রহস্য রোমাঞ্চ গোয়েন্দা পত্রিকার সেরা ১০০ গল্প
সম্পাদনা – অনীশ দেব
প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০৫
প্রচ্ছদ রঞ্জন দত্ত
‘কনান ডয়াল, চেস্টারটন প্রমুখ লেখক যে সাহিত্য রচনা করতে লজ্জিত নন, তা রচনা করতে আমারও লজ্জা নেই।’
—শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৫৯ সালে নেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ‘মাসিক রোমাঞ্চ’র সম্পাদক রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন ‘আজকাল অনেক নামকরা সাহিত্যিক দেখেছি এই (রহস্য-রোমাঞ্চ) শ্রেণীর গল্প লিখতে লজ্জা বোধ করেন।’ শরদিন্দুর উদ্ধৃতিটি তারই প্রতিক্রিয়া। সাক্ষাৎকারটি ১৯৭০ সালের নভেম্বর (কার্তিক) সংখ্যা ‘মাসিক রোমাঞ্চ’-এ প্রকাশিত হয়েছিল।
‘জাত যদি যায় যাক, তবু নির্লজ্জভাবেই স্বীকার করছি যে রহস্য-কাহিনী আমি ভালোবাসি।
আজ নয়, চিরকালই ভালোবাসি এবং শুধু ডিটেকটিভ গল্প নয়, রোমাঞ্চকর যতরকমের গল্প আছে সব কিছুরই বরাবর আমি ভক্ত। এখনও ভালো সেরকম গল্প পেলে আহার-নিদ্রা ত্যাগ করতে পারি।’
—প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৯৫৭ সালে ‘মাসিক রোমাঞ্চ’ পত্রিকার ‘রজতজয়ন্তী সংখ্যা’য় প্রকাশিত প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘সাহিত্যে রোমাঞ্চ’ রচনা থেকে উদ্ধৃত।
‘What makes you think I have a choice?’
—Stephen King
(When asked by an interviewer why he writes about fear and terrible manifestations.)
from Introduction by Kirby McCauley (Ed.) in Dark Forces (Macdonald Futura Publishers, 1980).
.
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
যে-দুজনের সহযোগিতা এই বইটিকে সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করেছে তাঁরা হলেন লেখক-বন্ধু শ্রীপার্থ (আসল নাম সৌরেন দত্ত) এবং সন্তোষকুমার চট্টোপাধ্যায়। হাসিমুখে পুরোনো বহু পত্র-পত্রিকার জোগান দিয়েছেন ওঁরা। এ ছাড়া রহস্য-রোমাঞ্চ পত্রিকার কিছু পুরোনো সংখ্যা দিয়ে সাহায্য করেছেন উপেন মান্না ও স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘স্প্যান’ পত্রিকার ১৯৯৯ সালের মে-জুন সংখ্যা থেকে গ্রেগরি নেমেকের ছবির অংশ এই বইয়ে অলংকরণ হিসেবে ব্যবহার করেছি। ‘স্প্যান’ পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
বিভিন্ন ঘরোয়া বৈঠকে আলোচনার মাধ্যমে বহু তথ্যের জোগান দিয়েছেন ‘মাসিক রহস্য পত্রিকা’র কর্ণধার গোবিন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ভাস্কর রাহা, অসিত মৈত্র, অশোক রায় ও ‘মাসিক রোমাঞ্চ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের পৌত্র অভ্রদীপ চট্টোপাধ্যায়। এ ছাড়া ‘মাসিক রোমাঞ্চ’র বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য সংখ্যা অভ্রদীপের কাছ থেকে পেয়েছি।
অক্ষরবিন্যাসের কাজে দীর্ঘ সময় ধরে মুখ বুজে পরিশ্রম করেছেন প্রদ্যুৎ সাহা ও প্রণব সাহা। ওঁদের আমার ভালোবাসা জানাই। প্রুফ সংশোধনের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন আরতি বসু। তাঁর সঙ্গে আছেন আরও কয়েকজন—মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, মোনালিসা বসাক, সায়ক দেব ও শুভাশিস ঘোষ। এঁদের সবাইকে ধন্যবাদ।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই প্রয়াত কমলকুমার মজুমদারের স্ত্রী দয়াময়ী মজুমদারকে। ওঁর কাছে কমলকুমারের ‘তদন্ত’ পত্রিকা সম্পর্কে কয়েকটি জরুরি তথ্য পেয়েছি। আর ধন্যবাদ জানাই স্নেহভাজন রাহুল সেনকে।
লেখকরা ও তাঁদের পরিবারবর্গ গল্প প্রকাশের অনুমতি দিয়ে আমাকে ঋণী করেছেন। ওঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ। আর বিশেষ অভিনন্দন জানাই পত্রভারতীর কর্ণধার বন্ধুবর ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়কে। এই বই প্রযোজনার বিরল দুঃসাহস ও নিষ্ঠা বোধহয় শুধু ওঁকেই মানায়।
২২ ডিসেম্বর ২০০৪
.
রহস্যময় দিন, রোমাঞ্চকর রাত
সত্যি, সে একটা সময় ছিল বটে! ম্যাগাজিন-স্টলে গেলেই পাওয়া যেত তিন-তিনটে লোভনীয় পত্রিকা ‘মাসিক রোমাঞ্চ’, ‘মাসিক রহস্য পত্রিকা’, আর ‘মাসিক গোয়েন্দা’। কী যে এক অদ্ভুত আকর্ষণ কাজ করত আমার ভেতরে! ওই পালপ ম্যাগাজিন বা মণ্ড-পত্রিকাগুলো আমাকে নিশির ডাকের মতো টানত। মনে হত, কতক্ষণে ওগুলো হাতে পাব, রুদ্ধশ্বাসে শেষ করব গল্প-উপন্যাসগুলো!
এই যে বইটা আপনি হাতে তুলে নিয়ে এই গৌরচন্দ্রিকাটি পড়ছেন, এই বই তৈরির পিছনে রয়েছে প্রায় ন’ বছরের একরোখা চেষ্টা। আর সেই চেষ্টারও একটা কারণ আছে—যে-কারণটা বোঝাতে গেলে নিজের কথা কিছুটা বলতে হয়। আশা করি আপনি সেটা আত্মপ্রচার না ভেবে ক্ষমা করবেন। আসলে এ যেন ঠিক কোনও আপনজনকে কাছে পেয়ে মনের দরজা খুলে দেওয়া। এই যে আপনি এই বইটা হাতে নিয়ে উলটেপালটে দেখছেন, এ যেন আপনি নন—আমি। কারণ, পাঠক হিসেবে এই বইটা হাতে তুলে নিয়ে আদর করে এর প্রতিটি পৃষ্ঠা ওলটাব, এই ছিল আমার মনের সাধ—গত ন’বছর ধরে, বিশ্বাস করুন। তাই আপনাতে আর আমাতে কোনও তফাত নেই। আমার বুকের ভেতরে জমে থাকা যেসব কথা আমি বলতে চাই সে যেন আপনারই কথা—আপনি, যিনি রহস্য-রোমাঞ্চ-গোয়েন্দা কাহিনির একনিষ্ঠ পাঠক—আমারই মতো।
খুব ছোটবেলা থেকেই রহস্যকাহিনির প্রতি একটা টান টের পেতাম। সেটা বোধহয় বুদ্ধির মারপ্যাঁচে রহস্যের জট ছাড়ানোর নেশায়। তারপর যতই বয়েস বেড়েছে, এই টান বেড়েছে ততই। ছোটবেলার ‘বাজপাখি সিরিজ’ ছেড়ে ধরেছি নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটি রায়, শশধর দত্তের দস্যুমোহন, দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রবার্ট ব্লেক। বয়েস আরও বাড়ছে—সঙ্গে-সঙ্গে চলেছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুখময় মুখোপাধ্যায়, নিশাচর, গজেন্দ্রকুমার মিত্রের তরুণ গুপ্ত, সমরেশ বসুর অশোক ঠাকুর, আরও কত নামী-অনামী লেখক এবং তাঁদের গোয়েন্দাদের কীর্তিকলাপ।
এসবের মাঝেই কখন যেন আর্থার কোনান ডয়েল, এলান পো, আগাথা ক্রিস্টি হাতে চলে এসেছে। ফলে নদী ছেড়ে সাগরের স্বাদ পেতে শুরু করেছি। যতই দিন যায়, রহস্য-রোমাঞ্চ-গোয়েন্দা-ভৌতিক-কল্পবিজ্ঞান কাহিনির প্রতি টান ততই বাড়তে থাকে। সেই অর্থে বিশ-বাইশ বছর বয়েসেই আমি রাশি-রাশি ‘অপাংক্তেয়’ সাহিত্য পড়ে রীতিমতো ‘নষ্ট’ হয়ে গেছি। কিন্তু আশ্চর্য, এইভাবে নিজেকে ‘নষ্ট’ করার জন্য কখনও আক্ষেপ হয়নি।
এইসব বই পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে মণ্ড-পত্রিকাগুলোও নিয়মিত পড়ছিলাম। ডবল ডিমাই ষোলো পেজি ফর্মা, লালচে নিউজপ্রিন্ট আর ফরেন নিউজপ্রিন্ট মিলিয়ে লেটার প্রেসে ছাপা, লাইন ব্লকের হেডপিস, বাইকালার লাইন ব্লকে ছাপা প্রচ্ছদ—এই অগৌরবের সাজসজ্জা নিয়েও পত্রিকাগুলো আমাকে টানত, হাতছানি দিয়ে ডাকত। ‘মাসিক রোমাঞ্চ’-র গ্রাহকও ছিলাম টানা বেশ কয়েক বছর। মোটামুটিভাবে ১৯৬৩-৬৪ সাল থেকে (বয়েস তখন বারো-তেরো) এই পত্রিকাগুলো পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে হানা দিতাম পুরোনো বই কিংবা ম্যাগাজিনের স্টলে। পত্রিকাগুলোর সংখ্যা জোগাড় করে নিয়ে আসতাম। এ-ছাড়া আর-একটা খনি ছিল যত পুরোনো খবরের কাগজের দোকান। সেখানে রাজ্যের পুরোনো কাগজ হাঁটকে এই সব পত্রিকা খুঁজে বের করে ওজন-দরে কিনে নিয়ে এসে পড়তাম।
এতসব কাণ্ডের মাঝে একদিন একটা ঘটনা ঘটে গেল। একটি গোয়েন্দা-কাহিনি লিখে ডাকে পাঠিয়ে দিলাম ১৬৫ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে (এখনকার বিধান সরণি) ‘মাসিক রহস্য পত্রিকা’র দপ্তরে। ষোলো প্লাস বয়েসে লেখা দুর্বল রচনাটি সতেরো মাইনাস বয়েসে ছাপা হয়ে গেল। সেদিন ম্যাগাজিন স্টলে দাঁড়িয়ে পত্রিকাটি হাতে নিয়ে ছাপা অক্ষরে নিজের নাম (তখন নামের বানানটা ছিল ‘অনীষ’) দেখে হাত এমনভাবে কাঁপছিল যে, নিজের লেখার একটা লাইনও পড়তে পারছিলাম না। সে-রোমাঞ্চ আজও মনে আছে।
গল্পটির নাম ছিল ‘ভারকেন্দ্র’। লালচে নিউজপ্রিন্ট কাগজে লাইন ব্লকে তৈরি একটি হেডপিস দিয়ে (শিল্পী বাদল ভট্টাচার্য) লেখাটি ছাপা হয়েছিল। আজ এই অঙ্গসজ্জার মান নগণ্য বলে মনে হলেও সেসময়ে আমার কাছে ছিল ‘দারুণ’।
তারপর দিন যায়, সম্পাদকদের আশকারায়—’রহস্য’, ‘রোমাঞ্চ’, গোয়েন্দা’—তিনটি পত্রিকাতেই লেখালিখির অভ্যেস দাঁড়িয়ে যায়। ধীরে-ধীরে নিজেকে আমি পালপ ম্যাগাজিনের লেখক বলে ভাবতে থাকি। আর একইসঙ্গে ওইসব পত্রপত্রিকার লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকি।
সত্তর দশকের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত একই ধরনের আরও কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। একটা সময়ে তো এ জাতীয় পত্রিকার সংখ্যা দশের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল!
১৯৭৫ সালে টেলিভিশন ভারতে এল, আর আশির দশকের শুরুতে কলকাতায়। হয়তো টিভির জনপ্রিয়তার দৌরাত্ম্যে এই পত্রিকাগুলো স্তিমিত হতে শুরু করল। এবং আশির দশক যতই শেষের দিকে এগোতে শুরু করল, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই পত্র-পত্রিকাগুলোও এগোতে লাগল শেষের দিকে। একে-একে নিভতে-নিভতে ১৯৯০-৯১ সালে ‘ওরা’ চলে গেল—আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম মাঝরাস্তায়।
সেসময়ে মনের ভেতরে কী যে দুঃখ তৈরি হয়েছিল সে আমিই জানি। বেশ মনে পড়ে, আমি আশায়-আশায় থাকতাম, এই বুঝি কেউ তোড়জোড় করে আবার একটা ক্রাইম ম্যাগাজিন বের করে ফেলল। কিন্তু তা হয়নি… আজও হয়নি।
এই পত্রিকাগুলো না-থাকার দুঃখ থেকেই এই বইটা তৈরি করার কথা ভেবেছিলাম। কোনও প্রকাশকের আশ্বাস না চেয়েই শুরু করেছিলাম এই বইয়ের কাজ। তিল-তিল করে কাজ এগোচ্ছিল আর ভেতরের দুঃখটা একটু-একটু করে কমছিল। তারপর…তারপর এতদিন পরে এই বইটা তুলে দিতে পারলাম আপনার হাতে। দুঃখ থেকে তৈরি আনন্দের বই।
আপনি হয়তো জিগ্যেস করবেন, কেন ওই পালপ ম্যাগাজিনগুলো বন্ধ হয়ে গেল? কিন্তু এই প্রশ্নের চটজলদি কোনও উত্তর আমার জানা নেই। তবে এই প্রশ্নটা নিয়ে আমি ভেবেছি অনেক দিন।
উত্তরটা যে সহজে খুঁজে পাইনি তার কারণ, রহস্য-রোমাঞ্চ-গোয়েন্দা পত্র-পত্রিকাগুলো শুরু হয়েছিল দারুণভাবে। আর তাদের ঐতিহ্যও নিতান্ত ফ্যালনা নয়।
সেই কোন ১৯৩২ সালের ১ জানুয়ারি মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় ‘১২, হরিতকী বাগান লেন, কলিকাতা-৬’ (উত্তর কলকাতার মানিকতলার কাছাকাছি) থেকে প্রকাশ করেছিলেন সাপ্তাহিক ‘রোমাঞ্চ’ পত্রিকা। পত্রিকাটির নামকরণ করেছিলেন মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির সাহিত্য-মজলিশে নিয়মিত হাজিরা দেওয়া সেদিনকার তরুণ কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র। ‘প্রহ্লাদ’ সবাকচিত্রের প্রচারপুস্তিকায় ‘রোমাঞ্চ’র প্রথম সংখ্যার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। ‘রোমাঞ্চ’র প্রথম সংখ্যার লেখক ছিলেন গীতিকার প্রণব রায়। লেখাটির নাম ‘ইয়াংসু হোটেলের কাণ্ড’। লেখাটি মাপে বড় হওয়ায় প্রথম সংখ্যায় এর একটি অংশ ছাপা হয়। বাকি অংশটি ‘সিঙ্গাপুর কাফে’ নাম দিয়ে প্রকাশ করা হয় দ্বিতীয় সংখ্যায়।
এইভাবে দশ বছর কেটে গেল। তার কিছুদিন পরেই মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় প্রয়াত হন। কিন্তু সাপ্তাহিক ‘রোমাঞ্চ’ থামেনি। ১৯৫২ সালে ‘রোমাঞ্চ’ রূপবদল করল সাপ্তাহিক থেকে হল মাসিক। নামী-দামি লেখকরা নিয়মিত লিখতে থাকলেন ‘মাসিক রোমাঞ্চ’-এ।
‘রোমাঞ্চ’ যখন সাপ্তাহিক থেকে মাসিক হয় তখন সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়। তাঁর শ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আরও একজনের হাড়-ভাঙা খাটুনি। তিনি হলেন রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়ের অগ্রজ অমিত চট্টোপাধ্যায়। ওঁদের ‘গোলাপ প্রিন্টিং ওয়ার্কস’ থেকে মুদ্রিত হত ‘মাসিক রোমাঞ্চ’—ওই ১২ নম্বর হরিতকী বাগান লেন থেকেই। অমিত চট্টোপাধ্যায় নিজেই মেশিন চালিয়ে ‘রোমাঞ্চ’র ফর্মা ছাপতেন। আর পাশাপাশি লিখতেন রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনি—স্বনামে এবং বেনামে। অনুজ রঞ্জিতও মোটেই পিছিয়ে ছিলেন না। নিজেদের পত্রিকায় লেখালিখির পাশাপাশি দিব্যি কম্পোজ করতে পারতেন। দু-ভাই যে পত্রিকাটিকে ভালোবেসে কী পরিশ্রম করতেন ভাবাই যায় না!
বিমল করের মুখে শুনেছি, তিনি আর তাঁর কবি-বন্ধু অরুণ ভট্টাচার্য মিলে একটি রহস্য জাতীয় পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। নাম ছিল ‘বিমল করের রহস্য পত্রিকা’। সম্ভবত পত্রিকাটি ১৯৫০-৫১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। স্বল্পকালজীবী এই পত্রিকাটির কোনও সংখ্যা আমার হাতে আসেনি।
পঞ্চাশের দশকেই কোনও এক সময় কানু ঘোষের সম্পাদনায় ‘কুয়াশা’ নামে আরও একটি ক্ষণস্থায়ী পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। এ-পত্রিকাটিও আমার কাছে অধরা থেকে গেছে।
১৯৫২ সালে সাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদার ‘তদন্ত’ নামে একটি ‘ডিটেকটিভ সাপ্তাহিক’ বের করেন। কিন্তু সেটিও কয়েক সংখ্যার বেশি স্থায়ী হয়নি।
কমলকুমার যে ক্রাইম সাহিত্য নিয়ে ভাবতেন তার ইশারা পাওয়া যায় ‘তদন্ত’র প্রথম বর্ষ, নবম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে। কমলকুমার লিখেছেন :
পাঠক, বুঝিলাম ‘দারোগার, দপ্তরে’এর জন্য আপনি অত্যন্ত উদগ্রীব হইয়াছেন, আপনার আর্জি যে উহা এককালীন ছাপান হইতেছে না কেন? পাঠক, দারোগার দপ্তর এককালে ছাপাইতে হইলে, আমাদের নির্দ্ধারিত পৃষ্ঠার সকল পৃষ্ঠাই দপ্তরে পরিণত হয়। ফলে, উহা একটু একটু করিয়া দিতে হইতেছে, ইহাতে আমাদের কষ্টও বড় কম নহে। একটু একটু করিয়া পড়িলে গল্পের সাধারণত ঘটনাই লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ ক’রে, সুধীগণ যাহাকে আর্ট বলেন, তাহার কথঞ্চিৎও ইহাতে দেখা দেয় না। আর্ট অতি ভীরু বস্তু, বড়ই লাজুক, এতটুকু ইতর বিশেষে তাহার মন্দা হয়। অবশ্য এখানে কি গুরু অপরাধ হইতেছে তাহা জানি না, কারণ, পূর্ব্বে উল্লেখে এই মনে হয় যে, দারোগার দপ্তরকে আর্টের পর্য্যায় ফেলা হইতেছে। গুণী সুধী অপরাধ লইবেন না। ”জেনটলমেন ইন য়ুরোপীয়ান ড্রেস” দেখা সত্ত্বেও ল্যাংট পরিয়া নিরক্ষররাই ঢুকে—আমরা তাহা করিব না।
অনেকেই বলিয়াছেন, ”বাপু এত শত প্রকাশ করিতেছ অথচ ভূতের গল্প দিতেছ না কেন? দিনে যেমন খুন হয়, তেমন যে খুন হয় সে ভূতও তো হয়।” কিন্তু পাঠক, আমরা বলি খুনে যেমন প্রায় ক্ষেত্রেই ধরা পড়েনা, তেমনি সে ভূত প্রায় ক্ষেত্রে আমাদের চোখে পড়ে না। গল্প পাইলেই প্রকাশ করিব।
(বানান মুদ্রণপ্রমাদ সমেত অপরিবর্তিত)
‘তদন্ত’র নিয়মাবলীতে কমলকুমার লেখকদের জানিয়েছেন, ‘আইন আদালতের খবর, গোয়েন্দা কাহিনী, রহস্য গল্প, ভূতের গল্প পাঠাতে পারেন।’
১৯৫৩ সালে ‘গোবিন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের রহস্য পত্রিকা’ নামে একটি পত্রিকার পুজো সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বোঝাই যায়, বিদেশি ‘আলফ্রেড হিচককস মিস্ট্রি ম্যাগাজিন’ কিংবা ‘এলারি কুইনস মিস্ট্রি ম্যাগাজিন’-এর নামের আদলে এই পত্রিকাটির নামকরণ করেছিলেন প্রকাশক গোবিন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই বছরেই নভেম্বর-ডিসেম্বরে তিনি দ্বিমাসিক ‘রহস্য পত্রিকা’ প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাটির মাত্র তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল।
গোবিন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ‘মাসিক রোমাঞ্চ’র নিয়মিত লেখক ছিলেন। সমুদ্র গুপ্ত, এস. মদনমোহন, রঞ্জন রায়, অনুপমা সেন ইত্যাদি ছদ্মনামে তিনি সেসময়ে প্রচুর রহস্য কাহিনি লিখেছেন। একইসঙ্গে পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি নাগাদ ‘মাসিক রহস্য পত্রিকা’ আত্মপ্রকাশ করে।
এর পরের পত্রিকাটি ‘মাসিক গোয়েন্দা’। প্রকাশ করেন রবিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। ‘মাসিক রহস্য পত্রিকা’য় বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর ১৯৬০ সালে ‘মাসিক গোয়েন্দা’ প্রকাশিত হয়। প্রথম সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন ভাস্কর রাহা ও বিমল সাহা। পরবর্তীকালে সম্পাদনার দায়িত্ব নেন রবিরঞ্জন মুখোপাধ্যায় নিজেই। সম্পাদনার কাজ ছাড়াও তিনি নক্ষত্র মুখোপাধ্যায় ছদ্মনামে, বা কখনও-কখনও নিজের নামে, নানান গল্প-উপন্যাস লিখতেন ‘মাসিক গোয়েন্দা’য়। তাঁর বিশেষ টান ছিল অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির প্রতি।
১৯৭০-৭১ সালে নকশাল বিদ্রোহের অস্থিরতা শুরু হল। সেই অস্থির সময়ে সস্তামানের কয়েকটি যৌনপত্রিকা ম্যাগাজিন স্টলে চোখে পড়ত। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রকাশিত এই পত্রিকাগুলো পিন দিয়ে আঁটা থাকত—হয়তো পাঠকদের কৌতূহল বাড়িয়ে তোলার জন্য। এইরকম কয়েকটি পত্রিকার নাম ছিল ‘সুন্দর জীবন’, ‘জীবন যৌবন’, ‘সুন্দরী’, ‘রঙ্গিনী নায়িকা’, ‘নায়িকা সঙ্গিনী’ ইত্যাদি। এই পত্রিকাগুলোর উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে পুলিশ এগুলো বাজেয়াপ্ত করে, এর সম্পাদক/প্রকাশককে ধরপাকড় শুরু করে। পত্রিকাগুলো এই চাপে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। তখন এর মালিক তথা সম্পাদকরা নতুন পত্রিকা করার কথা ভাবতে থাকেন।
এই ভাবনা থেকেই জন্ম নিয়েছিল ‘ক্রাইম’, ‘শেষ সংকেত’, ‘অপরাধ’ ইত্যাদি পত্রিকা—এগুলো যথাক্রমে ১৯৭২, ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪ থেকে শুরু হয়। আরও একবছর পরে প্রকাশিত হয় ‘মাসিক ক্রিমিনাল’। এই পত্রিকাটির সম্পাদক সহদেব সাহা আগে কখনও পত্রিকা করেননি। ক্রাইম সাহিত্যকে ভালোবেসে তিনি ‘মাসিক ক্রিমিনাল’-এর প্রকাশ শুরু করেছিলেন। পত্রিকাটির আবির্ভাব সংখ্যাই ছিল পুজো সংখ্যা।
‘মাসিক রোমাঞ্চ’, ‘মাসিক রহস্য পত্রিকা’ এবং ‘মাসিক গোয়েন্দা’ ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত নির্বিঘ্নে ‘রাজত্ব’ করেছিল। কিন্তু অন্যান্য পত্রিকার প্রকাশ শুরু হওয়ার পর তারা নতুন ধরনের প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে যায়।
নতুন পত্রিকাগুলো প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই তিন-রঙা হাফটোন ব্লক ব্যবহার করে প্রচ্ছদপট তৈরি করত। আর কোনও প্রচ্ছদই একবারের বেশি ব্যবহার করত না। তা ছাড়া তারা আমাদের মতো নগণ্য লেখকদেরও যৎকিঞ্চিৎ সম্মান-দক্ষিণা দিত—যা ‘রহস্য’, ‘রোমাঞ্চ’ বা ‘গোয়েন্দা’ কখনও দেয়নি।
১৯৭২-এ ‘চতুর্থ’ পত্রিকা হিসেবে ‘ক্রাইম’ বাজারে এসেছিল। এর মালিক ছিলেন রামচন্দ্র সাহা। সম্পাদক হিসেবে ছোট ভাই দীনেশচন্দ্রর নাম থাকলেও সব কাজ করতেন রামচন্দ্র নিজেই।
‘ক্রাইম’ পত্রিকায় আমরা অনেকেই নিয়মিত লিখতাম এবং সাপ্তাহিক আড্ডার লোভে লেখক-বন্ধুরা কোনও চায়ের দোকানে বা কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে নিয়মিত মিলিত হতাম। সে-আড্ডায় ভাস্কর রাহা, উপেন মান্না, উৎপল ভট্টাচার্য, অভিজিৎ দত্ত, শ্রীপার্থ, অনিরুদ্ধ চৌধুরী, ধ্রুবেন সেন, সুজিত ধর ইত্যাদি অনেকেই আসতেন—রামচন্দ্রও আসতেন নিয়মিত। আমাদের মধ্যে নানান বিষয়ে আলোচনা হত—আড্ডায় যেমন হয়। তারই মধ্যে একদিন উঠল সম্মান-দক্ষিণার কথা। আমরা ঠিক করলাম, বিনাপয়সায় আর লিখব না—অন্তত পাঁচ টাকা হলেও দিতে হবে। আমাদের বন্ধু হওয়ায় রামচন্দ্রের কানে সে-জেহাদ পৌঁছে যায়। আশ্চর্য, রামচন্দ্র সাহা হাসিমুখে আমাদের প্রস্তাব মেনে নেন। তিনি আমাদের প্রত্যেককে লেখা-পিছু পাঁচ টাকা করে দিতে রাজি হন। যতদূর মনে পড়ে, ১৯৭২ সালের শেষাশেষি আমরা গল্প বা উপন্যাস যা-ই লিখি না কেন—লেখা-পিছু পাঁচ টাকা করে পেতে শুরু করি।
রামচন্দ্র সাহার এই পদক্ষেপ কোনওদিনই ভোলার নয়। পাঁচ টাকার অর্থমূল্য নয়—সম্মান-মূল্য আমাদের সেদিন অভিভূত করেছিল। আমরা অন্যান্য রহস্য-রোমাঞ্চ পত্রিকায়—মানে, ‘মাসিক রোমাঞ্চ’, ‘মাসিক রহস্য পত্রিকা’ আর ‘মাসিক গোয়েন্দা’—বিনাপয়সায় লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সেইদিনের পর থেকে আর কোনও ব্যবসায়িক পত্রিকায় বিনাপয়সায় আমাদের লিখতে হয়নি।
শুধু যে এই ঘটনার জন্য রামচন্দ্র সাহাকে আমরা মনে রেখেছি, তা নয়। রামচন্দ্র ছিলেন হৃদয়বান, মিশুকে, পরোপকারী, সদাহাস্যময় তরুণ। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে এই মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে যান—তখন ওঁর বয়েস মাত্র তিরিশ।
রামচন্দ্র সাহার চলে যাওয়াটা আমাদের প্রত্যেকের বুকে তীব্রভাবে বেজেছিল। ‘ক্রাইম’ পত্রিকার মে-জুন (১৯৭৪) সংখ্যাটি ‘রামচন্দ্র সাহা স্মৃতি সংখ্যা’ হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই সংখ্যায় মনের ব্যথা থেকে আমরা সবাই কিছু-না-কিছু লিখেছিলাম। তা ছাড়াও ছিল বহু নামী এবং শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিকের লেখা—যাঁদের সঙ্গে রামচন্দ্রের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, যাঁরা ‘ক্রাইম’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন।
রামচন্দ্রের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন :
‘ক’দিনের বা পরিচয়। মাস কয়েকের বেশী নয়। কিন্তু তাইতেই সে মনের মধ্যে একটা ছাপ ফেলেছিল। ছাপটা যে কারণে পড়েছিল তা হ’ল তার ভেতরকার প্রাণ-শক্তির একটা প্রচ্ছন্ন দীপ্তি।
…আমায় যা আকৃষ্ট করেছিল, তা তার অকৃত্রিম সরল আন্তরিকতা, যা তার ভেতরকার প্রাণশক্তির প্রকাশকে আরো স্পষ্ট করে তোলে।
…দেবতারা যাদের ভালবাসেন, তারা নাকি বড় সকাল সকাল চলে যায়। তাই কি চলে গেছে রাম?
কি দরকার ছিল দেবতাদের অত ভালবাসার! আমাদের এই এত ভালবাসা স্নেহ কি যথেষ্ট ছিল না।’
(‘দেবতাদের প্রিয়’/’ক্রাইম’, মে-জুন, ১৯৭৪)
নীহাররঞ্জন গুপ্ত লিখেছিলেন :
‘…আজকের যুগে অমন একজন সত্যনিষ্ঠ, কর্মঠ পরিশ্রমী, প্রত্যাশায় পূর্ণ যুবক বড় একটা চোখে পড়ে না। ভগবানের একি বিচার জানি না। ভাল ফুলটিই তিনি হাত বাড়িয়ে তুলে নেন সম্ভাবনার অবসান ঘটিয়ে।’
(‘রামচন্দ্র সাহা’/’ক্রাইম’, মে-জুন, ১৯৭৪)
রামচন্দ্রের পর ওঁর ভাই দীনেশচন্দ্র সাহা পত্রিকার সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন।
১৯৭৩ সালে আমরা লেখকরা মিলে একটি রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনির সংকলন বের করেছিলাম। ভাস্কর রাহা, উপেন মান্না, উৎপল ভট্টাচার্য, মঞ্জিল সেন, অসিত মৈত্র এবং আরও কয়েকজন মিলে মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকা করে চাঁদা দিয়ে ন’টি কাহিনির এই সংকলনটি প্রকাশ করা হয়েছিল। নাম ছিল ‘রক্ত ফোঁটা ফোঁটা’। একেবারে বিদেশি পেপারব্যাক বইয়ের ধাঁচে বইটি আমরা তৈরি করেছিলাম। অ্যান্টিক কাগজে ছাপা, চব্বিশ পেজি ফর্মা, চার রঙের লাইন-হাফটোন কম্বাইন্ড ব্লকে আর্ট বোর্ডে ছাপা প্রচ্ছদ—সে একেবারে ঝকমকে ব্যাপার। দুশো চার পৃষ্ঠার সুদৃশ্য বইটির দাম ছিল সাড়ে তিন টাকা। এখনও বইটিকে দেখলে মনে হয় কী আধুনিক!
‘রক্ত ফোঁটা ফোঁটা’র পর চাঁদা তুলে আরও একটি সংকলন আমরা বের করেছিলাম। ১৯৭৪-এ বেরোনো এই বাংলা পেপারব্যাক বইটির নাম ছিল ‘কফিন’। অ্যান্টিক কাগজে ছাপা একশো আটষট্টি পৃষ্ঠার বইটির দাম ছিল চার টাকা। ‘অপরাধ’ পত্রিকার সম্পাদক অশোক রায় এই বইটি প্রকাশে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
আজ এই প্রচেষ্টা দুটো নগণ্য এবং হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই : রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনিকে পাঠকের প্রিয় করে তোলা।
সেসময়ে যে-ক’টি রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনির মাসিক পত্রিকা ছিল, তাদের মালিক/সম্পাদকদের কেউ-কেউ আমাদের এই প্রচেষ্টাকে সহজভাবে নেননি।
১৯৭৫ থেকে শুরু হয়েছিল ‘মাসিক ক্রিমিনাল’। তার কয়েক বছরের মধ্যেই প্রকাশিত হয় ‘গোয়েন্দা-রহস্য’ এবং ‘উল্কা’। দুটি পত্রিকারই কর্ণধার ছিলেন বিমলকান্তি সাহা—যদিও সম্পাদক হিসেবে নাম প্রকাশ করেছিলেন শুধুমাত্র ‘গোয়েন্দা-রহস্য’-তে।
যেসব পত্র-পত্রিকার কথা বললাম সেগুলো ছাড়াও কয়েকটি এজাতীয় পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই পুরোনো কালে ‘রহস্যমালা’ (১৯৪৮), তারপর ষাটের দশকে ‘অন্তরালে’, ‘তদন্ত-রহস্য’, ‘রহস্য সন্ধানী’, ‘তদন্ত’। এদের মধ্যে একমাত্র ‘রহস্য সন্ধানী’ ছিল তুলনায় দীর্ঘজীবী।
আশির দশক পেরোতে-না-পেরোতেই টিভির প্রকোপ শুরু হল। টিভি ঢুকল ঘরে-ঘরে। আর এই মণ্ড-পত্রিকাগুলো ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়তে লাগল। ১৯৮৪-তে অশোক রায় ‘অপরাধ’ পত্রিকাকে বিদেশি ‘ট্রু ডিটেকটিভ’ পত্রিকার ধাঁচে বদলে দিলেন। পত্রিকার মাপও ষোলো পেজি ডবল ডিমাই থেকে আট পেজি বড় মাপে পালটে দিলেন। সেক্স-ক্রাইম লেখা ছেপে নতুন প্রজন্মের পাঠকদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করতে লাগলেন।
এটাই ছিল বোধহয় শেষের শুরু।
১৯৮৪-৮৫ সাল নাগাদ রঙিন টিভি ঢুকে পড়ল বাজারে। আর তার পরে-পরেই মুদ্রণে এল নতুন যুগ। শুরু হল ফটো টাইপ সেটিং আর অফসেট। পুঁজি অল্প থাকায় এই পত্র-পত্রিকাগুলো আধুনিক মুদ্রণ প্রক্রিয়ায় যেতে পারেনি। ওদের সেই হ্যান্ড-কম্পোজ, লালচে নিউজপ্রিন্ট, আর ফ্ল্যাট মেশিন।
সুতরাং পত্রিকাগুলো একে-একে নিভতে শুরু করল।
আশির দশকের শেষের দিকে ক্রমশ অনিয়মিত হয়ে একসময় পত্রিকাগুলো বন্ধ হয়ে গেল। এমনকী, বাংলা ভাষায় সর্বকালের দীর্ঘজীবী পত্রিকা ‘রোমাঞ্চ’ও! এই পত্রিকাটি ১৯৩২ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত টিকে ছিল।
‘ক্রাইম’ পত্রিকার রামচন্দ্র সাহা চলে গিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালে। ১৯৭৮ সালে চলে গেলেন রবিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। এবং ‘মাসিক গোয়েন্দা’কে অনাথ করে গেলেন। দিনের পর দিন এই মানুষটিকে দেখেছি কী কষ্ট সয়ে, দরকার হলে ধার-দেনা করে, পত্রিকার পুজো সংখ্যার আয়োজন করেছেন। সবসময়ে পত্রিকার ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবতেন। ওঁর অনুজ শিল্পী-বন্ধু নরেন রায় (কার্টুনিস্ট ‘সুফি’) প্রায়শই ‘মাসিক গোয়েন্দা’র প্রচ্ছদ আঁকতেন। এ জাতীয় পত্রিকার প্রচ্ছদে হাফটোন ব্লকের ব্যবহার রবিরঞ্জনই শুরু করেছিলেন। ওঁর পক্ষে এ-কাজ সহজ ছিল, কারণ, ‘গোয়েন্দা’র আগে তিনি ‘সচিত্র তোমার জীবন’ নামে একটি সিনেমা-পত্রিকা প্রকাশ করতেন।
১৯৯১ সালে ‘মাসিক রোমাঞ্চ’ পত্রিকার অন্তিম পুজো সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। তার পরের বছর অমিত চট্টোপাধ্যায় বিদায় নিলেন। আর ১৯৯৮ সালে রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়। আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় নতুন একটি রহস্য-রোমাঞ্চ পত্রিকা প্রকাশের স্বপ্ন দেখতেন। ১৯৯১ সালের পুজো সংখ্যা ‘রোমাঞ্চ’কে ‘শেষ সংখ্যা’ বলে কিছুতেই ওঁর মন মানতে পারেনি। তাই স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি তিনি। ওঁর স্বপ্ন শেষ হল স্বপ্নলোকে গিয়ে।
কিন্তু আমার স্বপ্ন দেখা এখনও শেষ হয়নি। সেই স্বপ্ন আর দুঃখ থেকেই এই বই।
ওইসব পালপ ম্যাগাজিনগুলোয় কারা লিখতেন তাঁদের নাম এখনও আমি আপনাকে বলিনি। কারণ এই বইয়ের সূচিপত্র দেখলেই আপনি সেটা বুঝতে পারবেন। এই বইয়ের প্রথম লেখাটি ১৯৪৮ সালে সাপ্তাহিক ‘রোমাঞ্চ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। আর শেষ লেখাটি ১৯৮৮ সালের ‘মাসিক রোমাঞ্চ’ থেকে। শুধু ১৯৪৯-১৯৫১ সাল, আর ১৯৫৩-১৯৫৪ সাল থেকে কোনও নমুনা-গল্প সংগ্রহ করতে পারিনি। তা ছাড়া ষোলোটি পত্রিকা থেকেই অন্তত একটি করে নমুনা পেশ করতে পেরেছি। সুতরাং এইভাবে কমবেশি চল্লিশ বছর ধরে পত্র-পত্রিকার পাতায় রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যের বিবর্তনের ধারা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি এই বইতে। বইয়ের প্রতিটি গল্পের শেষে দেওয়া আছে পত্রিকার নাম এবং গল্পটি প্রকাশের মাস ও বছর। যেহেতু সংকলনটিতে গল্পের সংখ্যা একশো, সেহেতু রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যের এই পত্রিকাগুলো মোটামুটি চার দশকে কোনটা কতটা ছাপ ফেলেছে তার একটা আন্দাজ পাওয়া কঠিন হবে না। যদি সেই ছাপকে আমরা বলি ‘ইমপ্যাক্ট ইনডেক্স’ বা ‘অভিঘাত সূচক’ তা হলে শতকরা হিসেবে চেহারাটা দাঁড়াবে এইরকম :
পত্রিকা | অভিঘাত সূচক(শতকরা) |
রোমাঞ্চ (সাপ্তাহিক) | ১ |
রহস্যমালা (সাপ্তাহিক) | ১ |
তদন্ত (সাপ্তাহিক) | ১ |
মাসিক রোমাঞ্চ | ৪২ |
মাসিক রহস্য পত্রিকা | ২২ |
মাসিক গোয়েন্দা | ৭ |
অন্তরালে | ৩ |
তদন্ত-রহস্য | ১ |
রহস্য-সন্ধানী | ১ |
তদন্ত | ১ |
ক্রাইম | ৭ |
শেষ সংকেত | ১ |
অপরাধ | ৬ |
মাসিক ক্রিমিনাল | ৪ |
গোয়েন্দা-রহস্য | ১ |
উল্কা | ১ |
এখানে আপনাকে জানানো দরকার, ‘অভিঘাত সূচক’ হিসেব করে মোটেই গল্প নির্বাচন করা হয়নি। বরং গল্প বাছাই করার পর এই সূচকটি হিসেব করা হয়েছে। এ ছাড়া কোন দশকে এই পত্র-পত্রিকাগুলো বাড়বাড়ন্তের শীর্ষে পৌঁছেছিল তারও মোটামুটি একটা হিসবে কষা যেতে পারে। তাতে ছবিটা দাঁড়ায় এইরকম :
সময় | গল্প-সংখ্যা |
১৯৪৮ সাল | ২ |
১৯৫১-১৯৬০ সাল | ২১ |
১৯৬১-১৯৭০ সাল | ২০ |
১৯৭১-১৯৮০ সাল | ৩৭ |
১৯৮১-১৯৯০ সাল | ২০ |
বোঝাই যাচ্ছে, সত্তর দশকের যে-উত্থান আশা জাগিয়েছিল, পরের দশকে খুব দ্রুত সেটা স্তিমিত হয়ে গেছে। তবে এর কারণ হিসেবে শুধুমাত্র অডিয়ো-ভিশুয়াল মিডিয়ামকে দোষ দেওয়া যাবে না। কিংবা আধুনিক মুদ্রণ পদ্ধতির জাঁকজমককে দায়ী করা যাবে না। এই দুইয়ের কাছে পত্রিকাগুলো হেরে তো গিয়েছিলই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল একঘেয়ে দুর্বল রচনার চাপ। এই তিনের কাছে নতিস্বীকার করে ‘ওরা’ নিভে গিয়েছিল।
বেশিরভাগ সময়েই পত্রিকাগুলোর পুজো সংখ্যা দীপ্তিমান রচনাতে সমৃদ্ধ হত। তাতে গল্প-উপন্যাস লিখতেন নামী-অনামী লেখকরা। সেই কারণেই হিসেব কষতে গিয়ে দেখছি, এই বইয়ের শতকরা ঊনষাট ভাগ গল্পই পুজো সংখ্যা থেকে নির্বাচিত।
সব মিলিয়ে বলতে পারি, এই সংকলন সেইসব দিনগুলো আবার মনে করিয়ে দেবে। যেন আপনাকে ফিরিয়ে দেবে সেই ‘হারানো’ পত্রিকাগুলো। আর বইটা হাতে নিয়ে আপনার মনে হবে, ‘সেদিন’ ‘ওরা’ বাংলা রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যের জন্য কী চেষ্টাই না করেছিল!
তাই এখন ‘ওদের’ হারিয়ে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে এ যেন আমার স্মৃতি তর্পণ। এই বই আমি তুলে দিচ্ছি সেইসব মানুষদের যাঁরা এই সাহিত্যকে ভালোবাসতেন, ভালোবাসেন, এবং ভালোবাসবেন—অর্থাৎ, আপনার হাতে।
অনীশ দেব
২২ ডিসেম্বর, ২০০৪
ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
বিজ্ঞান কলেজ (রাজাবাজার)
কলকাতা-৭০০ ০০৯
Leave a Reply