৬
জীবনটাই তো হারা আর জেতার। “জীবন তো ভাই হার জিতের।” কিন্তু হেরেও যে এত আনন্দ আমি বড়সাহেবের বাড়ি থেকে ফেরার পথে প্রথম বুঝলাম। আমি ফুটবল খেলোয়াড় ছিলাম, তাই আমার মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গিয়েছিল এই মন্ত্র, বিনা যুদ্ধে হেরে মাঠ ছাড়ব না কখনও। চাকরির ক্ষেত্রেও ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে এই মনোভাব নিয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমি বারবার বিপদে পড়েছি। মুচিপাড়া থানায় সমাজবিরোধীদের মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি বড়বাজার থানায় বদলি হয়ে এলাম। ওখানে এসে আমি প্রথম প্রথম মারোয়াড়িদের আলাদা করে চিনতেই পারতাম না। সবাইকে একই রকম মনে হত। ধন্দে পড়ে যেতাম। ওখানকার বেশ কিছু কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে ভাবতাম, আরে এখানে কি পুলিশ বলে কিছু নেই? রাজকাটরা এলাকায় তখন পুলিশ ঢুকতে পারত না। ওটা ছিল স্মাগলার আর চোরাই মালের ঘাঁটি।
এশিয়ার বৃহত্তম এই বাজারে সারাদিন কালো টাকার অবাধ আমদানি রপ্তানি চলত। অবশ্য সেটা রাতারাতি গড়ে ওঠেনি। সেই গড়ে ওঠার পেছনে যারা মদত দিয়েছিল আমি আস্তে আস্তে তাদেরও পরিচয় পেতে লাগলাম। কালোবাজারির একটা অংশ তারা হক হিসেবে পেয়ে থাকত। আমি কোন হুমকি মানলাম না। ওই স্মাগলিংয়ের ঘাঁটি ভাঙাটা আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলাম। থানার কিছু সহকর্মী আমাকে নিষেধ করল, ভয় দেখাল, যাতে আমি ওই ভীমরুলের চাকে ঢিল মারতে না যাই। কিন্তু আমি দমলাম না। প্রায় প্রতিদিনই থানা থেকে কয়েকজন সিপাই নিয়ে রাজকাটরা অঞ্চলে স্মাগলারদের ডেরা রেড করতে লাগলাম। স্মাগলিং করা জিনিসপত্র আটক করে থানায় নিয়ে যেতাম। মাঝে মাঝেই স্মাগলারদের পোষা গুণ্ডাবাহিনীর সাথে আমাদের খণ্ডযুদ্ধ হতে থাকল। তাতে দুপক্ষেরই কিছু না কিছু লোক আহত হত। আমিও সেই আঘাতের হাত থেকে বাঁচতে পারিনি।
আমাকে সাহায্য করার জন্য একজন কাস্টম অফিসারকে ফুলটাইম নিয়োগ করা হয়েছিল। প্রতিপক্ষকে একদম নাজেহাল করে দিলাম, চোরাই বাজার চালান ওদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াল। চোরাচালান চক্রে যুক্ত বেশ কিছু লোককে গ্রেফতার করে চালান করে দিলাম। যখন ওদের আমি দম ফেলতে দিচ্ছি না, ওরা স্বাভাবিকভাবেই আমাকে জব্দ করার জন্য উঠে পড়ে লাগল। ওদের মধ্যে জয়চাঁদ নামে এক বড়সড় চাঁই ছিল। সে আমাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে হাই কোর্ট ও ব্যাঙ্কশাল কোর্টে দুটো মিথ্যে মামলা করল। ভাবল আমি মামলার ভয়ে ওদের বিরুদ্ধে আর দাঁড়াব না, চাকরিও চলে যাবে আমার। জীবনে সেই প্রথম আমার বিরুদ্ধে কেউ মামলা করল। তখন কমিশনার ছিলেন মিঃ এস. এম. ঘোষ। তিনি আমার পক্ষে দাঁড়ালেন, নিজে গিয়ে স্ট্যান্ডিং কাউনসেল মিঃ এ. কে. মিত্রকে পুরো ঘটনা বলে এলেন। মিঃ মিত্র আমার হয়ে কোর্টে লড়ে সেই সাজান মামলা নস্যাৎ করে দিলেন।
সে সময় বড়বাজার থানার অফিসার-ইন-চার্জ ছিলেন মিঃ কল্যাণ দত্ত। তাঁর আদি বাড়ি ছিল হাওড়ায়। তিনি অদ্ভুত খেয়ালি লোক ছিলেন। বদমেজাজী ও অহংকারীও বলা যায়। আর সবসময় কারণে, অকারণে টেনশনে ভুগতেন। তিনি একাই থানার ওপরে কোয়ার্টারে থাকতেন, সঙ্গে থাকত পঞ্চা নামে একটা কাজের ছেলে। একদিন সন্ধেবেলায় ভীষণ টেনশনে ভুগছেন উনি কারণ প্রায় দশটা বাজে, এখনও স্পেশাল রিপোর্ট তৈরি করা হয়নি। দশটার মধ্যে লালবাজারে প্রত্যেক থানা থেকে ও.সি.র স্পেশাল রিপোর্ট পাঠানর নিয়ম। সারাদিনে থানার থেকে কি বিশেষ বিশেষ ভাল কাজ করা হয়েছে তার বিবরণ লিখে স্পেশাল রিপোর্ট পাঠাতে হয়। কিন্তু সেদিন এমন কোনও কাজ হয়নি বা এমন কারোকে গ্রেফতার করা হয়নি যা লিখে পাঠান যায়। তাই টেনশন। পায়চারি করে যাচ্ছেন, আর আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছেন, “কি হবে?” আমি বললাম, “ঠিক কিছু না কিছু ব্যবস্থা হবে স্যার, চারদিকে লোক পাঠিয়েছি, কারোকে না কারোকে ধরে নিয়ে আসবে।” এদিকে ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে এগিয়ে চলেছে। যাদের কিছু একটা “কাজ” করে আসতে পাঠান হয়েছে তাদের পাত্তা নেই। মিঃ দত্ত বিড়বিড় করে চলেছেন, “থানার একদম বদনাম হয়ে গেল, সারাদিনে কোনও ভাল কাজ নেই, ভ্যারেণ্ডা ভাঙ্গছে সব।”
আমি জানি, উনি থানার কথা নয়, নিজের বদনামের কথা ভাবছেন, আর তাই নিয়ে টেনশনে ভুগছেন। উনি ভাবছেন, “আমি কল্যাণ দত্ত, আমার নামে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খায় আর আমার থানা থেকেই কোনও স্পেশাল রিপোর্ট যাবে না, আমার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি!” উনি থানার সামনের বারান্দায় পায়চারি করছেন আর যাকে পাচ্ছেন তাকেই গালাগালি দিচ্ছেন। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, যাদের পাঠিয়েছি “কাজ” করে আসতে, দেখছি, তারা কেউ আসছে কিনা। বড়বাবু আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। থানার সামনে দিয়ে বহু লোক যাতায়াত করছে, উনি লাল চোখ দুটো দিয়ে যেন সব গিলে খাবেন। হঠাৎ হুঙ্কার ছাড়লেন, “কে আছিস, কে আছিস?” সামনে একজন সাদা পোশাকের কনস্টেবল ছিল, তাকে বললেন, “ধর, ধর।” থতমত খেয়ে কনস্টেবল অন্ধের মত থানার বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে রাস্তায় নামল। কিন্তু কাকে ধরবে তা তো বুঝতে পারছে না। রাস্তা দিয়ে তখন দুটো বিশ-বাইশ বছরের মারোয়াড়ি ছেলে গল্প করতে করতে যাচ্ছে, একজনের হাতে একটা রেডিও। কনস্টেবল একবার বড়বাবুর দিকে দেখছে, আর একবার রাস্তার এদিক ওদিক খুঁজছে। কাকে ধরবার জন্য বড়বাবু বলছেন? বড়বাবু উত্তেজিতভাবে ওই ছেলে দুটোর দিকে আঙুল দেখিয়ে চিৎকার করে বললেন, “রেডিও, রেডিও।”
কনস্টেবল এবার বড়বাবুর নির্দেশ বুঝে চোখের পলকে ছুটে গিয়ে রেডিও হাতে যে ছেলেটা যাচ্ছিল তাকে জাপটে ধরল। সঙ্গের ছেলেটা তাই দেখে দে ছুট। বড়বাবু বললেন, “নিয়ে আয়, নিয়ে আয়।” কনস্টেবল ছেলেটাকে টানতে টানতে থানার বারান্দায় তুলে নিল। বড়বাবুর মুখ দেখে মনে হল যেন বহুদিনের ক্ষুধার্ত নেকড়ে একটা নধর খাসি পেয়েছে। ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বড়বাবুর সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, “স্যার, আমি কি দোষ করেছি?” বড়বাবু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “রেডিও।” তারপর ছেলেটাকে নিয়ে গেলেন সামনের একটা ঘরে। অবাক ছেলেটা আবার জিজ্ঞেস করল, “স্যার আমার রেডিওর কি হয়েছে?” বড়বাবু খেঁকিয়ে উঠে জানতে চাইলেন, “লাইসেন্স আছে?” ছেলেটা বলল, “আছে স্যার।” বড়বাবু এবার দারুণ রেগে বললেন, “থাক।” তারপর একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টরকে ইংরেজিতে ডিকটেশন দিতে শুরু করলেন, “আজ আমরা একটা বেআইনি চোরাই রেডিও উদ্ধার করেছি।” সেটা শুনে ছেলেটা কাতর কণ্ঠে বড়বাবুকে বলল, “স্যার, বেআইনি নয়, লাইসেন্স আমার বাড়িতে আছে, এনে দেখাচ্ছি।”
বড়বাবু চোখ রাঙিয়ে গলা চড়িয়ে ছেলেটাকে বললেন, “বলেছি না থাক। ওটা ওখানেই থাক।” তারপর মুখ ঘুরিয়ে ফের ডিকটেশন দিলেন, “আমরা খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ওটা উদ্ধার করেছি।” আমি এবার শেষ চেষ্টা করলাম, “স্যার ও যখন বলছে লাইসেন্স আছে তখন একবার দেখাই যাক না।” বড়বাবু উত্তর দিলেন, “হবে হবে, আগে স্পেশাল রিপোর্ট পাঠাই, তারপর সব দেখব।” এবার তিনি এ. এস. আই.র দিকে ফিরে বললেন, “লিখুন, আমরা আসামীকে গ্রেফতার করেছি।” বড়বাবু বলে চলেছেন, আমি ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ছেলেটা দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে কাঁদছে, সে বুঝে গিয়েছে আজ আর তার নিস্তার নেই।
লেখা শেষ হলে বড়বাবু নিজেই টাইপ মেশিন নিয়ে বসে পড়লেন। দ্রুত হাতে টাইপ করে মেসেঞ্জারের হাতে স্পেশাল রিপোর্ট দিয়ে বড়বাবু বললেন, “ছোট।” বড়বাবুর গাড়ি নিয়ে সে ছুটল ওই “বিশেষ ভাল কাজের” রিপোর্টটা লালবাজারে জমা দিতে। মূষিক প্রসব করে বড়বাবু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। থানার সব কর্মচারীদের উদ্দেশে বললেন, “কাজ শেখ, কাজ শেখ।” তারপর ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি বলছিলি? লাইসেন্স আছে?” ছেলেটা জলভরা চোখে কোনমতে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।” বড়বাবু বললেন, “তবে রাস্তায় লাইসেন্স ছাড়া ঘুরিস কেন?” ছেলেটা চুপ করে রইল।
ইতিমধ্যে ছেলেটার বন্ধু বুদ্ধি করে রেডিওর লাইসেন্সটা বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। সেটা দেখে বড়বাবু ধমকে উঠলেন, “আর কখনও লাইসেন্স ছাড়া বের হবি?” ছেলেটা করুণ সুরে বলল, “কখনও না। রেডিও আমি বিক্রি করে দেব।” বড়বাবু বললেন, “কিন্তু তোর তো জামিন নিতে হবে, কেস লেখা হয়ে গেছে।” উকিল থানাতেই মজুদ। সব থানাতেই সন্ধের পর দু তিনজন উকিল থাকে, তারা থানায় আসে রাতের পেটি কেসের জামিনদার হতে। কিন্তু আদালতে গিয়ে এরা প্রায় বোবা হয়ে যায়, কোর্ট তো আর থানা নয়। এরকমই একজন জামিনদার হয়ে ছেলেটাকে ছাড়িয়ে নিল। ছেলেটার কিছু টাকা গচ্চা গেল। সে জামিন পেয়ে বড়বাবুর পায়ে উপুড় হয়ে প্রণাম করল। থানা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বড়বাবু ছেলেটাকে বললেন, “লাইসেন্সটা পরীক্ষা করে দেখব, তারপর তোকে রেডিও দেব। এখন যা।”
সেদিন বড়বাবুর কোয়ার্টারে যেতে একটু দেরি হয়ে গেল। এবার সেখানে খানাপিনার আসর বসবে। তাঁর হুলোরা সবাই অনেক আগেই এসে গেছে। হুলোদের মধ্যে ছিল বিশু উকিল, শুক্লা উকিল, রেলের কর্মচারি কেলো আর সার্জেন্ট এ. চ্যাটার্জি রোজ আসত চিনা খাবার নিয়ে। মদের মধ্যে ওদের পছন্দ ছিল রাম। আসরে বড়বাবু প্রচণ্ড খিস্তিখেউড় করতেন আর তাঁর হুলোরা গদগদ হয়ে হাসত। রাত এগারটা, বারটা বা তারও বেশি সময় চলত নরক গুলজার।
একদিন আমার নাইট ডিউটি, সারারাত থানায় থাকতে হবে। রাত দশটা নাগাদ বড়বাবুর কাজের ছেলে পঞ্চার সাথে থানার বারান্দায় দেখা হল, সে নিচে এসেছিল সিগারেট কিনতে। পঞ্চা বলল, “স্যার, আজ খুব জমেছে।” আমি প্রশ্ন করলাম, “কি করে বুঝলি?” পঞ্চার উত্তর, “আজ যা খিস্তি হচ্ছে, তা বাপের জন্মে শুনিনি।” বুঝলাম, আসর জোর জমেছে। আমি পঞ্চাকে বললাম, “তাড়াতাড়ি ওপরে যা, শিখে নে সব, পরে কাজে লাগতে পারে।” পঞ্চা আমার কথায় একটু লজ্জা পেয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। আমি অন্য কাজে চলে গেলাম।
ঘণ্টাখানেক পর আমার এক অধস্তন কর্মচারী এসে বলল, “স্যার, ওপর থেকে বড়বাবু ফোন করে বললেন, একটু পরে বিশুবাবু নামবে, তাকে সিক্সটি এইট লিখে লক আপে ঢুকিয়ে দিতে।” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তার মানে?” উত্তরে সে বলল, “হ্যাঁ, স্যার, এক্ষুণি বড়বাবু ফোন করে জানতে চাইলেন ডিউটি অফিসার কে আছে। আমি আপনার নাম করতেই, উনি ওই কথা বলে ফোনটা নামিয়ে রাখলেন।” আমি বললাম, “ঠিক আছে, আপনি যান।” দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম আমি, নিশ্চয়ই এমন কিছু হয়েছে যাতে বড়বাবু বিশুদার ওপর রেগে গিয়ে ওই অ্যারেস্টের অর্ডার দিয়েছেন। কিন্তু আমি যদি বড়বাবুর ঐ নির্দেশ মত কাজ না করি তবে আগামীকাল থেকে আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে শুরু করবে। তাই আমি বড়বাবুকে অযথা সে সুযোগ দেব না ঠিক করে উপর থেকে আমি সিঁড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, যাতে বিশুদা নামলেই ধরে লক আপে ঢোকাতে পারি। ওই থানার লাক-আপটা ছিল আবার সিঁড়ির পাশেই।
মিনিট দুয়েক পরেই দেখি বিশু উকিল একা একা বকতে বকতে টলতে টলতে নামছে। সিঁড়ির শেষ ধাপে পা রেখে সে যখন বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ঘুরতে যাচ্ছে, আমি বললাম, “এই যে বিশুদা ওই দিকে নয়, এদিকে আসুন।” বিশুদা তখন তো আর জানে না আমি কি উদ্দেশে তাকে উল্টো দিকে ডাকছি। বিশুদা আমার দিকে তাকিয়ে বকবকানি থামিয়ে বলল, “কে, রুণু? আমি কি ভুল রাস্তায় যাচ্ছিলাম?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, এদিকে আসুন।” ইতিমধ্যে আমি ইশারা করে দিয়েছি, জমাদার লক- আপের তালা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। বিশুদা ঘুরে একটু এগিয়ে আসতেই আমি কনুইটা ধরে লক-আপের সামনে নিয়ে গেলাম। বিশুদাকে লক-আপের ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম। লক-আপে চোর, পকেটমার, আরও নানারকম আসামী ছিল। বিশুদাকে চেনে অনেকেই, তারা ওকে দেখেই আওয়াজ দিতে শুরু করল, “আরে বিশে উকিল, আমাদের সাথে রাত কাটাবে।” ঐ আওয়াজেই বিশুদার সম্বিত ফিরে এল। এবার আমাকে গালাগালি করতে লাগল। আমি দূর থেকে শুনতে পাচ্ছি। আজ সারারাত ধরেই উকিলবাবু আমার বাপান্ত করে যাবে নির্ঘাৎ।
আমি সে দিকে কান না দিয়ে বড়বাবুর নির্দেশ মত ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করে রাখলাম, “মত্ত অবস্থায় থানার সামনে আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে।” কিছুক্ষণ পর জমাদার এসে বলল, “স্যার, বিশুবাবু লক-আপের দরজার সামনে বসে আপনার নামে যা তা বলে যাচ্ছে।” আমি হেসে বললাম, “বলুক গে। আচ্ছা পঞ্চাকে একবার খবর পাঠান যাবে, আমি ডাকছি? সে যেন বড়বাবু ঘুমিয়ে পড়লে আমার সাথে একবার দেখা করে।” পঞ্চাই বলতে পারবে কি এমন ঘটেছিল যে বড়বাবু তার প্রাণের বন্ধু বিশুদার ওপর রেগে লক-আপে পুরে দিতে বললেন। রাত প্রায় একটা নাগাদ পঞ্চা আমার কাছে এল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁরে পঞ্চা, কি এমন হয়েছিল রে, যার জন্য বড়বাবু বিশুদাকে লক-আপে পুরে দিলেন?” পঞ্চা একটু হেসে বলল, “সে অনেক ঘটনা স্যার, বলব?” আমার কৌতূহল আরও বাড়ল। বললাম, “বল।”
পঞ্চা শুরু করল, “তখন তো দেখলেন, আমি সিগারেট নিয়ে ওপরে গেলাম। আমি বড়বাবুকে সিগারেট দিয়ে রান্নাঘরে গিয়েছি ওদের জন্য আলু ভাজা বানিয়ে আনতে। ভাজা নিয়ে যখন রান্নাঘর থেকে বেরচ্ছি দেখি বিশুবাবু বড়বাবুর শোওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে আমার আগে আগে চলেছেন। উনি বড়বাবুকে গিয়ে বললেন, ‘তোর টেস্ট আছে, কি সুন্দর সাদা মার্বেল দিয়ে তুই বাথরুমটা বানিয়েছিস। আমার বাথরুমটা জানিস কল্যাণ, সাদা নয়।’ বড়বাবু বিশুবাবুর কথা শুনে মাথা নেড়ে হাসছিলেন। আমি খাবার দিয়ে রান্নাঘরে চলে এসেছি। কিছুক্ষণ পর বড়বাবুর রোধহয় খেয়াল হয়েছে বাথরুম তো সাদা মার্বেল দিয়ে তৈরি নয়, লাল সিমেন্টের। বিশুবাবু তবে কেন বলল সাদা মার্বেলের? সেটা দেখতে উনি শোওয়ার ঘর দিয়ে বাথরুম যাচ্ছিলেন, ঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে আমায় ডাকলেন, আমি ছুটে গেলাম।” এই পর্যন্ত বলে মুখে হাত চাপা দিয়ে বেদন হাসতে লাগল পঞ্চা। কোনমতে হাসি থামিয়ে বলল, বড়বাবু তখন খুব রেগে বিশুবাবুর বাপ মা তুলে গালাগালি দিচ্ছেন। আমায় দেখে বললেন, দেখেছিস, বিশু কি করেছে? বড়বাবু আমায় বিছানাটা দেখালেন, দেখি সাদা ধবধবে বিছানাটা পুরোপুরি ভেজা।” হাসির চোটে পঞ্চার দম আটকে আসতে লাগল। কোনমতে বলল, “বড়বাবু তেড়ে তেড়ে উঠছিলেন, শালা আমায় বলে কিনা তোর টেস্ট আছে, মার্বেল দিয়ে বাথরুম বানিয়েছিস খুব সুন্দর।”
আমি বুঝলাম, বিশুবাবু বাথরুমে না গিয়ে বড়বাবুর বিছানাটাকে নেশার ঘোরে বাথরুম ভেবে মনের আনন্দে পুরোপুরি ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। পঞ্চা বলল, “বড়বাবু নাক টিপে ওখান থেকেই ফোন করে আপনাকে বললেন বিশুবাবুকে লক-আপে পুরে দিতে। তারপর বিশুবাবুকে গালাগালি দিতে দিতে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিয়েছেন। শুক্লাবাবুদের কোনও কথা বলতে দেননি।” আমি কোনমতে হাসি চেপে জানতে চাইলাম, “তা বড়বাবু এখন কোথায় ঘুমচ্ছেন?” পঞ্চা বলল, “কোথায় আর ঘুমবে, ড্রয়িং রুমের সোফায়। কাল আমাকেই দেখবেন ওই বিছানা ফেলতে হবে, যা গন্ধ না স্যার, নিশ্চয়ই কোনও রোগ আছে।” আমি পঞ্চাকে আর কথা বাড়াতে না দিয়ে বললাম, “ঠিক আছে তুই যা।” পঞ্চা চলে যেতে আমি বড়বাবুর বিছানার হাল মনে করে একচোট হেসে নিলাম। বিশুদা তখনও লক-আপে বসে আমায় বাছা বাছা গালাগালি দিচ্ছে, শুনতে পাচ্ছি।
পরদিন সকালে বড়বাবু নিচে নেমে লক-আপে বিশুদাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “আরে বিশু তুই এখানে?” বড়বাবু এমনভাবে কথাটা বললেন যেন উনি কিছু জানেন না। বিশুদা আমাকে শাপ-শাপান্ত করতে করতে বলল, “রুণু কাল রাতে আমায় এখানে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।” তারপর অন্যান্য আসামীদের দেখিয়ে বলল, “আমাকে এ শালারা সারারাত গালাগালি দিয়েছে, উৎপাত করেছে।” বড়বাবু হাসি হাসি মুখে বিশুদাকে প্রশ্ন করলেন, “কাল রাতে ভাল ঘুমিয়েছিস তো?” বিশুদা বড় বড় চোখ করে বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কল্যাণ তুই কি আমার সঙ্গে ইয়ারকি মারছিস।” বড়বাবু বিশুদার কথা যেন শোনেনই নি এমন ভাব দেখিয়ে জমাদারের হাত থেকে চাবিটা নিয়ে নিজেই লক-আপ খুলে বিশুদাকে বললেন, “তুই এখন বেরিয়ে আয়, আজ রুপুকে দেখছি।” বিশুদা লক-আপ থেকে বেরিয়ে বলল, “কি আর দেখবি? এক রাত তো আমায় হাজতবাস করিয়ে দিল রুণুটা।” বড়বাবু বললেন, “তা করাল, কিন্তু কি জন্য করাল তা একটু তদন্ত করে দেখি।”
বড়বাবু নিজের ঘরে এসে বসলেন, পিছু পিছু বিশু উকিলও ঢুকল। বড়বাবু আমার লেখা কেস রিপোর্ট পড়তে লাগলেন। তার মধ্যেই বিশুদা বড়বাবুকে বলল, “কল্যাণ, তবে এখন আমি বাড়ি যাই। বাড়িতে সবাই চিন্তা করছে, সারারাত ফিরিনি, কি ভাবছে কে জানে।” বড়বাবু পড়া ছেড়ে মুখ তুলে বললেন, “সে কি রে তুই বাড়ি যাবি কি করে? তোর নামে তো রুণু সিক্সটি এইট লিখে গেছে, তুই কাল রাতে থানার সামনে মাতলামি করছিলি।” বিশুদা বড়বাবুর কথা শুনে ধপাস করে সামনের একটা চেয়ারে বসে পড়ে বলল, “তুই বিশ্বাস করলি কল্যাণ? আমায় কখনও মাতাল হতে দেখেছিস? যতই খাই, জ্ঞান আমার টনটনে থাকে না? তুই বল? যা করার কর, আমায় এখন যেতে দে।” বড়বাবুর চোয়াল একটু শক্ত হল, তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, “তা হয় না, এখানে দেখছি তোকে কোর্টে পাঠানর চালানও করে রেখে গেছে রুণু, আমি তোকে ছাড়তে পারি না।” বিশুদা এবার আর্তনাদ করে উঠল, “তাহলে কি হবে?” বড়বাবু নির্বিকার ভাবে বললেন, “কি আর হবে, কোর্টে যাবি।” বিশুদা আঁতকে উঠল, “ওরে আমার মান-সম্মান সব যাবে, তুই বুঝতে পারছিস না?” বড়বাবুর ঠাণ্ডা গলা, “আমি বুঝে কি করব? তোকে যদি কোর্টে না পাঠাই, রুণু তোদের বার অ্যাসোসিয়েশনে জানাবে, তখন ওকালতির লাইসেন্সও ক্যানসেল হয়ে যেতে পারে।” বিশুদা এবার প্রায় কেঁদে ফেলল, “আমায় তুই বাঁচা কল্যাণ, লাইসেন্স গেলে আমি খাব কি, মুখ দেখাব কোথায়?”
বড়বাবু চুপচাপ বিশুদার কথা শুনে যাচ্ছেন। বিশুদা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বড়বাবুর সামনে গিয়ে পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমায় বাঁচা কল্যাণ, আমায় বাঁচা।” বড়বাবু বিশুদার কাছ থেকে এরকম কিছু বোধহয় আশা করেননি, তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বিশুদাকে টেনে তুললেন। “ঠিক আছে, দেখছি কি করা যায়, তুই বস।” বিশুদা চোখ মুছতে মুছতে একটা চেয়ারে বসল। বড়বাবু বললেন, “আরে তোর সকালের চা খাওয়া হয়নি তো।” বিশুদা মাথা নেড়ে জানাল, না। বড়বাবু আর্দালিকে চা আনতে দিলেন। চালানটা বড়বাবু চেপে দিলেন শেষ পর্যন্ত। বিশুদাকে কোর্টে না পাঠিয়ে বাড়ি যেতে বললেন।
সেদিন সন্ধেবেলায় থানায় এসে সব খবরই পেলাম। পঞ্চা বলল, ““স্যার, পুরো বিছানাটাই ফেলে দিয়েছি।” আমি হেসে ফেললাম, “জানি পঞ্চা, তুই এখন যা।” বড়বাজার থানার বড়বাবুর বিসতারার কি ভাবনা? একটা গেলে দশটা আসবে!