাঞ্জিসাহেব ওখানেই আছেন।
টাইয়ের নটটা ঠিক করে ভিতরে ঢুকতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো আমি চমকে উঠলাম। আমার গলা চিরে তীক্ষ্ন কণ্ঠস্বর বেরিয়ে আসে : হীরালাল, তুমি!
—ওস্তাদ, আমিই কাঞ্জিলাল।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে হীরালাল ওরফে কাঞ্জিলালের প্রচণ্ড এক ঘুষি আমার মুখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তালি মারা ছাতাটা দশহাত দূরে ছিটকে পড়ল। কোনওরকমে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াই। ছাতাটা বেশ দূরেই পড়ে আছে। ওটা তুলতে যাওয়া বোকামি। অথচ ওটার ভিতরেই আমার রিভলভারটা সেট করা আছে।
ছাতাটা হাতে না পেলে কাঞ্জিলালকে গ্রেপ্তার করা অসম্ভব।
অথচ—।
বেশ নিরীহের মতো পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলি, হীরালাল, এবার হাত তোলো। একটু নড়লেই গুলি চালাব।
—ওস্তাদ, ওসব বাতেলা অন্য জায়গায় ঝেড়ো। ফাঁকা পকেটে হাত ঢুকিয়ে রিভলভার আছে—ও-টেকনিক আমার কাছে দেখাতে এসো না।
এবার হীরালাল বিড়িতে বারকয়েক টান দিয়ে ঘরের এককোণে ছুড়ে দিল। আমি লক্ষ করলাম, বিড়িটা কয়েকটা ম্লান আলোর ফুলকি তুলে বড় ডাঁটিওয়ালা ইলেকট্রিক পাখার তারের ওপর পড়ল।
হীরালাল চকিতে সেদিকে তাকিয়ে কোমর থেকে একটা ধারালো ছোরা বের করল।
ওয়েল, মিস্টার ওব্রায়াম,—হীরালালের ঠান্ডা-তীক্ষ্ন কণ্ঠস্বর বরফ টুকরোর মতো আমার গায়ে ছড়িয়ে পড়ে : তুমি আমার অনেক ক্ষতি করেছ। আমার দলের লোককে হাজতে পুরেছ। আজ তুমি আর ছাড়া পাবে না, ওস্তাদ। তোমার জানটা আজ খুবলে নেব।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে হীরালাল ওরফে কাঞ্জিলালের ঝকঝকে ছুরিটা ফ্লুরোসেন্ট আলোর কোমল অথচ নিথর পরিবেশে ঝলসে ওঠে।
আমি ভয়ে, বিস্ময়ে ও উৎকণ্ঠায় বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকালাম।
গুল! গুল!—সুমিত্র হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, ওব্রায়াম, ওসব গুল অন্য জায়গায় ঝেড়ো, বাপধন।
তিতুদি মুখের ওপরে ছেলেমানুষ-ছেলেমানুষ ভাব এনে সুমিত্রর দিকে তাকায়।
—সুমিত্র, ওরকমভাবে কথা বলিসনি, ভাই। ওব্রায়াম দুঃখু পাবে।
দেবুদা গম্ভীর মেজাজে ওব্রায়ামের কথাগুলো হাঁ করে গিলছিল। হুঙ্কার দিয়ে ওব্রায়ামের ওপর লাফিয়ে পড়ে : দেখি বাছাধন, কাঞ্জিলালের ছুরির দাগটা আছে কিনা?
ওব্রায়াম বোকা-বোকা দৃষ্টি নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে নিস্পৃহভাবে টুথ-ব্রাশ মার্কা গোঁফে হাত বুলোতে থাকে।
—কাঞ্জিলাল আর ছুরি মারল কই? তার আগেই তো দপ করে আলোটা নিভে গিয়েছিল। আমিও ঠিক সেই মুহূর্তে সাঁৎ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে কাঞ্জিলালের পশ্চাৎদেশে এক লাথি হাঁকাই। কাঞ্জিলাল মুখ থুবড়ে পড়ল, আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দিই।
—চিয়ার আপ! চিয়ার আপ!
সুমিত্র, তিতুদি আর দেবুদা ঘর ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, গ্র্যান্ড, গ্র্যান্ড, ওব্রায়াম!
দেবুদা হঠাৎ টেবিলের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতে থাকে : বৎসগণ, একটু চুপ করো। মৃত্যুর গহ্বর থেকে, ব্র্যাকেটে কাঞ্জিলালের উদ্ধত ছুরির হাত থেকে, মিস্টার ওব্রায়াম ফিরে এলেন শুধু মাত্র ঈশ্বরের জন্যে। মহামান্য ঈশ্বরই তার প্রিয় পুত্রকে মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন। তোমরা আমাকে প্রশ্ন করতে পারো—কী করে তা সম্ভব হল? আমি তার উত্তরে বেশ গম্ভীরভাবে বলব, ঠিক সময়ে, চরম উৎকণ্ঠাময় মুহূর্তে, ঈশ্বর তাঁর প্রিয় পুত্রের জীবন রক্ষার নিমিত্ত সুইচ অফ করে আলোটা নিভিয়ে দিয়েছিলেন।
কথা শেষ করেই ওরা তিনজনে হো-হো করে হেসে উঠল।
আমার মনে হল, তিনজন যুবক-যুবতীর নির্বুদ্ধিতার জন্যে ওব্রায়াম লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবে।
ওব্রায়াম কোনও কথা না বলে মেঝে থেকে তালি মারা ছাতাটা তুলল। ওদের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল।
—চলি তাহলে,—ওব্রায়ামের গলা কেঁপে-কেঁপে ওঠে : সেদিন ঈশ্বর আমাকে বাঁচিয়েছেন কিনা জানি না, তবে কাঞ্জিলালের আধ-খাওয়া বিড়িটাই আমাকে বাঁচিয়েছিল। ফ্যানের প্লাস্টিকের তারের ওপর জ্বলন্ত বিড়িটা পড়াতে ওপরের পিভিসি কভারটা পুড়ে যায়। আর তার ফলেই ইলেকট্রিক তারের ফ্রেজ নিউট্রাল তার দুটো জুড়ে গিয়েছিল। সর্ট সার্কিটের জন্যেই আলোটা নিভে যায়।
মাসিক রহস্য পত্রিকা
নভেম্বর-ডিসেম্বর, ১৯৬৯