২২
রাজ্য পুলিশ এলাকায় শুধুমাত্র বর্ধমানের ব্যাঙ্কের ডাকাতই আমরা ধরিনি। আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে ঘটে যাওয়া বহু ডাকাতির কিনারা আমরা করেছি। ডাকাত ধরাটাকে আমাদের পেশার সাথে মিশিয়ে নেশায় পরিণত করেছিলাম। তাই পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে আমরা দায়িত্ব নিজেরাই কাঁধে তুলে নিতাম। ছোটখাট ডাকাতির থেকে ব্যাঙ্ক ডাকাত ধরতেই বেশি সময় ব্যয় করতাম।
বিরাশি সাল থেকে চুরাশি সালের মাঝামাঝি অবধি রাজ্য পুলিশের এলাকায় বিভিন্ন ব্যাঙ্কের ডাকাতির খবর আমরা পেতে থাকলাম। আর সেইসব ডাকাতির কায়দাও প্রায় এক। এবং শুনতে পেলাম, ব্যাঙ্কে গিয়ে ডাকাতরা আবার লম্বা চওড়া বক্তৃতাও দিচ্ছে। তারা ব্যাঙ্কে ঢুকেই ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের প্রথমে ভয় দেখিয়ে তারপর বলছে, “আমরা সব বেকার শিক্ষিত যুবক, কাজ পাইনি, তাই বাধ্য হয়ে এ কাজে নেমেছি। টাকা নিয়ে আমরা ভাল ভাল কাজই করব। ফূর্তি করে উড়িয়ে দেব না। সবার যাতে কল্যাণ হয় তেমন কাজই করব।” এই ডাকাতরা ব্যাঙ্কে আসত সবাই টুপি পরে। দক্ষিণেশ্বরে একটা ব্যাঙ্কে ডাকাতি করার পর একটা দেশি টুপিও পাওয়া গেল।
রাজ্য পুলিশ এলাকায় ডাকাতি বা ওই ধরনের বড় কোনও অপরাধ’ সংঘটিত হলে আমাদের ওপর তার তদন্তের দায়িত্ব না থাকলেও আমরা তার খোঁজ রাখতাম ঠিকই। কিন্তু ওই ডাকাতিগুলোকে প্রথমদিকে আমরা তেমন গুরুত্ব দিইনি। রাজ্য পুলিশ এলাকাতে সংঘটিত হয়েছে বলেই নয়, আমাদের মধ্যে তখন একটা উন্নাসিকভাবও এসে গিয়েছিল, যেন ডাকাত ধরাটা আমাদের কাছে কিছু না। ভাবখানা এমন যখন আমাদের কলকাতা পুলিশের এলাকায় হবে তখন দেখা যাবে।
ইতিমধ্যে হাওড়ার ডোমজুড় এলাকায় একটা ব্যাঙ্কে ডাকাতি হল। ডাকাতরা এক লক্ষ ছ’ হাজার টাকা নিয়ে পালাল। ডাকাতি যেদিন হয়, সেদিন হাওড়ার তখনকার এস. পি. সুলতান সিং রাত এগারটা নাগাদ লালবাজারে এলেন, তখন বিভাগে আছি আমি আর রাজকুমার। তিনি আমাদের জানালেন, ডাকাতরা সবাই ডাকাতি করার সময় দেশি টুপি পরে ছিল। তিনি এসেছিলেন, সেই ডাকাতির সময় যে অ্যাম্বাসাডর গাড়িটা ব্যবহৃত হয়েছিল সেই গাড়িটার নম্বর নিয়ে, সেই গাড়ির আসল মালিক কে তা জানার জন্য। গাড়িটার নম্বর উনি পেয়েছেন, ওই ব্যাঙ্কের উল্টোদিকে যে স্কুল আছে তার ছাত্রদের কাছ থেকে। ডাকাতির সময় সেই স্কুলের ছাত্ররা দেখতে পেয়ে গাড়িটার নম্বর বুদ্ধি করে লিখে রেখেছিল।
গাড়িটার নম্বর বেলতলার মটর ভিহিকেলসের, সেখান থেকে পাওয়া যাবে না মালিকের নাম, কারণ পাঁচটার মধ্যেই মটর ভিহিকলস বন্ধ হয়ে গেছে। উপায় আমাদের ট্রাফিক ডিপার্টমেন্ট, সেখানেও সন্ধের পর গাড়ির নম্বর বিভাগের সবার ছুটি হয়ে যায়। তবু ওই বিভাগে গিয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গাড়ির মালিকের নাম, ঠিকানা নিয়ে এলাম। গাড়ির মালিকের ঠিকানা দমদম ক্যান্টনমেন্টের।
ঠিকানা পেতেই সিং সাহেব মালিকের খোঁজ করতে উদ্যোগী হলেন। আমি তাঁকে বললাম, “আমাদের ডাকাত ধরায় অভিজ্ঞ কজন অফিসারকে কি আপনার সাথে দেব?” উনি বললেন, “না, না, তার দরকার হবে না।” উনি চলে গেলেন।
তিনি চলে যেতে আমরা বসলাম ডাকাতিটার ঘটনা ব্যাখ্যা করতে। প্রথমেই ভাবলাম, আচ্ছা, ওই ডাকাতগুলো টুপি পরে ডাকাতিগুলো করছে কেন? তার মানে, ডাকাতদের কারও মাথায় কিছু আছে, সেটা ঢাকতেই ওরা টুপি পরছে, যাতে চট করে কেউ চিনতে না পারে, এবং ডাকাতরা পরিচিত না হয়ে যায়। এ নিয়ে আমরা আগেও চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু বেশি দূর যাইনি। যেহেতু তেমন কোন ঘটনার বিবরণ সরাসরি হাতে পাইনি। এবার আমরা ঠিক করলাম, মাথায় বিশেষ কিছু চিহ্ন আছে তেমন পরিচিত ডাকাত কে কে আছে, তার একটা তালিকা তৈরি করা যাক।
তালিকা তৈরি করতে প্রথমেই এমন একটা নাম তালিকায় লেখা হল, যার মাথায় একটা বিশাল টাক, সে সবসময় টাক ঢাকবার জন্য টুপি পরে থাকত। তাই তার কিশোরী নামের সাথে বিশেষণ যোগ হয়ে সে টুপি কিশোরী নামেই পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। সেই ডাকাতকে আমরা প্রথমে চিনি সত্তরের দশকে কতগুলো সোনার দোকান ও অন্যান্য দোকানে ডাকাতির ঘটনায়। তখন সেই ডাকাতিগুলোর জন্য তাকে আমরা ধরি, এবং জেলে পাঠাই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তখনও সে দমদম সেন্ট্রাল জেলে আছে। এবং সে না কি বদ্ধ উন্মাদ সেজে আছে। সে যখন জেলে আছে, সে নিশ্চয়ই হবে না ওই ডাকাতির পাণ্ডা।
এবার দ্বিতীয় যার নাম আমাদের তালিকায় এল, তার মাথাতেও টাক এবং তাকেও টুপি কিশোরীর সাথে ধরা হয়েছিল। সে সাজা খেটে জেল থেকে বেরিয়ে গেছে। সে ছিল অমিতাভ বসু বা ছোটুর দলে। এই ছোট্ উনসত্তর-সত্তর সালে একটা ডাকাতির দল গড়ে। দলে ছিল আট-দশ জন অল্পবয়সী বখে যাওয়া ছেলে। ছোট্ট প্রথমেই একটা গাড়ি যোগাড় করে। ছোটুর ডান হাত ছিল ফরডাইজ লেনের হাতকাটা রাধাকৃষাণ। এদের আগের থেকে কোনও ছক কষা থাকত না। সন্ধেবেলায় এরা গাড়িতে চড়ে সবাই বেরিয়ে পড়ত। তারপর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঠিক রাত আটটা থেকে সওয়া আটটার সময়, যখন দোকান বন্ধ করে দোকানদাররা টাকা পয়সা গুছিয়ে বের হতে যাবে, এরা সেই সব দোকানে ঢুকে টাকা পয়সা কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যেত।
এই ছোট্টর দল সারা কলকাতা জুড়ে এমন মোট ছত্রিশটা দোকানে ডাকাতি করেছিল। তারমধ্যে লিন্ডসে স্ট্রিটের একটা ওয়াইন শপ, কলেজ স্ট্রিটের হরলালকার দোকান ইত্যাদি ছিল।
একদিন খবর পাওয়া গেল ছোট্ট তার পুরো দল নিয়ে শ্রদ্ধানন্দ পার্কের কাছে ইন্ডিয়া হোটেলে আছে। খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমাদের বাহিনী হোটেলে ঘিরে ফেলল। ছোটু সর্দারজীর ছদ্মবেশ নিয়ে আমাদের লোকেদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল। কেউ তাকে চিনতে পারল না। সে ও তার দলের অন্য একজন ছাড়া হোটেলে সবাই ধরা পড়ল। গাড়িটাও পাওয়া গেল।
ছোট্ট হোটেল থেকে পালিয়েই দিন পনেরোর মধ্যে নতুন একটা দল তৈরি করল। আবার একটা গাড়ি যোগাড় করে নতুন করে দোকানে দোকানে ঠিক একই কায়দায় শুরু করল ডাকাতি। এবার আমরা তাদের ধরলাম। এই দলেই ছিল সেই টাক মাথার ছেলেটা, যার নাম আমাদের তালিকায় দ্বিতীয় হয়ে এল।
ছোটুর দলের বিরুদ্ধে আমরা “গ্যাং কেস” করলাম। তারা সবাই আদালতে নিজেদের দোষ স্বীকার করে নিতে আদালত তাদের অল্প সাজা দিলেন। তারা সেই সাজা খেটে বেরিয়ে গেল।
সেই টাক মাথার ছেলেটা জেল থেকে বের হয়ে নিজে একটা ছোট দল করে দক্ষিণ কলকাতায় একটা সোনার দোকানে ডাকাতি করল এবং আমাদের হাতে ধরা পড়ল। জামিনে ছাড়া পেতে সে আর আদালতে হাজির হল না। কিছুদিন পর সে আমাদেরই এক অফিসারের সোর্স হয়ে যায়। তাই তার নাম তালিকায় আসতে আমরা আশ্চর্য হয়ে গেলাম। প্রথমে ভাবা হল, না এটা বোধহয় ঠিক নয়। ওই গাড়ির মালিকের মত এই ডাকাত বন গয়্যা সোর্সের বাড়িও দমদম ক্যান্টনমেন্টেই। ভাবলাম, এটা কি কাকতালীয় না সত্যিকারের কোন মিল আছে? আমরা চুপ করে রইলাম, রাজ্য পুলিশের তদন্তের অগ্রগতির দিকে নজর দিলাম।
অন্যদিকে হাওড়ার এস. পি. সাহেব দমদম ক্যান্টনমেন্টের ওই গাড়ির মালিকের বাড়ি গেলেন। মালিক ভদ্রলোক রাতে আর কোথায় যাবেন, বাড়িতেই ছিলেন। এস. পি. সাহেব তাঁর গাড়ির খোঁজ করতে তিনি বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, গাড়ির নম্বর আর রঙ যা বলছেন, তা তো আমারই গাড়ি। গ্যারেজেই আছে, কিন্তু গাড়িটা তো আমি চালাই না, চালায় আমার ড্রাইভার স্বপন ঘোষ।”
এস. পি. সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “গাড়িটা আজ সকালে কোথায় গিয়েছিল, তা কি আপনি জানেন?” গাড়ির মালিক ভদ্রলোক বললেন, “তা তো জানি না, ড্রাইভার স্বপন দুদিন আগেই আমায় বলেছিল, আজ ও সকালে বেড়াতে যাবে। গাড়িটা যদি ওকে দিই তবে সেটা নিয়েই যাবে। আমি দেখলাম, রোজই ও আমার গাড়ি চালায়, একদিন যদি চায়, কি আর ক্ষতি? আমি ওকে আজ গাড়িটা দিয়েছিলাম, সে সকালেই নিয়ে গিয়েছিল, সন্ধের সময় দিয়ে গেছে, কোথায় নিয়ে গিয়েছিল, তা তো আমি জানি না।”
এস. পি. সাহেব ওই ভদ্রলোকের থেকেই ড্রাইভারের ঠিকানা নিয়ে তার বাড়ি গেলেন। তার বাড়িও ক্যান্টনমেন্টেই। কিন্তু জানতে পারলেন, সেই যে সকালে বেরিয়েছে, তারপর থেকে আর ফিরে আসেনি। সেখান থেকেই খবর পাওয়া গেল মিতা বৈদ্য নামে একটা মেয়ের সাথে স্বপনের খুব ঘনিষ্ঠতা আছে, স্বপন ওই মেয়েটার বাড়ি প্রায় প্রতিদিনই যায়। মিতার বাড়িতে এস. পি. সাহেবের নেতৃত্বে হানা দেওয়া হল। মিতা বাড়িতে ছিল, কিন্তু স্বপন ওখানে নেই।
মিতার ঘরে ছিল দুটো স্টিলের আলমারি। মিতার কাছে একটা আলমারির চাবি ছিল, সেটা খুলে দেখা হল, কিন্তু ডাকাতি সংক্রান্ত কোনও কিছুই পাওয়া গেল না। এস. পি. সুলতান সিংয়ের নির্দেশে অন্য আলমারিটা ভাঙা হতে সেই আলমারিতে পাওয়া গেল বেশ কয়েক বোতল স্কচ হুইস্কি, পঁয়ষট্টি হাজার টাকা আর বেআইনী বেশ কিছু অশ্লীল পত্রপত্রিকা। মিতা আলমারি ভাঙার আগেই জানিয়েছিল, ওই আলমারিটা তার নয়, তার পিসিমার, সে মুম্বাই থাকে এবং সেখানে সে হোটেলে নাচে। সেই পিসিমা কলকাতায় এলে এখানে থাকে, ওই আলমারিতে জিনিসপত্র রাখে। যাই হোক, সিংসাহেব ওই সব জিনিসগুলোর সিজার লিস্ট বানিয়ে বাজেয়াপ্ত করে মিতাকেও গ্রেফতার করে নিয়ে গেলেন।
মিতাকে নিয়ে গিয়ে ওরা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই হোক কিংবা অন্য কোন কারণেই হোক, আমরা জানতে পারলাম না। মিতা প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ল, তাকে হাসপাতাল ভর্তি করাতে হল। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তা নিয়ে পত্রপত্রিকায় তোলপাড় শুরু হল।
আমরা কিন্তু মিতার পিসিমার আলমারি থেকে পাওয়া জিনিসগুলো বা মিতাকে নিয়ে মাথাই ঘামালাম না। আমরা দমদম অঞ্চলে আমাদের রাডারগুলোকে সজাগ করে দিয়েছি মাত্র।
রাডারগুলোকে সজাগ করে দিতে আমাদের কেউ বলেনি। এমন কি এস. পি. সাহেবও আমাদের বলেননি, এই ব্যাপারে কোনরকম খোঁজ খবর করতে। কিন্তু খবর যখন পেয়েছি, বর্ণনা যখন শুনেছি, নিজেরা নিজেদের দায়িত্বে এগিয়ে গেলাম। সরকারের প্রতি, সমাজের প্রতি, নাগরিকদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার জন্যই এই উদ্যোগ। আমাদের মানসিকতা ছিল এরকম, ডাকাতরা নির্বিঘ্নে ঘুরবে, আর আমরা এলাকার দোহাই পেড়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যাব তা হয় না। সেই রাডারের মাধ্যমে খবর পেলাম, যেদিন ডাকাতি হয়েছে তার পরদিন আমাদের এক অফিসারের ডাকাত- সোর্স আর স্বপন একটা রিকশা করে বেলঘরিয়ার দিকে চলে গেছে, তারা আর দমদম ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসেনি।
আমরা তদন্ত শুরু করলাম এইখান থেকে। সেই সোর্সের নাম ছিল চন্দন চৌধুরী। তার আর স্বপন ড্রাইভারের যোগাযোগের অর্থ ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। তাছাড়া তার টুপি পড়ে ডাকাতি করার সম্ভাবনা আছে। আমাদের বানান তালিকায় তার নাম টুপি কিশোরীর পরেই রেখেছি। সে দমদম ক্যান্টনমেন্টের বাসিন্দা এবং স্বপনের সাথে একসঙ্গে রিকশায় বেলঘরিয়ার দিকে যেতে দেখা গেছে, তার মানে কি দুয়ে দুয়ে চার হল? মনে তৌ হয় দুয়ে দুয়ে চারই। তাহলে খোঁজ কর চন্দনের।
চন্দনের সব পুরনো আস্তানায় নিঃশব্দে আমরা ওই সোর্সের মাধ্যমে খবর নিতে লাগলাম। চন্দন নেই। কোথায় গেল, কেন তার হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা? তার একটাই অর্থ, সে বুঝতে পেরেছে তাকে খোঁজা হবে। আমরা অবশ্য তার সন্দেহের তালিকায় ছিলাম না, এস. পি. সাহেব এবং রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা দফতর সি. আই. ডি. খুঁজবে, সে জানত। কিন্তু আমরাও যে তার খোঁজে নেমে পড়েছি তা সে জানে না, সে আমাদের দফতরের এক অফিসারের সোর্স হওয়াতে তার বিশ্বাস ছিল যে আমরা তাকে ধরব না। সে আবার আমাদের গ্রেফতার এড়াতেই কলকাতা পুলিসের এলাকার বাইরে ডাকাতিগুলো করত। কিন্তু আমরা যে তার খোঁজে নেমেছি তা তার অজানাই রইল।
আমরা চন্দনের পুরনো দলের লোকজনকে খুঁজতে শুরু করলাম, যাঁরা চন্দনের খোঁজ দিতে পারে, এবং গতিবিধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারে। কিন্তু তাদের মধ্যে বিশেষ কে কে চন্দনের ঘনিষ্ঠ ছিল? প্রথমে এক এক করে বাছাই করতে করতে আমরা খড়দহ থানা অঞ্চলের সোদপুরের নিউ কলোনির একটা ছেলেকে ঠিক করলাম, যাকে ধরলে হয়ত চন্দনের খবর আমরা পেতে পারি। ছেলেটার নাম গোপাল। সে, চন্দন, শিউপ্ৰসাদ, রূপলাল, তারক, টিটাগড়েব জগা, বেলঘরিয়ার নারু মিলে টালিগঞ্জের ও মধ্য কলকাতার সোনার দোকানে ডাকাতি করেছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ধরাও পড়েছিল। তখন থেকে গোপালকে আমরা চিনি।
তাছাড়া গোপাল, চন্দনরা রানাঘাট ও আমডাঙ্গায় ব্যাঙ্ক ডাকাতি করেছিল। এগুলো সবই আমরা পরে জেনেছি।
ডোমজুড়ে ডাকাতি হওয়ার পর ইতিমধ্যে তিন চার দিন পার হয়ে গেছে। এরপর আমরা প্রথমেই গোপালকে ধরার সিদ্ধান্ত নিলাম, সেই অনুযায়ী আমাদের অফিসাররা সোদপুরের নিউ কলোনিতে তার বাড়িতে রাত্রিবেলা হানা দিলেন, সঙ্গে নিয়ে গেলেন সি. আই. ডি. অফিসারদের। তাকে পাওয়া গেল। তল্লাশি করে ডাকাতির কোনও কিছু পাওয়া না গেলেও, আমাদের অফিসারেরা পেল, চন্দনকে লেখা আমাদের দফতরের সেই অফিসারের একটা চিঠি যার সোর্স ছিল চন্দন। চিঠিটা সেই ছেলেটার কাছে পাওয়া যেতে সি. আই. ডি. অফিসারদের সামনে তারা যথেষ্ট বিব্রত বোধ করল, কারণ চন্দন যে আমাদের সেই অফিসারের সোর্স ছিল তা তো আর সি. আই. ডি. অফিসাররা জানেন না। তাঁরা হয়ত ভেবে বসতে পারেন চন্দনের সাথে আমাদের সেই অফিসারের গোপন কোনও যোগ আছে। তারা সি. আই. ডি. অফিসারদের হাতে ওইসব চিঠিগুলো না দিয়ে নিজেরাই নিয়ে চলে গেল, সাথে গোপালকেও।
যে অফিসার চিঠিটা পেয়েছিল সে লালবাজারে এসে আমাকে সেটা দিয়ে বলল, “স্যার, দেখুন।”
আমি চিঠিটা নিয়ে পড়ে সেটা পকেটে রেখে দিলাম। যে অফিসারের সোর্স ছিল চন্দন তাঁকে আমি কিছুই বললাম না, কারণ তাঁর পেশাদারী আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত।
চন্দন খুবই ধূর্ত ছিল। তাই সে জেল থেকে বের হয়ে নিজেকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য ডাকাতি দমন শাখারই অফিসারের সোর্স হয়ে গেল। আমাদের সেই অফিসারকে সে বোকা বানিয়ে কলকাতা পুলিশের এলাকার বাইরে একটার পর একটা ডাকাতি করে চলল।
সেই অফিসার আমারই অধীনে ছিল। তার যদি কোনও দোষ থেকে থাকে তবে তার দায় তো আমার ওপরও বর্তায়।
আর চিঠিটার মধ্যে এমন কিছু লেখাও ছিল না, শুধু চন্দনকে সে দেখা করতে বলেছিল। সেই অফিসারের চাকরি জীবনের আনুগত্যকে মুহূর্তে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার সুযোগ আমার হাতে এসেছিল, কিন্তু তা করলে তার এতদিনের দক্ষতাকে অস্বীকার করা হত।
এমন ভাবেই আমাদের ডাকাতি দমন শাখার আর একজন অন্যতম প্রধান অফিসার আশিসদাকে অন্যায়ভাবে অপদস্থ করা হয়েছিল। সে ডাকাতদের ভেতরে সোর্সের সাথে যোগাযোগ রাখতে গিয়ে পেশাদারী হিংসার বলি হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে প্রচার করা হয়েছিল তার নাকি ডাকাতদের সাথে ঘনিষ্ঠতা প্রবল। এমনভাবে পত্রপত্রিকায় মুখরোচক গল্প ফেঁদে প্রচার হল, মনে হবে সে যেন ডাকাতদের থেকে ডাকাতির টাকার বখরা নেয়।
সবচেয়ে যা ক্ষতি হয়, কিছু সন্দেহবাতিক ঊর্ধ্বতন অফিসার এই সব প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে এমন কিছু প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়, যার ফলে চরম ক্ষতি হয় দফতরের। তখন সাহস করে অফিসাররা আর বিশেষ ঝুঁকি না নিয়ে কোনমতে শুধুমাত্র “চাকরি বজায়” রাখার কাজটুকু করেই বাড়ির ছেলে বাড়ি চলে যায়।
একবার এক অফিসার পেশাদারী হিংসায় বশবর্তী হয়ে, এক ডাকাতকে ভয় দেখিয়ে এক লরি লুটের গল্প বানিয়ে ডাকাতের মুখ দিয়ে সেই গল্পকে স্বীকারোক্তি হিসাবে বলাল এবং তা বড় একটা টেপ রেকর্ডারে টেপ করে নিল। সেই গল্পে সে অন্য এক অফিসারকে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসাবে দেখাল, এবং ডাকাতের মুখ দিয়ে জানাল সেই লরি লুটের টাকা অফিসারটি নিয়েছে। আসলে তেমন কোন লরিই লুট হয়নি। টাকা নেওয়া তো দূরের কথা। এই মিথ্যা অনেক কষ্টে ধামাচাপা দেওয়া গেছে।
আসলে আশিসদা চব্বিশ পরগনা অঞ্চলের কিছু ডাকাতকে সোর্স হিসাবে ব্যবহার করতেন, সেটাই তাঁর বিরুদ্ধে প্রচার করার হাতিয়ার হিসাবে কেউ কেউ ব্যবহার করেছিল। এই রকম সোর্স সবাইকেই রাখতে হয়, নয়ত কাজ কঠিন হয়ে পড়ে।
ডাকাতদের তো আর বিশেষ গণ্ডি নেই, এখানে ডাকাতি করব না, ওইখানে করব। তারা যেখানে সুযোগ পাবে সেখানেই ডাকাতি করবে। তাছাড়া আমরা দেখেছি, কলকাতা অঞ্চলের ডাকাতরা ডাকাতি করে হয়ত পালিয়ে যেত উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা অঞ্চলে, আবার ওই সব অঞ্চলের ডাকাতরা তাদের এলাকায় ডাকাতি করে আস্তানা নিত কলকাতায়। সুতরাং আমাদের সব জায়গাতে সোর্স রাখতে হত।
তেমন একটা ঘটনা চন্দনকে লেখা আমাদের সেই অফিসারের চিঠিটা। তবু আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সেদিন রাতেই গোপালকে জিজ্ঞেস করলাম, “চিঠিটা তুই কিভাবে পেয়েছিস?”
সে বলল, “একদিন ওই অফিসার ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তখন চিঠিটা তিনি দেন চন্দনকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু চন্দনকে তা দেওয়া হয়নি।” ওর কথা শুনে আমি ব্যাপারটা নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি না করে চুপ করে গেলাম।
কিন্তু চিঠিটা ওই ছেলেটির কাছে পেতে একটা জিনিস হাতেনাতে প্রমাণ হল, চন্দনের সাথে ওই ছেলেটার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। নয়ত চন্দনের চিঠি সে তার হেফাজতে রাখত না।
পরদিন সকালে গোপাল আমাদের কাছে বলল, চন্দনের এই সব টুপি পরা ডাকাতির সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। ডোমজুড়ে যে ডাকাতি হয়েছে তা সে শুনেছে, তা চন্দনের নেতৃত্বেই হয়েছে। আরও জানাল, চন্দন খুব সম্ভবত দুর্গাপুরে আছে এবং দুর্গাপুরের সেই বাড়িটা সে চেনে। ঠিক করলাম, দুর্গাপুরে যাব। আমরা গোপালকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম দুর্গাপুরের উদ্দেশে।
শীতকাল, কুয়াশায় পথঘাট প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। জি. টি. রোড ধরে গাড়ি দ্রুত এগতে পারছে না। উল্টোদিক থেকে হুস হুস করে প্রচণ্ড গতিতে লরির ঝাঁক হেডলাইট ও স্পট লাইট জ্বালিয়ে আমাদের গাড়ির ঘাড়ে এসে পড়ছে যেন হঠাৎ হঠাৎ। পানাগড় ছাড়িয়ে দুর্গাপুরের মুচিপাড়ার মোড় যখন এল, তখন রাত সাড়ে বারটা পার হয়ে গেছে।
এবার কোন দিকে ভাই? মুশকিল হল, সোদপুরের ছেলেটা দুর্গাপুরে যখন এসেছে তখন ট্রেনে করে এসেছে এবং স্টেশন থেকে রিকশা করে গিয়েছে তাদের আস্তানায়, ওইভাবেই সে চেনে। জি. টি. রোড থেকে কোন দিকে কিভাবে যাবে সে অত রাতে আন্দাজ করতে পারছে না। উত্তর দক্ষিণ সব গুলিয়ে ফেলছে। কি আর উপায়, গাড়ি মুচিপাড়া থেকে ঘুরল দুর্গাপুর স্টেশনের দিকে, তারপর রেললাইন পার হয়ে স্টেশনের চত্বরে গিয়ে ঢুকল। গাড়ি দাঁড়াল, এবার ছেলেটা গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে দিকটা ঠিক করে নিয়ে বলল, “এবার মনে হয় চিনেছি, চলুন।”
ঘুম নেই, কারও চোখে ঘুম নেই। কিন্তু ক্লান্তিও নেই। আমাদের এমনই হত। শরীর না চাইলেও মনের জোরে এগিয়ে যেতাম, যতক্ষণ না ধরতে পারছি আসামীকে। এবার গোপালের নির্দেশমত গাড়ি দুটো চলল। অনেকক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে দুর্গাপুরের একটা কলোনির মধ্যে সে আমাদের নিয়ে এল। চারদিকে নিঝুম, শীতের রাত, দুর্গাপুরের প্রচণ্ড শীতে সবাই ঠকঠক করে কাঁপছে, রাস্তার আলো দূর থেকে কুয়াশা ভেদ করে যতটুকু আসছে তা দিয়েই যা কিছু দেখার তা দেখতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে রাস্তার কুকুরের ডাক ছাড়া আর কোন প্রাণের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে না। গাড়ি দাঁড় করিয়ে সে এবার হাঁটিয়ে নিয়ে চলল। কারণ তাকে আগেই বলা হয়েছিল, বাড়ির থেকে একটু দূরে যেন গাড়ি দাঁড় করায়।
রাতে বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়ালে অপরাধীরা সজাগ হয়ে যায়, সজাগ হলেই আস্তানা থেকে বেরিয়ে পালায়। তাই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে গাড়ি দূরে দাঁড় করাতে বলা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী আমাদের গাড়ি দুটো কিছুটা দূরেই দাঁড় করিয়েছিল। ঠাণ্ডার মধ্যে আমরা তার পিছু পিছু এগিয়ে যেতে লাগলাম। একটু পরে একটা বাড়ি দেখিয়ে দিল সে। আমরা বাড়িটা নজর করে দেখে নিয়ে ঘিরে ফেললাম। বাড়ির সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেল দুজন। তারা চন্দনকে চেনে, অবশ্য চন্দনও তাদের চেনে। বাড়িটার চারদিক চারফুট মত উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সামনে লোহার গেট, তালা মারা। রাত তখন আড়াইটা, আমাদের দুজন অফিসার পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর সদর দরজায় গিয়ে কলিং বেল খুঁজে টিপে দিল, কোনও সাড়া নেই। আবার টিপল, ভেতর থেকে পুরুষকণ্ঠে প্রশ্ন এল, “কে?”
একজন অফিসার বলল, “আমি, কলকাতা থেকে এসেছি, একটা বিশেষ জরুরী খবর দিতে।” দুর্গাপুরের সব বাঙালিরই কলকাতায় আত্মীয়স্বজন আছেন। সুতরাং কার কি হল, কিসের খবর এল ইত্যাদি ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে এক ভদ্রলোক এসে দরজা খুলতেই তারা পরিচয়পত্র দেখিয়ে বলল, “এক আসামীর খোঁজে আমরা এসেছি, শুনেছি সে আপনার বাড়িতে আছে, আমরা আপনার বাড়িটা দেখব।” ভদ্রলোক বললেন, “কোনও আসামী আমার বাড়িতে নেই, ‘আপনারা দেখুন।” সবাই একথা বলে, বিশ্বাস করা যায় না, তাই তাঁরা বাড়ির ভেতর ঢুকে সব ঘর দেখল। কিন্তু কাউকে না পেয়ে ভদ্রলোকের কাছে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে এল।
তারপর বাড়ির চারদিকে ছড়িয়ে থাকা সবাই একসঙ্গে জড়ো হয়ে যখন আলোচনা করছি, তখন গোপাল বলল, “এই বাড়িটাই হবে, কিন্তু কিরকম যেন গুলিয়ে ফেলছি। সবই একইরকম দেখতে, কোয়ার্টার তো।” তখন আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঠিক করলাম, এতদূর এসে বিফল হওয়ার মানে হয় না, অন্তত যে বাড়িটায় চন্দন এসে থাকে সে বাড়িটা তো খুঁজে দেখা যাক। সত্যিই সে এখানে এসেছে না কি অন্যখানে? আর তার ঘনিষ্ঠজন যখন বলছে সে দুর্গাপুরে এসেছে, তখন নিশ্চয়ই তার মধ্যে কিছু সত্যাসত্য আছে, নয়ত আমাদের বিপাকে ফেলে, চন্দনকে আরও পালানোর সময় দিয়ে সে নিজের বিপদ ডেকে আনবে না। বিশেষ করে যেখানে সে নিজে এইসব ডাকাতিগুলোর একটাতেও অংশগ্রহণ করেনি।
তার কথা অনুযায়ী ডোমজুড়ের ডাকাতিতে অংশ নিয়েছে নবদ্বীপের অসিত, টালার মনা, দমদম ক্যান্টনমেন্টের সমর ও আরও কয়েকটা ছেলে যাদের নাম ওর জানা নেই। সুতরাং একেবারে মিথ্যা কথা বলে সে আমাদের নিযে আসেনি। একই রকম বাড়ি দেখে সঠিক বাড়িটা আন্দাজ করতে পারেনি, তার ওপর বাড়ির নম্বরটা এবং মালিকের নামও মনে নেই।
ঠিক ওই সময় অন্ধকারে পাশের বাড়ি থেকে চাদর মুড়ি দিয়ে একটা লোক বেরিয়ে রাস্তার ধারে প্রাকৃতিক কর্ম শুরু করেছে। আমাদের দুজন সেই লোকটাকে জিজ্ঞাসার উদ্দেশে এগিয়ে গেল। লোকটির প্রাকৃতিক কর্ম শেষ হওয়ার পর তারা তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে গেল, আরে কাকে জিজ্ঞাসা করছি, এই তো চন্দন!
একটু নাটক করেই অফিসার বললেন, “আরে চন্দন, তুই যে দুর্গাপুরে চলে এসেছিস তা আমাদের জানিয়ে আসবি তো, ওদিকে তোকে ভীষণ দরকার, কত ঝামেলা করে যে আমাদের আসতে হল তা আর বলে লাভ নেই, এখন চল। আর আমরা জানি, তুই একা আসিসনি, যাদের সঙ্গে এনেছিস তাদেরও ডাক, এখানে তাদের ফেলে রেখে কি করবি? আমাদের সাথে কলকাতা চলুক।”
চন্দন ঝানু ওস্তাদ, সে আমাদের প্রায় সব অফিসারকেই চেনে। সে পাকা খেলোয়াড়ের মত আমাদের যে অফিসারের সে সোর্স তাঁর নাম করে বলল, “কেন আমি তো “দাদা”কে বলে এসেছি। উনি কি বলেন নি? তা কি এমন দরকার পড়ল যে, আমার খোঁজে এতদূর আসতে হল? ঠিক আছে, আমি তো শুনলাম, কালকের দিনটা বাদ দিয়ে পরশুদিনই কলকাতায় গিয়ে দেখা করছি।”
অফিসার বললেন, “সে কি রে চন্দন, এমাজেন্সি আছে বলেই তো ‘আমরা ছুটতে ছুটতে এই ঠাণ্ডার মধ্যে তোর কাছে এলাম, চল, আগে তোর ঘরে চল।” তাঁরা চন্দনকে নিয়ে সেই বাড়িতে ওর ঘরের মধ্যে গিয়ে একটা ছেলেকে পেলেন, সে তখন অঘোরে ঘুমচ্ছে। একজন অফিসার তার গায়ের থেকে লেপটা সরিয়ে দিতেই ঠাণ্ডা লাগতে সে জেগে গ্লে। অফিসার বললেন, “চল, কলকাতায় যেতে হবে।” ধড়মড়িয়ে উঠে সে প্রশ্ন করল, “কেন?” অফিসার বলল, “ডাক এসেছে ভাই, ডাক এলে সবাইকেই যেতে হয়।”
অন্যদিকে দুটো গাড়ি ভাগ করে ফেলা হয়েছে। গোপাল যে চন্দনের আস্তানা চিনিয়ে দিয়েছে তা চন্দনকে জানান হবে না। তাকে একটা গাড়িতে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সেই গাড়িটা অন্য গাড়ির থেকে দূরে রাখা হয়েছে।
চন্দন আর নতুন ছেলেটাকে নিয়ে আমাদের অফিসাররা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। চন্দন সেই বাড়ির লোকজনকে অফিসারদের সামনেই বলল, “আমার অফিসের বিশেষ জরুরি কাজ পড়ে গেছে, তাই ওরা আমাকে খবর দিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। ঠাণ্ডাটা একটু কমুক, তারপর আবার আসা যাবে।” চন্দন আর নতুন ছেলেটাকে নিয়ে আমাদের অফিসাররা দ্বিতীয় গাড়িতে বসলেন। বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে দুটো গাড়ি ছুটল দুর্গাপুর স্টেশনের দিকে। শীতের জন্য দুটো গাড়ির কাঁচের জানালা বন্ধ। ভোর হয়ে আসছে, প্রায় চারটে বাজে, প্রথম গাড়িটা দুর্গাপুর স্টেশনে এসে থামল। দ্বিতীয় গাড়িটা স্টেশনের চত্বরের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল, চন্দনকে নিয়ে।
প্রথম গাড়ির থেকে গোপালকে নামিয়ে টাকাপয়সা দিয়ে বলা হল, প্রথম ট্রেনেই বাড়ি চলে যেতে। গোপাল বুঝে গিয়েছে, সে যে চন্দনের আস্তানা চিনিয়ে দিয়েছে তা যেন চন্দন বুঝতে না পারে, তাই এই ব্যবস্থা। অবশ্য চন্দনের সঙ্গীর নামটা সে আমাদের ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে। চন্দন যখন তাকে সঙ্গে নিয়ে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিল, তখন তাকে দেখেছে গোপাল। চন্দনের সঙ্গিটা হচ্ছে নবদ্বীপের অসিত।
গাড়ি এবার ছুটল কলকাতার দিকে। আবার মুচিপাড়ার মোড়। তারপর জি. টি. রোড, দুধারের বড় বড় গাছ থেকে পাখিরা ভোরের আলোর সাথে ঘুম থেকে জেগে ওঠার ডাক দিচ্ছে চারপাশের গ্রামের লোকজনকে, মাঠে মাঠে ভর্তি কুয়াশা, ফসলের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমাদের রাত তো জাগাই। ধরে নিয়ে আসছি এক সহকর্মীর সোর্সকে, ডাকাত হিসাবে। চন্দন অনেক আগেই বুঝে গেছে, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু সে চালাক ছেলে, এমনভাবে কথাবার্তা বলছে যেন ভুল করে তাকে ধরা হয়েছে, সে কোনও অপরাধই করেনি।
আমাদের গাড়ি দুটো সকাল দশটার মধ্যেই লালবাজারে পৌঁছে গেল। চন্দন আর অসিতকে লালবাজারের সেন্ট্রাল লকআপে পাঠিয়ে দিয়ে সবাই বাড়ি চলে গেলেন। বারটা নাগাদ চন্দন আর অসিতকে নিয়ে আসা হল আমাদের বিভাগে। শুরু হল জেরা।
ডোমজুড়ের ডাকাতির কথা, অন্য টুপি পরে যেসব ডাকাতিগুলো করেছে সেই সম্পর্কে প্রশ্ন। কিন্তু না চন্দন, না অসিত, কেউ কোনও কিছুই স্বীকার করল না। চন্দনের বয়স তখন কত, খুব জোর সাতাশ আঠাশ, ফর্সা গায়ের রং, বলিষ্ঠ চেহারার মাঝারি উচ্চতার ছেলে। কিন্তু তখনই ক্ষুরধার বুদ্ধি ধরে। অসিতও কোনও কথাই স্বীকার করল না। ওদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জেরা চলল প্রায় বার তের দিন। কিন্তু সব কথাই ওরা অস্বীকার করতে লাগল। অথচ আমাদের কাছে পাকা খবর ওরা সব কিছু জানে। তাই ওদের আমরা তো আর ছেড়ে দিতে পারি না।
ইতিমধ্যে আমাদের একটা ভুল হয়ে গিয়েছিল। আমরা ওদের দুজনকে একই লকআপে রাখতাম। জিজ্ঞাসাবাদ আলাদাভাবে করলেও একই লক- আপে থাকার ফলে ওরা রাতে একই সঙ্গে থাকত। তাই কি কি প্রশ্ন ওদের করছি তা নিজেরা আলোচনা করার সুযোগ ওরা প্রতিদিন পেত এবং কে কি উত্তর দিচ্ছে তাও নিজেরা আলোচনা করত। ফলে আমাদের জেরার উত্তরে ওরা “না” ছাড়া অন্য কোনও উত্তর দিত না। এবার আমরা আমাদের ভুলটা সংশোধন করে নিলাম, দুজনকে আলাদা আলাদা লক আপে রাখার ব্যবস্থা করলাম, যাতে ওরা পরস্পর পরস্পরের সাথে দেখা না করতে পারে, আলোচনা না করতে পারে।
ওদের আলাদা করার পর প্রথমেই আমরা লক আপ থেকে নিয়ে এলাম অসিতকে। একটা মোটা টাইপ করা কাগজের বান্ডিল দেখিয়ে ওকে বলা হল, “কিরে অসিত, তুই না বললেও দেখ চন্দন সব কিছু স্বীকার করে নিয়েছে, সব বলেছে, তুই যদি না বলিস, তুই বিপদে পড়বি। আমাদের কি, চন্দন তোদের ফাঁসিয়ে নিজে বেঁচে চলে যাবে। মাঝখান থেকে তুই মরবি।” অসিত একবার আমার হাতের কাগজের বান্ডিলটার দিকে দেখল, কাগজগুলো ইংরেজি টাইপে লেখা। জানি অসিত ইংরেজি জানে না। আমি ওকে বললাম, “পড়, পড়ে দেখ না, কি কি বলেছে চন্দন।” অসিতের মুখ সাদা হতে থাকল, বুঝলাম, আমাদের ওষুধে কাজ হয়েছে। সে বলল, “দাঁড়ান একটু ভেবে নিই।”
ব্যস, একবার ভেবে নিই মানে, পালাবার আর পথ নেই। তুমি নিশ্চয়ই জান, নয়ত কি আর ভাবার আছে! এবার শুরু কর, একবার চালু করলে যতক্ষণ না শেষ করবে ততক্ষণ ক্যাসেট চালিয়েই যেতে হবে।
অসিতকে চা জলখাবার এনে দেওয়া হল, যাতে সে ভাবার রসদ পায়। চা শেষ করে সে বলল, ডোমজুড়ের ডাকাতি ও অন্য কয়েকটা ডাকাতিতে সে চদ্দনের সবচেয়ে বড় সহযোগী হিসাবে কাজ করেছে। ডোমজুড়ের ডাকাতিটা সেদিন করতে সে চন্দনকে বারণ করেছিল, কিন্তু চন্দন তার কথাও শোনেনি, অন্যদেরও না।
অসিতরা বারণ করেছিল একটা কারণে। আগে ঠিক ছিল স্বপন মালিকের গাড়িটা নিয়ে বালিতে অপেক্ষা করবে, তারা অন্য একটা ছিনতাই করা গাড়ি নিয়ে ডোমজুড়ের ব্যাঙ্কে গিয়ে ডাকাতি করে, সেই গাড়িতে বালি পর্যন্ত এসে, ছিনতাই করা গাড়িটা ফেলে দিয়ে স্বপনের গাড়ি করে চলে যাবে। সেই অনুযায়ী তারা রাস্তাতে একটা গাড়ি ধরে, সেই গাড়ির ড্রাইভারকে মারধর করে নামিয়ে দিয়ে পালিয়ে ডোমজুড়ের দিকে যাচ্ছিল, কিন্তু মাঝপথে ওই ছিনতাই করা গাড়িটা খারাপ হয়ে গেল, কিছুতেই আর ঠিক করা গেল না। তখন অসিতরা চন্দনকে বলেছিল, আজ যখন একবার বাধা পড়েছে তখন ডোমজুড়ে গিয়ে লাভ নেই, ফিরে যাই, অন্যদিন আসা যাবে। কিন্তু চন্দন কারও কথা শুনল না, সে স্বপনের গাড়িটা নিয়েই চলল। বলল, “ও কিছু হবে না। বেরিয়েছি যখন, তখন কাজটা করেই ফিরব। একটার পর একটা ডাকাতি করে চন্দন এত বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল যে এইসব তুচ্ছ কারণগুলোকে আমলই দিত না। ডোমজুড়ে গিয়ে ব্যাঙ্ক লুঠ করে পালাতে অবশ্য তাদের কোনও অসুবিধা হয়নি। ডাকাতি করে ওরা এদিক ওদিক ঘুরে দমদম ক্যান্টনমেন্টেই ফিরে এসেছিল।
একে একে জায়গা মত মনা, সমর, চন্দন সবাই নেমে যেতে স্বপন তার মালিকের গাড়ি মালিকের বাড়িতে দিয়ে এসেছে। মালিকের বাড়ির লোক কেউ টেরই পায়নি যে ওদের গাড়ি নিয়ে স্বপন ডাকাতি করে এসেছে। স্বপনও চায়নি তার গাড়িটা সরাসরি ব্যাঙ্কের সামনে ডাকাতির জায়গায় নিয়ে হাজির করান হোক। কিন্তু চন্দনের হুমকির সামনে সে অসহায় বোধ করে এবং চন্দনের নির্দেশ মত সে বাধ্য হয় গাড়িটা নিয়ে যেতে। তারপর তারা গাড়ির নম্বর না পাল্টেই ব্যাঙ্কে ডাকাতিটা করে। ব্যাঙ্ক থেকে বের হয়ে সোজা গাড়িতে চড়ে পালায়। ডাকাতির টাকাটা সবাইকে অল্প কিছু কিছু দিয়ে চন্দন আর অসিতই বেশির ভাগটা নিয়ে চলে গিয়েছিল।
এইভাবে চন্দনের পরিকল্পনা মাফিক সব ঠিকই ছিল, কিন্তু বাদ সাধল ওই স্বপনের গাড়ি। ডাকাতির দিনই রাতে গাড়ির মালিকের বাড়ি পুলিশের হানা, তারপর স্বপনের বাড়ি। শেষমেষ মিতা বৈদ্যকে গ্রেফতার করে সুলতান সিং সাহেব নিয়ে যেতেই চন্দনরা সাবধান হয়ে যায়।
ওরা বোঝে স্বপনের খোঁজ পেয়ে গেছে হাওড়ার এস. পি. সাহেব অর্থাৎ রাজ্য পুলিশ। সুতরাং নিজেদের জন্য ওরা দমদম ক্যান্টনমেন্টকেই আর নিরাপদ মনে করতে পারল না। চন্দন মনে করল, স্বপন একটু দুর্বল চিত্তের, একবার ধরা পড়লেই সব গড়গড়িয়ে বলে দেবে, তাই একটা কিছু ব্যবস্থা করা উচিত। চন্দনের দৃঢ় ধারণা ছিল কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনীর কেউ ওর পেছনে লাগবে না, সুতরাং কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারলেই সময়ের ব্যবধানে রাজ্য পুলিশের দৌড়দৌড়ি বন্ধ হয়ে যাবে। আর রাজ্য পুলিশের লোকজন ওকে বিশেষ চেনে না। সেজন্য ওরা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালাল দুর্গাপুর। চন্দনই প্রথম স্বপনকে নিয়ে রিকশা করে বেলঘরিয়া যায়, সেখান থেকে অসিত, সমর, মনাকে সঙ্গে নিয়ে ওরা প্রথমে দক্ষিণেশ্বরে আসে, সেখান থেকে বাসে করে বালিতে এসে নামে, তারপর বালি স্টেশন থেকে কর্ড লাইনের ট্রেন ধরে বর্ধমানে এসে পৌঁছয়। বর্ধমানে নেমে ওরা দুপুরের খাওয়া দাওয়া স্টেশনের বাইরের একটা ছোট পাইস হোটেলে সারে, তারপর আবার ট্রেন ধরে দুর্গাপুর স্টেশনে এসে নামে।
“কিন্তু মনা আর সমর কোথায় গেল?” অসিতের কাছে আমরা জানতে চাইলাম। অসিত জানাল, সমর আর মনা দুর্গাপুর থেকে চলে গেছে আসানসোল।
ওখানে মনার মামা থাকে, সেখানে বেড়াতে গেছে। কোথায় এখন আছে, তা সে বলতে পারবে না। “আর স্বপন? সেও কি কোথাও বেড়াতে গেছে? না ফিরে এসেছে? তাড়াতাড়ি বল।” আমাদের প্রশ্নের মুখে অসিত চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর যা বলল তার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।
অসিত আমাদের দিকে মুখ করে গলার স্বর নিচু করে বলল, “স্বপন নেই।” “তার মানে?” আমাদের প্রশ্ন। অসিত বলল, “হ্যাঁ, স্বপন মারা গেছে।”
আমরা চমকে উঠলাম, কিন্তু সময় অপচয় না করে আমি বললাম, “তোরাই তবে মেরেছিস স্বপনকে?” অসিত যেন অন্য কোনও গল্প না ফেঁদে বসে, তাই ঝট করে ওকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়ে ওর দিকে আমরা তাকিয়ে বসে রইলাম। ওর চোখমুখের ভাষার কোনরকম পরিবর্তন হলে আমরা যেন বুঝতে পারি।
অসিত খুব নিচু স্বরেই বলল, “হ্যাঁ, আমরাই ওকে মেরে ফেলেছি। আসলে ওকে যখন হাওড়ার পুলিশ খুঁজতে শুরু করেছে, তখন চন্দন আমাদের বলল, দেখ স্বপনকে পুলিশ খুঁজছে, ওকে যদি পুলিশ ধরতে পারে তাহলে স্বপন আমাদের কথা বলে দিলে আমাদের বিপদ হয়ে যাবে, কিন্তু ওকে যদি ধরতে না পারে তবে পুলিশ আর আমাদের হদিসও পাবে না। তাই ওকে যাতে ধরতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।”
অসিত তারপর বলল, “আমি তখন বললাম, তাহলে ওকে বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দিলে হয়, কিন্তু চন্দন তখন বলল, হ্যাঁ বাইরেই পাঠাতে হবে, একেবারে পৃথিবীর বাইরেই পাঠিয়ে দিতে হবে, ওকে আমাদের পেছনে লেজ হিসাবে বাঁচিয়ে রেখে অশান্তিতে দিন কাটান বুদ্ধির কাজ হবে না। তাই ওকে একেবারে সরিয়ে দেওয়াই ভাল। তারপর চন্দন আমাদের বলল, আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে, বারটা নাগাদ আমার ক্লাবের সামনে তোরা চলে আসিস, তখন বলব। এরপর চন্দন আমাদের ওখানে রেখে কোথায় চলে গেল। আমি, মনা ভাল খাওয়া দাওয়া করতে শ্যামবাজারে চলে গেলাম। মনা আবার পকেটে পয়সা থাকলেই নোংরা জায়গায় যাওয়ার জন্য হটফট করত। সেদিনও যেতে চেয়েছিল। আমি যেতে দিইনি। শুধু ওখানে আমরা হোটেলে খাওয়া দাওয়া সেরে ঠিক রাত বারটায় চন্দনের জন্য কাঁঠালতলার ওর ক্লাব ঘরের সামনে এসে হাজির হলাম। একটু পরেই চন্দন এল, দেখলাম, ওর কাছে একটা চটের থলি। সেটা আমার হাতে দিলে আমি দেখি তাতে একটা কোদাল আর শাবল আছে। ক্লাবঘরের চাবিও সে রেখে দিয়েছিল। ক্লাবঘরটা দরমার, নিচে মাটি। দরজা খুলে চন্দন বলল, এখানে একটা গর্ত কর, স্বপনকে মেরে এখানেই ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যাব, মাটি চাপা দেওয়ার পর ভাল করে বস্তা আর মাদুর দিয়ে ওপরটায় বিছিয়ে দেব, কেউ টের পাবে না। নিচে স্বপন শুয়ে থাকবে, আমরা ওপরে বসে তাস খেলব।
চন্দন মিটিমিটি হাসতে থাকল। চন্দনের কথায় অল্প মোমবাতির আলোয় চন্দনের দেওয়া মাপ অনুযায়ী আমরা গর্ত করতে শুরু করলাম, চওড়ায় ফুট তিনেক হবে, লম্বায় প্রায় পাঁচফুট। গর্ত খুঁড়েই চলেছি। প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে গর্ত খুঁড়ে সাত ফুট মত গভীর হল। গর্ত হওয়ার পর আমি চন্দনকে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু এখন স্বপনকে কোথায় পাবি? চন্দন আমায় বলল, তা নিয়ে তোদের চিন্তার কিছু নেই, আমি এক জায়গায় ওকে রেখে এসেছি, ডাক দিলেই আমার সাথে চলে আসবে। কিন্তু এখন একটা কথা ভাবছি। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কি? সে বলল, কিছুদিনের মধ্যেই ক্লাবঘরটা পাকা করার কথা আছে, তখন যদি ওর লাশটা বেরিয়ে পড়ে, একটা ঝামেলায় জড়িয়ে যেতে হবে। তোরা বরং গর্তটা বুজিয়ে দে, আমি অন্য ব্যবস্থা করছি। আমরা তখন আবার গর্তটা বুজিয়ে দিলাম।
রাত দুটো বেজে গেছে। আমরা আর কোথায় যাই। ওখানেই শুয়ে রইলাম। চন্দন কিন্তু কোদাল আর শাবলটা নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল, আমি ভোরের দিকে আসব, তোরা এখানেই থাকবি। অন্ধকারের মধ্যে চন্দন বেরিয়ে গেল। একদম কাকভোরে চন্দন চাদর মুড়ি দিয়ে ক্লাব ঘরে এল, আমাদের ডেকে তুলে বলল, তোরা এখন বেরিয়ে পড়। বেলঘরিয়ার স্টেশনের কাছে থাকবি, আমি দশটার সময় যাব। আমরা ক্লাবঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। চন্দন ক্লাবঘরের মাটিতে কতগুলো চট আর মাদুর বিছিয়ে রাখল। যাতে ওখানে মাটি যে খোঁড়া হয়েছে, তা চট করে কেউ না বুঝতে পারে। তারপর ক্লাবঘরে তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে চলে গেল।
আমরা তিনজন হাঁটতে শুরু করলাম। কারণ তখনও ভোরের বাস চলা শুরু হয়নি। আমরা হাঁটতে হাঁটতে বেলঘরিয়া পৌঁছে গেলাম। তখন সকাল সবে ছটা সাড়ে ছটা বাজে। বেলঘরিয়ার একটা চায়ের দোকানে বসে আমরা চা বিস্কুট খেলাম, চন্দনের মাথায় কি আছে তখনও আমরা জানি না। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেও তার ঠিকানা পাচ্ছি না। কি করব ভাবছি, কারণ দশটা বাজতে তখনও অনেক বাকি। সমরের এক বন্ধু থাকে বেলঘরিয়ায়, আমাদের নিয়ে সমর ওর বন্ধুর বাড়ি গেল। সেখানে আমরা বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম, খাওয়া দাওয়া করলাম। তারপর সাড়ে নটা নাগাদ আমরা সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে এলাম বেলঘরিয়া স্টেশনে।
সেখানে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম চন্দনের জন্য, সেই আমাদের নেতা, তার নির্দেশমত আমাদের চলতে হবে। দশটা বেজে অল্প কিছুক্ষণ পার হয়েছে, চন্দন বেশ সেজেগুজে স্বপনকে নিয়ে রিকশায় করে এসে আমাদের কাছে নামল। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে আমাদের হাসতে হাসতে বলল, চল দক্ষিণেশ্বরে, মায়ের পুজোটা অনেকদিন দেওয়া হয়নি, পুজোটা দিয়ে আসি। আমরা একটা ট্যাক্সি ধরে দক্ষিণেশ্বরে এসে নামলাম, ট্যাক্সির মধ্যে চন্দনকে খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছিল, স্বপন কিন্তু মুখ গোমড়া করে বসে ছিল, কারণ মিতাকে পুলিশ ওর জন্যই ধরে নিয়ে গেছে, মিতা তো আর কিছু করেনি, মিতার কাছে ওর পরিচয়টা খারাপ হয়ে গেল, তাই সে চুপচাপই ছিল।
দক্ষিণেশ্বরে মায়ের মন্দিরে আমরা পুজো দিলাম, চন্দন সবার কপালে সিঁদুরের টিপ পরিয়ে দিল, লক্ষ্য করলাম, স্বপনের টিপটা বেশ বড় করে পরাল। আমরা মন্দির চত্বর থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। চন্দন একটা বাসে উঠতে বলল, আমরা পাঁচজন তাড়াতাড়ি সেই বাসে উঠে বসলাম।
নামলাম বালি, ওখান থেকে বর্ধমান তারপর বিকেলে দুর্গাপুর। দুর্গাপুর স্টেশনের বাইরে এসে একটা দোকানের বেঞ্চে বসে আমরা চা আর কেক খেলাম। চন্দন স্বপনকে টাকা দিয়ে কিছু জিনিস কিনতে দিল। দুই কাছি নারকেল দড়ি, দুটো গামছা, দুটো ব্লেড, ছ ইঞ্চি চওড়া একটা লিউকোপ্লাস্টের প্যাকেট, দু বোতল নাইট্রিক অ্যাসিড, একটা চটের থলি।
স্বপন টাকা নিয়ে চলে যেতে চন্দন তার পরিকল্পনাটা বলল। আমরা মনোযোগ দিয়ে তার সব নির্দেশ শুনে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম, কখন স্বপন সব জিনিসগুলি কিনে নিয়ে আসে। ইতিমধ্যে আরও দুবার আমাদের চা খাওয়া হয়ে গেছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর স্বপন সিগারেট টানতে টানতে চটের থলিতে ওই সব জিনিস নিয়ে হেলতে দুলতে এসে পৌঁছল। স্বপন চটের থলিটা চন্দনকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এসব দিয়ে কি হবে গুরু? এখানে কি কোনও অপারেশন করবে? চন্দন হেসে বলল, অপারেশন না করলে কি আর এগুলো কিনেছি? চন্দন চটের থলির মুখ খুলে দেখে নিল সব জিনিস ঠিকঠিক এনেছে কিনা।
স্বপন সবই নির্দেশমত এনেছে দেখে চন্দন ওকে বলল, সবই ঠিক এনেছিস দেখছি, এবার চল, সন্ধে হয়ে এসেছে, আর দেরি করা যাবে না। আমরা চন্দনের কথামত একটা অটো রিকশায় উঠলাম। চন্দন স্বপনের হাতে চটের থলিটা ধরিয়ে দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে চলল, এ. ভি. ভি. মোড়ের কাছে আসতে চন্দন অটো রিকশা ছেড়ে দিল।
এ. ভি. ভি. মোড়ের এদিকটা নির্জন, চারদিকে জঙ্গল, ছোট বড় মাঝারি শাল আর কাঁটাগাছে ভর্তি, পাশ দিয়েই চলে গেছে জি. টি. রোড, মোড়ের উল্টো দিকেই বিশাল জঙ্গল, ঝোপঝাড়ে ভর্তি জায়গা, ভবানী পাঠকের জঙ্গল বলে তা পরিচিত।
চন্দন স্বপনের কাছ থেকে ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে নিল। স্বপনকে বলল, শোন স্বপন, তোকে পুলিশ খুঁজছে, তুই ধরা পড়লে আমরাও ধরা পড়ে যাব। তাই আমাদের মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে, তাতে তোরও কিছু হবে না, আমাদেরও কিছু হবে না।
স্বপন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চন্দনের কথা মন দিয়ে শুনছে। চন্দন বলল, আমরা এখানে তোকে হাত পা বেঁধে ফেলে রেখে চলে যাব, এখান দিয়ে অনেক গাড়ি যায়। তুই চিৎকার করে একটা না একটা গাড়ি থামাবি। তখন গাড়ির লোকজনকে বলবি দড়ি খুলে দিতে, আর যখন জিজ্ঞেস করবে কে তোকে ফেলে রেখে দিয়েছে, তুই তাদের বলবি—চিনিস না, বলবি, তোকে বেঁহুশ করে একটা প্রাইভেট গাড়িতে তুলে পকেটের সব টাকাপয়সা, ঘড়ি নিয়ে এখানে ফেলে রেখে চলে গেছে। তারাই তোর একটা ব্যবস্থা করবে, খুব ভয় পেয়েছিস এমন ভাব দেখাবি, যাতে তুই দুর্গাপুরেই থাকতে পারিস। তুই যদি ধরা পড়ে যাস, তখন আমাদের দলটাই ভেঙে যাবে। চট করে তুই মিতার সঙ্গেও দেখা করবি না, মিতাকে ওরা ছেড়ে দেবে ঠিকই। কাগজে পত্রে যা লেখালেখি হচ্ছে তাতে ওকে আটকাতে পারবে না। স্বপন মাথা নাড়ল, জানাল যে সে বুঝেছে।
চন্দন বলল, তার আগে চল, জঙ্গলের একটু ভেতরে গিয়ে একটু মস্তি করি। তোর সঙ্গে তো অনেকদিন দেখা হবে না।
আমরা সবাই আস্তে আস্তে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়লাম। তখন প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। জঙ্গলের ওপর চাপ চাপ কুয়াশা। শীত করছে।
চন্দন হুইস্কির বোতলটা বের করে স্বপনকে দিয়ে বলল, খোল। স্বপন বোতলটা খুলে চন্দনকে দিল। চন্দন বোতলটা ধরে গলায় একটু ঢালল। “র” হুইস্কি খেয়ে মুখটা একটু বিকৃত করে স্বপনকে এগিয়ে দিল। স্বপনও খেল। তারপর আমরাও একটু একটু করে খেলাম। বারবার স্বপনকে দিতে থাকলাম হুইস্কি। খেতে খেতে অন্ধকার হয়ে গেল।
পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যেই বোতল ফাঁকা। স্বপনের পা টলছে, কথা জড়িয়ে গেছে। চন্দন তাকে বসতে বললে সে বসে পড়ল। চন্দন প্রথমেই লিউকোপ্লাস্ট প্যাকেট থেকে বের করে স্বপনের মুখ আটকে দিল যাতে স্বপন আর চিৎকার করতে না পারে। এরপর আমরা নারকেল দড়ি দিয়ে দ্রুত ওর হাত পা বেঁধে ফেললাম। তারপর টানতে টানতে জঙ্গলের আরও ভেতরে নিয়ে গেলাম। কেউ কোথাও নেই। একটা ঝোঁপের আড়ালে স্বপনকে নিয়ে গিয়ে বসান হল।
চন্দন ব্যাগ থেকে নতুন গামছা বার করে স্বপনের গলায় ফাঁস করে লাগিয়ে দিল। আমরা দুজন দুজন করে সেই গামছা দুদিক থেকে টানতে থাকলাম।
স্বপনের চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এল, মুখে লিউকোপ্লাস্ট, কোনও আওয়াজ বেরচ্ছে না। গামছা ধরেই হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে ওকে জঙ্গলের আরও ভিতরে নিয়ে গেলাম।
ওখানে চন্দন নতুন ব্লেড বের করে স্বপনের কণ্ঠনালী কেটে দিল। গামছার ফাঁসে মরেছে না মরেনি, কোনরকম দ্বিধায় সে থাকতে চায় না। তাই ব্লেড দিয়ে গলায় পোঁচ দিয়ে দিয়ে কণ্ঠনালীটা কেটে দিল। রক্তে ভাসতে থাকল স্বপনের মুখ। তারপর অ্যাসিডের বোতল দুটো ব্যাগ থেকে বার করে স্বপনের মুখের ওপর ঢালতে লাগল। স্বপনের মুখ বিকৃত হয়ে গেল, কেউ আর স্বপনকে চিনতে পারবে না।
তারপর ব্যাগের মধ্যে জিনিসগুলো ভর্তি করে জঙ্গলের অন্য দিকে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আমরা একে একে অন্ধকারে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলাম। আমাদের এই অপারেশন কেউ দেখল না। চন্দন তারপর সেই বাড়িতে আমাদের নিয়ে গেল, যেখান থেকে আমরা গ্রেফতার হলাম।
পরদিন মনা আর সমর আসানসোল চলে গেল। আমরাও আর দু চারদিন পর দুর্গাপুর ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতাম, ওখানে আর ভাল লাগছিল না।”
অসিতকে লক আপে পাঠিয়ে দিয়ে এবার চন্দনকে নিয়ে এলাম। চন্দনকে অসিতের স্বীকারোক্তির কথা বলতেই চন্দন চমকে উঠল। চুপ করে অসিতের সব কথা শুনে বলল, “সবই যখন জানেন, আমি আর নতুন কি বলব।”
আমরা বললাম, “বলবি, তোদের কাছে যে রিভলবার, পিস্তলগুলো আছে, কোনখানে রেখেছিস তা বলবি।” চন্দন আমাদের দমদম ক্যান্টনমেন্টের একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে একটা পুকুরের ধারে নিয়ে গেল। পুকুর পাড়ে একটা গাছ দেখিয়ে বলল, “ওই গাছের শিকড়ে একটা দড়ি আছে দেখবেন, সেটা আস্তে আস্তে টান দিলেই একটা পলিথিনের ব্যাগ উঠে আসবে। যা কিছু আছে, ওটার মধ্যেই আছে।”
চন্দনের কথা মত আমাদের একজন সিপাই গাছের কাছে গিয়ে দেখল, সত্যিই একটা দড়ি শিকড়ে বাঁধা আছে। সে তখন দড়ি ধরে আস্তে আস্তে টানতে লাগল। আমরা তাকিয়ে আছি, হ্যাঁ, একটা মোটা পলিথিনের ব্যাগ উঠে এল। সিপাই ব্যাগটা আমাদের কাছে নিয়ে এল, দেখলাম, ব্যাগের ভেতর পলিথিন সিট দিয়ে মোড়া রয়েছে রিভলবার ও পিস্তল। ওইগুলো নিয়ে আমরা ফিরে এলাম লালবাজার।
এবার আমরা দুর্গাপুর যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করলাম। স্বপনকে যেখানে চন্দনরা খুন করেছে, সেই জায়গাটা সরেজমিনে তদন্ত করতে যেতে হবে, আমরা রাজ্য পুলিশের সি. আই. ডি.কে খবর দিলাম। তারপর সি. আই. ডি. ও আমরা যৌথভাবে চন্দন আর অসিতকে নিয়ে রওনা দিলাম পরদিনই ভোরবেলায়।
স্বপনকে যেদিন খুন করা হয়েছিল, তারপর প্রায় মাসখানেক কেটে গেছে। দুপুরবেলা চন্দন আর অসিত সি. আই. ডি. ও আমাদের অফিসারদের নিয়ে গেল খুনের জায়গায়। সেখানে তখন পড়ে ছিল ছোটবড় মিলিয়ে চল্লিশ পঞ্চাশটা হাড়ের টুকরো, অর্থাৎ রাতে জঙ্গলের কোন কোন প্রাণী আর দিনে শকুনে মিলে স্বপনের মাংস মনের সুখে খেয়ে অল্প কিছু হাড় ফেলে রেখে গেছে।
এই বীভৎস হত্যাকাণ্ড চন্দনরা খুবই নিপুণভাবে করেছিল। জন্তু জানোয়ারের পেটে লোপাটও হয়ে গিয়েছিল স্বপনের দেহ। সারাজীবন ধরে মিতা হয়ত ভেবেই যেত স্বপন কোন না কোনদিন ঠিক তার কাছে ফিরে এসে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেবে।
না, কয়েকটা হাড়ের অংশবিশেষ ছাড়া তার দেহের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই এই পৃথিবীর বুকে।
হাড়ের টুকরোগুলো সি. আই. ডি. অফিসাররা যত্ন করে তুলে নিল ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে পাঠানর জন্য। আমরাও চন্দন ও অসিতকে তাঁদের হাতে তুলে দিলাম খুন ও ডাকাতির আসামী হিসাবে।
ডোমজুড় ডাকাতির মামলার তদন্তকারী অফিসার ছিলেন দুলাল সোম। মামলা ভালই করেছিলেন। চন্দনদের সাজাও হয়েছিল। কিন্তু আদালতের সাজাতেই কি আর স্বপন ফিরে আসবে? ফেরে না, ফিরবেও না।
মানুষের লোভ, নিজের সুখের জন্য যে কোন নিকৃষ্টতম কাজ করার প্রবৃত্তি যতক্ষণ না মুছে যাবে, এইসব অপরাধীরা যতদিন সমাজের বুকে থাকবে, সমাজকে দূষিত করবে। ধরা পড়ে গেলে, অল্প সাজা খেটে বেরিয়ে এসে আবার তারা এই সমাজকে দূষিত করার প্রক্রিয়া চালু করবে।