ড্রাগনভিলা – রবিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়
অদৃশ্য বস্তুর মতন এমন অনেক পার্থিব জিনিসই লুকিয়ে রয়েছে আমাদের চারপাশে, যাকে আমরা দেখেও দেখি না। এটা হয়তো সত্যিকারের কোনও অলৌকিক ঘটনার মতনই শোনাবে, তা হলেও এটা একটা বাস্তব সত্য। অত্যন্ত নিদারুণ সত্য বলেই এর বাস্তবতা ভয়ঙ্কর। ভ্রমণবিলাসী এবং পুরাতত্ত্ববিলাসী তাঁর সংবেদনশীল মন নিয়ে রূঢ় গোপনতার ভেতরে প্রবেশ করে যদি একটা নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসেন (অবিশ্যি সত্যিই তাঁরা যে ফিরে আসতে পারবেন এমন নিশ্চয়তা দেওয়া না-ই ভালো) তাহলেও সে-গুপ্ত পৃথিবীর রূপটা অন্য সবার কাছে অপরিজ্ঞাতই থেকে যাবে। এর একটা কারণ এই যে, পুরাতত্ত্ববিলাসী যখন সেই জগৎ থেকে ফিরবেন তখন তিনি আর চক্ষুষ্মান থাকবেন না। দু-চোখের দৃষ্টি হারিয়ে বাইরের পৃথিবীর আলোর জগতে তিনি যখন প্রবেশ করবেন তখন সবই তাঁর কাছে অন্ধকার আর চোখের কোটরের অন্দরের তীব্র ও বিভীষিকাময় এক অনুভূতি।
সে কী! আমরা চিৎকার দিয়ে উঠলাম, সুরম্য, তুই এসব কী বলছিস?
ঠিকই বলছি! বললে সুরম্য একটু ম্লান হেসে, জানিস, আমি গিয়েছিলাম সেই অন্ধকার কন্দরে!
কীসের কন্দরে?
ড্রাগনভিলায়! অবশ্য ‘ভিলা’ শব্দটা আমরাই যোগ করেছি। সুরম্য ধীর ও শান্ত কণ্ঠে কফি খেতে-খেতে বললে, নাম তার ড্রাগনভিলা। সংসারে অনেক অদৃশ্য বস্তুর মতনই সেই ড্রাগন-ভিলাও এতকাল লোকচক্ষে অদৃশ্যই ছিল। এই সেদিন, ধর মাসদুয়েক আগে এক শিকারি ভদ্রলোক হঠাৎ সেই ভিলাটা আবিষ্কার করেন। কী বলব, জামালপুর-মুঙ্গেরের পাহাড়ে-ঘেরা সে-
জঙ্গলের রূপ দেখলে তোরা শিউরে উঠবি। জামালপুর স্টেশনের পেছনে রেল কলোনি, সেই কলোনির পেছনে পাহাড়সারি ডিঙিয়ে চলে যাও পুব-দক্ষিণমুখো। পাহাড়ের চুড়োয় ওঠো—দেখবে পাহাড়ের সারি চলে গেছে যত দূর চোখ যায়। সেই ধোঁয়া-নীল পাহাড়ের তলায় অচেনা এক অরণ্য। শিকারিরা প্রায়ই যায় সে-জঙ্গলে। আমরাও গিয়েছিলাম। জামালপুর থেকে আমরা তিনবন্ধু শিকারের লোভে সেই প্রথম ওই অরণ্যে প্রবেশ করি। খুব ভোর-ভোর থাকতেই বেরিয়েছিলাম। প্রথমে পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে বেশ কয়েক মাইল পরিক্রমা করে দুপুরের দিকে এমন একটা পাহাড়ের গায়ে এসে নামলাম যেখান থেকে একদিক বাদে আর তিন-দিকের কোনও কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। বিশাল চেহারার দুটি পাহাড়-চুড়ো দু-দিক থেকে হঠাৎ যেন আবির্ভূত হয়ে দিগন্তকে গ্রাস করে ফেলেছে। তারই কোলে নীচের উপত্যকায় সুবিশাল এক জঙ্গল। আমরা যখন সেই জঙ্গলের উপত্যকায় নেমে এলাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। তিনদিকেই পাহাড়ের দেওয়াল বলে উপত্যকার জঙ্গলে কেমন আধো-আলো আধো-অন্ধকার ভাব। আমরা বুঝলাম, আমরা দিক ভুল করেছি। পাহাড়ের চুড়ো থেকে দূরবিনে গঙ্গার রেখা যতটুকু দেখে-দেখে এগিয়েছি—তারপর সেই রেখা অদৃশ্য হয়ে গেলে সম্পূর্ণ অজানা এদিকটায় আর এক পা-ও আমাদের অগ্রসর হওয়া উচিত হয়নি। যদি এই মুহূর্তে ফিরবার উদ্দেশ্য নিয়ে আবার পাহাড়ের চুড়োপথে না উঠি তো বাকি দিনটুকু এবং রাত্রিটা এই ভয়াবহ জঙ্গলেই কাটিয়ে দিতে হবে। সেটা আমাদের পক্ষে হয়তো শুভ নাও হতে পারে, কারণ, শুনেছি এদিকের জঙ্গলে নাকি ভয়াবহ ধরনের প্যান্থার আর নেকড়ের আস্তানা। আমরা অবশ্য শিকারে এসেছিলাম। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, একমাত্র দিব্যেন্দুই ছিল আমাদের মধ্যে প্রকৃত শিকারি। আমি আর প্রণব বলতে গেলে শখ করেই এসেছিলাম। তবে হ্যাঁ, শিকারি না হলেও আমরা দুজন ভ্রমণবিলাসী ছিলাম তো বটেই। আর প্রণব তো ছিল পুরাতত্ত্ববিদের ছাত্র।
হঠাৎ প্রণব বলে উঠল, তবে কি আমরা সেই অনুরাধাপুরেই এলাম?
চমকে উঠে আমি বললাম, কী বললি তুই প্রণব? কী পুর যেন বললি?
প্রণব বললে, অনুরাধাপুর!
দিব্যেন্দু তার দূরবিন চোখে রেখে প্রশ্ন করলে, অনুরাধাপুর কি কোনও ঐতিহাসিক নাম, প্রণববাবু?
প্রণবের দু-চোখে তীব্র এক অনুসন্ধানী দৃষ্টি। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে সে জবাব দিলে, হ্যাঁ, ঐতিহাসিক তো বটেই। সম্রাট অশোকের সময়ে পত্তন হয়েছিল সেই অনুরাধাপুরের। কলিঙ্গ যুদ্ধের সময়ে সম্রাটের এক নাতি, যতদূর সম্ভব মনে আছে, নাম তাঁর অনঙ্গদেব, তিনিই এই নগরী তৈরি করেছিলেন। সম্রাটের অনুরোধে পরে তিনি এ-নগরী বৌদ্ধদের দান করেন। তাঁর মেয়ে অনুরাধার কিন্তু এতে সায় ছিল না। অনুরাধা পরে কয়েকজন তরুণ বৌদ্ধ ভিক্ষুর সঙ্গে চক্রান্ত করে মঠের বৌদ্ধদের হত্যা করে চারদিকে আগুন লাগিয়ে দেয়। সম্রাট অশোকের তখন মৃত্যু হয়েছে। চিনদেশের দু-একজন ভ্রষ্টচরিত্র ভিক্ষুও অনুরাধার সঙ্গে ছিল। তাদের মধ্যে একজনকে অনুরাধা বিয়ে করে অনুরাধাপুরে শাসনকার্য চালাতে থাকে। এরপরে একদিন অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে অনুরাধার মৃত্যু হয়। তার চোখ দুটো ঝলসে গিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। তার মৃত্যুর পর তার স্বামী সেই চিনে ভিক্ষুটিরও আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। মৃত অনুরাধার দেহের পাশে পাওয়া গিয়েছিল একটা বীভৎস আকৃতির ড্রাগনের মূর্তি। আর—আর—।
প্রণব হঠাৎ থেমে গেল।
আমি বলে উঠলাম, আর, আর—বলেই ফেল না সবটা।
প্রণব কেমন দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বললে, আর সেই ড্রাগনের দাঁতগুলোর সঙ্গে গাঁথা ছিল অনুরাধার অমন সুন্দর চোখজোড়ার মণি দুটো!
শিউরে উঠলাম প্রণবের কথায়। এমন বিদঘুটে কাহিনি ইতিহাসের কোন জীর্ণ পাতা ঘেঁটে সে উদ্ধার করলে সেসব প্রশ্নের মধ্যে আর না গিয়েও বললাম, তা তুমি কী করে জানলে যে, এই উপত্যকার জঙ্গলের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সেই অনুরাধাপুর?
প্রণব এবার হাসল। তীব্র অনুসন্ধানী চোখ দুটো আশ্চর্যরকমের সপ্রতিভ হয়ে উঠল তার। নীচ থেকে একটা ভাঙা পাথরের মূর্তির অংশ টেনে তুলে নিয়ে সে বললে, এই দ্যাখো,
জঙ্গলের মধ্যে পড়ে আছে। প্রথম দৃষ্টিতে বোঝাই যায় না এটা কোনও মূর্তির অংশ কিংবা একটা বাজে পাথর। এর এককোণায় প্রাচীন পালি হরফের একটা বাক্য ফুটে উঠেছে যার সরল অর্থ হচ্ছে, ‘অনুরাধাপুরের দেবদাসী’। তার মানে এই ভাঙা পা-টা কোনও দেবদাসীর পাথরের মূর্তির অংশ!
অন্ধকার তখন আরও জমাট হয়ে এসেছে। উপত্যকার জঙ্গলের রূপ দেখে আমরা ক্রমশই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম। রাইফেলধারী দিব্যেন্দু দেখলাম বেশ নিশ্চিন্তমনে সমুখের উঁচু টিলার জঙ্গলটার দিকে ওঠবার উপক্রম করছে। সে বরাবরই শিকারের সঙ্গে আনুষঙ্গিক হিসেবে এক-আধটু রোমাঞ্চ ভালোবাসত। কিন্তু আমরা নতুন শখ করে এসেছি। দুশ্চিন্তায় ও আশঙ্কায় আমার মুখ ঘনায়মান হয়ে উঠল।
আমি বললাম, চলুন দিব্যেন্দুবাবু, এবার ফেরা যাক। পাহাড়ের মাথায় উঠলে এখনও আলো পাওয়া যাবে। অন্তত দু-চার মাইল তো দিনের আলোয় হাঁটতে পারব।
দিব্যেন্দু ওখান থেকে চেঁচিয়ে বললে, কিন্তু শিকার? কিছু একটা না করে ফিরে গেলে, আপনারা তো কলকাতা চলে যাবেন, আমার কিন্তু বাড়ি ফিরে গিয়ে হতাশা আর ব্যর্থতার মধ্যে থেকে-থেকে মাথা খারাপ হয়ে যাবে।
কিন্তু এই রাত্তিরে, এই ভয়াবহ জঙ্গলে!—কেমন বিবর্ণ কণ্ঠে বললাম।
ভয় কী, তাঁবু আর খাবার তো সঙ্গে রয়েছেই।—তেমনই চেঁচিয়ে বললে দিব্যেন্দু।
প্রণবেরও দেখলাম পুরোপুরি ইচ্ছে এই জঙ্গলে রাতটা কাটানো। পুরাতত্ত্ব আবিষ্কারের নেশা ধরেছে হঠাৎ তার। আর একজনের শিকারের নেশা। এমন বিচিত্র লোকদের সঙ্গে কখনও বের হতে হয়! অগত্যা সব আশা ছেড়ে দিয়ে প্রণবের অনুগামী হলাম। জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। আর সে কী জঙ্গল—ভাষায় বর্ণনা করি এমন সাধ্য নেই আমার। শাল আর সেগুনের ফাঁকে-ফাঁকে বুনো পলাশ, পিয়াল, বোংগা, কদম আর ধওড়া গাছের দুর্ভেদ্য জঙ্গল। এক ধরনের রাক্ষুসে তৃণলতা আর চীহড় লতায় বেষ্টিত হয়ে সেই জঙ্গল উঁচু-উঁচু টিলার এ-ধারে ও-ধারে ছড়িয়ে থেকে যেন অসংখ্য ব্যূহের সৃষ্টি করেছে। একবার যদি সেই ব্যূহের ভেতরে ঢোকো তো আর বের হতেই পারবে না। আর সেই ব্যূহবেষ্টনীর ভেতরে ঘুটঘুট্টে অন্ধকার। এমনিতরো জঙ্গল প্রায় মাইলদেড়েক পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে বিপরীত দিকের একটা পাহাড়ের কোলে। শুনলাম এ-জঙ্গলে নাকি চিতাবাঘ আর বন্য বরাহও রয়েছে। দিব্যেন্দুর মুখখানা দেখলাম খুশিতে ডগমগ করে উঠেছে।
অগত্যা আমি বললাম, ওহে পুরাতত্ত্ববিদ, তোমার সেই অনুরাধাপুরের কোনও একটা ধ্বংসস্তূপ-টুপও কী পাওয়া যাবে না এই জঙ্গলে ঘুরে-ঘুরে?
অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠে প্রণব বললে, তাই তো খুঁজছি, সুরম্য! কিন্তু একটা কথা, অনুরাধার চোখের মণি দুটো ড্রাগনের মূর্তির দাঁতে গাঁথা হল কেমন করে?
আমি হেসে বললাম, হয়তো কোনও গুপ্তস্থানে অনুরাধার পর্যাপ্ত ধনসম্পদ রক্ষিত ছিল। চিনে ভিক্ষুটা সেসব লুঠ করে সরে পড়বার আগে তাকে হত্যা করে লোককে ভয় দেখানোর জন্যেই চোখ দুটো তুলে নিয়ে ওই ড্রাগনের দাঁতে লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।
প্রণব দাঁতে দাঁতে চেপে বললে, তা নয়। তা হতেই পারে না।
আমি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললাম, হয়তো নয়! কিন্তু তুমি এ-সব উদ্ভট ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন এখন?
জঙ্গলের একেবারে মাঝামাঝি এসে একটা উঁচু টিলার ওপরে উঠছিলাম আমরা। চীহড় লতার এমন ঘন সন্নিবেশ এতক্ষণের মধ্যে আর চোখে পড়েনি। হঠাৎ টিলার ওপার থেকে দিব্যেন্দুর চিৎকার শোনা গেল, প্রণববাবু, দেখে যান—আপনার কথাই সত্যি হল তাহলে!
অন্ধকার হলেও তখনও কিছু-কিছু আলো দেখা যাচ্ছিল চারদিকের। প্রণব ঊর্ধ্বশ্বাসে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ওপরের দিকে উঠে ওপারের ঢালুর দিকে নেমে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে আমিও পশ্চাদ্ধাবন করলাম তার, কতকটা প্রাণের দায়েই। স্পষ্ট অনুভব করলাম, কাঁটায় ভরা শিমূল গাছের সঙ্গে ঘষা লেগে আমার ডানদিকের ঘাড় আর হাত ছড়ে গিয়ে রক্ত ঝরছে। জামাটা তো সঙ্গে-সঙ্গেই ছিঁড়ে গিয়েছিল।
দিব্যেন্দু কেমন বড়-বড় চোখ নিয়ে টিলার দেওয়ালের একদিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওই দেখুন, একটা সুড়ঙ্গপথ। চীহড় লতার আড়ালে।
বিস্ময়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। দিব্যেন্দুর জোরালো ইলেকট্রিক টর্চ যেদিকে তীব্র ফোকাস ফেলে স্থির হয়ে রয়েছিল, জঙ্গলে-ভরা বিরাট ও বিশাল সেই টিলাটার এ-প্রান্তের দেওয়ালে চীহড় লতার ঘন-সন্নিবেশের আড়ালে সত্যিই দেখতে পেলাম একটা প্রবেশমুখ। অনেকটা সুড়ঙ্গমুখের মতন।
প্রণব তখনও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে সেদিক পানে।
দিব্যেন্দু বললে, আপনার অনুরাধাপুরের কোনও ধ্বংসাবশিষ্ট গুপ্ত প্রাসাদের পথ হয়তো এটা, প্রণববাবু।
প্রণব বলে উঠল, চলুন, ভেতরে ঢোকা যাক!
আশঙ্কার সুরে আমি বললাম, কিন্তু ওই সুড়ঙ্গপথের ভেতরে হয়তো কোনও হিংস্র জন্তু-টন্তুর আস্তানাও থাকতে পারে, দিব্যেন্দুবাবু!
তীব্রকণ্ঠে বাধা দিয়ে প্রণব বলে উঠল, না, তা থাকতে পারে না। চীহড়ের গড়ন এবং সন্নিবেশটা বেশ ভালো করে দ্যাখো!
দেখলাম।
প্রণব বললে, যদি বন্য জন্তু এই পথে যাওয়া-আসা করে থাকে তাহলে চীহড়ের ঘন সন্নিবেশ এমন মজবুত ও অনড় থাকত না। অন্তত এই চীহড় ও পরগাছা লতাগুলোর মাঝবরাবর একটা ফাঁক থাকতই, যেখান দিয়ে বন্য জন্তুরা ওই সুড়ঙ্গপথে যাওয়া-আসা করত। কিন্তু এখানে তা কই?
সত্যি তা কই? বিস্মিত হলাম আমি। কিন্তু তবুও বললাম, কিন্তু পাইথন থাকতে পারে। বিশেষ করে ভাঙা বাড়ি বা দুর্গ-টুর্গর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে শুনেছি ভয়াবহ জাতের পাইথনেরা বাস করতে ভালোবাসে।
টর্চ হাতে দিব্যেন্দু বললে, তা থাকতে পারে।
তবে—তা সত্ত্বেও ঢুকতে চাইছেন?
কিন্তু পাইথন তো এ-জঙ্গলের সর্বত্রই রয়েছে, সুরম্যবাবু, সবখানেই তার ভয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তো এই জঙ্গলে আপনি আমাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। চলুন, রাতটা বাইরে তাঁবুর বদলে ওই সুড়ঙ্গ-শেষের অনুরাধাপুরীর মধ্যে গিয়েই থাকি!
বুঝলাম, এ-যাত্রা আর এদের হাত থেকে সহজে নিস্তার নেই। পৈতৃক প্রাণটা এবার রেখে যেতেই হবে এ-জঙ্গলের তলার সুড়ঙ্গগর্ভে। কী কুক্ষণেই না সোল অ্যাভেন্যুর কফি হাউসে বসে প্রণবের কাছে মুঙ্গেরে আসার কথাটা বলেছিলাম। পুরাতত্ত্ববিদ প্রণব কথাটা শুনেই আমার সঙ্গে আসার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করলে। শেষপর্যন্ত এলও। তারপর মুঙ্গেরের বিখ্যাত শিকারি দিব্যেন্দুর বাড়িতে এসে দুজনে উঠলাম। তারপর দেখলাম, ওরা দুজনে বেশ মিলে গেছে। দুজনেই রোমাঞ্চ ভালোবাসে। আমিও ভালোবাসি, তবে মুখে, কাজে নয়। অথচ দিব্যেন্দু আমারই বন্ধু—প্রণবের সঙ্গে তার পরিচয় এই প্রথম। আমরা দুজন তার অতিথি। কিন্তু প্রণবের সঙ্গে তার সেয়ানে-সেয়ানে মিল হয়ে গেছে। শালুক চিনেছে ঠাকুর। দিব্যেন্দু চিনেছে প্রণবকে। সে বেপরোয়া শিকারি—রোমাঞ্চকর তার জীবন। প্রণবও পুরাতত্ত্ববিদ—জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে ঘুরতে ভালোবাসে। সেই সঙ্গে অদ্ভুত-অদ্ভুত কথা বলে। দিব্যেন্দু তার মনের মতো সঙ্গী খুঁজে পেলে। তারপর এই অভিযানে আসা।
রাত্রির রূপ ক্রমশই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল। গভীর জঙ্গলের মধ্যে যাঁরা রাত্রির এ-ভয়াল রূপ দেখেননি তাঁদের কাছে এর বর্ণনা সহজসাধ্য নয়। জঙ্গলের দিকে-দিকে হিংস্র জানোয়ারদের চিৎকার শোনা যেতে লাগল। জঙ্গলের আকৃতি এতই ঘন যে, তার ফাঁক দিয়ে রাত্রির আকাশের এতটুকু চেহারাও নজরে পড়ছিল না।
প্রণব বলল, আমিই প্রথমে ঢুকছি।
দিব্যেন্দু হেসে বললে, তাতে অবশ্য আমার আপত্তি নেই।
প্রণব আগে-আগে, তারপর দিব্যেন্দু আর আমি সুড়ঙ্গমুখের ঝোপঝাড় আর চীহড় সরিয়ে প্রবেশ করলাম। প্রণবের হাতে টর্চ জ্বলছে। সমুখের সবকিছুই দেখতে পাচ্ছি আমরা। দুজন মানুষ চলতে পারে এমন একটা গহ্বর-পথ নেমে গেছে ক্রমশ নীচের দিকে। দু-ধারে নিরেট মাটি আর পাথরের দেওয়াল। দেওয়ালের গায়ে মাঝে-মাঝে কোথাও সোরা আর বিবর্ণ শ্যাওলার মতন উদ্ভিদ। খয়েরি ভেলভেটের মতন দেখতে অনেকটা। অত্যন্ত সতর্কপদে অগ্রসর হচ্ছিলাম আমরা। ক্রমশই ঢালুর দিকে নেমে গেছে গহ্বর-পথটা। পথের ওপর মাঝে-মাঝে প্রতিবন্ধকের মতন ভাঙাচোরা দু-চারটে পাথরের স্তম্ভ এবং দেওয়াল থেকে ধসে পড়া পাথরখণ্ড। সেগুলো ডিঙিয়ে যেতে আমাদের কোনও কষ্টই হল না।
হঠাৎ প্রণব থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বললে, পথ শেষ। গহ্বর-পথের ভেতর দিয়ে অনেকটা নেমে এসেছি আমরা।
প্রণবের কথা শেষ হলে বিস্মিত ও আতঙ্কিত চোখে দেখতে পেলাম, আমাদের সমুখে বিরাজ করছে নিশ্ছিদ্র কালো রঙের নিরেট এক পাথরের দেওয়াল, তার গায়ে কোথাও এতটুকু ফাঁক বা প্রবেশপথের চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
তাহলে?—কেমন থমথমে গলায় আমি বলে উঠলাম।
কতটা নীচে নেমেছি আমরা, প্রণববাবু?—দিব্যেন্দু কৌতূহলী কণ্ঠে প্রশ্ন করলে।
অন্তত একশো ফিট নীচে তো হবেই। তাহলেই বুঝুন, কতটা নীচে চাপা পড়ে আছে হাজার-হাজার বছর আগেকার সেই অনুরাধাপুর।
কিন্তু আর পথ কই?
পথ সম্ভবত এখানেই শেষ।—প্রণব তার অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে পাথরের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল আমার মনে হয়, এই দেওয়ালটার গায়ে কোনওখানে একটা দরজা রয়েছে। কালের প্রভাবে মাটি আর পাথরে চাপা পড়ে গেছে সেটা।
তন্নতন্ন করে চারধারটা খুঁজে দেখেও দেওয়ালের কোথাও কোনও চিহ্ন দেখা গেল না। বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগলাম, যদি এখানে একটা নিরেট দেওয়ালই থাকবে তাহলে
এ-সুড়ঙ্গপথ তৈরি করবার অর্থ কী! এমন কোনও মহামূর্খ থাকতে পারে সেই ইতিহাসের যুগে, যে শুধু-শুধু একটা বন্ধ সুড়ঙ্গপথ তৈরি করানোর জন্যে অর্থ আর শ্রম ব্যয় করেছিল?
আমি বললাম, চলুন দিব্যেন্দুবাবু, ফিরে যাই। প্রায় ঘণ্টাখানেক তো ঘুরেই মলাম এই বিদঘুটে গহ্বর-গলিতে—আর কেন?
কিন্তু পরমুহূর্তেই প্রণবের চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। জোরালো পাওয়ারের চশমার আড়ালে তার চোখ দুটো থেকে যেন আগুন বের হচ্ছে। মানুষের চোখের দৃষ্টি যে অমন হতে পারে, বিশেষ করে মাটির তলার ওই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে, তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। আমি কেমন বোবার দৃষ্টিতে প্রণবের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ইলেকট্রিক টর্চ তেমনি জ্বলেই চলেছে।
প্রণব আচমকা এক চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, শোনো, ওই শোনো, আমি অনুরাধার ডাক শুনতে পাচ্ছি। এই দেওয়াল—দেওয়ালের ওপরই।
সমস্ত সুড়ঙ্গ প্রতিধ্বনিত করে প্রণবের চিৎকারটা যেন পাতালের কোন অন্ধকারে গিয়ে পৌঁছল। দিব্যেন্দুকে দেখলাম, ধীর ও সংযতভাবে সে প্রণবের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
প্রণবের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল শেষপর্যন্ত! গল্পে বর্ণিত ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দৈত্যের মতো লম্বা-লম্বা পা ফেলে প্রণব এগিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি মারল নেই নিরেট দেওয়ালের গায়ে। সঙ্গে-সঙ্গে যে-বিস্ময়কর কাণ্ডের সৃষ্টি হল তা ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। প্রথমে ঝুরঝুর শব্দ করে তারপর প্রচণ্ড এক শব্দ করে সমুখের দেওয়ালটা ধসে পড়ল গহ্বরের মধ্যে। আর সঙ্গে-সঙ্গে দৃষ্টি গিয়ে ঠেকল সমুখে হঠাৎ আবির্ভূত এক সুদৃশ্য কারুমণ্ডিত প্রবেশপথের দিকে। দরজার প্রশস্ত পাল্লা দুটো খোলাই ছিল। বিকট এক চিৎকার দিয়ে ধ্বংসস্তূপটা লাফিয়ে পার হয়ে প্রণব সেই দরজাপথ দিয়ে ভেতরের কক্ষে ঢুকে গেল।
আমরা দুজনে হতমৌন হয়ে অন্ধকারের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইলাম। একটিমাত্র আলো—সে ওই টর্চ, তাও প্রণবের হাতে।
অন্ধকারে অনুভব করছি, দিব্যেন্দু তার দামি টেলিস্কোপিক রাইফেলটার গায়ে হাত বোলাতে-বোলাতে মাঝে-মাঝে অস্পষ্ট কণ্ঠে কী আবোল-তাবোল বকে উঠছে।
আমি ফিসফিস করে বলে উঠলাম, অনুরাধাপুর না ছাই! কোনও একটা প্রাচীন গুম্ফার ধ্বংসস্তূপ হবে এটা!
দিব্যেন্দু বললে, যাই হোক, শুনুন, প্রণববাবুকে উদ্ধার করে আনতে হবে ওই গুম্ফা থেকে! যেরকম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন আবিষ্কারের নেশায় তাতে ওই গুম্ফার ভেতরের কোনও একটা কুঠুরির মধ্যে গিয়ে বেঘোরে মারা না পড়েন!
তা সত্যি।
তাহলে চলুন ভেতরে ঢুকে পড়ি।
কিন্তু এই তীব্র অন্ধকারে কিছুই যে দেখতে পাচ্ছিনে, দিব্যেন্দুবাবু।
কী করব ভাবছি, ঘড়িতে খুব সম্ভবত রাত দশটা, অকস্মাৎ গুম্ফার ভেতরের কোনও একটা কক্ষ থেকে প্রণবের একটা নির্দয় চিৎকার ভেসে এল, আমার চোখ—আমার চোখ! অনুরাধা, আমার চোখ দুটো তুমি তুলে নিয়ো না,—কে আছ, বাঁচাও—বাঁচাও—।
এক ঝটকায় আসুরিক বিক্রমে একটা লাফ দিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই সেই ধ্বংসস্তূপ পার হয়ে দিব্যেন্দু গিয়ে পৌঁছল গুম্ফার অন্ধকার কক্ষে। মিনিটকয়েক ধরে তার পায়ের শব্দ শুনলাম। তারপর একসময় ক্ষীণ হয়ে তাও মিলিয়ে গেল। গুম্ফার অন্ধকার প্রবেশপথের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। কী এমন অপার্থিব জীব থাকতে পারে ওই কুৎসিত গুম্ফার বিষাক্ত কন্দরে যার ভয়ে প্রণব অমন ভয়ার্ত কণ্ঠে সাহায্য চাইছে?
হঠাৎ আমার দৃষ্টি ঘুরে গেল গুম্ফার একেবারে অভ্যন্তরে। অসংখ্য জোনাকি দিয়ে গড়া দুটো জ্বলন্ত চোখ যেন ধেয়ে-ধেয়ে এগিয়ে আসছে দরজার দিকে। সঙ্গে-সঙ্গে ঝিঁঝির ডাকের মতন সুরেলা অথচ বীভৎস একটা শব্দ তীব্র ঐকতান সৃষ্টি করে নৃত্যের তালে-তালে অগ্রসর হচ্ছে।
আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম, প্রণব, দিব্যেন্দুবাবু—।
কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। তবে? তবে কি তারা কেউ বেঁচে নেই! এ-অভিশপ্ত গুম্ফায় কেন প্রবেশ করলাম ওদের সঙ্গে? ভয়ে আমার সমস্ত দেহ থরথর করে কাঁপতে লাগল। একবার ভাবলাম, পালাই এ-অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ ধরে। পরমুহূর্তেই বন্ধুদের কথা মনে পড়ল। ওই মৃত্যুপুরীর মধ্যে ওদের ফেলে রেখে কোন আক্কেলে পালাব আমি। দিব্যেন্দুর বাড়িতে গিয়ে (অবশ্য যদি সশরীরে গিয়ে পৌঁছতে পারি) এ-মুখ দেখাব কেমন করে?
ঝিঁঝির শব্দ আর সেই বীভৎস জোনাকিপুঞ্জের চোখ ক্রমশই ধেয়ে-ধেয়ে আসতে লাগল আমার দিকে। ক্রমে দরজার গোড়ায় এসে স্থির হয়ে দাঁড়ালে সে-চোখ দুটো। ঝিঁঝির তীব্র ঐকতানবাদন তেমনই বিশ্রী সুরে বেজেই চলল।
মনে-মনে ভাবলাম, ওটা কি অনুরাধার প্রেতাত্মা? অবশ্য যদি প্রেতাত্মা বলে কোনও জিনিস থেকে থাকে!
সেই মুহূর্তেই গুলির শব্দে কেঁপে উঠল চারদিক। গুম্ফাটা যেন থরথর করে কাঁপতে লাগল। জোনাকি-চোখ অপচ্ছায়াটার পেছন দিক থেকে তীব্র টর্চের আলো এসে পড়ল। বন্ধ হয়ে গেল ঝিঁঝির বাদ্যধ্বনি—আর মিইয়ে গিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল জোনাকিপুঞ্জের নৃত্যরত চোখ দুটো। শুধু হিস—সাঁ—ই—করে একটা তীব্র শব্দ হয়ে সবকিছুই নীরব হয়ে গেল মুহূর্তমধ্যে।
টর্চের আলোয় পলকের জন্যে একবার জোনাকি-চোখের নৃত্যরত জীবটার চেহারা দেখেছিলাম আমি। সে-চেহারার কথা আর বলতে চাইনে। সে-কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই না বলাই ভালো।
একটু পরে রক্তাক্ত মুখ হতচেতন প্রণবকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়াল দিব্যেন্দু। তারপর আমার হাতে টর্চ দিয়ে ক্লান্ত ও বিষণ্ণ কণ্ঠে বললে, চলুন, তাড়াতাড়ি চলুন এ-সুড়ঙ্গ ছেড়ে।
ঊর্ধ্বশ্বাসে আমরা সুড়ঙ্গপথে এগিয়ে চলতে লাগলাম। এবার সুড়ঙ্গের পথ চড়াই। বাঁকগুলো অতি কষ্টে পার হয়ে এলাম। দিব্যেন্দুর কাঁধে তখনও প্রণবের অজ্ঞান দেহটা নিথর। সুড়ঙ্গের বাইরে এসে বিবর্ণ কণ্ঠে দিব্যেন্দু হঠাৎ বলে উঠল, প্রণববাবুর চোখদুটো আর নেই, সুরম্যবাবু! একেবারে অন্ধ হয়ে গেছেন উনি।
সে কী!—নিদারুণ বিস্ময়ে চমকে গেলাম আমি।
হ্যাঁ, অনুরাধা ওর চোখ দুটো ছিনিয়ে নিয়েছে!
কিন্তু আপনি গুলি ছুড়লেন যাকে লক্ষ্য করে, সেটা কী?
সেটা?—দিব্যেন্দু মাটির ওপর শুইয়ে রাখলে প্রণবের হতচেতন দেহটাকে। তারপর বললে, একটা ড্রাগন! আর ওই গুম্ফাটাও ড্রাগনের গুহা।
গল্প আমার শেষ হয়ে গেল। এ থেকে যে যা-খুশি আন্দাজ করে নিতে পারেন। অনেকে আমাকে পাগল বলবেন সন্দেহ নেই। কিন্তু এ-কথা সত্যি, অভিশপ্ত ওই অনুরাধাপুর জামালপুরের অনেক পাহাড় পেরিয়ে এখনও সে-উপত্যকার জঙ্গলের তলায় গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে। কে প্রণবের চোখ দুটো কেড়ে নিয়েছিল জানিনে এবং প্রণবও এ-সম্বন্ধে তারপর থেকে নিশ্চুপ, কিন্তু দরজাপথে অন্ধকারের মধ্যে যে একটা বীভৎস অপচ্ছায়া আমি দেখেছিলাম তাতে আর কোনও সন্দেহ নেই।
আমি বললাম, তাহলে তুই টর্চের আলোয় যা দেখলি সেটা কী?
সেটা?—এদিক-ওদিক তাকিয়ে চুপিচুপি কণ্ঠে সুরম্য বলল, সেটা একটা অতিকায় চেহারার হিংস্র গিলা। অনেকটা গোসাপের মতন দেখতে। হাত-পায়ের নখগুলো তীক্ষ্ম ধারালো! হাঃ হাঃ হাঃ—গিলা!
আমরা বললাম, হ্যাঁ, টেক্সাস ও ব্রেজিলের অরণ্যে এমনি গিলার কথা পড়েছি আমরা!
আমি বললাম, ও-ই ড্রাগন! চুপ-চুপ—প্রণব হয়তো এখুনি এসে পড়তে পারে!
কিন্তু প্রণব গুম্ফার মধ্যে ঢুকে ‘অনুরাধা আমার চোখ নিয়ো না—নিয়ো না’—বলে অমন অমানুষিক চিৎকার দিয়ে উঠেছিল কেন?—আমরা প্রশ্ন করলাম।
প্রণব হয়তো অন্ধকারে গিলাটাকে ভালো করে দেখতে পায়নি। সে আন্দাজ করেছিল, অনুরাধার প্রেতাত্মাই হয়তো ড্রাগনের রূপ ধরে তার চোখ ছিনিয়ে নিচ্ছে। তাই সে চিৎকার দিয়ে উঠেছিল অমনি করে।
কিন্তু তুমি এমন ফিসফিস করে কথা বলছ কেন?
কারণ, প্রণব শুনতে পেলে তার সেই অন্ধ-বিশ্বাসটাই নষ্ট হয়ে যাবে। তার ধারণা, অনুরাধাই তার অন্ধ হওয়ার মূল কারণ। যেই মুহূর্তে জানতে পারবে আসল রহস্য, পরমুহূর্তেই সে এতটুকু দ্বিধা না করে তার বিকলাঙ্গ জীবনের অবসান ঘটাবে।
আমি নিঃশব্দ হলাম।*
* নক্ষত্র মুখোপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত
মাসিক গোয়েন্দা
পুজো সংখ্যা, ১৯৬৩