ঘুঘু – সমীর চৌধুরী
ঘুঘুর কথা লিখতে বসেছি।
ঘুঘু দু-রকম। একরকম যারা ডালে-ডালে ঘোরে। আর একরকম যারা ঘোরে পাতায়-পাতায় অর্থাৎ ‘মানুষ ঘুঘু’।
সেদিন দুপুরবেলা মটর রায়ের দোকানে এক অ্যাংলো ছোকরা এসে হাজির বললে আমার বাবার জন্যে একটা চশমা চাই—দু-একটা ফ্রেম দেখাবেন? মটর রায় ফ্রেম দেখালেন, একটা ফ্রেম পছন্দও করলে, বললে ফ্রেমটা বাবাকে একবার দেখানো দরকার, বাবা এই স্টেটসম্যান অফিসে চাকরি করেন, আপনার চাকরের হাতে দিন, ও আমার সঙ্গে আসুক। স্টেটসম্যান হাউস মটর রায়ের দোকানের সামনেই। দোকানের চাকর বিষ্টুচরণের হাতে ফ্রেমটা দিয়ে অ্যাংলো বাচ্চার সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন—সাবধান অবশ্য করে দিতে ভুললেন না, কারণ হুঁশিয়ার লোক মটর রায়, বলে দিলেন, হাতছাড়া করবি না খবরদার।
কিন্তু আধঘণ্টা বাদে বিষ্টুচরণ খালি হাতেই ফিরে এল। সাহেব নাকি তাকে একটা মস্ত কাচের দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে সেই যে ভেতরে ঢুকেছে আর বেরোয়নি।
ব্রজেন রায় বললেন, কাজটা তোমার ভুলই হয়েছে মটর—ও ব্যাটা খাস আমদানি উড়িষ্যার এক গণ্ডগ্রাম থেকে, স্টেটসম্যান হাউসের মতো বাড়ি আর সাহেব-টাহেব দেখে হকচকিয়ে যাবে, এ তো জানা কথাই।
মটর রায়ের মেজাজটা এমনি সর্বদা বেসুরো বেতালা হারমোনিয়ামের মতন—ব্রজেন রায়ের উপদেশ শুনে আরও খচে টং—বললেন, এখন আর উপদেশ মারতে হবে না, চুপ করুন, যখন নিয়ে গেল তখন কোথায় ছিলেন?
এই অ্যাংলোর বাচ্চা একজাতের ঘুঘু—ইংরেজিতে এদেরই নাম ‘ফোর টোয়েন্টি’।
ঘুঘুর পাল্লায় পড়েনি এমন লোক কমই আছে। যেখানে-সেখানে এনতার ঘুঘু ঘুরছে সর্বদাই এবং বহু ঘোড়েল লোকও এদের হাত থেকে নিস্তার পায় না।
তপন সেবার বি.এসসি. পাশ করে দিনকতক চাকরির জন্যে হামলা চালিয়েছিল আফিসে, দপ্তরে। ছোকরার বুদ্ধি নেই তা নয়, তবে খাস পশ্চিমে প্রায় চোদ্দো বছর কাটানোয় মাথায় বোধহয় কিঞ্চিৎ শ্যাওলা জমেছিল। অবশ্য ইদানীং কলকাতার জল-হাওয়ায় মাথা খুলে গেছে। অম্বল ধরেছে—মাথা তো খুলবেই।
সকালবেলা উঠে প্রতিদিন চা এবং খবরের কাগজের ‘কর্মখালি’ একসঙ্গে গিলত সে। সেদিনকার কাগজে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল কেমিকাল ইন্ডাস্ট্রিজ (ইন্ডিয়া লিমিটেড)’-এ অফিসার, কেরানি, কেমিস্ট ইত্যাদি বহু লোক চাই। মাইনে ভালোই। তপন দরখাস্ত ছেড়ে দিল।
তিন দিন বাদে জবাব এল—দেখা করতে হবে, সামনের শনিবার বেলা দেড়টা থেকে দুটোর মধ্যে।
মটর রায় বললেন, এ-চাকরিটা তোর লেগে—বুঝলি তপন, তা নইলে এত তাড়াতাড়ি কখনও জবাব দেয়?
শনিবার তপন সেজেগুজে দস্তুরমতন স্যুট চাপিয়ে—মটর রায়ের টাইটা ধার করে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ম্যাঙ্গো লেনে অফিস। একতলায় একটা ফার্নিচারের দোকান—দোতলায় একখানা বড় ঘর। বহু লোক বসে আছে—একদিকে পার্টিশানের ওপাশে দু-তিনজন লোক কাজ করছে। বাইরে চাপরাশি অপেক্ষা করছে। পাশেই আর-একটা ঘর—বাইরে প্লেট ঝুলছে ‘এস. ধাক্কালাল, সেক্রেটারি।’
যথাসময় তপনের ডাক পড়ল এস. ধাক্কালালের ঘরে। বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে দামি স্যুট পরে চোখে মোটা শেলের চশমা এস. ধাক্কালাল—তপনকে দেখে স্মিত হেসে বললেন, বসুন, মিঃ রয়।
তপন বসল। অনেক কথা বললেন তিনি তপনকে। বললেন, আপনার মতন লোকই আমরা চাই—ইয়াং অ্যান্ড এনারজেটিক, ইনটেলিজেন্ট অ্যান্ড স্মার্ট। সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছি আপনার স্বাস্থ্য দেখে।
তারপর বললেন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট আপনার হয়ে গেছে ধরে নিন। তবে আমাদের কোম্পানির আইন অনুযায়ী আপনার একটা মেডিকেল টেস্ট হবে। আমি আপনার অ্যাপ্লিকেশানের ওপর লিখে দিচ্ছি। মেডিকেল ফি’র টাকা আমাদের অফিসে জমা দিয়ে দিন। ডাক্তার আমাদেরই—আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এবং কবে মেডিকেল টেস্ট হবে কালই জানিয়ে দেওয়া হবে চিঠিতে। প্রচুর লোক নেওয়া হচ্ছে তো, তাই আজই আপনাকে তারিখটা বলে দেওয়া যাচ্ছে না। এই বলে মিঃ ধাক্কালাল কলিং বেলে চাপড় মারলেন। উর্দিপরা চাপরাশি এসে দাঁড়াল।
সাবকো আফিসমে লে যাও।—বললেন মিঃ ধাক্কালাল।
পাশের ঘরে সেই পার্টিশনের মধ্যে গিয়ে তপন টাকা জমা দিল—রসিদ নিল।
দু-দিন পরই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এবং মেডিকেল টেস্টের তারিখ সে পেয়ে গেল—সাতদিন পরেই মেডিকেল টেস্ট।
সাতদিন পরে ম্যাঙ্গো লেনের আফিসে হাজির হল তপন।
তপন একঘণ্টা আগেই হাজির হল। দেখলে ম্যাঙ্গো লেনের আফিসের সামনে বিরাট ভিড় আর ভয়ঙ্কর গোলমাল, চিৎকার—পুলিশ-পল্টন উপস্থিত। বেঙ্গল ন্যাশনাল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ-এর ঘরে এক মস্ত তালা ঝুলছে।
একতলার ফার্নিচারওয়ালার কাছ থেকে যেটুকু খবর সংগ্রহ হল, তাতে জানা গেল আফিসের যেসব ফার্নিচার, তা এদের কাছ থেকেই ভাড়া নেওয়া। অবশ্য মাত্র পনেরো দিনের ভাড়া আগাম পেয়েছিল তারা।
সকালে তাদের লেটার বক্স থেকে একটা চাবি পাওয়া গেছে, সঙ্গে একটা চিঠি :
আপনাদের ফার্নিচারের জন্য ধন্যবাদ। চাবি রইল, ঘর খুলে আপনাদের ফার্নিচার বের করে নেবেন। আমাদের কাজ ফুরিয়েছে।
ভিড়ের মধ্যে চাপরাশি দুজন এবং কেরানি দুজন যারা টাকা জমা নিয়েছিল তাদেরও দেখা পাওয়া গেল। বিনা মাইনেতে দিনকতক চাকরি করে নিয়েছে এরা এই দুর্দিনে, এইটাই ওদের সান্ত্বনা।
ঘুঘু ধাক্কালাল ফুড়ুত করে সরে পড়েছেন।
ম্যাঙ্গো লেন থেকে ফিরে এসে মুখখানা ছাঁচি কুমড়োর মতন ফ্যাকাশে করে মটর রায়ের দোকানে একটা চেয়ার টেনে বসল তপন।
সব শুনে ব্রজেন রায় বললেন, আমার কিন্তু ওই আট টাকা ফি শুনেই কেমন খটকা লেগেছিল।
এই ব্যাপারে মটর রায় মুখখানা অস্বাভাবিক রকম বিকৃত করে বসেছিলেন। ব্রজেন রায়ের কথা শুনে এক ধমক মারলেন, বললেন, বাজে ফ্যাচফ্যাচ করবেন না, চুপ করুন।
মিঃ বর্মন এতক্ষণ কৌচের মধ্যে সেঁধিয়ে ছিলেন। এবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেন, বললেন, উঃ, কী ব্রেন মাইরি—দেখুন একবার কী সাহস শালার!—তারপর বললেন, পালিয়ে গেল, নইলে শালাকে পুলিশ দিয়ে এমন ঠ্যাঙাতুম। শালা জানে না কার সঙ্গে লেগেছে।
মিঃ বর্মনের কথা শুনে সকলে না হেসে থাকতে পারল না।
এরপর মিঃ বর্মন আর এক ঘুঘুর গল্প ফাঁদলেন—এক বাস্তুঘুঘুর গল্প।
গুলনগরের যুবরাজ এসে উঠলেন কোলকাতায় এক মস্ত হোটেলে। হোটেলের এক সেরা কামরা বেছে দিলেন ম্যানেজার—যুবরাজ মানুষ, ম্যানেজার তাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অবশ্য ব্যস্ত হওয়ার আর-একটা কারণ হল যুবরাজ হোটেলে ঘর রিজার্ভ করেই একশো টাকা আগামের সঙ্গে পঞ্চাশ টাকা ম্যানেজারের হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ওর খানসামাদের বখশিস এটা। ম্যানেজার বখশিসের মোটা অংশটা নিজের পকেটেই রাখলেন।
তিন-চারদিন পরে হঠাৎ যুবরাজ ডেকে পাঠালেন ম্যানেজারকে—বললেন, আমার স্টেট থেকে টাকা এসে পৌঁছনোর কথা ছিল আজ—পৌঁছয়নি। হয়তো কাল-পরশু আসবে—আমাকে হাজারখানেক টাকা ধার জোগাড় করে দিতে হবে।
ম্যানেজার একটু কী ভাবলেন, তারপর চলে গেলেন। আধঘণ্টা বাদে একজন কাবুলিওয়ালাকে নিয়ে ফিরলেন। যুবরাজের টাকা পেতে অসুবিধে হল না। কাবুলিওয়ালাকে বললেন, পরশু বিকেলে সাড়ে তিনটের সময় তোমার টাকা নিয়ো।
এক মিনিট এদিক-ওদিক হল না। ঠিক নির্দিষ্ট দিনে সাড়ে তিনটের সময় সুদসমেত কাবুলিওয়ালার টাকা মিটিয়ে দিলেন যুবরাজ। ম্যানেজারকে প্রচুর ধন্যবাদ দিলেন এবং পকেট থেকে থেকে তাঁর গোল্ড ক্যাপ শেফারস পেনটা ম্যানেজারের পকেটে লাগিয়ে দিয়ে বললেন, বিপদের সময় আপনি যে—সাহায্য করলেন তা কোনওদিন ভুলব না।
ম্যানেজারের চিবুকের তলার চর্বি আনন্দে থরথর করে কেঁপে উঠল।
একহপ্তা পরে যুবরাজের আবার টাকার দরকার হল। ম্যানেজার প্রায় ছুটতে-ছুটতে কাবুলিওয়ালাকে ধরে আনলেন। এবারে পাঁচ হাজার টাকা চাই।
কাবুলিওয়ালা টাকা দিল এবং দু-দিন পরে ঠিক সময় সুদসমেত ফেরত পেয়ে গেল। ম্যানেজারকে একখানা একশো টাকার নোটে বন্ধুর শুভেচ্ছা জানিয়ে সই করে নিলেন। বললেন, এটা রেখে দিন—যতদিন এটা থাকবে ততদিন অন্তত বন্ধুকে মনে থাকবে।
ম্যানেজারের চিবুকের তলার চর্বি ঝুলে পড়ল।
এরপর দু-হপ্তা কেটে গেছে। হঠাৎ এক শনিবার দুপুরে যুবরাজ কোথায় গিয়েছিলেন ট্যাক্সি করে, ফিরে এসে ব্যস্ত হয়ে ম্যানেজারকে ডেকে পাঠালেন, বললেন আজ শনিবার খেয়াল ছিল না—ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে গেছে, অথচ আমার এখুনি তিরিশ হাজার টাকা চাই।
কাবুলিওয়ালার ডাক পড়ল। তার নিজের কাছে অত টাকা নেই—সে ছুটল—অন্য সব কাবুলিদের কাছ থেকে টাকাটা জোগাড় করে আনল।
যুবরাজ বললেন, চেক দিয়ে দেব—সোমবার ফার্স্ট আওয়ারে পেয়ে যাবে। কাবুলি জানাল, কোনও প্রয়োজন নেই, সে সোমবারই নেবে।
টাকাটা পেয়ে হাঁফ ছাড়লেন যুবরাজ। তারপর ম্যানেজারকে বললেন, আজ একমাস হতে চলল আমি এসেছি অথচ আপনি একপয়সাও বিল নেননি এখনও—এটা ঠিক নয়—সোমবার দিন বিলটা দিয়ে সমস্ত পাওনা মিটিয়ে নেবেন।
ম্যানেজার একগাল হেসে বললেন, তার জন্যে ব্যস্ত হওয়ার কী আছে? নিলেই হবে একসময়।
এরপর যুবরাজ বেরুলেন।
কিন্তু এই যে বেরুলেন, আর ফিরলেন না।
বাস্তুঘুঘু যুবরাজ ম্যানেজার আর কাবুলিদের ভিটেয় ঘুঘু চরিয়ে হাওয়ার সঙ্গে মিলে গেলেন।
ব্রজেন রায় কথাটা শুনে বললেন, আমার কিন্তু তখনই সন্দেহ হয়েছিল।
মটর রায় এক ধমক মেরে বললেন, আপনি বড় বাজে ফ্যাচফ্যাচ করেন।
তদন্ত (সাপ্তাহিক)
৩১ অক্টোবর, ১৯৫২