৮
এক পড়ন্ত বেলায় আমরা অফিসে বসে আছি। সেটা ছিল ছেষট্টি সালের নভেম্বর মাসের তিন তারিখ। হঠাৎ খবর এল, নিউ আলিপুরের একটা ফ্ল্যাটে এক ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন। ব্যস, তোল পাল, চালাও তরী। আমরা দুটো গাড়ি নিয়ে সাত আটজন জুনিয়র ও সিনিয়র অফিসার ছুটলাম। কে খুন হয়েছেন, কখন খুন হয়েছেন, কিভাবে খুন হয়েছেন, আমরা তখনও কিছুই জানি না।
আমাদের গাড়ি দুটো ঠিকানা মিলিয়ে সেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। বাড়ির সামনে প্রচুর ভিড়। আলিপুর থানার অফিসার ও সিপাইরা ভিড় সামলাতে ব্যস্ত। আমরা ফ্ল্যাটে ঢুকলাম। ভেতরেও অনেক লোক, কোনও একটা ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। পুলিশ দেখে ভিড় একটু সরে গেল। আলিপুর থানার দুজন অফিসার ফ্ল্যাটেই ছিলেন। তাঁরা প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট লিখে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দেখলাম, রান্নাঘর আর ডাইনিং হলের সামনে করিডোরের ওপর পড়ে আছে মৃতদেহ। বীভৎস দৃশ্য। ভদ্রমহিলার মুখে খুনী কোনও ভারি পাথর বা বড় হাতুড়ি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে করে একেবারে থেঁতলে দিয়েছে। মাথায় মেরে খুলি চৌচির করে ফেলেছে। জমাট রক্তে চুল আটকে আছে মেঝের সাথে। বুকে, তলপেটে প্রচণ্ড আঘাতের চিহ্ন। জামাকাপড় লণ্ডভণ্ড। বোঝা যাচ্ছে খুন হওয়ার আগে ভদ্রমহিলা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। সম্ভবত এত আঘাত সহ্য করতে না পেরে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে যান। তখন আততায়ী প্রতিহিংসার জ্বালায় গায়ের সব শক্তি এক করে ভারি কিছু দিয়ে আঘাত করতে করতে মুখটাকে একদম বিকৃত করে ছেড়েছে। ভদ্রমহিলার কে এমন শত্রু ছিল যে খুন করার পরও ওইভাবে চোখ, মুখ, নাকের ওপর আঘাত করেছে! হামান দিস্তার মত মারতে মারতে হিংসার তাড়নায় জ্বলতে জ্বলতে নিজের জ্বালা মিটিয়েছে। প্রকৃত মুখের অবয়বের কোনও চিহ্নই আর অবশিষ্ট রাখেনি, মুখটা একটা দলা পাকান মাংসপিণ্ডে পরিণত করেছে। এত বীভৎস খুন আগে কখনও দেখিনি।
আমাদের ফটোগ্রাফার ছবি তুলে নিয়ে গেল। আমরা তদন্তের কাজ শুরু করলাম। ভদ্রমহিলার নাম মহালক্ষ্মী দত্ত। ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশনের ম্যানেজারের স্ত্রী। বিশাল সাজান ফ্ল্যাট তখন বিধ্বস্ত, ওলটপালট। আলমারি ভাঙা, দেরাজ ওল্টান, চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জামাকাপড়, অন্যান্য জিনিসপত্র। খুনী মহালক্ষ্মী দেবীকে খুন করার পর স্টিল ও কাঠের আলমারি, দেরাজ ভেঙে গয়নাগাঁটি, জামাকাপড় ইত্যাদি নিয়ে চম্পট দিয়েছে। কতটা কি নিয়েছে আমরা তার হিসাব নিতে পারছি না, কার থেকে জানব ওই পরিস্থিতিতে? ভদ্রমহিলার স্বামী মিঃ দত্ত ছাড়া ওই পরিবারের আর এক সদস্য তাঁদের চোখের মণি একমাত্র মেয়ে। তার ও তার বাবার তখন যা অবস্থা, কি প্রশ্ন করব তাদের? আমাদের তবু কর্তব্যের খাতিরে নিষ্ঠুর, দয়ামায়াহীন হতেই হল। ‘আইনের স্বার্থে, তদন্তের অগ্রগতির জন্য, সূত্র ধরে খুনীকে গ্রেফতারের আশায় জিজ্ঞাসাবাদ করে যাচ্ছি বিভিন্ন জনকে।
ইতিমধ্যে আলিপুর থানার কর্মীরা মহালক্ষ্মী দেবীর মৃতদেহ সাদা কাপড় ঢেকে তুলে নিয়ে গেছে পোস্ট মর্টেমের জন্য। জানি, মমিনপুরের নারকীয় মর্গে কাটাছেঁড়ার জন্য চলে যাবে এই ধনী গৃহবধূর দেহ। সেখানে প্রথমেই বিশাল বিশাল ইঁদুরেরা ছুটে এসে খেয়ে নেবে তাঁর চোখ দুটো। লাশের গাদায় হিম জমাট অন্ধকার ঘরে অসহ্য দুর্গন্ধময় পরিবেশে পড়ে থাকবেন তিনি। লাশকাটা ঘরের চারপাশে ঘুরে বেড়াবে শুয়োর, কুকুর, শেয়াল নিশ্চিন্তে, এই কলকাতা শহরের বুকেই আমাদের সভ্যতার অহংকারের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে। তারপর আগামীকাল এক বেহেড মাতাল ডোমের দয়ায়, মৃতার আত্মীয় পরিজনের সাথে টাকাপয়সার হিসেবনিকেশ শেষ হওয়ার পর শুরু হবে পোস্ট মর্টেম সেই ডোমের হাতেই। দূর থেকে দাঁড়িয়ে ডাক্তার তা দেখে রিপোর্ট লিখে রাখবেন খাতায়। তাঁর ভিসেরা কেটে পলিথিনের ব্যাগে আলাদা করে রাখা থাকবে আরও হাজার হাজার ভিসেরার সঙ্গে। তারপর ডোমই সেলাই করে দেবে তাঁর দেহ। একটা ছোট দরজা দিয়ে বেরিয়ে চলে আসবে নিকট আত্মীয়ের হাতে তাঁর কাটাছেঁড়া শরীর, সঙ্গে সৎকার করার ছাড়পত্র। ওই পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট অনেক তদ্বির তদারকি করেও মাস দুয়েকের আগে পাওয়া যাবে না -হাতে। এই নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম আজও নেই।
মহালক্ষ্মী দেবীর মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়েই পুলিশি কর্তব্যের মধ্যে এইসব ভাবনা মনে আসছে। আশেপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন ও পাড়ার ছেলেদের জিজ্ঞেস করে তখন পর্যন্ত আমরা যা জানতে পেরেছি তা হল, স্বামী আর একমাত্র মেয়ে নিয়ে ছিল তাঁর সুখের সংসার। কেউ কোনদিনও তাঁদের উঁচুগলায় কথা বলতে পর্যন্ত শোনেনি। মিঃ দত্ত এতবড় চাকরি করেন, কিন্তু এতটুকু অহংকার নেই, ভীষণ অমায়িক ও ভদ্র। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় তিনি মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে যান। স্কুলেরই একজন লোক ও গাড়ি ঠিক করা আছে। লোকটি মেয়েকে বাড়ির সামনে ছেড়ে দিয়ে চলে যায় ছুটির পর।
সেদিনও মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে বারবার কলিংবেল টিপছে, “মা-মা” বলে ডাকছে, কিন্তু মা দরজা খুলছেন না। অথচ ফ্ল্যাটের বাইরে কোনও তালা ঝুলছে না, ভেতর থেকে ডোর লকটা আটকান, তার মানে মা ভেতরেই আছেন। মাসখানেক হল নকুল নামে ওড়িশার একটা লোক ঘরের কাজের জন্য বহাল হয়েছে, সেও কি বাড়িতে নেই? মেয়েটি কিছুই বুঝতে পারছে না। প্রায় আধঘণ্টা পর পাড়ার লোকেদের ডাকল সে। তারা এসে দরজা ধাক্কা দিতে শুরু করল, কিন্তু ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ নেই। তারা দরজা ভেঙে ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকে হকচকিয়ে গেল। সারা ফ্ল্যাট জুড়ে যেন প্রলয় হয়ে গিয়েছে, জিনিসপত্র ছত্রাকার। একটু এগিয়ে যেতেই তাদের চোখে পড়ল মহালক্ষ্মী দেবীর বিকৃত নিষ্প্রাণ দেহ। সঙ্গে সঙ্গে তারা ফ্ল্যাটেরই ফোন থেকে খবর দিল আলিপুর থানায়, পাড়ার এক ডাক্তারবাবুকে আর মিঃ দত্তকে তাঁর অফিসে। মেয়েটি ওই দৃশ্য দেখে পাগলের মত করতে লাগল, তাকে সামলান দায়। আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকে দু একজন মহিলা এসেছিলেন, তাঁরা তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন অন্য একটা ঘরে। কিন্তু নকুল নেই কোথাও। নকুল প্রতিদিন তিনটে নাগাদ বেরিয়ে যেত ঘণ্টা দেড়েকের জন্য, আজও কি সে বেরিয়ে যাওয়ার পর এই ঘটনা ঘটেছে না কি অন্য কিছু?
ডাক্তার ও আলিপুর থানার পুলিশ প্রায় একই সঙ্গে ফ্ল্যাটে এসে পৌঁছলেন। ডাক্তার দূর থেকে দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়ে পুলিশ অফিসারকে জানিয়ে দিলেন অমোঘ সত্যটা। আমাদের পৌঁছনর অল্প কিছুক্ষণ আগেই মিঃ দত্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন তাঁর ফ্ল্যাটে। তখন থেকে তিনি প্রায় বোবা। কোনমতে কয়েকজন আত্মীয় বন্ধুর টেলিফোন নম্বর বলতে পেরেছেন পাড়ার ছেলেদের, তারা সেইসব জায়গায় ফোন করে চলে আসতে বলেছে তাঁদের। আমরা পৌঁছবার পরও দেখলাম তিনি কিছুতেই ধাতস্থ হতে পারছেন না।
এদিকে আস্তে আস্তে কার্তিক মাসের সন্ধে নেমে এসেছে। কিন্তু নকুলের কোনও খবর নেই, সে কোথায় গেছে কেউ বলতে পারল না। মিঃ দত্ত আমাদের অনেক অনুরোধে কোনমতে তাঁদের হারানো গয়নাগাঁটির একটা হিসেব দিলেন। আমরা বললাম, “এই ফ্ল্যাটে আজ আর আপনারা থাকবেন না, অন্য কোনও বাড়িতে গিয়ে থাকুন। আগামীকাল আমরা আবার আসব। কি কি জিনিস খোয়া গেছে তার তালিকাটা আরও ভালভাবে করব।” আমাদের প্রশ্নের উত্তরে মিঃ দত্ত জানালেন, তিনি নকুলের কোনও ঠিকানা জানেন না। মাসখানেক আগে বাড়ির সামনে এক রবিবার সকালে তাঁর সঙ্গে নকুলের আলাপ হয়েছিল, সেদিন নকুল তাঁকে বলেছিল যে সে বাড়িতে কাজ করতে চায়। মিঃ দত্ত সেদিন থেকে নকুলকে তাঁর বাড়িতে সারাদিনের কাজের লোক হিসেবে বহাল করেছিলেন। সে রান্না করত, থাকত। আর কিছু জানেন না। এমন কি নকুলের পদবিও তিনি বলতে পারলেন না। তারপর আমাদেরই পরামর্শে আলিপুর থানার অফিসাররা ফ্ল্যাটটা বন্ধ করে মিঃ দত্ত ও তাঁর মেয়েকে অন্য বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। আমরা সেদিনের মত চলে গেলাম, কিন্তু বাড়ির ওপর সারারাত আমাদের নজরদারেরা নজর রাখল। অনেকসময়ই খুনী অকুস্থলে ফিরে আসে কিনা! কিন্তু না, তেমন কিছুই তাদের নজরে পড়ল না।
পরদিন সকালে মিঃ দত্তের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে নিয়ে আবার ফ্ল্যাটে গেলাম। মিঃ দত্তর চোখমুখ লাল, চোখের নিচে একরাতেই কালি বসে গেছে। বোঝা গেল গতরাতে তিনি একটুও ঘুমোননি। আমরা কি করব? কর্তব্যের খাতিরে তাঁকে বিরক্ত করতেই হবে। আমরা সেই লণ্ডভণ্ড ফ্ল্যাটে ঢুকে আততায়ী কি কি জিনিস নিয়ে গেছে মিঃ দত্তর কাছ থেকে এক এক করে জানতে লাগলাম। গতদিনের তৈরি করা তালিকার সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখতে লাগলাম। মিঃ দত্ত এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে তাঁকে বারবার প্রশ্ন করে বিব্রত করতে আমাদের সঙ্কোচ হচ্ছে। কিন্তু পুলিশের চাকরি করতে এসে এসব ভাবলে চলে না, তাই ধীরে ধীরে তাঁকে সময় দিয়ে আমরা এগোতে লাগলাম। গতকালই আমরা খুনীর সম্ভাব্য ব্যবহৃত হাতিয়ারগুলো নিয়ে গিয়েছি। তার মধ্যে ছিল একটা বঁটি, বাটনা বাটার পাথরের নোড়া, একটা মোটা লাঠি, আধলা ইঁট। প্রায় সবগুলোই ছিল রক্তমাখা। এখন ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে সে সব পরীক্ষার জন্য রাখা আছে। তাছাড়া নিয়ে গিয়েছি নকুলের ব্যবহৃত কিছু জিনিস, সূত্র খোঁজার জন্য।
মিঃ দত্ত কিন্তু কিছুতেই নকুলের নাম ছাড়া আর কিছু মনে করতে পারছেন না। তবে তিনি নকুলের চেহারার একটা বর্ণনা দিলেন, আর জানালেন ওর বয়স খুব বেশি হলে হবে বছর চল্লিশেক। কিন্তু দড়কচা মেরে এমন হয়েছে যে মনে হয় পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন। তিনি এরপর আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিলেন। নকুল প্রতিদিন মহালক্ষ্মী দেবীর কাছ থেকে চারটে করে টাকা নিয়ে বিকেলে বেরত। ফিরে এসে বসে বসে ঝিমত। মিঃ দত্তের অনুমান, নকুল বাইরে বেরিয়ে গিয়ে আফিং খেয়ে ফিরত। এর বেশি আর কোনও খবর তিনি নকুল সম্পর্কে দিতে পারলেন না। তিনি জানালেন, তাঁদের পরিবারের বা মহালক্ষ্মী দেবীর এমন কোনও শত্রু নেই যাকে তিনি খুনী হিসেবে সন্দেহ করছেন। গতকাল সকালে তিনি যেমন মেয়েকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরন তেমনই বেরিয়েছিলেন, যাওয়ার সময়ই তিনি শেষবার নকুলকে দেখে গিয়েছেন। সে তখন যথারীতি বাড়ির কাজকর্ম করছিল। হঠাৎ কি যে সব ঘটে গেল তা তাঁর কাছে এখনও দুঃস্বপ্নই। টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি যা গিয়েছে তার জন্য তিনি দুঃখিত নন, কিন্তু মহালক্ষ্মী দেবীর মৃত্যু তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। মেয়ের কথা ভেবে তিনি আরও কাতর হয়ে পড়ছেন। আমরা আর কি সান্ত্বনা দিতে পারি? তবু যতটুকু সম্ভব আমরা বোঝনোর চেষ্টা করলাম। আর প্রতিজ্ঞা করলাম, মহালক্ষ্মী দেবীর খুনীকে ধরবই, তাহলে মিঃ দত্ত কিছুটা সান্ত্বনা পাবেন। আসলে সেসময় পুলিশের মধ্যে হিউম্যান এলিমেন্ট ছিল, আজকের দিনে যা দুর্লভ।
আমরা ভাবছি, ওই রকম একজন শিক্ষিত, উচ্চপদস্থ অফিসার কি করে একটা অচেনা, অজানা ওড়িশাবাসী লোককে সারাদিনের কাজের জন্য ঠিক করলেন? এমন কি তিনি তার ঠিকানা পর্যন্ত রাখেননি। আগে নকুল কি করত বা কোথায় থাকত তারও কোনও খোঁজ নেননি, এটা সত্যিই অদ্ভুত। আমরা মিঃ দত্তকে তাঁর ফ্ল্যাটে তাঁর আত্মীয়দের কাছে রেখে বেরিয়ে এলাম।
ঠিক করলাম, এই হত্যারহস্যের সমাধানের জন্য নকুলকে খুঁজে বের করতেই হবে। কিন্তু একমাত্র আফিং খাওয়ার খবর ছাড়া তার সম্পর্কে আমরা আর কিছুই জানি না। না আছে তার ফটো, না ঠিকানা, না বন্ধুবান্ধব কিংবা আত্মীয়স্বজনের কোনওরকম হদিস। নিউ আলিপুরের আশেপাশে কোথায় আফিংয়ের দোকান আছে, শুরু করলাম অনুসন্ধান। খুঁজতে খুঁজতে একটা দোকান পেয়ে গেলাম কালীঘাট অঞ্চলে। ভেবে দেখলাম, প্রতিদিন আফিং যখন সে কিনতে আসত তখন তার মত অন্য নেশাখোর খদ্দেরের সঙ্গে তার পরিচয় হতেই পারে, বন্ধুত্বও হতে পারে। সে প্রতিদিন বিকেল তিনটের সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত, অনুমান করা যায়, দোকানে পৌঁছতে তার সাড়ে তিনটে বাজত। তারপর আফিং খেয়ে নিশ্চয়ই কোনও জায়গায় একটু বসে সে ফিরে যেত ফ্ল্যাটে। সেই হিসেব অনুযায়ী আমি সাড়ে তিনটে নাগাদ ওই আফিংয়ের দোকানে গেলাম। প্রথমে দোকানদারকে নকুল সম্পর্কে প্রশ্ন করতে সে বলল, “হ্যাঁ, ওই রকম একটা লোক আসত বটে, তবে কোথা থেকে আসত, কোথায় চলে যেত, তা তো বলতে পারি না।”
তারপর আমি খদ্দেরদের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। চার পাঁচজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে পেয়ে গেলাম ওড়িশার বাসিন্দা একজনকে। নকুলকে চেনে কিনা জিজ্ঞেস করতে সে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, চিনি, এখানেই ওর সাথে আমার আলাপ হয়েছিল, সে তো নিউ আলিপুরে একটা বাড়িতে কাজ করত। দিন কয়েক আগে বলল, আগের বাড়িটা ছেড়ে মাসখানেক হল নিউ আলিপুরেই অন্য একটা বাড়িতে কাজ শুরু করেছে।” অন্ধকারে একটুখানি ফিকে আলো। তাড়াতাড়ি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “আগে যে বাড়িতে সে কাজ করত, সেই বাড়ি তুমি চেন বা বাড়ির কর্তা কি অন্য কারও নাম জান?” সে বলল, “না, তা তো আমি জানি না, এখন কোন বাড়িতে কাজ করে তাও চিনি না।” হাল না ছেড়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, “ওড়িশার কোথায় ওর বাড়ি, কোনদিন কিছু বলেছে?” লোকটি বলল, “না, জানি না, এখানে আসত, আফিং কিনে দু চার মিনিট কথা বলে চলে যেত, তার মধ্যে এত কথা কখন হবে?”
আমি ওই সামান্য তথ্যই মুঠিতে ধরে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। নকুল মিঃ দত্তর বাড়িতে কাজ করার আগে নিউ আলিপুরেই অন্য একটা বাড়িতে কাজ করত। কিন্তু কোন বাড়িতে কাজ করত তা জানি না। সেই বাড়িটা যদি খুঁজে বার করতে পারি, তাহলে হয়ত সেখান থেকে নকুলের সুলুক সন্ধান কিছু পেলেও পেতে পারি। উপায়ান্তর না দেখে নিউ আলিপুর অঞ্চলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, নকুলের বর্ণনা দিয়ে জানতে – চেষ্টা করলাম, তেমন কোনও লোক তাদের বাড়িতে মাসখানেক আগে কাজ করেছে কিনা। সারাদিন চলে গেল, কিন্তু কোনও বাড়ি থেকেই সদুত্তর পেলাম না। এ যেন তুলোর বস্তার মধ্যে পিন খোঁজা। নিউ আলিপুর তো একেবারে ছোট অঞ্চল নয়। ধৈর্য ধরে এগিয়ে যেতে হবে!
এদিকে এক একটা দিন যাচ্ছে, পত্রপত্রিকায় আমাদের ব্যর্থতা নিয়ে জ্বালাময়ী সব রিপোর্ট বেরচ্ছে। তিন তারিখে খুন হয়েছেন মহালক্ষ্মী দেবী, তিন দিন পার হয়ে গেল, এখনও কিনা খুনীর হদিস করতে পারলাম না, এতবড় অপদার্থ আমরা! সেইসব লেখায় তখন কলকাতা উত্তাল। মিঃ দত্ত উচ্চপদস্থ অফিসার, সমাজে তাঁর বিরাট প্রতিষ্ঠা ও যোগাযোগ। তার ওপর তাঁর নিহত স্ত্রীও এক নামকরা পরিবারের মেয়ে ছিলেন, আলোড়ন তো হবেই, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা বসে আছি, করছি না, খুনীকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছি না, তা তো নয়। আসলে তদন্তের স্বার্থেই আমরা কোন পথে কিভাবে এগচ্ছি তা খবরের কাগজকে জানাতে পারছি না।
আবার একদিন আমরা নিউ আলিপুরে নকুলের আগের মালিকের খোঁজে বের হলাম। বাড়ি বাড়ি খোঁজ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছি, “না” শুনে কান পচে গেল। মিঃ দত্তের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটা বাড়িতে গৃহকর্তাকে প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, “হ্যাঁ, ওই রকম একটা লোক কদিন আগে আমার কাছ থেকে একটা মানি অর্ডার ফর্ম ভর্তি করিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।” আমার তখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল, “বাবা, অন্ধজনে দেহ আলো।” তাড়াতাড়ি প্রশ্ন ছুঁড়লাম, “সেই ঠিকানাটা আপনার মনে আছে?” উনি একটু হেসে বললেন, “আপনারা ভেতরে আসুন।” উনি আমাদের ড্রয়িংরুমে নিয়ে গিয়ে সোফা দেখিয়ে বললেন, “আপনারা বসুন, আমি একটু ভেবে দেখি ঠিকানাটা মনে করতে পারি কি না।” তিনি পাশের ঘরে চলে গেলেন। ড্রয়িংরুমের চারদিকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বিভিন্ন রকমের ফটো, তাঁদের লেখা বই। উনি মিনিট দশেক পর ফিরে এলেন। আমি তখন ফটোগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। ভদ্রলোক হেসে বললেন, “আমার পূর্বসূরীদের ছবি।” তারপর একটু থেমে বললেন, “দেখুন, আমি শুধু সেই মানি অর্ডারের পোস্ট অফিসের নামটা মনে করতে পারছি, আর যেটুকু মনে আছে তা হল মানি অর্ডারটা পাঠান হয়েছিল একজন মহিলাকে। তবে তাঁর নামটা মনে পড়ছে না।” আমি পোস্ট অফিসের নামটা জানতে চাইলাম, উনি বলতে আমি সেটা আমার নোট বইতে লিখে রাখলাম। তারপর অনুরোধ করলাম, “আমরা আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছি, ততক্ষণে দেখুন না ঠিকানাটা মনে পড়ে কিনা।” উনি হেসে বললেন, “মনে পড়লে এতক্ষণে পড়ত, আমি আপনাদের অবস্থাটা বুঝতে পারছি, ঠিক আছে, যদি হঠাৎ মনে পড়েই যায় তবে টেলিফোনে আপনাদের জানিয়ে দেব।” আমরা আর কি করি ফিকে আলোটা সামান্য উজ্জ্বল করে বাংলার বাঘের উত্তরসূরীর অঙ্গন থেকে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়।
লালবাজারে এসে ঠিক হল একমাত্র পোস্ট অফিসের নামের সূত্র ধরেই নকুলের সন্ধানে ওড়িশায় পাড়ি দেওয়া হবে। আমি যাব, সঙ্গে যাবে কনস্টেবল শঙ্কটা মিশির। আমি প্রথমেই চলে গেলাম বড়বাজার এলাকায়। সেখান থেকে দুজন ওড়িশার লোক, একসময়ের বড় মাস্তানকে যাত্রার সঙ্গী করে নিলাম। কারণ ‘আমি ও মিশির কেউ ওড়িয়া ভাষাটা জানি না। যখন বড়বাজার থানায় ছিলাম, তখন দেখেছি ওখানে বহু ওই রাজ্যের মাস্তান আছে। ওদের ঠাণ্ডা করতে গিয়ে ওদের সাথে আমার পরিচয়। যে দুজনকে আমাদের সঙ্গী করলাম তাদের আমি আমার সোর্স বানিয়ে নিয়েছিলাম। তবে একটা জিনিস আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, আমাদের রাজ্যে, বিশেষ করে কলকাতায়, অন্য প্রদেশের লোক এসে কি করে অবাধে মাস্তানি করে? কলকাতায় সর্দারজি, বিহারি, ওড়িশাবাসী, উত্তরপ্রদেশীয়, রাজস্থানি, গুজরাটি — সবরকম মাস্তান আছে। এইসব মাস্তানদের উত্থান কি করে হয়? কাদের সাহায্যে? কই একটা বাঙালি গিয়ে তো দিল্লি, মুম্বাই, পাটনা বা ভারতবর্ষের অন্য কোনও শহরে মাস্তানি চালাতে পারে না! সেখানকার লোকেরা তাদের পিটিয়ে ছাতু করে দেবে। আমার এই ভাবনার মধ্যে হয়ত প্রাদেশিকতার গন্ধ থাকতে পারে, কিন্তু তাতে আমি অপারগ।
কারণ আমি ভাবি একমাত্র আমরাই কি “এক দেহে হব লীনের” শপথ নিয়েছি? এমনকি মাস্তানির ক্ষেত্রেও? এইসব অন্য প্রদেশের মাস্তানরা আমাদের প্রদেশে যখন মাস্তানির সুযোগ পায়, তখন তাঁরা সাধারণ মানুষের উপর নির্দয়ভাবে মাত্রাহীন অত্যাচার চালায়, এদের ভিতর বিন্দুমাত্র দয়ামায়া থাকে না। এইসব ভিনপ্রদেশী মাস্তানেরা ভীষণ নির্দয় হয়। একমাত্র টাকা রোজগার ও ফূর্তি করার চিন্তা ছাড়া অন্য কোনও চিন্তা এদের থাকে না।
সেদিনই সন্ধেবেলায় আমি আর মিশির সেই দুজন মাস্তানকে নিয়ে যাত্রা করলাম কটকের উদ্দেশে। ভাবছি, মহালক্ষ্মী দেবীর খুনীর সন্ধান পাব তো? আফিংখোর নকুল আর তার পাঠানো একটা মানি অর্ডারের পোস্ট অফিসের নাম, এই হচ্ছে সামান্য সূত্র। সেই সম্বল করে আমাদের পাড়ি। অন্ধকার চিরে ট্রেন ছুটছে। আমার মাঝে মাঝে মনে পড়ছে মহালক্ষ্মী দেবীর ছোট্ট মেয়েটার অসহায় মুখ, তার পাগল করা কান্না, মিঃ দত্তের বুকফাটা হাহাকার। সকালে যখন মিশির আমার ঘুম ভাঙাল তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। দেখলাম কোনও একটা স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। মিশির ভাঁড়ে করে চা এনে দিল, জানাল, আর অল্পসময়ের মধ্যেই কটক এসে যাবে।
সঙ্গে জিনিসপত্র বেশি কিছু নেই, কিন্তু যা আছে তা সবই জরুরি, তাই হাতে হাতে নিয়েই আমরা কটক স্টেশনের বাইরে এসে খোঁজ করতে শুরু করলাম, আশেপাশে কোথায় পোস্ট অফিস আছে। দোভাষী মাস্তানেরা জানাল কাছেই একটা পোস্ট অফিস আছে। আমরা সেখানে গিয়ে পোস্ট মাস্টারের কাছে জানতে চাইলাম নকুলের মানি অর্ডারে লেখা পোস্ট অফিসটা কোথায়? জানা গেল, সেই পোস্ট অফিস এখান থেকে অনেক দূর। আমাদের প্রথমে যেতে হবে রাজকণিকাপুর, কটক থেকে প্রায় আশি-পঁচাশি কিলোমিটার দূরে। সেখানে থেকে আরও ভেতরে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার গেলে পাওয়া যাবে সাতভায়া। সেখানে গিয়ে খোঁজ করতে হবে সেই পোস্ট অফিসের। একটা প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করলাম। ঘণ্টা চারেকের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম রাজকণিকাপুর। সেখানে সবাই বলল, ঠিক রাস্তাতেই যাচ্ছি। সাতভায়া থেকে দশ-বারো কিলোমিটার গেলে পেয়ে যাব আমাদের প্রথম লক্ষ্যস্থল সেই পোস্ট অফিসটা।
আমরা আবার গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম সাতভায়ার উদ্দেশে। সাতভায়া এসে শুনলাম, সেই পোস্ট অফিসে যেতে হলে কিছুটা যাওয়ার পর গাড়ি ছেড়ে দিতে হবে, কারণ রাস্তা কাঁচা। তখন সন্ধে হয় হয়, আমরা ঠিক করলাম, সেদিন রাতটা সাতভায়াতে কাটিয়ে পরদিন সকালে রওনা হওয়া ভাল। এখন রওনা হলে পৌঁছতে পৌঁছতে পোস্ট অফিস বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা গাড়ি ছেড়ে দিয়ে সেদিন সাতভায়াতে একটা খুবই জঘন্য হোটেলের ঘর ভাড়া করলাম। অবশ্য তার চেয়ে ভাল হোটেল ওই অঞ্চলে আর নেই। হোটেলের দুটো ঘরে চারটে খাটিয়া পেতে দেওয়া হল আমাদের। বালিশ আর তোষক বলে যা দেওয়া হল, তাতে কোনও ঢাকনা পর্যন্ত নেই। এত তেলচিটে যে তাতে একবার শুনে মাসখানেক আর শরীরে তেল না মাখলেও চলবে। ঘর দুটোই খুব নিচু, হ্যারিকেনের আলোয় চারপাশটা ভাল দেখাও যায় না। গুপ্তি আর দোক্তার গন্ধ সারা ঘরময়। হোটেলের মালিক বলে যে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার পরিচয় হল, তিনি ইতিমধ্যেই এমন ভদ্রলোক অতিথিদের যত্ন আত্তির জন্য দুবার ঘুরে গেছেন। রাতে কি খাব বারবার জিজ্ঞেস করলেন, আমি প্রতিবারই উত্তর দিলাম, “যা খাওয়াবেন তাই খাব।” উনি আমাকে বোঝাতে চাইছিলেন, আমি যা-ই অর্ডার দিই না কেন, উনি তাই-ই বানিয়ে দিতে পারবেন এবং প্রতিটা আইটেমই এত সুস্বাদু যে বারবার চেয়ে খাব। তাঁর হোটেলের এত নাম ডাক যে, সাতভায়া এলে এখানে একবার খেতেই হবে।
মালিকভায়ার কিছু কথা আমার কানে আসছে, কিছু আসছে না, কিন্তু উনিও নাছোড়বান্দা, মনে মনে একটু বিরক্তই হলাম। মিশিরকে বললাম, “তোমাদের পছন্দ মত কিছু অর্ডার দিয়ে দাও, তাই আমি খাব।” আর পুলিশের চাকরি করতে এসে খাওয়া নিয়ে চিন্তা করার মত সময় কোথায়? সাতভায়ার হোটেলের মালিকভায়া যা দেবেন তাতেই খুশি। রাত দশটা নাগাদ খাওয়া দাওয়া হল, মালিকভায়া নিজে দাঁড়িয়ে আমাদের খাওয়ালেন। মাংস ভাত, এমনিতে খারাপ না, তবে এত মোটা চাল যে ছুঁড়ে মারলে মাথা ফেটে যেতে পারে। একটা সুবিধে, তাড়াতাড়ি হজম হবে না, আগামী দু একদিন খাওয়া জুটবে কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। এবার শোওয়ার পালা। তেলচিটে বালিশটা সরিয়ে সঙ্গে আনা ডাকব্যাকের বালিশটা ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে নিলাম, তারপর একটা চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘরের অন্য দিকে মিশির ততক্ষণে শুয়ে নাক ডাকাতে শুরু করেছে। হ্যারিকেনটা কমিয়ে রেখেছি। বড়জোর মিনিট পনের, খাটিয়ার চারপাশ থেকে বেরিয়ে পড়ল রক্তলোলুপ খটমলরা। তাদের কামড়ের ঠেলায় উঠে বসেছি। ওহে খটমলের দল, তোমরা কি ঘুষ খাও? যদি খাও তবে কত দিলে চলবে, সর্দারকে পাঠিয়ে দাও, আমি তার হাতে দিয়ে দিচ্ছি। তাও খাও না, শুধু রক্ত খাও? হ্যাঁ, তোমাদের এই গুণটা দারুণ, তোমরা নিষ্ঠাবান, উপোস করে থাকব, তবু ঘুষ খাব না। এই গুণটা যদি পুলিশের মধ্যে থাকত! খাটিয়ায় বসে এইসব আবোল তাবোল ভাবছি, হঠাৎ মিশির ভোগে গিয়ে আমাকে বসে থাকতে দেখে অবাক, “স্যার, ঘুমোননি?” আমি হেসে বললাম, “ছারপোকার কামড়ের চোটে উঠে পড়েছি।” মিশির তো আমার কথা শুনে একেবারে আকাশ থেকে পড়ল, “ছারপোকা কোথায় স্যার, ছারপোকা থাকলে আমি বুঝতে পারব না? আমি ছারপোকার কামড় মোটেই সহ্য করতে পারি না।” মিশিরকে বললাম, “না, না, এখানে তেমন ছারপোকা নেই। আমার হঠাৎ মনে হল, তাই উঠে বসে আছি, ঘুম এলেই শুয়ে পড়ব। তুমি ঘুমোও, কাল সকালে আবার আমাদের অনেক হাঁটতে হবে।” মিশির আবার শুয়ে পড়ে নাক ডাকাতে শুরু করল। হ্যারিকেনটা উস্কে দিয়ে দেখলাম, ছারপোকারা পরমানন্দে তার শরীরে মহাভোজ জমিয়েছে। আমি সারারাত বসে বসে কাটিয়ে দিলাম, কখনও ঘরে, কখনও বা বারান্দায়। ভাবছি, সাতভায়া না এসে কাছেই রিহাগড় বা আর একটু বড় শহর ভক্তিকণিকাতে গিয়ে রাতটা কাটালে ভাল হত, ওখানে সম্ভবত এর চেয়ে ভাল হোটেল পাওয়া যেত। ভেবে অবশ্য লাভ নেই, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। ভোর হয়ে এল, এবার ছোটা শুরু।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমরা হোটেলের বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এলাম। সর্দারজীদের হোটেল খুঁজে চা খেতে হবে। এই একটা জাত। সর্বত্র আছে। আর ওদের বিখ্যাত “পোয়া পাত্তি” চাটা নিশ্চিন্ত মনে খাওয়া যায়। পেয়েও গেলাম চায়ের দোকান। চা খেয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। সাতভায়া থেকে দশ কিলোমিটার মত এসে প্রথম লক্ষ্যস্থল পোস্ট অফিসে হাজির হলাম। এই পোস্ট অফিসের মারফতই নকুল এক মহিলাকে টাকা পাঠিয়েছে। কোন ঠিকানায় সেটাই এই পোস্ট অফিস থেকে খুঁজে বের করতে হবে। পোস্ট মাস্টারকে নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, “মাসখানেক আগে কলকাতা থেকে একটা মানি অর্ডার এসেছে, ক্লার নামে কোন ঠিকানায় সেটা এসেছে, জানতে চাই।” উনি বললেন, “কলকাতা থেকে তো প্রচুর মানি অর্ডার আসে, কি করে বের করবেন? ঠিক আছে, আমি আমাদের মানি অর্ডারের এন্ট্রি লেজারটা দিচ্ছি, তা দেখে যদি আপনারা বের করে নিতে পারেন, দেখুন।”
আমি সেই লেজারটা নিয়ে বসলাম, সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি তারিখ থেকে দেখতে শুরু করলাম। কলকাতা থেকে প্রচুর মানি অর্ডার এসেছে দেখছি, অর্থাৎ এ অঞ্চলের বহু লোক কলকাতায় বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে। খুঁজতে খুঁজতে ইউরেকা, এইতো, নকুল জানা, নিউআলিপুর থেকে এখানে গ্রামের এক মহিলাকে মানি অর্ডার পাঠিয়েছে। মন বলল, এই নকুল জানাই আমাদের নকুল, মহালক্ষ্মী দেবীর খুনের হদিস এবার হবেই। মহিলার ঠিকানাটা টুকে নিয়ে পোস্ট মাস্টারকে বললাম, “এই ঠিকানায় কি করে যাব, বলুন।” তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, “ওরে বাবা, সে তো অনেক দূর, প্রায় আঠের উনিশ কিলোমিটার হাঁটা পথ, মাঝখানে দুটো নদী পার হতে হবে। আর আপনি চিনবেনই বা কি করে? এখানকার লোক নিয়ে যেতে হবে।” জিজ্ঞেস করলাম, “এখানকার থানাটা কোথায়?” ভদ্রলোক জানালেন, “এখানে থানা নেই, তবে একটা ফাঁড়ি আছে।” তারপর তিনি আমার দোভাষীকে বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে আমাদের সেই ফাঁড়িতে যেতে হবে।
ফাঁড়িতে এসে নিজেদের পরিচয় দিয়ে আমাদের আসার কারণটা জানাতে ওখানকার ইনচার্জ দুজন সিপাই দিলেন সঙ্গে। স্থানীয় সিপাইদের নেতৃত্বে আমরা চলতে শুরু করলাম নকুলের গ্রামের দিকে। দুপুর বেলা, চড়া রোদ মাথায় করে হাঁটছি তো হাঁটছিই। সবারই খিদে পেয়ে গেছে। অন্যদিকে নকুলের ঠিকানাটা পাওয়ার পর থেকে একটা উত্তেজনা মাথার মধ্যে কাজ করছে। ভেবে দেখলাম এখন যদি পেটে না কিছু দিই, তবে হয়ত আর সময় পাব না। আমি দোভাষীদের বললাম, “কিছু খাবারের বন্দোবস্ত কর। সিপাইদের জিজ্ঞেস কর, কোথায় কি পাওয়া যায়?” একটু পরে ওরা একটা ঝুপড়ি দোকানে আমাদের নিয়ে গেল। সবাই ঘাড় নিচু করে ঢুকলাম। যে যা পারলাম পেটে ঢুকিয়ে নিয়ে আবার চলতে শুরু করলাম।
ঘন্টাখানেক পর আমরা পৌঁছে গেলাম বিশাল এক নদীর ধারে। ব্রাহ্মণী নদী। এখানে ব্রাহ্মণী তার চওড়া বুক নিয়ে উজানে চলেছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। খেয়া পার হতে হবে। খেয়া ছাড়ার মুহূর্তেই আমরা পৌঁছেছি। কিন্তু যা লোক তুলবার তা তোলা হয়ে গেছে, আমরা অতিরিক্ত। দেখলাম, স্থানীয় সিপাইরা নিজেদের ভাষায় চিৎকার করে মাঝিকে কি বলল। মাঝি তার উত্তরে কিছু বলে খেয়া থেকে গোটা দশেক লোককে নামিয়ে দিল। আমরা সেই জায়গা ভরাট করলাম। উচিত হল না, একদম উচিত হল না, মনে মনে ভাবছি। কিন্তু তখন নকুলকে ধরা ছাড়া আর কোন চিন্তাকেই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। দেরি হলে পাখি উড়েও তো যেতে পারে। খুনী যখন খুন করে তখন কি তার মনের ভিতর ন্যায় অন্যায় উচিত অনুচিত বোধকে মনে জায়গা দেয়? দেয় না। আমরাও সেই খুনীকে ধরতে যাবার সময় এত. উচিত অনুচিত, ন্যায় অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে পারব কেমন করে? খুনীর খুন করাটা যতটা সহজ, আমাদের তাকে গ্রেফতার করে আদালতে মামলা করে সাজা দেওয়াটা ততটা কঠিন। উদ্দেশ্য যদি ন্যায়ের পক্ষে হয়, তবে কারও ক্ষতি না করে সামান্য অন্যায় করাটা বোধহয় ঈশ্বরও ক্ষমার চোখে দেখেন।
খেয়া ছেড়ে দিয়েছে, আমরা ব্রাহ্মণীর বুকের ওপর দিয়ে চলেছি। এখান থেকে মোহনা বেশি দূরে নয়। মায়পুরার কাছে ব্রাহ্মণী তার সতীনকে নিয়ে চলেছে, দুভাগে ভাগ হয়ে মিলেছে সাগরে। বিকেলের রোদে নদীর দুপারের গ্রামগুলো সোনালি ছবির মত। ওপারের গ্রাম সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, এগিয়ে আসছে এপার। জীবনের খেয়া যেমন চলে তেমন নিয়মেই, আজ যা আছে কাল তা অতীত, আবার আজ যা নেই আগামীকাল তা ভবিষ্যৎ। ব্রাহ্মণী পার হয়ে আবার হাঁটা গ্রামের মাঝখান দিয়ে, ভীষণ গরিব সব গ্রাম, ছোট ছোট আদুল গায়ে ছেলেমেয়েদের দেখলেই বোঝা যায়, অপুষ্টির রোগে ভুগছে তারা।
আস্তে আস্তে কমে আসছে রোদ, পা চালালাম তাড়াতাড়ি, সন্ধে নেমে এলে মুশকিল। ভাঙা কাঁচা রাস্তায় দ্রুত হাঁটাও যায় না। স্থানীয় সিপাইরা আগে আগে যাচ্ছে গ্রামের মোড়ল জাতীয় লোকেদের সাথে কথা বলতে বলতে। মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে গুণ্ডি দিয়ে পান খাচ্ছে। এত পান খাওয়ার চোট দেখে আমার বিরক্ত লাগছে। কিন্তু কিছু বলতেও পারছি না। এখন ওরাই আমার কাণ্ডারী। গ্রামের ভেতর ওদের যা দাপট দেখছি, কলকাতায় কমিশনার সাহেবেরও বোধহয় এত দাপট নেই।
ঘণ্টা দুয়েক হাঁটার পর আবার একটা নদী। বৈতরণী। কে দিয়েছিল এই নাম? এই নদীর বুকে বৈঠা চালিয়ে সবাই নাকি পাড়ি দেয় স্বর্গে? আমরা তো যাচ্ছি খুনীর সন্ধানে, নরকের দরজায়। পার হওয়ার জন্য আমরা উঠে বসলাম নৌকোয়। এবার বেশি যাত্রী নেই। বৈতরণীও এখানে মোহনার কাছাকাছি এসে বেশ চওড়া। স্থানীয় সিপাইরা জানাল, কটক জেলা থেকে আমরা এবার বালেশ্বর জেলায় ঢুকছি। তাদের কাজের এলাকা ওটা নয়, তবু আমাদের সাহায্যের জন্য ওরা চলেছে সঙ্গী হয়ে। আমি ওদের ধন্যবাদ জানালাম। ওরা লজ্জা পেয়ে নৌকোর অন্য দিকে গিয়ে মাঝির সঙ্গে গ্রাম্য ওড়িয়া ভাষায় গল্প জুড়ে দিল। আমি তার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারছি না। এখানে বঙ্গসন্তান বলতে একমাত্র আমি, রবীন্দ্রনাথের মাটির গন্ধ একমাত্র আমার গায়ে বৈতরণীর বুকে তাই রবীন্দ্রনাথ সুর করে আমার গলা দিয়ে গেয়ে উঠল, “ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা…” পড়ন্ত বিকেলে বৈতরণী ঘরে ফেরার আনন্দে বিভোর, তবু মুখ ঘুরিয়ে বোধহয় একবার আমার দিকে তাকাল, কারণ দেখলাম, তার ঢেউয়ের মাথায় মাথায় সূর্যের সোনা রঙ হেসে উঠল চিকচিক করে। মাথার ওপর ডানা মেলা অসংখ্য সামুদ্রিক পাখির দল সেই সোনা রঙে নিজেদের রাঙাতে ঝাঁপ দিয়ে নেমে এল নিচে, তারপর কোথায় কোন অজানা আকাশের দিকে উড়ে গেল। এই অপূর্ব গোধূলিতে মনে হল, পৃথিবীতে যেন নেমে আসছে চিরশান্তি! হায়, এই পৃথিবীতে তো নকুলরাও আছে, খুন করে যারা গৃহলক্ষ্মীদের। দোভাষীর কাছে জানতে পারলাম, এই খেয়া পার হওয়ার মিনিট কুড়ির মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাব নকুলের গ্রামে।
নৌকো থেকে পা রাখলাম পাড়ের এক হাঁটু কাদায়। তারপর নদীর ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে এসে ঢুকলাম একটা গ্রামে। খুব গরিব গ্রাম। এটাই নকুলের গ্রাম। সন্ধে হয়ে গেছে। গ্রামের বাড়িগুলো সবই মাটির দেওয়ালের ওপর খড় কিংবা খোলা দিয়ে ছাওয়া। সিপাইরা খুঁজে নিয়ে এল গ্রামের চৌকিদারকে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “নকুলের বাড়ি কোনটা?” সে পাল্টা প্রশ্ন করল, “কোন নকুল?” জানা গেল, এই গ্রামে তিনটে নকুল আছে। একটা নকুল কলকাতায় বাবুর বাড়ি কাজ করে, বহুদিন হল গ্রামে ফেরেনি। আর একটা নকুল বাড়িতেই আছে, তৃতীয় নকুলটা কে, পরে জানা যাবে। কাছেই দ্বিতীয় নকুলের বাড়ি, চৌকিদার হাঁক পাড়তেই নকুল তার ঘর থেকে গামছা পরে বেরিয়ে এল, আমাদের দেখে ঘাবড়ে গেল। আমি দেখেই বুঝলাম, এ নয়। এর বয়স অল্প, আমার শোনা ফেরারী নকুলের চেহারার বর্ণনার সাথে এর কোনও মিল নেই। আমার দোভাষী ওকে জিজ্ঞেস করল, “কবে কলকাতা থেকে এসেছ?” ছেলেটা কাঁদ কাঁদ স্বরে বলল সে কোনদিন কলকাতাতেই যায়নি। আমি দোভাষীকে থামিয়ে চৌকিদারকে বললাম, “চল অন্য নকুলের বাড়ি।” আমরা তৃতীয় নকুলের বাড়ির দিকে রওনা দিতেই চৌকিদার বলল, “ওই নকুলকে তো সকালবেলা দেখেছি নতুন একটা বাক্স কাঁধে, আরও সব জিনিসপত্তর আর পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে খেয়ার দিকে যাচ্ছে।” চৌকিদারের কথা শুনে আমার বুকটা ধক করে উঠল, তার মানে সে এখান থেকে পালিয়েছে। চৌকিদার বলেই চলেছে, “নকুল তিনচারদিন হল কলকাতা থেকে এসেছে অনেক জিনিসটিনিস নিয়ে। আমায় বলল, সেইসব জিনিস নাকি তাকে তার কলকাতার গিন্নিমা দিয়েছে। সে যে চুরি করে এখানে পালিয়ে এসেছে তা তো আমি জানি না। জানলে কি পালাতে দিতাম?” চৌকিদার নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, এই নকুল চুরি করে পালিয়ে এসেছে। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিন্ত হলাম, মহালক্ষ্মী দেবীকে এই নকুলই খুন করেছে, নয়ত সে পালাবে কেন? আর যে জিনিসপত্রের কথা চৌকিদার বলছে তা নিশ্চয়ই দত্ত পরিবারের খোয়া যাওয়া জিনিস। এখানে এসে নকুল নিজের গ্রামটাকেও নিরাপদ মনে করেনি, গ্রাম ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়েছে। দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে মেলাতে আমরা একটা ছোট্ট মাটির বাড়ির সামনে হাজির। চৌকিদার বলল, এই সেই নকুলের বাড়ি। দেখলাম, বন্ধ দরজায় একটা ছোট লোহার তালা ঝুলছে। গ্রামের একটা কুকুর ঘরের ছোট বারান্দায় ঘুমচ্ছিল, আমাদের পায়ের শব্দে দে দৌড়। আমরা ফিরে চললাম। চৌকিদারের কাছে জানতে চাইলাম বৈতরণী নদী না পার হয়ে কি গ্রাম থেকে বেরনো যায়? চৌকিদার বলল, “না, অন্য কোনও রাস্তা নেই।”
মন খারাপ হয়ে গেল। এত দূর এসেও খালি হাতে ফিরতে হবে? ভাবলাম, খেয়া পার হয়েই যখন যেতে হয় তখন কোন না কোন নৌকোর মাঝি নকুলের গতিবিধি সম্পর্কে কিছু জানলেও জানতে পারে। ততক্ষণে আমরা প্রায় খেয়া ঘাটে পৌঁছে গেছি। আমার মন অস্থির। নকুলকে পাব কোথায়? কোথায় পালিয়েছে সে? তাকে যদি ধরতে না পারি তবে শুধু আমার নয়, গোটা কলকাতা পুলিশের মুখে চুনকালি পড়ে যাবে। মিঃ দত্ত আর তাঁর মেয়েকে কি জবাব দেব? রিপোর্টাররা তো নেকড়ের মত ঝাঁপিয়ে পড়বে। দাঁড়িয়ে আছি বৈতরণীর তীরে, মনে মনে নদীর দিকে তাকিয়ে বললাম, আমায় বিপদ থেকে পার কর মা। রাত ঘন হচ্ছে, দূরের গ্রামগুলোতে ছোট্ট ছোট্ট আলোর বিন্দু ফুটে আছে। নদীতে যে কটা নৌকো, তাদের ছইয়ের তলাতেও দেখছি কেরোসিনের কুপি জ্বলছে। ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে নৌকো, জলে কাঁপছে সেই কুপির আলো। ভেতরেও একইরকম অন্ধকার, তখনও সেখানে কোনও আলোর রেখা দেখছি না। আলোর আশায় আমি দোভাষী আর মিশিরকে ডেকে বললাম, “দেখ, নকুল এই খেয়া পার হয়ে গেছে। সে নিশ্চয়ই কলকাতায় ফিরে যায়নি, আশেপাশের কোনও অঞ্চলে আস্তানা গেড়েছে। নৌকোর মাঝিরা কিছু জানলেও জানতে পারে। তোমরা গল্পের ছলে যেভাবেই হোক সেটা বের করার চেষ্টা কর। দরকার হলে মদটদ খাওয়াও, গ্রামের ভেতর নিশ্চয়ই চোলাই মদ পাওয়া যাবে, চৌকিদার জানবে, তাকেও কাজে লাগাও। আমি দূরে থাকব, তবে কতদূর কি এগচ্ছে, তোমরা সে খবর আমায় দেবে।” দোভাষীরা চৌকিদারকে নিয়ে নদীর দিকে নেমে গেল, যেখানে নৌকোগুলো বাঁধা আছে।
খেয়া পারাপার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একটা নৌকোয় মাঝিরা গোল হয়ে বসে গল্পগুজব করছে। আমি বৈতরণী পার হওয়ার সময় বুঝেছিলাম মাঝি মদ খেয়ে আছে। তাতেই মনে হল, এখানে নিশ্চয়ই চোলাই মদের ঠেক আছে। মিশির আর দোভাষীরা চৌকিদারকে নিয়ে নেমে গেছে। আমি সিপাইদের নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি। মাঝিরা আমাদের দেখতে পাচ্ছে না। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা বাড়ছে। এখন ওদের কেরামতির ওপর নির্ভর করছে সবকিছু। বেশ কিছুক্ষণ পর চৌকিদার আর মিশির অন্ধকার ফুঁড়ে পাড়ে উঠে এল। মিশির বলল, “স্যার, ওকে পঞ্চাশটা টাকা দিন, মাল নিয়ে আসবে।” আমি চৌকিদারের হাতে পঞ্চাশ টাকা দিতে সে চোলাই মদ কিনতে চলে গেল। মিশির ফিসফিসিয়ে বলল, “স্যার, এদের যত বোকা মনে হচ্ছে, তত বোকা এরা নয়, ঠারেঠোরে নকুলের কথা জিজ্ঞেস করাতে কেউ কিছু বলছে না, তবে মাল খেতে রাজি হয়েছে, এখন দেখা যাক পেটে পড়লে কি বের হয়।” আমি মিশিরকে বললাম, “তোমাকেই কায়দা করে বের করতে হবে, নকুল তো আর কপূরের মত উবে যায়নি। তোমরা এমন ভাব দেখাও যেন মনে হয় ওর সাথে দেখা করতে এসেছ। খুব আপন লোক হয়ে যাও।” কথাবার্তার মাঝখানেই দেখি চৌকিদার গ্রামের দিক থেকে আসছে। মিশিরকে ওর সাথে নৌকোয় যেতে বললাম। ওরা দুজনে চলে গেল।
একটা কাটা গাছের গুঁড়ি পড়ে ছিল, আমি তার ওপর বসে পড়লাম। একটু দূরে সিপাইরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছে। বসে বসে নদীর হাওয়াতে আমার ঝিমুনি আসছে, দুরাত ঘুম নেই। মাঝে মাঝে নৌকো থেকে ওদের হাসি ঠাট্টার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। এদিকে রাত বাড়ছে। মিশিররা ব্যর্থ হলে নকুলকে তো পাওয়া যাবেই না, তার ওপর এখানেই সারারাত আটকে থাকতে হবে। দুদিন হল কলকাতা থেকে এসেছি, ওদিকে লালবাজারে কে কি ভাবছে কে জানে? এখানে ওই মাঝিরাই আমাদের শেষ যোগসূত্র। মন মাঝি কি করবে কে জানে! পরিস্থিতি যখন হাতের বাইরে চলে যায় তখন বসে বসে দুশ্চিন্তা করা ছাড়া উপায় কি? অন্ধকারে বৈতরণীর পারে একি শাস্তি আমার?
বসে বসে ঘণ্টাখানেক কেটে গেছে, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, মিশির আর এক দোভাষী প্রায় ছুটতে ছুটতে আমার দিকে আসছে। ওদের ছোটা দেখে আমার বুক ধক ধক করে উঠল। খবর ভাল নিশ্চয়ই, নয়ত ওইভাবে আসবে কেন? আমার আর তার সইছে না। মিশির এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “স্যার একটা মাঝি বলেছে, আজ সকালে সে নকুলকে এই নদীর মোহনার কাছে একটা দ্বীপে রেখে এসেছে।” খবর শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করল। কিন্তু মিশিরের পরের কথাতেই চুপসে গেলাম। “ওই মাঝিটা বলল এখনই যাওয়া দরকার, কিন্তু ওর নৌকোটা নিয়ে যাওয়া যাবে না, কি গণ্ডগোল আছে, অন্য নৌকো নিয়ে যেতে হবে।” আমি বললাম, “তাহলে? কিছু ব্যবস্থা করেছ?” মিশির বলল, “কি করা যায় সেটা জানতেই তো এসেছি।” একটু ভেবে বললাম, “তাহলে অন্য একটা নৌকোর জন্য চেষ্টা করতে হবে। তা কি আজ রাতের মধ্যে সম্ভব?” সিপাইরা আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, তারা বলল, “আমরা একবার চেষ্টা করে দেখি, আপনিও চলুন।” আমি ভাবলাম, সূত্র যখন পাওয়া গিয়েছে, তখন দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। দেরি হলে ফঙ্কে যেতে পারে। আমরা সবাই নিচে নামতে লাগলাম। চৌকিদার আর মাঝিমাল্লারা ওদিকে জমিয়ে ফূর্তি করছে। আমাদের আসতে দেখে একটু চুপ করল। ঝিমুনিটা এখনও কাটেনি, নিচে নামতে নামতে বুঝতে পারছিলাম। আজ রাতেই যদি দ্বীপে যেতে হয়, আমার যে নিদারুণ কষ্ট হবে তা এখনই মালুম হচ্ছে।
আমরা সবাই নৌকোয় এসে উঠলাম। মিশির সেই মাঝিকে চিনিয়ে দিল যে সকালে নকুলকে রেখে এসেছে। চৌকিদার আর সিপাইরা কাজে নেমে গিয়েছে, তারাই সেই নৌকোটা ঠিক করল যেটায় আমরা বৈতরণী পার হয়ে এসেছি। দুদিন ধরে হেঁটে হেঁটে, না ঘুমিয়ে শরীর আর চলছে না, মনে হচ্ছে একটা বিছানা পেলে শুয়ে পড়ি। কিন্তু চৌকিদারের প্রচণ্ড উৎসাহে আমরা তখনই পাড়ি জমালাম। বৈতরণীর কালো জলে শব্দ উঠছে ছলাৎ ছলাৎ। যে মাঝি নকুলকে সকালে নিয়ে গেছে, তাকেই রাজি করান হয়েছে নৌকো বাইতে। আমি নৌকোর মাঝখানে ছাউনিতে পিঠ দিয়ে বসলাম। ভাবলাম, একপক্ষে ভালই হল, সারারাত থাকতামই বা কোথায়? তাছাড়া নকুলের সন্ধান যখন পেয়েছি, তখন ওকে না ধরা পর্যন্ত আমার গ্র্যান্ড হোটেলের বিছানাতে শুয়েও ঘুম আসবে না।
চৌকিদার আর মাঝিদের কথাবার্তায় যতটুকু জানতে পেরেছি তা হল, বৈতরণী যেখানে বঙ্গোপসাগরে মিলেছে তার এক কিলোমিটার আগে ওই দ্বীপ। সেখানে নদী যেন কোন বন্ধুকে দেখে গলা জড়িয়ে ধরে তাকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরতে চেয়েছে। বৈতরণীর ওই হঠাৎ বাঁক নেওয়ার মুখে তৈরি হয়েছে একটা দ্বীপ। আর সেই দ্বীপেই মাঝি রেখে এসেছে নকুলকে। ওখানে আছে আট দশটা ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর। সেখানে চোর, ডাকাত, খুনীরা লুকিয়ে থাকে। সাধারণ মানুষ ওখানে পা দেয় না। দিনের বেলায় কেউ যদি বা গিয়ে পড়ে, দূর থেকেই ওখানকার বাসিন্দারা দেখতে পায়। সতর্ক হয়ে নদীর অন্য দিক দিয়ে পালিয়ে যায় তারা। আত্মগোপন করার আদর্শ জায়গা। রাতের অন্ধকারেই ওখানে হানা দেওয়া ভাল। একজন দোভাষীকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি কথাবার্তা তোমরা চালাচ্ছ?” সে জানাল, “ভোর হতে না হতেই আমরা দ্বীপে পৌঁছে যাব। কেউ কিছু বোঝার আগেই আমরা দ্বীপটা ঘিরে ফেলতে পারব।” আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। উৎসাহে ঝিমুনি ভাবটাও কেটে গেছে, খিদে তেষ্টা সব উধাও। চৌকিদার দেখছি সবাইকে জাগিয়ে রেখে, হল্লা করতে করতে নিয়ে যাচ্ছে। মাঝিকে দেখলাম, জোরে জোরে দাঁড় টানতে। মদ্যপানে সম্মানজ্ঞান, দায়িত্বজ্ঞান বেড়ে যায়, সেই ক্রিয়াই সবার মধ্যে চালু হয়েছে দেখে মনে মনে আনন্দ পেলাম। চৌকিদারের খুব সম্মানে লেগেছে, কারণ তাদের গ্রামের লোক “চুরি” করে কলকাতা থেকে পালিয়ে এসেছে, তাতে শুধু তার নয় গ্রামের সম্মানহানি হয়েছে।
আমরা ক্রমশ মোহনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। বৈতরণী আস্তে আস্তে আরও চওড়া হচ্ছে। নদীর উত্তর দিকের ধার ঘেঁষে পূর্ব দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। রাত শেষ হয়ে আসছে। আর কত দূর? মাঝি চৌকিদারকে চেঁচিয়ে কি যেন বলল, দোভাষীর কাছে শুনলাম, মাঝি জানাল এখন শেষ প্রহর। আর বেশি দূরে নেই দ্বীপ। মাঝির ক্ষমতা দেখে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়, সারারাত ক্লান্তিহীন দাঁড় টেনে চলেছে। বৈতরণীই ওর ঘরবাড়ি উঠোন, এ নদীর সব কিছু ওর নখদর্পণে। কতকালের চেনা ঢেউয়ের মাথায় মাথায় অবলীলায় দাঁড় বাইছে। হঠাৎ মাঝি চিৎকার করে দোভাষীদের কি বলল, দোভাষীরা সেটা শুনে দাঁড়িয়ে পুব দিকে দেখতে লাগল। তারা আমায় বলল, “স্যার উঠে দাঁড়িয়ে দেখুন ওই যে দেখা যাচ্ছে দ্বীপটা।” আমি উঠে দেখতে চেষ্টা করলাম। একটা কালো মত জায়গা নদীর মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। দাঁড়িয়েই রইলাম। ধীরে ধীরে সেই কালো টুকরোটা আরও পরিষ্কার হল। দেখলাম, সত্যিই নদীর একটা হাত যেন হঠাৎ বেরিয়ে আবার মূল স্রোতে ফিরে এসেছে একটা গোলাকার ছোট জমিকে জড়িয়ে ধরে। প্রকৃতির কি অদ্ভুত খেলা।
দ্বীপের একেবারে কাছে চলে এসেছি। দেখলাম, গাছপালার ভেতর সাত আটটা কুঁড়ে ঘর। ভোরের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সব ঘরই বন্ধ। ওখানে কোন একটা ঘরের মধ্যে নকুল আছে। অন্য ঘরে আছে আরও সব খুনী, চোর, ডাকাত। কি আশ্চর্য উপনিবেশ। হলিউড ছবিতে দেখেছি, ক্রাইম থ্রিলারে পড়েছি অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য এরকম সব দ্বীপের কথা। আমি দোভাষীর মাধ্যমে সবাইকে আক্রমণের কৌশলটা বলে দিলাম। নৌকো দ্বীপের মাটিতে ঠেকতেই সবাই লাফিয়ে নেমে পড়লাম, তারপর এক দৌড়ে উঠে গেলাম ওপরে। দ্বীপের চারদিকটা ঘিরে ফেলতে হবে যাতে নকুল কোনদিকে পালাতে না পারে। আমি ঘাটের দিকটা আগলে রাখলাম, নকুলকে নৌকোয় উঠতে দেওয়া চলবে না। হঠাৎ একটা কুঁড়েঘরের দরজা খুলে একটা লোক বেরিয়ে উল্টো দিকে দৌড়তে শুরু করল। চৌকিদার তাকে চিনে ফেলল, “নকুল, নকুল” বলে চেঁচাতে লাগল সে। মিশির, সিপাইরা আর দোভাষী দুজন, সবাই তার পেছনে ছুটতে শুরু করেছে। না, নকুল বেশিদূর যেতে পারেনি। সবাই মিলে লাফ দিয়ে ওকে জাপটে ধরল। আমাদের ছুটোছুটি আর চিৎকারে অন্য ঘরগুলো থেকে বেরিয়ে এসেছে সব আত্মগোপনকারী ক্রিমিনালরা। আমরা নকুলকে ধরতেই তারা আমাদের আক্রমণ করল। নকুলকে আমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেবেই। এমন সময় দেখলাম, আমার বড়বাজারের মাস্তানরা পুরনো ফর্মে ফিরে গেছে। সে কি হুঙ্কার। আর ওড়িয়া মাস্তানী ভাষায় যা বলতে লাগল তারা, তাতে নকুলের প্রতিবেশীরা চুপসে গেল। পরে ওদের কাছ থেকে শুনেছি, ওরা বলেছিল, আমরা সারা দ্বীপ ঘিরে ফেলেছি, পালাবার পথ নেই। তোমরা সবাই চুপ করে থাক, আমরা শুধু ওকেই ধরতে এসেছি, ওকে নিয়ে যেতে দাও। যদি কোনরকম বাধা দাও, তবে তোমাদেরও পিটিয়ে এখান থেকে তুলে নিয়ে যাব।
আমি মিঃ দত্তের দেওয়া বিবরণের সঙ্গে এই নকুলকে চট করে মিলিয়ে নিলাম। চৌকিদারকে বললাম, “চল ও যে ঘরটায় ছিল সেখানে।” নকুলকে টানতে টানতে সবাই মিলে ওর ঘরের দিকে গেলাম। দরজা খোলাই ছিল। এক মহিলা, নকুলের স্ত্রী নিশ্চয়ই, বিছানায় বসে আছে। পাশেই রাখা একটা নতুন টিনের ট্রাঙ্ক, আর কতগুলো কাপড়ে বাঁধা পুঁটলি। আমি তাড়াতাড়ি ট্রাঙ্কটা খুলে ফেললাম, এই তো মহালক্ষ্মী দেবীর গয়নাগাঁটি, কিছু প্রসাধনী। পুঁটলিগুলো ঘেঁটে পেলাম মহালক্ষ্মী দেবীর সব দামিদামি শাড়ি, আরও অন্যান্য জিনিস। মিশিরকে বললাম, “সব নিয়ে চল।” কয়েকটা শাড়িতে দেখলাম তখনও রক্ত লেগে আছে। মিশির আর চৌকিদার সব তুলে নিল। সিপাইরা আর দোভাষী নকুলকে ধরে নিয়ে এল নৌকোর কাছে। নকুলের স্ত্রীকেও নিয়ে আসা হল। আমি নৌকোয় উঠে আমার ব্যাগে রাখা হ্যান্ডকাফটা বের করলাম। মিশির সেটা নকুলকে পরিয়ে দিল। নকুল মাঝিকে কিছু বলতে, মাঝিও খুব রেগে ওকে উত্তর দিল। নকুল বোধহয় বিশ্বাসঘাতক বা এরকম কোনও গালাগালি দিয়েছিল, নয়ত মাঝি অত রেগে যাবে কেন?
নৌকো ছেড়ে দিল। নকুলকে ছাউনির ভেতর দড়ি দিয়ে বেঁধে বসিয়ে রাখলাম। ছাউনির দুই মুখে আমি আর মিশির বসলাম। যাতে নকুল হঠাৎ বৈতরণীতে লাফ দিয়ে পড়তে না পারে। নৌকো ছাড়ার পর থেকেই চৌকিদার বকবক করছে, “কত খুনী, ডাকাত ধরলাম, এ তো সামান্য চোর। গ্রামের লোক বলে পার পেয়ে যাবে তা তো হয় না।” নৌকো ধীরে চলছে, স্রোতের উল্টো দিকে গতি কম হবেই। আমার মনের গতি কিন্তু তীব্র এত কম সময়ের মধ্যেই যে নকুলকে ধরে ফেলতে পারব তা আশা করিনি। নিজেকে অনেক হালকা মনে হল।
আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে হুইলারস দ্বীপপুঞ্জের ছোট্ট দ্বীপটা। এখান থেকে ষাট সত্তর মাইল দক্ষিণে পারাদ্বীপ। মহানদীর মোহনা। বৈতরণীর খেয়ালী দ্বীপটা দারুণ পিকনিক স্পট হতে পারে। তার বদলে ওটা কিনা হয়ে গেছে খুনী ডাকাতদের গোপন ডেরা! অবহেলায় আমাদের দেশের কত কিছুই না পড়ে নষ্ট হচ্ছে এমন, কে তার খোঁজ করে?
নকুলকে নিয়ে কলকাতায় ফিরতে একটা দিন কেটে গেল। অবশ্য তার আগের দিনই বিকেলে লালবাজারে ফোন করে নকুলের গ্রেফতারের খবর জানাতে, গৌরাঙ্গবাবুর নেতৃত্বে এসকর্ট পার্টি এসে গেছে। তারা আজ সকালে আমাদের সঙ্গে জাজপুর কোর্টে মিলেছে। এখন আমরা জাজপুর স্টেশনে ট্রেনে উঠে বসে আছি। ট্রেন ছাড়বে। নকুলকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে কামরার মাঝখানে একটা রডের সঙ্গে বেঁধে রেখেছি। ট্রেন ছাড়লে ওকে নিয়ে পড়ব। গত কদিনের ছোটাছুটিতে শ্রান্ত শরীরকে একটু বিশ্রাম দেওয়া যাক। আমরা আর রাজকণিকা যাইনি, সোজা একটা গাড়ি ভাড়া করে জাজপুর চলে এসেছি। মাঝি আর চৌকিদারের হাতে নকুলের স্ত্রীকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছি। ফেরার পথে নকুলকে দু একবার বাংলায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন সে মহালক্ষ্মী দেবীকে খুন করেছে। কিন্তু সে প্রতিবারই এক উত্তর দিয়েছে, “মুঃ সে স্ত্রী লোকোকে মারি নাই। সেই স্ত্রী লোকো ধীরে ধীরে মুঃকে সুনার অলংকারও আর লোগাপটা দিয়েছে।” আমি আর বেশি জোরাজুরি করিনি। তখন আমার মাথার মধ্যে অন্য পরিকল্পনা খেলছে।
ছোটবেলায় আমাদের কোচবিহার শহরের একটা ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে গেছে। আমাদের পাড়াতেই এক ভদ্রলোকের বাড়িতে একটা বেশ হৃষ্টপুষ্ট লাল রঙের গরু ছিল। এমনিতে শান্ত স্বভাবের সেই গরুটা আরও অন্য গরুর সঙ্গে সারাদিন চরে বেড়িয়ে সন্ধের একটু পরে গোয়াল- ঘরে ঢুকে ঝিমতে ঝিমতে ঘুমিয়ে পড়ত। সেই গরু গাভীন হতে মালিক তাকে আটকে রাখত, আর মাঠে চরতে দিত না। বাড়িতেই খড় কেটে খেতে দিত। গরুটা সেই খড় খেয়ে সারাদিন জাবর কাটত আর ঘুমত। কিন্তু সন্ধে হলেই তার কি যে হত, দড়ি ছিঁড়ে কোথায় চলে যেত। প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে ফিরত। মালিক প্রথম প্রথম ততটা গুরুত্ব দেয়নি। সরু দড়ি দিয়ে বাঁধত। কিন্তু গরুটা প্রতিদিনই সেই দড়ি ছিঁড়ে সন্ধেবেলায় উধাও। একদিন মালিক গরুর এই সান্ধ্য “অভিসার” বন্ধ করার জন্য মোটা দড়ি দিয়ে খুঁটিতে বেঁধে রাখল। কিন্তু গরুটা ঠিক সন্ধেবেলায় সেই মোটা দড়িও গায়ের জোরে ছিঁড়ে ছুটে বেরিয়ে চলে গেল, ফিরল ঠিক ঘণ্টাখানেক পর। পরদিন মালিক তার চেয়েও মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধল, কিন্তু ঠিক সন্ধে পড়তেই, সেই গরুর কি তেজ, যেন হাতির মত বলবান। সেই মোটা দড়ি ছিঁড়ে ছুটে বেরিয়ে গেল মালিককে বোকা বানিয়ে। আবার ফিরেও এল শান্তশিষ্ট হয়ে। তারপর থেকে দেখা গেল, মালিক যতই মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধুক না কেন গরুটা প্রতিদিনই সন্ধেবেলায় দড়ি ছিঁড়ে নয়তো খুঁটি উপড়ে ফেলে কোথায় চলে যায় কিসের টানে! এই রহস্য কিছুতেই ভেদ করা গেল না।
অগত্যা মালিক একদিন এক বিহারী লোক ঠিক করল, তাকে বলল, গরুটা দড়ি ছিঁড়ে ছুটতে শুরু করলেই তুমিও গরুর পেছন পেছন ছুটে গিয়ে দেখে আসবে কোথায় কিসের টানে যায় সে। কথা মত, বিহারী লোকটা সন্ধের একটু আগে গোয়াল ঘরের সামনে হাজির। গরুটা নড়েচড়ে উঠল, তারপর বিরাট হাম্বা ডাক ছেড়ে দড়ি ছিঁড়ে ছুটতে শুরু করল। বিহারী নজরদারও তার পেছন পেছন ছুটতে লাগল। শহরের শেষ প্রান্তে যেখানে আর্মি ব্যারাক তার পেছনে খালাসপিট্টি নামে একটা জায়গা আছে। চোলাই মদের ভাটিখানা থেকে প্রতিদিন সন্ধেবেলায় সেখানে মদের গাদটা ফেলে। গরুটা সেই গাদটা খেতেই যায়। সেদিনও সবটা খেয়ে ফেলে আস্তে আস্তে ঢুলতে ঢুলতে বাড়ির পথে ফিরতে শুরু করল। ঠিক ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এসে ঢুকল তার গোয়ালঘরে। বিহারী লোকটা মালিককে সব বলল। বোঝা গেল, গরুটা রীতিমত নেশাগ্রস্ত হয়ে গেছে। নেশার টানে সে দড়ি ছিঁড়ে ওই রকম পাগলের মত ছুটে চলে যায়।
আমি রাস্তায় এক দোকান থেকে আফিং কিনে ট্রেনে উঠেছি। আমার পরিকল্পনার কথা এখনও কেউ জানে না। ট্রেনটা ছাড়ুক, শুরু করব আমার অভিনব জেরা। নকুলের পেট থেকে বের করতেই হবে কথা, ট্রেন নড়ে উঠল। আমিও নড়েচড়ে বসলাম। স্টেশন ছাড়তেই আমি নকুলের সামনে এসে দাঁড়ালাম, আমার হাতে ধরা আফিংয়ের প্যাকেটটা।
ট্রেন ছুটতে শুরু করেছে। নকুলকে দিয়ে স্বীকারোক্তি করাতেই হবে। মামলার প্রয়োজনে। কি কারণে সে খুন করল সেটা জানা জরুরী। তারপর তার কথার সূত্র ধরে যোগাড় করতে হবে সাক্ষী। প্রথমেই তার “না”য়ের বাঁধন ভেঙে “হ্যাঁ”তে নিয়ে আসতে হবে। নকুলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “বল, কেন তুই মহালক্ষ্মী দেবীকে খুন করেছিস?” এবারও একই কথা, “মুঃ ওই স্ত্রী লোকোকে মারি নাই।” কিন্তু আমি তো নিশ্চিত, নকুলই খুনী। এখনও শাড়ি কাপড়, কিছু কিছু গয়নাগাঁটিতে রক্ত লেগে আছে আর ও বলছে খুন করেনি! এদিকে আমি ওর শরীরের ভাষা পড়ে বুঝতে পারছি আফিংয়ের টান শুরু হয়ে গেছে। যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে উইথড্রয়াল সিমটম। গতকালও হয়েছিল, কিন্তু বেশি দূর বাড়তে পারেনি। আমাদের ধমকে এবং পরিস্থিতির চাপে চাপা পড়ে গিয়েছিল। আজ আমাকে এই ব্যাপারটা কাজে লাগাতে হবে।
আমি পকেট থেকে আফিং বার করে ডান হাতের চেটোতে নিয়ে বললাম, “নকুল তুই স্বীকার কর, তবে তোকে আফিং খেতে দেব।” নকুল মাথা নিচু করে বেঞ্চের পাশে বসে ছিল। ডান হাতটা লোহার রডের সঙ্গে হ্যাণ্ডকাফে বাঁধা। আফিংয়ের কথা শুনেই চট করে মাথা তুলে তাকাল। আমার হাতের চেটোয় আফিং দেখেই ওর চোখটা চকচক করে উঠল। বললাম, “বল, এটা দেব।” নকুল চিৎকার করে বলে উঠল, “করি নাই, আমি করি নাই।” আমি এবার ডান হাতটা একটু এগিয়ে ওর সামনে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম, “বল, দেব।” নকুল ঝটিতি ওর বাঁ হাত দিয়ে আমার হাত থেকে আফিংটা ছিনিয়ে নিতে চাইল। আমি সতর্ক ছিলাম, হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললাম, “তুই বল, তোকে এমনিই দেব, চাইতে হবে না।”
নকুল একটা প্রচণ্ড হুঙ্কার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওর গলার এই অদ্ভুত আওয়াজে কামরার সব লোক চমকে তাকাল। ট্রেন দ্রুত গতিতে ছুটছে, অনেকটাই চাপা পড়ে গেল নকুলের গর্জন। তবু ওই চেহারা থেকে এমন রণহুঙ্কার, বড়ই বেমানান। শুধু গর্জন নয়, একই সঙ্গে নকুল ডানহাতটা হ্যাণ্ডকাফ থেকে ছাড়ানর জন্য টানতে লাগল। ওর জবাফুলের মত চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। নাক মুখ দিয়ে বুনো শুয়োরের মত ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস বেরচ্ছে। প্রতিহিংসার জ্বালায় আমার দিকেই তেড়ে আসতে চাইছে। আমি তখন বুঝে গিয়েছি, এই ওষুধেই কাজ হবে। বললাম, “শিগগির বল, আফিংটা তো তোর জন্যই এনেছি।” আবার হুঙ্কার, ওর শরীরের সমস্ত পেশী ফুলে ফুলে উঠছে, দু হাত দিয়ে লোহার রডটাকে এমন চাপ দিচ্ছে যেন ভেঙেই ফেলবে। যেন বহুদিনের ক্ষুধার্ত বন্দী বাঘ কচি বাছুর দেখে খাঁচা ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে। নকুলের চোখমুখ এমন বীভৎস রূপ নিয়েছে যেন আমাকে চিবিয়ে খাবে। হ্যান্ডকাফের টানে ডানহাতের কব্জির কাছে চামড়া কেটে রক্ত বেরচ্ছে, সেদিকে ওর খেয়ালই নেই। ওর শরীরে এখন অমানুষিক শক্তি। নেশাখোরদের নেশার জিনিস না পেলে এমনই হয়।
দেখলাম, নকুল হাতের টানে রডটা অল্প বেঁকিয়ে ফেলেছে। লোহার রডের সঙ্গে বাঁধা হ্যান্ডকাফটা ঘষা লেগে ঝনঝন ঝনঝন শব্দ হচ্ছে। নকুলের গলার বিকট আওয়াজের সঙ্গে লোহার ঝনঝনানি, তার ওপর ট্রেন ছোটার শব্দ, সব মিলিয়ে যেন কামরার ভেতর তুমুল প্রলয়। ওর কাণ্ড দেখে সবাই স্তম্ভিত। কিন্তু আমি তো জানি, কোচবিহারের সেই গরুর নেশার টানের ছটফটানি, অন্ধ উত্তেজনায় জ্ঞানশূন্য হয়ে পাগলের মত ছোটা, তাই আমার কাছে নকুলের এই পশুর মত আচরণ তেমন কোনও বিস্ময়ের উদ্রেক করল না। ও যত আমার দিকে তেড়ে তেড়ে আসতে চাইছে, আমি তত পিছিয়ে যাচ্ছি আর বলছি, “বল, সত্যি কথা বল, তোকে আফিং দেব।” নকুল চিৎকার করে আমাকে ওড়িয়া ভাষায় গালাগালি দিতে শুরু করল। আমার সঙ্গের মাস্তানরা তেড়ে মারতে গেল নকুলকে। আমি বারণ করলাম। এখন আমার দরকার কাজ হাসিল করা।
নকুলের মুখটা বীভৎস লাগছে, কালো মুখের ওপর খোঁচা খোঁচা অনেকদিনের দাড়ি ও এলোমেলো রুক্ষ চুল, কোটরাগত চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, লাল ছোপ ধরা দাঁতগুলো বের করে আমাকে রাগী হনুমানের মত খিঁচোচ্ছে। অনেকদিনের স্নান না করা ময়লা শরীর আর পরনের জামাকাপড় থেকে বিশ্রী দুর্গন্ধ বেরচ্ছে, নভেম্বরের শীতের হাওয়াতেও তার গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। বুনো ষাঁড়ের মত থ্রি টায়ার কামরার আটজন শোওয়ার খালি জায়গায় উথালপাথাল যা পারছে করছে। ওর নাচানাচির দাপটে আশেপাশের বাঙ্ক থেকে সবাই নামিয়ে নীচে রেখেছি জিনিসপত্র। এক একবার মনে হচ্ছে, ওর টানের চোটে বোধহয় দাঁড়িয়ে যাবে ট্রেন। মনে হচ্ছে, যদি ও দা জাতীয় কিছু এখন পেত তবে তা দিয়ে এক কাপে নিজের ডানহাতটা কেটে মুক্ত হয়ে আমার থেকে আফিংটা নেবার জন্য লাফিয়ে পড়ত। উসকে দেওয়ার জন্য চেটোর মধ্যে আফিংয়ের ডেলা রেখে মাঝে মাঝে বলছি, “বল, কেন মেরেছিলি? তাহলে আফিং দেব।”
ঘণ্টাখানেক একটানা অসুরের মত দাপাদাপি, চিৎকার আর গালাগালির পর নকুল হাঁপাতে হাঁপাতে বেঞ্চে ধপ করে বসে পড়ল, “বলছি, আগে দে, তারপর বলছি।’ ব্যস, আমার কাজ শেষ, নকুলের প্রতিরোধ ভেঙে পড়েছে। আমার পরীক্ষা সফল। আমি হাত সরিয়ে নিলাম, “না, আগে বল, তারপর দেব।”
নকুল বুঝল সব কথা না বলিয়ে আফিং দেওয়ার পাত্র আমি নই। ও তখন দম নিয়ে বলতে শুরু করল, “সেদিন গিন্নিমা আমায় সকাল থেকে অনেক বেশি কাজ করিয়েছে। আমি বললাম, আজ কিন্তু আমার চার টাকায় হবে না, আমাকে পাঁচ টাকা দিতে হবে। তো বলল, ঠিক আছে তোকে পাঁচ টাকাই দেব, মন দিয়ে কাজ কর। আমিও খুব খাটলাম। তিনটের সময় যখন টাকা চাইলাম, গিন্নিমা বলল, পাঁচ টাকা তো খুচরো নেই নকুল, তিন টাকা আছে। আজ এটা নে, কাল তোকে বাকিটা দিয়ে দেব। ওর কথা শুনে আমার মাথায় আগুন চড়তে লাগল। আমার তখন বেরনোর সময়, এত টালবাহানা ভাল লাগল না। তারপর গিন্নিমা বলল, তিন টাকা না নিবি, তো ভাগ, আজ টাকাই দেব না। এত কি নেশা? সেই কথা শুনে আমার মাথায় খুন চেপে গেল। আমি রাগের মাথায় পাশে পড়ে থাকা নোড়া দিয়ে মেরে দিলাম ওর মাথায় এক ঘা, চিৎকার করে গিন্নিমা পড়ে গেল, আমি তখনও ওই নোড়া দিয়ে মুখের মধ্যে ঘা মেরেই চলেছি। তারপর ইঁট, কাঠ যা পেয়েছি তাই দিয়ে মেরেছি। মারতে মারতে দেখলাম, মরে গেল। ভাবলাম, আপদ গেছে।”
একটানা যেন ঘোরলাগা মানুষের মত কথাগুলো বলে নকুল চুপ করে গেল। আমার চোখের সামনে তখন ভাসছে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ছবি। একটু আগে নকুলের যে নরঘাতক উন্মত্ততা দেখেছি তারই উলঙ্গ প্রকাশ নিউ আলিপুরের ওই ফ্ল্যাটে হয়েছিল, তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই। আর সেই হিংস্রতার বলি হয়েছিলেন মহালক্ষ্মী দেবী। নকুল এখন চুপ করে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর?” এবার নিস্তেজ গলায় নকুল বলল, “তারপর আলমারি, দেরাজ খুলে গয়নাগাঁটি, জিনিসপত্তর গুছিয়ে বেঁধে আমি ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলাম কালীঘাটের দোকানে। ওখান থেকে আফিং কিনে, কিছুটা খেয়ে চলে গেলাম হাওড়া। ওখান থেকে ট্রেনে চেপে দেশে।” আবার চুপ করে গেল নকুল। আমরাও চুপ। যা জানার জেনে নিয়েছি। এরপর শুধু স্বীকারোক্তি অনুযায়ী যাচাই করে এগিয়ে যাওয়া।
একটু পরে নকুলই স্তব্ধতা ভাঙল, “এবার দে।” কি নির্লজ্জ লোকটা! এর পরও আফিং চাইছে! রাগে তখন আমার শরীর কাঁপছে। গৌরাঙ্গবাবু পাশেই ছিলেন। আমার মনোভাব বুঝতে পেরেছেন। বললেন, “দাও একটু, নয়তো সারারাত চেল্লাচেল্লি করবে। একটু খেলে ঝিমবে, শান্তিতে ঘুমতে পারব আমরা।” গৌরাঙ্গবাবুর কথায় আমি নকুলকে আফিং দিতেই সে টক করে সেটা খেয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর থেকে ঝিমতে লাগল। সারা রাত একভাবেই বসে রইল।
পরদিন সকালে আমরা হাওড়ায় নেমে সোজা লালবাজার। সিনিয়র অফিসাররা জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। সবারই এক কথা, “তুমি কলকাতা পুলিশের মুখ উজ্জ্বল করেছ, মান বাঁচিয়েছ।”
আদালতে নকুলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। হাজতে আফিং না পেয়ে অসুস্থ হয়ে নকুল মারা যায়। জানি না মিঃ দত্ত আর তাঁর মেয়ে শেষ পর্যন্ত এতটুকুও সান্ত্বনা পেরেছিলেন কিনা।