সেই রাত, সেই অন্ধ রাত – দিব্যেন্দু পালিত
বেগমগঞ্জে পৌঁছে প্রথম রাত্রেই সেই দুঃসহ অস্বস্তির স্পর্শ পেলাম। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়বার সঙ্গে-সঙ্গেই গাঢ় অন্ধকারে ভরে গেল সমস্ত ঘর। মনে হল, জীবনে এই প্রথম যেন অন্ধকার দেখছি।
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলতেই তিনটে জোনাকি ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার মুখের ওপর। আর ঠিক তখনই শুনতে পেলাম সেই কান্না। প্রথমে অস্পষ্ট, বাতাসের হাহাকারের মতো। তারপর একটু-একটু করে তা রক্ত-মাংসের রূপ নিতে লাগল।
কিন্তু আমার সমস্ত ভয়, সব সংশয় হারিয়ে গেল কুমারবাহাদুরের মেয়ে চন্দ্রার সান্নিধ্যে এসে। রাজকুমারীর রূপ ছিল জলের বুকে শ্বেত-পদ্মের প্রথম পাপড়ি-মেলা মুহূর্তটির মতো। এমনই উজ্জ্বল, জীবন্ত আর পবিত্র! আমার কথা শুনে চন্দ্রার সে কী হাসি!
‘ও মা! এখনও ভূতের ভয় আছে আপনার?’
নিঃশব্দে হেসে বললাম, ‘ও-কথা যেতে দাও। বলো তো, কাকে তুমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসো? মাকে!’
তুমুল প্রতিবাদে মাথা দোলাল চন্দ্রা ‘উহুঁ, না, না। বাবাকে।’
রাজকুমারীর চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘বিশ্বাস হয় না।’
‘তবে?’
‘পারিজাতবাবুকে।’
চন্দ্রার লাজ-রক্ত কপোলের অস্থির বর্ণাভাস আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না। বুকের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে সলজ্জভাবে বললে, ‘মাস্টারমশাই, আপনি যেন কী!’
অনুমানে অনেক কিছু বুঝলেও পারিজাতবাবুর সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ তখনও আমার হয়নি। তবে, রমেনের সঙ্গে আলাপ হল বেগমগঞ্জে আসবার পরদিনই। আশ্চর্য ছেলে এই রমেন! পৃথিবীর তালাবন্ধ রহস্যঘরের চাবিকাঠি যেন তার হাতে। পরে মনে হয়েছিল : রমেন নিজেই বুঝি একটি ঘনীভূত রহস্য, যার শুরু আছে, শেষও আছে; কিন্তু মাঝের অংশটুকু অন্ধকারের পুরু চাদরে ঢাকা!
কাছারিবাড়ি আর কুমারবাহাদুরের বসতবাটীর মধ্যে ব্যবধান ছিল অনেকখানি। আমরা কয়েকজন, কোনও-না-কোনও কাজে এসে যারা কুমারবাহাদুরের আশ্রয় নিয়েছিলাম, তাদের থাকবার জন্য কয়েকটা ছোট-ছোট দু-ঘরের কোয়ার্টারের ব্যবস্থা ছিল। বেগমগঞ্জের এই দিকটা ছিল জনবিরল। পথে বেরুলে একসঙ্গে দুজন লোক চোখে পড়ত না। তবে নিঃসঙ্গ একাকীত্বের যন্ত্রণা বেশিদিন সহ্য করতে হয়নি। জমিদারি এস্টেটের সবকিছু ছিল স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মতো। পথের দু-ধারে হিজল, হরিতকীর ঘনবদ্ধ গাছের সারি; মাঠের মাঝখানে কাচের চৌবাচ্চায় রং-বেরঙের ছোট-ছোট রকমারি মাছ। প্রকাণ্ড জাল-ঘেরা খাঁচায় অজস্র পাখি। তবে…।
আমার কাছে যা সবচেয়ে বিস্ময়ের মনে হয়েছিল, তা হল রানিঝিল। কুমারবাহাদুরের বসতবাটী থেকে বাগানের মধ্যে দিয়ে পায়ে হেঁটে মিনিটপাঁচেকের পথ রানিঝিল। আশেপাশের বাগানটা ছিল একটু বেশি ঘন। নানারকমের দেশি-বিদেশি ফুলের গাছগুলো যেন নিবিড় আশ্লেষে ঢলে পড়েছে একে অন্যের গায়ে। সন্ধের পর যখন জমাট অন্ধকার নামত সেখানে, পিঙ্গল আলো জ্বেলে ঘুরে বেড়াত লক্ষ-লক্ষ জোনাকি, ঝিঁঝির অবিশ্রান্ত ঝিঁঝিঁরব শোনা যেত—তখন মনে হত মৃত্যুর মতো অপ্রত্যক্ষ একটা আত্মা সবসময় আকর্ষণ করছে সেদিকে। ভয় করত। পরে বুঝেছিলাম, সকলের আর-সবকিছুর আকর্ষণ হল রানিঝিল।
রমেন বললে, ‘কুমারবাহাদুরের মনের সব শান্তি নষ্ট করেছে ওই রানিঝিল।’
অবাক হলাম ‘কুমারবাহাদুরের মনের শান্তি!’
রমেন বললে, ‘কেন, ওঁর মুখ দেখে কিছু বুঝতে পারোনি?’
‘কই, সেরকম কিছু লক্ষ করিনি।’
‘চেষ্টা করো, পারবে।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রমেন আবার বললে, ‘সবরকম সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থেকেও যে শান্তি পাওয়া যায় না, কুমারবাহাদুরকে না দেখলে তা বোঝা যাবে না।’
আমি কিছু বললাম না।
‘ছাত্রী কেমন পড়াশুনা করছে?’ হাঁটতে-হাঁটতে রমেন জিজ্ঞাসা করলে।
বললাম, ‘ভালোই। খুব ইনটেলিজেন্ট মেয়ে।’
‘চালচলন?’
রমেনের ইঙ্গিত বুঝতে দেরি হয়েছিল। বললাম, ‘নেহাতই ছেলেমানুষ।’
‘ছেলেমানুষ!’ রমেন হাসল ‘হ্যাঁ, ছেলেমানুষ ছাড়া আর কী! চলো, ফেরা যাক।’
রাত হয়েছিল। রমেন নিজের কোয়ার্টারে ঢুকে পড়ল। আমার কোয়ার্টার খানিকটা দূরে। সেখানে পৌঁছে দেখলুম, বাজার-সরকার শিবতোষবাবু অন্ধকারেই একটা চেয়ার টেনে বসে
আছেন। অসময়ে ওঁর উপস্থিতি আমাকে বিব্রত করল।
‘সরকারমশাই, আপনি!’
‘আপনার সঙ্গে কথা আছে।’
‘বসুন। আলোটা জ্বালি।’
‘না।’ শিবতোবাবু বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনার মঙ্গলের জন্যেই বলছি, রমেন ছোকরার সঙ্গে বেশি মিশবেন না।’
বলেই দ্রুত হেঁটে কাছারিবাড়ির পথে অদৃশ্য হলেন তিনি।
কয়েক মুহূর্ত নিস্পন্দ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। একরাশ প্রশ্ন মৌমাছির মতো গুঞ্জন তুলল মস্তিষ্কে। কিন্তু কোনও প্রশ্নের জবাব পেলাম না। ঘরে তালা খুলে আলো জ্বালতেই জানালার ওপাশে রমেনের হাসি-মুখ উঁকি দিল।
‘কী হে, কী ভাবছ?’
‘তুমি!’
‘চুপ, চুপ।’ ঠোঁটে আঙুল রেখে ফিসফিস স্বরে রমেন বললে, ‘বুড়ো কী বলে গেল এরমধ্যেই ভুলে গেলে?’
রাত বাড়তে লাগল। যেটুকু শব্দ ছিল—গাছের আর পাতার, কিংবা পাখিদের আচমকা কোলাহলে, ক্রমে সেটুকুও হারিয়ে গেল। রিস্টওয়াচে দেখলাম, রাত একটা। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। কেমন এক ধরনের ভয়-ভয় অনুভূতি গ্রাস করছিল আমাকে। ভাবলুম জানলাটা বন্ধ করে দিই। কিন্তু অসহ্য গরম।
ঘুম আসছিল না। ছেলেবেলায় নামতা মুখস্থ করার চেয়েও এ এক ক্লান্তিকর অস্বস্তি। প্রতিটি মুহূর্ত ফোঁটা-ফোঁটা ঘাম হয়ে জমল কপালে, গলায় আর বুকে। বাতাসের বেগ বাড়তে লাগল।
পিঙ্গল আলো জ্বেলে উড়ে এল অসংখ্য জোনাকি।
তারপর, আবার। হ্যাঁ, আমার শুনতে একটুকু ভুল হয়নি। প্রথমে অস্পষ্ট। বাতাসের হাহাকারের মতো। তারপর ক্রমশ তা কান্নার রূপ নিতে লাগল।
একটা সিগারেট জ্বেলে জানলার পাশে এসে দাঁড়ালাম। শুক্লা-রাত্রির ধবল জ্যোৎস্নায় পরীরা নেমে এসেছে রানিঝিলের বুকে। হঠাৎ ডানা ঝটপটিয়ে আর্তনাদ করে উঠল কতগুলি পাখি…।
ঘুম ভাঙল খুব সকালে। তখন আকাশে থরথর কাঁপছে ভীরু শুকতারা, পাখির ঠোঁটে ভোরের কাকলি তখন সবে শুরু। আমার কোয়ার্টার থেকে বেশ খানিকটা দূরে বকুল গাছের পাশে দুটি ছায়া দুলে উঠল যেন। রাজকুমারী চন্দ্রাকে চিনতে দেরি হয়নি। অনুমানে চিনলাম পারিজাতবাবুকে। দেখলাম, চন্দ্রার খোঁপায় পরম আদরে ফুল গুঁজে দিচ্ছেন পারিজাতবাবু।
তারপর দুজনে লঘু অন্তরঙ্গ পায়ে হাঁটতে শুরু করল। বারান্দার এক কোণে—যেন কিছুই জানি না, ভান করে—দাঁড়িয়ে রইলাম। চন্দ্রার ভুরুতে বিস্ময় কেঁপে গেল।
‘মাস্টারমশাই, এত ভোরে আপনি!’
মৃদু হেসে তাকালুম পারিজাতবাবুর দিকে। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে রাজকুমারীর সুশুভ্র মুখাবয়বে সিঁদুরের আভা ছড়িয়ে পড়ল। আয়ত চোখ দুটি সামান্য তুলে বললে, ‘আমার কাকা, মাস্টারমশাই।’
সেই প্রথম দেখলুম পারিজাতবাবুকে। লক্ষ করলুম, পরিজাতবাবুর প্রসঙ্গে কেমন আরক্ত হয়ে ওঠে চন্দ্রা! আরও পরে বিস্মিত হয়ে ভাবলুম, রানিমার প্রশ্নে অমন আতঙ্কের শিহরন জাগে কেন রাজকুমারীর চোখে-মুখে?
অথচ, রানিমাকে তখনও চাক্ষুষ দেখিনি।
রমেন বললে, ‘জীবনের সবকিছুরই দুটো মানে আছে। একটা যা অত্যন্ত সহজ, আর দ্বিতীয়টি অত্যন্ত জটিল আর রহস্যময়। কুমারবাহাদুরের আশ্রয়ে এতদিন আছি, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে আজও কাউকে চিনলুম না। যখন মনে হয়, কুমারবাহাদুরকে চিনেছি, রানিমা তখন অস্পষ্ট হয়ে যান। আবার যদি ভাবি, রানিমাকেই চিনতে পেরেছি, কুমারবাহাদুর তখন অতলান্ত রহস্য!’
আমার মনে হল রমেন নিজেও একটি রহস্য। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘পারিজাতবাবু কি কুমারবাহাদুরের সহোদর?’
‘না, বৈমাত্রেয়।’ রমেন বললে, ‘বেগমগঞ্জ এস্টেটের অর্ধেক মালিক পারিজাতবাবু।’
পরদিন শুক্লপক্ষের চাঁদ খুব সাদা হয়ে দেখা দিল আকাশে। অনেক রাতে দরজায় টোকা পড়তেই খিল খুলে বেরিয়ে এলাম। রমেন বললে, ‘আজ একটা নতুন জিনিস দেখাব তোমাকে।’
‘কোথায়?’
‘রানিঝিলে। চুপ, আর কথা নয়। এসো।’
কারও চোখে পড়বার ভয়ে উলটো পথ ধরে এগিয়ে চললাম। পায়ের তলায় শুকনো পাতার মৃদু মর্মর। কানের পরদায় অবিরাম ঝিল্লিরব। চাঁদ উঠে এসেছে রানিঝিলের মাথায়। ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে। রানিঝিলের পশ্চিম দিকে একটা অশ্বত্থের ঘন ছায়ায় দাঁড়ালাম আমরা। আমার কবজিটা দৃঢ় মুঠিতে ধরে রমেন বললে, ‘দেখতে পাচ্ছ কিছু?’
তাকালুম। প্রথমে বিশ্বাস হল না। তারপর যেন একটা হিম শৈত্য অনুভব করলুম সর্বাঙ্গে।
রানিঝিলের পূর্বদিকে মার্বেল পাথরের বাঁধানো বেদির পাশে স্ট্যাচুটায় ঠেস দিয়ে বসে আছে এক সুন্দরদেহী পুরুষ এবং তার পাশে এক অপরূপা নারী। যেন দুটি সৌন্দর্যের ভঙ্গিমা কেউ ভুল করে সাজিয়ে দিয়েছে এই পৃথিবীর বুকে!
‘চিনতে পারো?’ রমেনের ডাকে বিস্ময় ভাঙল।
চাপাস্বরে বললাম, ‘কুমারবাহাদুর?’
‘না।’
‘তবে? পারিজাতবাবু?’
অদ্ভুতভাবে হাসল রমেন ‘আর একজন?’
মেঘের ছায়া ধীরে-ধীরে সরে আসছিল স্ট্যাচুটার গায়ে। স্পষ্টভাবে চেনা যাচ্ছিল না।
বললাম, ‘চিনতে পারছি না!’
‘চন্দ্রা।’
‘রমেন!’
‘ছেলেমানুষি কোরো না। চলো।’
‘কিন্তু—।’
আমার হাত চেপে ধরল রমেন ‘এসো বলছি।’
ফিরে চললাম। আবার সেই শুকনো পাতার শব্দ, জোনাকির আলো। কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। বললাম, ‘তোমার ভুল হয়েছে, রমেন। ও রাজকুমারী হতেই পারে না!’
দ্রুত পথ চলতে-চলতে রমেন বললে, ‘কী জানি, হয়তো তোমার কথাই ঠিক।’
কিন্তু…সেই কান্না! যেন এক নতুন রহস্য! মাঝে কিছুদিন শুনতে পাইনি। তারপর হঠাৎ একদিন রাতে আবার কানে এল।
কী যেন আবিষ্কারের আনন্দে উদ্দাম হয়ে উঠলাম।
শুক্লপক্ষের চতুর্দশী। ফিনকি দিয়ে জ্যোৎস্না ছুটছে। রানিঝিলের পথে পা বাড়ালুম। আজ আর রমেন সঙ্গে নেই—আমি একা। দেখতে হবে, তন্নতন্ন করে খুঁজতে হবে। যদি কিছু পাই।
কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছবার আগেই বাধা পেলুম।
‘মাস্টারমশাই!’
থমকে দাঁড়ালাম। পেছনে তাকিয়ে জিভ শুকিয়ে গেল। আর কেউ নয়, কুমারবাহাদুর স্বয়ং। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করতে হল।
‘এত রাত্রে এদিকে কোথায় যাচ্ছিলেন, মাস্টারমশাই?’
আড়ষ্ট কণ্ঠে মিথ্যে বললাম, ‘এই এমনি, একটু বেড়াতে।’
‘আপনি দুঃসাহসী!’ কুমারবাহাদুরের কথায় যেন তলোয়ারের ধার, ‘অসম্ভব দুঃসাহসী! যাক, ফিরে যান এবার।’
যন্ত্রচালিতের মতো আদেশ পালন করলাম। সব শুনে রমেন বললে, ‘গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়েছিলে? তুমি একটা হোপলেস!’
আমি যে সত্যিই কী, তা ভাববার অবসর পাইনি। কিন্তু, সত্যি বলতে কী, সেদিনের পর আর কান্না শুনতে পাইনি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেছে, ভয়ে—দুঃস্বপ্নে। পরে বুঝেছি, সবই অচেতন মনের ভুল।
ইতিমধ্যে কলকাতা থেকে নতুন আর ভালো একটা চাকরির খোঁজ পেয়ে স্থির করলুম, এই অস্বস্তির জগৎ থেকে চলে যাব। আমার ধারণা ছিল, সেই রাতের ঘটনার পর কুমারবাহাদুর নিশ্চয় আমাকে ডেকে পাঠাবেন। কিন্তু, দশ-বারো দিন হয়ে গেল, কুমারবাহাদুরের কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।
মনে আছে, কিছুদিন পরে কুমারবাহাদুর আমাকে তাঁর লাইব্রেরি ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আশঙ্কায় দুরু-দুরু বুকে গিয়েছিলুম সেখানে।
বিরাট হলঘরের চতুর্দিকে সুচারুরূপে সাজানো সারি-সারি বই ভরতি আলমারি। তার মাঝখানে বসে আছেন কুমারবাহাদুর। দেওয়ালে পিতা-প্রপিতামহের বড়-বড় অয়েল পেন্টিং, ল্যান্ডস্কেপ, আর একটি জিনিস—যা আমাকে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত করল। এই পবিত্র পরিবেশের সমস্ত মাধুর্য মলিন করে দেওয়ালে ঝুলছে সাপের মতো লিকলিকে কতকগুলো চাবুক।
কোনও ভূমিকা না করেই কুমারবাহাদুর বললেন, ‘সেদিন রাতে আমার ব্যবহারে আপনি নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছেন, মাস্টারমশাই। কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করুন, কোনও উপায় ছিল না বলেই অমন রূঢ় ভাষায় কথাগুলো বলতে হয়েছিল।’
সোজাসুজি তাকালুম কুমারবাহাদুরের চোখের দিকে।
কুমারবাহাদুর বললেন, ‘আপনি আমার অতিথি—বিপদ-আপদে আপনাকে রক্ষা করা আমার কর্তব্য। আপনি জানেন না, অত রাতে বনে-জঙ্গলে কত বিপদ লুকিয়ে থাকতে পারে।’
সসঙ্কোচে মাথা হেঁট করলুম। একবার ইচ্ছে হল জিজ্ঞাসা করি, বিপদ তো সব মানুষকেই আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু, আপনি সেখানে কী করছিলেন? কিন্তু দুর্বার দ্বিধায় মেরুদণ্ড সোজা হল না।
আমার শরীর ও মনের খবর নিলেন কুমারবাহাদুর। জিজ্ঞাসা করলেন চন্দ্রার কথা। বললুম। উচ্ছ্বাসে ভেঙে পড়লেন কুমারবাহাদুর ‘ও-ই আমার একমাত্র সন্তান, মাস্টারমশাই। ওর ওপর একটু নজর রাখবেন।’
চলে আসবার আগে ইতস্তত করে আমার অভিপ্রায় জানালুম। অনেকক্ষণ বইয়ের পাতায় চোখ ডুবিয়ে রাখলেন কুমারবাহাদুর। তারপর ধীরে-ধীরে বললেন, ‘চলে যাবেন? জানতাম। এখানে কারও মন টেকেনি। এ এক যন্ত্রণার পৃথিবী, মাস্টারমশাই। বাইরেই চটক, ভিতরটা ফোঁপরা। আপনাকেও বেঁধে রাখতে চাই না। তবু, একটি অনুরোধ…।’
জিজ্ঞাসু চোখে তাকালুম। কুমারবাহাদুর বললেন, ‘বিশেষ কাজে কাল একবার বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে দিন পনেরো লাগবে। যদি আপনার অসুবিধে না হয়, তাহলে ওই ক’টা দিন থেকে যাবেন?’
বললাম, ‘থাকব।’
কিন্তু অনুরোধ রাখতে পারিনি।
কুমারবাহাদুর চলে যাওয়ার দিনতিনেক পরে সহসা একদিন সন্ধেবেলায় ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি নামল। সে-বৃষ্টি চলল মাঝরাত অবধি। বেগমগঞ্জের রহস্য আর স্মৃতি আমার মনে অবসাদ এনেছিল। জানি না, তখন রাত দুটো কী একটা। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জানালায় ঝড়ের ক্রুদ্ধ মুষ্ঠি, বাতাসে আহত জন্তুর নিশ্বাস। হঠাৎ, দরজায় কড়া নড়ে উঠল।
এমন অসময়ে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কে আসতে পারে, ভাবতে-ভাবতে দরজা খুললাম। কিন্তু, এ কী!
কালো বোরখায় ঢাকা ভিজে মূর্তিটার মুখের কাপড় সরে গিয়ে একঝলক বিদ্যুতের আলো পাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল সেখানে। এর আগে কখনও দেখিনি, তবু রাজকুমারীর মুখের সঙ্গে কী অদ্ভুত মিল! বুঝলাম, কুমারবাহাদুরের স্ত্রী—রানিমা!
ক্ষীণ সম্ভাষণ বেরুল গলা দিয়ে, ‘আপনি!’
‘হ্যাঁ।’ আবেগে, উত্তেজনায় আর শীতে কাঁপছিলেন রানিমা ‘অনেক কলঙ্কের বোঝা নিয়ে সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এসেছি, মাস্টারমশাই। আপনি অন্তত একটু দয়া করুন।’
দয়া? আমি! নিঃশব্দে সরে দাঁড়ালুম।
দরজাটা ভেজিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন রানিমা। আর আমি তাকিয়ে রইলুম এক অনুপম সৌন্দর্যের দিকে।
আবার বললাম, ‘এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আপনি!’
স্থির, শান্ত দুটি চোখ তুলে তাকালেন রানিমা ‘ঘৃণা আর ভালোবাসা, ভালোবাসা আর ঘৃণা, মেয়েমানুষের জীবনে দুটিই চরম, মাস্টারমশাই। স্বামীর চোখে, সন্তানের চোখে, ঘৃণা আর ঈর্ষার বস্তু হয়ে থাকার বিড়ম্বনা যে কী, তা আপনাকে বোঝাতে পারব না। আপনি বুঝবেন না, কী অসহ্য জ্বালায় দিন কাটছে আমার!’
নির্বোধ কণ্ঠে প্রশ্ন জোগাল না।
রানিমা বললেন, ‘বিশ্বাস না হয়, নিজের চোখেই দেখুন।’
চোখের পলকে পেছন ঘুরে পিঠের আবরণ উন্মুক্ত করে দিলেন রানিমা। চমকে উঠলাম। মাখনের মতো নরম, কোমল, মাংসল ধবধবে পিঠের ওপর ঘন হয়ে বসে গেছে কতকগুলো সরু লম্বা ক্ষতের শুকিয়ে যাওয়া দাগ। অনিন্দ্য সুষমার মধ্যে প্রেতলোকের জঘন্য সঙ্কেত।
রানিমা বললেন, ‘ক্ষতের জ্বালাও একদিন জুড়িয়ে যাবে; কিন্তু মনের জ্বালা—।’
বললাম, ‘ক্ষমা করবেন, আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
রানিমার দীর্ঘশ্বাস আর্তনাদ করে উঠল ‘কেউ বুঝতে পারল না—কেউ না।’
তারপর এগিয়ে এসে আমার হাতদুটো চেপে ধরে বললেন, ‘শুনলাম, আপনি চলে যাচ্ছেন। কিছুই যদি না বুঝে থাকেন, তবে এটুকু জেনে রাখুন, শুধু এইজন্যেই এসেছি—আপনার যাওয়া হতে পারে না, মাস্টারমশাই। বেগমগঞ্জ ছেড়ে আপনি যাবেন না।’
কোনও জবাব দিতে পারলাম না। রানিমা হাতদুটো ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনার চোখ বলছে, কথা রাখবেন।’
তারপর বোরখায় সর্বাঙ্গ ঢেকে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সঙ্গে যাব আপনার?’
‘না।’
শুধু যতদূর চোখ গেল, দেখলুম, একটা অন্ধকার ছায়া ক্রমশ দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে কুমারবাহাদুরের বসতবাটীর দিকে।
বেগমগঞ্জের কোনও অনুরোধ রক্ষা করতে পারিনি। কুমারবাহাদুরের ফিরে আসবার অপেক্ষাটুকুও সহ্য হয়নি। কেন, তা বলতে পারব না। পরদিন রাতের অন্ধকারে কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে এসেছি। আসবার সময় দেখলুম চতুর্দিকে মৃত্যু-ঘন অন্ধকার। এত অন্ধকার জীবনে কখনও দেখিনি।
মাসিক রহস্য পত্রিকা
পুজো সংখ্যা, ১৯৬০