সংঘাত – প্রবীরগোপাল রায়
মির্জাপুর স্ট্রিটের অভিজাত খাবার দোকানে ঘেরা-জায়গাটিতে বসে কাজল ভালো করে অদ্রীশকে দেখার সময় পেল। প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কেটেছে এতক্ষণে। মিনিটপাঁচেক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ করে বাইরে বেরিয়েছে, এমন সময়ে গেটের পাশ থেকে অদ্রীশ ওকে ডাক দিয়েছিল। বোঝাই যায় এ-সাক্ষাৎকে দৈবের চক্রান্ত বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কিন্তু ওকে ওর ‘দিশদার’ এতদিন পরে হঠাৎ কী দরকার পড়ল তা বারদুয়েক প্রশ্ন করেও জানতে পারেনি। কুশল প্রশ্নের বিনিময় সমাপ্ত। এইবার আসল কথাটা কীভাবে পাড়বে তাই বোধহয় ভাবছে অদ্রীশ। চশমার আড়ালে চোখের দৃষ্টি নত। দিশদার চেহারা খুব বদলায়নি, ভাবল কাজল। মাথার চুল কপাল থেকে একটু পশ্চাদপসরণ করেছে, চেহারা ভারী হয়েছে সামান্য—আর কিছু নয়। চল্লিশের চেয়ে কি বেশি বয়স ওঁর। ‘কৃষ্ণা চৌধুরী নামে কবিতা লেখে এমন কারও নাম শুনেছিস?’ জিগ্যেস করল অদ্রীশ।
‘না। হঠাৎ এ-প্রশ্ন?’
অদ্রীশ কিছু জবাব দেওয়ার আগেই আচমকা কাজল বলে বসল, ‘নাম শুনে মনে হয় আমাদের কোনও বোন।’
আইসক্রিমের পাত্রে চামচটা রেখে দিয়ে পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে এক জায়গায় সেটা খুলে কাজলের দিকে বাড়িয়ে দিল অদ্রীশ, ‘পড়ে দ্যাখ।’
গুটিতিন-চার কবিতার নকল। পাশে-পাশে কবে কোথায় সেগুলি প্রকাশিত হয়েছে তাও উল্লিখিত। সব ক’টিই বেরিয়েছে গত তিন মাসের মধ্যে বিভিন্ন সাহিত্য-পত্রিকায়।
কাজল একে-একে পড়ে আর ওর বিস্ময় বেড়ে চলে। শ্লথ কিন্তু উত্তপ্ত কাব্য। চিত্রকল্প একান্তভাবে ব্যক্তিক। শব্দালঙ্কারের প্রয়োগ সুপ্রচুর। একটি কবিতায় ‘সহজ’ শব্দটিকে তিনটি বিভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে। সহজ, সহ-জ এবং স-হজ—তীর্থযাত্রার পুণ্য সমেত। ভাব নয়, রূপের দিক থেকে এ-কাব্যের সঙ্গে আর-একজনের কাব্যের অভূত দৃশ্য হঠাৎ দেখতে পেল কাজল। কিন্তু দ্বিতীয়জন আট বৎসর পূর্বে মৃত।
নোটবইটা ফেরত দিয়ে কাজল বলল, ‘ভারি মজার ব্যাপার। ছোড়দির কবিতা অনুকরণ করার মতো লোকও বাংলা সাহিত্যে আছে।’
‘কবিতারও অনুকরণ হয়!’ প্রশ্নটি ভাবতে কয়েক-মুহূর্ত সময় নিল অদ্রীশ, তারপর দৃঢ়স্বরে বলল, ‘ও-কবিতা অসিতারই লেখা।’
‘আপনি এই বলে বেড়ান আর লোকে অসিতা গাঙ্গুলিকে ফোর-টুয়েন্টি মনে করুক।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর মুখে ওই বোম্বাই মার্কা ভাষা শুনে বিচলিত হলেও ওর কথার ইঙ্গিত বুঝতে অদ্রীশের অসুবিধে হয়নি। মৃত লেখকের পুনর্জীবন লাভ বাংলা সাহিত্যে নতুন নয়। যে-কবি আজ থেকে আট বৎসর পূর্বে মৃত বলে বিজ্ঞাপিত, তাঁরই কলম থেকে বেরুনো বলে এখন যদি লোকে কৃষ্ণা চৌধুরীর কবিতাগুলিকে সন্দেহ করে তাহলে তারা স্বভাবতই ধরে নেবে অসিতার মৃত্যু-সংবাদটা ব্যবসায়িক কৌশলমাত্র। অসিতা নাম্নী কোনও মহিলা আদৌ ছিলেন না, এমনও মনে হবে।
কিন্তু কোথাও একজন মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে এ তো অদ্রীশ জেনেছে। পত্রিকার সম্পাদকদের কাছে ছুটে গিয়েছিল কৃষ্ণা চৌধুরীর ঠিকানা জোগাড় করতে। ঠিকানা জোগাড় হয়েছে, কিন্তু সেসব ঠিকানাই কল্পিত। কেন এমন হয়?
কাজলের কথায় চমক ভাঙল।
‘দিশদা, আপনি রাজীববাবুর কাছে গেলে উনি বলতে পারেন হয়তো যে, ছোড়দির অপ্রকাশিত কবিতা কেন কৃষ্ণা চৌধুরীর নামে বেরুচ্ছে।’
‘কে? রাজীবলোচন মুখার্জির কথা বলছিস? তাঁর সঙ্গে এ-ঘটনার কী সম্পর্ক?’
‘ছোড়দি নিজের সমস্ত কবিতা ওঁকেই দিয়ে গেছে। কবিতার বইটা তো উনিই প্রকাশ করেছেন।’
অদ্রীশের কাছে সংবাদটি অপ্রত্যাশিত। কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইল ও।
‘রাজীববাবুর ঠিকানা জানিস?’
‘প্রকাশকদের কাছে চেয়ে নেবেন। বাবাও জানতে পারে।’
দুই
চৌধুরী জমিদারের আনুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত গ্রামের বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেয়ে রাজীববাবু প্রথম কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। গ্রামে মেয়েদের স্কুল ছিল না বলে অসিতার মা নিজে ডেকে পাঠিয়ে মেয়েদের শিক্ষার ভার রাজীববাবুর হাতে দিয়েছিলেন।
অসিতা বলত, ‘মাস্টারমশাইয়ের কাছে শিখেছি জীবনকে আর জীবনের যা-কিছু ভালো তাকে ভালোবাসতে।’
অদ্রীশ পরিচয় দিতেই রাজীববাবু চিনলেন। ছেলেমানুষের মতো একটি হাত ধরে টানতে-টানতে ওকে ঘরে নিয়ে বসালেন। তক্তপোশের ওপর বই-খাতা সব ছড়ানো। হাত দিয়ে একপাশে সেগুলো ঠেলে সেখানেই বসল ও।
‘আমার অসিতাদিদির মুখে আপনার কথা শুনেছি। ইদানীং বলত, ”মা গিয়ে আমার আত্মীয়ের মধ্যে এক দিশদা।” ‘
‘আর বান্ধবের মধ্যে মাস্টারমশায়।’
সলজ্জ হেসে রাজীববাবু উড়িয়ে দিলেন অদ্রীশের কথা।
দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এসে দেখে যাও কে এসেছেন।’
মোটাসোটা চেহারার রং ময়লা একজন গিন্নি বেরিয়ে এলেন দরজার আড়াল থেকে। মাথায় কাপড় নেই। গায়ে সোনার ভারী গহনা। মুখে পান। রাজীববাবুর পাশে কেমন ভালো লাগল ওঁকে। নিরাসক্ত মুখে অদ্রীশের পরিচয় শুনলেন। প্রতি-নমস্কার করাটা উচিত সে-খেয়াল করলেন না।
দশ বছর আগে অসিতার যখন বিয়ে হয়নি, তখন সে এর কাছে কীরকম ব্যবহার পেয়েছে না জানি, মনে-মনে ভাবল অদ্রীশ।
‘কী খাওয়াচ্ছ আজ আমার এই ভাইটিকে?’
বলাবাহুল্য, ভাইটির প্রবল আপত্তি অগ্রাহ্য করলেন রাজীববাবু। গিন্নি রান্নাঘরে যেতে অদ্রীশ আরম্ভ করল নিজের কথা।
‘দেখুন, অত্যন্ত গুরুতর ব্যাপার নিয়ে আপনার কাছে এসেছি।’
‘হবে এখন সে-কথা। আপনাকে যা দেখাচ্ছি আগে দেখুন।’
তক্তপোশের তলায় রাখা একটা টাঙ্ক থেকে একটা ফাইল বেরুল।
‘কাগজে-কাগজে অসিতার বই-এর কী সুন্দর সব সমালোচনা বেরিয়েছিল দ্যাখো।’ ফাইলটা ওর হাতে দিতে-দিতে বললেন, ‘তোমায় আর ”আপনি” বলব না।’
দু-একটা কাটিং অদ্রীশ পড়ে দেখল। একজন লিখছেন :
গ্রন্থখানির ‘শবরী’ নামকরণ লেখিকার মনোভঙ্গির যথাযথ পরিচায়ক। কবিতাগুলির মধ্য দিয়া সংসারের সংঘাতে আহত একটি নারীহৃদয় তাহার করুণ প্রেমের অর্থ অনাগত অভিরামের উদ্দেশে মেলিয়া ধরিয়াছে!…
‘ওর অপ্রকাশিত কবিতাও তো কিছু আছে?’
প্রশ্নের জবাবে রাজীববাবু টাঙ্ক থেকে একটা মোটা বাঁধানো খাতা বার করলেন। একনজরেই ধরা পড়ে, তাতে লেখা কবিতাগুলো একই সময় নকল করা হয়েছে। অপ্রকাশিত কবিতাগুলো দেখা শেষ হলে অদ্রীশ প্রশ্ন করল, ‘আপনার কাছে আর কবিতা নেই?’
রাজীববাবু মাথা নাড়লেন।
‘অন্য কারও কাছে আছে বলে জানেন?’
‘কী ব্যাপার বলো তো? কুচো কবিতা দু-একজনের কাছে নিশ্চয়ই আছে। তোমার কাছেই কি আর নেই? কিন্তু সে মারা যাওয়ার পর এই আটবছর বাদে কে আর সেগুলোর কথা মনে করে রেখেছে। তা ছাড়া অসিতা সেগুলোকে স্বীকার করে না।’
‘সন্দেহ করবার কারণ রয়েছে। কে বা কারা অসিতার কিছু কবিতা অন্য কবির নামে পত্রিকায় চালাচ্ছে।’
‘অসম্ভব।’
পকেট থেকে নোটবইটা বের করে দিল অদ্রীশ। উত্তেজনায় হাত কাঁপছিল। পড়তে-পড়তে বিস্ময়, অবিশ্বাস ইত্যাদি ভাব খেলা করল রাজীববাবুর মুখে। পড়া শেষ হয়ে গেলে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন। স্বগতোক্তি করলেন, ‘আশ্চর্য!’
উৎসাহভরে অদ্রীশ কিছু বলতে যাচ্ছিল। উনি অধৈর্যের সঙ্গে হাত তুলে থামিয়ে দিলেন, ‘আশ্চর্য হওয়ার আসল কারণ কোথায় তা তুমি ধরতেই পারোনি।’
অদ্রীশ চুপ।
‘তোমার আনা কবিতাগুলো অসিতারই লেখা বলে মনে হয়। কিন্তু তা কী করে সম্ভব! ভাবের দিক থেকে ওগুলো ”শবরী”র কবির পরিণত অভিজ্ঞতার সৃষ্টি বলে মনে হয় যে। কিন্তু দুজন কবির কাব্যে রূপগত এত মিল!’
নিজের বুদ্ধিকে ধিক্কার দিল অদ্রীশ। ভাবের পরিণতির ব্যাপারটা এখন ওর কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট মনে হচ্ছে। সেটা ওর কাছে এতদিন ধরা পড়েনি কেন? ভেবে বুঝল তার কারণ আছে। মহৎ কবির সৃষ্টিতে ভাবের পালাবদল কাব্যের রূপে পরিবর্তন আনে। ভাবের সঙ্গে রূপের সে-মিলন অসিতার সেই কাব্যে কোথায়? রূপের পুনরাবৃত্তি সেখানে ভাব-বৈলক্ষণকে স্পষ্ট করে ধরতে বাধা দিয়েছে। তথাপি, শবরীর প্রতীক্ষা যে শেষ হয়েছে, এ প্রেমস্নিগ্ধ স্বীকৃতি চাপা পড়েনি। শুধু জীবন নয়, আগে প্রেম তারপর জীবন, এই নবীন উপলব্ধির ঘোষণা অস্পষ্ট হতে পারে কিন্তু তা অকৃত্রিম। পরিণত অভিজ্ঞতা? যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে…
অদ্রীশের চমক ভাঙল। রাজীববাবু একটা চিঠি ওকে দেখবার জন্য দিলেন। ও পড়ে গেল :
মবাইয়া
৩রা অক্টোবর, ১৯৫০
শ্রীচরণেষু মাস্টারমহাশয়,
আমার রচনার উপর আপনারও কিছু অধিকার আছে। সঙ্গের খাতাটায় যে আশিটি কবিতা আছে সেগুলির পরিবর্তন, প্রকাশন ইত্যাদি যাবতীর স্বত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে আপনাকে দিলুম। কখনও ভালো লাগলে ছাপাবেন। আমার অন্য কোনও রচনাকে আমি স্বীকার করি না। আপনি এ-দায়িত্ব নিলে আমি স্বস্তি পাই। প্রণাম জানবেন। ইতি—
অসিতা
অদ্রীশের চিঠিটা পড়া শেষ হলে রাজীববাবু বললেন, ‘দিদি আমার যেন বুঝতে পেরেছিল ভগবান ওকে এইবার নিজের কাছে ডেকে নেবেন।’
কিন্তু অদ্রীশ ভাবছিল অন্য কথা। অসিতা মারা গেছে ১৯৫০-এর ৫ অক্টোবর। ভয়ঙ্কর মৃত্যু। রাঁচি থেকে কিছু দূরে মবাইয়ায় তখন অসিতা থাকে। পাটনায় যে-স্কুলে ও শিক্ষকতা করছিল সেখানে পুজোর ছুটি হওয়াতে ও ওখানে গিয়েছিল। ৫ তারিখে ভোরে উঠে ও বেড়াতে বেরিয়েছিল। আর ফেরেনি। কয়েকশো ফুট গভীর একটা খাদের ধার দিয়ে সঙ্কীর্ণ পথ চলে গেছে। সেই পথে বেড়ানোর সময়ে ও খাদে পড়ে যায়। দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। খাদের নীচে বর্ষ-শেষের খরস্রোতা জলধারা বইছে। ওর পরনের কাপড়খানা খাদের গায়ে একটা গাছে আটকেছিল। দু-পায়ের স্লিপারও খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।
সেদিন রাজীববাবুর কাছে বিদায় নেওয়ার আগে অদ্রীশ জানিয়েছিল কৃষ্ণা চৌধুরীর ভুয়ো ঠিকানা দিয়ে কবিতা পাঠানোর কথা।
‘হাতের লেখা?’ প্রশ্ন করেছিলেন রাজীববাবু।
‘সব ক’টি কবিতাই সাদা কাগজের ওপর টাইপ করা। প্রত্যেকবারই কলকাতার কোনও-না-কোনও অঞ্চল থেকে সেগুলো ডাকে দেওয়া হয়েছিল।’
বহু পরে, রহস্যের সমাধান হয়ে গেলে অদ্রীশ জেনেছিল কৃষ্ণার বাবা কলকাতায় কর্মোপলক্ষে এলে কবিতাসুদ্ধ খামগুলো ডাকে দিয়ে দিতেন।
তিন
জমিদারবাড়ির সনাতন-রীতি অনুসারে অসিতার দুই দিদি অল্পবয়সে লেখাপড়া ছেড়ে স্বামীর ঘর করতে গিয়েছিল। অসিতার বেলা ব্যতিক্রম হল। রাজীববাবু ওর মার কানে কী মন্ত্র দিলেন, তিনি জেদ করে মেয়েকে কলেজে পড়াবেন বলে কলকাতায় নিজের বাপের বাড়িতে পাঠালেন। অদ্রীশ অসিতার মামার বাড়ির দিক থেকে ওর দূরসম্পর্কের ভাই। কলকাতার দুজনের আলাপ। অসিতা বলত, ‘জীবন নয়, জীবন সংগ্রামের দীক্ষা আমার দিশদার কাছে। কেবল ভালোবাসা নয়, গ্রহণ।’
মা-মরা মেয়ে অসিতাকে ওর বাপ বনেদী ঘরের একমাত্র ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। বছর না ঘুরতে যখন মেয়ে স্বামীকে ছেড়ে বাপের বাড়ি এসে উঠল তখন বোঝা গেল রাজীববাবু আর অদ্রীশের শিক্ষাদানের ফল। বোঝার যেটুকু বাকি ছিল তাও পূর্ণ হল যখন অদ্রীশের পরামর্শে পাটনায় একটা স্কুলে চাকরি নিয়ে অসিতা চলে গেল। বিবাহ-বিচ্ছেদের উপায় থাকলে সেটাও বোধহয় বাদ পড়ত না।
এসব হল প্রায় দশবছর আগের ইতিহাস। অসিতার ছোড়দা রজত চৌধুরী এখন কলকাতার ডাক্তারি করেন। তাঁর ওখানে মেজদা শুভ্র চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে আসার সময়ে অদ্রীশের মনে সংশয় ছিল কেমন অভ্যর্থনা পাবে। ত্রুটিহীন মৌলিক আপ্যায়নে শুভ্র চৌধুরী ওকে নিশ্চিন্ত করলেন। সাহস পেয়ে ও কাজের কথা পাড়ল।
‘অসিতার মৃত্যুর খবর পেয়ে মবাইয়া গিয়েছিলেন আপনিই তো?’
‘হ্যাঁ।’ কঠিন হয়ে গেল শুভ্র চৌধুরীর মুখ : ‘কিন্তু অতদিন আগের কথা আর টেনে আনছেন কেন?’
‘দুর্ঘটনার ব্যাপারটা আগাগোড়া সাজানো ছিল না তো?’
‘বুঝলুম না।’
‘সন্দেহ করবার কারণ রয়েছে। ও আজও অজ্ঞাতবাস করছে।’
কিছুক্ষণ কেটে গেলে তবে কথা সরল শুভ্র চৌধুরীর মুখে : ‘আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’
অদ্রীশ নিজের সন্দেহের কারণ আগাগোড়া বলে গেল। ওর কথা শেষ হতে শুভ্র চৌধুরী ভুঁড়ি দুলিয়ে হেসে উঠলেন : লোকের লেখা এক ধরনের হল বলে আপনি মরা মানুষকে জ্যান্ত করে তুলবেন!’
‘কিন্তু কৃষ্ণা চৌধুরী নামটা? মিথ্যে ঠিকানায় টাইপ করে কবিতা পাঠানো?’
পুনর্বার চিন্তার প্রয়োজন আছে বলে শুভ্র চৌধুরী মনে করলেন না।
ওঠবার আগে অদ্রীশ বলল, ‘আমি সমস্ত ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত বুঝে ছাড়ব।’
‘তাতে অসিতার কী উপকারটা হবে? মরে শান্তি পেয়েছে ও।’
‘শুভ্রবাবু, আমি নাস্তিক।’
‘তাই বোঝেন না যে, কূলবধূর জীবনে মৃত্যুর চেয়েও বড় ক্ষতি আছে।’
‘আপনার এ-কথার অর্থ আমি ভেবে দেখব।’
চলে যাচ্ছিল অদ্রীশ। শুভ্র চৌধুরী ডাকলেন। রাগে জ্বলছে তাঁর চোখ।
‘এত যদি আপনার শোনার ইচ্ছে তো শুনুন। দুর্ঘটনায় মরেনি অসিতা। তাকে খুন করা হয়েছিল। আর খুনিকে নির্জন রাতে বাড়িতে ডেকে এনেছিল আপনার প্রগতিশীলা ভগ্নীটি।’
নিষ্ঠুর কঠিন শোনাচ্ছিল শুভ্র চৌধুরীর কণ্ঠস্বর। বিস্ময় সামলে নিয়ে অদ্রীশ কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তিনি দরজার দিকে সঙ্কেত করলেন : ‘বেরিয়ে যান এবার।’
চার
চৌধুরীদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মুখ নিচু করে হনহনিয়ে হাঁটছিল অদ্রীশ। কাজল এসে ধরল : ‘মাগো, রাস্তার লোক প্যাট-প্যাট করে দেখছে। আপনাকে ধরতে প্রায় ছুটে আসছি।’
কাজলের দিকে তাকিয়ে অদ্রীশ হাসল।
‘সাজগোজের বাহারটা একটু কম করলে তো আরও আগে এসে ধরতে পারতিস।’
একটু লজ্জিত হল কাজল। সেটা চাপা দিতে অনেক কথা বলল।
‘ইস। মেজদার সঙ্গে নীচে তর্কাতর্কি করছিলেন কানে আসছিল। তা আমার সঙ্গে একবার দেখা করে এলে কি মান যেত? নাকি, ছোড়দি ছাড়া আমরা সব পর?’
একটু ভেবে অদ্রীশ বলল, ‘চল, তোর সঙ্গে কথা আছে।’ সেদিনের মতো আবার রেস্তোরাঁর একটি নিভৃত কোণে দুজন বসল। কালো মোটা সাপের মতো দুই বিনুনি বুকের ওপর এসে পড়েছে কাজলের। টান-টান হয়ে বসে কাজল বলল, ‘আমি আর কচি খুকিটি নেই।’
সকৌতুকে অদ্রীশ বলল, ‘আচ্ছা!’
‘সব কথা আমি শুনতে চাই।’
‘কীরকম?’
‘মেজদার সঙ্গে আপনার কী কথা হচ্ছিল?’
একটু চুপ করে থেকে অদ্রীশ কী বলবে ভেবে নিল।
‘লোককে যা-ই বোঝানো হোক তোর মেজদা অন্তত আগাগোড়াই জানে যে, অসিতা দুর্ঘটনায় মরেনি।’
‘তাহলে কি…’
‘তোর মেজদার বিশ্বাস ওকে খুন করা হয়েছিল।’
রুদ্ধনিশ্বাসে কাজল বলল, ‘সর্বনাশ!’
একটু দম নিয়ে অদ্রীশ বলল, ‘আচ্ছা ধরে নে খুন ও হয়নি। তাহলে কী সমাধান হতে পারে?’
‘আত্মহত্যা।’ চটপট জবাব এল।
‘ঠিক। কিন্তু অসিতার এ-চিঠিটা পড়বার পরও কি তুই বলবি আত্মহত্যা ওর পক্ষে সম্ভব ছিল?’
নোটবই থেকে বের হওয়া চিঠিটা কাজল পড়ল।
মবাইয়া
৩ অক্টোবর, ১৯৫০
দিশদা,
কী ভালোই লাগছে এখানে এসে। বাংলাদেশে শরতের শিউলিবিছানো সৌন্দর্য দেখেছি। এখানকার সৌন্দর্যে কিন্তু বিশেষ একটি গৌরব চোখে পড়ে। এখানকার মাটি শ্যামলিমার অনুকূল নয়। তবু যে-গাছপালাগুলি প্রতিজ্ঞা করেছে বাঁচবে তারা আজকের এই শরতের ভোরে শিশিরে স্নান করে রৌদ্রালোক পান করছে। দেখতে-দেখতে মন থেকে সংস্কারের মায়া, হতাশার বাঁধন আলগা হয়ে যায়। ওদের কাছে জীবন বরণের মন্ত্র নিই। লোকালয়ে যতক্ষণ থাকি দেখি জীবনের অপচয়। চারিদিকের অন্ধকার আর বাধা সেখানে মানুষকে ব্যঙ্গ করছে। এখানে এসে বুঝলুম হার স্বীকার করাটা প্রকৃতির নিয়ম নয়। তুমি ঠিক এই কথাই কতদিন বুঝিয়েছ, নয় কি? ভালোবাসা জেনো। ইতি—
অসিতা
চিঠিটা পড়া শেষ হলে কাজল ওটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ‘এই চিঠি লেখার দুদিন পরে ছোড়দি যদি আত্মহত্যা করে থাকে তবে খুব আশ্চর্য বলতে হবে।’
অদ্রীশ কিছু বলছে না দেখে আবার বলল, ‘ভাবছেন বোধহয় নারীর মন কত বিচিত্র।’
‘না, সে-কথা নয়। ভাবছিলুম শেষ সম্ভাবনাটির কথা। অসিতা আদৌ মরেনি এমন হওয়াটা কি খুব অসম্ভব?’
অর্ধস্ফুট আওয়াজ বেরুল কাজলের মুখ থেকে।
‘তখন সব শুনতে চাইছিলি না? শোন তবে।’
রাজীববাবু ও শুভ্র চৌধুরীর সঙ্গে নিজের সাক্ষাৎকারের আনুপূর্বিক বিবরণ দিল অদ্রীশ।
‘মেজদার শেষ কথা শোনার পরও আপনি জল ঘোলা করতে চান?’
‘একশোবার। পৃথিবীতে একটি লোকও কথায় বা কাজে অসিতার প্রতি অন্যায় করছে চিন্তা করলে আমি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না।’
‘তবে আর কী! আটবছর আগে ছোড়দি কীভাবে মরেছিল তাই নিয়ে গোয়েন্দাগিরি আরম্ভ করুন।’ রেগে উঠেছে বলে কাজল আর নিজেকে সামলাতে পারল না। ‘আপনার কাণ্ডজ্ঞান আর-একটু বেশি থাকলে আপনি বুঝতেন ছোড়দির প্রতি আপনার এই দৃষ্টিকটু মনোযোগের জন্যে ওকে বেঁচে থাকতে কত দুঃখ পেতে হয়েছে।’
‘মিথ্যে কথা।’
‘জামাইবাবুর সঙ্গে দিদির ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় আপনার প্রসঙ্গ নিয়ে। এ-কথা বাড়ির সবাই জানে।’
‘মনের মিল ওদের দুজনের প্রথম থেকেই হয়নি। তারপরে একটা বাগদী মেয়েকে নিয়ে স্বামীর কেলেঙ্কারির জন্য অসিতা চলে এসেছিল জানি। নিজের মুখরক্ষা করতে তোর জামাইবাবু ওর নামে নিন্দা রটনা করেছিল।’
কাজল নিজের মত বদলাল কি না বোঝা গেল না। তবে চুপচাপ রইল। কিছুক্ষণ পরে অদ্রীশ বলল, ‘তোর ছোড়দিকে কতটুকু দেখেছিস তুই! বড় সুন্দর ছিল ও। কাউকে সুন্দর বললে তো তোরা নিজেদের প্রিয় অভিনেত্রীর মুখটা কল্পনা করে নিস। বললে বুঝবি কী করে সে কী ধরনের সুন্দর ছিল। এমন একটি করুণ মায়া সে সৌন্দর্যকে ঘিরে থাকত যে, ওকে স্পর্শ করতে ভয় লাগত—মনে হত সে-সৌন্দর্য বুঝি ভেঙে পড়বে। ওকে ভালোবাসতুম। কিন্তু তা কি এমন কিছু—’ কথাটা মাঝপথে থামিয়ে আবার বলল, ‘অসম্ভব।’
‘দিশদা, আপনি আমায় ক্ষমা করুন।’
টেবিলের ওপর রাখা কাজলের শুভ্র নিটোল হাতখানির ওপর অদ্রীশ একটু চাপ দিল ‘দূর পাগলি! তুই নাকি আবার বড় হয়ে গেছিস!’
রেস্তোরাঁ থেকে বেরুবার সময়ে অদ্রীশ বলল, ‘তোর মেজদার সঙ্গে কথা বলার পর আবার তোর সঙ্গে কথা বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে, অসিতার মৃত্যু সম্বন্ধে সব খোঁজ নেওয়ার দায়িত্ব আমার রয়েছে।’
কাজল কিছু বলি-বলি করছিল। সেদিকে নজর যায়নি বলে বিদায় নিয়ে অদ্রীশ চলে যাচ্ছিল। কাজল ওর পাঞ্জাবি ধরে টানল।
‘তুমি তিন সত্যি করো, যা খবর পাবে সব আমায় জানাবে।’
হেসে আজ্ঞা পালন করল অদ্রীশ।
পাঁচ
অসিতার মৃত্যুর তদন্ত করেছিলেন দারোগা রামাবতার মিশ্র। উচ্চতর পদ পেয়ে তিনি এখনও রাঁচিতেই ছিলেন। কর্মজীবনে অদ্রীশ কৃতী। রামাবতারবাবুর মুখ খোলানোর উপযুক্ত পরিচয়পত্র জোগাড় করতে ওর অসুবিধে হয়নি। খবর দিয়েছিল আগেই। উনিই কেস-ফাইলটা দেখে রেখেছিলেন।
দুজনের কথাবার্তা ইংরেজিতেই হল। কাজের কথায় এসে অদ্রীশ স্পষ্টই বলল, ‘অসিতা দেবী দুর্ঘটনাতেই মারা গেছলেন কি না সে বিষয়ে আমাদের সন্দেহ আছে।’
‘এতদিন বাদে আপনার কাছে বলতে আমার আপত্তি নেই যে, উনি দুর্ঘটনায় মরেছিলেন, না, খুন হয়েছিলেন তা পুলিশ ঠিক ধরতে পারেনি। কেবল আত্মীয়-স্বজনের অনুরোধে পুলিশ ব্যাপারটাকে দুর্ঘটনা বলেই প্রচার করেছিল।’
‘পুলিশ প্রথমে দুর্ঘটনা বলেই সন্দেহ করেছিল বোধহয়।’
‘অবশ্য। রোজই ভোরে বেড়াতে বেরুতেন। সেদিন সকালে ঝি এসে দ্যাখে দরজায় তালা দেওয়া। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন ফিরলেন না তখন খুঁজতে বেরিয়ে খাদের ধারে…।’
‘সমস্ত ব্যাপারটা সাজানো হওয়া সম্ভব নিশ্চয়ই?’
‘খুবই সম্ভব। মৃতদেহ পাওয়া গেল না এবং বেড়াতে বেরুতে কেউ দেখেনি।’
‘তা যখন দেখেনি তখন যে চার তারিখ রাতেই মারা যাননি তারও তো কোনও নিশ্চয়তা নেই।’
রামাবতারবাবুকে এ-যুক্তির সারবত্তা মানতে হল। ‘যাক, তারপরে বলুন।’
‘ছ’তারিখ সকালে শুভ্রবাবু এসে পৌঁছলেন। দুপুরে রাঁচির ব্যাঙ্ক থেকে খবর পাওয়া গেল যে, চার তারিখে অসিতা দেবী ওঁর অ্যাকাউন্টস-এ যে-দশহাজার টাকা ছিল সেটা তুলে নিয়েছিলেন। কলকাতার অফিসের সঙ্গে আগেই এ-ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন তিনি। সে-টাকার খোঁজ পাওয়া গেল না যখন, তখন পুলিশ সন্দেহ করল দুর্ঘটনাটা সাজানো ব্যাপার হয়তো।’
অসিতার স্বামী অজিত গাঙ্গুলি বাপের একমাত্র ছেলে। সাত-পাঁচ ভেবে বুড়ো গাঙ্গুলি ছেলের বিয়ে দেওয়ার পরেই পুত্রবধূর নামে দশহাজার টাকা লিখে দেন। এ-কথা অদ্রীশের অজানা ছিল না।
‘শুভ্রবাবু এবং অজিতবাবুর দুর্ঘটনা সম্পর্কে কী মতামত ছিল?’
‘শুভ্রবাবু প্রথমে খুনের থিয়োরি স্বীকার করেছিলেন এবং বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলেন যেন অপরাধী শাস্তি পায়। বিকেল হতে-হতে দেখলুম, ওঁর উৎসাহও কমে গেল। বিকেলে অজিতবাবুও এসে পৌঁছুলেন। খুনের থিয়োরি উনি মানতে চাননি। স্ত্রীর জীবন অসুখী করে তোলার জন্যে তিনি বারংবার অনুতাপ প্রকাশ করলেন এবং বললেন যে, পারিবারিক অশান্তির জন্য অসিতা দেবী আত্মহত্যা করে থাকবেন। টাকাটা কেউ সুযোগ বুঝে সরিয়েছে এই ছিল তাঁর মত।’
‘নিজের থিয়োরির স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ দিয়েছিলেন অজিতবাবু?’
‘তিনি বলেছিলেন যে, দু’তারিখে লেখা একটা চিঠিতে ওঁর স্ত্রী অনুরোধ করেছিলেন ওঁদের বিবাহটা একটা ভুল বলে ধরে নিয়ে স্বামী যেন আর-একটি বিবাহ করেন। নিজের দোষ-ত্রুটির জন্য ক্ষমা-প্রার্থনাও নাকি করেছিলেন সে-চিঠিতে।’
‘পুলিশের কাছে আছে সে-চিঠি?’ ব্যগ্রতা ফুটে উঠল অদ্রীশের কণ্ঠস্বরে।
‘অজিতবাবু সে-চিঠি হারিয়ে ফেলেছিলেন।’
‘মবাইয়ার দিনগুলো অসিতা দেবী কীভাবে কাটাতেন আভাস দিন।’
‘সকাল-সন্ধ্যায় বেড়াতেন, অন্য সময়ে লেখাপড়া নিয়ে কাটাতেন। মাঝে-মাঝেই প্রায় সারা দিনটা রাঁচিতে কাটিয়ে দিয়ে আসতেন।’
‘রাঁচিতে কী জন্যে আসতেন?’
‘মনে হয় বেড়াতে, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে—এই সবের জন্যে আর কী।’ বোঝা গেল উত্তরটা অদ্রীশের খুব মনঃপুত হল না।
‘চার তারিখে এমন কিছুই ঘটেনি কি যাতে রহস্যের হদিশ মেলে?’
‘সেদিন ব্যাঙ্কে এসেছিলেন এই মাত্র। দু-বেলা ঝি এসে অস্বাভাবিক কিছুই লক্ষ করেনি।’
‘ওঁর সঙ্গে দেখা করতে কেউ আসত না?’
‘না। এখানে এক তরুণেশ রায় ছাড়া ওঁকে কেউ চিনতই না।’
‘তরুণেশ রায়টি কে?’
‘একটা বিলাতি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের রাঁচি শাখার প্রধান হয়ে সদ্য পাটনা থেকে বদলি হয়ে এসেছিলেন। পাটনা থাকার সময়ে অসিতা দেবীর সঙ্গে স্কুল কমিটির মেম্বার হিসাবে সামান্য পরিচয় ছিল। দুঃসংবাদ শুনে ছ’তারিখ বিকেলে নিজে এসে শুভ্রবাবু ও অজিতবাবুর সঙ্গে আলাপ করে যান।’
‘এখনও রাঁচিতে থাকেন?’
‘না। অনেকদিন আগেই এখান থেকে বদলি হয়ে গেছেন।’
‘অসিতা দেবীর নামে চিঠিপত্র আসত?’
‘না।’
‘পাটনায় উনি যে-বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন সেখানে ওঁর সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছিলেন?’
‘নেওয়া হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য তথ্য কিছুই পাওয়া যায়নি।’
‘পুজোর ছুটি কাটাতে উনি বেছে-বেছে রাঁচির কাছেই কেন এসেছিলেন তা খোঁজ নিয়েছিলেন কি?’
অবাক হয়ে রামাবতারবাবু কিছুক্ষণ অদ্রীশের দিকে চেয়ে রইলেন।
‘রাঁচি ছুটি কাটানোর জায়গা বলেই তো জানি।’
‘যাকগে। যে-ঝি ওঁর ওখানে কাজ করত তার নাম-ঠিকানাটা দিন।’
দীর্ঘকাল আগের একটি ঘটনা সম্বন্ধে ওকে এক স্পষ্ট ধারণা গড়ে দিলেন রামাবতারবাবু।
ওঁর প্রশ্নের জবাবে অদ্রীশ জানাল অসিতা এখন বাঙলা-সাহিত্যের একজন বিখ্যাত মহিলা-কবি। তাঁর বিস্তৃত জীবনী-গ্রন্থ রচনার উপাদান সংগ্রহ করতেই অদ্রীশের এতদূর ছুটে আসা।
ছয়
ঝিকে খুঁজে বের করল অদ্রীশ। জানিয়ে দিল শীঘ্রই ওর পরিবারের সকলে রাঁচি আসছে। এখন ওর মতো একটি ভালো বাঙালি ঝি যদি পাওয়া যায় তো বেশি মাইনে দিয়েও ইত্যাদি-ইত্যাদি। কিছুক্ষণ কথা বলেই ঝিটি বুঝল বাবু কেচ্ছার মহাভক্ত। অদ্রীশের প্রতি ওর রীতিমতো ভক্তি জন্মাল যখন দেখল অনেকদিন আগেকার একটা ঘটনা খুব স্পষ্টভাবে মনে রেখেছে।
‘তা তেনাকে লক্ষ্মীঠাকরুনের মতো দেখতে হলে কী হয়, স্বভাব-চরিত্তির মোটেই ভালো ছিল না।’
‘কেন বলো তো?’
‘মরার আগের দিন সন্ধেয় গতিক দেখে মনে হল কেউ আসবে। জিগ্যেস করতে স্পষ্ট বললেন, কেউ না তো। ঘরে ফিরছি, একটি বাবু আমায় তেনার নাম করে বাড়ি দেখায়ে দিতে বলল।’
‘এ-কথা পুলিশকে বলোনি কেন?’
‘এই দ্যাখো। মারা যাওয়ার পর তাঁর নিন্দে করে নিমকহারামি করি কেন? তেনার ভাই আবার আমায় বুঝায়ে দিলেন যে, পুলিশের লোকগুলোর আমার কথায় বিশ্বেস হবে না। ভাববে, আমিই টাকা সরিয়ে গল্প বানাচ্ছি।’
অদ্রীশ বুঝল ঝির মুখ বন্ধ রাখতে শুভ্র চৌধুরী কোনও অস্ত্র প্রয়োগ করতে বাকি রাখেননি। কলকাতা থেকে এসেই বোধহয় ওর কাছ থেকে সব কথা বের করেছিলেন।
‘সে-বাবুটিকে পরে চিনতে পারোনি?’
‘চিনব! অন্ধকারে কাপড়-চোপড় জড়ানো ভাল্লুকের মতো মানুষটা ফিসফিস করে দুটো কথা কয়েছিল। তবে হ্যাঁ…।’
ঝি ইতস্তত করছে দেখে অদ্রীশ বলল, ‘বলে ফেলো।’
‘রাত্তিরের সেই বাবুটির হাতে ছোকরোট ছিল, ভারী সুন্দর তার গন্ধ। মারা যাওয়ার পরের দিন বিকালে দারোগাবাবু আবার দশরকম কথা জিগ্যেস করতে ডাকছিলেন। ফিরতিছি, নাকে এল ঠিক সেই গন্ধ। একটা ঘরে দিদিমণির ভাই আর দুজন বাবু বসেছিলেন। তেনাদের কারও ছোকরোট হবে। দাঁড়িয়ে নজর করব তার জো ছিল না।’
আর কোনও কথাই বের করা গেল না ঝিটির কাছ থেকে। অদ্রীশ কেবল ভাবছিল চার তারিখে রাত্রে কে এসেছিল অসিতার কাছে। অজিত গাঙ্গুলি? তরুণেশ রায়? না কি, শুভ্র চৌধুরী?
সাত
পাটনায় স্কুল-হস্টেলে থাকত অসিতা। হোস্টেল-সুপারিনটেনডেন্ট মহিলাটিকে কার্ড পাঠাতে তিনি এসে সাদরে অভ্যর্থনা করলেন অদ্রীশকে।
‘আপনি অসিতার দাদা তো? মনে আছে আমার।’
‘এতদিনের কথা ভোলেননি, আশ্চর্য!’
‘ওকে আপনি ছাড়া আর বিশেষ কেউ চিঠি দিত না তো!’
অদ্রীশ বুঝল নিজের দায়িত্ব মহিলা একটু ভালোভাবেই পালন করতেন।
‘ওর সঙ্গে কেউ দেখা-সাক্ষাৎ করতে আসত?’
‘না। যা রিজার্ভড মেয়ে ছিল। অনেকে আলাপ করতে চেয়ে হতাশ হত।’
‘কীরকম?’
‘স্কুল-কমিটির মেম্বার ছিলেন তরুণেশ রায়। ও বই পড়তে ভালোবাসে শুনে দু-দিন মোটরে করে এসে নিজের একগাদা বই দিয়ে গেলেন। তৃতীয় দিন যখন এলেন অসিতা আমার পাশে দাঁড়িয়ে বাগানে জল দিচ্ছিল। তরুণেশবাবু কিছুক্ষণ কথা বলেছেন, ও হাত তুলে ওঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ”আপনার দেওয়া বইগুলোর একটি পাতাও আমার পড়া হয়নি।” মালিকে দিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে বইগুলো আনিয়ে মোটরে তুলে দিল।’
‘তারপর?’
‘তরুণেশবাবু আর আসেননি! সামান্য অবস্থা থেকে জীবনে উন্নতি করেছিলেন। আত্মমর্যাদা জ্ঞানটা কিছু বেশি ছিল।’
মানী লোকেরা কি হার মানে, মনে-মনে ভাবল অদ্রীশ।
মুখে বলল, ‘ওঁর জীবনের কথা বাড়ির লোকদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছিলেন বোধহয়?’
‘উনি একলা মানুষ ছিলেন। ওঁর বিষয়ে এমনি নানা জনের মুখে শোনা।’
‘অসিতা ছুটিতে রাঁচির কাছে গিয়েছিল কি তরুণেশবাবুর মুখে ও-জায়গার সুখ্যাতি শুনে?’
বিস্মিতস্বরে মহিলা বললেন, ‘কই, শুনিনি তো সে-কথা। আপনার কেন ও-কথা মনে হল?’
‘না, এমনি।’
‘আপনি আমার কাছে কীসের জন্যে এসেছিলেন বললেন না।’
‘দরকার শেষ হয়ে গেছে। আর-একটি কথা। অসিতা দুর্ঘটনায় মরেছিল আপনার বিশ্বাস হয়?’
‘আমার মতে আত্মহত্যা করেছিল। ওকে দেখলে আমার কোনও ট্র্যাজেডি কুইনের কথা মনে পড়ত। বোম্বাই ফিল্মের এক হিরোইনের মতো।’ এতজন ছাত্রী ও শিক্ষিকার চরিত্র রক্ষার ভার যার ওপর তাঁর মুখে এ-মন্তব্য শুনে অদ্রীশ একবার ভাবল প্রশ্ন করে, নায়কের মুখ রসগোল্লার মতো হলে ভালো হয়, নাকি ঝাঁটার কাঠির মতো গোঁফেই বেশি মানায়!
শেষ পর্যন্ত কিন্তু গম্ভীরস্বরে বলল, ‘দেখুন, যারা কবিতা লেখে বা ছবি আঁকে তারা আমাদের চেয়ে ঢের-ঢের বেশি জীবনকে ভালোবাসে। জীবনে ওরা তাই আমাদের চেয়ে বেশি দুঃখও পায়। তবু যদি কবিতা লেখা, ছবি আঁকা, বন্ধ হয় তো বুঝবেন জীবনের প্রতি ভালোবাসা তখনও মরেনি।’
আট
দিলদরিয়া মেজাজে অজিতবাবু অভ্যর্থনা জানালেন।
‘যাক, একযুগ পরে সম্বন্ধীর পায়ের ধুলো পড়ল এই গরিবের বাড়িতে।’ অদ্রীশের এখনও বিবাহ হয়নি শুনে চোখ কপালে তুললেন।
‘পরজন্মের জন্যে ওটা বোধহয় তোলা রইল?’
‘পরজন্ম আমি মানিই না। আসল কথা, আপনারা দুটো করে বিয়ে করলে আর আমরা পাত্রী পাই কোথায়?’
হো-হো করে হাসলেন অজিতবাবু। হাসি থামলে বললেন, ‘কেন, আমার দু-নম্বর বউটিকেও কি আপনার কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা নাকি?”
অদ্রীশ বিচলিত হল। উঠে এসে দুটি হাতে অজিতবাবুর হাত চেপে ধরে গভীর স্বরে বলল, ‘আমার আর অসিতার সম্পর্ককে আপনি ভুল বুঝেছিলেন।’
দৃষ্টি অন্য দিকে করে অজিতবাবু জবাব দিলেন, ‘সেসব তো অনেক দিন আগে শেষ হয়ে গেছে।’
অদ্রীশ সেইভাবেই দাঁড়িয়ে বলল, ‘অসিতার কিছু ত্রুটি থাকলে আপনি মাপ করে দিন।’
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অজিতবাবু তীব্র দৃষ্টিতে অদ্রীশকে দেখলেন।
‘স্ত্রীর যদি স্বামীকে পছন্দ না হয় তো স্বামীর কী কষ্ট আপনি বুঝবেন না। আপনার স্ত্রী যদি লুকিয়ে আর-একজনের সঙ্গে প্রেম করে আপনার কেমন লাগে?’
‘কী বললেন আপনি?’
‘অসিতাকে লেখা প্রেমপত্র আমি পেয়েছি।’
‘কোথায় গেল সেগুলো?’
‘নষ্ট করে ফেলেছি।’
‘আপনার উদারতা আশ্চর্যজনক।’
অদ্রীশের কণ্ঠে এত বিদ্রপ ছিল যে, অজিতবাবু প্রায় খেপে গেলেন।
‘এই গাঙ্গুলিবাড়ির অনেক বউকে অসিতার অপরাধের মতো অপরাধের জন্যে এক সময়ে খুন করা হয়েছে আপনি জানেন?’
‘আমার কাছে এমন সব প্রমাণ আছে যেগুলো পুলিশকে দিলে আপনার পক্ষে তাদের বোঝানো শক্ত হবে যে, আপনিও স্ত্রীকে খুন করেননি।’
অজিতবাবুর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
‘অসিতা মরবার পর এই আটবছর বাদে আপনি এইসব কথা আমায় শোনাতে এসেছেন! কী জানেন আপনি?’
‘অনেক কিছুই জানি। কিছু আন্দাজ করতে পারি। তেসরা অক্টোবর (অসিতা মারা যায় পাঁচই অক্টোবর) আপনি অসিতার একটা চিঠি পান। নয় কি?’
‘মিথ্যে কথা।’
‘আপনি পুলিশের কাছে কিন্তু স্বীকার করেছেন চিঠি পাওয়ার কথা।’
তেতো ওষুধ গেলার মতো মুখ হল অজিতবাবুর।
অদ্রীশ প্রশ্ন করল, ‘কী ছিল সে-চিঠিতে?’
‘এতদিন বাদে কখনও মনে রাখা সম্ভব?’
‘আমি আন্দাজে বলি তাতে কী ছিল। অসিতা আপনাকে মবাইয়াতে ডেকেছিল।’
অজিতবাবুর গলা থেকে আপনিই বেরিয়ে এল, ‘তারপর?’
‘আপনি চৌঠা সকালের গাড়িতে রাঁচিতে গিয়ে রাত্রে অসিতার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ঝি আপনাকে দেখেছিল। আপনার গলার স্বর শুনে চিনতে পারে।’
‘কিন্তু আমি অসিতাকে জীবিত দেখে এসেছিলুম।’
‘কোনও প্রমাণ নেই তার। আপনার এখানকার লোহার ব্যবসা ১৯৫০-এর শেষে আরম্ভ করেছিলেন। প্রায় দশহাজার টাকা মূলধন। কোথা থেকে হঠাৎ এল অত টাকা? সে-টাকা আপনি যে অসিতাকে খুন করে নিয়ে আসেননি কোনও প্রমাণ নেই তার।’
‘আপনি আমায় বিশ্বাস করুন। কী জানতে চান বলছি।’ প্রায় আর্তনাদের মতো শোনাল অজিতবাবুর গলা।
‘অসিতাকে ব্ল্যাকমেল করে প্রেমপত্রগুলোর বদলে টাকাটা আদায় করেছিলেন বোধহয়?’
মুখখানা প্যাঁচার মতো করে অজিতবাবু মাথাটা নাড়লেন। বললেন, ‘বিদায়ের সময়ে অসিতা কিন্তু বলেছিল, ”তোমার বাবার দেওয়া দশ হাজার টাকা তোমায় ফিরিয়ে দিয়ে স্বস্তি পেলুম।”’
‘আর কী বলেছিল?’
‘ওকে যেন ভুলে যাই, আর একটি বিয়ে করি, ক্ষমা করে দিই যেন—এইসব আর কী। পরে বুঝেছিলুম আত্মহত্যার ইঙ্গিত ওতেই ছিল।’
কী ভেবে উজ্জ্বল হয়ে উঠল অদ্রীশের মুখ।
মুখে বলল, ‘তখন ওর কথায় কী বুঝেছিলেন?’
‘রাতটা ওর ওখানে কাটিয়ে আসতে চেয়েছিলুম। ও রাজি হল না। সেই জন্যে ক্ষমা চাইল বলে মনে হয়েছিল। বোধহয় বুঝেছিল গাঙ্গুলিবাড়ির ছেলে অবাধ্য স্ত্রীর ওপর অত্যাচার করে না।’
বুক ফুলিয়ে অজিতবাবু গাঙ্গুলিবাড়ির গৌরবকে প্রকাশ করলেন। দেখে ওঁর প্রতি করুণা হল অদ্রীশের।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘বিদায় নিয়েছিলেন কোথায়?’
‘রেল-স্টেশনে। রাত দশটায় আমার টেন ছাড়ার সময়ে।’
‘অত রাত্রে সাত মাইল দূরে নিজের বাড়ি ও ফিরবে কেমন করে তা বলেনি? তখন তো বাস বন্ধ হয়ে গেছে।’
‘এটা তো জিগ্যেস করা হয়নি। এ হে। তা কোনও হোটেলে-টোটেলে ছিল বোধহয়।’
‘হ্যাঁ। তারপর ভোরে উঠে সাত মাইল এসেছিল কেবল আত্মহত্যা করতে।’
সন্দিগ্ধচোখে ওকে দেখে নিয়ে অজিতবাবু ক্ষুণ্ণস্বরে বললেন, ‘আপনি আমার সঙ্গে মজা করছেন।’
‘ওহো না, না। আপনি প্রেমপত্রগুলোর বিষয়ে যা মনে করতে পারেন বলুন দেখি।’
‘তিনখানা বাংলায় লেখা চিঠি। পাটনার একজন ওর ট্রাঙ্ক থেকে ওগুলো চুরি করে আমায় দিয়েছিল। চিঠিতে তারিখ আর অস্পষ্টভাবে নামের সই ছাড়া আর প্রেরকের ঠিকানা বলে কিছু ছিল না। খামগুলো পাওয়া যায়নি বলে ডাকঘরের ছাপ থেকে কিছু ধরব তার উপায় ছিল না। তবে হ্যাঁ, ভদ্রলোকের ছেলের চিঠি।’
‘কেন বলুন তো?’ অদ্রীশের মজা লাগছিল।
‘অত্যন্ত ভদ্র ভাষা। কোথায় কুমুদিনী নামে একটা মেয়ে শেষ পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ি ফিরে গিয়েছিল, নাম ভুলে গেছি কোন বিলেতি বউ পরপুরুষকে ভালোবেসে শেষ পর্যন্ত রেলের তলায় আত্মহত্যা করেছিল…এইসব আগড়ম-বাগড়ম কথা। পাটনায় কত ধুলো, স্কুল কেমন চলছে, মাস্টারি করতে কেমন লাগে, নিজেকে সরিয়ে রাখার কত যন্ত্রণা, অসিতা কত সুন্দর, জীবনে আর্থিক উন্নতি করেও সব পাওয়া যায় না, প্রেম ভিক্ষায় অগৌরব নেই…।’
‘থাক, থাক। কিন্তু সত্যিই আপনি পত্রলেখকের পরিচয় জানতে পারেননি? আপনার এজেন্ট কোনও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন?’
‘না।’
অদ্রীশের হঠাৎ কী সন্দেহ হল। বলল, ‘আপনি আবার আমাকেই সন্দেহ করে বসেননি তো?’
অজিতবাবু উত্তর দিচ্ছেন না দেখে অদ্রীশ হেসে ফেলল।
‘হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট মহিলা ছিলেন। তাঁর নজর এড়িয়ে সাধ্য কী কোনও লোক আপনার স্ত্রীর অমর্যাদা করে। ও চিঠিগুলো হাতে-হাতে কোনোওরকমে দেওয়া হত। ডাকে আসত না।’
‘মানে?’
‘মানে এই যে, আপনি-আমি যখন কলকাতায় বসে, তখন পাটনারই কোনও বীরপুরুষ অসিতাকে একটির পর একটি প্রেমপত্র লিখে যাচ্ছিলেন।’
বিদায় নেওয়ার আগে অদ্রীশ বলল, ‘আপনার অনেক কথাই আমি বিশ্বাস করলুম। আপনি আমার অন্তত একটা কথা বিশ্বাস করুন।’
‘বলুন।’
‘অসিতা আত্মহত্যাই করেছিল। এ বিষয়ে মনে কোনও সন্দেহ রাখবেন না।’
বিশ্বাস করলেন কি না অজিতবাবু মুখ দেখে বোঝা গেল না।
নয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায় অদ্রীশের চিঠি পেল কাজল।
বোম্বাই
৭ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৯
কাজল,
কদিন আগে তোর জামাইবাবুকে বলে এসেছি অসিতা আত্মহত্যা করেছে। মিথ্যে বলিনি। তোরা মেয়েরা প্রেমে চিরদিন আত্মবিলোপই তো করে এসেছিস।
অসিতা মরেনি। কেবল গাঙ্গুলি-পরিবারের বধূ পরিচয়টিকে সে মুছে ফেলেছে। এতে কারও ক্ষতি হয়েছে মনে করি নে। ও মনের মতো মানুষকে নিয়ে ঘর বেঁধেছে। মবাইয়ার ছলনাটুকুর আশ্রয় না নিলে ও অন্য কীভাবে আমাদের সমাজে আরেকজনের স্ত্রী হতে পারত জানি না।
সামাজিক ভালোমন্দের দিক দিয়ে ওকে বিচার করিস নে। ভাবাবেগে শিল্পী তো মুহূর্তে দেশ-কাল-পাত্রের গণ্ডি অতিক্রম করছে। আমাদের ক্ষুদ্র সংস্কারে ওদের বাঁধব কী করে। ‘তেজের ভাণ্ডার হতে কী আমাতে দিয়েছ যে ভরে’—অসংখ্য প্রধান কবির সঙ্গে-সঙ্গে এ তো অসিতার মতো অপ্রধান কবিরও উপলব্ধি।
দিদিকে দেখতে চাস তো আয়। হোটেলের ঠিকানা দিলুম। বাড়িতে যেন কিছু জানতে না পারে। ভালোবাসা নিস। ইতি—
দিশদা
বাড়ির সামনের লনে বসে দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ এক ভদ্রলোক পাইপ মুখে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। পাশে বসে ফুটফুটে ছোট একটি মেয়ে খবরের কাগজের অতিরিক্ত সংবাদগুলি পরিবেশন করছিল।
অদ্রীশ নমস্কার করে বলল, ‘তরুণেশবাবু, আমার সঙ্গের এই মহিলা আপনার স্ত্রীর সঙ্গে একটু দেখা করতে চান।’
ভদ্রলোক স্মিতাহাস্যে নমস্কার করে মেয়েটিকে বললেন, ‘যাও তো মা কৃষ্ণা, এঁকে মার কাছে দিয়ে এসো।’
অদ্রীশ আর তরুণেশ তখন বোম্বাইতে ডাকটিকিট জমানোর শখ তৈরি করা কত সহজ সেই নিয়ে সারগর্ভ আলোচনায় মেতে উঠেছে। কৃষ্ণা নাচতে-নাচতে এসে অদ্রীশের হাত ধরে টানতে আরম্ভ করল।
‘দিশ-মামা, মা-মণি তোমায় ডাকছে।’
তরুণেশের বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে অদ্রীশ ভিতরে চলে গেল। গিয়ে দেখে দুই বোন বসে হাসতে-হাসতে আঁচলে চোখের জল মুছছে।
ওকে দেখার সঙ্গে-সঙ্গে কাজল কলরব করে বলল, ‘জানিস ছোড়দি, তোকে খুঁজতে বেচারা কী ছুটোছুটিই না করলে।’
অদ্রীশ ধরা গলায় অসিতাকে বলল, ‘তোমায় আজ সুখী দেখে কী আনন্দই না হচ্ছে! পরিশ্রম সার্থক।’ নিচু হয়ে কৃষ্ণার গালে ঠোনা দিয়ে বলল, ‘যা তোর বাবাকে ডেকে নিয়ে আয়।’
অসিতা কাজলের দিকে তাকিয়ে অদ্রীশকে বলল, ‘এইবেলা যদি কিছু পুরস্কার চাও তো বলো।’
অসিতার চোখের দিকে তাকিয়ে কাজল হঠাৎ লাল হয়ে উঠল।
অদ্রীশ মাথা চুলকে বলল, ‘আর বুড়ো হয়ে গেলুম। এখন কি আর চাইবার জোর আছে?’
কাজল চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে অসিতা তার পিঠে গুম করে এক কিল মেরে বলল, ‘মর মুখপুড়ি, প্রণাম করে বলবি তো, ”ওগো, আমার শিবের মতো বুড়ো বর চাই।” ‘
মাসিক রহস্য পত্রিকা
জুলাই-আগস্ট, ১৯৬০