একটি রাত্রি : একটি অভিজ্ঞতা – হরিনারায়ণ বিশ্বাস
অন্ধকারাচ্ছন্ন থমথমে রাত্রি। নিবিড় অরণ্য। ওই অরণ্যের একটা বড় গাছের তেডালায় বসে আছি আমি। একটু দূরে অন্য একটা ডালে রঘুবীর। আমার হাতে দোনলা বন্দুক, রঘুবীরের কাছে সড়কি ও লাঠি।
আসামের এই অরণ্য নিবিড় ও দুর্ভেদ্য। বড়-বড় মহীরুহ নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে উচ্চ থেকে উচ্চতর হয়েছে। দিনেরবেলাও সূর্যরশ্মি মাটিতে পড়তে পায় না। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে অল্প একটু আলো আসে। যতক্ষণ দিনের আলো থাকে, ততক্ষণ অরণ্যের মধ্যে মোটামুটি দৃষ্টি চলে। যখনই সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ে, গাছের ছায়া দীর্ঘতর হয়, তখনই এই বনানীর অভ্যন্তর অন্ধকারে ভরে যায়। অন্ধকারের রাজত্ব এখানে, আলো নির্বাসিত। তাই অরণ্যের মাটি কালো ও স্যাঁতসেঁতে। অরণ্যের গভীরে বাস করে চিতা, হায়না, ভাল্লুক, বাঘ, বুনো শুয়োর, অজস্র হরিণ, আরও নানান প্রাণী।
আমি আবগারি বিভাগে চাকরি করি। স্থানীয় অধিবাসীদের মন নানা কুসংস্কারে ভরা। ভূতের ভয়, অন্ধকারের ভয় অত্যন্ত প্রবল। সন্ধ্যা নামার পর পারতপক্ষে কেউ আর বাড়ির বার হয় না। ফলে প্রচণ্ড পরিশ্রমে তারা যে ফসল ফলায়, রাত্রিতে হরিণ ও বুনো শুয়োর তা নষ্ট করে। সরকার থেকে তাই হরিণ ও বুনো শুয়োর মারার জন্য পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে।
আমার অখণ্ড অবসর। তাই রঘুবীরকে সঙ্গে নিয়ে মাঝে-মাঝে বেরিয়ে পড়ি। অরণ্যের শান্ত পরিবেশে আমরা যেন মূর্তিমান ভগ্নদূত। যখন ফিরি, সঙ্গে থাকে দু-একটা হরিণ বা শুয়োর।
সম্প্রতি গুজব রটেছে যে, অরণ্যের দেবতা নাকি মানুষের এই অনধিকার প্রবেশকে বরদাস্ত করতে পারছেন না। প্রমাণস্বরূপ বলা হচ্ছে, আজকাল শিকারিরা অরণ্যের মধ্যে প্রবেশ করলেই নানা বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। হরিণ বধ করার জন্যে যখনই তারা লক্ষ্য স্থির করে, তখনই নাকি লক্ষ্যপথে এসে হাজির হয় এক মানবশিশু।
আর আবির্ভাবের সঙ্গে-সঙ্গেই হরিণগুলো কোথায় হারিয়ে যায়।
মানবশিশুকে বধ করার মনোবৃত্তি কোনও শিকারিরই থাকে না। অবাক বিস্ময়ে যখন তারা চিন্তা করে কোথা থেকে এল এই মানবশিশু ভয়াবহ অরণ্যে, ঠিক সেই সময়েই একটা ভয়াবহ আওয়াজ শোনা যায় আর চকিতে মানবশিশু অন্তর্ধান করে। সেইদিন অরণ্যে আর কোনও প্রাণীকেও পাওয়া যায় না।
শিকারিদের মতে ওই মানবশিশু অরণ্যের রক্ষা-কর্তা। প্রজাকুলকে রক্ষা করার জন্যে প্রয়োজনের সময় রক্ষাকর্তা আবির্ভূত হন।
সেদিন সোমসাহেবও সেই কথা বললেন। সোমসাহেব একজন নামকরা কন্ট্রাক্টর। তাঁর কথা আমি হেসে উড়িয়ে দিতে পারি না।
সোমসাহেব বললেন, চৌধুরীবাবু, ওই নির্জন, ভয়াবহ, শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে মানবশিশুর আবির্ভাব সত্যিই বিস্ময়জনক।
আমি বলি, আপনার দেখার ভুল হয়নি তো?
—আরে মশাই, আমি তো একা ছিলাম না। আমার সঙ্গে ছিল আরও চার-পাঁচজন। আপনি কি বলতে চান, সকলেরই চোখ খারাপ?
—না-না, তা কেন! তবে কী জানেন, আজকের যুগে ওইসব সব আজগুবি ব্যাপার কি কেউ বিশ্বাস করবে?
—বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা আর বলবেন না। আমাদের জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আমরা দিতে পারি না। ওই মানবশিশুও অমনি এক বিতর্কের বিষয়। আপনার যদি ইচ্ছা থাকে, স্বচক্ষে দেখে আসুন। সন্দেহভঞ্জন হয়ে যাক।
—কোন জায়গায় আপনি তার দেখা পেয়েছিলেন?
—অরণ্যের ঠিক মাঝখানে, যেখানে নুনো মাটি আছে, সেইখানে।
গাছের ওপর বসে সোমসাহেবের কথাগুলো ভাবছিলাম। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন চারিদিক। কাছের ও দূরের থেকে নানা প্রাণীর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দূর থেকে গম্ভীর স্বরে বাঘের ডাক শোনা গেল। তাকিয়ে দেখলাম, রঘুবীরও নিশ্চল।
আমাদের সামনে সেই লবণক্ষেত্র। অন্ধকার রাত্রিতে সাদা নুনের ওপরে চাঁদের আবছা আলোর রেশ। উজ্জ্বল সাদা রং দেখা যাচ্ছে। চোখে পড়ছে বিরাট-বিরাট মহীরুহের কালো-কালো কাণ্ড। সহসা জোরে বাতাস বইতে লাগল। নিথর বনানী নানান শব্দে মুখর হয়ে উঠল। পাতার মর্মরে, জোনাকির দ্যুতিতে, শৃগালের হুক্কারবে, রাতজাগা পাখির কাকলিতে, শ্বাপদের হুঙ্কারে, বাতাসের শীতল স্পর্শে অদ্ভুত এক রহস্যময়, অপার্থিব অনুভূতি ক্রমে-ক্রমে আমার মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে লাগল। মনে হল, আমি যেন সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের অস্ত্রবিহীন গুহামানব। আমার সামনে এক বিরাটকায় অজগর ধীরে-ধীরে আমাকে গ্রাস করবার জন্যে এগিয়ে আসছে। তাকে প্রতিহত করার মতো কোনও শক্তিই আর আমার শরীরে অবশিষ্ট নেই। ভয়ের স্পর্শে ও অজগরের দৃষ্টিতে আমি সম্মোহিত হয়ে গেছি। নিশ্চিত মৃত্যু আমাকে গ্রাস করার জন্যে এগিয়ে আসছে…আসছে…আসছে…। সহসা একটা চাপা কণ্ঠের আওয়াজে চমক ভাঙল। সম্মোহনের ঘোর থেকে আমার মুক্তি ঘটল। শুনলাম রঘুবীরের কণ্ঠস্বর,—বাবুজি, হরিণ!
হরিণ! চমকে উঠলাম। চমকের চোটে হয়তো পড়েই যেতাম ওই উঁচু ডাল থেকে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে দড়ি দিয়ে নিজেকে বেঁধে রেখেছিলাম বলেই অপঘাত-মৃত্যু থেকে রক্ষা পেলাম।
বেশ কিছুক্ষণ লাগল সামলে নিতে। তারপর ওই সাদা নুনভরা জমিটার দিকে তাকালাম। ওই সাদা ক্ষেত্রের মধ্যে দুটো কালো ছায়া। ছায়াগুলো নড়ছে। নড়ছে বলেই ওগুলো যে প্রাণী তা বোঝা যাচ্ছে। নইলে এই ঘন অন্ধকারে কিছুই বোঝা যেত না। বন্দুকটা ঠিক করে নিয়ে আলো ফেললাম লক্ষ্যস্থলের দিকে। আলোকবৃত্তে দেখা গেল দুটি সুন্দর হরিণ চরে বেড়াচ্ছে আর নুন চেটে-চেটে খাচ্ছে। গুলি ছুড়লাম। একটা হরিণ পড়ে গেল। অন্যটা ছুটে পালাল। যে-ভয় আমার চেতনাকে ধীরে-ধীরে গ্রাস করে ফেলছিল, বন্দুকের আওয়াজে তা কেটে গেল। এখন আর কোনও কাজ নেই। চুপচাপ প্রভাতের জন্যে অপেক্ষা করা। নীচে নামলে শ্বাপদের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা।
একটা সিগারেট ধরালাম। রঘুবীরকেও একটা দিলাম।
রঘুবীর বলল, সাব, লক্ষ রাখবেন যেন বাঘে হরিণটা নিয়ে না পালায়।
বললাম, ঠিক আছে। তুমিও লক্ষ রেখো। আর, বাঘ যদি আসে, ক্ষতি কী! চাই কী হরিণ শিকার করতে এসে বাঘ শিকার হয়ে যাবে।
রঘুবীর সহসা থেমে গেল। ইশারা করে নীচের দিকে দেখাল। দেখলাম, মৃত হরিণের কাছে কী একটা জন্তু ঘুরে বেড়াচ্ছে। চকিতে বন্দুক বাগিয়ে স্পটলাইট জ্বালালাম। জ্বালিয়েই চমকে উঠলাম। দেখলাম, মৃত হরিণের পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা মানবশিশু। সম্পূর্ণ নগ্ন। কাঁধে ধনুক-বাণ। ধীরে-ধীরে হরিণটাকে ঠেলছে।
আলো পড়তেই সে তাকাল। কী বীভৎস সে-দৃষ্টি। জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো দুটো চোখ, হিংস্র দাঁত। মাথার চুল রক্তাভ। আমাদের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে সে আবার হরিণটাকে ঠেলতে লাগল। বিস্ময়ের চোটে বন্দুকটা সহসা স্থানচ্যুত হয়ে নীচে পড়ে গেল। দেখলাম, মৃত হরিণটা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল এবং সেই ধনুর্ধারী মানবশিশু তার পিঠে চড়তেই সেটা ক্ষিপ্রপদে অরণ্যের গভীরে চলে গেল। এবং হঠাৎই আমার স্পটলাইটটা নিভে গেল। তারপরই শোনা গেল একটা অপার্থিব আওয়াজ। যেন অতৃপ্ত আতৃত্মারা মাটি ভেদ করে উঠে আসতে চাইছে। অরণ্যের সমস্ত প্রাণীর আওয়াজ একদম থেমে গেল। খানিক পরে ওই অপার্থিক আওয়াজও থামল।
সারারাত আমি আর রঘুবীর স্থাণুর মতো বসে রইলাম। আমাদের কোনও বোধশক্তিই আর অবশিষ্ট নেই। এ কী দেখলাম আমরা? এই গভীর অরণ্যে হিংস্র শ্বাপদের মাঝে মানবশিশুর অস্তিত্ব তো কল্পনারও অতীত। তবে তো সোমসাহেবের কথাই ঠিক। ওই কি অরণ্যের রক্ষাকর্তা? অরণ্যদেব। নইলে মৃত হরিণের জন্যে তার প্রাণ আকুল হবে কেন! তবে কি সে মৃতদেহেও প্রাণসঞ্চার করতে পারে? এই সব ভাবতে-ভাবতেই রাত্রি প্রভাত হল।
আমি আর রঘুবীর গাছ থেকে নেমে ভাঙা বন্দুকের টুকরোগুলো সংগ্রহ করে এগিয়ে গেলাম সেই লবণক্ষেত্রের দিকে। যেখানে হরিণটা পড়েছিল, সেখানে প্রচুর রক্তের দাগ। কিন্তু তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান করেও আমরা মৃত বা আহত কোনও হরিণের দেখা পাইনি।
গল্প শেষ করে দাদু বলেছিলেন, তোরা একালের মানুষ। হয়তো আমার বাস্তব অভিজ্ঞতাকে তোরা নিছক গল্প বলে অবিশ্বাস করবি। কিন্তু ভেবে দ্যাখ, আমার না হয় ভুল হতে পারে, কিন্তু রঘুবীর, সোমসাহেব, আরও অনেকের কি একই ভুল হবে?
দাদুর প্রশ্নের জবাব আমরা দিতে পারিনি, শুধু চুপচাপ বসেছিলাম।
রহস্য সন্ধানী
ডিসেম্বর, ১৯৭২