সাদা আমি কালো আমি – ১.২৩

২৩

আর বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই অপরাধী হয়ে ওঠে, অপরাধ করে। আসলে কেউ অপরাধী হয়ে জন্মায় না। কিন্তু সমাজের অপরাধ জগতে থাকতে থাকতে, মিশতে মিশতে এবং সেই পরিবেশে বড় হতে হতে এক একজন তৈরি হয়ে যায় পেশাদার অপরাধী। এদের পরিবর্তন করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ এদের মানসিক গড়নই এমন হয়ে যায় যে তারা অন্ধকার দিকটা ছাড়া জগতের অন্য দিকটা দেখতে পায় না। তাছাড়া অল্প পরিশ্রমে, অল্প আয়াসে টাকা রোজগারের এরা পথ পেয়ে যায়, তখন বেশি পরিশ্রম করে সাধারণ মানুষের মত জীবনধারণ করাটা এরা চিন্তার বাইরেই রেখে দেয়।

আবার কেউ হঠাৎ আবেগতাড়িত হয়ে একটা অপরাধ করে বসে। তাৎক্ষণিক বুদ্ধিভ্রংশে হয়ে যায় খুন, জখম বা অন্য কোনও অপরাধ। এইসব অপরাধী কিন্তু অপরাধ করার পরেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজের ভুল বুঝতে পারে। তখন নিজেরাই নিজেদের পরিবর্তন করে নেয়।

এছাড়া রাজনৈতিক আবেগের জন্যও বহু অপরাধ অহরহ ঘটছে, যা রাজনৈতিক ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। একটা বিশ্বাসের তাড়নায় কোন সিদ্ধান্তে এসে এই সব অপরাধগুলো সংঘটিত হয়।

অন্যদিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক অপরাধ তো প্রচুর হয়। কখনও তা ফসল নিয়ে ভূস্বামী ও কৃষকদের মধ্যে, কখনও বা শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিক-মালিকের দ্বন্দ্বের জন্য।

আর ভদ্রবেশী অর্থনৈতিক অপরাধ এখন আমাদের দেশে জন ভাত হয়ে গেছে। তা কোনও ক্ষেত্রে ব্যক্তি ব্যক্তিকে করছে বা সরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাঙ্ককে প্রতারণার মাধ্যমে করছে, কিংবা চিট ফান্ড জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হচ্ছে।

তাছাড়া মানসিক বিকারগ্রস্ত ও নেশাগ্রস্ত মানুষেরাও অসুস্থ অবস্থায় বা নেশার তাড়নায় অপরাধ করে বসে। এইসব অপরাধীকে সময়মত পদক্ষেপ নিয়ে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কোনও কঠিন কাজ নয়।

আবার আমাদের ভুলের জন্যও অনেক “হঠাৎ করে বসা কোনও অপরাধের আসামীকে” পেশাদার অপরাধী বানিয়ে ফেলি।

পুলিশের কাছে অপরাধীর তালিকা সম্বলিত জাবদা খাতা আছে। তাতে সব রকম অপরাধীর নাম-ঠিকানা লেখা আছে।

যখন কোনও বিশেষ অভিযান, যেমন পুজোর আগে বা বাংলা বন্ধ কিংবা ওই জাতীয় প্রয়োজনে আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে অপরাধী ধরার অভিযান শুরু করা হয়, তখন পুলিশ ওই জাবদা খাতাটা ব্যবহার করে লাইন দিয়ে আসামী ধরে নিয়ে আসে।

অপরাধীদের গ্রুপ বা কোনরকম বিভাগ না করেই পাইকারি ধরা হয়। সেই অভিযানের জালে যেমন পেশাদার অপরাধীরা ধরা পড়ে, তেমনই ধরা পড়ে হঠাৎ কোনও অন্যায় করে ফেলা বা আবেগতাড়িত হয়ে অপরাধ সংঘটিত করা কোনও পুরনো আসামী, যে কিনা স্বাভাবিক সুস্থ জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সংগ্রাম শুরু করেছে।

বারবার তারা পুলিশের অন্ধ অভিযানের জালে ধরা পড়ে এবং জেলে গিয়ে পেশাদারদের সঙ্গে মিশে, একসময় তারাও পেশাদার হয়ে যায়।

কারণ বারবার অকারণে ধরা পড়ার জন্য তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং ধরেই নেয় যে, পুলিশ তাকে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দেবে না। আর ফিরতে যদি নাই দিতে চায়, তবে আর অযথা চেষ্টা করে লাভ কি? তার চেয়ে শুরু করা যাক পেশাদারদের জীবন। আর জেলে বারবার যাওয়ার ফলে পেশাদার অপরাধীদের সঙ্গে তাদের পরিচয় ভালই হয়ে যায়। সুতরাং সে পথে যেতে তখন তাদের কোন অসুবিধাই হয় না।

এই অন্ধের মত অপরাধীদের চরিত্র বিশ্লেষণ ছাড়াই বারবার একটা সাজান মামলায় বা মামলা সম্পর্কিত অর্থাৎ কেস কানেকশানের নামে পেশাদারি অপরাধী ছাড়া অন্য অপরাধী ধরে এনে তাকে জেলে পাঠিয়ে পুরোপুরি সমাজবিরোধী বানিয়ে ফেলার ভুল পদ্ধতির জন্য অনেককে আমরা অন্ধকার জগতে ঠেকে দিয়েছি বা এখনও দিচ্ছি।

আমাদের এই অন্ধ প্রক্রিয়ার মধ্যে অজান্তে হাকিম সাহেবদেরও পরোক্ষ মদত থাকে। কারণ হাকিম সাহেবরা এইসব কেস কানেকশানের অপরাধীদের যখন পুলিশের হেফাজতে বা জেলের ভেতর পাঠানর নির্দেশ দেন, তখন কোনরকম বিচার বিশ্লেষণই করেন না। তিনি একটাই লাইন লিখে দেন, তা হল, “সন্দেহ হচ্ছে এই অপরাধের সাথে সে জড়িত।” সুতরাং যাও পুলিশ হাজতে বা জেলের অন্দরমহলে।

এইসব কার্যকলাপে অপরাধী বাড়ে, কমে না। আসলে পুলিশ বাহিনী নিজে যদি নিজের শক্তি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল হয় এবং অপরাধী ধরবার সমস্ত জাল যদি তার করায়ত্ব থাকে তখন তারা এই চোখ কান বোঁজা কর্মগুলো করে না, যখন তারা নিজেদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে তখনই এই ভুলভ্রান্তিগুলো করে বসে। একটা ফুটবল দল যখন খেলায় বিরোধী পক্ষকে হারাতে না পেরে মারপিট করে খেলায় জিততে চায়, এটাও ঠিক তেমনি। দুর্বল মানসিকতাই দিকবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে অম্যকে আঘাত করার প্ররোচনা দেয়।

আগে কলকাতা পুলিশের একটা ঐতিহ্য ছিল যে অপরাধীদের নতুন করে সামাজিক জীবন শুরু করার সুযোগ দেওয়া, তাকে সাহায্য করা যাতে সে আর অপরাধ না করে।

আমরা এমন বহু হঠাৎ অপরাধ করে ফেলা বা জেলফেরত আসামীকে জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছি। একবার তো আমি এক ডাকাতকে ভারতবর্ষের এক নামকরা শিল্পপতির বাড়িতে দারোয়ানের কাজ দিয়েছি, সে সেখানে দারুণভাবে সফল, এবং নিজেকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে সুস্থ জীবনে ফিরে এসেছে সে।

আসলে বক্তৃতা দিয়ে নয়, প্রকৃতপক্ষে দরদ দিয়ে সমস্যা বুঝতে হবে, তার সমাধান করতে হবে। প্রতিনিয়ত সেইসব “মূলস্রোতে ফিরতে চাওয়া” প্রাক্তন আসামীদের খোঁজখবর রাখতে হবে। তার জন্য সময় দিতে হবে। নিজের বদনামের ভয়ে পিছিয়ে না গিয়ে, আবার যাতে না সে অপরাধী হয়ে যায় তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

কলকাতা পুলিশের আগের এই ঐতিহ্য ক্রমশ বিলুপ্তির পথে, তার জন্য অনেক কিছুকেই দায়ী করা যায়। কিন্তু সেই সব দোষের হিসাব-নিকাশ না করে শুধু এটুকুই বলা যেতে পারে, নেতৃত্বে যাঁরা থাকেন তাঁরা যদি সচেতন পদক্ষেপ ঠিক সময়ে নিতে পারেন, পত্রপত্রিকার বিবৃতিতে মনোযোগ না দিয়ে গঠনমূলক কাজে তৎপর হন, তবে আবার কলকাতা পুলিশ তার হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারে।

গোষ্ঠ পালেরা খালি পারে যা ফুটবল খেলতেন তা কি আজকের আধুনিক সরঞ্জাম সজ্জিত ও ট্রেনিং পাওয়া খেলোয়াড়রা পারছেন? কিংবা সত্যজিৎ রায় যেমন ইউরোপের বাতিল করা ক্যামেরা দিয়ে ছবি করে আন্তর্জাতিক পুরস্কার নিয়ে এসেছেন, তেমন কি এখন আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে অন্যেরা পারছেন? না, পারছেন না।

সব কিছুর পেছনেই চাই মানসিকতা। নিজের কাজের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, আন্তরিকতা। চটজলদি নামের পেছনে ছুটে স্পনসরশিপের দৌলতে হয়ত ক্ষণস্থায়ী অর্থ ও নাম করা যায়, কিন্তু আখেরে তা সমাজের কোনও উপকারেই লাগে না।

কলকাতা পুলিশের এই হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা কারও একার দ্বারা সম্ভব নয়। সামগ্রিক চিন্তা ও কাজের মধ্য দিয়েই তা আনতে হবে।

সমাজে লোভ বাড়ছে, লোভী বাড়ছে, তার সাথে সাথে অপরাধও বাড়ছে, অপরাধী বাড়ছে।

আশির দশকের প্রথম দিকে একদিন সকাল সাড়ে এগারটা নাগাদ খবর এল, একটু আগেই ব্যাঙ্ক অফ মহারাষ্ট্রের চৌরঙ্গি শাখায় ডাকাতি হয়ে গেছে।

আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোড ও জওহরলাল নেহরু রোডের সংযোগস্থলের কাছেই ব্যাঙ্কের শাখাটা।

অফিসের সময়, প্রচণ্ড ব্যস্ত রাস্তার ওপর ব্যাঙ্ক। দুর্ধর্ষ ডাকাতির খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমরা ছুটলাম। ব্যাঙ্কের লোকজনের কাছ থেকে জানতে পারলাম, মাত্র চারজন যুবক, বছর তিরিশের আশেপাশে তাদের বয়স, ডাকাতি করেছে। ডাকাতরা লাখ পাঁচেক টাকা নিয়ে চলে গেছে।

ডাকাতদের হাতে রিভলবার, পিস্তল ছিল। ব্যাঙ্কের বাইরে গাড়ি ছিল, সেই গাড়িতেই ডাকাতরা পালিয়েছে। কেউ সেই গাড়ির নম্বর বলতে পারল না।

বললেও কিছু হত কি না জানি না। কারণ ডাকাতরা সঠিক নম্বর লাগিয়ে তো আর সাধারণভাবে ডাকাতি করতে আসে না। এই ব্যাপারে অনন্ত সিংহের দলের লোকেরা দারুণ পারদর্শী ছিল। যদিও ডোমজুড়ের ব্যাঙ্কে ডাকাতরা গাড়ির সঠিক নম্বর না পাল্টেই ডাকাতি করেছিল এবং সেই সূত্র ধরেই তারা ধরা পড়েছিল।

কিন্তু সেটা একেবারে একটা ব্যতিক্রম। নিয়মের ব্যতিক্রমও হয়, তাই গাড়ির নম্বর নেওয়াটা ও সেটা মিলিয়ে দেখাটা আমাদের একটা রুটিন কাজের মধ্যে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীকে জেরা করা, ডাকাতি করে কোনদিকে পালিয়েছে বা গাড়ির রঙ কি ছিল জানা, সবই রুটিন কাজের মধ্যে পড়ে, প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ এক হয় না। একেক জন একেক রকম বলে। তবু একটা সিদ্ধান্তে আসতে এইসব বিবরণ সাহায্য করে বৈকি।

ডাকাতিটার ধরন দেখে আমাদের চেনা পুরনো কোনও ডাকাতির মত মনে হল না। সাধারণভাবে ডাকাতরা সেইসব ব্যাঙ্ক ডাকাতি করার জন্য বাছে যা একটু নির্জন জায়গায় অবস্থিত এবং যেখানে যানবাহনের জটিলতা কম। কারণ ডাকাতি করে পালানর পথটা যাতে মসৃণ হয়, সেদিকে তারা খেয়াল রাখে।

একবার ট্রাফিক জ্যামে আটকে গেলে ধরা পড়ে যেতে পারে, সেজন্যই তারা একটু নিরাপদ রাস্তা খোঁজে। তার ওপর ডাকাতরা সংখ্যায় ছিল মাত্র চারজন। সুতরাং তারা যে অপরিকল্পিত ঝুঁকি নিয়েছে, তাতে কোন সন্দেহই নেই। তাছাড়া ব্যাঙ্কটা নির্জন জায়গায় নয় এবং রাস্তাও ফাঁকা নয়, তবু ডাকাতরা এই ব্যাঙ্কটা কি করে ডাকাতির জন্য পছন্দ করে নিল সেটাও আশ্চর্যের বিষয়। তাতে এই সিদ্ধান্তে আসা যায়, ডাকাতরা ওই দুটো ব্যাপার মাথায় রাখেনি। অর্থাৎ ডাকাতরা খুব পোক্ত দল নয়, এটা হাতে খড়ি।

তবে এরকমই যে হবে তেমন কোনও কথা নয়। এটা স্রেফ অনুমান। কিংবা ডাকাতরা এই ব্যাঙ্কে খুব যাতায়াত করত, খুব চেনা, তাই এই ব্যাঙ্কটা ডাকাতির পক্ষে তাদের উপযুক্ত জায়গা ভেবেছে, এমনও হতে পারে। ডাকাতরা ভল্টের দিকে যায়নি, শুধুমাত্র ক্যাশ কাউন্টারগুলোর থেকে যা পাওয়া গিয়েছে তা নিয়ে গেছে।

ব্যাঙ্কে তদন্ত সেরে আমরা লালবাজারে এসে আমাদের পর্যবেক্ষণ যন্ত্রগুলোকে চারদিকে সজাগ করে দিলাম। তারা তাদের কাজ শুরু করে দিল। সে সময় ডাকাতদের মধ্যে একটা অলিখিত নিয়ম ছিল, কলকাতার বাইরে, বিশেষ করে উত্তর চব্বিশ পরগনায় ডাকাতি করলে ডাকাতরা কলকাতায় তাদের পরিচিত বন্ধুদের কাছে চলে আসত, আবার কলকাতায় ডাকাতি করলে তারা উত্তর কিংবা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় তাদের বন্ধুদের আস্তানায় চলে যেত।

এমনও হয়েছে, হয়ত উত্তর চব্বিশ পরগনায় একটা ডাকাতি করে কলকাতায় গোপন আস্তানায় দিন কাটাচ্ছে, তার মধ্যেই হঠাৎ কলকাতায় একটা ডাকাতি করে অন্য জায়গায় পালিয়ে গেল। যেদিন ডাকাতি হত, সেদিন থেকে রেড লাইট এলাকাগুলো ও বার রেস্তোঁরায় নজর বাড়িয়ে দিতাম, কারণ সাধারণ ডাকাতরা টাকা ওড়াতে এইসব জায়গায় আসত।

ওই ব্যাঙ্ক ডাকাতির পরদিন অনেক রাতে খবর পেলাম চিত্তরঞ্জন অ্যাভিন্যুর রেড লাইট এলাকায় দুটো অপরিচিত ছেলে অনেক টাকা নিয়ে এসে একটা বাড়িতে ফূর্তি করছে। আমি আমাদের চারজন সহকর্মীকে নিয়ে ছুটলাম। আমাদের একজন সহকর্মী ছিল, সে একসময় বটতলা থানায় ছিল, এবং তার ওই সব বাড়িগুলো একদম নখদর্পণে। তাকেও গাড়িতে তুলে নিলাম।

যে বাড়ির কথা শুনে এসেছি সেই বাড়ি ও এলাকার অন্য বাড়িগুলোকে সে ভালভাবেই চেনে।

বাড়িটার একটাই দরজা, সেই দরজা বন্ধ করে দিলে অন্য কোনও রাস্তা নেই পালিয়ে যাওয়ার। রাতের রাস্তা ফাঁকা, মেট্রো রেলের খোঁড়াখুঁড়িতে রাস্তার যা হাল, তাতে ওই এলাকায় দিনের বেলা দ্রুত পৌঁছন যায় না। বড় রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করলাম। বড় রাস্তা ফাঁকা থাকলেও ওই অঞ্চলের গলিগুলো কিন্তু রাতের বেলা চঞ্চল থাকে, ব্যস্ত থাকে।

বটতলা থানার ভ্যান কয়েকবার ওইসব অঞ্চলে হানা দেয়। অপ্রীতিকর কোনও ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য দৈনন্দিন রুটিন টহলদারির ব্যবস্থা আছে। আমি বড় রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বসে আছি, আমার সহকর্মীরা গাড়ি থেকে নেমে ওই বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল।

প্রায় আধ ঘণ্টা পর ফিরে এসে আমার এক সহকর্মী বলল, “স্যার, ওদের পাইনি, তবে অন্য একজনকে পেয়েছি।”

আমি গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কাকে পেয়েছ?”

অন্য এক সহকর্মী হাসতে হাসতে পেছন দিক থেকে একটা মানুষকে আমার সামনে নিয়ে এসে হাজির করাল। লোকটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তো দেখেই চিনতে পেরেছি।

বললাম, “তুমি? তুমি এখানে কি করছ?”

লোকটা বলল, “একটু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে এখানে এসেছিলাম।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তা প্রায়ই আস নাকি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে?” সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। বুঝলাম, অভিজ্ঞতার ঘাটতি পড়লেই বাবু ছুটে এখানে চলে আসেন। আমি আর কি বলব? বললাম, “তা যাও, আজকের অভিজ্ঞতার কথাটা ফলাও করে কালকের কাগজে লিখে দাও, আমরা এখন চলি।”

গাড়িতে আমাদের সহকর্মীরা উঠে বসেছে। গাড়ি ছাড়ার আগে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তা তুমি এখন কোথায় যাবে?”

লোকটা বলল, “আমি ঠিক চলে যাব।”

বললাম, “নেশা তো ভালই করেছ, এত রাতে এদিক ওদিক না ঘুরে, বেঘোরে প্রাণটা না দিয়ে এখানেই আরও অভিজ্ঞতা নাও, কাল সকালে বরং বাড়ি যেও।”

লোকটা বলল, “সেই ভাল।”

আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল। লোকটা দাঁড়িয়ে রইল। লোকটা আমাদের সবারই খুব পরিচিত। কলকাতার এক নামজাদা পত্রিকার সাংবাদিক। লালবাজারে খবরের খোঁজে প্রায়ই আসে, সেই সূত্রে আমাদের সাথে আলাপ। সাংবাদিকতায় তার বেশ নামও আছে। তবে কিছু কিছু সাংবাদিক আছে না, যারা নিজেদের সবজান্তা মনে করে! এ সেই শ্রেণীর। সব জানতেই বোধহয় তার এখানে আগমন। আর তার ফলে আজ আমাদের কাছে মাথা নিচু হয়ে গেল।

গাড়িতে ফিরতে ফিরতে আমার এক সিনেমা প্রযোজক বন্ধুর কথা মনে পড়ল। তাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তুমি হঠাৎ এই লাইনে ব্যবসা করতে গেলে কেন? ওই লাইনের তো ভীষণ বদনাম, সবাই নাকি নেশাগ্রস্ত, তারপর অন্য দোষও সবার আছে।”

প্রযোজক বন্ধুটি হেসে বলেছিল, “ভুল, একেবারে ভুল ধারণা, আচ্ছা এই যে শ’য়ে শ’য়ে ব্রথল আছে, সেখানে হাজার হাজার যৌনকৰ্মী আছে, তাদের চলে কি করে? সেখানে কি শুধু সিনেমার লোকজন যায়? খোঁজ নিয়ে দেখুন, যত লোক ওখানে যায় তার শতকরা একভাগ লোকও ফিল্ম লাইনের লোক নয়, বরং অন্য পেশার লোক, আপনাদের পেশার লোকও আছে। আর মদ খাওয়ার কথা বলছেন? মদ কোম্পানিগুলো যে গ্যালন গ্যালন মদ তৈরি করছে, তা কি শুধু আমাদের লাইনের লোকেরাই খাচ্ছে, অন্যেরা খাচ্ছে না? খাচ্ছে, অনেক বেশি খাচ্ছে, কিন্তু বদনামটা আমাদের, কারণ ফিল্ম লাইনের লোকেরা, বিশেষ করে শিল্পীরা পাবলিক পার্সন, সাধারণ লোকজন তাঁদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অতিরিক্ত মাত্রায় কৌতূহলী, তাঁদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতে দারুণভাবে উৎসাহী ও আগ্রহী, তাই এই লাইনের কোনও ঘটনা বা দুর্ঘটনা এমনভাবে রটে যে সেটা তিল থেকে তাল নয় একেবারে মহাতাল হয়ে যায়।”

আজ আমি সেই প্রযোজক বন্ধুটির কথাটা কতটা খাঁটি, তা মর্মে মর্মে বুঝতে পারলাম।

যদিও জানি এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কারণ, তখন আমাদের অনেক সাংবাদিক বন্ধু ছিল, তাঁদের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক ছিল, তাঁদের অনেকের সঙ্গেই আমাদের দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক ছিল। তাঁরা যেমন আমাদের কাছ থেকে খবর নিতে আসতেন আমরাও তাঁদের মাধ্যমে অনেক খবর পেয়ে যেতাম। তবে আমাদের থেকে তাঁরা কখনও আগাম কোনও খবর পেতেন না।

কোন ঘটনার তদন্ত করতে আমরা কিভাবে অগ্রসর হচ্ছি তাঁরা জানতে উৎসুক থাকতেন স্বাভাবিকভাবেই, কিন্তু আমাদের কারও কাছ থেকেই আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপের বিন্দুমাত্র আন্দাজও তাঁরা পেতেন না।

পেলে তো তাঁরা পত্রিকায় নিজেদের কৃতিত্ব দেখাবার জন্য আগাম প্রকাশ করে দেবেন এবং আসামীরা সতর্ক হয়ে যাবে, আমাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটবে। কিন্তু এই পদ্ধতি পরবর্তীকালে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সাংবাদিকরা আগাম খবর পেয়ে যেতে এবং তা কাগজে প্রকাশ হয়ে যেতে তদন্তের ব্যাঘাত ঘটতে দেখলাম। খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। এটা আসলে নিজেদের মধ্যে কর্মের যোগাযোগের অসারতাই প্রমাণ করে।

সেদিন রাতে ফিরে যে যার বাড়িতে চলে গেলাম। পরদিন সোর্সদের নির্দেশ দিলাম আরও সক্রিয় হতে। আমরাও বসে নেই, নানান দিকে চিন্তাভাবনা করে খোঁজখবর নিচ্ছি।

কে হতে পারে, কারা হতে পারে। পুরনো ডাকাতদল যারা জেলের বাইরে আছে, তাদের ভেতরে খবর নিচ্ছি, না, তেমন কাউকে পাচ্ছি না।

ডাকাতির দিন পাঁচেক পর সোর্সের মাধ্যমে খবর পেলাম বিরাটির মাইকেল নগরের পুরনো ডাকাত তিল দেবু হঠাৎ খুব টাকাপয়সা খরচা করছে। একটা বেকার নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে হঠাৎ দুহাতে টাকাপয়সা খরচা করছে, তা বন্ধুমহলে এবং এলাকায় একটু গুঞ্জন তো হবেই। এবং সদ্য একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়ে গেছে, তাতে তার চালচলন তো আমাদের পর্যবেক্ষণ যন্ত্রে ধরা পড়বেই। খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমরা ব্যবস্থা নিলাম।

বিরাটিতে তার বাড়ি সেদিন রাতেই ঘিরে ফেললাম। তিল দেবুকেও পেয়ে গেলাম। সাথে ষাট হাজার টাকা।

লালবাজারে নিয়ে আসার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দেবু স্বীকার করল ডাকাতির কথা। তার সঙ্গী কে কে ছিল তাও জানতে পারলাম। তিল দেবু যে ধরা পড়েছে সেই খবর যাতে বেশি প্রকাশ না হয়ে পড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক ছিলাম, যাতে তার সঙ্গীরা সজাগ হয়ে পালিয়ে যেতে না পারে।

সবচেয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম তাদের নেতার খবর পেয়ে। ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ার, ফার্স্ট ক্লাস এম. টেক। সে বেলঘরিয়ার একটা স্কুলে চাকরি করে। তার দাদা ডাক্তার, কলকাতার নামকরা ক্যান্সার স্পেশালিস্ট। ছেলেটার স্ত্রী সুন্দরী, বিদূষী, জ্যাঠামশাই একসময় বেলঘরিয়ার মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। বেলঘরিয়ায় তাঁদের পরিবারকে সবাই এক ডাকে চেনে।

সেই ছেলে হঠাৎ ডাকাতি করতে গেল কেন? ছেলেটি অঞ্চলে সি. পি. আই. (এম)-র মাঝারি ধরনের নেতা ছিল। তাছাড়া ওই পার্টির বিরাট বিরাট তাবড় সব নেতাদের স্নেহধন্য। তিল দেবুকে যেদিন গ্রেফতার করলাম, তার পরদিনই ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে সেই নেতার সব খবর আমরা পেয়ে গেলাম।

যে স্কুলে সে চাকরি করত, ডাকাতির দিন থেকে সেখানেও অনুপস্থিত। কোর্টে তিল দেবুকে হাজির করিয়ে, ওর সঙ্গীদের নামেও পরোয়ানা বের করে নিলাম। কারণ বেলঘরিয়ার সেই ডাকাতির নেতা সূর্য মুখার্জির বাড়িতে আমরা হানা দেব। গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া যদি ঢুকতে না পারি, তাই সেই পরোয়ানা নিয়ে চললাম সূর্য মুখার্জির বাড়ি।

বেলঘরিয়ায় সবাই তাদের চেনে, সুতরাং বাড়ি খুঁজতে আমাদের কোনও অসুবিধাই হল না। বিশাল বাড়ি ঘিরে ফেললাম। সূর্য নেই। স্ত্রী ও তার ছোট্ট মেয়ে কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না। সূর্য রাত সাড়ে দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরছিল ট্যাক্সিতে। বাড়ি পৌঁছনর একটু আগে রাস্তায় অঞ্চলের দুই মাস্তানের কাছ থেকে জানতে পারল বাড়িতে লালবাজার থেকে পুলিশ এসেছিল। সে স্ত্রী, মেয়েকে বাড়িতে পাঠিয়ে নিজে পালাল। সূর্যের ঘর খুঁজলাম, না কোনও আলো পেলাম না। আমরা অন্যদের বেশি বিরক্ত না করে ওই বাড়ি থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম।

সূর্য সম্পর্কে খোঁজ করতে শুরু করলাম। খোঁজ করতে করতে জানতে পারলাম, সূর্যের প্রচণ্ড রেসের নেশা হয়ে গিয়েছিল। ঋণের বোঝার ফলে সে একদম অক্টোপাসের জালে ফেঁসে গিয়েছিল। সেই ঋণ থেকে মুক্তি পেতেই ডাকাতির দল গড়ে ডাকাতি করেছে।

ওর বাড়িতে আমরা ওর কোন ফটো পাইনি, সেগুলো বোধহয় সে সরিয়ে ফেলেছিল। আমরা খুঁজতে খুঁজতে ওর এক আত্মীয়কে ধরলাম, তার ময়দান মার্কেটে দোকান ছিল, তার কাছ থেকে আমরা সূর্যের একটা ফটো যোগাড় করলাম। কিন্তু ফটো পেলেই তো হবে না, আমরা চাই আসল লোকটাকে। সোর্সদের সক্রিয় করা হল আরও।

একদিন রাত দশটা নাগাদ দমদম বিমানবন্দরের কাছ থেকে আমার এক সোর্সের ফোন এল। ফোনে জানাল, বিমানবন্দরের কাছে এক বাড়িতে সে সূর্যকে দেখেছে। আমায় বলল তক্ষুণি চলে যেতে। আমি জেনে নিলাম সে কোথায় আছে। তাকে সেখানে থাকতে বলে আমি ফোন নামিয়ে রাখলাম।

সেদিন ছিল বাংলা বন্ধ। দফতর ফাঁকা। ঠিক করলাম আমি একাই যাব। সোর্সের কাছ থেকে সূর্যের আস্তানাটা দেখে নিয়ে দমদম থানায় গিয়ে ওদের থেকে ফোর্স নিয়ে সূর্যকে গ্রেফতার করতে যাব।

সেই অনুযায়ী একটা জিপ নিয়ে ছুটলাম বিমানবন্দরের দিকে। সঙ্গে আছে শুধু আমাদের এক ড্রাইভার।

বন্‌ধের রাত। ফাঁকা। হু হু করে আলো-আঁধারির রাস্তা দিয়ে ছুটল আমাদের জিপ। বেলেঘাটা ফুলবাগান মোড় থেকে বাঁদিকে ঘুরে কিছুটা যেতেই দেখি এক যুবক রাস্তায় দুহাত তুলে ডানদিক বাঁদিক করে পাগলের মত হাত নাড়িয়ে আমাদের থামতে বলছে।

তা দেখে ড্রাইভার বলল, “স্যার।”

বললাম, “দাঁড়াও।”

ড্রাইভার জিপটা যুবকটির সামনে দাঁড় করাতেই সে লাফ দিয়ে আমার কাছে এসে বলল, “স্যার, আমায় বাঁচান।”

প্রশ্ন করলাম, “কেন, কি হয়েছে?”

বলল, “আমার স্ত্রীর বাচ্চা হবে, ব্যথা উঠেছে, প্রচণ্ড কাতরাচ্ছে। এখানে কোনও গাড়ি পাচ্ছি না। যাদের আছে, তারা কেউ আজকে যেতে চাইছে না। অ্যাম্বুলেন্সও পাচ্ছি না।”

জানতে চাইলাম, “আপনার বাড়িটা কোথায়?”

সে পাশের একটা গলি দেখিয়ে বলল, “এই গলির ভিতর, বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি যায়।”

প্রশ্ন করলাম, “আপনার স্ত্রীকে কোথায় নিয়ে যেতে হবে?”

যুবকটি বলল, “রামকৃষ্ণ মিশন সেবা সদনে।

হসপিটালের নাম শুনেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “উরেব্বাস, সে তো অনেক দূর, হাজরায়। আমার তো ভাই এত সময় নেই।”

সে আমার কথা শুনে প্রায় কেঁদেই ফেলল। বলল, “তাহলে কি হবে?”

আমি ভাল করে তার মুখের দিকে তাকালাম। বুঝতে চাইলাম ছেলেটা সত্যি বলছে না মিথ্যা। মনে হল, মিথ্যা বলছে না। ওদিকে সূর্য। সোর্স দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে দুটো প্রাণ। কোনদিকে যাব?

আমি জিপ থেকে নেমে পড়লাম। ড্রাইভারকে বললাম, “যাও ওর স্ত্রীকে নিয়ে এস।” যুবকটিকে বললাম, “জিপের সামনের সিটে বসুন, ওখানেই স্ত্রীকে বসিয়ে নিয়ে আসবেন।”

ড্রাইভার যুবকটিকে নিয়ে জিপ ঢুকিয়ে দিল প্রায়ান্ধকার গলির ভেতর। আমি গলির মুখের কাছে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বেলেঘাটা বিপজ্জনক জায়গা। তাই আমি গলির মধ্যে গেলাম না।

অন্ধকারে একটা পাঁচিল ঘেঁষে এমনভাবে দাঁড়ালাম যাতে ওরা গলির থেকে বের হয়ে আমাকে দেখতে না পায়, কিন্তু আমি সব দেখতে পাব। কোথায় কোন ফাঁদ পাতা থাকবে, কে আগের থেকে বলতে পারবে? রিভলবার একটা আছে সঙ্গে, কিন্তু তা কি আর যথেষ্ট?

মিনিট দশেকের মধ্যে জিপের আওয়াজ শুনতে পেলাম, অর্থাৎ ফিরে আসছে। হেড লাইটের আলো লাফ দিয়ে বড় রাস্তার ওপর পড়ল। জিপও বড় রাস্তায় পড়ে দাঁড়িয়ে গেল।

ড্রাইভার আর যুবকটি চারদিকে তাকিয়ে আমায় খুঁজছে। ততক্ষণে আমি যা দেখার দেখে নিয়েছি। যুবকের স্ত্রী জিপের সামনের সিটে যুবকের গায়ে আধশোয়া হয়ে তাকে জাপটে ধরে আছে। যুবকটিও তার স্ত্রীকে হাত দিয়ে ধরে রেখেছে। অল্পবয়সী ভদ্রমহিলার শরীরই জানান দিচ্ছে, তার স্বামী আমাকে মিথ্যা বলেনি।

আমি মুহূর্তে সব দেখে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে চট করে জিপের পেছনে উঠে ড্রাইভারকে বললাম, “গাড়ি ঘোরাও।”

ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ছুটল। ভদ্রমহিলা ছটফট করছেন। যুবকটি আমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। সেদিকে কান না দিয়ে আমি ডাইনে-বাঁয়ে করে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিতে থাকলাম। বেলেঘাটার কাছেই আমার এক পরিচিত ডাক্তারের নার্সিং হোম আছে। আমি সেই নার্সিং হোমের সামনে গাড়ি দাঁড় করাতে যুবকটি বলে উঠল, “দাদা, এখানে?”

আমি জিপ থেকে নেমে তাকে বললাম, “হ্যাঁ এখানে।” তারপর সোজা নার্সিংহোমের সদর দরজায় গিয়ে কলিং বেল বাজালাম। কোনও সাড়া নেই। চার পাঁচবার বাজানর পর ভেতর থেকে একটা ছেলের গলা শুনতে পেলাম, “কে?”

বললাম, “খুলুন, একটা পেসেন্ট এনেছি।”

ভেতর থেকে উত্তর এল, “ডাক্তারবাবু নেই।”

আমি ডাক্তারের নাম করে বললাম, “ওকে গিয়ে বলুন লালবাজার থেকে একজন এসেছে।” ওদিকের আওয়াজ থেমে গেল।

মিনিট পাঁচেক পর দরজা খুলল ডাক্তার নিজেই। বললাম, “কি তুমি না কি নেই?”

ডাক্তার হেসে বলল, “বধের দিন, কোথায় কোন উৎপাত নিয়ে এসে হাজির হবে, তাই আমার লোককে বলে দিয়েছি, কেউ এলে বলবি আমি নেই। তা তুমি কি জন্য?”

বললাম, “একটা পেসেন্ট নিয়ে এসেছি, ভীষণ জরুরি, ডেলিভারি কেস।”

ডাক্তারের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, বলল, “আমি তো গাইনি নই।”

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই বললাম, “কি তোমার গাইনি? আগে তো আমরা দেশের বাড়িতে দাই-মার হাতে হয়েছি, এখন যতসব শুনি গাইনি-ফাইনি। তুমি তো ডাক্তার, আর নার্সও আছে তোমার এখানে। তাতেই হবে।”

ডাক্তার বলল, “তোমার সবটাতেই জোর, সিজার কেসও হতে পারে, পেসেন্টের কিছু হলে তখন তুমি আবার আমাকেই ধরবে।”

বললাম, “এত বুঝি না, যা হয় একটা ব্যবস্থা কর, আমার তাড়া আছে।”

ডাক্তার কি ভাবল, বলল, “ঠিক আছে নিয়ে এস তোমার পেসেন্টকে।” আমি রাস্তায় দাঁড়ান জিপের কাছে গেলাম। ডাক্তার একটা ছেলের হাতে স্ট্রেচার পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি আর যুবকটি মিলে তার স্ত্রীকে স্ট্রেচারে বসিয়ে নার্সিংহোমের ভেতর নিয়ে গেলাম।

ডাক্তার নার্সদের কি বলতে তারা পেসেন্টকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের দিকে চলে গেল।

“তোমার ডাক্তার একটা ফোন করছিল। কথা শেষ করে আমাকে বলল, গাড়িটা কিছুক্ষণের জন্য পাওয়া যাবে? পুলিশের জিপ, রাস্তায় কেউ কিছু বলবে না।”

জিজ্ঞেস করলাম, “কেন, কোথায় যাবে?”

সে বলল, “একজন গাইনি ডাক্তারকে নিয়ে আসব, কাছেই থাকে। আমি ফোনে কথা বলে নিয়েছি।”

বললাম, “কে যাবে সঙ্গে?”

ডাক্তার তার এক কর্মচারীকে দেখিয়ে বলল, “এই ছেলেটা যাবে, তোমাকে যেতে হবে না।”

আমি ছেলেটাকে নিয়ে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে এলাম। ড্রাইভার তাকে নিয়ে ডাক্তার আনতে চলে গেল। আমার বন্ধু ডাক্তারও ভেতরে চলে গেল।

যুবকটি এতক্ষণ আমার পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল, ডাক্তার চলে যেতে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “দাদা, এখানে খরচ কেমন হবে?”

সূর্য তখন আমার মাথায়। ছেলেটার প্রশ্ন শুনে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “আগে স্ত্রীকে বাঁচান, তারপর খরচের কথা চিন্তা করবেন।”

ছেলেটা আমার মুখ দেখে চুপ করে গেল। মিনিট পাঁচ-সাত পর ডাক্তার আমাকে এসে জিজ্ঞেস করল, “পেসেন্ট তোমার কে হন?”

প্রশ্ন শুনে বুকের ভেতর ধক করে উঠল, জানতে চাইলাম, “কেন?”

ডাক্তার বলল, “না, নাম, ঠিকানা সব লিখতে হবে তো।”

ওর কথা শুনে বুকের ভারটা নেমে গেল, বললাম, “আমার পরিচিত।” তারপর যুবকটিকে দেখিয়ে বললাম, “এর স্ত্রী।”

ডাক্তার তাকে বলল, “চলুন, সব লিখিয়ে খাতায় সই করে যান।”

ওরা দুজন নার্সিংহোমের অফিস ঘরের দিকে চলে যেতে আমি সেখান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পর যুবকটিও আমার পাশে এসে দাঁড়াল। ওর চোখ মুখ দেখেই মনে হচ্ছে, দুশ্চিন্তায় কাহিল।

বললাম, “ভয় নেই। সব মা-বাবার জীবনেই এই সময়টা আসে।”

আমার কথা শুনে সে কেঁদে ফেলে বলল, “কিন্তু আজকের দিনটাতে আপনি না হলে হত না, আপনি তখন না এলে, আমায় না বাঁচালে কি যে হত?”

বললাম, “চুপ করুন ভাই, সাহস রাখুন।”

গাড়ির আওয়াজ পেতেই তাকিয়ে দেখলাম, একটা জিপ আসছে। ভাবলাম, আমাদেরটা তো?

হ্যাঁ। জিপ এসে নার্সিং হোমের সামনে দাঁড়াল। ডাক্তার নেমে সোজা ঢুকে গেল ভেতরে।

আমার কাজ শেষ, এবার আমি সূর্যকে ধরতে যাব। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে বলে যাই।

ভেতরে ঢুকে একজন নার্সকে বললাম ডাক্তারকে একটু ডেকে দিতে। নার্স ফিরে এসে জানাল, “আপনাকে আর মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করতে বলেছে।”

কি করি? এতক্ষণ যখন গেছে তখন আর নয় পাঁচ মিনিট যাক।

ডাক্তার সত্যিই মিনিট পাঁচেক পর আমার কাছে এল। একটা প্রেসক্রিপশান ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এই ওষুধগুলো কিনে নিয়ে এস। শোন, এদিকে কোনও দোকান এত রাতে খোলা পাবে না। একটা দোকান আছে, যার মালিক দোকানের ওপরের ফ্ল্যাটে থাকে। তাকে তুলে ওষুধগুলো আনতে পার। কিন্তু আমার নাম করবে না।” ডাক্তার দোকানের নামটা জানাল।

যুবকটি বলল, “আমি যাব সাথে?”

বললাম, “না, আপনি থাকুন।”

যুবক তাড়াতাড়ি ওর পার্স বের করে টাকা দিতে চাইল। বললাম, “থাক, একসঙ্গে বিল হলে নেওয়া যাবে।”

রাত তখন প্রায় বারটা বাজে। আমি ছুটে এসে জিপে উঠে ড্রাইভারকে বললাম, “চল।” ড্রাইভার গাড়ি ছোটাল। আমরা সেই দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। জিপ থেকে নেমে সেই ফ্ল্যাট বাড়ির দারোয়ানকে খুঁজে বের করে তার কাছে জেনে নিলাম দোকানদার ভদ্রলোক কোন ফ্ল্যাটে থাকেন। পুলিশের জিপ দেখে দারোয়ান গেট খুলে দিলে আমি সেই ফ্ল্যাটের দরজায় বেল টিপলাম।

দরজা খুললেন এক ভদ্রলোক। বছর চল্লিশেক বয়স হবে। তাকে প্রশ্ন করলাম, “নিচের মেডিকেল শপটা কি আপনার?”

আমার প্রশ্ন শুনেই দরজাটা বন্ধ করতে করতে বলল, “এখন দোকান খোলা যাবে না।”

ততক্ষণে আমি দরজার ফাঁক দিয়ে আমার বাঁ হাতটা ঢুকিয়ে দিয়েছি, যাতে দরজাটা বন্ধ না করতে পারে।

ওপাশ থেকে ভদ্রলোক বললেন, “এ কি মাস্তানি নাকি? জবরদস্তি? রাত বারটায় দোকান খুলব!”

হাত আমার ঢোকানই। বললাম, “দরজাটা খুলুন, বলছি।”

লোকটা কোনমতে একটু ফাঁক করতে আমি বাধ্য হয়েই আমার ব্রহ্মাস্ত্রটা ছুঁড়লাম। আমি আমার বদ “নামটা বললাম। দেখলাম, বদ “নামটা” শুনে একটু কাজ হয়েছে। তখন বললাম, “একটা ডেলিভারি কেস, দুটো জীবনের ব্যাপার, দয়া করে ওষুধগুলো দিয়ে দিন।”

লোকটা আর কোন কথা না বাড়িয়ে ভেতরে চলে গেল। তারপর হাতে একগোছা চাবি নিয়ে এসে বলল, “চলুন।”

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে বলল, “আসলে, জানেন তো কি সময় পড়েছে, যে সে এসে জ্বালাতন করে। তাই, একবার দোকান বন্ধ করলে আর খুলি না।”

দোকানের পেছন দিক দিয়ে দরজা আছে। আমাকে সেখান দিয়ে নিয়ে গিয়ে, দোকানে ঢুকে, প্রেসক্রিপশনটা নিল। একটা একটা করে ওষুধ বের করে এক জায়গায় রেখে বলল, “একটা ওষুধ নেই।”

কি আর করি, তাকে টাকা পয়সা দিয়ে আমি জিপে এসে উঠে চললাম নার্সিংহোম।

ডাক্তারকে ওষুধগুলো দিয়ে বললাম, “একটা ওষুধ পাওয়া যায়নি, পরে এসে দেখছি।” আমার একটু তাড়া আছে, ঘুরে আসছি। নার্সিংহোম থেকে ছুটে বের হতে হতে যুবকটিকে বললাম, “আপনি থাকুন, আমি ঘুরে আসছি।”

জিপ এবার দ্রুত ছুটল বিমানবন্দরের দিকে। যেতে যেতে ভাবছি, “সত্যিই এই বন্ধের দিনে রোগীদের কি দুর্দশা হয়, ভুক্তভোগীরা ছাড়া ক’জন বোঝে? বন্ধ যাঁরা ডাকেন, তাঁরা বলবেন, অ্যাম্বুলেন্সকে তো বন্ধের আওতার বাইরে রাখা হয়। আরে, তাঁরা কি জানেন না, সারা পশ্চিমবাংলায় কটা অ্যাম্বুলেন্স আছে। তাতে কটা রোগীর সেবা করা যায়?”

বিমানবন্দরের কাছে নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি দাঁড় করাতে, অন্ধকার থেকে আমার সোর্স বের হয়ে এল।

সে এসে আমায় বলল, “এত দেরি করলেন স্যার।”

বললাম, “আগে চল বাড়িটা দেখে আসি, তারপর তোর কথা শুনব।”

সে বলল, “কোথায় যাবেন? সূর্য তো ঘণ্টাখানেক আগে সেই বাড়ি থেকে সাইকেলে চড়ে বিরাটির দিকে চলে গেছে। কোথায় গেছে কিছুই বলতে পারব না।”

আমি হতাশ হয়ে বললাম, “ঠিক আছে, তুই আর কি করবি। খোঁজ রাখ।”

আমি গাড়ি ঘুরিয়ে নার্সিংহোমে এসে শুনলাম, ভদ্রমহিলা একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।

ডাক্তারকে ডেকে বললাম, “যুবকটির কাছ থেকে কোন টাকাপয়সা নিও না, আমি পরে এ ব্যাপারে জানাব।”

গাইনি ডাক্তারকে তার বাড়িতে দিয়ে ফিরতে ফিরতে ভাবলাম, ডাকাত সূর্যকে আজ না ধরতে পারলেও আসল একটা সূর্যকে পৃথিবীতে আনতে শ্রমটা আমার ব্যর্থ হয়নি।

অন্য আর এক জন সেই ডাকাতিতে ছিল। হাওড়ার বালির রাজচন্দ্রপুরের তপন গাইন। তিল দেবুর কাছ থেকে সব খবর নেওয়া হল, তারপর সোর্সের মাধ্যমে তপনের সব খবর আস্তে আস্তে আসতে থাকল। ওই রাজচন্দ্রপুরে সব গাইন পরিবারের বাস। ওখান থেকে যদি ওকে গ্রেফতার করতে যাই তবে সব গাইন পরিবারেরা আমাদের কাজে বাধা তো দেবেই এমনকি দাঙ্গাও লেগে যেতে পারে। গাইন গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচণ্ড একতা।

তার ওপর ওখানে ওরা বংশানুক্রমে বাস করার ফলে ওদের কাছে নানা ধরনের অস্ত্র মজুদ থাকার সম্ভাবনা। সুতরাং গ্রামের ভেতর গিয়ে তপনের বাড়ি থেকে তপনকে গ্রেফতার করার ঝুঁকি নেওয়া যায় না।

সোর্সকে আরও সক্রিয় হতে বললাম। গ্রাম থেকে বেরিয়ে কোথায় কখন যায়, কখন কোথায় গ্রামের এলাকার বাইরে আড্ডা মারে, এইসব খবর যোগাড় করতে বললাম। আমাদের একজন খুবই দক্ষ কনস্টেবল অসিত বেরা তপনকে চিনে এল। সে স্বাস্থ্যবান ঝকঝকে যুবক, দেখলেই বোঝা যায় শরীরে ভাল শক্তি ধরে।

তপনকে দেখার দিন দুই পর খবর পেলাম, সে গ্রাম থেকে প্রতিদিনই সকাল নটা সাড়ে নটা নাগাদ একটা বুলেট মটর সাইকেলে চড়ে বেরিয়ে এসে দিল্লি রোডের ওপর একটা চায়ের দোকানে চা খেতে আসে। ওখানে কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে মটর সাইকেল নিয়ে হাওড়া শহরের দিকে চলে যায়। অবশ্য কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় নয়, আজ এখানে, কাল ওখানে, নিজের মর্জিমত বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা করতে বা আড্ডা মারতে যায় সে।

আমরা ঠিক করলাম, দিল্লি রোডের ওই চায়ের দোকান থেকেই ওকে ধরব। কিন্তু সেখানেও খুবই সতর্কতার মধ্য দিয়ে এগতে হবে, কারণ চায়ের দোকান থেকে তাদের গ্রাম রাজচন্দ্রপুরের দূরত্ব বেশি নয়। একবার যদি খবর সেখানে পৌঁছে যায় তাহলে গ্রামের মানুষ হৈ হৈ করে এসে আমাদেরই আক্রমণ করতে পারে। নিরীহ গ্রামবাসীকে আক্রমণের সময় বোঝানও যাবে না যে তপন একটি ব্যাঙ্ক ডাকাতির আসামী, ওকে এমনি এমনি গ্রেফতার করতে আসিনি। যদি উন্মত্ত গ্রামবাসীরা আমাদের আক্রমণ করে বসে, আমরা তো আর চট করে প্রতিআক্রমণ করে সাধারণ গ্রামবাসীকে আঘাত করতে পারি না, তাই বিশেষ সতর্ক হয়ে তপনকে গ্রেফতার করতে যেতে হবে।

দিনক্ষণ ঠিক হল তপনকে ধরতে যাওয়ার। আমরা দুটো গাড়ি নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক ভোরবেলা ছুটলাম দিল্লি রোডের দিকে।

সেই চায়ের দোকানে যেতে হবে, রাজচন্দ্রপুর ছাড়িয়ে আমরা অনেকটা দূর এগিয়ে গেলাম। আমরা আগেই দেখে রেখেছিলাম, ভোরবেলা ডানলপে কয়লা খালাস করে অনেক লরি।

সেদিন আমরা একটা লরিকে কয়লা খালাস করার পরই ধরলাম। ড্রাইভার তো কিছুতেই রাজি নয় আমাদের সঙ্গে যেতে। তখন প্রায় জোর করে ওকে রাজি করালাম।

লরির ড্রাইভার আর খালাসিকেও সঙ্গে রাখলাম, যাতে ওরা গিয়ে কোনও জায়গায় প্রচার না করতে পারে, কোনও বিশেষ অভিযানের জন্য লালবাজারের লোকেরা তাদের লরি নিয়ে গেছে। আমাদের সাথে আটজন প্রচণ্ড বলিষ্ঠ চেহারার সিপাই ছিল। তারা কয়লার লরির খালাসির মত কালিঝুলি মেখে নিল। তেমন জামা, গামছা পরে নিল। তার মধ্যে মাত্র দুজন বাঙালি, বাকি ছ’জন বিহারী ও উত্তরপ্রদেশীয়। ওরা মাথায় বেঁধে নিল কালিমাখা গামছা, ওদের মেকআপটা এমন হল যে কেউ বুঝতেই পারবে না ওরা খালাসি নয়, লালবাজার গোয়েন্দা দফতরের অত্যন্ত দক্ষ কনস্টেবল। যাদের অনুপস্থিতিতে লালবাজারের গোয়েন্দা দফতর রক্তবাহী শিরাবিহীন একটা স্থবির, অথর্ব প্রাণীতে পরিণত হয়ে যাবে। ওরা তৃণমূলের কর্মী, সমস্ত কাজকর্মের বিদ্যুৎবাহী তার। একটা জীবন্ত গাছের শিকড়, পাতা, শাখা-প্রশাখা, যার দ্বারা গাছ আলো, বাতাস, জল আহরণ করে বেঁচে থাকে।

কয়লার লরি ছুটল সেই চায়ের দোকানে, যেখানে তপন প্রতিদিন চা খেতে আসে। লরি নিয়ে ওরা পৌঁছে গেল সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে। লরিটা ওরা ঘুরিয়ে এনে দাঁড় করাল কলকাতার দিকে মুখ করে।

অফিসারদের দুটো প্রাইভেট গাড়ি দোকান ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেল, গাড়ি দুটোকে এমনভাবে ধুলো দিয়ে ময়লা করা হল যেন মনে হয় আরোহীরা বহু দূর থেকে আসছে। গাড়ির ভেতর আমরা সবাই তেমন ভাবেই আড্ডা মারতে লাগলাম। বনেট তুলে রাখা হয়েছে, মনে হবে যেন ইঞ্জিনকে বিশ্রাম দেওয়া হচ্ছে। আমরা কেউ গাড়ির পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কেউ গাড়িতে বসে লক্ষ্য রাখতে লাগলাম দোকান ও রাজচন্দ্রপুরের দিকে।

খালাসিবেশী সিপাইরা চায়ের দোকানের সামনে লরি লাগিয়ে, দোকানদারকে চা বানানর নির্দেশ দিয়ে কেউ দোকানের ভেতর, কেউ দোকানের বাইরে রাস্তায় বসল। সঙ্গে ড্রাইভার আর লরির আসল খালাসিকে রাখল, যাতে ওরা কাউকে না বলতে পারে সঙ্গীরা সব পুলিশ, কোনও বিশেষ উদ্দেশে ওদের লরি নিয়ে এখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছে।

সেইসব গল্প রটতে রটতে যদি একবার আসামীর কাছে পৌঁছে যায়, সে কিছুতেই ফাঁদে এসে পা দেবে না, সাত যোজন দূর থেকে পালিয়ে যাবে। তখন ব্যর্থ হয়ে যাবে আমাদের এত পরিশ্রম, অভিযান। আর একবার যদি অপরাধী বুঝে যায় সে চিহ্নিত হয়ে গেছে, তখন সে পুরনো যোগাযোগ ছিন্ন করে আত্মগোপন করার চেষ্টায় এমন জায়গায় যাবে যে সুলুক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

ইতিমধ্যেই আমরা সূর্যের বাড়িতে হানা দিয়ে ও দমদমে বাংলা বন্ধের রাতে তাকে না পেয়ে ব্যর্থ তো হয়েইছি, উল্টে সে সতর্ক হয়ে যাওয়াতে এমন জায়গায় চলে গেছে যে তার কোনও সন্ধানও আমরা পাচ্ছি না। সে শিক্ষিত ছেলে, উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্ম, বিভিন্ন মহলে তার যোগাযোগ আছে। সে আমাদের প্রদেশে আছে, না অন্য প্রদেশে চলে গেছে, তাও বুঝতে পারছি না।

অন্য প্রদেশে চলে গেলে, খোঁজ পাওয়া আরও মুশকিল হয়ে যায়, যদি না সে তার যোগসূত্র কোনও না কোনওভাবে ফেলে যায়।

তবে মানুষ বড় মায়ায় বাঁধা, এমনকি পেশাদার অপরাধীরাও বিভিন্ন মায়ার বাঁধনে পড়ে যায়, তাই পুরনো সুতো সবই সে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। আমরা সেই সুতোর সন্ধান করে, সুতো ধরে এগিয়ে যাই, সুতোর ভিত্তিতে চেকিং ও ক্রসচেকিং করে করে এগতে হয়।

তাই আমাদের সিপাইরা সব সাবধান, যাতে ড্রাইভার আর খালাসির মুখ থেকে বাইরে না কোনও কথা বেরিয়ে যায়।

অফিসাররা দিল্লি রোডের ওপর সকালের মিষ্টি রোদ মেখে এমনভাবে ঠাট্টা ইয়ারকি মারছে যেন কোনও তাড়াহুড়ো নেই। সিগারেটে টান দিচ্ছে, জোরে জোরে হাসছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখে যেন মনে হয়, বহু দূরের ভ্রমণে সময় পায়নি নিজেকে পরিষ্কার করার। ওদিকে পাশ দিয়ে হু হু করে বেরিয়ে যাচ্ছে লরি, বাস, মিনিবাস, প্রাইভেট গাড়ি।

হঠাৎ শোনা গেল দূর থেকে একটা বুলেট মটর সাইকেলের ভট ভট আওয়াজ উদ্ধত ভঙ্গিমায় এগিয়ে আসছে। সকাল নটা বেজে দশ। আমাদের সোর্সের নিরীক্ষণ তাহলে সম্পূর্ণ সঠিক। হ্যাঁ, মটর সাইকেল গর্জন করতে করতে এগিয়ে এল। স্বাস্থ্যবান, মাথা উঁচু একটা ছেলে, পায়ে ঝকঝকে জুতো, নতুন গেঞ্জি পরা, বেপরোয়া ভাবে চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। ঠিক সেই ভঙ্গিতে বুলেটটা দাঁড় করিয়ে, গাড়ির চাবির গোছা ঘোরাতে ঘোরাতে চায়ের দোকানীকে “চা দে” বলে একটা হুঙ্কার ছেড়ে দোকানের সামনে রাখা একটা বেঞ্চিতে দুদিকে পা রেখে বসে পড়ল।

অসিত তপনকে আগে চিনে এসেছিল, সে ওই ছেলেটাকে দেখে ইশারায় জানান দিল, আগন্তুক ছেলেটাই আমাদের লক্ষ্যবস্তু। অন্যদিকে অফিসাররা গাড়ির বনেট নামিয়ে দিয়ে খেয়াল রাখছে দোকানের দিকে।

ছেলেটা বুঝতেই পারছে না কুলি আর খালাসির দলটা লালবাজারের সিপাই। সবাই ততক্ষণে জায়গা নিয়ে নিয়েছে। তিনজন খালাসিবেশী সিপাই তপনের কাছে গিয়ে ঝট করে তাকে তুলে ধরল। তপন চিৎকার করতে লাগল “বাঁচাও, বাঁচাও” করে। ততক্ষণে তাকে লরিতে তুলে ফেলা হয়েছে। সিপাইরা লরিতে উঠে গেছে। ড্রাইভারকে নির্দেশ দিতেই সে গাড়ি ছোটাল। তপন ছটফট করছে, আর চিৎকার করে চলেছে।

প্রাইভেট গাড়ি দুটো লরি ছেড়ে দেওয়ার পর আস্তে আস্তে চলতে শুরু করল।

তপনের “বাঁচাও বাঁচাও” চিৎকাবে ওখানকার মানুষ ভেবেছে, তপনকে কেউ কিডন্যাপ করে নিয়ে চলেছে। চায়ের দোকানদার, দোকানের কর্মচারী, আশেপাশের লোকজন ছুটতে শুরু করেছে দিল্লি রোড ধরে। রাজচন্দ্রপুরে গাইনদের গ্রামেও খবর চলে গেছে, “একদল লোক তপনকে চায়ের দোকান থেকে তুলে নিয়ে চলে গেছে।”

রাজচন্দ্রপুর থেকে হৈ হৈ করে “গাইন গোষ্ঠীর” লোকজন দিল্লি রোডে চলে এসে দুটো লরি ধরে তাতে উঠে পড়েছে। সেই লরি দুটোর ড্রাইভারকে নির্দেশ দিচ্ছে “জলদি চালাও, সামনের একটা লরিকে আমাদের ধরতে হবে।” এসবই ঘটছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে।

রাজকুমার মটর বাইকে চড়ে আসতে আসতে চিৎকার শুনে পেছন ফিরে দেখতে পেল, অসম্ভব গতিতে দুটো লরিতে চিৎকার করতে করতে প্রচুর লোকজন আমাদের লরিটা ধরতে আসছে। সে বাইকের গতি বাড়িয়ে দিয়ে আমাদের লরিটার কাছে গিয়ে বলল, পেছনে দুটো লরিতে লোকেরা আমাদের ধরতে আসছে। সুতরাং আরও জোরে চালাও। সেও বাইকের গতি বাড়িয়ে দিল, আমাদের লরির ড্রাইভারও প্রচণ্ড গতিতে ছুটতে শুরু করল। লরির ওপরে তপনকে ততক্ষণে হাতে পায়ে হ্যান্ড কাফ পরিয়ে, দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছে। তার আর নড়ার ক্ষমতা নেই।

রাজকুমার আমাদের জানিয়ে গিয়েছিল পেছনে রাজচন্দ্রপুরের লোকেরা দুটো লরিতে করে আসছে। তখন আমরা প্রাইভেট গাড়ি দুটো এমনভাবে চালাতে লাগলাম যে ওরা যেন টপকে আমাদের লরির কাছে যেতে না পারে। খুব আস্তে আস্তে আমাদের গাড়ি চলতে লাগল। ওরা প্রচণ্ড জোরে হর্ন বাজাতে লাগল। ওই লরির থেকে লোকেরা আমাদের চালক দুজনকে গালাগালি দিতে লাগল, কিন্তু ওরা কান না দিয়ে আমাদের নির্দেশ মত গাড়ি চালিয়ে যেতে লাগল। তার ফলে আমাদের লরির সাথে ওই লরির দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে গেল, ওরা পিছিয়ে পড়ল।

এমন সময় রাজ্য পুলিশের ট্র্যাফিক পুলিশ ভ্যানও ঘটনাস্থলে এসে পড়ল।

তারা ট্র্যাফিক পুলিশ নামাতে নামাতে আসছিল। সামনে তপনকে নিয়ে আমাদের লরি ছুটছে। মাঝে আমাদের প্রাইভেট গাড়ি দুটো পেছনের গাড়িকে পথ আটকে চলছে। তারও পেছনে পুলিশের ভ্যান।

লরি দুটো যতই হর্ন দিক না কেন, আমাদের গাড়ি না ছুটছে দ্রুত, না দিচ্ছে জায়গা, যাতে রাজচন্দ্রপুরের লোকেরা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে।

এদিকে পুলিশের ভ্যান লরি দুটোকে টপকে চলে এসে আমাদের গাড়ির পেছনে হর্ন দিয়ে জায়গা চাইছে। আমরা ওদের জায়গা দিলাম। ভ্যানটা দ্রুত গতিতে এসে আমাদের গাড়ি দুটোর সামনে দাঁড়াল। ওদিকে তখন তপনকে নিয়ে দ্রুত ছুটে চলেছে আমাদের লরি। তাকে ধরা যাবে না। বালি আর উত্তরপাড়ার মাঝামাঝি জায়গায় ভ্যান থেকে নেমেই একজন সিপাই আমাদের গালাগালি দিয়ে বলল, “আপনারাও কি ডাকাত দলের লোক? কতগুলো ডাকাত গ্রাম থেকে একটা ছেলেকে তুলে নিয়ে গেছে। গ্রামের লোক তাদের ধাওয়া করেছে, আর আপনারা জায়গা দিচ্ছেন না। যেন ন্যাকামি করে রাস্তায় হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন, এমনভাবে চলছেন!”

আমরা ততক্ষণে রাস্তায় নেমে আমাদের পরিচয়পত্র ওদের দেখিয়ে বললাম, “আমরা লালবাজারের লোক, আমরা ডাকাত নই। একটা ডাকাতকে ধরে নিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বাস না হয় আমাদের সঙ্গে লালবাজারে চলুন।”

রাজ্য পুলিশের সিপাইরা আমাদের ছেড়ে দিয়ে রাজচন্দ্রপুরের লোকেদের কি বলল। তারা চুপ করে গেল। আমরা ততক্ষণে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছি। এবার স্বাভাবিক গতিতে। ওদিকে আমাদের লরি তপনকে নিয়ে লালবাজারে পৌঁছে গেল নিরাপদে।

তিল দেবু আর তপনকে তো গ্রেফতার করলাম। কিন্তু দলের নায়ক সূর্য আমাদেরই ভুল সিদ্ধান্তে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে কোথায় গেছে তার কোনও হদিস পাচ্ছি না। তারপর থেকে আর কোনও খবর নেই। খবর নেই ওদের দলের অন্য সদস্য রিষড়ার পুরনো ডাকাত গোপাল সাউয়ের। সে ওই ডাকাত দলের চতুর্থ সদস্য ছিল। এদিকে দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে। মামলা মোটেই এগচ্ছে না।

প্রায় মাস তিনেক পর আমি আমার বিশ্বস্ত সোর্স নারায়ণ সরকারের মাধ্যমে একটা খবর পেলাম। শিয়ালদা থেকে ডায়মন্ড হারবার রেল লাইনের ওপর গোচারণ নামে একটা জায়গা আছে। গোচারণ থেকে বাঁদিকে গেলে একটা গ্রাম পাওয়া যাবে। সেই গ্রামে সূর্য হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি করছে। এর আগে আমরা দেবু ও তপনের কাছ থেকে জেনে ছিলাম যে সূর্য ওদের শরীর খারাপ হলে হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিত। হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি করছে শুনে বুঝলাম, নারায়ণের খবরটা সত্যি।

খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমরা গোচারণে আমাদের নিজস্ব নজরদার পাঠালাম। নজরদার খবর দিল, হ্যাঁ, ওখানে একজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার আছে যার সঙ্গে সূর্যের চেহারার মিল আছে, কিন্তু অন্য নাম। আমরা বুঝলাম, সূর্য ওখানে নাম ভাঁড়িয়ে হোমিওপ্যাথ ডাক্তার হিসাবে রয়েছে। একদিন সকালবেলা গোচারণে আমাদের দল দুটো গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেল। গাড়ি বহু দূরে রেখে আমাদের তিনজন অফিসার আর আটজন সিপাই কিছুটা গ্রাম্য বেশে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব রেখে রেখে হেঁটে চলল গোচারণের সেই গ্রামের দিকে। যেখানে সূর্য হোমিওপ্যাথ হিসাবে ছদ্মবেশ নিয়ে ডাক্তারি করে যাচ্ছে।

কাঁচা রাস্তা। আমাদের দল গ্রামের রাস্তায় ঢুকে পড়ল। সূর্য গ্রামের একটা ছোট দোকানঘরের মত ঘর ভাড়া নিয়েছে। আমাদের প্রথম দুজন সূর্যর চেম্বারে ঢুকে গেল রোগী হিসাবে। সূর্য তখন গ্রামের একটা বাচ্চা ছেলেকে দেখছিল। সেই ছেলেটা চলে যেতে আমাদের দুজন সোজাসুজি সূর্যর হাত ধরে ওকে চেয়ার থেকে টেনে তুলল।

সূর্য কিছু বোঝার আগেই তাকে ঘিরে ধরল আমাদের সাত আটজন লোক, হাতে রিভলবার। সূর্য কাঁপতে লাগল।

আমাদের লোকেদের সাথে বেরিয়ে এল তার হোমিওপ্যাথ চেম্বারের বাইরে। সে একবার বাড়ি যেতে চেয়েছিল। কিন্তু অফিসাররা তাকে কোন সুযোগই দিল না। ওকে হাঁটিয়ে গ্রাম থেকে বড় রাস্তার দিকে যখন নিয়ে আসছে, গ্রামের লোকেরা উঁকি মেরে মেরে দেখতে লাগল। তাদের গ্রামের ডাক্তারকে হাতকড়া দিয়ে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে!

তারপর গাড়ি করে একেবারে লালবাজার। লালবাজারে এসে সূর্য হতভম্ব। যেন কিছুই জানে না। প্রশ্নের উত্তরে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটাই জবাব দিচ্ছে, “আমি জানি না স্যার এসব কিছু, কি যে বলছেন, আমি গ্রামের গরিব হোমিওপ্যাথ, আমাকে কেন ধরে এনেছেন?” ওর উত্তরে আমরা ধন্দে পড়ে গেলাম।

তবু ওকে নানারকমভাবে আমরা প্রচণ্ড ভয় দেখালাম, তখনও কিন্তু ও একই কথা বলছে। একজন ওকে আমাদের বিভাগের তিনতলার বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বলল, “সত্যি কথা বল, নয়ত এখান থেকে ফেলে দেব।” কিন্তু সে অনড়। সেদিন রাতে ওকে সেন্ট্রাল লক আপ থেকে নিয়ে এলাম। মুখোমুখি ওকে দাঁড় করালাম। চারপাশে আমাদের বলিষ্ঠ চেহারার সিপাইরা দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার নাম কি সত্যি করে বল, তুমি সূর্য মুখার্জি নয়? বেলঘরিয়ায় তোমার বাড়ি নয়?”

সে বলল, “বিশ্বাস করুন, আমার নাম সূর্য মুখার্জি নয়। বেলঘরিয়ায় বাড়ি কি, আমি কোনদিনও বেলঘরিয়াতেই যাইনি। যে নামে আমি ডাক্তারি করছি, সেটাই আমার একমাত্র নাম, অন্য কোনও নাম আমার নেই, তবে — 1”

প্রশ্ন করলাম, “তবে কি?” সে বলল, “তবে কমাস আগে আমাদের গ্রামে আর একজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার এসেছে, তার নাম আর আমার নাম এক। সে গ্রামেই একটা বাড়িতে থাকে, বিয়ে থা করেনি।”

এতক্ষণে বুঝলাম আমরা ভুল লোককে ধরে এনেছি। কি আশ্চর্য, লোকটার চেহারার সাথে সূর্যের চেহারার অদ্ভুত মিল, তার ওপর দুজন একই নামে হোমিওপ্যাথি করছে। অর্থাৎ সূর্য ইচ্ছে করেই এই ডাক্তারের নামটা নিজে ব্যবহার করে সবাইকে ধোঁকা দিতে চেয়েছে।

আমাদের বাহিনী ভুল সূর্যের কাছ থেকে খবর পেয়ে ফের ছুটল গোচারণ। গ্রামের ভেতর খবর নিয়ে জানতে পারল, ভুল সূর্যের কথাই ঠিক। একই নামে আরও একজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার ওই গ্রামে ছিল। কিন্তু যেদিন আমরা ওই ডাক্তারকে ধরে এনেছি, সেদিনই সে গ্রাম থেকে কোথায় চলে গেছে, কেউ বলতে পারল না।

গ্রামে যে বাড়িতে সে থাকত, সেখানেও কেউ কিছু জানে না। সে যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফিরবে না, কি করে তারা আন্দাজ করবে? গ্রামের সরল মানুষ তারা, এতসব মারপ্যাঁচ জানে না।

কোনও খবর না পেয়ে আমাদের বাহিনী ফিরে এল। এই নিয়ে তিনবার সূর্য আমাদের হাত থেকে ফস্কে বেরিয়ে গেল। আমরা ওই ডাক্তারকে ছেড়ে দিলাম, সে গোচারণে বাড়ি ফিরে গেল।

প্রায় মাসখানেক পর আমরা খবর পেলাম, সূর্য গোচারণের সেই গ্রাম থেকে পালিয়ে আরও ভেতর দিকে প্রায় সুন্দরবনের কাছাকাছি একটা অত্যন্ত গ্রামে চলে গিয়েছে। সেখানে সে ওই গ্রামের মানুষের সাথে মিশে এস.ইউ.সি. আই পার্টি করছে।

চালাক ছেলে, যেখানে যেমন, তেমনভাবে ঠিক মানিয়ে গ্রেফতার এড়িয়ে আত্মগোপন করে আছে। একসময় করত সি.পি.আই (এম)। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে সে ভোল পাল্টে ফেলেছে। বাড়ির ঐতিহ্য এবং নিজের পড়াশুনোর গুণে সে নিজের পার্টির নেতাদের খুবই কাছের লোক হয়ে গিয়েছিল। এমন কি একসময় সে পার্টির এক নেতার সাথে মিলে ভবানীপুর অঞ্চলে ওষুধের দোকান দিয়েছিল। ওই গ্রামে গিয়ে এস.ইউ.সি.আই পার্টি করতে তার কোনও অসুবিধাই হয়নি। তার ওপর ওই প্রত্যন্ত গ্রামে তার মত শিক্ষিত লোক আর কেউ ছিল না। ফলে খুব অল্পদিনের মধ্যেই সে সেখানকার এস.ইউ.সি.আইয়ের নেতা হয়ে গেল। এস.ইউ.সি.আইয়ের সাথে সি.পি.আই (এম)-এর মাঝেমাঝে ঝামেলা হত ওখানে বিভিন্ন কারণে। এস.ইউ.সি.আইয়ের অঞ্চলে ভাল সংগঠন ছিল। সি.পি.আই (এম) চাইত, ওদের সংগঠন ভেঙে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে।

তাছাড়া জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদ, খাস সম্পত্তির ওপর ফসল কাটার সময় ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে তো সংঘর্ষ চলতই। সূর্য তার নতুন পার্টির ওই অঞ্চলের কর্মীদের বোঝাল, এইভাবে লড়াই করে পার্টিকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না, অন্য লড়াই করতে হবে, আধুনিক অস্ত্র কিনতে হবে। সবাই যদি রাজি হয় তবে সূর্য সেই অস্ত্র কলকাতা থেকে কিনে নিয়ে আসতে পারে, তার এমন যোগাযোগ আছে। সূর্যের কথায় সেখানকার এস.ইউ.সি. আই পার্টির লোকেরা রাজি হতে, সূর্য লুকিয়ে কলকাতার বেলগাছিয়া অঞ্চলে এল এক নামকরা সি.পি.আই (এম) নেতার ছেলের কাছে। সেই ছেলে পার্টি করত। কিন্তু তার চলনবলন ছিল জঙ্গী ধরনের। সে তার পূর্বপরিচিত ছিল। সেই নেতার ছেলের সাথে সূর্য অস্ত্র কেনার আলোচনা করল।

সে সূর্যর সব কথা শুনে, তাকে তিনদিন পরে আবার তার কাছে আসতে বলল। সূর্য তিনদিন পর এলে তাকে সে বলল, রিভলবার পাওয়া যাবে, সাথে দশ রাউন্ড করে গুলি। দুটো কিনতে গেলে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে, সূর্য যেন সেই টাকার আগে বন্দোবস্ত করে।

সূর্য তার কথা শুনে গ্রামে ফিরে গেল এবং স্থানীয় এস.ইউ.সি.আই কর্মীদের টাকার কথা বলল। তারা বহু কষ্টে চাঁদা তুলে সেই টাকা যোগাড় করতে লাগল। ঠিক সময় মত সূর্যের হাতে তারা টাকা তুলে দিলে, সূর্য এসে ছেলেটার সাথে দেখা করে বলল, টাকা সে যোগাড় করে ফেলেছে। যেন দুটো রিভলবার ঠিক রাখে, সে এসে নিয়ে যাবে।

টাকাটা সূর্য সেই ছেলেটাকে দিয়ে দিল। সূর্য তার দেওয়া তারিখ অনুযায়ী বেলগাছিয়ায় সেই ছেলেটার কাছে এল রিভলবার নিতে। সেই ছেলেটা আমাদের আগেই সব কিছু জানিয়ে দিয়েছিল।

সে আমাদের এক অফিসারের সোর্স ছিল। সে বলে রেখেছিল কখন সূর্য তার কাছে, তার বাড়িতে রিভলভার নিতে আসবে। সেদিন দুপুরের আগে থেকেই আমাদের লোকেরা সেই নেতার বাড়ির অঞ্চল সাধারণ পোশাক পরে ঘিরে রেখে দিয়েছিল।

সূর্য এল। সূর্যর ফটো সবাই দেখে রেখেছিল, তাই সূর্য আসতেই প্রত্যেকে তাকে অনায়াসে চিনতে পারল। সূর্য সেই নেতার বাড়িতে ঢুকতে যাবে, এমন সময় আমাদের লোকেরা তাকে ঘিরে ধরে গ্রেফতার করে ফেলল। না, এবার আর সূর্য ফস্কে গেল না বা আর কোনও ভুল সূর্যকেও আমরা ধরলাম না।

সূর্য লালবাজারে এসে আমাদের কাছে তার ডাকাতির কথা অস্বীকার করার কোনও সুযোগই পেল না। আমরা আদালতে চার্জশিট দিলাম, মামলা চলল, আমাদের অফিসার দুলাল চক্রবর্তী তদন্ত ভালই করেছিল।

সাজা হয়ে গেল সূর্যের। গোপাল সাউকে আমরা ধরতে পারিনি। শুনেছি সে বিহারে কোথায় আত্মগোপন করে আছে। ধরতে পারলে হয়ত তার থেকে অন্য কোনও ডাকাতির কথা জানতে পারতাম।

জেলের ভেতর থেকে সূর্য আমাকে চিঠি দিত, জেলখানার পরিবেশ আর অন্যান্য অবস্থা জানিয়ে।

জেল থেকে তপন আর দেবু আগে ছাড়া পেয়ে গেল। কারণ ওদের সাজা কম হয়েছিল। ছাড়া পেয়ে ওরা নিজেদের বাড়ি ফিরে গেল। সূর্য বেলঘরিয়ায়, তিল দেবু বিরাটিতে আর তপন রাজচন্দ্রপুরে। তার বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ খবর পেলাম তপন রাজচন্দ্রপুরের কাছে অজানা আততায়ীর হাতে খুন হয়ে গেছে। জানি না তপনের খুনীরা ধরা পড়েছিল কিনা বা ধরা পড়লে তাদের সাজা হয়েছিল কিনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *