সাদা আমি কালো আমি – ১.১০

১০

আজ যখন অতীতের ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকাচ্ছি, তখন কত কথা, কত ঘটনা আর চরিত্রের ছবি সামনে এসে যাচ্ছে। আবার কত কিছু মিলিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। ঘটনা, ঘটনা আর ঘটনার অবিরত হানায় সাতষট্টি থেকে সাতাত্তর সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ যেমন কেঁপেছে, কেঁপেছে তার রক্ষীবাহিনীও। আমি তো ছিলাম তাদেরই একজন।

সে ইতিহাসের এক দুর্বার অধ্যায়, অগ্নিগর্ভ ইতিহাসের অধ্যায়। নকশাল আন্দোলনের রক্ত ঝরানোর ইতিহাসের অধ্যায়। আমি ইতিহাসবিদ নই। ইতিহাস আমি লিখব না। সে কাজ করবেন ইতিহাসবিদগণ। আমি আগামী প্রজন্মের গবেষকদের জন্য রেখে যাব কিছু তথ্য আর বর্তমান প্রজন্মকে শুনিয়ে যাব কিছু “আনটোল্ড স্টোরি”, স্টোরি নয়, নেপথ্যের প্রকৃত ঘটনা।

ঘটনা বলতে গেলে আগে ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা বলতে হবে। আলাপ ছাড়া যেমন মার্গীয় সঙ্গীত জমে না, তেমনই পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি না জানা থাকলে ঘটনার স্বাদ পাওয়া যায় না।

অথচ মুশকিল হচ্ছে, আমি রাজনীতিবিদ নই, রাজনীতি আমি কোনও দিন করিনি। কিন্তু পারিপার্শ্বিকতা বলতে গেলে রাজনীতি এসেই যাচ্ছে, সেটা বাদ দিয়ে রাজনীতির মোড়কে মোড়া ঘটনাকে বর্ণনা করা যায় না। তাই ঘটনা বলতে গিয়ে যতটুকু রাজনীতি আসবে তা তো বলতেই হবে। অবশ্য যেটুকু আমি বলব, সেই রাজনীতির ব্যাখ্যা কোনও ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে আক্রমণ নয়। বিচারকের ভূমিকা তো নয়ই, এমনকি রাজনৈতিক বিশ্লেষণও নয়, বরং বলা যায় কিছুটা গল্পকারের ভূমিকায়। কে সঠিক ছিল, কে বেঠিক সে বিচারের ভার বিচারকদের অর্থাৎ আপনাদের। আমি শুধু আপনাদের আদালতে পেশ করব কিছু প্রামাণ্য তথ্য। যদিও জানি আপনাদের হাতে আছে অনেক তথ্য। আমার পেশ করা তথ্যগুলি তাতে কিছু নতুন মাত্রা যোগ করবে। আপনারা সেগুলি দেখবেন, শুনবেন, বুঝবেন আর আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যাবেন আপনাদের আদালতের রায়। সে রায়ের নির্যাস হবে আগামী সব প্রজন্মের ভবিষ্যৎ আলোর দিশারী।

ছেষট্টির খাদ্য আন্দোলনের পরই পশ্চিমবঙ্গ আস্তে আস্তে উত্তাল হয়ে ওঠে। মনে হয়, এর পেছনে একদিকে ছিল তখনকার কংগ্রেস সরকারের ব্যর্থতা, অন্যদিকে চৌষট্টিতে যখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দুভাগ হয়ে যায়, তখন সেই দুই পার্টির নিচুতলার কর্মীদের চরিত্রগত অমিল। আজকের মত দুই কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে প্রায় সব স্তরে মিল ছিল না। তখন সি. পি. আই (এম)-এর নিচুতলার কর্মী ও সমর্থকদের চাপে নেতাদেরও নিজেদের বিপ্লবী ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে জঙ্গী খাদ্য আন্দোলনে সামিল হতে হয়েছিল। সেই গণআন্দোলনের ফলেই সাতষট্টির নির্বাচনে কংগ্রেস সরকারের পতন আর প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের জন্ম।

আবার সাতষট্টিতেই দার্জিলিং জেলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চল নকশালবাড়িতে হঠাৎ এক স্বতঃস্ফূর্ত কৃষক আন্দোলনের মাধ্যমে জন্ম নিল নতুন ধরনের জঙ্গী কমিউনিস্ট সংগ্রাম।

এখনও আশ্চর্য হয়ে ভাবি, যখন নকশালবাড়ির কৃষকেরা আন্দোলন করল, তখন যুক্তফ্রন্ট সরকার, বিশেষ করে দুই কমিউনিস্ট পার্টি কেন তাকে “বালখিল্যের আন্দোলন” বলে তাচ্ছিল্য করল? কেন রাজনৈতিকভাবে তার মোকাবিলা করল না? উল্টে বাবা যেমন ছোট ছেলে দুষ্টুমি করলে কান ধরে পিঠে দু ঘা দিয়ে দেয়, ঠিক তেমনভাবে আন্দোলন দমন করতে গেল। ফল হল উল্টো। যে নকশালবাড়ির আন্দোলন শুধুই একটা সীমাবদ্ধ কৃষক আন্দোলন ছিল, তা ব্যাপক রাজনৈতিক চরিত্র পেয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতবর্ষে। যখন ওখানকার নেতারা নিজেরাই জানেন না এরপর কোন পথে নিয়ে যাওয়া উচিত আন্দোলনকে, তখন সরকারের চরম দমননীতির ফলে সবার চোখ গিয়ে পড়ল নকশালবাড়ির ওপর। জন্ম হল এক নতুন মতাদর্শের, যারা নিজেদের বলতে লাগল চীনপন্থী কমিউনিস্ট। ফল দাঁড়াল যে প্রশ্নে একবার চৌষট্টি সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দুভাগ হয়েছিল, সেই একই প্রশ্নে সাতষট্টি সালে পার্টি আবার ভাগ হতে লাগল। সি. পি. আই (এম) পার্টি থেকে তাদের পুরো দার্জিলিং জেলা কমিটিকে বহিষ্কারের পর সেই কমিটির সদস্যরাই এই আন্দোলনের পুরোধা হয়ে গেলেন। সি. পি. আই (এম) থেকে ব্যাপকহারে নিচুতলার কর্মী বেরিয়ে এসে নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলনের পাশে দাঁড়াল। আবার বেজিং রেডিও থেকে নকশালবাড়ির আন্দোলনকে সমর্থন করায় তা পেয়ে গেল এক আন্তর্জাতিক রূপ।

একদিকে তখন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন আক্রমণের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের সশস্ত্র প্রতিরোধ অভিযান, অন্যদিকে ভারতের প্রতিষ্ঠিত দুই কমিউনিস্ট পার্টির চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে নকশালবাড়ির নতুন ডাক। দারুণ উত্তেজনায় আবেগতাড়িত হয়ে হাজার হাজার ছাত্র-যুবক, তরুণ-তরুণী কোনরকম চিন্তা ভাবনা ছাড়াই ঝাঁপ দিল সেই আন্দোলনে। বাঙালির বুকের মধ্যে নেচে উঠল রোমান্টিসিজমের ভূত। প্রতিটি এলাকায় স্থানীয় সি. পি. আই (এম) পার্টি থেকে বেরিয়ে আসা ছোট ছোট নেতারা কর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে সংগঠিত হতে লাগল, যে যার মত আন্দোলন করতে শুরু করল। প্রায় সব আন্দোলনই জঙ্গী চরিত্রের। কোনও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নেই। শুধুমাত্র তারুণ্যের উন্মাদনায় ভেসে যেতে লাগল সেইসব নকশাল তরুণ-তরুণীরা। নামকাওয়াস্তে একটা কো-অর্ডিনেশন কমিটি ছিল, কিন্তু সেইসব নেতাদের অভিজ্ঞতা, তাত্ত্বিক গভীরতা ও নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা এমন পর্যায়ে ছিল না যাতে তারা এই যুব শক্তিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। উল্টে তারাই সেইসব রোমান্টিক ছাত্র-যুবকদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে গা ভাসিয়ে দিল। রোমান্টিকতার চাপ সহ্য করে বাস্তব পথে আন্দোলনকে নিয়ে যাওয়ার বদলে নিজেরাই আবেগের শিকার হয়ে গেল। তাছাড়া সেই বল্গাহীন পাগলা ঘোড়াকে বশ করে ছোটানর মত সঠিক দিশা তাদের কাছেও ছিল না। সমাজের পরীক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত সব বাঁধনকেই তারা অস্বীকার করতে লাগল। কোনও রাজনৈতিক দলই ওদের সামনে কোনও বিকল্প আদর্শ দেখাতে পারল না। রাজনৈতিক ডামাডোল চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল।

আমাদের, তখন রোজকার কাজই নকশালদের ট্রাম-বাস পোড়ান আর মিটিং-মিছিল সামলান, কংগ্রেস, সি. পি. আই (এম) কর্মীদের সাথে তাদের সংঘর্ষের মোকাবিলা করা। এমন কোন দিন যেত না, প্রেসিডেন্সি কলেজকে কেন্দ্র করে কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে নকশাল ছাত্র-যুবকদের হাঙ্গামা দমন করতে যেতে হয়নি। ওই সময়েই নকশালদের অনেক নেতা ও কর্মীকে আমরা চিনেছি। তবে শুধু কলেজ স্ট্রিট এলাকা নয়, কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী প্রায় সব অঞ্চল জুড়েই নকশালদের তাণ্ডব উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল।

সাতষট্টির যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে গেল। আবার নতুন করে অন্তবর্তী নির্বাচন জিতে ওই যুক্তফ্রন্ট সরকারই উনসত্তরে ক্ষমতায় এল। তবে ক্ষমতায় এলেও যুক্তফ্রন্টের মধ্যে আগের মত সবারও আদর্শগত সামঞ্জস্য ছিল না। একমাত্র কংগ্রেস-বিরোধিতার সাধারণ ঐক্য ছাড়া তাদের মধ্যে অন্য কোনও দৃঢ় নীতিগত মিল ছিল না।

সে সময় এদিক ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নকশালরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। তখনও পর্যন্ত আন্দোলন সর্বনাশা ভয়াল রূপ নেয়নি। ঝড়ের আভাস পাওয়া গেল যখন উনসত্তরের পয়লা মে শহীদ মিনার ময়দানে কানু সান্যাল ঘোষণা করলেন তাঁরা সি. পি. আই (এম. এল) পার্টি তৈরি করেছেন। কয়েকজন নকশাল নেতা মিলে গোপনে ওই পার্টি তৈরি করে ফেলেছিলেন।

তবে আসল সর্বনাশের দিন ঘনিয়ে এল যখন চারু মজুমদার পার্টির মধ্যে তাঁর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন। সুশীতল রায়চৌধুরীর মত কিছু নকশাল নেতা চারু মজুমদারের লাইনের বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু তা ব্যাপক ব্যক্তিপূজার অন্ধ আবেগে ভেসে গেল।

ফলে সত্তর সালের প্রথম দিক থেকেই চারু মজুমদারের “খতমের লাইন” ওদের পার্টির একমাত্র কর্মসূচী হয়ে দাঁড়াল। শুরু হল রাজনীতির এক অন্ধকার অধ্যায়। চারু মজুমদার বিপ্লবের নামে চূড়ান্ত সন্ত্রাসবাদ চালু করলেন। হিরো সাজার নেশায় খতমের এই “শর্টকাট মেথড” কে নকশাল তরুণ-তরুণীরা আগু পিছু কিছু না ভেবেই শিরোধার্য করল। চারদিকে এলোপাথাড়ি খুন জখম শুরু হল। তারা চারু মজুমদারকে ভগবানের আসনে বসিয়ে দিল। “পার্সোনাল কাল্ট”কে অনেকেই ঘৃণা করলেও চারুবাবুর লাইনের বিরোধিতা করার সাহস ওদের পার্টির মধ্যে কেউ দেখাতে পারল না। কারণ বিরোধিতা করার অর্থ পার্টি থেকে শুধু বহিষ্কার নয় – পরিণামে মৃত্যু। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল, সন্ধে ছটার মধ্যে সমস্ত মানুষজন পড়িমরি করে বাড়ির দিকে ছুটত। সকালে যখন সবাই স্কুল-কলেজ-অফিসে যেত, তখন জানত না আদৌ সুস্থ শরীরে বাড়ি ফিরবে কি না। অন্ধকার নামলেই চারদিকে শুরু হয়ে যেত দাঙ্গাহাঙ্গামা। বোমার শব্দে থরথর করে কাঁপত মানুষের বুক। চেনা এবং ঘনিষ্ঠ লোকজনের সাথে ছাড়া অচেনা অন্য লোকজনের সাথে কথাবার্তা পর্যন্ত সবাই প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। গোটা দেশময় ভয়, সন্দেহ এমনভাবে থাবা গেড়ে বসল যে পশ্চিমবঙ্গের তরুণ-তরুণীরা তখন অন্য প্রদেশে চাকরি পর্যন্ত পেত না। অন্য প্রদেশের লোকেরা সন্দেহ করত, পশ্চিমবঙ্গের সব তরুণ-তরুণীই বোধহয় নকশাল, মানে জঙ্গী। সন্ধের পর অনুষ্ঠান, সভাসমিতি একদম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সিনেমা হলগুলোতে নাইট শোতে দর্শক প্রায় হতই না। অনেক হল নাইট শো বন্ধই করে দিয়েছিল।

নকশাল আন্দোলনের প্রথম দিকে আমরা বহু তরুণ-তরুণীকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি, কেউ ফিরে এসেছে, কেউ ফেরেনি। কেউ ফিরতে চাইলেও অন্য নকশালদের চাপে পড়ে ফিরতে পারেনি। তেমনই একটা পরিস্থিতির শিকার হল সিঁথির আটাপাড়া লেনের পুতুল মুখার্জি।

পুতুলের বাবা ছিলেন রেল কর্মচারী। ধানবাদের পাশে রেলওয়ে ভুলি ট্রেনিং স্কুলের ইন্সট্রাকটর। সেখানেই থাকতেন। মা দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে আটাপাড়া লেনের বাড়িতে থাকতেন। পুতুলই ভাইবোনদের মধ্যে বড়। তখন তার আর কত বয়স হবে? বড়জোর ষোল-সতের। হায়ার সেকেন্ডারির ছাত্রী। চেহারাও বেশ সুন্দর। আমাদের কাছে খবর ছিল, আটাপাড়ার এক নকশাল তাত্ত্বিক ডি. চক্রবর্তী ওখানে একটা গ্রুপ পরিচালনা করে। সেই গ্রুপের ছেলেমেয়েদের পরিচয়ও আমরা পেয়ে গিয়েছিলাম। চক্রবর্তীর বোন মীনা সেই গ্রুপের সদস্য। তারই অতি উৎসাহে পুতুল দলে যোগ দেয়। এছাড়া ছিল গোখনা, বাপী, বিপাশা, শঙ্কু, চিটকে।

একদিন সন্ধেবেলা দেবীবাবু, আমি আর অন্য দুই অফিসার আটাপাড়ায় গেলাম, ওদের বোঝাতে। কিন্তু কারোকে পেলাম না। তখন গেলাম পুতুলের বাড়ি। তার বাবা-মাকে বললাম, “আপনাদের মেয়ে সর্বনাশা পথে চলেছে, ওকে আপনারা ফিরিয়ে আনুন। আমরাও আপনাদের সাহায্য করব।” ওঁরা আশ্চর্য হয়ে আমাদের কথা শুনছিলেন। আমরা তখন বললাম, “আপনারা বরং আগামীকাল সকাল দশটা নাগাদ পুতুলকে নিয়ে লালবাজারে আসুন, আমাদের সঙ্গে দেখা করুন। কোনও ভয় নেই, আমরাই ওকে বুঝিয়ে বলব, যাতে আগুন নিয়ে খেলার রাস্তায় সে না যায়।” পুতুলের বাবা আমাদের কথা দিলেন, তিনি পরদিনই লালবাজারে পুতুলকে নিয়ে যাবেন। কিন্তু পরের দিন, তারপরের দিন, তারপরের দিন, তারপরের দিন, এইভাবে দিনের পর দিন চলে গেল, কোথায় পুতুল?

খোঁজ নিয়ে জানলাম, যেদিন আমাদের সাথে তার দেখা করার কথা, সেদিনই ভোরবেলা গোখনা, বাপী, শঙ্কু পুতুলের বাড়ি যায়। তারপর পুতুলের বাবার বুকে রিভলবার ঠেকিয়ে বলে, “খবরদার মেয়েকে লালবাজারে পাঠাবেন না। তাহলে আমাদের সব কথা ফাঁস হয়ে যাবে। আমরা পুতুলকে নিয়ে যাচ্ছি। কোনও কথা বললে উড়িয়ে দেব।” পুতুলকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই গোখনরা তুলে নিয়ে চলে গেল। ওরা খবর পেয়েছিল, আমরা পুতুলের বাড়ি গিয়ে তার বাবা-মাকে কি বলেছি। ওরা ভাবল, ওদের গোপন খবর জানার জন্যই আমরা পুতুলকে লালবাজারে আসতে বলেছি। তখনও পর্যন্ত ওরা কিন্তু তেমন কোন বড় অপরাধ করেনি যে জন্য ওদের আমরা হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াব। যদি খবরাখবর জানারই দরকার হত তবে সেদিন রাতেই তো পুতুলকে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসতে পারতাম। সে তো আত্মগোপন করেনি।

বাবার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর পুতুল দেখল, এইভাবে এতগুলো ছেলের মাঝখানে সে দিনরাত থাকতে পারবে না। গোখনার আগের থেকেই পুতুলের দিকে নজর ছিল, কিন্তু পুতুল আমল দেয়নি। পরিস্থিতি পাল্টে যেতে, পুতুলই এবার গোখনাকে চাপ দিল তাকে বিয়ে করতে। গোখনা সেই সুযোগে দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরে পুতুলকে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করল। বুঝলাম না, যারা ঈশ্বরে একেবারেই বিশ্বাসী নয়, তারা কেন মা কালীকে সাক্ষী রেখে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে বিয়ে করবে? অনেক নকশাল তরুণ-তরুণী তো শুনেছি তখন মাও সে-তুঙের রেড বুক সাক্ষী রেখে, সেই বই ছুঁয়ে শপথ করে বিয়ে করেছিল। আসলে নকশালদের একাংশের এই দ্বৈত চরিত্রই তাদের ভেতরকার আদর্শগত দুর্বলতাকে বুঝিয়ে দেয়। মুখে এক, কাজে অন্যরকম। গোখনা ছিল ওয়াগন ব্রেকার, লুম্পেন। ডি. চক্রবর্তীর উদ্যোগে সে নকশাল হয়েছিল। আসলে নকশাল হওয়া তখন খুব সহজ হয়ে পড়েছিল। নকশালদের খাতায় একবার নাম লেখাতে পারলেই এলাকায় দাদাগিরি করা যেত সহজে। যাবতীয় কুকর্ম করে অবাধে ঘোরা যেত এবং সেইসব অপরাধ আড়াল করা যেত “বিপ্লবী আন্দোলনের” আড়ালে। গোখনা ছিল হঠাৎ হওয়া নকশাল, কোনও দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সে রাজনীতি করতে আসেনি। আমরা দেখেছি, যারা দীর্ঘ আন্দোলনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনীতিতে এসেছিল, তাদের সঙ্গে হঠাৎ হওয়া নকশালদের তফাৎ ছিল বিরাট। যারা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে নকশাল হয়েছিল তাদের চরিত্রের মধ্যে একটা আদর্শবোধ, নীতি ছিল কিন্তু হঠাৎ হওয়া নকশালদের মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও ছিল না। এরা ছিল চরম উচ্ছৃঙ্খল, চিন্তাশূন্য, একবগ্গা, চারুবাবুর “খতমের লাইনের” দাওয়াই খাওয়া অন্ধ সন্ত্রাসবাদী। বহুক্ষেত্রে চরিত্রহীনও। নকশাল আন্দোলন যে অকালে শেষ হয়েছিল, তার প্রধান কারণ কিন্তু এইসব হঠাৎ হওয়া নকশালরা। এদের কর্মকাণ্ডের জন্যই দ্রুত মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে যে প্রভাব নকশালরা ফেলেছিল তা সরতে শুরু করেছিল।

এই সমাজ ও সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছিলই, আছে এবং থাকবেও আর তার মুখপত্র হিসাবে সব সময়ই দেখা দিয়েছিল মধ্যবিত্তরা। সেই সব বিক্ষোভকে চটকদারী শ্লোগান দিয়ে নকশালরা মধ্যবিত্তের মধ্যে নিজেদের একটা জায়গা করে নিয়েছিল। পরবর্তীকালে যেমন দেখেছি এই রাজ্যে সর্বভারতীয় প্রাচীন দক্ষিণপন্থী এক রাজনৈতিক দলের সাধারণ এক কর্মীকে দারুণ জনপ্রিয় হতে, একই কায়দায়। মধ্যবিত্তের চরিত্রের মধ্যেই রয়ে গেছে ছটফটে ভাব, তাঁরা সবসময়ই চায় এক্ষুণি, আশু সমাধান। হাজার হাজার বছর ধরে সমাজের ভেতর শিকড়-উপশিকড় ধরে যা গেঁথে আছে তাকে কি ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায়? কিন্তু চঞ্চল চিত্তের মধ্যবিত্তরা তাই-ই চায়। আর এই অস্থির মনোবৃত্তির আঁতুড় ঘরেই জন্ম নেয় সন্ত্রাসবাদ। আর সব জায়গাতেই সন্ত্রাসবাদের শিকার হয় ছাত্রছাত্রী, যুবক-যুবতীরা। নকশাল আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

সত্তর সালের প্রথম দিক থেকে সিঁথি অঞ্চলে প্রতিদিনই নকশালদের সঙ্গে সি. পি. আই (এম) ক্যাডারদের সংঘর্ষ হত। সংঘর্ষে দুপক্ষের অনেকেই মারা গিয়েছিল কিংবা আহত হয়ে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সি. পি. আই (এম) ক্যাডারদের কাছে বোমার প্রচুর মশলাপাতি ও অন্যান্য অস্ত্র থাকাতে নকশালরা ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছিল। ওরা তখন ষড়যন্ত্র করল এক ঢিলে দুই পাখি মারার। সেইমত একদিন সন্ধেবেলায় নকশালরা সি. পি. আই (এম) ক্যাডারদের সাথে হাঙ্গামা বাধাল, বোমাবাজী শুরু করল। কাশীপুর থানার ইন্সপেক্টর প্রদ্যুৎ মুখার্জির নেতৃত্বে সাব-ইন্সপেক্টর প্রশান্ত সেননিয়োগী পনের কুড়ি জনের ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছল। প্রশান্ত তার জিপে বসে ছিল। নকশালরা পরিকল্পনা মত প্রশান্তর জিপ লক্ষ্য করে পর পর বোমা ছুঁড়তে, গুলি চালাতে শুরু করল। পেট্রোল বোমার আঘাতে প্রশান্ত জিপের ভেতরেই লুটিয়ে পড়ল। দাউ দাউ করে আগুন ধরে গেল জিপে। প্রশান্ত জিপ থেকে নেমে আসার কোনও সুযোগই পেল না, জিপের ভেতরেই অসহায়ভাবে পুড়ে যেতে লাগল।

অন্য জিপে প্রদ্যুৎ মুখার্জিও বোমার আঘাতে আহত হলেন। নকশালদের দলে ছিল গোখনা, বাপী, শ্যাম, কেলো ও বাবু। ওরা ওদের কাজ সেরে পালাল। সিপাইরা বালতি বালতি জল ঢেলে জিপের আগুন নিভিয়ে ফেলল। কিন্তু ততক্ষণে প্রশান্তর ঝলসান দলা পাকানো দেহটা দেখে তাকে আর চেনার কোন উপায়ই নেই। ওয়ারলেসে কাশীপুর থানায় খবর পৌঁছনর সাথে সাথে আরও ফোর্স গেল সেখানে। শুরু হল ব্যাপক তল্লাশি। সি. পি. আই (এম) না নকশাল, কাদের বোমার আঘাতে প্রশান্ত মারা গিয়েছে তা তো জানা নেই। দুপক্ষের এলাকাতেই কাশীপুরের পুলিশ আসামী ধরতে নেমে পড়ল। সি. পি. আই (এম) ক্যাডাররাও তখন এলাকা ছেড়ে বেপাত্তা। কারোকে ধরা গেল না।

নকশালদের আসল পরিকল্পনা ছিল, যখন সি. পি. আই (এম)-কে নিজেরা তাড়াতে পারছি না তখন পুলিশ দিয়ে তাড়াও। তারা জানত, দুপক্ষের বোমা ছোঁড়াছুঁড়ির মধ্যে পুলিশকে খুন করতে পারলে পুলিশ দুপক্ষকেই ধরার চেষ্টা করবে। তখন সি. পি. আই (এম) ক্যাডাররাও বাধ্য হবে এলাকা ছেড়ে পালাতে। প্রশান্ত মারা যেতে নকশালদের এই এক ঢিলে দুই পাখি মারার পরিকল্পনা সফল হল।

এসবই অবশ্য আমরা পরে জেনেছি। তখন জানলে সি. পি. আই (এম) কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান নাও চালাতে পারতাম। তাহলে নকশালদের হয়ত সি. পি. আই (এম)-এর সঙ্গে লড়াই করে এলাকায় টিকে থাকতে হত। যারা মুখে এবং আলোচনা ও ঘোষণাপত্রে গ্রাম যুক্ত করে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার পরিকল্পনা করেছিল, তারা কার্যক্ষেত্রে কিন্তু শুধু শহরেই বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ঘটিয়ে নিজেদের বিপ্লবীয়ানা জাহির করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইল।

তবে শহর থেকে নকশালরা কোন না কোন সময় অনেকেই গ্রামে গিয়েছিল কৃষকদের সংগঠিত করে বিপ্লব করার ইচ্ছায়। কিন্তু কজন তাদের মধ্যে টিঁকে থাকতে পেরেছিল? কজন কৃষকদের চরম দরিদ্র জীবনের সাথে নিজেকে মিলিয়ে দিতে পেরেছিল! উল্টে গ্রামের কিছু জোতদার, ধনী চাষী, নিরীহ লোককে খুন করে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল মানুষের থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল তাদের শহরে। মধ্যবিত্ত মানসিকতার নকশালরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শহরের আকর্ষণ ত্যাগ করতে পারেনি। আর নকশাল নেতারা ওইসব তরুণ-তরুণীদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। তাই শহরের গণ্ডির মধ্যে যে যার ইচ্ছেমত “শ্রেণীশত্রু” কাজ খতম ও অন্যান্য কাজ চালিয়ে যেতে লাগল।

ওদিকে গোখনা পুতুলকে বিয়ে করে তার পুরনো ওয়াগন ব্রেকার বন্ধু তপন চন্দ, কালা, অমল মুখার্জির কাছে নিয়ে গেল। একসময় অমল সি. পি. আই করত, তার বাড়ি বঙ্গলক্ষ্মী নপাড়ায়। গোখনা আর পুতুল অমলের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিল।

ইতিমধ্যে এক রাতে নীলু সেনগুপ্ত, মুকুল ও আরও দুজন নকশাল ইজ্জত কলোনির কাছে মিলিটারি কনভয়ের ওপর গ্রেনেড চার্জ করল। কনভয়ের কিছু হল না। গ্রেনেডগুলো বেশিরভাগই ফাটেনি। কেন ফাটেনি দেখার জন্য একটা গ্রেনেড মুকুল রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনতে গেল। তুলতেই সেটা বিকট শব্দে ফেটে মুকুলের ডান হাত উড়িয়ে দিল, পায়েও আঘাত লাগল। প্রাণে বেঁচে গেলেও মুকুলকে তারপর থেকে খুঁড়িয়ে চলতে হত।

একদিকে মিলিটারি আর পুলিশের ওপর ঘনঘন আক্রমণ, সি. পি. আই (এম)-এর সঙ্গে প্রতিদিন সংঘর্ষ নকশালদের, অন্যদিকে পুলিশের তাড়ায় সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। মানুষজন বাড়িঘর ছেড়ে, এলাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করল। সিঁথির নকশালরাও বেশিরভাগ বেদিয়া পাড়ার দিকে গিয়ে আশ্রয় নিল। বেদিয়া পাড়ার দিকে যাওয়ার আগে নকশালরা একদিন ভর দুপুরে সি. পি. আই (এম) মহিলা সংগঠনের কর্মী বীথি দেকে খুন করল। বীথি ছিলেন ডিভোর্সি, আটাপাড়ায় ভাইয়ের বাড়িতে থাকতেন। সেদিন সকালে বেরিয়েছিলেন কিছু কেনাকাটার জন্য। বাড়ি ফেরার সময় ৩০এ বাস থেকে নয়া রাস্তার মোড়ে নামতেই বাপী, বিপাশা, অমিত, চিটকে ওঁকে ঘিরে ধরে। তারপর টানতে টানতে আটাপাড়ার কাছে রেললাইনের ধারে নিয়ে এসে চিত করে ফেলে দিয়ে ভোজালি আর ছুরি দিয়ে বীথির বুকে, পেটে অনবরত কোপ দেয়। বীথির চিৎকারে কোনও মানুষ সেদিন সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল না। ওর লাল ব্লাউজের সাথে রক্ত মাখামাখি হয়ে রেললাইনের পাথর, মাটি সব লালে লাল হয়ে ভিজে যেতে লাগল। দশ মিনিট ধরে বাপীরা ওঁকে কোপাল, তারপর প্রাণহীন দেহটা ফেলে পাশের একটা পুকুরে গিয়ে ভোজালি আর ছুরি ধুয়ে চলে গেল। “বিরাট বিপ্লব হয়েছে”, এই আনন্দে নাচতে নাচতে।

বাপীর মস্তিষ্কের ডানদিকে একটা রোগ ছিল। মাঝেমাঝেই সে হিংস্র অপ্রকৃতস্থ হয়ে যেত। এমনিতেই খুনের নেশায় বাপী, শঙ্কু ও চিটকে সবসময় পাগল হযে থাকত। সারাদিনের মধ্যে কারোকে খুন করতে না পারলে রাতের দিকে রাস্তার কুকুর হলেও মেরে হাতের সুখ করত। চারুবাবু শিখিয়েছিলেন, “শত্রুর রক্তে হাত না রাঙালে বিপ্লবী হওয়া যায় না।” চাকবাবুর এই কথা নকশালরা জীবনের মূলমন্ত্র করে নিয়েছিল। রাস্তার কাগজ কুড়ানিওয়ালা, ভুজিয়াওয়ালা, ফেরিওয়ালা, যাকে খুশি তাকেই পুলিশের নজরদার কিংবা গুপ্তচর বানিয়ে খুন করে বিজয় উল্লাসে ঘুরে বেড়াত। “শ্রেণীশত্রুর রক্তে” হাত রাঙিয়ে বিপ্লব করত! যে নকশাল সেদিন কোন খুন করতে পারেনি, তাকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখত অন্যরা, যেন খুন করতে পারেনি বলেই দেশের মুক্তি পিছিয়ে গেল। প্রতিদিন রক্ত হাতে না মাখলে সে আবার কিসের বিপ্লবী? কিসের চারুবাবুর সুযোগ্য শিষ্য? তারা ভাবত, খুন করতে না পারার পেছনে রয়েছে দ্বিধাগ্রস্ত মানসিকতা, চারুবাবুর আদর্শে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ না করার পলায়নী মনবৃত্তি। তাই ওদের চোখে এরা ছিল দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণীর বিপ্লবী, কিছুটা অপাংক্তেয়।

নকশালরা একাত্তর সালের প্রথমেই পশ্চিমবঙ্গের বুকে এমন একটা আঘাত হানল, যাতে সাধারণ মানুষ স্তম্ভিত, নির্বাক হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *