1 of 2

রানিমা – বিমল মিত্র

রানিমা – বিমল মিত্র

রানিমা কলকাতায় আসছেন। মহারানি মানে নাহারগড় স্টেটের খাস রানি। নাহারগড়ের যুবরাজ বিন্ধ্যপ্রসাদের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর তিনি সেখানেই চলে গিয়েছিলেন। আর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। সে আজ প্রায় দশ বছর আগেকার কথা। আসলে রানিমা সাধারণ ঘরেরই মেয়ে। নেহাত পাঁচ-পাঁচী। ডাক নাম ছিল গৌরী। গৌরী দেবী নামটাই ছাপানো হত কাগজে।

রানিমা এতদিন পরে কলকাতায় আসছেন শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

কলকাতায় রানিমার এস্টেট ছিল জানতাম। মার্লিন প্লেস না কোথায় একটা প্যালেস ছিল। সারা বছর ফাঁকাই পড়ে থাকত। বিরাট বাড়ি শুনেছি সেটা। বাড়ি, বাগান, চাকর, মালি সবই ছিল, শুধু মালিক ছিল না। মালিক থাকত ছোটনাগপুরে, নিজের রাজ্যে।

টেলিফোন পেয়ে তাই একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

—আপনি কি মিঃ মিত্র?

বললাম, হ্যাঁ, কথা বলছি—।

বোধহয় ভদ্রলোক রানিমারই নায়েব-গোমস্তা-সেক্রেটারি কেউ হবেন। সম্পত্তি দেখাশোনা করেন।

বললেন, রানিমা বুধবার সন্ধেবেলা কলকাতায় আসছেন, চার ঘণ্টার জন্যে, রাত্রেই আবার চলে যাবেন সুইজারল্যান্ডে—আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান—।

প্রথমটা ঠিক বুঝতে পারিনি। এত বছর পরে গৌরী দেবীর সঙ্গে যোগসূত্রটা ঠিক তাড়াতাড়িতে ধরতে পারিনি।

—আপনি বিকেল পাঁচটার সময় এলেই চলবে। পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটা আপনাকে টাইম দিয়েছেন—।

আমি রাজি হলাম। রাজি না হওয়ারও কারণ ছিল না। রাজি না হয়ে উপায়ও ছিল না। কারণ গৌরী দেবীকে আমি ভালো করেই চিনে নিয়েছিলাম।

তখনকার দিনে গৌরী দেবীর বেশ নাম। এখনকার লোকে সে-নাম ভুলে গেছে। সে-যুগেই দু-একটা ছবিতে ভালো অভিনয় করে নাম করেছিলেন গৌরী দেবী। ‘ঋষির প্রেম’ কি ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ কিংবা ‘পুরাণ-ভকত’-এ ভালো পার্ট করেছিলেন। সবে তখন টকি শুরু হয়েছে। এক-একটা ছবি আসে আর আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ি। টিকিট-ঘরের জানালা-দরজা ভাঙা-ভাঙি হয়। রানিবালা, জ্যোৎস্না গুপ্তা, প্রতিমা দাশগুপ্তার যুগ তখন। সেই যুগেই আরও কয়েকটা ছবি করলেই গৌরী দেবী একেবারে ফিলিম-স্টার হয়ে উঠতে পারতেন। কিন্তু হঠাৎ গৌরী দেবী একদিন ফিলিম লাইন থেকেই একেবারে চলে গেলেন।

কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। এ-গল্পের সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগ নেই।

বলতে গেলে গৌরী দেবীর সঙ্গে আমার সামান্যই আলাপ। আমি তখন সেই বাচ্চা বয়সে একটা নাটক লিখে ফেলেছিলাম। একেবারে আস্ত তিন অঙ্কে সমাপ্ত সম্পূর্ণ একখানা নাটক। কাঁচা বয়সের লেখা হোক আর যাই হোক, নাটকখানি পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের ভালো লেগেছিল। সামাজিক বিষয়বস্তু। নাম দিয়েছিলাম ‘ত্রিভুজ’। ক্লাবে আমি ছিলাম সবচেয়ে কম বয়সের ছেলে। বড়রাই পাণ্ডা। আমার মাস্টারমশাই আসতেন সন্ধেবেলা, তাই রিহার্সালে কোনওদিন যেতে পারতাম না। ইচ্ছে থাকলেও যাওয়ার উপায় ছিল না। শুধু অতুলদার কাছে শুনেছিলাম, বিখ্যাত অভিনেত্রী গৌরী দেবী নাকি হিরোইনের পার্ট করতে রাজি হয়েছেন। অতুলদাই ছিল ক্লাবের ড্রামাটিক সেক্রেটারি! অতুলদা অনন্যকর্মা লোক। অতুলদাই চেষ্টা করে বড়-বড় লোককে ক্লাবে আনত। তখনকার দিনে মেয়র-শেরিফ-লাটসাহেব কাউকেই ক্লাবের ফাংশানে আনতে বাকি রাখেনি অতুলদা। সেই অতুলদা যে আমার নাটকে গৌরী দেবীকে হিরোইনের পার্ট করতে রাজি করাতে পেরেছে, তা শুনে আমি খুব বেশি অবাক হইনি। তবে আনন্দ হয়েছিল খুবই নিশ্চয়। ভেবেছিলাম ডি. এল. রায়ের মতো কী গিরিশ ঘোষের মতো না-হোক, একটা ছোটখাটো নাট্যকার আমি বড় হয়ে হবই।

কিন্তু হঠাৎ একদিন অতুলদা এল বাড়িতে।

বললে, ওরে, একটা মুশকিল হয়েছে—।

আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাহলে কি আমার নাটক হবে না?

—না তা নয়, গৌরী দেবী বলছেন ওই লাভ-সিনটা ঠিক হয়নি। ডায়ালগগুলো পছন্দ হচ্ছে না ওঁর—।

—তাহলে কী হবে? প্লে করবেন না উনি?

অতুলদা বললে, কিছু বুঝতে পারছি না।

জিগ্যেস করলাম, উনি কী বললেন?

—জিগ্যেস করলেন ড্রামাটিস্ট কে? আমি তোর নাম করলুম। তখন উনি আবার জিগ্যেস করলেন, বয়স কত? আমি তোর বয়সটাও বললাম। বললাম—সেকেন্ড ইয়ার স্টুডেন্ট—।

—শুনে কী বললেন?

—শুনে গৌরী দেবী বললেন—লাভ সম্বন্ধে এর কোনও আইডিয়া নেই—।

—কেন?

অতুলদা বললে, তা কিছু বললেন না। আমি তো অত বড় আর্টিস্টকে কিছু বলতে পারি না। তখন আমি বললাম, এখন কী করা যায় বলুন? শুনে গৌরী দেবী বললেন, ড্রামাটিস্টকে একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দিন, আমি তার সঙ্গে একটু ডিসকাস করব—।

খানিক থেমে অতুলদা বললে, তুই এক কাজ কর, তুই একবার গিয়ে দেখা কর গৌরী দেবীর সঙ্গে—গিয়ে ডিসকাস করে দ্যাখ না কী বলেন।

বললাম, আমি একলা যাব?

—হ্যাঁ, তুই একলাই যা—আমার যাওয়া ঠিক হবে না। যা-যা বলেন তাই তাই-ই করা যাবে। অত বড় আ.স্ট যখন পাওয়া গেছে, তখন আর ওঁর টেস্ট মতো নাটক বদলাতে ক্ষতি কী?

—বাড়ির ঠিকানা কী?

অতুলদাই ঠিকানা বলেছিল। অতুলদাই বলতে গেলে সব বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল।

দিন-ক্ষণ ঠিক করে আমি একদিন গিয়ে হাজির হলাম গৌরী দেবীর বাড়ি। আনোয়ার শা রোডের ওপর বাড়ি। তখন আনোয়ার শা রোড আরও জঙ্গল ভরতি ছিল। সামনে নিউ থিয়েটার্সের দু-নম্বর স্টুডিয়ো। আমি সেই স্টুডিয়ো বাঁয়ে রেখে আরও কিছু দূর গিয়ে ডান-হাতি একটা বাড়ির গেট খুলে ভেতরের বাগানে ঢুকে পড়লুম।

গৌরী দেবীকে সশরীরে আগে কখনও দেখিনি। সিনেমায় দেখা ছিল। চাকর দরজা খুলে দিতেই আমি আমার নাম বললাম। চাকরটা আমায় ভেতরে নিয়ে একটা ড্রইংরুমে বসাল। বেশ সাজানো ঘর। চারিদিকে আসবাব। ওয়ালে গৌরী দেবীরই কয়েকটা ফ্রেমে-বাঁধানো ছবি টাঙানো।

একটা সোফার ওপর আড়ষ্ট হয়ে বসেছিলাম। চাকরটা পাখা ঘুরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।

ভাবছিলাম জীবনে কখনও কোনও অ্যাকট্রেসের বাড়ি ঢুকিনি। এরা কীরকমভাবে কথা বলবে আমাদের মতো সাধারণ লোকের সঙ্গে তারও অভিজ্ঞতা ছিল না, তা ছাড়া, বহুদিন, বহুরাত পরিশ্রম করে নাটকটা লিখেছি। এর অভিনয় না হলে সব পণ্ডশ্রম হয়ে দাঁড়াবে। আর গৌরী দেবী অভিনয় না করলে শেষপর্যন্ত এ-নাটকের অভিনয় হবে না। পাড়ার ক্লাবের লোকেদের কাছে নাটকটা আকর্ষণ নয়, আকর্ষণ হল গৌরী দেবী। নাটকের তো অভাব নেই বাংলা ভাষায়। শেষপর্যন্ত আমার নাটক না নিয়ে হয়তো অন্য কোনও নাটক পছন্দ করে বসবে। গৌরী দেবীরই কোনও পছন্দসই ড্রামাটিস্টের নাটক! সেই গৌরী দেবীই অভিনয় করবেন, ক্লাবেও থিয়েটার করবেন, মাঝখান থেকে আমিই শুধু বাদ পড়ে যাব।

হঠাৎ যেন নাকে সেন্টের গন্ধ লাগল।

আর সঙ্গে-সঙ্গে আঁচলটা ওড়াতে-ওড়াতে ঘরের ভেতর এসে হাজির হলেন গৌরী দেবী।

আমি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত জোড় করে নমস্কার করলাম।

গৌরী দেবী সামনের সোফাটায় বসলেন। বললেন, বোসো তুমি—।

চেয়ে দেখলাম সেজেগুজেই এসেছেন। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত নিখুঁত।

বললাম, আমাকে অতুলদা পাঠিয়েছেন আপনার কাছে। আমার একটা ড্রামা ওঁদের ক্লাব প্লে করছে, আপনি বলেছিলেন একটা সিন নিয়ে একটু ডিসকাস করবেন আমার সঙ্গে—।

গৌরী দেবী আবার বললেন, হ্যাঁ, ওদের আমি বলিনি, কিন্তু ড্রামাটাই আমার ভালো লাগেনি—ওটা ড্রামাই হয়নি—।

বললাম, কেন? ও-কথা বলছেন কেন? ওঁরা সবাই ভালো বলছেন—।

—ওঁরা বলুন গে, ওঁরা তোমার মুখ-রাখা কথা বলতে পারেন, কিন্তু আমি তো আর্টিস্ট, আমি তো বুঝি কীসে ড্রামা হয় আর কীসে ড্রামা হয় না—।

আমি হতবাক হয়ে চেয়ে রইলাম গৌরী দেবীর মুখের দিকে। আমি এখানে আসবার সময় আশাই করিনি এমন হতাশ করবেন গৌরী দেবী।

বললাম, কোন জায়গাটায় ডিফেক্ট আছে যদি বলে দেন তো আমি সেটা সংশোধন করতে পারি—।

গৌরী দেবী বললেন, সংশোধন করলেও হবে না—আগাগোড়াই ডিফেক্ট—।

এরপর আর আমার কোনও কথা বলবার রইল না।

গৌরী দেবী বললেন, আসলে তোমার লাভ সম্বন্ধে কোনও অভিজ্ঞতাই নেই। ওভাবে প্রেম হয় না—বিশেষ করে নাটকে—।

জিগ্যেস করলাম, কিন্তু…?

গৌরী দেবী বাধা দিয়ে বললেন, যে-জিনিস সম্বন্ধে তোমাদের কোনও এক্সপিরিয়েন্স নেই, তা নিয়ে লেখো কেন তোমরা? শুধু তুমি নও, আজকাল অনেকের লেখাতেই এটা দেখছি—কেউ লিখতে জানে না—।

বললাম, কোনটা সম্বন্ধে বলছেন?

—ওই লাভ সম্বন্ধে! প্রেম সম্বন্ধে! তোমার বয়েস কত?

বললাম, উনিশ!

—উনিশ বছর বয়েসে কতটুকু জানা সম্ভব! ক’টা মেয়ের সঙ্গে মিশেছ? এক মা-বোন ছাড়া সংসারে কার সঙ্গে মেশবার সুযোগ হয় তোমাদের?

আমি স্বীকার করলাম যে, সে-সৌভাগ্য আমার হয়নি। আর মা ছাড়া অন্য কোনও স্ত্রীলোকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশিইনি। তা ছাড়া আমার নিজের বোনও নেই। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের সে-যুগে মেয়েদের সঙ্গে মেশবার সুযোগই ছিল না এখনকার মতো।

—তাহলে? তোমার ‘ত্রিভুজ’ নাটকে হিরোইনকে করেছ অপরূপ রূপসী, আর হিরোকে করেছ আগলি। হিরো খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে হাঁটে। সে হিরোকে হিরোইন কী করে ভালোবাসে? যদি নায়ক খোঁড়া হয় তাহলে নায়িকা তাকে ভালোবাসতে পারে?

—কিন্তু খোঁড়াদের কি বিয়ে হয় না? স্ত্রীরা কি খোঁড়া স্বামীদের ভালোবাসে না? স্যার ওয়ালটার স্কট তো—বইতে পড়েছি—খোঁড়া ছিলেন, তাঁরও তো বিয়ে হয়েছিল, তাঁর স্ত্রী তো তাঁকে ভালোইবাসত!

গৌরী দেবী যেন চটে গেলেন।

বললেন, দ্যাখো, যা জানো না তা নিয়ে তর্ক কোরো না। লাইফের ট্রুথ আর লিটারেচারের ট্রুথ কি এক? নাটক কি লাইফের কার্বন-কপি?

আমি শুনেছিলাম গৌরী দেবী গ্র্যাজুয়েট। কিন্তু তাঁর যে এত জ্ঞান তা জানতাম না। কথাগুলোর কোনও জবাব আমার মুখ দিয়ে বেরুল না। আর তখন আমি এত ভেবেচিন্তে লিখিনি। নাটক লিখব বলেই নাটক লিখেছি। বেশ জমাটি হলেই হল, শেষপর্যন্ত সাসপেন্স থাকলেই হল, তার বেশি আর কিছু জানতাম না।

বললাম, তাহলে কী করব?

—নাটকটা ছিঁড়ে ফেলে দাও, ও তোমার পণ্ডশ্রম হয়েছে মনে করো!

বললাম, আর কি আমার উৎসাহ হবে? খুব ইনসপিরেশন নিয়ে লিখেছিলাম, আর ওঁরাও বললেন প্লে করবেন, তাই দু-মাস রাত জেগে লিখে ফেলেছিলাম—।

গৌরী দেবী বললেন, কিন্তু আমি তার কী করব! আমি তো বলছি প্লে করতে পারি আমি যদি হিরোকে খুব বিউটিফুল দেখতে করে দাও! ও হয় না, কোনও ইয়াং মেয়ে ও-রকম খোঁড়া ছেলেকে ভালোবাসতে পারে না! ওরকম চেহারা দেখলে আমার মুখ দিয়ে প্রেমের কথা বেরোবে না!

বললাম, কিন্তু প্লে করলে আপনি দেখতেন খুব হাততালি পেতেন, দর্শকদের সিম্প্যাথি পেতেন—।

—না না না, আমি তো বলেছি, জীবনে বা আর্টে অসুন্দর জিনিসের ঠাঁই নেই! খোঁড়া লোককে কি কুঁজো লোককে আমি দেখতে পারি না—।

—সত্যি বলছেন?

—সত্যি বলছি না তো মিথ্যে বলে আমার লাভ কী?

—রাস্তার খোঁড়া ভিখিরি দেখলেও আপনার মায়া হবে না?

গৌরী দেবী বললেন, রাস্তার ভিখিরিকে কি আমি ভালোবাসি? তার সঙ্গে কি আমার ভালোবাসার সম্পর্ক? তার দিকে তো একটা পয়সা ছুড়ে দিলেই হল। কিন্তু স্বামী? খোঁড়া স্বামীকে আমি কী করে ভালোবাসব? তার দিকে চেয়ে দেখতেই যে আমার ঘেন্না হবে! তুমি তো শেষ দৃশ্যে তাদের বিয়ে হল দেখিয়েছ—অ্যাবসার্ড! আর্টের এলিমেন্টারি নলেজও তোমার নেই! তুমি অন্য নাটক লেখো, কিন্তু হিরোকে সুস্থ-স্বাভাবিক সুন্দর করে দাও, আমি গ্ল্যাডলি প্লে করব!

তারপর একটু থেমে আবার বললেন, আর অত কথা থাক। এই যে তুমি, তুমি তো সুন্দরী মেয়েটার সঙ্গে খোঁড়া ছেলেটার চূড়ান্ত প্রেম দেখিয়েছ, তুমি নিজে কোনও খোঁড়া মেয়েকে বিয়ে করার কথা কল্পনা করতে পারো? খোঁড়া মেয়েকে দেখলে তোমার প্রেম জাগে? বলো, উত্তর দাও—।

তারপর যেন নিজের মনেই বলতে লাগলেন, আরে নাটক লেখা যদি অত সোজা হত তো বাংলাদেশে কেউ আর বাদ থাকত না—সবাই ড্রামাটিস্ট হয়ে যেত—।

আমার আর কোনও কথা বলবার রইল না। আমি চুপ করে রইলাম। গৌরী দেবীর শাড়ির আঁচলটা কাঁধ থেকে সরে পড়ে যাচ্ছিল, আর বারবার তিনি সেটাকে তুলে দিচ্ছিলেন। চারিদিকে নিস্তব্ধ নিঝুম আবহাওয়া, আর ঘরের মধ্যে শুধু আমরা দুজন। সেই কমবয়েসের চোখ দিয়ে সেদিন গৌরী দেবীকে যেরকম সুন্দরী দেখেছিলাম, পরে আর কখনও কোনও মেয়েকে আমার চোখে অত সুন্দর মনে হয়নি। পায়ের আঙুলের নখগুলো রং করা, হাতের নখগুলোও রঙিন। গাল ঠোঁট শাড়ি ব্লাউজ সবই রঙিন। সেদিন গৌরী দেবী আমার জন্যে অনেকখানি সময় নষ্ট করেছিলেন, সে-জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু গৌরী দেবীর মতের সঙ্গে আমি মত মেলাতে পারিনি। সৌন্দর্য কি শুধু বাইরের জিনিস? ভালোবাসা কি সত্যিই দেহ নির্ভর? তাহলে মন নিয়ে কেন এত মারামারি? আমার সেই অল্প অপরিণত বয়সেই দৃঢ় ধারণা হয়েছিল যে, গৌরী দেবীর কথা সত্য নয়। গৌরী দেবী বড় আর্টিস্ট হতে পারেন, কিন্তু নাটক সম্বন্ধে তাঁর মতটাই শেষ মত নয়!

গৌরী দেবী দাঁড়িয়ে উঠলেন।

বললেন, আমার আবার এক্ষুনি একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে—।

আমিও দাঁড়িয়ে উঠেছিলাম। বললাম, তাহলে অতুলদাকে গিয়ে কী বলব?

—বোলো ও নাটকে আমি প্লে করব না।

—কিছু কারণ বলব?

গৌরী দেবী বললেন, হ্যাঁ, তাও বলতে পারো। বোলো খোঁড়ার সঙ্গে প্রেম হয় না, খোঁড়াকে ভালোবাসা যায় না—।

এর পরে আমি আর দাঁড়াইনি। সে-দিন আমি তাঁকে নমস্কার করেই চলে এসেছিলাম গৌরী দেবীর বাড়ি থেকে। আমার জীবনে নাটক লেখার প্রয়াসের সেখানেই ইতি হয়েছিল।

বাড়ি ফিরে আসতেই অতুলদা বলল, কী রে, কী হল?

সব বললাম। নাটক হয়নি। নাটক লেখাতেই গোলমাল আছে। যা-যা গৌরী দেবী বলেছিলেন সব খুলে পরিষ্কার করে বললাম।

সব শুনে অতুলদা বলল, বড় ভাবিয়ে তুললে। এতদূর প্রগ্রেস করে এখন পেছিয়ে যাওয়া… বড় মুশকিলে ফেললে দেখছি।

বললাম, তোমরা অন্য প্লে ধরো না—।

শেষপর্যন্ত অবশ্য তাই-ই হয়েছিল। তাড়াতাড়ি একটা চলতি নাটক ধরে প্লে করা হয়েছিল। গৌরী দেবী তাতে প্লে-ও করেছিলেন। হাততালি পেয়েছিলেন খুব, তারিফ পেয়েছিলেন খুব। অত বড় আর্টিস্ট, তিনি যে দয়া করে একটা অ্যামেচার ক্লাবের প্লে-তে নেমেছিলেন তাতেই সমস্ত লোক ধন্য হয়ে গিয়েছিল। প্রচুর টিকিট বিক্রি হয়েছিল। শুধু আমি সে-প্লে দেখতে যাইনি। দেখতে যাইনি অভিমানে নয়, ক্ষোভে। আমার সমস্ত পরিশ্রম পণ্ডশ্রম হল বলে নয়, আমার শিল্প-প্রচেষ্টার কদর্থ হল বলে। সবাই জানল এবং বিশ্বাস করল আমার নাটক নাটকই হয়নি। সবাই বুঝল, আমি নাটক লিখতে পারি না। নাটকের এ-বি-সি-ডি-ও আমি জানি না। ক্লাবের রিহার্সালে এসেই গৌরী দেবী সকলকে সে-কথা বলে গিয়েছেন শুনলাম। আমি ক্লাবের সকলের সঙ্গে চিরদিনের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।

এরপর জীবনে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। গৌরী দেবীও সিনেমা-থিয়েটারের লাইন থেকে বিদায় নিয়েছেন। রানিবালা, জ্যোৎস্না গুপ্তা, প্রতিমা দাশগুপ্তার মতো গৌরী দেবীও একদিন অভিনেত্রী-জীবন থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। কিন্তু বড় হঠাৎ। ঠিক উঠতির সময়। পরে শুনলাম নাহারগড় স্টেটের যুবরাজ বিন্ধ্যপ্রসাদ সিংকে বিয়ে করে তিনি নাহারগড় স্টেটের রানি হয়ে গেছেন। ছোটনাগপুরের বিরাট স্টেট নাহারগড়। কোটি টাকার রেভিনিউ স্টেট। নানারকম কথা ছড়ানো। একজন বললে, গৌরী দেবী দলবল নিয়ে থিয়েটার করতে যান নাহারগড়ে, সেই সময়ই ঘটনা ঘটে। যুবরাজ বিন্ধ্যপ্রসাদের নজরে পড়ে যান গৌরী দেবী। মহারাজার আপত্তি সত্ত্বেও গৌরী দেবীকে তিনি বিয়ে করে বিলেতে গিয়ে বাস করতে আরম্ভ করেন।

এসব অনেক বছর আগেকার কথা।

এরপর স্টেট মহারাজার হাতছাড়া হয়ে গেছে। মহারাজাও মারা গেছেন। কিন্তু স্টেটের যা প্রপা. তার সবটুকু গভর্নমেন্ট নিতে পারেনি। বহু সোনা, বহু জুয়েলারি সুইজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কে সরিয়ে রেখেছিলেন তিনি। বাপ মারা যাওয়ার পর বিন্ধ্যপ্রসাদ মহারাজা হয়েছেন। গৌরী দেবীও মহারানি হয়েছেন। নাহারগড়েই বিরাট প্যালেস। এয়ারকন্ডিশনড প্যালেস। তারপর এইবার, এই গেলবার, জেনারেল ইলেকশনের সময়…মহারাজা নাহারগড় থেকে পার্লামেন্টের ক্যান্ডিডেট হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কংগ্রেসের নমিনেশন পেয়ে এম. পি. হয়েছেন। এসব খবর সেসময় খুব শুনেছিলাম। শুনেছিলাম গৌরী দেবী নাকি প্রজাদের প্রত্যেকের বাড়িতে পায়ে হেঁটে গিয়ে-গিয়ে ভোট চেয়ে-চেয়ে বেড়িয়েছেন। যে-মহারানিকে প্রজারা জীবনে চোখে দেখেনি, সেই তাঁকেই স্পষ্ট করে ভোট চাইতে দেখে প্রজারা নাকি কেঁদে ভাসিয়েছিল। প্রজারা নাকি কৃতার্থ হয়ে গিয়েছিল, ধন্য হয়ে গিয়েছিল মহারানির কষ্ট দেখে। সেইসব কিছু-কিছু বোম্বাই-এর কোন ইংরাজি সাপ্তাহিক পত্রিকায় নাকি ছাপাও হয়েছিল।

তা এতদিন পরে সেই মহারানি কলকাতায় আসছেন সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার পথে। আর আমাকে দেখা করতে অনুমতি দিয়েছেন। এতে আমার কৃতার্থ হওয়ারই কথা। কিন্তু আমি মনে-মনে কৃতার্থ হতে পারিনি। আমার নাটক লেখা হয়নি বলে নয়। জীবন সম্বন্ধে আমার বোধই বদলে গিয়েছিল এই ক’বছরে। বাংলাদেশে এখন লোকে আমাকে গল্প-উপন্যাস লেখক বলে জানে। কিন্তু সেদিন সেই গৌরী দেবীর দেওয়া আঘাত আমি জীবনে ভুলতে পারিনি। নাট্যকার হতে পারিনি। নাট্যকার হতে পারিনি বলে তবে কি আমার মনে ক্ষোভ আছে? এখনও কি আমি নিজের অহঙ্কার ত্যাগ করতে পারিনি?

দেখা হলে রানিমা আর কীই-বা বলবেন আমাকে? কীই-বা বলতে পারেন?

বড়জোর সবাই যেমন মাতব্বরি করে সেইরকম দু-চারটে মাতব্বরির কথা বলবেন। আমার লেখার কী দোষ-ত্রুটি তাই-ই খুঁটিয়ে বলবেন। কোন লেখককে এ-দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়নি তা তো জানি না। একমাত্র হোমার আর বাল্মীকি ছাড়া পৃথিবীর সব লেখককেই সমালোচকের কুৎসা-কটূক্তি শুনতে হয়েছে। যে-লেখক সমালোচককে ভয় করে তার লেখাই উচিত নয়, এই সিদ্ধান্তই জীবনে পাকা করে নিয়েছি।

তাই গৌরী দেবীর নিমন্ত্রণ পেয়ে সেদিন তৈরি হয়েই গেলাম।

বুধবার বিকেল সাড়ে চারটে থেকে পাঁচটা। ঠিকানা মিলিয়ে মার্লিন প্লেসে গিয়ে পৌঁছলাম। গেটে দারোয়ানের কাছে নাম-ধাম কুলুজি দিলাম।

যথা সময়ে সে আমাকে ভেতরের পার্লারে নিয়ে বসিয়ে দিলে। তারপর বোধহয় ভেতরে গিয়ে খবর দিলে। আমি চুপ করে বসে-বসে বাইরের বাগানের দিকে চেয়ে দেখছিলাম। বাগানের তেমন যত্ন নেই। মহারাজা বা রানিমা কেউই কলকাতায় কখনও আসেন না। বছরের অর্ধেকটাই কাটে বাইরে। এখন মহারাজা এম. পি. হওয়াতে দিল্লিতে আসেন। চাকর-বাকর-মালি কেউই তাই মন দিয়ে কিছু কাজ করে না।

হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লোক শশব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন।

বললেন, আপনি এসেছেন? এই আধঘণ্টা হল রানিমা এসেছেন, এসেই আপনার কথা জিগ্যেস করছিলেন—।

হঠাৎ বাইরের বাগানের দিকে একটা শব্দ হতেই চেয়ে দেখি দুজন উর্দি পরা চাকর একটা ছোট ছেলেকে হাতে ধরে নিয়ে বেড়াচ্ছে। বছরচারেক বয়েস হবে। ফুটফুটে ফরসা চেহারা। চমৎকার দামি সাজপোশাক।

জিগ্যেস করলাম, ও কে? কার ছেলে?

ভদ্রলোক বললেন, আমাদের মহারাজকুমার, রানিমার এই প্রথম ছেলে, একটিই হয়েছে—।

কী রকম যেন ভূত দেখতে লাগলাম চোখের সামনে।

ভদ্রলোক বললেন, মহারাজকুমারকে নিয়েই রানিমা সুইজারল্যান্ড যাচ্ছেন, অপারেশান করতে…।

অপারেশান করতে! দেখি ছেলেটা খোঁড়াচ্ছে। একটা পা সোজা কিন্তু আর একটা পা ত্রিভঙ্গ হয়ে বেঁকে গেছে। সেই খোঁড়া পায়ে বেড়াতে গিয়ে বড় অদ্ভুত ভঙ্গি করতে হচ্ছে ছেলেটিকে। বড় করুণ, বড় কষ্টকর সে-দৃশ্য।

ভদ্রলোক বললেন, আমি খবর দিচ্ছি রানিমাকে—।

বলে ভদ্রলোক আবার ভেতরে চলে গেলেন।

আমি একদৃষ্টে ছেলেটির দিকে চেয়ে দেখতে লাগলাম। আমার মনে হল আমার নাট্যকার হওয়া হয়নি, তা না হোক। কিন্তু আমার সেদিনের সেই আঘাতের প্রতিশোধ ঈশ্বর এমন করে নিলেন কেন? আমি তো এ চাইনি! আমি তো এ কল্পনাও করতে পারতাম না। গৌরী দেবী কি এই খোঁড়া ছেলেকে ভালোবাসতে পারবেন? নিজের পেটের সন্তানকে তিনি গুলি করে মারতে পারবেন? তবে কেন সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যাচ্ছেন অপারেশান করবার জন্যে? লাইফের টুথ আর লিটারেচারের টুথ কি সত্যিই আলাদা? লিটারেচার কি সত্যিই লাইফের কার্বন-কপি নয় তাহলে?

আমার মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে গেল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। তারপর কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানে নামলাম। তারপর গেট পেরিয়ে একবারে সোজা রাস্তায়। রাস্তায় নেমে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে লাগলাম। মহারানির পরাজয় যেন আমারও পরাজয়। গৌরী দেবীর এ-লজ্জা আমি চোখের সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে পারতুম না।

তারপর সেই রাস্তার মানুষের ভিড়ের মধ্যে নিরুদ্দেশ হয়ে যেন খানিকটা স্বস্তি পেলাম।

অন্তরালে

পুজো সংখ্যা, ১৯৬৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *