1 of 2

ইস্কাবনের বিবি – অনিলকুমার ঘোষ

ইস্কাবনের বিবি – অনিলকুমার ঘোষ

পূর্ণচন্দ্র স্ট্রিটের শেষের দিকে মস্ত বড় চারতলা একটা বাড়ি।

বাড়িটা যে কতকালের, কে জানে। কালের অপ্রতিহত নিষ্ঠুর আঁচড়ে বাড়িটা ক্ষতবিক্ষত। চুন-বালির পলেস্তারা ঝরে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে নোনা-খাওয়া আধভাঙা ইঁট।

বাড়ির মধ্যে পায়রার খোপের মতো ছোট-ছোট অগুন্তি ঘর। প্রত্যেকটি ঘরে গিজগিজ করছে মানুষ। এরা কেউই আলোকিত পথের পথিক নয়। এদের অর্থসঞ্চয়ের পথটাও রহস্যপূর্ণ। প্রত্যেকেই নোংরা, অশিক্ষিত, বিবেকহীন এক কুৎসিত জগতের লোক। কেউ চোর, কেউ পকেটমার, কেউ স্মাগলার, কেউ গুণ্ডা। প্রত্যেক রকমের অপরাধীকেই পাওয়া যাবে এ-বাড়ির কোনও-না-কোনও ঘরে।

বাড়ির সুনামের কথা পাড়ার লোকেরা জানে। সেহেতু এরা পাড়ার মধ্যে নিজেদের কোনও কলাকৌশল দেখায় না, পাড়ার লোকেরাও এদের ঘাঁটায় না, বরং সমীহ করে দূরে-দূরেই থাকে।

পুলিশ প্রায়ই হানা দেয়, কিন্তু কিছুই পায় না। শোনা যায়, বাড়িওয়ালার নাকি কড়া আদেশ—কেউ কোনও চোরাই মাল নিয়ে এ-বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। বাসিন্দারা তাই চোরাই মাল বিক্রি করে বাড়িতে ঢোকে।

সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছ’টা।

দোতলায় রাস্তার দিককার একটা ঘরে পাশাপাশি দুটি খাটিয়ায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল পকেটমার রহিম ও ছিঁচকে চোর কালু। এমনসময় দরজা ঠেলে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল ওয়াগনব্রেকার গজু। ঘরে ঢুকেই সে চিৎকার করে উঠল, ‘এই রহিম…আরে ও কালু, তোরা এখনও ঘুমোচ্ছিস? দ্যাখ…দ্যাখ, রাস্তায় কী কাণ্ড…!’

রহিম ও কালু হুড়মুড় করে উঠে পড়ল। তাদের মুখে ভয়ের চিহ্ন দেখা দিল। তারা বিহ্বল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন? কী হয়েছে?’

গজু ততক্ষণ জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। রহিম ও কালু কান পেতে শুনল, বাইরে শোনা যাচ্ছে বহু লোকের সমবেত চিৎকার। গজু বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘আই বাপ, রাস্তায় লোক গিজগিজ করছে! ওরা এই বাড়িটা ঘিরে ফেলেছে! সবাই এই বাড়ির দিকেই দেখিয়ে-দেখিয়ে কী যেন বলছে! কী ব্যাপার র‍্যা?’

ততক্ষণ রহিম ও কালু জানলার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কালু আনমনে বলল, ‘খোদা জানে কী হয়েছে। তবে মনে হচ্ছে, কেউ কোনও ঝামেলা করে এ-বাড়িতে ঢুকেছে। মকান-মালিক টের পেলে খাল খুলে নেবে…।’

কালুর কথা শেষ হওয়ার আগেই দড়াম করে দরজা খুলে কে যেন ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকেই দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল।

‘কে রে?’ রহিম বিরক্ত হয়ে হাঁক দিল।

‘চোপ,’ আগন্তুক ক্রুদ্ধস্বরে ধমক দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।

‘ওস্তাদ!’ এদের তিনজনের মুখ থেকে বিস্ময়সূচক স্বর বেরিয়ে এল।

আগন্তুক কুখ্যাত গুণ্ডা ও স্মাগলার করিম খাঁ।

প্রায় ছ’ ফুট লম্বা, শক্তিশালী চেহারা। শরীরের প্রত্যেকটি পেশি সতেজ ও সবল। মাথায় লম্বা-লম্বা চুল উলটো করে আঁচড়ানো। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি ও গোঁফ। একাধিক পুরোনো আঘাতের চিহ্ন মুখটাকে ক্ষতবিক্ষত করে কেমন যেন বীভৎস করে তুলেছে। হিংস্রতায় ভরা চোখ দুটোর দিকে তাকালেই শরীরটা যেন ঠান্ডা হয়ে যায়।

পুলিশের খাতায় করিমের নাম অনেকদিন থেকেই উঠে রয়েছে, কিন্তু প্রমাণের অভাবে আজও ধরা যায়নি। পুলিশ ভালোভাবে জানে লোকটা বহুরকম অপরাধমূলক কাজে জড়িত আছে। কিন্তু প্রমাণ কই? ওদিকে কলকাতার প্রত্যেকটি চোর-বদমায়েশ করিমকে সমীহ করে চলে। তারা জানে, এই বদরাগী লোকটা কথায়-কথায় চাক্কু চালায়। তাই তারা ভয়ে বা ভক্তিতে ওকে ‘ওস্তাদ’ বলে ডাকে।

এ হেন লোককে ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে ওরা দু-চোখে আতঙ্ক ও বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল।

দু-পা এগিয়ে এসে করিম জিজ্ঞাসা করল, ‘তোরা কতক্ষণ থেকে এখানে আছিস?’

কালু ভয়ে-ভয়ে বলল, ‘আমরা তো ঘুমোচ্ছিলাম…।’

থাবড়া মেরে কালুর মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে করিম বলল, ‘ব্যস-ব্যস, শোন কান খুলে—আমিও এখানে ছিলাম বেলা সাড়ে চারটে থেকে, বুঝলি?’

‘সাড়ে চারটে থেকে!’ ওরা তো আকাশ থেকে পড়ল, ‘তার মানে?’

‘মানে দিয়ে তোদের কী কাম?’ দাঁত খিঁচিয়ে বীভৎস মুখে করিম তেড়ে এল ‘শুধু মনে রাখ—আমি বেলা সাড়ে চারটে থেকে তোদের সঙ্গে বসে আছি। একবারও উঠিনি। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে এই কথা বলবি। নইলে…।’ বলতে-বলতে সে পকেটে হাত দিল।

পকেটে হাত দেওয়ার মানে ওরা জানত, তাই তাড়াতাড়ি বলল, ‘জী ওস্তাদ, ঠিক আছে। কিন্তু কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে আমরা কী করছিলাম, তাহলে কী বলব?’

কয়েক সেকেন্ড কী যেন ভেবে করিম চারিদিকে একবার চেয়ে দেখল। তারপর চট করে তাকের ওপর থেকে এক প্যাকেট পুরোনো তাস তুলে এনে বলল, ‘আমরা তাস খেলছিলাম…মানে ব্রিজ খেলছিলাম…বুঝলি? যদি না বলিস, তাহলে…।’ বলতে-বলতে সে পকেট থেকে একটা বড় ছোরা বের করে দোলাতে লাগল।

গজু ও কালু এ-লাইনের পুরোনো লোক। ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে না বুঝলেও ওরা বুঝতে পেরেছিল, করিম কোথাও কোনও ঝামেলা পাকিয়ে এসেছে। এখন ব্যাক-টাইম বলে নিজের অ্যালিবাই সুদৃঢ় করতে চায়।

‘ক্যা হুয়া রে উল্লু,’ করিম গর্জন করে উঠল, ‘বৈঠ ইধার।’

কোনও উচ্চবাচ্য না করে ওরা গোল হয়ে খাটিয়ায় বসে পড়ল। ঠিক সেইসময় কাঠের সিঁড়িতে শোনা গেল একাধিক ভারী বুটের আওয়াজ। এ-আওয়াজ ওরা চেনে—পুলিশ।

পরক্ষণেই বন্ধ দরজায় জোরে-জোরে ধাক্কা দিতে-দিতে গম্ভীর সুরে কে যেন বলল, ‘খোল…দরজা খোল শিগগির…।’

করিম চকিতে সকলের মুখের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে চাপা স্বরে বলল, ‘দরজা খুলে দে। কিন্তু মনে রাখিস…।’ কথাটা মাঝপথে থামিয়ে একটা ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত করল।

ওদিকে করাঘাত বেড়েই চলেছে। করিমের ইশারা মতো কালু দরজা খুলতে গেল। করিম নির্বিকারভাবে বসে তাস শাফল করতে লাগল।

দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন ওয়াটগঞ্জ থানার ও. সি. মিঃ মল্লিক ও তিন-চারজন পুলিশ। চারিদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে মিঃ মল্লিক কড়া গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘তোরা কী করছিলি?’

করিম মুখ তুলে বলল, ‘সেলাম বড়বাবু।’

করিমের দিকে দৃষ্টি পড়তেই মিঃ মল্লিক চমকে উঠলেন : ‘এই যে করিম, তুমি এখানে? আমি ঠিক জানতাম তোমাকে এ-বাড়িতেই কোথাও পাব। তুমি কি ভেবেছিলে এখানে লুকিয়ে থাকলেই আমার চোখে ধুলো দিতে পারবে?’

অবাক হওয়ার ভান করে করিম বলল, ‘কী বলছেন, বড়বাবু? আমি লুকোব কেন? আমি তো এখানে বসে তাস খেলছিলাম।’

‘তাস খেলছিলে?’ মিঃ মল্লিক জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, ‘কতক্ষণ থেকে তাস খেলছিলে?’

নির্বিকারভাবে করিম বলল, ‘সেটা আপনি ওদেরই জিজ্ঞাসা করুন।’

মিঃ মল্লিক ওদের প্রত্যেককেই চিনতেন। তিনি চোখ রাঙিয়ে কালুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘করিম কখন এসেছে?’

কালু বিনা দ্বিধায় বলল, ‘আজ্ঞে, সাড়ে চারটেয়।’

প্রচণ্ড এক ধমক দিয়ে মিঃ মল্লিক আবার প্রশ্ন করলেন, ‘কী করে বুঝলি তখন সাড়ে চারটে?’

কালু তাকের দিকে দেখিয়ে বলল, ‘ওই দেখুন ওই ঘড়িটা…।’

তাকের ওপর কমদামি টাইমপিসটা টিকটিক করে চলছিল। সেদিকে বারেক লক্ষ করে মিঃ মল্লিক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এতক্ষণ তোরা কী করছিলি?’

কালু বলল, ‘আজ্ঞে ব্রিজ খেলছিলাম।’

ভ্রূ কুঁচকে মিঃ মল্লিক প্রশ্ন করলেন, ‘কী বললি, ব্রিজ খেলছিলি? তোরা আবার ব্রিজ খেলিস নাকি?’

উত্তর দিল করিম, ‘কেন বড়বাবু, ওটা কি ভদ্রলোকেরই একচেটিয়া খেলা?’

মিঃ মল্লিক তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন : ‘করিম, তোমার রসিকতা ছাড়ো এবং বলো তুমি আলীকে খুন করলে কেন?’

‘খুন!’ করিম যেন আকাশ থেকে পড়ল : ‘বলেন কী, বড়বাবু? খুন হয়েছে নাকি? আলী লোকটা আবার কে?’

দাঁতে দাঁত চেপে মিঃ মল্লিক বললেন, ‘আলী যে কে তা আমার চেয়ে তুমিই ভালোভাবে জানো। কিছুক্ষণ আগে তুমি তাকে রাস্তার ওপরে খুন করলে কেন?’

‘তোবা, তোবা,’ দু-হাতে নিজের কান ঢেকে করিম যেন আঁতকে উঠল ‘হুজুর, আপনি নিজের কানেই তো শুনলেন আমি সাড়ে চারটে থেকে এখানে বসে তাস খেলছি। এর মধ্যে একবারও জায়গা ছেড়ে উঠিনি। এরা তিনজনই আমার সাক্ষী।…কিন্তু হুজুর, আমাকে কি কেউ খুন করতে দেখেছে? বেশ তো, ডাকুন তাকে, সে এসে আমাকে চিনিয়ে দিক।’

মিঃ মল্লিক স্থির-নিবদ্ধ দৃষ্টিতে করিমের দিকে চেয়ে বললেন, ‘রাস্তার বহু লোকই দেখেছে খুনিকে। তারা বলেছে, খুনি লম্বা লোক। তার গায়ে বিরাট বড় একটা আলখাল্লা ছিল। মাথার চুল লম্বা-লম্বা এবং সামনের দিকে এমন করে আঁচড়ানো যাতে মুখটা সম্পূর্ণ ঢেকে গিয়েছিল।’

করিম নির্বিকারভাবে পিটপিট করে চাইতে লাগল।

মিঃ মল্লিক আবার বলতে লাগলেন, ‘আমরা সেই আলখাল্লাটা সিঁড়ির নীচে কুড়িয়ে পেয়েছি…তোমার মাথার চুলগুলোও লম্বা-লম্বা…।’

‘হুজুর,’ ঈষৎ কড়া গলায় করিম বলল, ‘আমার বিরুদ্ধে আপনি ওসব কথা ওভাবে বলতে পারেন না। আপনারা দণ্ডমুণ্ডের মালিক। আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, হত্যার সময়ে আমি তাস খেলছিলাম এবং তার তিনজন সাক্ষী আছে।’

মিঃ মল্লিক তখন করিমকে ছেড়ে গজু, কালু ও রহিমকে চেপে ধরলেন। নানারকম ভয় দেখিয়ে ও জেরা করেও কোনও ফল হল না। ওদের সেই একই কথা—করিম সাড়ে চারটেয় এসেছে এবং সেই থেকে ওরা ব্রিজ খেলছে।

একটু হতাশ হয়ে মিঃ মল্লিক সাব-ইন্সপেক্টর নুর খাঁ-কে বললেন, ‘আপনি অন্য ঘরগুলো দেখুন। আমি এখানেই থাকব।’

নুর খাঁ চলে গেল। মিঃ মল্লিক আনমনে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের রাস্তার দিকে চেয়ে পরবর্তী কার্যক্রমের কথা চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি জানতেন, গজুদের সাক্ষ্যই করিমকে বাঁচিয়ে দেবে। অথচ ওরা মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে এতে কোনও সন্দেহই নেই। কিন্তু ওদের সাক্ষ্যের মধ্যে ফাটল ধরানো যায় কী করে?

সহসা রাস্তার ভিড়ের মধ্যে একজনের ওপর দৃষ্টি পড়তেই মিঃ মল্লিক আনন্দে যেন লাফিয়ে উঠলেন। তিনি একজন পুলিশকে ডেকে বললেন, ‘ওই ভিড়ের মধ্যে অঞ্জনবাবু দাঁড়িয়ে রয়েছেন, দেখেছ?’

পুলিশটি অঞ্জনকে চিনত, বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘যাও, ওঁকে সেলাম দাও।’

একটু পরে সেই পুলিশটির সঙ্গে অঞ্জন ওপরে উঠে এল। মিঃ মল্লিক তাকে সিঁড়ির কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ভারী বিপদে পড়েছি, অঞ্জনবাবু।’

‘ব্যাপার কী, মিস্টার মল্লিক?’ অঞ্জন বলল, ‘শুনলাম কে নাকি খুন হয়েছে!’

‘হ্যাঁ, আলী খুন হয়েছে।’

‘আলী? নামটা চেনা-চেনা মনে হচ্ছে।’

‘সে ছিল কুখ্যাত গুণ্ডা ও স্মাগলার করিম খাঁ-র ডান হাত। কোকেনের একটা বড় চালান চুরি করে আলী গা-ঢাকা দিয়েছিল এবং করিম শিকারি কুকুরের মতো তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল—এ খবর আমাদের ইনফরমার আমাকে জানিয়েছিল। আজ সন্ধে ছ’টায় খবর পেলাম, কে একজন আলখাল্লা পরা লোক, যার মুখটা লম্বা-লম্বা চুলে ঢাকা ছিল, একজন কাকে নাকি ছোরা মেরে ছুটে এই বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। আমি ঘটনাস্থলে এসে দেখি, মৃত ব্যক্তি আলী। সঙ্গে-সঙ্গে আমার সন্দেহ করিমের ওপর পড়ল। এ-বাড়ির সিঁড়ির কাছে আলখাল্লাটা কুড়িয়ে পেলাম। পরে ওই ঘরটায় গিয়ে দেখি, করিম আরও তিনজন বদমায়েশের সঙ্গে বসে রয়েছে। ওই বদমায়েশ তিনটে দৃঢ়ভাবে বলছে, করিম নাকি সাড়ে চারটে থেকে ওদের সঙ্গে তাস খেলছে, একবারও ওঠেনি।’

অঞ্জন চমৎকৃত হয়ে বলল, ‘বাঃ চমৎকার! শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল। আপনি ওই তিনজন সাক্ষীকে ধরে আপনাদের বিশেষ চাপ দিলেই তো ওরা বাপ-বাপ করে সত্যি কথা বলে দেবে।’

ম্লান হেসে মিঃ মল্লিক বললেন, ‘আমি ওই তিনজনকে ভালোভাবে চিনি। ওদের কেটে টুকরো-টুকরো করে ফেললেও ওরা সত্যি কথা বলবে না।’

চিন্তিতভাবে অঞ্জন বলল, ‘ছোরার গায়ে আঙুলের ছাপ…।’

মাথা নেড়ে মিঃ মল্লিক বললেন, ‘ছোরার বাঁটে কাপড় বাঁধা ছিল, ফলে তাতে হাতের বা আঙুলের ছাপ পড়েনি।’

হাতঘড়ির দিকে চেয়ে অঞ্জন বলল, ‘আমি রাত ন’টার শো-তে একটা সিনেমা দেখতে যাব। এ-পাড়ায় আমার এক বন্ধু থাকে। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব বলেই এসেছিলাম। আমার হাতে বেশি সময় নেই। তবু চলুন ওই ঘরে, দেখি, যদি কিছু সাহায্য করতে পারি।’

মিঃ মল্লিকের সঙ্গে অঞ্জন কালুদের ঘরে ঢুকল।

করিম ও অন্যান্য তিনজন উৎকণ্ঠিতভাবে দরজার দিকে চেয়ে ছিল। মিঃ মল্লিক ওদের লক্ষ করে বললেন, ‘এই বাবুকে চেনো? ইনি হলেন চোর-ডাকাতের যম—রহস্যান্বেষী অঞ্জন বসু। ইনি তোমাদের যা জিজ্ঞাসা করেন, সঠিক উত্তর দিয়ো।’

অঞ্জনের নাম অপরাধ-জগতে সুপরিচিত। গজু, কালু ও রহিমের চোখে-মুখে ঈষৎ চাঞ্চল্য দেখা দিল। কিন্তু করিম নির্বিকারভাবে বসে রইল। তার চোখে-মুখে কোনও ভাবের লক্ষণ দেখা গেল না।

অঞ্জন তীক্ষ্ন অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে ওদের মুখের দিকে চেয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর সহসা কালুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘করিম এখানে কখন এসেছে?’

‘সাড়ে চারটেয়,’ অম্লানবদনে কালু উত্তর দিল।

‘তারপর তোমরা কী করলে?’

‘ব্রিজ খেলতে শুরু করলাম।’

‘ব্রিজ? তা তোমাদের পয়েন্ট লেখার কাগজ কোথায়?’

‘আমরা ওসব কাগজে-টাগজে লিখি না।’

‘সবচেয়ে শেষ খেলায় কার ডাক ছিল?’

‘গজুর।’

‘কীসের ডাক ছিল?’

‘দুটো নো ট্রাম্পের।’

‘কী হল?’

‘খেলা শেষ হওয়ার আগেই বড়বাবু এসে গেলেন।’

অঞ্জন ভ্রূ কুঁচকে কী যেন ভাবল। তারপর এগিয়ে এসে গজুকে বলল, ‘তুমি উঠে এসো, আমি এদের সঙ্গে একহাত ব্রিজ খেলব।’

গজু সঙ্গে-সঙ্গে উঠে গেল। করিম মুচকি হেসে বলল, ‘বাবুজী আমার পার্টনার হবেন? আমি কিন্তু আনসান ডাক দিই।’

অঞ্জন কোনও কথা বলল না। সে তাসের প্যাকেটটা তুলে একমনে শাফল করতে লাগল।

সবাই অঞ্জনের মতলব বুঝতে পেরেছিল। সে পরীক্ষা করে দেখছিল, ওরা সবাই ব্রিজ খেলতে জানে কি না।

ঠিক সেইসময় কে যেন দরজা দিয়ে উঁকি মারল। সদা-সতর্ক অঞ্জন ভীষণভাবে চমকে উঠে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে? কে ওখানে?’

চকিতে সবাই দরজার দিকে তাকাল। মিঃ মল্লিক একলাফে দরজার কাছে চলে গেলেন। ঠিক সেইসময় নুর খাঁ ঘরে ঢুকে বলল, ‘আমি স্যার। সব ঘরের তল্লাশি নেওয়া হয়ে গেছে, কিন্তু…।’ বলতে-বলতে সে হতাশভাবে মাথা নাড়ল।

ওদিকে অঞ্জন ততক্ষণ তাস দেওয়া আরম্ভ করে দিয়েছে। সে বাঁদিকের কালুকে প্রথম তাস দিয়ে আরম্ভ করল। অতএব শেষ তাস তার নিজের পাওয়ার কথা। কিন্তু দেখা গেল, তাস শেষ হল ডানদিককার রহিমের কাছে।

অঞ্জন একটু আশ্চর্য হয়ে তাসগুলো তুলে আবার দিতে আরম্ভ করল বেশ সাবধানতার সঙ্গেই। কিন্তু এবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল।

‘ব্যাপার কী!’ অঞ্জন চিন্তিত কণ্ঠে বলল। তারপর সবগুলো তাস তুলে সেগুলো রং অনুসারে আলাদা-আলাদা করতে লাগল। অন্যান্যরা একমনে তার কাজ দেখতে লাগল। রং আলাদা-আলাদা করার পর অঞ্জন সেগুলো নম্বর অনুসারে সাজাতে লাগল।

একটু পরে সে আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘এ কী? ইস্কাবনের বিবি কোথায়?’

‘ইস্কাবনের বিবি?’ অজানা আতঙ্কে করিম যেন কেঁপে উঠল।

‘হ্যাঁ, ইস্কাবনের বিবি। এই তাসের মধ্যে ইস্কাবনের বিবি নেই।’

‘নেই!’ ওরা বিস্ময়ে থ’।

কালুর ওপরে কঠোর ও অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে অঞ্জন শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘তুমি বললে, তোমরা এতক্ষণ ব্রিজ খেলছিলে। আশ্চর্য, একটা তাস কমে কী করে ব্রিজ খেলা যায়, বলতে পারো?’

কালু আমতা-আমতা করতে লাগল। সে চেষ্টা করল অন্যদিকে, বিশেষ করে করিমের দিকে, চাইতে, কিন্তু অঞ্জনের জ্বলন্ত দৃষ্টির আকর্ষণ থেকে চোখ ফেরাতে পারল না।

অঞ্জন মৃত্যুর মতো হিম কণ্ঠে বলে চলল, ‘এবার মিস্টার মল্লিক তোমাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করবেন। আদালতে তোমাদের বিচার হবে। সেখানে তোমাদের ব্রিজ খেলার কথা টিকবে না। কেননা, একটা তাস কম হলে ব্রিজ খেলা যায় না। ফলে তোমরা সবাই আলীর হত্যাপরাধে জড়িয়ে পড়বে। তারপর ফাঁসি…।’

‘না, না,’ কালু চিৎকার করে উঠল। সে যেন চোখের সামনে ফাঁসির দড়িটা ঝুলতে দেখতে শুরু করেছিল : ‘বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি কথাই বলেছি।’

‘মিথ্যে কথা,’ অঞ্জনের কণ্ঠস্বর হঠাৎ কঠোর হয়ে উঠল। সে বিদ্যুৎবেগে মিঃ মল্লিকের দিকে ঘুরে বলল, ‘মিস্টার মল্লিক, এই লোকটা ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যে কথা বলছে। একে এক্ষুনি গ্রেপ্তার করুন। আলীর প্রকৃত হত্যাকারীকে না পাওয়া গেলে এর নামেই কেস চালাবেন। এখানে একটা তাস কম রয়েছে অথচ ও বলছে, ওরা নাকি ব্রিজ খেলছিল…।’

মিঃ মল্লিক গম্ভীরভাবে কালুর দিকে এগিয়ে আসতেই কালু অকল্পনীয় আতঙ্কে শিউরে উঠে আর্তনাদ করে উঠল, ‘আমাকে বাঁচান হুজুর, আমরা তাস খেলছিলাম না…।’

‘খবরদার,’ বীভৎস কণ্ঠে করিম চিৎকার করে উঠল।

চকিতে অঞ্জন একবার মিঃ মল্লিকের দিকে চাইল। তার চোখের ইশারা বুঝতে পেরে মিঃ মল্লিক সদলবলে করিমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বেশ কিছুক্ষণ ঝটাপটির পর করিমকে গ্রেপ্তার করা হল। অঞ্জনের নির্দেশ অনুসারে নুর খাঁ তাকে বাইরে নিয়ে গেল।

এবার ঘরে মিঃ মল্লিক ও অঞ্জনের সঙ্গে রইল গজু, কালু ও রহিম। অঞ্জনের ইশারা মতো মিঃ মল্লিক সদর্পে এগিয়ে এসে বললেন, ‘তোদের তাস খেলার কথা যে মিথ্যে, তা তো প্রমাণ হয়ে গেল। এবার সত্যি কথা খুলে বল। ভয় নেই, করিম আর ফিরে আসবে না। ওর ফাঁসি হবেই। বল…বল শিগগির, যদি আলীর খুনের সঙ্গে নিজেদের না জড়াতে চাস…।’

এবার ওরা তিনজনই ভেঙে পড়ে সব কথা খুলে বলল।

মিঃ মল্লিক তক্ষুনি একটা লিখিত বিবৃতি নেওয়ার জন্য ওদের তিনজনকে থানায় পাঠিয়ে দিলেন।

ঘরের মধ্যে রইলেন মিঃ মল্লিক ও অঞ্জন।

সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে অঞ্জনের দিকে চেয়ে মিঃ মল্লিক বললেন, ‘আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব! সত্যি, আপনি অদ্ভুত কর্মী।’

অঞ্জনের মুখে একটুকরো রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল। সে ঈষৎ ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, ‘এটা সাবধানে রাখুন। সুযোগ পাওয়ামাত্র এটাকে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবেন,’ বলতে-বলতে সে কোটের পকেট থেকে কী যেন একটা বের করে মিঃ মল্লিকের হাতে গুঁজে দিল।

বিস্মিত মিঃ মল্লিক হাতের মুঠো খুলে দেখলেন তাঁর হাতে রয়েছে ইস্কাবনের বিবিটা। তিনি সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘এ কী! এটা আপনার কাছে এল কী করে?’

মুখে কৃত্রিম একটা করুণ ভাব ফুটিয়ে তুলে অঞ্জন বলল, ‘হাতসাফাই মিস্টার মল্লিক, স্রেফ হাতসাফাই। আসলে ওদের প্যাকেটে পুরো বাহান্নটা তাসই ছিল। আমি মওকা মতো হাতসাফাই করে…।’ সহসা মুখটা আরও করুণ করে সে বলল, ‘কী করব, বলুন। এরকম না করলে ওই তিন মহাত্মার সাক্ষ্য কি ভাঙা যেত?…যাই এবার, সিনেমার সময় হয়ে এসেছে।’

বিস্মিত হতবাক মিঃ মল্লিকের মুখে কয়েক সেকেন্ড কোনও কথাই ফুটল না। তারপর তিনি চমৎকৃত কণ্ঠে বললেন, ‘সত্যি অঞ্জনবাবু, আপনার তুলনা নেই। আপনিও জুলিয়াস সিজারের মতো বলতে পারেন—ভিনি, ভিডি, ভিসি…।’

মাসিক রহস্য পত্রিকা

পুজো সংখ্যা, ১৯৬৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *