সাদা আমি কালো আমি – ১.৯

১৯৬৬ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ তেতে উঠছিল। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে রাজনৈতিক আন্দোলন আস্তে আস্তে নিরীহ আন্দোলনের থেকে ক্রমশ জঙ্গী রূপ নিচ্ছিল। খাদ্য আন্দোলনকে বলা যায় তার সূচনা। সুতরাং আমাদেরও ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছিল। ওই আন্দোলনের বীজ থেকেই জন্ম নিল প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার ১৯৬৭ সালে আবার একই আন্দোলনের অন্য একটি ধারা সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে মোড় নিল, যার ফল উত্তরবঙ্গে নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রাম। এই পটভূমিতে কলকাতায় একটা বড় মাপের ডাকাতি হয়। আটষট্টি সালের পয়লা জুলাই সকাল নটা নাগাদ পার্ক স্ট্রিট পোস্ট অফিসের পূর্বদিকের গলির ভেতর পোস্টাল ভ্যান থেকে প্রায় চার লাখ টাকা ডাকাতি হল। ডাকাতরা একটা কালো ল্যান্ডমাস্টার গাড়ি করে ক্যামাক স্ট্রিট ধরে পালাল। এই ধাঁচের সশস্ত্র ডাকাতি কলকাতা তার আগে দেখেনি।

পোস্ট অফিস থেকে পার্ক স্ট্রিট থানা ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। ডাকাতি করে পালানোর পর পরই পুলিস অফিসাররা এসে হাজির। গোয়েন্দা দফতর থেকেও বড়-ছোট অফিসাররা দ্রুত পৌঁছলেন ঘটনাস্থলে। ওখানে পাওয়া গেল ডাকাতদলের ব্যবহৃত দুটি ছোট কাঠের বেঞ্চ ও একটা বেতের ছিপ। ছিপের মাথায় ছোট আঁকশি করা, আঁকশির তলায় ঝুলছে প্লাস্টিকের সুতো দিয়ে বানানো ছোট ব্যাগ। এছাড়াও পড়ে ছিল দুটো অদ্ভুত ধরণের প্যার্সেলের প্যাকেট। দুটো প্যাকেটই প্রায় ফুট দেড়েক লম্বা, চওড়ায় এক ফুট। প্যাকেট দুটোর আকৃতি দেখে মনে হচ্ছে কেউ তার একদিক থেকে দুখাবলা চেঁছে নিয়েছে। অদ্ভূত খাঁজ তৈরি হয়েছে সেখানে। কোরা কাপড় দিয়ে সুন্দর করে গালা মুড়ে লাগানো, ঠিকানা লেখা, টিকিটও সাঁটা রয়েছে। পাশে ছিল একটা মোটা লোহার রড। আর কিছু তখন পাওয়া গেল না।

ডাকাতরা পোস্টাল ভ্যানের রক্ষীদের দুটো বন্দুকও সঙ্গে নিয়ে চলে গেছে। সব দেখে শুনে দেবীবাবু একজনের নাম করলেন, যাকে তিনি এই ডাকাতিটা সংগঠিত করেছেন বলে অনুমান করছেন। কিন্তু অনুমান আর প্রমাণ তো এক নয়, কিন্তু শুধুমাত্র অনুমানের ওপর নির্ভর করে কারোকে গ্রেফতার করা যায় না। আমাদের দফতরের যতরকম সোর্স ছিল সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হল ডাকাতির সূত্র খুঁজে বার করার জন্য। কিন্তু কোনদিক থেকেই কেউ আলোকপাত করতে পারছে না। যাকেই ধরে আনা হচ্ছে, দু এক ঘণ্টার মধ্যে প্রমাণিত হচ্ছে যে ভুল, একদম ভুল করে আমরা তাকে ধরে নিয়ে এসেছি।

কলকাতা পুলিশের মানসম্মান ধুলোয় লুণ্ঠিত হওয়ার অবস্থা। তবে একটা ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেল, এ কোনও সাধারণ ডাকাত দলের কাজ নয়। আমরা যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে খোঁজখবর করছি, তাতে একটা না একটা সূত্র ঠিক জানা যেত। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন অন্য গ্রহ থেকে কোন দল এসে ডাকাতিটা করে ফিরে গেছে তাদের গ্রহে। তাছাড়া সাধারণ ডাকাতরা এত নিপুণ ছকে ডাকাতি করে না। ডাকাতির পর ডাকাত দলের ফেলে যাওয়া যে সব জিনিস নিয়ে এসেছি, তা কোনও সাধারণ ডাকাত দলের বুদ্ধিতে আসবে বলে মনে হয় না। এসব জিনিস কি কি কারণে তারা নিয়ে এসেছিল তাও আমরা চট করে বুঝতে পারিনি। কমিশনার সাহেব থেকে আমাদের দফতরের ছোট অফিসারদের পর্যন্ত মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলার অবস্থা। সূত্র কই? সূত্র! দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এইভাবে চলে যাচ্ছে। আমরা হাতড়ে বেড়াচ্ছি অন্ধকারে।

আমাদের যখন এই অবস্থা, তখন গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত অক্টোবর মাসের বাইশ তারিখে ফের এক চাঞ্চল্যকর ডাকাতির ঘটনা ঘটল। সকালবেলায় সদর স্ট্রিটে এক সিগারেট সরবরাহী কোম্পানির লক্ষাধিক টাকা কর্মচারীরা ব্যাঙ্কে জমা দিতে যাচ্ছিলেন। ছ সাত জনের এক সশস্ত্র ডাকাত দল তাঁদের ওপর হামলা করে টাকা নিয়ে গাড়ি করে পালিয়ে যায়। এরপরই পত্রপত্রিকায় আমাদের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বইতে লাগল। সদর স্ট্রিট ডাকাতির জট মাস দুয়েকের মধ্যে খুলে কিছুটা মুখ রক্ষা করতে পারলেও পার্ক স্ট্রিট পোস্ট অফিসের ডাকাতির কোনও কিনারা হল না।

এদিকে তখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিনদিন অবনতি ঘটছে, অস্থিরতা বাড়ছে চারদিকে। আমরা সেদিকেই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছি। এর মধ্যে আবার ডাকাতি হয়ে গেল। এবার ডাকাতিটা হল নিউ আলিপুরে ন্যাশনাল এন্ড গ্রিন্ডলেজ ব্যাঙ্কে। মাঝেরহাট ব্রিজ যেখানে ট্যাঁকশালের দিকে নেমে গেছে তার পূর্ব কোণে বিরাট পেট্রল পাম্পের উল্টো দিকে ব্যাঙ্কটা। খোলে দুপুর সাড়ে বারটায়। উনসত্তরের দোসরা এপ্রিল ডাকাতরা ঠিক ওই সময় ছদ্মবেশে ব্যাঙ্কে ঢুকে কর্মী ও কাস্টমারদের রিভলবার, পিস্তল, স্টেনগান দেখিয়ে কাউন্টার থেকে প্রায় লাখ দেড়েক টাকা ডাকাতি করে নিয়ে গেল। ব্যাঙ্কের সামনে থেকে পাওয়া গেল নাইন, এম. এম. পিস্তলের ফায়ার করা কার্তুজের খোল। বেশ কিছু দূরের একটা গলি থেকে পাওয়া গেল একটা বেতের ঝুড়ি, যার মধ্যে ছিল একটা সোনালি রঙের পাগড়ি ও সর্দারজীদের দাড়ি বাঁধার কালো কাপড়, গাড়ির নাম্বার প্লেট। একটা কালো অ্যাম্বাসাডর গাড়ি ডাকাতদের তুলে নিয়ে গেছে বলে জানা গেল। এই নতুন ডাকাতি আমাদের উত্তেজনার পারদ আরও চড়িয়ে দিল 1 এবারও সমস্ত সোর্স খবর দিতে ব্যর্থ। পোস্ট অফিসের ডাকাতির মত এই ডাকাতিরও কোনরকম সূত্র মিলছে না। অন্য তদন্ত মোটামুটি শিকেয় তুলে এই দুই ডাকাতির রহস্য উদ্ধারের জন্য আদা জল খেয়ে লাগলাম। কিন্তু সবই পণ্ডশ্রম বলে মনে হচ্ছে। তবু হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না।

এদিকে জুলাই থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় পরপর পাঁচটা টাইম বম্ব ফাটল। কি উদ্দেশে এই বিস্ফোরণ তা বোঝা যাচ্ছে না। উদ্দেশ্য কি সন্ত্রাস সৃষ্টি করা? কারা চাইছে এই সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে? বোমাগুলো যে খুব জোরাল, তাও নয়। তবে মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট। গ্লোব ও লাইটহাউস সিনেমায় শো চলাকালীন ফাটল দুটো টাইম বোমা। দুটো ফাটল মার্কিন ভিসা অফিসে এবং আমেরিকান লাইব্রেরিতে। আর শেষটা বিবাদী বাগে জি পি ওতে একটা পোস্টাল ব্যাগের ভেতর। সিনেমা হল দুটোতে এবং ভিসা অফিসে টাইম বন্ধ রাখা হয়েছিল মহিলাদের ব্যাগের ভেতর। আর লাইব্রেরি ও পোস্টাল ব্যাগে ফাটল বইয়ের ভেতর। ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর যখন বোমা ফাটল তখন ধরেই নেওয়া যায়, ব্যাগ নিয়ে কোন পুরুষ নয়, মহিলাই হলে ঢুকেছিল। পোস্টাল ব্যাগে যে বোমাটা ফাটল সেটা যে বইয়ের ভেতর রাখা ছিল তার টুকরো টুকরো কাগজগুলো কুড়িয়ে নেওয়া হল। বোঝা গেল বইটা পার্সেল করে পাঠান হচ্ছিল আমেরিকান লাইব্রেরিতে। টুকরো ঘেঁটে পাওয়া গেল একটা পাখির পায়ের ছবি। কাগজ ও ছাপা দেখে মনে হল এটা কোনও বিদেশি বইয়ের মলাট। লাইব্রেরিতে খোঁজ শুরু হল, কি বই ওটা? ওই বই কি লাইব্রেরি থেকে কেউ নিয়ে গিয়েছিল? যদি নিয়ে যায় তবে কে সে? অনেক জল ঘোলা করার পর জানা গেল, যে বইটার খোঁজ করা হচ্ছে, তার দুটো কপি আমেরিকা থেকে এসেছিল। একটা চলে যায় পাটনায় লাইব্রেরির এক শাখায়, অন্যটা কলকাতায় ছিল। সেই বইটা নিয়ে গিয়েছিলেন জনৈকা মিসেস মিত্র, তার ঠিকানাটা ভবানীপুরের। পাখির পায়ের ছবিটা মেলানোর জন্য পাটনা থেকে প্লেনে করে বইটার কপি আনিয়ে মেলানো হল হল।

আমরা যখন একদিকে টাইম বন্ধ রহস্যের কিনারায় ব্যতিব্যস্ত, অন্যদিকে পার্ক স্ট্রিট পোস্ট অফিস ও নিউ আলিপুরের ব্যাঙ্ক ডাকাতদের খুঁজছি, তখনই যে ঘটনাটা ঘটল তাকে বলা যায় অকল্পনীয়। নিউ আলিপুরের সেই একই ন্যাশনাল এন্ড গ্রিন্ডলেজ ব্যাঙ্কে পনেরই অক্টোবর ঠিক সেই দুপুর সাড়ে বারোটায় দ্বিতীয় বার ডাকাতি হয়ে গেল। একই ব্যাঙ্কে সাত মাসের ব্যবধানে দু দুবার ডাকাতিতে আমরা একেবারে হতবাক। এবারও ডাকাতরা স্টেনগান, রিভলবার, পিস্তল ব্যবহার করল। এক লক্ষ বারো হাজারের মত টাকা কাউন্টার থেকে নিয়ে সেই কালো অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে করে পালাল। ডাকাতদের গড় বয়স পঁচিশ। এবার পাওয়া গেল একটা চটের নতুন থলি, স্টেনগান থেকে ছোঁড়া কার্তুজের খোল। সেগুলোই কুড়িয়ে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের অফিসাররা নিয়ে গেলেন পরীক্ষার জন্য।

দূর, দূর, আমাদের নিয়ে দফতরের কালো অ্যাম্বাসাডরের ডাকাতরা যেন ছেলেখেলা করছে। আমাদের অফিসারদের মনের যা অবস্থা, ডাকাতদলের কাউকে পেলে যেন চিবিয়ে খাবে। ব্যর্থতায় রাগ বেড়ে যাচ্ছে আমাদের। সোর্সগুলোকে মনে হচ্ছে চরম অপদার্থ। এদিকে আমাদের প্রতিদিন তুলোধোনা করছে পত্রপত্রিকা। অন্যদিকে কিন্তু গোপনে আমরা টাইম বোমার রহস্য জাল আস্তে আস্তে গুটিয়ে আনছি। ভবানীপুরে অনেক ঘুরে অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানা গেল, মিসেস মিত্র ও মিস্টার মিত্রের আসল পরিচয় নয়। তাঁরা হচ্ছেন মিসেস রায় ও মিস্টার রায়। তাঁরা বহুদিন ধরেই ওইখানে আত্মগোপন করে আছেন। মিসেস রায়ের অফিস থেকে জানা গেল তিনি বেশ কয়েকমাস ধরে ছুটিতে আছেন।

জাল গোটানো প্রায় শেষ। এগারই নভেম্বর, ভাই ফোঁটার দিন ছিল। খবর এল, মিসেস রায় বেলগাছিয়ায় তাঁর ভাইকে ফোঁটা দিতে যাবেন। আমাদের দল সেই ভাইয়ের বাড়ির চারধার সাদা পোশাকে ঘিরে রাখল। ইতিমধ্যে বেলতলার মোটর ভিহিকেলস্ ডিপার্টমেন্ট থেকে বহু পরিশ্রম করে মিস্টার রায়ের ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফটো যোগাড় করা হয়েছিল। তাতে রায়কে চিনতে আমাদের সুবিধে হয়েছিল। রাত নটা নাগাদ রায় দম্পতিকে দেখা গেল। খবর পাকা। ধরতে যেতেই ওঁরা আমাদের সঙ্গে তর্ক করে একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে কেটে পড়ার ফন্দি করলেন। কিন্তু সেই সুযোগ না দিয়ে সোজা ওঁদের নিয়ে আসা হল লর্ড সিনহা রোডে স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসে। তারপর লালবাজার। একনাগাড়ে জিজ্ঞাসাবাদের উত্তরে শেষ পর্যন্ত দুজনেই স্বীকার করলেন যে তাঁরাই টাইম বোমাগুলো ফাটিয়েছেন। সন্ত্রাস সৃষ্টিই একমাত্র লক্ষ্য ছিল। তাঁরা নকশালদের সমর্থক, কিন্তু কোনও আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নন। তাঁদের দীর্ঘ স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করে নভেম্বরের শেষ দিকে প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল। টাইম বন্ধ রহস্যের আবরন তো খোলা গেল, কিন্তু ডাকাতির রহস্য তখনও অন্ধকারেই।

উনসত্তরের বারোই ডিসেম্বর, শীতের সকাল। গোটা শহর ইডেন গার্ডেনমুখী। ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচ শুরু। অনেক দিন পর বাংলার কোন তরুণ খেলছিল ভারতীয় দলে। সেদিন ব্যাটসম্যান অম্বর রায়ের টেস্ট অভিষেক। সকাল দশটায় খেলা শুরু। আমরা সবাই পড়িমড়ি করে খেলা দেখতে গেছি। কারও কারও ওখানে ডিউটিও আছে। সাড়ে দশটাও বাজেনি, জায়গা মত বসেছি কি বসিনি, হঠাৎ ইডেনের মাইকে ঘোষণা ভেসে এল, লালবাজার কন্ট্রোল রুম থেকে অনুরোধ করা হচ্ছে, মাঠে উপস্থিত গোয়েন্দা দফতরের সব অফিসাররা যেন এক্ষুণি লালবাজারে হাজির হন। সেই নির্দেশ শুনে যে যেখানে ছিল তড়িঘড়ি লালবাজারে ছুটল। শুনলাম, পার্ক স্ট্রিট আর রাসেল স্ট্রিট ক্রসিংয়ে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার শাখায় ব্যাঙ্ক খোলার সাথে সাথে ডাকাতি হয়ে গেছে।

আবার ব্যাঙ্ক ডাকাতি! ওখানে গিয়ে শোনা গেল, যখন ব্যাঙ্ক কর্মীরা ভল্টের থেকে টাকা বার করে ট্রাঙ্কে ভরে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই ডাকাতরা তড়িৎগতিতে ঢুকে পড়ে। একজন বন্দুকধারী নেপালী পাহারাদারকে গুলি করে খুন করে, অন্য একজন পাহারাদারকে আহত করে চার লাখ পঁয়ষট্টি হাজার টাকা ও বহু সিকিউরিটির কাগজপত্র নিয়ে চম্পট দেয় তারা। একটা স্টেশন ওয়াগন ছিল তাদের বাহন। চোদ্দ পনের জন অল্পবয়সী ডাকাত মিনিট দুয়েকের মধ্যে রাসেল স্ট্রিট ধরে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। স্টেশন ওয়াগনের সামনে ছিল একটা কালো অ্যাম্বাসাডর গাড়ি, পেছনে ছোট একটা লরি। যাওয়ার সময় স্টেশন ওয়াগনের ড্রাইভারের সিটের দিকের জানালা দিয়ে লাল পতাকা ওড়াতে ওড়াতে তারা গেছে। ডাকাতরা ব্যাঙ্কের ভেতর ছড়িয়ে গেছে দশ বার পাতার ছোট বই আকারে তাদের ঘোষণাপত্র। শুধু তাই নয়, রাসেল স্ট্রিটের ওপর ব্যাঙ্কের মূল দরজার বাঁ দিকে ফুটপাতে যে সরু মত ফুলের বাগান আছে, তাতে রেখে গেছে একটা টেপ রেকর্ডার। তাতে ক্যাসেটে রয়েছে তাদের আগামী পদক্ষেপের ঘোষণা। আর পাওয়া গেল বড় একটা ছুরি, সাদা কাউন্টি ক্যাপ, একটা হুইসেল। ডাকাত দলের যে লরিটা স্টেশন ওয়াগনকে পেছন পেছন পাহারা দিয়ে নিয়ে গেছে, জানা গেল সেটা সকাল নটার আগে থেকে ব্যাঙ্কের সামনে পার্ক করা ছিল। নটার পর থেকে পার্ক স্ট্রিট দিয়ে লরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেজন্যই এই ব্যবস্থা।’ যেই ডাকাত দল ব্যাঙ্কে ঢুকেছে, ঠিক তখনই লরির চালক স্টার্ট দেয়। পাশেই ক্রসিংয়ে ছিল একজন ট্রাফিক কনস্টেবল, সে লরি চালাতে বারণ করে। কনস্টেবল লরি চালকের কাছে ড্রাইভিং লাইসেন্স চাইলে সে পকেট থেকে সেটা বের করে নির্দ্বিধায় দিয়ে দেয়। আমরা পেলাম সেই লাইসেন্সটা, যা বলাই বাহুল্য নকল। লাইসেন্সের ফটোর সঙ্গে অবশ্য ড্রাইভারের চেহারার মিল ছিল।

এর কিছুক্ষণ পর এক পথচারী খুঁজে পেয়ে দিয়ে গেলেন ব্যাঙ্কের সিল করা দশ হাজার টাকার একটা বাণ্ডিল। যেখানে রাসেল স্ট্রিট শেষ হয়ে লিটল রাসেল স্ট্রিট শুরু হয়েছে, সেখানে স্টেশন ওয়াগন থেকে ওই বাণ্ডিল পড়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে ডাকাতির খবর রটে গেছে চারদিকে। তারপর দেখা গেল, সাউথ ক্লাবের উল্টো দিকে লী রোডে পড়ে আছে ডাকাতদের ব্যবহার করা তুঁতে রঙের পুরনো স্টেশন ওয়াগনটা। একসময় ওটা ছিল এয়ার ইন্ডিয়ার স্টাফ কার। স্টেশন ওয়াগনে পাওয়া গেল ব্যাঙ্কের তিনটে কালো রঙের ট্রাঙ্ক, তিনটেই ভাঙা। যেটাতে টাকা ছিল সেটা ফাঁকা। একটায় সিকিউরিটির কাগজ ভর্তি, অন্য যেটাতে কয়েন ছিল সেটাও ফাঁকা। আর পাওয়া গেল লাল পতাকা, দুটো ব্যাগ, একটা লোহার রড। ভ্যানের ভেতর দেখা গেল রক্তের ছাপ। তার মানে ডাকাতদলের কেউ আহত হয়েছে। তারপর সব বেপাত্তা।

লালবাজারে তখন বসে গেছে শলাপরামর্শ। ডাকাতদের ফেলে যাওয়া ঘোষণাপত্র পড়ে ও ক্যাসেট চালিয়ে জানা গেল, তাদের দলের নাম রেভল্যুশনারি কমিউনিস্ট কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া। চৌ এন লাই যেমন চীনে সাংহাই শহরে অভ্যুত্থান করে সরকারি অস্ত্রাগার ও কোষাগার লুঠ করে হাজার হাজার মুক্তিসেনা নিয়ে গ্রামের দিকে চলে গিয়েছিলেন বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের উদ্দেশে, এরাও তেমনি ঠিক করেছে, কলকাতায় অভ্যুত্থান করে শহর দখল করে অস্ত্রশস্ত্র লুঠ করে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চলে যাবে গ্রামে। আর তারই প্রস্তুতির জন্য তাদের প্রয়োজন প্রচুর টাকা। সেই টাকা তারা ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে যোগাড় করছে। এর থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার হল, এরা সাধারণ ডাকাত দল নয়। আর সেজন্যই এদের হদিস পেতে আমাদের এত বেগ পেতে হচ্ছিল।

পুরনো সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত দলগুলোর মতই এদের ক্রিয়াকলাপ হওয়া উচিত মনে হল। আমাদের ছোটবড় সব অফিসারদের মাথার চুল খাড়া হয়ে গেছে, কিভাবে এদের সন্ধান পাওয়া যায়? হঠাৎ আমাদের মনে হল টাইম বন্ধ মামলায় ধৃত মিঃ রায়ের স্বীকারোক্তিতে কিছু অসংলগ্ন কথাবার্তা আছে যা কিনা তাঁর কাজের জগতের বাইরের। নিয়ে আসা হল তাঁর সেই স্বীকারোক্তি। সেই স্বীকারোক্তি বারবার পড়ে দেখা হল, কমিউনিস্ট বিপ্লব সম্পর্কে যেসব ব্যাখ্যা মিঃ রায় দিয়েছেন, গুপ্ত সংগঠন এবং তাদের কাজের ধরণ সম্পর্কে ওঁর যা ধারণা, তা যেন মিলে যাচ্ছে আর. সি. সি. আইয়ের এই ঘোষণাপত্রের সাথে। রায় তখন প্রেসিডেন্সি জেলে বিচারাধীন বন্দী। সেদিনই একটা অন্য মামলায় কোর্টের নির্দেশ নিয়ে রায়কে জেল থেকে নিয়ে আসা হল লালবাজারে। তাঁকে প্রশ্ন করা হল স্বীকারোক্তির ওই সব কথার অর্থ কি? ছোটখাট দোহারা চেহারার রায় কিন্তু আমাদের প্রশ্নের কোনও সদুত্তর দিতে পারলেন না।

অকুল সমুদ্রে ডুবতে ডুবতে তখন আমাদের খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা। একদিকে সরকারের প্রচণ্ড চাপ, অন্যদিকে খবরের কাগজ। পুলিশের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই টানাটানি। সেই মরণপণ লড়াইয়ে মিঃ রায় কতক্ষণ প্রতিরোধ করতে পারবেন? একসময় ভেঙে পড়লেন। রাত তখন বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে। তিনি স্বীকার করলেন, প্রথম থেকেই আর. সি. সি. আই দলের সদস্য ছিলেন। এমনকি দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও ছিলেন। দলের নেতা হচ্ছেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন খ্যাত অনন্ত সিং। তিনিই এই দল তৈরি করেছেন, পরিচালনাও করেন। দলের সভ্য সংখ্যা একসময় ছিল প্রায় ষাট জন। এখন কত আছে তা অবশ্য রায় জানেন না। পার্ক স্ট্রিট পোস্ট অফিসে ডাকাতির পরই তাঁর সঙ্গে দলের পরিচালকদের রাজনৈতিক বিরোধ বাধে। নিউ আলিপুর গ্রিন্ডলেজ ব্যাঙ্কে প্রথম ডাকাতির পর দলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখন কি অবস্থায় আছে দল তা তিনি জানেন না, তবে দলের সক্রিয় সদস্য এবং অনন্তবাবুর খুবই ঘনিষ্ঠ কল্যাণ বসু ওরফে গোরার গড়িয়ার বাড়ি তিনি চেনেন। ওই বাড়িটা অনন্তবাবুর বাড়ির কাছেই।

গভীর রাত, আমি আর গৌরাঙ্গবাবু রায়কে নিয়ে দুটো প্রাইভেট গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম গড়িয়ার দিকে। রায়ের কাছে শুনলাম, দলের সব সদস্যই অন্যত্র আত্মগোপন করে থাকলেও, গোরা বাড়ি ছেড়ে যায় না চট করে, কারণ বাবা-মার সে একমাত্র ছেলে। সে যে এই রকম একটা গুপ্ত সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে তাও তার বাবা মাকে কিছুতেই বুঝতে দিতে চায় না। সেইভাবেই সে চলাফেরা করে। যদিও গোরার মত বাবা মার একমাত্র ছেলেকে রিক্রুট করা অনন্তবাবুর পলিসি বিরোধী, তবু যে কারণেই হুক, অনন্তবাবু গোরাকে দলে নিয়েছেন। গাড়ি ছুটছে কলকাতার একেবারে দক্ষিণ দিকে। আমার পাশে বসে আছেন রায়। আমি মনে মনে একবার ভাবলাম, জয় হোক মধ্যবিত্তের রোম্যান্টিক বিপ্লবের। নয়ত কি করে খুঁজে পেতাম ধারাবাহিক ডাকাতির সূত্র? মিঃ রায় দলছুট হয়ে এসে নিজের বিপ্লবীয়ানা দেখাবার তাগিদে টাইম বন্ধ ফাটিয়েছিলেন। তাঁর এই অতি বিপ্লবী মধ্যবিত্ত সুলভ রোম্যান্টিক কার্যকলাপের জন্যই তাঁকে আমরা ধরতে পেরেছি। তার অতিরিক্ত কথা বলার প্রবণতার স্বীকারোক্তিতে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন, যেখান থেকে সূত্রের সিঁড়ি পেয়ে ধরতে যাচ্ছি গোরাকে।

রায় গড়িয়াতে এসে একটা গলির মধ্যে গাড়ি ঢোকালেন, কিন্তু গোরার বাড়িটা নির্দিষ্ট করে দেখাতে পারলেন না। ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায় তখন বুঝতে পারলাম না। আমরা এলাম যাদবপুর থানায়। সেখানে এসে থানার অফিসারদের সাহায্যে বের করলাম গড়িয়ার ওই অঞ্চলের ভোটার লিস্ট। লিস্ট দেখতে দেখতে পেয়ে গেলাম গোরার নাম। ওই গলির ভেতরই থাকে। সেই বাড়ির ঠিকানা নিয়ে ছুটলাম আবার গড়িয়ায়।

যখন গোরার বাড়ির সামনে পৌঁছলাম তখনও সূর্য ভাল করে কুয়াশার পর্দা ছিঁড়ে মুখ বার করেনি। দরজার কড়া নাড়লাম। বেঁটে খাটো গোলগাল তেইশ চব্বিশ বছরের যুবক দরজা খুলল। হাফ প্যান্ট পরা, ঘুম থেকে উঠে এসেছে। ততক্ষণে গাড়িতে বসা মিঃ রায় ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছেন এই ছেলেটাই গোরা। গোরা শুধু আমাদের প্রশ্ন করেছিল, “কাকে চাই?” আমি বললাম, “তোমাকেই।” সোজা তুলে এনে গাড়িতে। গাড়ি ছুটল লালবাজার। খবর পেয়ে দেবীবাবু সমেত বড় বড় অফিসাররা সকালবেলাতেই দফতরে হাজির।

গোরাকে যতই জেরা করা হল, সে জানি না জানি না বলে এড়িয়ে যেতে লাগল। তা বললে কি চলে? আমরা তো মিঃ রায়ের কাছ থেকে জেনে নিয়েছি, এবার ভুল নয়, আসল লোককেই এনেছি। আমাদের জানতেই হবে, দলের অন্য সদস্যরা কে কোথায় আছে, ডাকাতি করা টাকা, অস্ত্রশস্ত্র সব কোথায়? গোরা চার পাঁচ দিন প্রতিরোধ করল। তার অভিসন্ধি ছিল, তার ধরা পড়ার খবর শুনে দলের অন্য সদস্যরা যেন এই ফাঁকে সতর্ক হয়ে যায়। কিন্তু একদিন গোরা ভেঙে পড়ল। বলল, কল্যাণ রায়ের গোপন ডেরা চিনিয়ে দেবে। দলে অনন্ত সিংয়ের পরেই ছিল কল্যাণ রায়ের জায়গা। গোরাকে নিয়ে আমরা সে রাতেই বেরিয়ে পড়লাম। গোরা কাঁকুলিয়া রোডের একটা বাড়ি দেখিয়ে দিল। তখনও ভোর হতে বেশ খানিকটা দেরি। আমরা বাড়ি ঘিরে রাখলাম। কাকভোরে বাড়ির মালিককে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হল। কিন্তু তিনি যা বললেন, তাতে আমরা হতাশ হয়ে পড়লাম। দিন দুই আগে তাঁর ভাড়াটে একটা টেম্পোতে সব জিনিসপত্র তুলে স্ত্রী এবং মেয়েকে নিয়ে অন্য বাসায় চলে গেছে। কোথায় গেছে বলতে পারলেন না।

হিসেব করে দেখা গেল, গোরাকে যেদিন আমরা ধরেছি ঠিক তার পরদিন কল্যাণ রায় সপরিবারে পালিয়েছে। একদিক দিয়ে গোরার কাজে লেগে গেছে ওদের দলের সদস্যদের। কিন্তু আমাদের তো বসে থাকলে চলবে না। সূত্র যখন পাওয়া গিয়েছে তার পেছনে আদাজল খেয়ে লেগে পড়তে হবে। এতদিন আমরা হাওয়ায় হাতড়ে মরেছি, কিন্তু এবার আমাদের হাতে কিছু মশলা আছে যা ধরে এগিয়ে যেতে পারি। আমরা কালীঘাট, গড়িয়াহাট অঞ্চলের টেম্পোর ঘাঁটিগুলোতে গিয়ে ড্রাইভারদের সাথে বন্ধুত্ব করতে লাগলাম। জানতে হবে কোন টেম্পো ভাড়া করে কাঁকুলিয়া রোডের বাড়ি থেকে কল্যাণ রায় গিয়েছে। টেম্পো খুঁজে বার করার জন্য ছ সাত জন কনস্টেবল ও একজন অফিসারের একটা টিম করা হল। তারা দক্ষিণ কলকাতার যত টেম্পো ঘাঁটি আছে সেখানে ছড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভারদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, বিড়ি সিগারেট চা খাওয়া চলতে লাগল। চার পাঁচ দিনের মাথায় পাওয়া গেল সেই টেম্পোর ড্রাইভারকে। সে জানাল, কাঁকুলিয়া রোড থেকে এক ভাড়াটেকে নিয়ে পাম অ্যাভিন্যুতে এক বাড়িতে সে ওই দিন দিয়ে এসেছে। তাকে বলতে সেই দিনই পাম অ্যাভিন্যুর বাড়িটা আমাদের দেখিয়ে দিল।

কল্যাণ রায়ের আস্তানা চেনার পর ঠিক হল, ওখানে প্রথমেই সরাসরি তল্লাশি করতে যাওয়া হবে না। প্রথমে বাড়ি ঘিরে রেখে দেখা হবে কে কে আসছে, সবাইকে চিনিয়ে দেবে গোরা। কারণ একবার যদি বাড়ি তল্লাশি করা হয় এবং কল্যাণ রায়কে না পাওয়া যায়, তবে সে সতর্ক হয়ে যাবে, তখন আবার পালিয়ে যাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা একটা কোম্পানির ডেলিভারি ভ্যান যোগাড় করলাম। ভ্যানের ভেতর গোরাকে বসিয়ে রাখা হল। ভ্যানের ছোট্ট জাল দেওয়া জানালা দিয়ে গোরা রাস্তায় নজর রাখল, কল্যাণ এলেই জানান দেবে, আসামী হাজির। ভ্যানটা পাম অ্যাভিন্যুর সেই তিনতলা বাড়ির সামনে চাকা খুলে অচল করে রাখা হল। আমাদের অফিসাররা চারদিকে ছদ্মবেশে ঘুরতে লাগল সাধারণ পথচারীর মত। কেউ কারোকে চেনে না। বাড়িটার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা হল।

সকাল চলে গেল, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বাড়িটার কাছেই ছিল কড়েয়া থানা। সেখানে ঘাঁটি গেড়ে আমাদের পরিচালনা করছিলেন তখনকার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার কল্যাণ চক্রবর্তী ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডি. সি. অরুণ মুখার্জি। তাঁরা অন্য কোনও জুনিয়র অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ না করেই, কড়েয়া থানার সামনের বাগান থেকে মুলো তুলে একটা চটের থলি করে বিকেল চারটের সময় পাঠিয়ে দিলেন পাম অ্যাভিন্যুর ওই বাড়িতে, দেখে আসতে ফ্ল্যাটে কল্যাণ রায় আছে কি না। কল্যাণ রায় তখন বাড়ি ফিরছিল, সে দূর থেকে দেখে বিকেল চারটের সময় একটি অচেনা লোক বাজার করে তার বাড়িতে ঢুকছে। দেখেই তার সন্দেহ হয়, শীতকালের পড়ন্ত বিকেলে কে সব্জি বাজার করে বাড়িতে আসবে? কল্যাণ রায় তক্ষুণি সেখান থেকে পালিয়ে যায়। আসলে বড় বড় অফিসারদের কাজ হল জুনিয়রদের কাজের গুরুত্ব বুঝিয়ে দেওয়া। দায়িত্ব পাওয়ার পর দক্ষ জুনিয়র অফিসাররাই পরিস্থিতি বুঝে এগিয়ে যায়। হাতে কলমে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিচুতলার অফিসারদের অনেক বেশি। কারণ তারাই মাঠে নেমে খেলে। আসলে প্রশাসন চালান আর তদন্ত চালান এক নয়। গোয়েন্দাগিরি করতে গেলে শখের বা ছেলেমানুষীর কোন জায়গা নেই। চোখকান খোলা রেখে এগিয়ে যেতে হয়, কারণ অপরাধীরা ধূর্ত।

সন্ধের মুখে হঠাৎ গোরা বলে উঠল, “বাদল, বাদল।” বাদল হচ্ছে যাদবপুরের বিমল রায়চৌধুরীর ছদ্মনাম। ছিপছিপে, ফর্সা, ছ ফুটের মত লম্বা, মাথায় খুব অল্প চুল, টিকলো নাক, সাতাশ আঠাশ বছরের এক সুদর্শন যুবক পাম অ্যাভিন্যুর বাড়িতে ঢুকে পড়ল। আমরাও ওর পেছন পেছন তিনতলার ফ্ল্যাটে ঢুকলাম। আটকে দিলাম ওকে। একবার যখন আমরা ফ্ল্যাটে ঢুকে নিজেদের পরিচয় জানিয়ে দিয়েছি তখন আর বসে থেকে লাভ কি? বিমলকে একদিকে বেঁধে রাখা হল, শুরু হল খানা – তল্লাশি। ফ্ল্যাটে ছিল কল্যাণ রায়ের স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ে। ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া গেল স্টেট ব্যাঙ্কের থেকে ডাকাতি করা পঞ্চাশ হাজারের ওপর টাকা, দলের গোপন কিছু কাগজপত্র, অস্ত্রের কিছু অংশ। আমরা যে ফ্ল্যাটের ভেতর আছি বাইরে কেউ জানে না। নিঃশব্দে কাজ হচ্ছে, কল্যাণ রায় যদি আসে সে টেরও পাবে না এমনভাবে ফাঁদ পাতা আছে। না, সে এল না। কল্যাণ রায় বিমলকে পাঠিয়েছিল টাকা নিয়ে আসতে। সে যখন আর ফিরে যায়নি, তখন ধরেই নিয়েছে কোনও বিপদ হয়েছে, তাই বাড়ির দিকে আর পা বাড়ায়নি।

আমরা কল্যাণ রায়কে পেলাম না, কিন্তু বিমলকে পেলাম। তাকে নিয়ে রাত এগারটা নাগাদ ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলাম। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ, শীত জাঁকিয়ে বসেছে কলকাতার বুকে। রাতের ফাঁকা রাস্তা ধরে হু হু করে গাড়ি ছুটল লালবাজারের দিকে। ডেলিভারি ভ্যান ততক্ষণে ফের ঢাকা লাগিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। সেও গোরাকে নিয়ে হাজির। বিমল বেশি প্রতিরোধ করেনি। করবেই বা কি করে? সে তো কল্যাণ রায়ের ফ্ল্যাটে বামাল ধরা পড়েছে। ইতিমধ্যে পুরুলিয়ায় ধরা পড়েছে এই দলেরই সদস্য প্রলয়েশ মিশ্র আর অমিয় (সাগর) চ্যাটার্জি, সঙ্গে তাদের স্ত্রীরা। ওরা ওখানে নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল। খবর পেয়ে আমরা তাদের লালবাজারে নিয়ে আসি।

বিমলের কাছ থেকে খবর পেয়ে যাদবপুরের একটা বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হল একটা সুটকেস। তাতে পাওয়া গেল কলকাতা মোটর ভিহিকেসের বহু রকম নকল রাবার স্ট্যাম্প, ড্রাইভিং লাইসেন্স বানানোর সবরকম সরঞ্জাম। সেসব দিয়ে যখন তখন যে কোনও নামে ওরা নকল লাইসেন্স বানিয়ে ফেলতে পারত, ট্রাফিক পুলিশের সাধ্য নেই চট করে চেনে। সেই সুটকেসের মধ্যে ওদের দলের দুই সদস্যের পাসপোর্ট সাইজ ফটো পাওয়া গেল। যখন তখন ভুয়ো নামে খুশীমত লাইসেন্স বানানোর জন্য রাখা ছিল। জানা গেল, একটা ফটো ভবানীপুর অঞ্চলের পাঞ্জাবী ছেলে টনি বা রূপেন্দ্র সিং সোধীর, অন্যটা বেহালার তরুণ নকশাল নেতা রাজারাম চৌধুরীর। ওদের দলের স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী ফটোগুলো খুঁজে পাওয়ার কথা নয়, বিমলেরই ভুলে সেগুলো আমাদের হাতে এল। অনন্তবাবুর কড়া নির্দেশ ছিল, কোনও জায়গায় এমন কি নিজের বাড়ি বা আত্মীয়স্বজনের কাছেও যেন কোনও ফটো না থাকে। সব ফটো যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়। সেই নির্দেশ মেনে সদস্যরা কখনও ফটো তুলতও না, এমন কি পুরনো সব ফটো নষ্ট করে ফেলত। ফটো পেলে আমাদের কাজের অনেক সুবিধা হয়, আসামীকে চিহ্নিত করা যায়। ফটো পাওয়ার দিন দশেকের মাথায় বেহালায় এক লঞ্জি থেকে অরুণ মুখার্জির নেতৃত্বে স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকেরা রাজারামকে গ্রেফতার করল। ওকে গাড়িতে মুখার্জি সাহেব বারবার প্রশ্ন করছেন, “কল্যাণ রায় কোথায় এখন, বল?” ঠিক তখনই কিন্তু তারাতলার মোড়ে কল্যাণ রায় ও ওদের দলের এক সদস্যা কল্পনা বসু কথা বলতে বলতে গাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে তারাতলা রোডের দিকে চলে গেল। গাড়ির মধ্যে রাজারাম নির্বিকার। পুলিশও ওদের চেনে না যে চট করে গিয়ে ধরবে। যাকে আমরা হন্যে হয়ে খুঁজছি, সেই-ই আমাদের গাড়ির সামনে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে হেঁটে চলে গেল। এমনই হয়, আর সেজনই আমাদের প্রয়োজন হয় সাহায্যকারী ব্রীজ, অর্থাৎ সোর্স। রাজারামের বাড়িতে আমাদের অন্য এক দল গেল তল্লাশি করতে। কিন্তু সেখানে কিছুই পাওয়া গেল না। ওর পকেটে অবশ্য পাওয়া গেল ভারি গাড়ি চালানর নকল ড্রাইভিং লাইসেন্স, যার ফটোটা আমাদের উদ্ধার করা ফটোর অন্য এক কপি। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেল। সুদর্শন ছাত্র রাজারাম আর পালাবে কোথায়?

রাজারামকে গ্রেফতারের চারদিন পর সত্তরের জানুয়ারি মাসের দশ তারিখে অনন্তবাবুকে তাঁর গড়িয়ার বরদা অ্যাভিনিয়ুর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হল। তাঁকে গ্রেফতার করা মোটেই সহজ ছিল না। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। ততদিনে আমাদের হাতে এসে গিয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে কিছু নির্দিষ্ট প্রমাণ। সেগুলো আদালতে দাখিল করে আদালতের নির্দেশ নিয়ে এবং স্বরাষ্ট্র দফতরের সবুজ সংকেত পাওয়ার পরই তাঁকে গ্রেফতার করা হল। তাঁকে লালবাজার সেন্ট্রাল লক আপে রাখা হলেও তাঁর বয়স এবং গুরুত্ব অনুযায়ী সবরকম সুযোগ সুবিধে দেওয়া হয়েছিল।

এরপর আমাদের প্রায় মাস চারেক হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে হয়েছিল। কারণ ওদের দলের অন্য সদস্যদের গ্রেফতার করতে পারিনি। নতুন কোন যোগসূত্র পাওয়া যায়নি, ওরাও ভীষণ সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা হাল ছেড়ে দিইনি। নিউ আলিপুরের সাহাপুর ক্যাম্পের সামনে থেকে গ্রেফতার করলাম অনিল দত্তকে, যাকে পরে আমরা রাজসাক্ষী বানিয়েছিলাম। তারপর আবার পুরুলিয়া, এবার সেখানে ধরা পড়ল বাবুল, সমরেন্দ্র ও স্বপন। এই তিন তরুণ ছাত্র কলকাতার দল ছেড়ে পুরুলিয়ায় চলে গিয়েছিল মূল নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কৃষকদের সাথে মিশে লড়াই করতে। তাদের নিয়ে আসা হল লালবাজারে। অনিল দত্তের কাছ থেকে খবর পেয়ে একদিন গভীর রাতে দমদমের এক বাড়ি থেকে ধরা হল রণজিৎ দেকে। ধরা পড়ল যাদবপুরের ছোট্টখাট্ট চেহারার নকশাল খোকন দাস। নামখানায় নদী পারাপারের সময় আমাদের ফাঁদে ধরা পড়ল বেহালার আর এক নকশাল নেতা খোকন ভট্টাচার্য। তার সূত্র ধরে ধরা হল অস্ত্রের কাস্টডিয়ান বেহালার নকশাল সুভাষ সাহাকে। তার থেকে উদ্ধার করা হল বিদেশী একটা স্টেনগান, একটা পিস্তল, একটা রিভলবার ও গ্রেনেড। এগুলো স্টেট ব্যাঙ্কে ডাকাতির সময় ব্যবহার করা হয়েছিল। ডাকাতির পর সেগুলো মূল ঘাঁটিতে জমা না দিয়ে বেহালার খোকন আর রাজারামরা নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিল। অবশ্য সুভাষের সঙ্গে ওই দলের কোনও সম্পর্ক ছিল না। এদের সবাইকে গ্রেফতারের পর আমাদের সামনে দলের সম্পূর্ণ ছবিটা পরিষ্কার হয়ে গেল।

‘৬৫-৬৬ সাল থেকেই মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের প্রতি আস্থা হারিয়ে দলের বহু সদস্য ও সমর্থক দলের সঙ্গে সম্পর্ক আলগা করে ছোট ছোট উপদল তৈরি করেছিল, বিপ্লব করার উদ্দেশে। এইসব উপদলের সদস্যরা বিশ্বাস করত, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব কোনদিনই বিপ্লবের পথে যাবে না। তারা মুখে বিপ্লবের কথা বলে পার্টির সদস্যদের ভুলিয়ে রেখে সংসদীয় পথেই থাকবে। বিপ্লব করার জন্য যেভাবে পার্টিকে সংগঠিত করা দরকার তেমন কোনও পদক্ষেপও তারা নেবে না। এমনই একটা উপদল তৈরি করলেন অনন্ত সিং। তিনি পঞ্চাশের দশকেও “ওয়েজ” নামে একটা গুপ্ত দল তৈরি করেছিলেন। সেই দল ঊষা কোম্পানির ডাকাতি সমেত অনেকগুলো বড় ডাকাতি করেছিল, সেই টাকা তখনকার গুপ্ত পার্টির জন্য খরচ করা হয়েছিল। কিন্তু সেই দল ভেঙে যায়। তাদের বানানো একটা অত্যাধুনিক বুলেটপ্রুভ আর্মার্ড কার বিবাদী বাগে নিজেদের ভুলে গাড়িতে রাখা নিজেদেরই বিস্ফোরকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে উড়ে যায়। গাড়িতে দলের চারজন সদস্য ছিল, তারাও মারা যায়। তখন সেই দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিল কল্যাণ রায়। দল ভেঙে যাওয়ার পর সে চলে যায় আসানসোল- বার্নপুর অঞ্চলে, সেখানে সে সক্রিয়ভাবে কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করতে থাকে।

হঠাৎ তার মনে হয় এইভাবে দেশে বিপ্লব আনা যাবে না। সে আবার এক দশক পর ফিরে আসে কলকাতায়, দেখা করে তার পুরনো নেতা অনন্ত সিংয়ের সঙ্গে। এবার তারা দুজনে মিলে গড়ে তোলে নতুন দল আর. সি. সি. আই। কল্যাণ রায় দলে নিয়ে আসে তার ছোট তিন ভাই সলিল, অশোক ও অমলকে। সলিল কলকাতার এক নামকরা কলেজে চাকরি করত, সে সেই চাকরি ছেড়ে পেশাদার বিপ্লবী হয়ে গেল। অনন্তবাবু তার দলের সদস্যদের তেমন ভাবেই নিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন, যারা পেশাদার বিপ্লবী হতে রাজী আছে। যারা বাড়িঘর, মা, বাবা, আত্মীয়পরিজন ছেড়ে শুধুমাত্র বিপ্লবের জন্যই কাজ করতে প্রস্তুত তাদেরই দলে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন অনন্ত সিং। এককালের স্বদেশী সন্ত্রাসবাদী অনন্ত সিং তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে কখনও সন্ত্রাসবাদ ত্যাগ করতে পারেন নি। কমিউনিস্ট পার্টির এককালের সক্রিয় নেতা পার্টিও ছেড়েছিলেন নিজের ভিতরে সন্ত্রাসবাদী চিন্তাধারার জন্যই। তাঁর দল গঠন এবং পরিচালন নীতি ও কৌশল নির্ণয়ের মাধ্যমে বার বার পরিষ্কার হয়ে গেছে যে সন্ত্রাসবাদ তাঁর রক্তে মিলে গিয়েছিল। তাঁর দল গঠন এবং পরিচালন নীতিতে বারবার প্রমাণ হয়ে গিয়েছে যে সন্ত্রাসবাদ তাঁর রক্তে মিশে গিয়েছিল। তিনি দলের সদস্য হিসেবে নিতে থাকলেন তরুণ আদর্শবান ত্যাগস্বীকারে নির্ভয় সব ছেলেদের। এক এক করে, বহুদিন মিশে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দলে নেওয়া হত এদের। দলে প্রত্যেকের আলাদা ছদ্মনাম দেওয়া হত। এবং সেই নামেই সে দলে পরিচিত হত। যখন কোন সদস্য নতুন কারোকে দলে আনত সে এবং নতুন সদস্যটি দলের বাকিদের কখনও বলত না কোথায় তার বাড়ি কিংবা কি তার আসল পরিচয়। কেউ কারোকে করত না ব্যক্তিগত কোনও প্রশ্ন। কারণ সে যদি কখনও ধরা পড়ে তবে ইচ্ছা থাকলেও যেহেতু অন্য সদস্যের আসল পরিচয় সে জানে না তখন পুলিশকে জানাতে পারবে না। প্রাণে বাচার জন্যও নয়, কারণ সে তো জানেই না এসব খবরাখবর। দল যখন গড়ে উঠছে তখনই ঘটে গেল উত্তরবঙ্গে নকশালবাড়িতে কৃষক অভ্যুত্থান। এই দলও সেই আন্দোলনের সমর্থক হয়ে গেল। তরুণ সদস্য পেতেও এদের বেশি কষ্ট করতে হয়নি। কারণ তখন সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে, বিশেষ করে কলকাতায় ছাত্রদের মধ্যে নকশালবাড়ি আন্দোলন রীতিমত ঝড় তুলে দিয়েছিল। এই দলের সদস্যদের মধ্যে বেশির ভাগই নিজেদের অঞ্চলের সক্রিয় নকশাল নেতা বা কর্মী ছিল। অধিকাংশই ছিল বেহালা ও যাদবপুর অঞ্চলের, আর বাকিরা কলকাতা ও তার আশেপাশের মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণ তরুণী। নকশালবাড়ি আন্দোলনের ফলে তখন সি. পি. আই (এম)-এর বহু সদস্য ও সমর্থক প্রকাশ্যে পার্টির বিরোধিতা শুরু করল। এই আন্দোলনের মূল স্লোগান চীন বিপ্লবের অনুসরণে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা। প্রথমে গ্রাম মুক্ত করে শহর ঘিরে ফেলে পরে শহর দখলের কৌশল দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই কৌশলই আর সি. পি. আই. দল গ্রহণ করল। অনন্তবাবু বললেন, গ্রাম দখলের জন্য দরকার রসদ। তাছাড়া নিজেদের তৈরি সৈন্য ছাড়া গ্রাম দখল করা যাবে না। সেই রসদ ও সৈন্যের জন্য চীনের সাংহাই শহর অভ্যুত্থানের মত কলকাতা অভ্যুত্থান করে গ্রামে গিয়ে ঘাঁটি গাড়তে হবে। অভ্যুত্থান করতে হবে ছেষট্টি সালের খাদ্য আন্দোলনের মত জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায়। সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে নিজেদের প্রস্তুত রাখতে হবে। এই প্রস্তুতির জন্য চাই টাকা ও অস্ত্র আর চাই কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সমস্ত ইউনিয়ন ও ফ্রন্টে ন্যাচারাল নেতাদের সঙ্গে ব্যাপক যোগাযোগ ও রাজনৈতিক সম্পর্ক। এই ন্যাচারাল নেতারা হচ্ছেন তাঁরাই যাঁদের ডাকে শয়ে শয়ে কর্মী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

বড় বড় পার্টিগুলোর নেতাদের চালাকি ও পলায়নী মনোবৃত্তিকে তুচ্ছ করে যেন তারা বিপ্লবের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। ন্যাচারাল নেতাদের অধীনে অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীরাই মুক্তি ফৌজ। সেই মুক্তি ফৌজকে নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম যুক্ত করে এগিয়ে গিয়ে শহরগুলোকে ঘিরে ফেলতে হবে। অবশেষে দখল করে ফেলতে হবে শহর।

অনন্তবাবুর এই চমকপ্রদ থিওরি দলের সদস্যরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করত। সেই পথে এগিয়ে যেতে প্রথম প্রস্তুতি হিসেবে টাকার প্রয়োজন এবং সেইজন্যই ডাকাতি। কিন্তু ডাকাতির প্রস্তুতির জন্যও চাই টাকা। ন্যূনতম অস্ত্র ও একটা গাড়ির তো প্রয়োজন আছে। তাছাড়া আছে দৈনন্দিন খরচ। অনন্তবাবু সেই উপায়ও বের করলেন। দলের ছেলেরা প্রাথমিক খররের জন্য শুরু করল ছোটখাট চুরি। সাইকেল, রেডিও, টেপ রেকর্ডার নিজের ও বন্ধুবান্ধবদের বাড়ির থেকে চুরি করে আনত তারা। কেউ কেউ বাড়ির নগদ টাকা ও সোনাদানাও চুরি করে দলের তহবিলে দিল। অধিকাংশ‍ই ভদ্র শিক্ষিত পরিবারের, তবু শুধুমাত্র বিপ্লবের তাগিদে তারা চুরি করে দলের প্রাথমিক তহবিল গড়ে তুলল।

ইতিমধ্যে ঠিক হয়েছে পার্ক স্ট্রিটে পোস্ট অফিসের গলির ভেতর পোস্টাল ভ্যানে ডাকাতি করা হবে। সেই অনুযায়ী তারা তৈরি হতে লাগল। ডাকাতি হবে মাসের প্রথম দিন। কারণ পয়লা তারিখ ভ্যানে করে বেতনের টাকা জি পি ও থেকে আসে। বি. বা. দী বাগ থেকে ভ্যান প্রথম পার্ক স্ট্রিট পোস্ট অফিসে আসে, তারপর যায় এলগিন রোড পোস্ট অফিসে। এক এক করে পোস্ট অফিসে টাকা নামাতে নামাতে ভ্যান এগিয়ে যায়। পুরো টাকাটা পেতে হলে পার্ক স্ট্রিট পোস্ট অফিসে ভ্যান এলে সেখানেই ডাকাতি করতে হবে। যদিও ওখানে পোস্ট অফিসের কাছেই থানা, তবু বেশি টাকা পেতে গেলে সেই ঝুঁকিটা নিতেই হবে।

ডাকাতির প্ল্যান হওয়ার পর তিনটে গ্রুপ করে আলাদা আলাদা দায়িত্ব দিয়ে রিহার্সাল দিতে লাগল অনন্ত সিংয়ের দলের ছেলেরা। একটা গ্রুপ দায়িত্ব নিল সিগন্যালের। ভ্যান জি. পি. ও. থেকে ছাড়লেই সিগন্যাল দিতে শুরু করবে পরপর চেইন-ওয়াইজ এবং তা পৌঁছে যাবে পোস্ট অফিস পর্যন্ত। একজন নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়াবে। প্রথম জন তার হাতে রাখা কোনও জিনিস দিয়ে সংকেত দিলেই পরের জন বুঝে যাবে যে ভ্যান আসছে, তারপর সেও একইভাবে পরের জনকে দেবে সংকেত। এইভাবে পরপর সিগন্যাল পেয়ে মূল গ্রুপ, যারা পোস্ট অফিসের গলিতে অপেক্ষা করছে ডাকাতির জন্য, তারা জেনে যাবে ভ্যান আসছে। ভ্যান ছিল দুরকমের, বড় আর ছোট। বড় ভ্যানগুলোর পেছনের জানালা অনেকটা উঁচু, নিচে দাঁড়িয়ে দেখা যায় না ভ্যানের ভেতর কত জন আছে। তাদের আত্মসমর্পণ করতেও বলা যায় না। তাই দরকার উঁচুতে দাঁড়ান। সেজন্যই তারা নিয়ে গিয়েছিল কাঠের দুটো বেঞ্চ। আর যে দুটো অদ্ভুত দর্শন খাঁজকাটা পার্সেল আমরা পেয়েছিলাম, তা ছিল ভ্যান পৌঁছনর সাথে সাথে সামনের ও পেছনের চাকার তলায় গুঁজে দেওয়ার জন্য, যাতে ড্রাইভার ভ্যান দাঁড় করানর পর কিছুতেই গাড়ি এগিয়ে বা পিছিয়ে না নিয়ে যেতে পারে। লোহার রডটা ছিল ভ্যানের পেছনের তালা এক চাপে খুলে ফেলার জন্য। আর ছিপসমেত আঁকশিটা দিয়ে ভ্যানের ভেতরের একটা জায়গা থেকে চাবির ঝোলানো তোড়াটা জানালা দিয়ে টেনে নিজেদের হাতে নিয়ে নেওয়ার জন্য। আর টানার সময় যাতে নিচে না পড়ে যায় সে জন্যই আঁকশির তলায় প্লাসটিকের নেট ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তৃতীয় গ্রুপটার দায়িত্ব ছিল থানা থেকে পুলিশ বা কোনও টহলদারী ভ্যান যদি সেখানে পৌঁছে যায় তবে বোমা ও গ্রেনেড মেরে তাদের আটকে দেওয়া যাতে মূল দল ডাকাতির টাকা নিয়ে ঠিকঠাক পালাতে পারে। এরা হচ্ছে পেছনের গার্ড গ্রুপ। আপাতদৃষ্টিতে এই গার্ড গ্রুপের কোনও সক্রিয় ভূমিকা না বোঝা গেলেও এদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এদের ভূমিকাটা অনেকটা রক্ষাকর্তার। পুরো ডাকাতির ছকটাই অনন্তবাবুর।

সেদিন ছোট পোস্টাল ভ্যান এসেছিল। তাদের আর বেঞ্চ ব্যবহার করতে হয়নি। নিচে দাঁড়িয়েই দুই বন্দুকধারী পাহারাদারকে আত্মসমর্পণ করত বাধ্য করে, মিনিট খানেকের মধ্যে টাকা ও বন্দুক নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ান কালো ল্যান্ডমাস্টার গাড়িতে উঠে পড়ল তারা। গাড়িটা সেদিন ভীষণ অসুবিধের সৃষ্টি করেছিল, কারবোরেটর ফুটো হয়ে জল পড়ে যাচ্ছিল। বারবার লিউকোপ্লাস্ট দিয়ে জল আটকে গাড়ি চালাতে হয়েছিল। পালানর সময় এই বিপত্তি, ভাবা যায়! গাড়ি চালিয়েছিল কল্যাণ রায় নিজে।

পার্ক স্ট্রিট পোস্ট অফিসে ডাকাতির পর দলকে ঢেলে সাজান হল। দলের ভেতর পাঁচ ছজন করে ছোট ছোট গ্রুপ ভাগ করা হল, একজন করে গ্রুপ লিডার দলের কেন্দ্রের সাথে দৈনন্দিন যোগাযোগ রাখত। তার মাধ্যমেই অনন্তবাবুর নির্দেশ আসত। গ্রুপের সদস্যরা প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে নিজেরা মিলত, রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা, পড়াশুনো করত। এরা কলকাতার বিভিন্ন পার্কে, ময়দানে নিজেরা মিলিত হত। তাছাড়া ওরা কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট ছোট অফিস ঘর ভাড়া করেছিল, সেখানে চেয়ার টেবিল বসিয়ে অফিসের মত সাজিয়ে নিয়েছিল। সেই সব অফিসে গ্রুপ মিটিং বসত। লোকের তাতে কোনও সন্দেহ হত না। পার্ক স্ট্রিট ডাকাতির পর দলের সদস্যদের গুরুত্ব অনুযায়ী রাহা খরচ দেওয়া হত। তিনশো, পাঁচশো, সাতশো এবং বিবাহিতদের এক হাজার করে টাকা প্রতি মাসে দেওয়া হত। তাছাড়া যারা বাড়ি ঘরদোর ছেড়ে চলে এসেছিল তারা ছোট ছোট ঘর এবং ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল আত্মগোপন করে থাকবার জন্য। সেসব ঘরের ভাড়া আলাদা ভাবে দেওয়া হত। বেশির ভাগই ছিল দক্ষিণ ও মধ্য কলকাতায়। ষড়যন্ত্রমূলক বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে ওরা গড়ে তুলছিল নিজেদের সংগঠনকে। সদস্যদের নিষ্ঠা, একাগ্রতা, সততা, সাহস, রাজনৈতিক শিক্ষা এবং চরিত্র ছিল প্রশ্নাতীত। পরবর্তীকালের নকশাল ও অন্য পার্টির সদস্যদের সঙ্গে তুলনামূলক বিচার করলে সামগ্রিকভাবে এই দলের সদস্যরা কয়েক কদম সবসময়ই এগিয়ে থাকবে। তবে অতীতের সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে এদের চরিত্রের বহু জায়গায় মিল ছিল।

পার্ক স্ট্রিট ডাকাতির পর ওরা আর একটা ডাকাতির পরিকল্পনা করেছিল। সেটা ছিল সাউথ ইস্টার্ন রেলের ক্যাশ ভ্যান। এই ক্যাশ ভ্যানটা বি. বা. দী বাগের হেড অফিস থেকে বেরিয়ে ইডেন গার্ডেনের পশ্চিম দিকে গঙ্গার পাশ দিয়ে মেরিন হাউসের সামনের রাস্তা ধরে সোজা মুন্সীগঞ্জের দইঘাট ব্রিজ পার হয়ে চলে যেত বি. এন. আরের মূল কেন্দ্রীয় অফিসে। মাসের প্রথম দিন সেই ক্যাশ ভ্যান মাইনের প্রায় চোদ্দ পনের লাখ টাকা নিয়ে যেত। ক্যাশ ভ্যানের নিজস্ব দুজন বন্দুকধারী পাহারাদার ছাড়াও রাস্তায় ভ্যানটা পাহারা দিয়ে নিয়ে যেত কলকাতা পুলিশের এক লরি রাইফেলধারী কনস্টেবল। পুরো রাস্তা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে ওরা ঠিক করল,মেরিন হাউসের সামনে পৌঁছনর কিছুটা আগে ভ্যান দাঁড় করাবে। সেই অনুযায়ী ছক তৈরি করল। তাতে দেখা গেল ওদের প্রয়োজন দুটো লরি। একটা লরি হেস্টিংস থানার দিকের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে ক্যাশ ভ্যানের সামনে রাস্তা আটকে দাঁড়াবে। অন্য লরিটা পাহারাদার পুলিশের লরির পেছন দিকে দাঁড়াবে। যেখানে ক্যাশ ভ্যান ওরা দাঁড় করাবে ঠিক করল, তার থেকে হেস্টিংস থানার দূরত্ব বেশি নয়। তাই ঠিক হল, একটা প্রাইভেট গাড়ি থানার সামনের রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। পুলিশের ভ্যান বা অন্য কোন গাড়ি বের হলেই ওই প্রাইভেট গাড়ি থেকে গ্রেনেড বা ডিনামাইট ভর্তি সেল ছুঁড়ে গাড়ি উড়িয়ে দেবে।

ওরা ততদিনে ওদের আগের ঝরঝরে কালো ল্যান্ডমাস্টার গাড়িটা বিক্রি করে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড অ্যাম্বাসাডর কিনে সেটাও কালো রঙ করে নিয়েছিল। এই কালো রঙের মধ্যেও একটা বিশেষত্ব ছিল। ওরা তখন কলকাতায় রাস্তায় পর্যবেক্ষণ করে দেখেছিল যে অ্যাম্বাসাডর গাড়ির মধ্যে অধিকাংশই কালো রঙের। হাজার হাজার কালো গাড়ির ভিড়ে তাদের একটা গাড়িও সহজেই মিশে যেত। সাধ্য কি পুলিশের রঙ ধরে গাড়ি খুঁজে বের করার? তাছাড়া ওরা কখনও নম্বরহীন বা ভুয়ো নম্বর প্লেট গাড়িতে লাগিয়ে ডাকাতি করত না। এই নম্বর খুঁজে বের করতে অবশ্য ওদের অনেক পরিশ্রম করতে হত। এমন একটা নম্বর খুঁজে ওরা বার করত, যে গাড়িটা অন্তত ডাকাতির দিন রাস্তায় বের হবে না। আর গাড়ির মালিক ও আত্মীয় পরিজন, যারা ওই নম্বরটার সাথে পরিচিত, তারাও ডাকাতির জায়গায় ও আশেপাশে যাবে না। হঠাৎ যদি তারা দেখে যে তাদের গাড়ির নম্বারটা অন্য একটা গাড়িতে লাগান আছে, তবে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু সন্দেহ করবে। নিজে বাঁচার জন্য সাথে সাথে পুলিশে খবর দেবে, আর পুলিশ এসে ধরবে নকল নম্বর প্লেট লাগান অর্থাৎ ডাকাতি করতে আসা গাড়িটাকে। অনেক অনুসন্ধানের নিজেদের গাড়ির মডেলের নম্বর অনুযায়ী খুঁজে সেই নম্বর তারা ডাকাতির সময় ব্যবহার করত। ওদের প্রতিটি কাজই ছিল নিখুঁত।

রেলের ক্যাশ ভ্যান ডাকাতির পরিকল্পনায় একটা সমস্যা দেখা দিল। ভ্যান দাঁড় করালেও পুলিশ এবং রক্ষীদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করবে কি করে? নিজেরা লরি থেকে অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নামার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশের রাইফেল গর্জে উঠবে। সুতরাং রাস্তায় নামার আগেই পুলিশকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে হবে। তাছাড়া আরও একটা আশঙ্কা ছিল। লরি দাঁড় করানোর সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ গুলি চালাতে পারে। কিন্তু এই সমস্যারও সমাধান আছে। ওরা লরি দুটোকেই স্টিলের মোটা পাত দিয়ে মুড়ে সাড়ে পাঁচ ফুট উঁচু বডি করে আমার্ড কার তৈরি করে ফেলল। রাইফেলের বুলেট তা ভেদ করতে পারবে না। লরির সামনের দিকটা কিন্তু বুলেট প্রুফ করা গেল না, তাই ওরা ঠিক করল লরি দুটো দাঁড় করাবে আড়াআড়ি ভাবে যাতে ইঞ্জিনের দিকে পুলিশ গুলি চালাতে না পারে। আবার অন্য ভয়ও আছে, আড়াআড়ি দাঁড় করালে পুলিশ গুলি করে টায়ার পাংচার করে দিতে পারে। তাহলে তারা লরিতে পালাতে পারবে না। তাই এমন একটা অতিরিক্ত স্টিলের পাত বড়ির ভেতর রাখল, যাতে লরি দাঁড় করানর সঙ্গে সঙ্গেই লক খুলে দিলে সেটা লরির চাকা সমেত নিচের একদিকটা ঢেকে দেবে। এতে গুলি লাগবে না, আবার চলাফেরার কোনও অসুবিধেও হবে না। এ তো গেল আত্মরক্ষার ব্যাপার। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য তো তা নয়। পুলিশদের আত্মসমর্পণ করিয়ে ডাকাতি করে পালাতে হবে। তখন ওরা ঠিক করল প্রথমে মাইকে পুলিশকে আত্মসমর্পণ করতে অনুরোধ করবে, কাজ না হলে আর্মার্ট কার থেকে অ্যাসিড স্প্রে করা হবে পুলিশের দিকে। অ্যাসিড একবার গায়ে পড়লেই পুলিশ বাধ্য হবে আত্মসমর্পণ করতে। তখন ওরা নিচে নেমে ক্যাশ ভ্যান লুঠ করে পালাবে।

এই ডাকাতির পরিকল্পনা যখন চলছে তখন দলের ভেতর রাজনৈতিক সংঘাত দেখা দিল। একদল বলল, ডাকাতি করে অস্ত্র যোগাড় করে কলকাতা অভ্যুত্থানের দরকার নেই। সোজাসুজি গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সংগঠিত করে তাদের নিয়ে সংগ্রাম করে, কৃষকদের ফৌজ তৈরি করে, শহর ঘিরে ফেলতে সি. পি. আই (এম-এল) দলের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে দিলেই চলবে। অন্য দল আগের পথই আঁকড়ে থাকল। বিরোধ তুঙ্গে উঠে গেল। দল ভাগ অনিবার্য হয়ে পড়ল। ততদিনে পার্ক স্ট্রিটের ডাকাতির টাকা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে। এতগুলো ছেলের রাহাখরচ, বাড়ি ভাড়া, তার ওপর দুটো পুরনো লরি কিনে তাকে আর্মার্ড কার বানানো, দুটো অ্যাম্বাসাডর গাড়ি কেনা। এছাড়াও নতুন অনেক স্টেনগান, পিস্তল, রিভলবার এবং বিস্ফোরক পদার্থ কেনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে প্রচুর টাকা লেগেছিল। শুনেছি বিহারের কিছু শীর্ষস্থানীয় নেতাকে সংগঠনের কাজের জন্য “ টাকা দেওয়া হয়েছিল। এতেই ওদের প্রথম ডাকাতির টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিল। এদিকে দল দ্বিধাবিভক্ত হওয়াটা চূড়ান্ত হয়ে গেল। তখন ঠিক হল একটা ছোট ডাকাতি করে ডাকাতির টাকা ও দলের অস্ত্রশস্ত্র দুভাগ করে দুদল নিয়ে নেবে। একদল চলে যাবে গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সংগঠিত করতে, অন্য দল কলকাতায় থেকে আগের মত কলকাতা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি চালিয়ে যাবে।

সেই অনুযায়ী অল্পদিনের প্রস্তুতিতে তারা নিউ আলিপুরের ন্যাশনাল এন্ড গ্রিন্ডলেজ ব্যাঙ্কে ডাকাতি করল। টাকা ও অস্ত্র দুভাগ হয়ে গেল। গ্রামে কৃষক সংগঠন করতে চলে গেল দীপক বসু, কাজল পাল, প্রলয়েশ, অমিয় সমেত প্রায় তিরিশ জন। বাকিরা রয়ে গেল কলকাতায়। যারা রয়ে গেল তাদের সবাইকে নিয়ে একটা মিটিং হল ডায়মন্ড হারবারে। সেই মিটিংয়ে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ঠিক হল আর একটা ডাকাতি করা হবে এবং সেটার পরিমাণ হবে এক কোটি টাকা। এই ডাকাতিটাই হবে ওদের দলের শেষ ডাকাতি। ওই এক কোটি টাকার তহবিল থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে কলকাতা অভ্যুত্থানের। তাছাড়া গণআন্দোলনের বিভিন্ন ধারাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন মত সাহায্য করা হবে ওই তহবিলের টাকা দিয়ে। কিন্তু একসঙ্গে এক কোটি টাকা কোথায় পাওয়া যাবে?

অমলেন্দু সেন খবর আনল, পাওয়া যাবে। অমলেন্দু আগে দুর্গাপুরের স্টিল প্ল্যান্টে চাকরি করত। ওই প্ল্যান্ট থেকেই বিশেষ ট্রেনিংয়ের জন্য তাকে পশ্চিম জার্মানিতে পাঠান হয়েছিল। কিন্তু সে ফিরে এসে আর চাকরিতে যোগ না দিয়ে আর. সি. সি. আইতে যোগ দিয়ে পেশাদার বিপ্লবী হয়ে গেল। দুর্গাপুর অমলেন্দুর পরিচিত জায়গা। সে জানাল অত টাকা পাওয়া সম্ভব দুর্গাপুরে স্টেট ব্যাঙ্কের শাখায়। ওই ব্যাঙ্কে মাসের পয়লা তারিখে স্টিল প্ল্যান্টের ও অন্যান্য কতগুলো বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মাইনের টাকা আসে, যার পরিমাণ এক কোটি টাকার বেশি। স্টেট ব্যাঙ্কের শাখাটা একটা অদ্ভুত জায়গায়। জি. টি. রোড ধরে কলকাতা থেকে আসানসোল যেতে ওয়ান ওয়ে টামলা ব্রিজ ছিল। তার একটু আগে বাঁ দিকে জনবসতিহীন একটা বিরাট সরকারি জমির ওপর আছে দুর্গাপুর কোর্ট আর অন্যান্য সরকারি অফিস। সেখানে যাতায়াত করতে হলে দুটো কালভার্টের যে কোন একটা দিয়ে যেতে হয়। পুবদিকের প্রথম কালভার্ট পার হলেই একটা বিরাট খোলা মাঠ। মাঠের দক্ষিণ দিকে পিচের রাস্তা, সেই রাস্তার ওপর বিরাট একতলা বাড়ি, বাড়ির সামনে টানা বারান্দা। সেই বিরাট বাড়ির পুবদিকের কোণে স্টেট ব্যাঙ্ক আর বাড়ির শেষদিকে পশ্চিমপ্রান্তে সি. আর. পি. অফিস। অফিসের সামনে সব সময় প্রহরায় থাকে দুজন রাইফেলধারী সি. আর. পি. সিপাই, আর অফিসের ভেতর থাকে আরও ছজন। কোন গণ্ডগোলের আভাস পেলেই ওই সব সিপাই মুহূর্তে বেরিয়ে আসবে। ব্যাঙ্ক এবং ছোটখাট সরকারি অফিসে সামনের বারান্দাটা প্রায় ফাঁকাই থাকে, ফলে সি. আর. পি. সিপাইরা পরিষ্কার ব্যাঙ্কের সামনের বারান্দাটা পরিষ্কার দেখতে পায়। ব্যাঙ্কের পাশ দিয়ে পেছনে যাওয়ার রাস্তা। রাস্তাটা পুব থেকে পশ্চিমে গিয়ে তারপর দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। ব্যাঙ্কের পেছনেই পোস্ট অফিস। আর দক্ষিণ দিকের রাস্তায় ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের শাখা, রাজ্য পুলিশের রিজার্ভ ফোর্সের বিরাট ব্যারাক। সবসময় ওখানে পাঁচ ছটা ভ্যান, লরি থাকে। তাছাড়া আছে কোর্ট। এমন একটা আপাত দুর্ভেদ্য ব্যাঙ্কই ওরা বেছে নিল ডাকাতি করার উদ্দেশে।

প্রথমে ওরা ঠিক করল রাতে ডাকাতিটা করবে। রাতে ডাকাতি করলে সংঘর্ষ এড়ানর সম্ভাবনা বেশি। আবার রাতে ডাকাতি করলে ব্যাঙ্কের বন্ধ ভল্ট খুলে টাকা বের করতে হবে। প্রথমেই হৈ চৈ না করে খুলতে হবে ব্যাঙ্কের দরজা, যাতে নিঃশব্দে ব্যাঙ্কে ঢোকা যায়। এতটুকু শব্দ হলেই বেরিয়ে আসবে সি. আর. পি. জওয়ানরা আর বাতের প্রহরী আটজন রাইফেলধারী রাজ্য পুলিশের সিপাই। প্রয়োজনে পেছনের রিজার্ভ ফোর্সকে ডাকবে ওরা। সুতরাং যতক্ষণ না টাকা নিয়ে সরে পড়া হবে ততক্ষণ যেন কেউ জানতে না পারে, ডাকাতি হচ্ছে।

সেটা কি করে সম্ভব? সম্ভব হয় যদি ভেতর থেকে কেউ ব্যাঙ্কের দরজা খুলে দেয় এবং ওরা অন্ধকারে বিনা বাধায় ব্যাঙ্কের ভেতর ঢুকতে পারে। কিন্তু কে খুলে দেবে ব্যাঙ্কের সদর দরজা? রাতে ব্যাঙ্কের ভেতর থাকে দুই বন্দুকধারী দারোয়ান। তবু অসম্ভবকে সম্ভব করতেই হবে, ভেতর থেকেই খুলতে হবে দরজা। ওরা প্রথমেই ব্যাঙ্কের পাশে একটা দরমা দিয়ে ঘেরা চা, বিস্কুটের দোকান খুলল। ওখানে অনেক দরমা আর হোগলা ও টালির ছাউনি দেওয়া চা-খাবারের দোকান ছিল। নতুন একটা দোকান গজিয়ে উঠতে কারও কোনও সন্দেহ হল না। দোকান চালাতে লাগল রণজিৎ, সমরেন্দ্র আর খোকন দাস। সাধারণ গরিব চায়ের দোকানীর মত ওরা চলাফেরা রপ্ত করে ফেলল। ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা একজন দুজন করে ওদের দোকানে চা ও অন্যান্য খাবার খেতে শুরু করল। আর খেয়েই আশ্চর্য হয়ে যেতে লাগল, এত ভাল চা আর খাবার এত সস্তায়?

খদ্দের আর অন্য দোকানে যায় না। যাবে কি, ওরা তো দার্জিলিং চা পাতা কলকাতা থেকে অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনে নিয়ে ‘ যেত। সেই চা ওখানে অন্য দোকানীরা পাবে কেমন করে? আর দামও অন্য দোকানের থেকে কম। সুতরাং ব্যাঙ্কের সমস্ত কর্মচারীই দিন পনেরর মধ্যে ওদের খদ্দের হয়ে গেল। ম্যানেজার থেকে দারোয়ান সবার সাথেই ওদের পরিচয় হল। চা নিয়ে, খাবার নিয়ে ব্যাঙ্কের ভেতরে গিয়ে ওরা পরিবেশন করত। অবাধ গতি, সবার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা, এমন হয়ে গেল যে ওদের ছাড়া ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের চলে না। কোনও একজন যদি “দেশে যাচ্ছি” বলে কলকাতায় দু-এক দিনের জন্য আসত, তাহলেই সবাই বারবার খোঁজ নিত।

দোকান খোলার মাসখানেকের মধ্যেই দারোয়ানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তাদের ওরা বোঝাল, ওই দোকানঘরে রাতে তাদের তিনজনের থাকতে ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে। যদি রাতে অন্তত একজনকে ও ব্যাঙ্কের ভেতর শুতে দেয় তবে ওদের সমস্যাটা কিছুটা কমে। দারোয়ানরা সরল বিশ্বাসে তাদের “ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের” ব্যাঙ্কের ভেতর তাদের পাশে শুতে দিল। প্রথমে একজন, কদিন পরে দুজন ব্যাঙ্কের ভেতর শুতে শুরু করল। এটাই তো ওদের উদ্দেশ্য, ডাকাতির দিন যাতে ঠিক সময় মত ভেতর থেকে নিঃশব্দে খুলে দেওয়া যায়, আর তখন ভেতরে ডাকাতির জন্য ঢুকে পরবে তাদের সাথীরা। দারোয়ানরা যাতে ডাকাতির রাতে কোনরকম সন্দেহ না করতে পারে সেজন্য ওরা প্রতি রাতে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার নামে ব্যাঙ্কের দরজা খুলে বেরিয়ে আবার একটু পরে ঢুকে শুয়ে পড়ত। ওদের ওপর বিশ্বাসের ভিতটা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, ডাকাতি করার উদ্দেশে।

দলের অন্যান্য ছেলেরা দুর্গাপুরেই ভাড়া করা বাড়িতে থাকত। করঙ্গপাড়া, সাগরডাঙ্গা, বেনাচিতি, শ্যারপুর কলোনি ও লিঙ্ক রোডে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল ওরা। কলকাতা থেকে নিয়ে গিয়েছিল অ্যাম্বাসাডর গাড়ি ও লরি। লরি নিয়ে যাতায়াত করত টনি, মানব ও রাজারাম। এরা তিনজনেই দলের বড় গাড়িগুলো চালাত। ছোট গাড়ি চালাত অন্যরা। রাতে ডাকাতির জন্য ছদ্মবেশ নিতে ওরা শিয়ালদার চোরাইবাজার থেকে আর্মির পুরনো ইউনিফর্ম ও জুতো কিনল। ওগুলো পরলে রাতে ওখানে কেউ দেখলে চট্ট করে সন্দেহ করবে না। ভাববে সি. আর. পি বা সেনাবাহিনীর জওয়ান। ঠিক হল, ডাকাতির পর ব্যাঙ্কের সামনে থেকে ওদের তুলে নিয়ে আসবে একটা লরি ও অ্যাম্বাসাডর গাড়ি।

কিন্তু এত টাকা তারা কলকাতায় নিয়ে আসবে কি করে? ডাকাতি করে বেরিয়ে আসার পর জানাজানি হয়ে গেলেই ওয়ারলেসে চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়বে। দুর্গাপুর থেকে পালানর দুটোই মাত্র রাস্তা। একটা জি. টি. রোড, অন্যটা রেলপথ। ব্যাঙ্কের থেকে রেল অনেক দূর, আর ট্রেনে করে অত টাকা তো নিয়েও আসা যাবে না। ওই দুটো পথে পুলিশ গাড়ি ও ট্রেন তল্লাশি শুরু করবে। তাই অনন্তবাবু বুদ্ধি দিলেন বড় লরিটাকে তেলবহনকারী ট্যাঙ্কার তৈরি করতে। ওরা লরিকে ট্যাঙ্কারে পরিণত করল। প্রথম পুলিশ যখন লরিগুলো রাস্তায় থামিয়ে তল্লাশি শুরু করবে, তখন ট্যাঙ্কারে খুব একটা ঝামেলা করবে না কারণ সাধারণভাবে ট্যাঙ্কার নিয়ে কেউ ডাকাতি করে না। আর যদি তল্লাশি করেও তাহলে ট্যাঙ্কারের পর পর তিনটে আলাদা ঢাকনা খুললে পেট্রোলই দেখবে। এমনকি রড জাতীয় কিছু তেলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেখলেও তেলই পাবে। এরকমভাবেই তৈরি হয়েছিল সেই ট্যাঙ্কার।

কিন্তু এতেও বিপদ থেকে যাচ্ছে। তেলের মোটা নলের পাশে লুকনো চেম্বার করা হল, যাতে টাকা রাখা যায়, কিন্তু কোনও লোক যদি দেখে ফেলে ডাকাতি করে এসে ডাকাতরা তেলের ট্যাঙ্কারে টাকা লুকিয়ে রাখছে, তাহলে সমূহ বিপদ। তাই এমন একটা জায়গা বাছতে হবে, যেখানে লোকজন সচরাচর আসে না। ওদের দুটো দল দুর্গাপুরের মধ্যে ও তার চারপাশটা এক সপ্তাহ ধরে তন্নতন্ন করে দেখল। এরা একটা জায়গা নির্দিষ্ট করল যেখানে ডাকাতির টাকাটা ট্যাঙ্কারে লুকিয়ে ফেলা যায়, কাকপক্ষীও টের পাবে না। এ তো গেল একদিক। অন্য দিকটা হচ্ছে, রাতে নিঃশব্দে ভল্টটা খুলবে কি করে? ভল্টের একটা চাবি থাকে ম্যানেজারের কাছে, অন্যটা অ্যাকাউন্টেন্টের কাছে। দুটো চাবি একসাথে না হলে ভল্ট খোলা যাবে না।

দুজন সেই ব্যাঙ্কে নকল নামে অ্যাকাউন্ট খুলল। আস্তে আস্তে ম্যানেজার ও অ্যাকাউন্টেন্টের সাথে পরিচিত হল। বন্ধুত্ব গড়ে তোলার জন্য মাঝে মধ্যেই ব্যাঙ্ক বন্ধ হওয়ার পর হঠাৎ নিজেদের গাড়ি নিয়ে ব্যাঙ্কের সামনে হাজির হয়ে যেত। ম্যানেজার ও অ্যাকাউন্টেন্টকে গাড়িতে তুলে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিত। ম্যানেজারের বাড়ির কাছেই ওদের বেনাচিতির ফ্ল্যাটটা ছিল। একজন দুজন আড্ডা মারতে, ম্যানেজারের স্ত্রীকে এটা সেটা উপহার দিতে ম্যানেজারের বাড়িতে চলে যেত প্রায়ই। সম্পর্কটা পুরো পারিবারিক করে তুলেছিল। ওরা ডাকাতির দিন ওদের গাড়িতে উঠে কোন জায়গায় চলে গেলে কেউ যেন সন্দেহ করার অবকাশ না পায়। ওরা ঠিক করেছিল, ডাকাতির দিন এমনি করেই ব্যাঙ্ক ছুটির পর ম্যানেজার ও অ্যাকাউন্টেন্টকে গাড়িতে তুলে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে যাবে লিঙ্ক রোডের বাড়িতে। বাড়িটা ছিল নির্জন অঞ্চলে, একটা খালের ধারে। ওখানেই ওদের বেশিরভাগ ছেলে থাকত। সারাদিন কাজকর্মের পর তারা বড়বড় চটের বস্তায় শরীরটা ঢুকিয়ে মুখটা বের করে শুয়ে পড়ত। সেই বাড়িতে ওরা দুটো কাঠের খাঁচা তৈরি করেছিল। ম্যানেজার ও অ্যাকাউন্টেন্টকে নিয়ে এসে আলাদা আলাদা ঘরে দুটো খাঁচায় ওদের আটকে রেখে, মুখ বেঁধে, চাবি নিয়ে চলে যাবে, এরকমই ঠিক ছিল। দুজনের বাড়িতে ওদের লোক খবর দিয়ে দেবে যে বাড়িতে ফিরতে রাত হবে, তারা পার্টিতে গেছে। বাড়ির লোকও বিশ্বাস করবে, কারণ সবচেযে বিশ্বাসযোগ্য বন্ধুরাই তো খবরটা দিয়ে গেল। সুতরাং কোথায় গেল ওরা কেউ খোঁজ করবে না।

এদিকে তাদের থেকে দুটো চাবি হাতিয়ে ততক্ষণে ভল্ট খুলে নিয়ে নেবে এক কোটি টাকা অনন্তবাবুর দলের ছেলেরা। ওদের প্রত্যেকের কাছেই ছিল দুটো করে ট্রেনের টিকিট, একটা কলকাতার দিকের, অন্যটা আসানসোলের দিকের। যে ট্রেন আগে পাবে, তাতেই উঠে যেদিকে পারবে চলে যাবে, দুর্গাপুর অঞ্চল থেকে প্রথম সুযোগেই উধাও হতে হবে।

কিন্তু যদি কোনও কারণে তেলের ট্যাঙ্কার ধরা পড়ে যায়, তবে কি হবে? এতদিনের পরিশ্রম পুরোপুরি ব্যর্থ! তাই ওরা ঠিক করল কিছু টাকা সঙ্গে নিয়ে যাবে। কিন্তু কি করে? কারণ স্টেশনে স্টেশনে তল্লাশির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। সুতরাং নিজেদের কাছে টাকা রাখা যাবে না। ঠিক হল, বাচ্চা কোলে বিবাহিতা মহিলারা টাকা নিয়ে যাবে ট্রেনে। বাচ্চা সমেত গিন্নিবান্নিরা ডাকাতি করে ফিরছে এরকম ধারণা পুলিশের দল নিশ্চয়ই করবে না। বাচ্চার দুধের টিনের ভেতব, ভেজা কাঁথা ও তোয়ালের ভেতর টাকা নিয়ে যাবে তারা।

পরিকল্পনা যখন চূড়ান্ত, তখনই ওদের মাথায় বাজ পড়ল। ব্যাঙ্কের দুই দারোয়ানের মধ্যে একজনের অল্পবয়সী স্ত্রী উত্তরপ্রদেশ থেকে এসে হাজির। তাকে নিয়ে দারোয়ান রাতে ব্যাঙ্কের ভেতর থাকে, ফলে বাড়তি দুজনের শোওয়ার জায়গা হল না। অনেক বলে কয়ে অন্য এক দারোয়ানের সাথে একজন শোওয়ার জায়গা পেল। দুজনের বদলে কমে একজন হয়ে গেল। তাও না হয় একরকম, কিন্তু বিপদ বাড়ল অন্য জায়গায়। রাজ্য পুলিশের যে সাত-আটজন রাইফেলধারী সিপাই ওখানে রাতে পাহারার দায়িত্বে থাকত, এতদিন তারা টহল না দিয়ে ব্যাঙ্কের পেছনে একজায়গায় বসে আড্ডা দিত। ওদের পরিকল্পনা ছিল, ডাকাতির সময় ওরা আচমকা অন্ধকারের মধ্যে গিয়ে সিপাইদের ঘিরে ফেলবে। সিপাইরা পাশে রাখা রাইফেল তোলারও সময় পাবে না। সেসময় ওরা রাইফেল তুলে নিয়ে সিপাইদের নিরস্ত্র করে ফেলত। কিন্তু দারোয়ানের স্ত্রী আসার পর অন্য ঝামেলা শুরু হল। ব্যাঙ্কের যে ঘরে দারোয়ান তার স্ত্রীকে নিয়ে থাকত, ওই ঘরের জানালা দিয়ে সিপাইরা উঁকি দিতে লাগল। মাঝেমধ্যেই আড্ডা বাদ দিয়ে ঘুরে ঘুরে টহল দিতে লাগল। তারা টহল দেওয়ার ফলে অনন্তবাবুর ছেলেদের অসুবিধা হল। কারণ একটা জিনিস স্থির হলে তাকে ভাঙা বা ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা করতে যত সুবিধা, একটা চলমান শক্তিকে ভাঙা বা ভেঙে ফেলা খুব কঠিন। ছ সাতজন সিপাই বসে থাকলে স্টেনগান, পিস্তল দিয়ে ঘিরে ফেলে কাবু করা খুব কঠিন নয়, কিন্তু যদি তারা টহল দিতে শুরু করে তাহলে তাদের রূপ গেল সম্পূর্ণ পাল্টে। এবার ওদের কোথায় ধরা বা কিভাবে ধরা হবে? কখন ধরা হবে, কারণ ওরা তো স্থির নয়, এই এখানে আছে, পরক্ষণেই বেশ খানিকটা দূরে চলে যাচ্ছে, রাইফেলও থাকছে হাতে। অংক কষে যারা যুদ্ধ করে তাদের কাছে এমন শত্রু আকাঙ্ক্ষিত নয়। তাই ওরা রাতের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে এবার দিনে ডাকাতির ছক করল। চায়ের দোকান যেমন চলছে, তেমনই চলতে লাগল।

ব্যাঙ্কে মাসের প্রথম দু-একদিনই বেশি টাকা থাকত। তারপর সেই টাকা বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে চলে যেত। সুতরাং ডাকাতি করতে হলে ওই দুদিনের মধ্যেই করতে হবে। না পারলে ফের একমাস বসে থাকতে হবে। দিনে ডাকাতিটা কখন হবে? ঠিক হল, ব্যাঙ্ক বন্ধের সময় যখন ম্যানেজার ও অ্যাকাউন্টেন্ট সমস্ত হিসেব-নিকেশ চুকিয়ে ভল্ট খুলে টাকা পয়সা ঢুকিয়ে রাখেন, তখন ডাকাতিটা করতে হবে। তাহলে আর ভল্ট খোলার ঝামেলা নিজেদের নিতে হবে না। ভল্টটা কখন খোলা-বন্ধ হচ্ছে তা জানার জন্য তো চায়ের দোকানের তিনজন নিজেদের ছেলে আছেই। যারা অবাধে ব্যাঙ্কের ভেতর ঢুকছে আর বের হচ্ছে।

দিনে ডাকাতি করার জন্য ওদের প্রয়োজন হল নিজেদের গাড়ি ছাড়াও একটা লরি আর একটা অ্যাম্বাসাডর। লরি যোগাড় করার দায়িত্ব পড়ল বিমল, টনি ও মানবের ওপর। এক লরির ড্রাইভারকে ধরল তারা, তাকে বলল, “তোমার গাড়ি রোজ ভাড়া নেওয়া হবে, যদি একটু সস্তায় দাও।” ড্রাইভার দেখল, প্রতিদিনের ভাড়া যদি এক জায়গায় থেকে পাওয়া যায় তাহলে খুবই সুবিধা। সে রাজি হতে টনি আর মানব ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে তার লরি চালিয়ে দেখে নিল ঠিক আছে কিনা। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে ওই লরিতে নিজেদের হাতটা অভ্যস্ত করে নেওয়া। এর পর একদিন ড্রাইভারকে বলল, “চল, – আমাদের স্টিল প্ল্যান্টের অফিসারের সাথে কথা বলে আসবে।” টনি আর মানব লরি নিয়ে স্টিল প্ল্যান্টের বিরাট বিল্ডিংটার সামনে সময়মত হাজির। স্যুটেড বুটেড বিমল আগে থেকেই ওই বিল্ডিংয়ের চারতলায় উঠে গিয়েছিল। সে নিচে লরির আগমন দেখেই লিফটে নেমে এসে টনিদের জিজ্ঞেস করল, “কোথায় লরি?” টনিরা গাড়িটা দেখিয়ে দিল। অফিসার বিমল গম্ভীর স্বরে জানতে চাইল, “গাড়ি ঠিক আছে তো? না কি যখন তখন বসে যাবে?” ড্রাইভার খুবই কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “না স্যার, আমার গাড়ি কোনরকম অসুবিধে করবে না।” বিমল টনিদের দেখিয়ে ড্রাইভারকে বলল, “ঠিক আছে, ওদের সঙ্গে কথা বলে নিও। কবে থেকে তোমার গাড়ি নেওয়া হবে, ওরা জানিয়ে দেবে।” বিমল হাতে রাখা একটা ফাইল খুলে ড্রাইভারের নাম, ঠিকানা, গাড়ির নম্বর লিখে নিল। লরির ব্লু বুক ড্রাইভারের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখে নিল। এগুলো সবই করল লোকটার বিশ্বাস অর্জনের জন্য। তারপর ড্রাইভারকে বলল, “ঠিক আছে এখন যাও, ওরা খবর দেবে।” ড্রাইভার বিমলকে একটা লম্বা সেলাম ঠুকে চলে গেল।

অ্যাম্বাসাডর গাড়িটা যোগাড় করার দায়িত্ব ছিল রাজারামের ওপর। রাজারাম একদিন একটা প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া নিল। অল্পবয়সী ড্রাইভারকে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াল, তার সঙ্গে গল্পগুজব করতে লাগল, তারপর সন্ধের মুখে গাড়ির ভাড়া ছাড়াও কুড়ি টাকা বখশিস দিয়ে আবার পরের দিন তৈরি থাকতে বলল। রাজারাম সকালে গ্যারেজে হাজির, ড্রাইভারকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ দুর্গাপুরের এ অফিস ও অফিস অকারণে ঘুরে বেড়াল। তারপর হঠাৎ ড্রাইভারকে বলল, “তুমি পাশে বস, আমার হাতটা কেমন দেখ তো।” রাজারাম নিজে গাড়ি চালাতে লাগল। আসলে রাজারাম বোঝাতে চাইছিল ড্রাইভারকে, তার হাত রীতিমত পাকা। এইভাবে দুচারদিন চলার পর ড্রাইভারকে একদিন বলল, “তুমি গাড়িতে থাকলে আমার ব্যবসার অসুবিধে হচ্ছে।” ড্রাইভার একটু অবাক, “কেন স্যার?” রাজারাম বোঝাল, “অফিসাররা গাড়িতে একে ওকে তুলে ফূর্তি করতে যাবে, তুমি থাকলে ওদের অসুবিধে হবে।” ড্রাইভার বলল, “ঠিক আছে, কাল থেকে আমাকে কোথাও নামিয়ে আপনি গাড়ি নিয়ে চলে যাবেন। আপনি যখন যেখানে থাকতে বলবেন, আমি সেখানেই সময়মত থাকব।”

এই তো চাই। পরদিন থেকে রাজারাম যখন খুশি গাড়ি নিয়ে চলে যেত, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে সময়মত ফিরে এসে গাড়ি ড্রাইভারের হাতে দিয়ে দিত। ভাড়া ও বখশিস হাতে নিয়ে সে নিশ্চিন্তে চলে যেত গ্যারেজে। কিছুদিনের মধ্যেই রাজারাম তার বিশ্বাসযোগ্যতা এমন স্তরে নিয়ে গিয়েছিল যে ড্রাইভারকে গ্যারেজ থেকে আর গাড়ি বেরও করতে হত না। মালিকই রাজারামকে চাবি দিয়ে দিত। রাজারাম নিজেই গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে নিয়ে যেত। কোথায় যেত, সারাদিন গাড়ি নিয়ে সে কি করত কোনওদিন কেউ তাকে প্রশ্নই করেনি। রাজারাম কিন্তু লুকিয়ে ড্রাইভারকে আলাদা বখশিস দিত, যাতে ড্রাইভার তার বিরুদ্ধে মালিককে কখনও খারাপ কিছু না বলে। সে তো জানে গাড়িতে রাজারাম অফিসারদের ফূর্তি করাতে নিয়ে যাচ্ছে। সেটা শুনে মালিক আর গাড়ি নাও ছাড়তে পারে। তাহলেই ঝামেলা। আর গ্যারেজটাও ছিল সুবিধেমত জায়গায়, দুর্গাপুর স্টেশনের কাছে। পরিকল্পনা ছিল, ডাকাতির পর ওরা চার-পাঁচ জন ওই গাড়ি নিয়ে সোজা গ্যারেজে এসে গাড়ি জমা দিয়ে চলে যাবে স্টেশনে, তারপর ট্রেন ধরে উধাও। গ্যারেজ থেকে ব্যাঙ্কের দূরত্ব অনেক, ওরা পৌঁছনর আগে কিছুতেই ডাকাতির খবর সেখানে পৌঁছনর সুযোগ ছিল না।

দুটো গাড়ি ওরা না কিনে, ছিনতাই না করে সুকৌশলে যোগাড় করে ফেলল। এবার অন্য দিক। দিনে ডাকাতি করতে হলে ব্যাঙ্কের কাছেই টামলা ব্রিজ বন্ধ করে দিতে হবে, যাতে আসানসোলের দিক থেকে কোনও লরি বা গাড়ি এসে ওদের পালিয়ে যাওয়ার পথ আটকে না দিতে পারে। পেছন পেছন তাড়া করা বা পুলিশ আসার আশঙ্কাও কমে যায় তাহলে। সেজন্য ওরা ঠিক করল, ডাকাতি শুরু করার মুহূর্তেই টামলা ব্রিজের মুখে একটা বড় গ্যাস বম্ব ফাটাবে। বোমা থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে সরু ব্রিজটা সম্পূর্ণ অন্ধকার করে দেবে, বড় জ্বলন্ত বোমা দেখে কেউ সাহসও করবে না সামনে যাওয়ার। ওদিকে আসানসোলের দিক থেকে গাড়ির পর গাড়ি এসে রাস্তায় জট পাকিয়ে ফেলবে, কেউ আর চট করে ব্রিজ পার হয়ে কলকাতার দিকে যেতে পারবে না। বোমা থেকে ঘণ্টাখানেক ধোঁয়া বেরবে। ততক্ষণে ওরা ডাকাতি সেরে, দুর্গাপুর ছেড়ে বহু দূরে চলে গিয়েছে।

ওরা ডাকাতি করে জি. টি. রোড ধরে পুবদিকে অর্থাৎ কলকাতার দিকে আসবে, ঠিক ছিল। ব্যাঙ্ক অঞ্চলে জি. টি. রোড থেকে ঢুকতে কিংবা বেরতে দুটো সিমেন্টের কালভার্ট পড়ে। দুটোই জি. টি. রোডের ধারে, শুকনো কিন্তু বেশ চওড়া নর্দমার ওপর। একটা পুব দিকে, অন্যটা টামলা ব্রিজের কাছে পশ্চিম দিকে। ওরা ঠিক করল, ডাকাতির শুরুতেই পশ্চিম দিকের কালভাটটা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবে। ডাকাতি করে ফেরার সময় শেষ অ্যাম্বাসাডর গাড়িটা পুবদিকের কালভাটটা উড়িয়ে দিয়ে চলে আসবে, যাতে ওদের পেছনে রাজ্য পুলিশের রিজার্ভ ফোর্স ড্যান বা লরি নিয়ে তাড়া করতে না পারে। কালভার্ট উড়িয়ে দিলে পুলিশ আর ওই অঞ্চল থেকে গাড়ি নিয়ে বেরতেই পারবে না।

ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে জি. টি. রোড ধরে গাড়িতে কলকাতার দিকে এলেই মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গান্ধী মোড়ের কাছে ফরিদপুর পুলিশ ফাঁড়ি। ফাঁড়িতে সবসময় রাইফেলধারী দশ-পনের জন সিপাই ও অফিসার থাকে। ডাকাতি করে ওই ফাঁড়ির সামনে দিয়ে জি. টি. রোড ধরে আসতে, হবে, অন্য কোনও রাস্তা নেই। ততক্ষণে ব্যাঙ্ক থেকে টেলিফোনে ফাঁড়িতে পৌঁছে যাবেই খবর। তাহলে কি উপায়? ফরিদপুর ফাঁড়ির সিপাইদের বেরতেই দেওয়া চলবে না। তাই ওরা ঠিক করল, ফাঁড়ির উল্টো দিকে যে জঙ্গল মত জায়গা আছে, সেখানে গাদাকামান বসিয়ে রাখবে। সিপাইরা রাস্তায় বেরনর চেষ্টা করলেই উল্টোদিকের জঙ্গলের থেকে গাদাকামান গর্জে উঠবে আর তার ঝাঁকঝাঁক স্পিংটারে ধরাশায়ী হয়ে যাবে সিপাইরা। গাদা কামান ওরা নিজেরাই বানাত, লোহার দু-আড়াই ইঞ্চি মোটা পাইপের মধ্যে গান পাউডার ও জালের কাঠি ভরে। ফাটাত ব্যাটারি চার্জ করে ডেটনেটর দিয়ে।

দিনে ডাকাতির পরিকল্পনা যখন পাকা, তখন হঠাৎ ব্যাঙ্কে এল মহাত্মা গান্ধীর ছবি ছাপা একশ টাকার নতুন নোট। তখনও সেটা বাজারে চালু হয়নি। ওরা ঠিক করেছিল শুধুমাত্র একশ টাকার নোট নিয়ে যাবে, ছোট নোট নেবে না। কিন্তু এবার সমস্যা হল, এক কোটি টাকার নতুন একশ টাকার নোট ডাকাতি হয়ে গেলে সরকার থেকে ওই টাকা বাতিল করতে পারে। তখন এক কোটি টাকার অনেক মূল্য ছিল আর বাতিল ঘোষণা করার সুবিধা ছিল, কারণ গান্ধীজীর ফটো সমেত নোট তখনও চালু করা হয়নি। সুতরাং ডাকাতির দিন পিছিয়ে গেল কিছুদিনের জন্য।

একমাস পর সেই দিনটা এল। সকাল পর্যন্ত সব ঠিকঠাক, হঠাৎ সি. পি. আই পার্টি থেকে পোস্ট অফিস ঘেরাও করে বসল বিকেল চারটে নাগাদ। ব্যাঙ্কের পেছনেই পোস্ট অফিস, ওখানে প্রচণ্ড ভিড় জমে গেল। ব্যাঙ্কের চারপাশে তো লোক গিজগিজ করতে লাগলই, এমন কি সামনের ও পেছনের রাস্তাও লোকে লোকারণ্য। ডাকাতি করার কোন সুযোগই রইল না। আবার পিছিয়ে গেল অপারেশন।

একমাস পর ফের নির্দিষ্ট দিনে ওরা তৈরি হয়ে নিল। ব্যাঙ্কে চলে এসেছে টাকা। হঠাৎ দুপুরবেলা দেখা গেল ওদের ট্যাঙ্কারের সেল্ফ স্টার্টার খারাপ হয়ে গিয়েছে, গাড়ি ঠেলা ছাড়া স্টার্ট নিচ্ছে না। সেটা ঠিক করে ব্যাঙ্কে ঢুকতে ঢুকতে ম্যানেজার ভল্ট বন্ধ করে চাবি নিয়ে চলে যাবে। সুতরাং সেদিনও হল না। অপেক্ষা আরও একমাস। না, সেদিনও হল না। সেদিন ছোট লরিটা, যেটা ওদের গার্ড দিয়ে নিয়ে আসার কথা ছিল, তার ব্যাটারি একেবারে ডাউন। তখন দুপুরবেলা, দুর্গাপুরে এমন কোনও ব্যাটারির দোকান পাওয়া গেল না, যেখান সাথে সাথে চার্জ দিয়ে দেবে, এমনকি কোথাও ব্যাটারি ভাড়াও পাওয়া গেল না।

এবার ঠিক হল, আর একমাস অপেক্ষা নয, পরদিনই ডাকাতি করা হবে। কোটি টাকা পুরো না পাওয়া গেলেও কাছাকাছি তো থাকবে। যথারীতি রাত শেষ হওয়ার আগেই টামলা ব্রিজের কাছে কালভার্টের নিচে দুটো ডিনামাইট বসিয়ে দেওয়া হল। ডাকাতি শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ডিনামাইটের ডেটনেটরের তার ব্যাটারির সঙ্গে লাগিয়ে কালভার্ট উড়িয়ে দেবে। আর ওই অন্ধকারের মধ্যেই ফরিদপুর ফাঁড়ির উল্টো দিকে ফাঁড়ির দিকে মুখ করে কয়েকটা গাদা কামান জঙ্গলে বসিয়ে দিয়ে এল। আসলে ওরা ডাকাতির দিন ভোর হবার আগেই ডিনামাইট আর গাদাকামান লাগাত। ডাকাতি না হলে আবার রাতে গিয়ে সেগুলো তুলে নিয়ে আসত। সেদিনও তাই করেছিল। কিন্তু ভোরবেলা সি. আর. পি.র এক সিপাই কৌটোয় জল নিয়ে প্রাকৃতিক কাজ সারতে গেল ওই কালভার্টের তলায়। সাধারণত ওখানে ওই কাজে কেউ যায় না। সে দেখে কালভার্টের তলায় নতুন ইলেকট্রিক তার ঝুলছে। তার ধরে এগিয়ে গিয়ে দেখে ডিনামাইট। ডিনামাইট দুটো খুলে সাথে সাথে ছুটল অফিসে খবর দিতে। বড় বড় অফিসাররা হাজির সাতসকালে। কে লাগাল ওখানে ডিনামাইট? কি মতলব? চারদিকের কালভার্টের তলায় খোঁজা শুরু হল। পুব দিকের কালভার্টের নিচে ওরা ডিনামাইট বসাত না কারণ ওই কালভার্টের মাঝখানে একটা তিন ইঞ্চি মোটা গর্ত ছিল। ওরা ঠিক করেছিল ফেরার পথে শেলের ভেতর ডিনামাইট দিয়ে গর্তে ঢুকিয়ে ওই কালভার্ট উড়িয়ে দেবে।

অন্য কালভার্টের তলায় কিছু না পাওয়া গেলেও, ফরিদপুর ফাঁড়ির উল্টোদিকের জঙ্গল থেকে গাদা কামানগুলো পুলিশ পেল। কিন্তু কারা ওগুলো বসিয়েছে, সেব্যাপারে পুলিশের ধারণা পরিষ্কার হল না। পুলিশের ধারণা হয়েছিল, দিনকয়েক আগে দুর্গাপুর রিজিওন্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে ফরিদপুর ফাঁড়ির পুলিশের যে গণ্ডগোল হয়েছিল, তারই জেরে ওই সব বসিয়েছে কোনও ছাত্রগোষ্ঠী। ওখানকার পুলিশ অফিসাররা একবার ভেবেও দেখল না, সাধারণ ঘরের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসা ছেলেরা ডিনামাইট, ডেটনেটর কোথায় পাবে? কি উদ্দেশ্যেই বা ওরা একটা গুরুত্বহীন কালভার্টের তলায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তা বসাতে যাবে? কি উদ্দেশ্যেই বা একটা কালভার্ট তারা উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করবে? বুদ্ধিমান অফিসাররা কিন্তু তাদের কথা চিন্তা না করে অন্য চিন্তা করত এবং দুর্গাপুর থেকে আসা-যাওয়ার রাস্তায় প্রচণ্ড নজর রাখত। তাতে কিছু কাজ হলেও হতে পারত।

পুলিশ ডিনামাইট খুঁজে পাওয়ার আধঘণ্টার মধ্যে অনন্তবাবুর দলের ছেলেদের কাছে খবর পৌঁছে গেল। এবার ওরা ঠিক করল আর নয়। দুর্গাপুর স্টেট ব্যাঙ্কে ডাকাতির পুরো পরিকল্পনাই বাতিল করে গাড়ি, লরি, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছেলেরা ফিরে এল কলকাতায়। চায়ের দোকান বন্ধ হয়ে গেল। ছ-ছবার ওরা ডাকাতির দিন নির্দিষ্ট করে ব্যর্থ হল। দুর্গাপুরের ওই স্টেট ব্যাঙ্ক ডাকাতি সত্যিই হলে আমাদের দেশে ডাকাতির ইতিহাসে একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত। এখনও পর্যন্ত অত বড় ডাকাতি আর হয়নি। কলকাতায় যখন ফিরল, তখন ওদের তহবিলের সব টাকা শেষ। মাসের পর মাস দুর্গাপুরে কুড়ি-পঁচিশজন ছেলের থাকা-খাওয়া, বাড়ি ভাড়া, গাড়ি ভাড়া, আর ডাকাতির পরিকল্পনায় হাত একেবারে শূন্য। কি করা যায়?

ওরা দুর্গাপুর থেকে ফিরে এসেই সপ্তাহখানেকের মধ্যে নিউ আলিপুরের ন্যাশনাল এন্ড গ্রিন্ডলেজ ব্যাঙ্কে দ্বিতীয়বার ডাকাতি করল। ওরা দেখল ওই ব্যাঙ্কের পুরো ব্যাপারটাই ওদের জানা, নতুন করে আর ব্লু প্রিন্ট করতে হবে না। যেন নিজেদের বাড়ির আলমারিতে টাকা রাখা আছে। গিয়ে নিয়ে এলেই হল। ঠিক তাই-ই করল।

গেল, কাউন্টার থেকে লক্ষাধিক টাকা তুলল, পালিয়ে গেল। এই টাকা থেকে ওরা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের পুরনো স্টাফ কার ডজ ভ্যান কিনল। কিছু অস্ত্রও কিনল। তার মধ্যে ছিল একটা কারবাইন স্টেন মেশিন গান। ওরা শেষ ডাকাতির পরিকল্পনা করল রাসেল স্ট্রিটের স্টেট ব্যাঙ্কে। ব্রিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ড, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাঠ, চিড়িয়াখানায় ওরা ডাকাতির রিহার্সাল দিতে শুরু করল। কোথা দিয়ে পালাবে, কখন কিভাবে কে ডাকাতির সময় কি কি কাজ করবে তার পুরো রিহার্সাল দিয়ে উনসত্তর সালের বারই ডিসেম্বর টেস্ট ম্যাচ শুরুর দিন ঠিক সকাল দশটায় ওরা ডাকাতি করে চলে গেল।

ওদের ছড়িয়ে যাওয়া ঘোষণাপত্র ও ক্যাসেট থেকে প্রথম জানতে পারলাম কালো অ্যাম্বাসাডর গাড়ির ডাকাতদল আসলে একটা রাজনৈতিক দল। অন্য একটা চিন্তাও অবশ্য কাজ করছিল মাথায়, হয়ত আমাদের বিপথে চালিত করার জন্য এটা ডাকাতদের কোনও কৌশল। তবু আমরা রাজনৈতিক দলের অনুসন্ধানেই প্রথমে নামলাম। তখন আমাদের হাতে আছে মিঃ রায় প্রেসিডেন্সি জেলে। আর তাঁরই সূত্র ধরে এবার আমাদের অভিযান। একজনের পর একজন গ্রেফতার হতে লাগল। ওদের দল ছত্রখান হয়ে গেলেও দলের বহু সদস্য তখনও বাইরে। তাদের ধরা যায় কি করে? ইতিমধ্যে বিহারে নকশাল আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার জন্য ধরা পড়েছিল দীপক, কাজল ও হারু। তাদের নিয়ে আসা হল কলকাতায়।

ওদের ধরাটা অত সহজ ছিল না। অনন্তবাবুর দলের ছেলেদের রণকৌশল ছিল দুরন্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত। অনন্তবাবুর ওপর আমরা পার্ক স্ট্রিট পোস্ট অফিসে ডাকাতির পরই নজর রাখতে শুরু করেছিলাম। ওই ডাকাতির ঢঙ দেখেই দেবীবাবু অনুমান করেছিলেন, এত নিপুণ পরিকল্পিত অপারেশনের পেছনের মাথাটা অনন্তবাবুর ছাড়া আর কারও নয়। তাঁর মত ডাকাতির বুদ্ধি শুধু কলকাতায় কেন, ভারতবর্ষে বোধহয় আর কারও ছিল না। যদিও পার্ক স্ট্রিট পোস্ট অফিসে ডাকাতির দিন তিনি মুম্বাই ছিলেন, জানতাম এটাও পরিকল্পিত। কারণ তিনি জানতেন ডাকাতির ধাঁচ দেখেই লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগ তাঁকে সন্দেহ করবে। তাই তিনি নিজেকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য চিকিৎসার অজুহাতে মুম্বাই গিয়ে বসে ছিলেন।

তিনি ফিরে আসার পর থেকে তাঁর ওপর আমরা নজর রাখলাম ঠিকই, কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। পারব কি করে? তাঁর গাড়ি এত ধীরে ধীরে চলত যে। অত ধীরে পেছন পেছন আমাদের গাড়ি গেলেই বোঝা যেত যে পেছন থেকে একটা গাড়ি তাঁর গতিবিধির ওপর নজর রাখছে। ইচ্ছে করেই তিনি ড্রাইভারকে ওভাবে চালাতে নির্দেশ দিতেন, যাতে বুঝতে পারেন পেছনে কেউ তাঁকে সত্যিই নজর রাখছে কিনা। এমনিতে তাঁর চোখে হাই পাওয়ারের চশমা ছিল। কিন্তু কেউ তাঁকে নজর করলেই সেটা ঠিক বুঝে ফেলতেন

দুএকবার তিনি আমাদের ফাঁদে ফেলারও চেষ্টা করেছেন। যেমন হঠাৎ করে গাড়ি থেকে নেমে কোনও পরিচিত লোককে একটা প্যাকেট দিয়ে দিলেন, যাতে পরে আমরা গিয়ে সেই লোকটাকে ধরি এবং প্যাকেট খুলে দেখি তাতে কি আছে। ওইসব প্যাকেটে যে তিনি কোনও বেআইনী জিনিস দেবেন না, সেবিষয়ে আমরা নিশ্চিত ছিলাম, তাই তাঁর ফাঁদে পা দিইনি। গোপন, ষড়যন্ত্রমূলক সংগঠন চালাতে তাঁর ধারে কাছে আর কারোকে দেখিনি। তিনি তাঁর দলের সদস্যদেরও সেইভাবে চলাফেরা করতে শিখিয়েছিলেন। তখন দলের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আর অনন্তবাবু ও তাঁর ডানহাত গোরা আমাদের কাছে। বাকিরা কি আরও বেশি সতর্ক হয়ে চলবে না?

আগে ওদের বেশিরভাগ গোপন আস্তানা আর যোগাযোগ ছিল দক্ষিণ কলকাতা আর ওদিকের শহরতলিতে। দলের বেশ কিছু সদস্য গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার পর ওরা সেটা পাল্টে উত্তর কলকাতা ও তার শহরতলিতে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আমাদের কাছে যা যা খবর ছিল তার আর মূল্য রইল না। সত্তর সালের মার্চ মাসে একদিন ওরা ইডেন গার্ডেন্সের কাছ থেকে একটা নৌকো ভাড়া করে হুগলি নদীর ওপর দিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেন পর্যন্ত গেল, ফের ফিরে এল। নৌকোয় বসে ওরা একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সেরে নিল, এবং তারই ফলস্বরূপ তারা চলে যায় দুর্গাপুরে। দুর্গাপুরে তারা দিন পনের ছিল, কিন্তু যে উদ্দেশে সেখানে যাওয়া তার কিছুই সম্ভব হয়নি। আসলে উদ্দেশ্য ছিল কিছু ঘটনা ঘটান।

দুর্গাপুরে সুবিধে করতে না পেরে, সেখানকার মানুষের কোনও সাহায্য না পেয়ে তারা ফিরে আসে কলকাতায়। অনন্তবাবুর গ্রেফতারের পর দল পরিচালনা করত কল্যাণ রায়। কিন্তু তার ততখানি ক্ষমতা ছিল না যে অতগুলো রাজনীতি সচেতন ছেলেকে সঠিকপথে চালনা করে দলকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কলকাতায় ফিরে কল্যাণ রায় সদস্যদের বলল, বিহারে জঙ্গল এলাকায় চলে যেতে হবে। সেখানে আদিবাসী মানুষদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তাঞ্চল গড়তে হবে। তার নির্দেশ অনুযায়ী দলের সদস্যরা আরও নতুন নতুন ছেলেদের দলে টেনে নিল।

মে মাসের প্রথম দিকে চেতলার এক গ্যারেজ থেকে ওরা একটা বাস কিনল। মে মাসেই আমাদের কাছে খবর এল, অমলেন্দু সেনের ব্রিটিশ নাগরিক স্ত্রী মেরি টেলার কলকাতায় আসছে। আমরা মেরির একটা ফটো যেযাগাড় করে ফেললাম। খবর অনুযায়ী হাওড়া স্টেশনে আমি আর লাহিড়ী মেরির ওপর নজরদারী করতে গেলাম। স্টেশনে দেখলাম অমলেন্দুর এক ভাই এসেছে, সে মেরিকে নিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে কফি হাউসে কফি খেতে গেল। আমরাও ঢুকলাম। আমরা ভেবেছিলাম ওরা ট্যাক্সি নিয়ে অমলেন্দুর বাড়িতে যাবে। কিন্তু ট্যাক্সিতে না গিয়ে তারা বাসে উঠল, আমরাও আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বাসে উঠলাম। ওরা বেহালায় নামল, আমরাও নামলাম। এভাবে ওদের ওপর নজর করতে করতে অমলেন্দুর বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া হল। তিনদিন ওখানে মেরি ছিল। তিনদিনই আমাদের নজরদাররা দিন রাত ওখানে পাহারায় ছিল, যদি মেরির যোগসূত্র ধরে অমলেন্দুকে পাওয়া যায়। চারদিনের মাথায় মেরিকে অমলেন্দুর ভাই জামশেদপুর যাওয়ার টিকিট কেটে হাওড়া স্টেশনে ট্রেনে তুলে দিয়ে গেল। আমরা সেই টিকিটের নম্বর ও ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট বিহার পুলিশকে জানিয়ে দিলাম, যাতে তারা মেরির ওপর নজর রাখে। এর চার পাঁচ দিনের মাথায় তিরিশে মে খবর পেলাম, জামশেদপুরের কাছে যদুগোড়ায় রুয়ামের পাহাড়ী জঙ্গলে সি. আর. পি.র হাতে ধরা পড়েছে কল্যাণ রায়, অমলেন্দু, মেরি সমেত বাহান্ন জন। অর্থাৎ অনন্তবাবুর আর. সি. সি. আই. দলের পুরনো ও নতুন সমস্ত সদস্য।

এই যদুগোড়ায় একসঙ্গে ধরা পড়াটা আমার মনে হয়েছে পরিকল্পিত আত্মসমর্পণ। কল্যাণ রায় যখন আর দল পরিচালনা করতে পারছিল না, আমাদের নাগপাশ ছাড়িয়ে আত্মগোপন করে থাকাও সম্ভব ছিল না, অথচ জনগণের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে ছুটে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছিল তারা, তখনই চূড়ান্ত অ্যাডভেঞ্চারের রাস্তায় চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। নয়ত বাসে সব সদস্যদের নিয়ে জঙ্গলে ঢোকার আগে ঘাটশিলার মৌভাণ্ডারে কেন থানা আক্রমণ করে পুলিশকে জানান হল তারা কোথায় যাচ্ছে? বিহার পুলিশ ও সি. আর. পি. থানা আক্রমণকারীদের পেছন পেছন ধাওয়া করে গিয়ে রুয়াম জঙ্গল ঘিরে তাদের এক এক করে গ্রেফতার করল। গুলি বিনিময় অবশ্য কিছু হয়েছিল। কিন্তু তাতে কেউ হতাহত হয়নি। কল্যাণ রায় কি জানত না, সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন কতগুলো অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে নিয়ে জঙ্গলে আত্মগোপন করে থাকলেই বিপ্লব হয় না? আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস, তিনি জানতেন, তবু তার কিছুই করার ছিল না। একটা বাসে করে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকে তিনি কি করতে চেয়েছিলেন, আর একটা জালালাবাদ?

আত্মসমর্পণ হোক আর যাই হোক, একসঙ্গে সবাই ধরা পড়াতে আমাদের সুবিধেই হল। ওদের কাছ থেকে পাওয়া গিযেছিল স্টেনগান, কারবাইন, রিভলবার, বন্দুক ও প্রচুর গোলাবারুদ। আর ছিল স্টেট ব্যাঙ্ক ডাকাতির ষাট হাজার টাকা।

আমরা আগস্ট মাসে বিহার পুলিশের কাছ থেকে মামলার জন্য নিয়ে এলাম সতের জনকে। বাকিদের সঙ্গে কলকাতার মামলার কোন সম্পর্ক নেই। তারা হাজারীবাগ সেন্ট্রাল জেলে রয়ে গেল। আমরা নিয়ে এলাম, কল্যাণ রায়, অমল, অমলেন্দু, গৌরীশংকর, টনি, কল্পনাকে। টনিকে আমরা দ্বিতীয় রাজসাক্ষী বানালাম। এই দলে টনি আর অনিল দত্ত ছাড়া প্রত্যেকেই একনিষ্ঠ ও সৎ ছিল। টনি আর অনিলের চারিত্রিক দোষ ছিল। আমরা সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তাদের রাজসাক্ষী বানিয়ে দিলাম। আবার উল্টোদিকে রাজারামকে দেখেছি স্টেট ব্যাঙ্ক ডাকাতির পর গাড়ি নিয়ে পালানর সময় ওর সাথে যে দেড় লক্ষ টাকা চলে এসেছিল, তা অবলীলায় দলকে ফেরত দিয়ে দিতে। সেই টাকা সে নিয়েও নিতে পারত। কিন্তু তার থেকে এক পয়সাও সে খরচ করেনি, অথচ তার বাড়ির আর্থিক অবস্থা কিন্তু মোটেই ভাল ছিল না। এমনই সৎ ছিল ওই দলের প্রায় প্রতিটা ছেলে। অনন্তবাবুর এই দলটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল পেশাদারি বিপ্লবী হবার চেষ্টা প্রতিটি ছেলেমেয়ে মধ্যে। তাই ওদের সব কাজ ও ডাকাতির পরিকল্পনাগুলো ছিল একেবারে নিখুঁত। পরবর্তীকালে আমরা বহু ডাকাতির রহস্যের সমাধান করেছি, ডাকাত ধরেছি, কিন্তু সেইসব ছক অনন্তবাবুর দলের কাছে কিছুই না।

এক এক করে আদালতের মধ্যে সব মামলাগুলো গেঁথে ওদের বিচারের জন্য গঠিত হল আলিপুর চতুর্থ ট্রাইবুনাল কোর্ট। বিচার শুরু হল। বিচার চলাকালীন একাত্তর সালের মাঝামাঝি প্রেসিডেন্সি জেল থেকে ন্যাশনাল লাইব্রেরির দিকের পাঁচিল টপকে পালিয়ে গেল খোকন ভট্টাচার্য, বাবুল, সমরেন্দ্র, স্বপন, খোকন দাস সমেত মোট আটজন নকশাল বন্দী। আমরা সবাইকে বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার করতে পারলেও খোকন ভট্টাচার্যকে আর পাওয়া যায়নি। শুনেছি, বেহালার ঠাকুরপুকুর অঞ্চলে চোংগার বনে নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সে ছিল এবং সেখানেই এক রাতে সি. আর. পি.র গুলিতে মারা যায়। ওদের দলের আরও একজন মারা যায় একাত্তরের নভেম্বরে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। অমিয় (সাগর) চ্যাটার্জি, এক সময় বেহালা মিউনিসিপ্যালিটির সি. পি. আই (এম) কমিশনার ছিল। লম্বা চওড়া, সুদর্শন অমিয় সি. পি. আই (এম) ছেড়ে নকশাল হয়েছিল। অনন্তবাবুর দলের সক্রিয় সদস্য ছিল সে। তাকে ও অন্য আরও সাতজন নকশালকে একই দিনে জেলে স্রেফ ডাণ্ডা দিয়ে পিটিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় মেরে ফেলা হয়েছিল বলে আমাদের কাছে খবর এসেছিল। অথচ জেল কর্তৃপক্ষ প্রচার করেছিল তারা নাকি জেল ভেঙে পালাতে চেষ্টা করেছিল, তাই মারা হয়েছে। আমাদের কাছে আরও খবর এসেছিল, জেল ভাঙার ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য জেল প্রাচীরের ভেতর লোহার ফেন্সিং এক জায়গায় নিজেরাই খুলে রেখেছিল জেলকর্মীরা। যদি পালানরই চেষ্টা করে থাকত, তবে নিশ্চয়ই ওরা জেলের পাহারাদারদের ওপর চড়াও হত, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আহত হত। সাহায্যের জন্য বাইরে থেকে অন্য নকশালরা বোমা গুলি দিয়ে আক্রমণ করত। তেমন কিছুই কিন্তু হয়নি। জেল থেকে পালনোর চেষ্টা করলে জেলরক্ষীরা ওদের রাইফেল থেকে গুলি চালাত। এমন প্রমাণও মেলেনি। যদি জেল কর্তৃপক্ষের বলা গল্প সত্যি হত, তাহলে কোথায় সেই পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট? নিশ্চয়ই পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে বলা থাকবে ওরা গুলিতে মারা গেছে। না, তেমন কিছু হয়নি। অবশ্য মমিনপুর মর্গে ইচ্ছেমত পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট লেখান যেত। মৃতদেহগুলি ওখানে মাতাল ডোমরা কাটাছেঁড়া ও সেলাই করে। ডাক্তার দূর থেকে মাঝেমাঝে তাকিয়ে দেখে। তারপর মৃতদেহের আত্মীয়স্বজনের সাথে বন্দোবস্তে পোষালে তেমনভাবে রিপোর্ট লিখে দিত। অন্যদিকে পুলিশের ইচ্ছা অনুযায়ী রিপোর্ট তো হতই।

একজন ডাক্তারকে দেখেছি, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট লেখার বিস্তারিত বিবরণী লেখা বই বগলের তলায় নিয়ে ঘুরতেন। দরদস্তুর পাকা হলে বই খুলে ফর্ম ভর্তি করে ছেড়ে দিতেন। এই রকম এক ডাক্তারকে বরখাস্ত হতে দেখেছি সুতরাং আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের নিহত বন্দীদের পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে যা লেখা হয়েছে, তা নিতান্তই মূল্যহীন। যারা ওই ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে দেখিনি কোনও ব্যবস্থা নিতে, বা কেউ তাদের দিকে আঙুল তুলে বলেনি, “ওরা খুনী।”

আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের সেদিনের ঘটনায় অনন্তবাবুর দলের প্রলয়েশ মিশ্র দারুণভাবে আহত হয়েছিল। তার সারা শরীর, বিশেষ করে মাথা থেঁতলে গিয়েছিল। কোনক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেও, তার মস্তিষ্ক আর ঠিকঠাক কাজ করত না। সে আর সুস্থ মানুষের মত চলাফেরা করতে পারত না। আমি জেলের সোর্সের দেওয়া এই খবর আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে যথাসময়ে জানিয়েছিলাম। তাঁরা আমাকে ওই ব্যাপারে আর অগ্রসর হতে বারণ করে, নিজেরা দেখছি বলে আমাকে এবং আমার সোর্সের খবরকে ধামাচাপা দিয়ে দেন।

আলিপুরে ওদের বিরুদ্ধে চতুর্থ ট্রাইবুনালে আট বছর ধরে মামলা চলেছিল। অনন্তবাবুর দলের ছেলেদের আমরা সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে মনে করতাম, তাই নিয়ম ভেঙে জেলের গেটের ভেতর পুলিশের ভ্যান ঢুকিয়ে তাদের তুলে আবার জেল গেট খুলে কোর্টে আনা হত। কোর্টে অনন্তবাবুর কাছে বহুবার দেখা করতে এসেছিলেন তাঁর বন্ধু স্নেহাংশু আচার্য, যিনি জ্যোতিবাবুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। সি. পি. আই (এম) পার্টির অন্যতম নেতা ছিলেন। অনন্তবাবু ওই পার্টির প্রতীক নিয়ে উনসত্তর সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হিসেবে চৌরঙ্গি কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের কাছে খুব অল্প ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন।

আট বছর ধরে মামলা চলার পর সাতাত্তর সালে প্রথম বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়। সেই সময় ওদের বিরুদ্ধে মামলাও সরকার পক্ষ থেকে তুলে নেওয়া হয়। অনন্তবাবু ও তাঁর দলের ছেলেরা ছাড়া পেল। সাধারণত ডাকাতি মামলার আসামী ছাড়া পেলে, পরবর্তী সময়ে অন্য কোন ডাকাতির তদন্তে আমরা তাদের ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করি। সূত্র খুঁজে বার করার জন্য কিন্তু অনন্তবাবুর ছেলেদের আমরা আর কোনওদিন ধরিনি বা কোন ডাকাতির সূত্র খোঁজার জন্য জিজ্ঞাসাবাদও করিনি। এমনকি, আশির দশকে যখন কলকাতা ও তার আশেপাশে পরপর নটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়ে গেল, তখনও নয়। যাতে যথেচ্ছভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ও বিভিন্নরকম রাসায়নিক বোমা ব্যবহার হয়েছিল। যার সূত্র খুঁজতে খুঁজতে একটা ছেলেকে ধরবার জন্য এগিয়ে গেছি। তখনই সেই ছেলেটা দমদম এলাকায় এক পরিত্যক্ত বাড়িতে তখন পর্যন্ত আমাদের অজানা এক বিস্ফোরকে মাংসের কিমা বানানার মত উড়ে গেছে। সেই সময়ও কিন্তু আমরা অনন্তবাবুর দলের ছেলেদের ধরে কোনও প্রশ্ন করিনি। অথচ তখন আমরা ও রাজ্য পুলিশ হন্যে হয়ে ডাকাতিগুলি কিনারা করার জন্য সূত্র খুঁজছি। যাকে পারছি তাকে ধরেই জেরা করছি। কলকাতা ও উত্তর ও দঃ চব্বিশ পরগনায় গোপনে চিরুনি তল্লাশি করছি। পরবর্তীকালে যখন আমরা সেই সব ডাকাতির রহস্য উন্মোচন করেছি, তাতে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, আমাদের সিদ্ধান্তই সঠিক। অনন্তবাবুর ছেলেরা আর কোনওদিন ডাকাতি করবে না। তারা বুঝে গিয়েছে যে ডাকাতির রাজনীতিটা ভুল। আর সেই ভুলের মাশুল তাদের জীবন দিয়ে দিতে হয়েছে।

জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার বছর খানেকের মধ্যে অনন্তবাবু মারা যান। শেষ হয় ভারতবর্ষের পঞ্চাশ বছরব্যাপী এক সন্ত্রাসবাদী ইতিহাসের নায়ক বা খলনায়কের অধ্যায়। যা কিনা তাঁর বিভ্রান্তিকর রাজনীতির এক বিয়োগান্ত করুণ পরিণতি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *