১৮
দেবীবাবু গোয়েন্দা বিভাগ থেকে ভূষি কেলেঙ্কারি মামলার তদন্তের ভার নিয়ে রাজ্য পুলিশে চলে যেতে লালবাজারে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হয়ে এলেন উত্তর কলকাতার ভারপ্রাপ্ত ডি. সি.। তিনি এসে প্রথমেই শুরু করলেন, “দেবী রায় পরিষ্কারকরণ প্রক্রিয়া।” তিনি দেবীবাবুর তৈরি করা গোয়েন্দা বিভাগকে ভাঙতে শুরু করলেন। বদলি করতে লাগলেন দক্ষ অফিসার ও বহুদিন গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করা অভিজ্ঞ কর্মচারীদের। ফলে সুবিন্যস্ত বিভাগটা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। তবে সমস্ত পুরনো ও সুদক্ষ অফিসারকে বদলি করার তিনি দুঃসাহস দেখালেন না, তাই কোনক্রমে বিভাগটা বেঁচে গেল। সেইসব বদলি হওয়া অফিসার ও কর্মচারীদের বদলে তিনি ওই সব পদে নিয়ে এলেন তাঁর প্রিয় ও পূর্বপরিচিত উত্তর কলকাতা বিভাগের অফিসার ও কর্মীদের। যাদের কারও গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে প্রথম দিকে গোয়েন্দা বিভাগে এদের থাকা বা না থাকাটা প্রায় সমান হয়ে গিয়েছিল। যেমন তিনি নিয়ে এলেন ঠাকুর নামে এক সার্জেন্টকে। সার্জেন্টরা মূলত ট্রাফিক ও গণজমায়েত সামলানর কাজ করে থাকেন। এবং তাঁদের ট্রেনিংও দেওয়া হয় সেইভাবে। তাঁদের ইনভেসটিগেটিং ক্ষমতাটা আইনগতভাবে নেই। তিনি তাঁকে নিয়ে এলেন গোয়েন্দা দফতরে। ঠাকুরবাবুর একটাই গুণ, তিনি সেই ডি.সি. সাহেবের খুবই অনুগত ও বাধ্য। একবার এক জুনিয়ার অফিসারের সঙ্গে চুরির তদন্তে গিয়ে ঠাকুর নিজেই তদন্তের সিজার লিস্ট তৈরি করেছিলেন। আদালতে হাকিম সাহেব ঠাকুরের কাছে জানতে চান, কেন তিনি ওই সিজার লিস্ট তৈরি করেছেন, আইনে যখন সার্জেন্টদের তদন্ত করার অধিকার দেওয়া নেই। ঠাকুর আদালতের প্রশ্নের উত্তরে নির্দ্বিধায় বললেন, “কেন, ডি.সি. বলেছিলেন স্যার।” ভাবটা এমন যেন আইনের চেয়ে ডি.সি. ঊর্ধ্বে।
সেই ঠাকুরের মাথায় জন্মের থেকেই চুল ছিল না। দুচারটে চুল এদিক ওদিক মাথার পাশে উড়ে বেড়াত। তাই তিনি সবসময় টুপি পরে থাকতেন। ডি.সি. সাহেব একদিন ঠাকুরকে বললেন, “আমি কবিরাজি ওষুধের পরীক্ষা করছি, তুমি দুচারদিন পর আমার সাথে দেখা কর, ওষুধ লাগিয়ে তোমার মাথায় আমি চুল গজিয়ে দেব।” ঠাকুর বললেন, “ঠিক আছে স্যার।” সেই কথা মত দু চারদিন পর ডি.সি. সাহেব লালবাজারে তাঁর কোয়ার্টারে ঠাকুরকে নিয়ে গেলেন কি সব গাছগাছালির পাতার শুকনো গুঁড়ো ও অন্যান্য জিনিসের গুঁড়ো দিয়ে তাতে জল মিশিয়ে একটা কাদার তাল বানালেন। তারপর সেটা ঠাকুরকে দিয়ে বললেন, “ঠাকুর এটা তোমার পুরো মাথায় লাগিয়ে টাকটা ঢেকে নাও।” ঠাকুর তাড়াতাড়ি টুপি খুলে ওই কাদার তালটা পুরো মাথায় লাগিয়ে নিলেন। তখন ডি.সি. সাহেব ঠাকুরকে বললেন, “যাও বারান্দায় রোদে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো।” ঠাকুর সাথে সাথে বারান্দায় গিয়ে রোদে দাঁড়িয়ে রইলেন। নট নড়নচড়ণ। এবং ঘণ্টা দুয়েক পর ডি.সি. অফিসে এসে ঠাকুরকে খবর পাঠালেন, আজ – আর দাঁড়াতে হবে না। ঠাকুর ডি.সি. সাহেবের সাথে দেখা করলেন, ডি.সি. সাহেব ঠাকুরকে বললেন, “আগামীকাল থেকে প্রতিদিন আমার কোয়ার্টারে এসে সকাল দশটা থেকে মাথায় ওষুধ লাগিয়ে রোদে দাঁড়িয়ে থাকবে, আমি দেখব।” এইভাবেই দিন পনের চলল। ঠাকুর প্রতিদিন সকাল দশটার মধ্যে লালবাজারে ডি.সি. সাহেবের কোয়ার্টারে এসেই গুঁড়োর কাদা- বানিয়ে, মাথায় ভাল করে লাগিয়ে রোদে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ডি.সি. সাহেব’ দেখতেন ঠাকুর তাঁর দেওয়া ওষুধ লাগিয়ে রোদে দাঁড়িয়ে আছে। ডি. সি. ওই দৃশ্য দেখে খুব খুশি হতেন। “সাতদিনের মাথায় ঠাকুরের মাথা থেকে ওষুধটা একটু সরিয়ে দেখে বললেন, “বাঃ, ওই তো চুল উঠছে।” উত্তরে ঠাকুর বললেন, “হ্যাঁ স্যার। আমিও হাতে ফিল করছি।” ডি.সি. সাহেব” মহানন্দে হাসতে হাসতে তাঁর চেম্বারে গিয়ে সবাইকে ডেকে ডেকে বলতে লাগলেন, “জান, ঠাকুরের চুল উঠছে।” তারপর ডি.সি. সাহেব কদিন’ খুব “প্রসন্ন রইলেন। তারও দিন তিনেক পর আমি আমার অফিসে ঠাকুরের টুপি সরিয়ে দেখলাম সত্যিই চুল উঠছে কি না। কিন্তু কোথায় চুল? কিচ্ছু নেই।” আমি : ঠাকুরকে বললাম, “ঠাকুর: কই চুল? চুল তো ওঠেইনি।” আমার প্রশ্নের উত্তরে ঠাকুর বললেন, “না স্যার, ডি.সি. বলেছেন, স্যার, আপনি ভাল করে দেখুন স্যার।” অর্থাৎ ডি.সি. যখন বলেছেন, তার ব্যতিক্রম হয় না; চুল নিশ্চয়ই উঠছে। সেই ঠাকুর অনেক রোদে পুড়েও সারা জীবন চুল ছাড়াই কাটিয়ে দিলেন।
সেই ডি.সি. সাহেব এমনিতে সজ্জন ছিলেন। নিজের মধ্যে নিজের মত করে থাকতে ভালবাসতেন। কোনও কোনও ব্যাপারে কিছুটা উদাসীন; আবার কিছুটা রোমান্টিক। নিজেই থমসন মেসিনগান নিয়ে অনেকটা ফিদেল কাস্ত্রোর ঢঙে, চলাফেরা করতে পছন্দ করতেন। কিন্তু এত ভুলো মনের ছিলেন যে, গাড়িতেই হয়ত সেটা ফেলে কোন দোকানে বা বাজারে চলে যেতেন। আর সে সময় উপস্থিত সঙ্গীকে সেটা পাহারা দিতে হত।
সেই ডি.সি. সাহেবের আমলে চুয়াত্তর সালের আগস্ট মাসে আমি একদিন সোর্সের মাধ্যমে একটা বিরাট বড় খবর পেলাম। বিশাল পরিমাণের ইউরেমিয়াম বিদেশে পাচার করার জন্য পাচারকারীরা কলকাতায় এসেছে। যে পরিমাণ ইউরেনিয়াম শুনলাম; তার দাম এক কোটি টাকার ওপর তো হবেই। সোর্সের মাধ্যমেই আরও খবর পেলাম, পাচারকারীরা গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের একটা “সুইট” বুক করে তাতে উঠেছে। তবে সেখানে দলের পাণ্ডাটি নেই, অন্য দুজন আছে। সোর্স ওদের পূর্বপরিচিত ছিল, তাই বললাম, ওদের খাইয়ে-পরিয়ে আরও আস্থাভাজন হতে! কারণ তারা যে ইউরেনিয়াম বিক্রি করতে কলকাতায় এসেছে চলে ব্যাপারে তাদের কাছ থেকে জানতে হবে এবং তারপর ইউরেনিয়ামের হদিসটা পেতে হবে। আমার পরামর্শ অনুযায়ী সোর্স কাজে নেমে পড়ল এবং ঘনিষ্ঠ হচ্ছে বেশি। সময় নিল না। সে জানাল, ইউরেনিয়ামের কোনও খদ্দের তখনও ওরা ঠিক করেনি। এতে আমার সুবিধাই হল। আমার কথামত সোর্স তাদের বলল, “তার কাছে জবরদস্ত পার্টি আছে, যদি তারা বলে তবে সেই পার্টিকে তাদের কাছে নিয়ে আসতে পারে।” পাচারকারীদের কাছে তখন অন্য পার্টি ছিল না। আমার সোর্সের কথায় রাজি হয়ে তারা সোর্সের পার্টিকে আলোচনার জন্য নিয়ে আসতে বলল।
এরপর আমি আমার দুই বিশ্বাসভাজন ব্যবসায়ী, একজন মাড়োয়ারি ও অন্যজন গুজরাটি, মিঃ বি. আগরওয়ালা ও মিঃ দোশীকে ভাল করে তাদের কাজ বুঝিয়ে খদ্দের সাজিয়ে আমার সোর্সের সাথে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে পাঠালাম। তারা গিয়ে পাচারকারীদের সাথে পরিচয় করল। আমার লোকেরা তাদের বলল, তারা সেই ইউরেনিয়াম বাংলাদেশের মাধ্যমে ইউরোপের বাজারে পাঠিয়ে দেবে। সে সব দায়িত্ব তাদের। তারপর তারা দরদপ্তর সব ঠিক করে ইউরেনিয়ামের কিছুটা নমুনা নিয়ে চলে এল। আমি সেই নমুনা আমাদের অ্যাটমিক এনার্জি বিভাগে পাঠিয়ে দিলাম। সেটা সত্যিকারের ইউরেনিয়াম কি না তা পরীক্ষার জন্য পরদিনই বিশ্লেষণের রিপোর্ট পেলাম, হ্যাঁ, ইউরেনিয়ামই। ব্যস, আমরা গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে গিয়ে সেই দুই পাচারকারীকে ইউরেনিয়াম সমেত গ্রেফতার করলাম। কিন্তু দলের মূল পাণ্ডাকে আমাদের চাই। লালবাজারে আমাদের পদ্ধতি অনুযায়ী ধৃত দুই পাচারকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলাম। জিজ্ঞাসার উত্তরে জানতে পারলাম, দলের পাশুর পরের দিনই অর্থাৎ আঠাশে আগস্ট বড়বাজার এলাকায় মহাত্মা গান্ধী রোডের একটা ছোট হোটেলে আসার কথা। আমরা ঠিক সময়ে সেখানে গিয়ে চারদিক ঘিরে রাখলাম। পাচারকারীদের একজনকে নিয়ে একটা গাড়িতে বসিয়ে একটু দূরে রেখে দিলাম। পাণ্ডা এল, সঙ্গের পাচারকারী আমাদের চিনিয়ে দিতে তাকে গ্রেফতার করে লালবাজারে এনে তুললাম।
পরদিন সব পত্রপত্রিকায় ইউরেনিয়াম উদ্ধার ও পাচারকারীদের গ্রেফতারের খবর ফলাও করে ছাপা হল। তাতে আমাদের সেই ডি.সি. সাহেব খুব খুশি হলেন। এতবড় একটা কাজে তাঁর নাম হল, তাতে তো খুশি হবেনই।
এরপর আমরা এই ইউরেনিয়াম পাচারের উৎসটা বন্ধ করার পরিকল্পনা করলাম। গ্রেফতার হওয়া পাচারকারীদের কাছ থেকে তখন জেনে নিয়েছি, জামশেদপুরের কাছে যদুগোড়ায় যে ইউরেনিয়ামের খনি আছে, সেখান থেকে এইসব ইউরেনিয়াম অন্ধকার পথে বেরিয়ে আসে। এখনই যদি উৎসটা বন্ধ না করা যায়, তবে আরও বেশী পাচার হবে এবং তাতে দেশের ক্ষতি হবে প্রচুর।
জামশেদপুরে তাদের দলের লোকজনের ঠিকানা জেনে ফেলেছি। তৎকালীন কমিশনার সুনীল চৌধুরীর নির্দেশ মত ঠিক হল, আমরা কয়েকজন অফিসার গাড়ি নিয়ে জামশেদপুর রওনা হব। সেই অনুযায়ী আমরা ডি.সি. সাহেবের কাছে প্রস্তাব দিলাম। তিনি জানালেন, আমাদের সাথে তিনিও যাবেন। আমরা তো আর ডি.সি. সাহেবকে না করতে পারি না। তাই-ই ঠিক হল।
পরের দিন দুটো অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে আমরা রওনা দেবার জন্য প্রস্তুত। একটা ডি.সি. সাহেবের, অন্যটা আমাদের বিভাগীয়। আমাদের কোনও অফিসারই ডি.সি. সাহেবের সাথে তাঁর গাড়িতে সঙ্গী হতে চাইছেন না। বাধ্য হয়ে আমিই তাঁর সঙ্গী হলাম। অন্য গাড়িতে শচী, লাহিড়ী, রাজকুমার, প্রদীপ, অমিত ও টুটুল। ডি.সি. সাহেবের ড্রাইভারটা আবার কানে শোনে না। আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, “স্যার, আপনার ড্রাইভার কানে শোনে না, এতে আপনার অসুবিধা হয় না?” আমার প্রশ্ন শুনে তিনি মুচকি হেসে বলেছিলেন, “বহু খুঁজে তবে ওকে আমি পেয়েছি। গাড়ির মধ্যে আমাদের কি কথা হয় অন্য কেউ শুনুক তা আমি চাই না। সেজন্য আমি ওকে খুঁজে বার করেছি।” আমি আর কথা না বাড়িয়ে চেপে গিয়েছিলাম।
আমাদের দুটো গাড়ি ছুটল জামশেদপুরের দিকে। ডি.সি. সাহেবের একটা মারাত্মক গুণ ছিল। তিনি যে কোনও বিষয়ের ওপর অনবরত কথা বলে যেতে পারতেন। শ্রোতা শুনছে কি না শুনছে সেদিকে তাঁর কোনও খেয়াল থাকত না। শ্রোতাকে শুধু মাঝেমধ্যে “হুঁ, হ্যাঁ” করে যেতে হত। তিনি তাঁর ধ্যানধারণা আর কথাকে সর্বশেষ বলে মনে করতেন। যদি কেউ তাঁর মতামতের প্রতিবাদ করতেন তবে তিনি তাঁর ওপর ভীষণ রেগে যেতেন এবং তাঁকে অপদার্থ বলে মনে করতেন।
তিনি যখন উত্তর কলকাতার ডি.সি. ছিলেন, তখন বটতলা থানায় এক জুনিয়ার অফিসারকে প্রায় কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন। ডি.সি. সাহেব প্রতিদিনই রাতে ওই অফিসারের সঙ্গে আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার সামনের মাঠে ব্যাডমিন্টন খেলতেন আর হেরে যেতেন। হেরে গিয়ে তিনি সেই অফিসারের সার্ভিস বুকে অহেতুক সাজা লিখে দিতেন। অফিসারের কেস ডায়েরি থেকে খুঁজে খুঁজে তুচ্ছ ভুল ধরে তিনি সাজা দিতেন। সেই জুনিয়ার অফিসার একদিন আমায় বলল, “ডি.সি. সাহেব রোজ আমায় ডেকে ব্যাডমিন্টন খেলেন, অথচ আমার কেস ডায়েরি খুঁজে কিছু না কিছু ভুল ধরে সাজা দেন, কি যে করি!” আমি প্রশ্ন করলাম, “তুমি ডি.সি. সাহেবের সঙ্গে খেলায় হার না জেত?” অফিসার জানাল, প্রতিদিনই সে জেতে। আমি সেটা শুনে বললাম, “এবার থেকে তুমি হারবে, তবে সাবধান, যেন বুঝতে না পারে তুমি ইচ্ছাকৃতভাবে হেরে যাচ্ছ। তাই মাঝেমাঝে দুএকটা ‘গেম জিতবে। কিছুদিন পর তুমি তোমার সার্ভিস বুক নিয়ে যাবে সাহেবের কাছে, ক্ষমা চাইবে। দেখবে হাতেনাতে ফল পেয়েছ।” অফিসার আমার ‘পরামর্শ মত খেলতে লাগল, এবং যথারীতি হারতে লাগল। তার দিন দশেক পর অফিসার তার সার্ভিস বুক নিয়ে গিয়ে সাহেবের কাছে হাজির। সাহেব প্রশ্ন করলেন, “কি ব্যাপার?” অফিসার বলল, “স্যার’ আমায় ক্ষমা করে দিন, ‘সাজাগুলো মকুব করে দিন।” সাহেব হেসে বললেন, “বস, বস, আমার সাথে চালাকি! কদিন শরীরটা ঠিক ছিল না, তাই হারিয়েছ, তারপর দেখলে তো, তোমায় কর্কের সাথে রোজ উড়িয়ে দিচ্ছি।” অফিসার বিগলিত হয়ে মাথা নিচু করে শুনলেন। সাহেব অফিসারের সার্ভিস বুক নিয়ে সব সাজা মুকুব করে দিলেন। পরদিন সেই ‘অফিসার’ আমাকে এসে বলল, “স্যার, আপনার কথা মত সব কাজ হয়েছে। তিনি সাজা তুলে নিয়েছেন।”
গাড়ি ছাড়ার পর ডি.সি. সাহেব খোশমেজাজে গল্প শুরু করলেন। আমি আর কি করি, নির্বাক শ্রোতার ভূমিকা পালন করতে লাগলাম। তাঁর কথার মাঝে একবার শুধু “রামায়ণ” ধরিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি তারপর “রামায়ণের” বিভিন্ন চরিত্র ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন। আমি মাঝেমধ্যে হুঁ, হ্যাঁ করে যেতে লাগলাম। ‘ বম্বে রোড ধরে গাড়ি ছুটছে, – অন্য গাড়িটা আমাদের গাড়ির পেছন পেছন আসছে। ওই গাড়িতে আমাদের অন্য অফিসাররা হাসিঠাট্টা করতে করতে আসছে। তাদের দেখে আমার হিংসা হচ্ছে, আমার খালি মনে হচ্ছে, আমি যেন জেলখানায় বন্দী।
ডি.সি. সাহেবের “রামায়ণ” শেষ হলে, আমি তাঁকে “বেদ” ধরিয়ে দিলাম। তিনি এবার “বেদ” নিয়ে বলতে শুরু করলেন। আমিও মাঝেমধ্যে হুঁ, হ্যাঁ করতে লাগলাম। ডি.সি. সাহেবকে দু-একবার বললাম ‘ গাড়ি দাঁড় করিয়ে চা-টা খেয়ে নিতে। তিনি বললেন, “কাজের সময় কাজ; কোনও খাওয়া দাওয়া ঠিক নয়, তাতে কাজে একাগ্রতা কমে যায়।” আমি চুপ করে গেলাম, তিনি আবার “বেদে” ঢুকে পড়লেন। আমার ইচ্ছা ছিল, একবার যদি গাড়ি থামাতে পারি, তবে আমি দ্বিতীয় গাড়িতে ‘উঠে’ সেই গাড়ি থেকে অন্য অফিসারকে ডি.সি. সাহেবের গাড়িতে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু আমার পরিকল্পনা ব্যর্থ হল। আমাদের গাড়ি কোলাঘাট পেরিয়ে মেদিনীপুর জেলায় ঢুকে পড়ল।
ডি.সি. সাহেব ‘কি জানি কি দেখে হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা রুশুবাবু, আপনি কত উঁচু ‘উই টিপি দেখেছেন?” আমি তাঁর প্রশ্ন শুনে একটু থমকে গেলাম। আমি কোচবিহারের ছেলে। কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির গ্রামে গ্রামে ঘুরে বড় হয়েছি। সেখানে বহু উই ডিপি দেখেছি রৈকি। তা সেগুলো.. আর কতটা উঁচু হবে? বড় জোর এক হাত দু হাত। কিন্তু আমি আমার কল্পনাশক্তিকে যতদূর পারি বাড়িয়ে দিলাম। কারণ আমি জানি যতই উঁচু বলি না কেন, তিনি ঠিক তার উত্তরে বলবেন, “মাত্র, এইটুকু!” আমি যাতে না হারি, তাই গল্পের গরুকে গাছে উঠিয়ে একটা ডাহা মিথ্যা বললাম, “তা ধরুন দেখেছি, এই দোতলা বাড়ির সমান উঁচু।” তিনি যথারীতি হেসে বললেন, “দূর, এইটুকু!” আমার তখন নিজেরই নিজের গালে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে, ভাবলাম কেন আরও বাড়িয়ে বললাম না। তিনি একটু থেমে বললেন, “আমি যখন ত্রিপুরায় ডি. এস. পি: · ছিলাম, তখন ওখানে আমি চারতলা সমান উঁচু উই ঢিপি দেখেছি।” সেটা শুনে আমার তখন “গুরু” বলে তাঁর পায়ের ধুলো নিতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কোনমতে সামলে আমি গাড়ির জানালা দিয়ে গ্রামবাংলা দেখতে লাগলাম।
ভাদ্র মাস; আকাশে শরতের মেঘের খেলা। ভরা ধানের ক্ষেত, আলের চারপাশে ধবধবে কাশ ফুলের দোলা। পুজো পুজো ভার। সন্ধের মুখে গ্রামের লোকেরা “জীবনের লেনদেন” শেষ করে অলস পায়ে ঘরে ফেরার দিকে। আমি সে দিকে মন দেব কি? ত্রিপুরার চারতলা সমান উঁচু উঁই ঢিপির বিশ্লেষণ শুনতে শুনতে হুঁ, হ্যাঁ করে যেতেই হচ্ছে।
খড়্গপুরের কাছে চলে আসতেই আমার মাথায় একটা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল। আমি সেই অনুযায়ী ডি.সি. সাহেবকে বললাম, “স্যার গাড়ি একবার দাঁড় করাতেই হবে। নয়ত আমার তলপেট ফেটে যাবে।” তিনি সাথে সাথে বললেন, “তবে তো থামাতে হবেই।” আমি একটা ধাবা দেখে গাড়ি দাঁড় করালাম। পেছনের গাড়িও দাঁড়িয়ে গেল। ধাবটা ছিল রাস্তার থেকে নিচে এবং বেশ খানিকটা দূরে। গাড়ি থামার সাথে সাথে ‘ আমি নেমে দ্বিতীয় গাড়ির কাছে গিয়ে শচীকে বললাম, “শচী, সাহেবের কাছে যাও, সঙ্গ দাও, এতক্ষণ আমি তো “হুঁ, হ্যাঁ” করে গেছি।” শচীরা আমার অবস্থাটা বুঝেছে। তাই আমাকে একটু নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ দিতে সে ডি.সি. সাহেবের কাছে গেল। আমি, রাস্তার ধারে : তলপেটের ওজন কমিয়ে থাবায় গিয়ে চায়ের অর্ডার দিলাম। দূর থেকে দেখছি, ডি.সি. সাহেব শচীকে নিয়ে রাস্তার ওপর একবার একশ গজ মৃত পশ্চিম দিকে যাচ্ছেন আবার একটু পর পুব দিকে গাড়ির কাছে ফিরে আসছেন। আর মাঝে মাঝে হাত দিয়ে কিছু না কিছু শচীকে দেখাচ্ছেন!
সন্ধে নেমে গেছে। আমরা সবাই চা ও খাবার খাচ্ছি। হঠাৎ শচী ছুটতে ছুটতে রাস্তা থেকে নেমে আমার কাছে এসে বলল, “স্যার বাঁচান, সর্বনাশ হয়ে গেছে, জোতদারের বাড়ি এগচ্ছে, আপনি যান। পেছন ফিরলেই বিপদে পড়ব।” শচীর কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। তাই প্রশ্ন করলাম, “কি এগচ্ছে?” শচী বলল, “জোতদারের বাড়ি।” বললাম, “তার মানে?” শচী করুণ মুখে বলল, “তা আর কি বলছি, আমি যেতেই তিনি একটার পর একটা গাছ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, বলুন তো এটা কি গাছ, আমি যাই উত্তর দিই না কেন, তিনি তখনই বলেন, দূর, এই গাছটা চেনেন না, এটা হল অমুক গাছ। আমি চুপ করে শোনার পরই বলেন, এতদিন কিছুই শেখেন নি, সাধারণ গাছগাছড়াও চেনেন না?” শচীকে বললাম, “তা অসুবিধা কোথায়? শুনে গেলেই হয়।” শচী আমায় বলল, “তাইতো শুনছিলাম, কিন্তু এবার যে বিপদে পড়ে গেছি।” জানতে চাইলাম, “কিসের বিপদ?” শচী জানাল, “তিনি দূরে অন্ধকারের মধ্যে একটা জায়গায় অনেকগুলো লাইট দেখিয়ে আমায় প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা ওই লাইটগুলো কোথায় জ্বলছে বলুন তো?” আমিও অনেকক্ষণ ওই লাইট গুলো লক্ষ্য করছিলাম। তাঁর প্রশ্ন শুনে ভাবলাম, এখানে আর কোথায় এত লাইট জ্বলবে, নিশ্চয়ই কোন জোতদারের দোতলা বাড়িটাড়িতে। তাই তাঁর প্রশ্নের জবাবে বললাম, কোথায় আর স্যার, জোতদারের বাড়িতে। তিনি আমার উত্তর শুনে বললেন, কারেক্ট। এতক্ষণে একটা ঠিক উত্তর দিয়েছেন, ওটা জোতদারেরই বাড়ি।” শচী এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে একটু থামলে বললাম, “ভালই তো, একটা প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিতে পেরেছ।” শচী আমার কথা শুনে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “না স্যার, ওই জোতদারের বাড়িই যে এগিয়ে আসছে, তাই দেখেই আমি আপনার কাছে ছুটে চলে এলাম। তিনি কারেক্ট বলার সাথে সাথেই পেছন ফিরে দেখি কি জোতদারের বাড়ি এগিয়ে আসছে, আসলে সেটা একটা লরি। অনেকগুলো লাইট জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।”
এরপর শচী ভয়ে রাস্তার দিকে ফিরে আমাদের একটা লরি দেখিয়ে বলল, “ওই যে স্যার জোতদারের বাড়ি।” আমরা দেখলাম একটা লরি সামনের দিকে ছোট বড় হরেকরকম লাইট জ্বালিয়ে দ্রুত বেগে রাস্তা দিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। “জোতদারের বাড়িটা” চলে যেতে আমি শচীকে বললাম, “তাহলে তুমি কি আর সাহেবের গাড়িতে যাবে না? তুমি কারেক্ট বলেছ, দেখবে তোমায় আর কিছু বলবে না। তবু শচী মাথা নেড়ে বলল, “আমাকে ছেড়ে দিন স্যার।” কি আর করি, আমিই আবার সাহেবকে গিয়ে বললাম, “চলুন স্যার।” তিনি জোতদারের বাড়ির প্রসঙ্গ আর তুললেন না।
গাড়ি আবার ছুটতে শুরু করল। আমি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। ডি.সি. সাহেব বিভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করে আমাকে বুঝিয়েই চলেছেন, আমি উত্তরে “হুঁ, হ্যাঁ” করে চলেছি। খড়্গাপুর পেরিয়ে নিমপুরা, কলাইকুণ্ডা, লোধাগুলি ছাড়িয়ে ঝাড়গ্রামকে ডান দিকে রেখে এগিয়ে চলেছি। ঝাড়গ্রাম ছাড়তেই তিনি বললেন, “আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বিহারে প্রবেশ করব।” আমি শুনলাম। এইভাবে চলতে চলতে আমরা ঘাটশিলায় পৌঁছলাম, সেখানে বম্বে রোডের ওপরে একটা বাড়ি দেখিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, “এই বাড়িটা কার বলুন তো?” আমি এক ঝলক দেখে বললাম, “জানি না।’ তিনি তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, “কিছুই জানেন না দেখছি, এটা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। দেবীবাবুর আমলে দেখছি কিছুই শেখেন নি।” আমার পেটের ভিতর তখন হাসি মেঘের মত গুরগুর করছে, কারণ আমি জানি, বিভূতিভূষণের বাড়ি ঘাটশিলার অনেকটা ভেতরে, বম্বে রোড থেকে তা দেখাই যায় না। তবু সাহেবের মুখের উপর কোন কথা না বলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে চুপ করে রইলাম। আর ভাবতে লাগলাম কতক্ষণে জামশেদপুর পৌঁছব।
অবশেষে জামশেদপুর পৌঁছলাম। রাত তখন অনেকটা এগিয়ে গেছে। সাকচি বাজারের ওপর একটা হোটেল ঠিক করলাম। সাহেবের জন্য আলাদা একটা ঘর দিয়ে আমরা অন্য কটা ঘরে জিনিসপত্র রাখলাম। আমি শচীকে নিয়ে ছুটলাম স্থানীয় থানায়, সেখানে নিজেদের পরিচয় দিয়ে, জামশেদপুরের এস. পি. সাহেবের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে বললাম। তাঁরা টেলিফোনে এস. পি. সাহেবের সাথে যোগাযোগ করলে আমি ফোনে তাঁকে বললাম, “একটা বিশেষ কারণে আমরা কলকাতা থেকে এসেছি, আপনার সাথে সরাসরি দেখা করতে চাই।” তিনি আমাকে ওই থানাতেই থাকতে বললেন।
মিনিট কুড়ি পর এস. পি. সাহেব জিপে চড়ে এলেন। আমাদের সাথে পরিচয় পর্ব শেষ হলে তিনি একটা আলাদা ঘরে আমাদের নিয়ে গিয়ে জানতে চাইলেন কি জন্য আমরা এসেছি। তাঁকে আমরা কারণ জানাতেই তিনি থানার অফিসার-ইন-চার্জকে নির্দেশ দিলেন আমাদের যেন সবরকম সাহায্য করা হয়। রাত একটায় আমরা আসব বলে থানা থেকে বেরিয়ে সোজা হোটেলে ফিরে এলাম।
হোটেলে ফিরে স্নান খাওয়াদাওয়া সেরে আসামী ধরবার অভিযানে বার হওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। সবাই তৈরি হলে আমি ডি.সি. সাহেবের ঘরে গিয়ে তাঁকে ডোকলাম। তিনি দরজা খুলে, আমাকে বললেন, “আমার কি যাওয়ার প্রয়োজন আছে?” উত্তরে বললাম, “সে আপনার ইচ্ছে।” তিনি বললেন, ‘আমি ভীষণ ক্লান্ত, আপনারাই যান, আমাকে ছাড়া পারবেন তো, সব কিছু ঠিকঠাক করতে?” উত্তরে বললাম, “কোনও অসুবিধা নেই, আপনি বিশ্রাম করুন স্যার, আমরাই যাচ্ছি।” তিনি ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন।
রাত একটায় আমরা থানায় পৌঁছলাম।, থানা থেকে একজন অফিসাব ও ফোর্স নিয়ে আমরা গাড়িতে উঠে আমাদের সঙ্গে আনা ঠিকানার খোঁজে চললাম। সেই অফিসারই রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। আমরা পরপর দুটো বাড়িতে হানা দিয়ে তিনজন আসামীকে গ্রেফতার করলাম। কোনও বকম হাঙ্গামাই হল না। আসামীদের থানার হাজতে রেখে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম।
পরদিন, আমরা যদুগোড়ায় ইউরেনিয়াম কারখানা দেখতে গেলাম। দূরে রুয়ামের পাহাড়-জঙ্গল, যেখান থেকে ধরা পড়েছিল অনন্তবাবুর দলের ছেলে-মেয়েরা। কারখানার এলাকাটা সম্পূর্ণভাবে সংরক্ষিত। বাইরের কোনও লোককেই ঢুকতে দেওয়া হয় না। তবু সেখান থেকেই পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের অমূল্য সম্পদ। আমরা চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সেখানকার রক্ষীবাহিনীর কর্তার সাথে কথাবার্তা বলে জামশেদপুরের হোটেলে ফিরে এলাম।
হোটেল থেকে জিনিসপত্র নিয়ে থানায় গেলাম। আসামীদের হাজত থেকে বার করে কলকাতার রাস্তা ধরলাম।