সাদা আমি কালো আমি – ১.১৫

১৫

চারুবাবুকে গ্রেফতারের সময় তাঁর বালিশের তলা থেকে টাকা ছাড়া যে সব চিঠিপত্র আমরা পেয়েছিলাম, তার মধ্যে চীন, ভিয়েতনাম, কানাডা, ইংল্যাণ্ড, আমেরিকা থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির লেখা কয়েকটা চিঠি ছাড়াও আমাদের দেশের কিছু ব্যক্তির লেখা চিঠিও ছিল। সেইসব চিঠি পরীক্ষার জন্য স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসাররা আমাদের থেকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। ওই চিঠির গুচ্ছের মধ্যে একটা চিঠি ছিল কোনও এক নবীনচন্দ্র সেনের। তিনি চারুবাবুকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁদের বাংলা-বিহার-নেপাল আঞ্চলিক কমিটির বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য কলকাতা থেকে কোনও এক দায়িত্বশীল নেতাকে তাঁর কাছে পাঠাতে। আরও জানিয়েছিলেন, তিনি নিজে নেপাল সীমান্তের নকশালদের সেখানে ডেকে এনে আলোচনার ব্যবস্থা করবেন।

চারুবাবুকে গ্রেফতার করে আমাদের দলটা সারা দিন আর রাতের দাপাদাপি ও উত্তেজনার জন্য ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আমি, শচী, সমীর ও সেপাইরা সবাই বিশ্রামের জন্য যে যার বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। বিকেল চারটে নাগাদ কোয়ার্টার থেকে আমাকে ডেকে পাঠালেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার সুনীল চৌধুরী। আমি তাঁর সাথে দেখা করতেই তিনি আমাকে বললেন, “তোমাকে আগামীকালই উত্তরবঙ্গে যেতে হবে।” শরীর জুড়ে অবসাদ, তবু উত্তরবঙ্গ শুনে মনটা আমার নেচে উঠল, কারণ আমি উত্তরবঙ্গের ছেলে, উত্তরবঙ্গ মানেই ঘরের টান। তাই শরীরের অবসাদ ভুলে গেলাম। তার ওপর সাহেবের নির্দেশ। বললাম, “ঠিক আছে।” আমার উত্তর শুনে টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে আমাকে বললেন, “এই চিঠিটা পড়, তাহলেই এবারের মিশনটা বুঝবে।” আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে চোখ বোলাতেই দেখলাম, চারুবাবুকে লেখা নবীনচন্দ্র সেনের সেই চিঠিটা। উনি তারপর আমাকে বললেন, “তোমার সাথে এস. বি. আর আই. বি. থেকে চারজন করে অফিসার যাবে, তুমি আমাদের ডি. ডি. থেকে যাকে যাকে নেওয়ার নিয়ে নেবে।”

পরদিন আমি আমাদের গোয়েন্দা দফতর থেকে কয়েকজন অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে শিয়ালদহ থেকে দার্জিলিং মেল ধরে নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। আমাদের সাথে চলেছেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের চারজন ও রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা দফতরের চারজন অফিসার।

রওনা হওয়ার আগে আমাদের হেফাজতে থাকা ওদের রাজ্য কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে জেনে নিলাম নবীনচন্দ্র সেনের সম্পর্কে। এটা তার আসল নাম নয়, ছদ্মনাম। সে চারু মজুমদার ও আরেক নেতা খোকন মজুমদারের মাঝখানে যোগাযোগের দায়িত্বে আছে। তাছাড়া তার মাধ্যমেই চারুবাবু উত্তরবঙ্গে তাঁর ক্যাডারদের নির্দেশ পাঠাতেন। সে নকশালবাড়ির সেটেলমেন্ট অফিসের কর্মচারী।

দার্জিলিং মেল ছেড়ে দিল। প্রথম শ্রেণীর কামরায় আমরা ছাড়া বাইরের কোনও লোক ছিল না। তাই আমাদের নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। আমি খুব গম্ভীরভাবে সবাইকে বললাম, “আমরা একটা ঐতিহাসিক কাজ করতে যাচ্ছি, সবাই মনে রাখবেন, সুতরাং যে কোনরকম হালকা চালচলন পরিত্যাগ করে চলবেন।” আমার গম্ভীর মুখ দেখে সবাই একে অপরের দিকে দেখতে থাকল। ঠাট্টা-ইয়ার্কি ছেড়ে সবাই নিষ্ঠাবান অফিসার হয়ে গেল। কেউ গম্ভীরমুখে সিগারেট টানছে, কেউ ম্যাগাজিন নিয়ে মনযোগ সহকারে পড়ছে, কেউ জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। যেন সব ফাইন্যাল ইয়ারের ছাত্র, পরীক্ষা দিতে চলেছে। মিনিট দশেক এইভাবে চলার পর আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। আমাকে ওইভাবে হাসতে দেখে সবাই অবাক। “আরে আমরা কি ঐতিহাসিক কাজ করতে যাচ্ছি না? বিখ্যাত কবি নবীনচন্দ্র সেনকে তো ধরতে যাচ্ছি, সেটা কি কম গুরুত্বপূর্ণ?” এবার সবাই আমার কথা বুঝে হাসিতে যোগ দিল। নবীনচন্দ্র সেনের আসল নাম কমলেশ রায়।

আমরা নিউ জলপাইগুড়ি রেলওয়ে স্টেশনে নামলাম। আমরা স্টেশনের বিশ্রামাগারের দুটো ঘর নিলাম। আমরা মোট এগার জন, আর দুটো ঘরে শোওয়ার জন্য মাত্র চারজনের ব্যবস্থা আছে হক, আমরা তো এখানে ঘুমতে আসিনি। কাজের তাগিদে এসেছি। বিশ্রাম তো বহুদিন আগে থেকেই শিকেয় উঠেছে।

সকালে আমি সবাইকে বিশ্রামাগারেই অপেক্ষা করতে বলে অরুণকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। উত্তরবঙ্গের বহু চা বাগানের মালিক আমার পরিচিত, অনেকেই আমার বন্ধু। আমি যখন ফুটবল খেলে বেড়াতাম তখন থেকেই তাঁদের সাথে আমার যোগাযোগ, পরিচয় ও বন্ধুত্ব। আমরা দুজন সেইরকম এক চা বাগানের মালিকের বাড়ি গেলাম। সে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তাকে বললাম দিন কয়েকের জন্য তার গাড়িটা আমাকে দিতে, ড্রাইভার লাগবে না। বন্ধু আমাকে ড্রাইভার ছাড়াই গাড়িটা দিল। আমরা চাই না এখানকার কোনও নিরীহ ড্রাইভার আমাদের সাথে থেকে কোনওরকম বিপদে পড়ুক, আমরা চলে আসার পর নকশালদের প্রতিহিংসার শিকার হোক। অরুণ অসম্ভব ভাল গাড়ি চালাতে পারত, তাই উত্তরবঙ্গের অসমান উঁচু নীচু রাস্তায় গাড়ি চালানর দায়িত্বটা তার হাতে সঁপে দিলাম।

গাড়ি নিয়ে ফিরে এসে আমরা সবাই আলোচনায় বসলাম। ছক করতে লাগলাম কিভাবে সেটেলমেন্ট অফিস থেকে কমলেশ রায়কে গ্রেফতার করা যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি বেরিয়ে গিয়ে এক বন্ধুর সাহায্যে একটা নেপালী যুবক ঠিক করলাম, যাতে নকশালদের বাংলা-বিহার-নেপাল সীমান্ত আঞ্চলিক কমিটির নেপাল সীমান্তের নেপালী ক্যাডার সাজতে পারে। যুবকটিকে ভাল করে তার কাজ বুঝিয়ে দিলাম। কমলেশ রায়ের চিঠিতে একটা জিনিস পরিষ্কার ছিল, কলকাতা ও নেপাল সীমান্ত থেকে যাদের সে ডেকেছে সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য, তাদের কাউকে সে চিনত না। এটাই আমাদের কাজের সুবিধা করে দিল।

ছক কষে আমরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। লক্ষ্য নকশালবাড়ির সেটেলমেন্ট অফিস। যেতে যেতে বেলা গড়িয়ে যেতে লাগল। অবশেষে পৌঁছলাম সেটেলমেন্ট অফিসের কাছে। আমরা পরিকল্পনা মাফিক ওই অফিস থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা নির্জন মত জায়গায় গাড়ি দাঁড় করালাম। তারপর নেপালী যুবক ও আই. বি-র একজন অফিসার কলকাতার নকশাল নেতা সেজে সেটেলমেন্ট অফিসে ঢুকে গেল। আমরা দূরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ওরা অফিসে গিয়ে নবীনচন্দ্র সেন মানে কমলেশ রায় কোন ব্যক্তিটি তা অন্য একজন কর্মচারীর কাছ থেকে জেনে নিল। কমলেশ অফিসের মধ্যেই এক জায়গায় দাঁড়িয়েছিল। আই. বি-র অফিসার তাঁর কাছে গিয়ে নিচু স্বরে বললেন, “কমরেড, শ্রদ্ধেয় নেতাকে যে ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলেন, সে জন্য কলকাতা থেকে আমরা এসেছি, কিন্তু তিনি নিজেই এর মধ্যে গ্রেফতার হয়ে গেলেন।” কমলেশও খাটো পর্দায় প্রশ্ন করল, “খবরটা সঠিক তো? তিনি অ্যারেস্ট হয়েছেন?” আসলে চারুবাবু গ্রেফতার হলেও অনেক নকশাল প্রথম দিকে বিশ্বাসই করেনি যে তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। কারণ তাদের অন্ধ বিশ্বাস ছিল যে তাদের “ভগবানকে” কোনও পুলিশ ধরতেই পারবে না। তাই কমলেশের ওই প্রশ্ন। কমলেশের প্রশ্নের উত্তরে আই. বি. অফিসার ফিসফিস করে বললেন, “হ্যাঁ, খবরটা সত্যি, কিন্তু ধরা পড়ার তিনদিন আগে আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে এখানে এসে আপনার সাথে দেখা করে আপনাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে, তা এখানে তো—” কমলেশ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “না, এখানে কোন কথা নয়, চলুন তাহলে বাইবে যাই, আপনার কাছ থেকে কিছুটা শুনে নিই।” তারা তিনজন অফিস থেকে বেরিয়ে এল, আলোচনা করতে করতে আমাদের গাড়ির কাছে চলে এল। অফিসার কমলেশকে বললেন, “গাড়িতে উঠুন, কোথাও গিয়ে বসা যাক।” তখন গাড়িতে আমাদের মাত্র দুজন ছিল, অন্যেরা একটু দূরে আড়ালে লুকিয়ে আছে। অফিসার কমলেশকে গাড়িতে উঠতে বললে কমলেশ একটু আশ্চর্য হয়ে অফিসারের মুখের দিকে তাকাল। অফিসার হেসে বললেন, “আপনার জন্যই এনেছি।” কমলেশ গাড়িতে উঠল গাড়ি কিছু দূরে যেতেই যারা আড়ালে ছিল তারা বেরিয়ে এল। আমরা গাড়ি নিয়ে সোজা পৌঁছে গেলাম শিলিগুড়ি থানায়।

থানায় এসে আমাদের পরিচয় দিলাম। কমলেশকে যে গ্রেফতার করে এনেছি তাও জানালাম। তখন প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে। শিলিগুড়ি থানার দারোগাবাবু কমলেশকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য একটা আলাদা ঘর দিলেন। কমলেশকে মধ্যবয়স্ক, বুদ্ধিমান, সুতরাং চট করে যে তার কাছ থেকে কোনও খবর আদায় করা যাবে না, তা আমরা জানি। কিন্তু তার সাথে যখন চারুবাবুর ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল, তখন নিশ্চয়ই সে অনেক খবর রাখে। সে নিশ্চয়ই খবর রাখে তখন পর্যন্ত গ্রেফতার এড়িয়ে থাকা নকশাল নেতা খোকন মজুমদারের গতিবিধি ও আস্তানার। কমলেশের কাছ থেকে প্রথমে এই খবরটাই বার করতে হবে বলে ঠিক করলাম। রাত বাড়ছে, আমাদের অফিসাররা দু-তিনজন পালা করে তাকে জেরা করে যাচ্ছে। বাকিরা খাওয়াদাওয়া সেরে নিচ্ছে। কিন্তু আসল কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, আমরাও নাছোড়বান্দা। জিজ্ঞাসাবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ছে একের পর এক। অবশেষে ভোর পাঁচটার সময় সে জানাল, কোথায় আছে খোকন মজুমদার। শিলিগুড়িরই এক বাড়ির ঠিকানা সে আমাদের বলল। আমি ঠিক করলাম, তখনই হানা দিই সেই বাড়িতে। কিন্তু আই. বি. অফিসাররা ও অন্য দুজন বললেন, “না, এখন নয় কারণ ওই বাড়িতে পৌঁছতেই আমাদের ভোর ছ-টা বেজে যাবে, হয়ত ততক্ষণে খোকন ঘুম থেকে উঠে চলে যাবে। অথচ আমরা যে গেছি সেটা সে পথে জেনে যাবে, তখন আর ওই বাড়িতে ফিরে আসবে না।” তাঁরা আমাকে আরও বললেন, “খোকন মজুমদার তো আর জানে না যে আমরা কমলেশকে গ্রেফতার করেছি, সুতরাং সে তার আস্তানা পাল্টাবে না।” আমি ওদের যুক্তি মেনে তখন আর খোকন মজুমদারকে গ্রেফতারের জন্য ওই বাড়িতে হানা দিলাম না। আমরা কমলেশকে শিলিগুড়ি থানার হেফাজতে রেখে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের বিশ্রামাগারে চলে এলাম। সেখানেই আমরা স্নান-টান সেরে স্টেশনের উল্টো দিকের একটা হোটেলে খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

আমরা ঠিক করলাম বিশ্রামাগারে স্নানটান করব, কিন্তু রাত কাটাব না। সেইমত আমি তখনকার শিলিগুড়ির অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট শ্যামল দত্তের সাথে দেখা করে আমাদের সমস্যার কথা বললাম। তিনি তখন আমাদের নিউ জলপাইগুড়ির রেলওয়ে পুলিশ ক্যাম্পের মধ্যে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। অর্থাৎ রাতে ওখানেই সেপাইদের খাটিয়াতে শুতে হবে। হোক, তবু রাতে আমরা সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় বিনা পাহারায় থাকব না, কারণ কমলেশকে ধরে একটা ঘাই তো মেরেছি!

সেদিন রাতে আমরা কমলেশের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী খোকন মজুমদারকে গ্রেফতারের উদ্দেশে সেই বাড়িতে হানা দিলাম। কিন্তু না, পেলাম না, খোকন সে রাতে ওই বাড়িতে আসেনি। বাড়িতে বাসুদেব নামে অন্য একটা নকশাল ছেলেকে পেলাম, তাকে শিলিগুড়ি থানায় নিয়ে এলাম। জেরার মুখে সে জানাল, গতকাল বিকালেই কমলেশের অফিসে খোকনের যাওয়ার কথা ছিল, কমলেশের সাথে আলোচনার জন্য, কিন্তু খোকন সেখানে গিয়েছিল কিনা সেটা বাসুদেব জানে না। আর কমলেশ যে ধরা পড়ে গেছে সেটা বাসুদেবও জানত না। বুঝলাম, খোকন কমলেশের অফিসে গিয়েছিল এবং সেখানে গিয়ে সে শুনেছে যে কমলেশ দুজন লোকের সাথে অফিস থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসেনি। তবে বাসুদেবের কাছ থেকে জানা গেল আগের রাতে খোকন ওই আস্তানাতেই ছিল। সেই কথাটা জানার পর আমার আফশোস হল, ভাবলাম, “ইস, যদি আমি আমার সহকর্মীদের পরামর্শ না শুনে ওই ভোরেই সেই বাড়িতে হানা দিতাম তবে খোকনকে পেয়ে যেতাম।” বাসুদেবের কথার ভিত্তিতে বোঝা গেল, কমলেশ খোকনকে বাঁচাতেই সেদিন যে খোকনের তার সাথে অফিসে দেখা করতে আসার কথা, সেটা আমাদের কাছে গোপন করে গেছে। যাতে খোকন সময় পায়, বোঝে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে এবং যথাসময়ে পালিয়ে যায়। কমলেশ যখন এই চালাকিটা করেছে তখন বুঝতে অসুবিধা হল না, কমলেশকে যত ছোট নেতা ভাবছি, আসলে তা নয়। সে আরও খবর জানে এবং খোকন মজুমদার কোথায় কোথায় যেতে পারে, সেই খবরটাও সে দিতে পারে। আমরা তারপর আলাদা আলাদা ভাবে তাদের দুজনকে জেরা করতে লাগলাম। দুজনের কাছ থেকেই জানতে পারলাম, বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে শিকারপুর এলাকায় রায়গঞ্জ গ্রামে নকশালদের একটা ঘাঁটি আছে।

আমরা শিকারপুর যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু সেখানে যেতে হলে স্থানীয় পুলিশের সাহায্যের দরকার। সেইমত আবার অতিরিক্ত এস. পি. দত্ত সাহেবকে গিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যটা বলতে, তিনি বললেন তিনিও আমাদের সাথে যাবেন। সন্ধেবেলা আমরা শিকারপুরের রায়গঞ্জ গ্রামের উদ্দেশে বাসুদেবকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। ওই গ্রামে যেতে গেলে গাড়ির রাস্তা ছেড়ে গ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রায় পনের কিলোমিটার হেঁটে যেতে হবে। দত্ত সাহেব বিরাট ফোর্স সঙ্গে নিয়ে আমাদের সাথে রওনা দিলেন। আমরা রাত দশটা নাগাদ গাড়ি ছেড়ে হাঁটতে শুরু করলান। প্রায় অর্ধেক রাস্তা হাঁটাব পর দত্ত সাহেব বললেন, “আমি আর হাঁটতে পারছি না, আপনারা এগিয়ে যান, আমি আস্তে আস্তে এখান থেকে ফিরে যাচ্ছি।” আমরা আর কি করি, তাঁকে ছেড়ে দিয়েই অন্ধকারের ভেতর বর্ষার জলীয় হিমেল বাতাস সরিয়ে কাঁচা মাটির রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। উল্টো দিকে দত্ত সাহেব হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।

রাত তখন প্রায় তিনটে, বাসুদেবের নির্দেশে আমরা রায়গঞ্জ গ্রামের সেই বাড়িটার কাছে পৌঁছলাম, যেখানে নকশালরা মাঝেমধ্যেই ঘাঁটি গাড়ে। বাড়িটা একদম বাংলাদেশ সীমান্তের লাগোয়া। বাড়ির উঠোনের প্রান্তেই বাংলাদেশ শুরু, তাই যে কোনও সময় বাংলাদেশে অনায়াসেই ঢুকে পড়া যায়। পালিয়ে যাওয়ার আদর্শ স্থান। আমরা নিঃশব্দে প্রথমে অন্ধকারের মধ্যে বাড়িটা ঘিরে ফেললাম। তারপর বাড়ির সদর দরজায় ঘা দিয়ে বলতে থাকলাম, “দরজা খোল, দরজা খোল।” আচমকা বাড়ির খোলা জানালা দিয়ে ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে এল দশ পনেরটা বল্লম। আমরা এর জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। তবে নকশালরা আমাদের আক্রমণ করতে পারে ভেবে আমরা প্রত্যেকেই আড়াল নিয়েছিলাম, তাই বল্লম কারও গায়ে লাগল না। এরপর আমরা টর্চের আলো ফেলে বাড়ির ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলাম। ওদিক থেকে বল্লম ছোঁড়ার পর আর কোন সাড়াশব্দ নেই। একটু পরে বাড়ির ভেতর থেকে একটা মেয়েলি কান্নার আওয়াজ পেতে বুঝলাম, ভেতরে মহিলা আছে, এবং সে সম্ভবত নকশাল নয়, নকশাল হলে ওইভাবে কেঁদে উঠত না। আমি এবার চিৎকার করে বলতে লাগলাম, “যারা যারা বাড়িতে আছ, বেরিয়ে এস, কোন ভয় নেই।” কিন্তু তাতেও কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

আর অপেক্ষা করা যায় না ভেবে আমরা অসম্ভব দ্রুতগতিতে সদর দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে পড়লাম। না, কোনও নকশাল পেলাম না। বাড়ির বাসিন্দা ছাড়া আর কেউ নেই। গৃহকর্তার কাছে জানলাম, তারা আমাদের ডাকাত ভেবে বল্লম ছুঁড়ে মেরে ছিল। ওখানে প্রচণ্ড ডাকাতের উৎপাত, ডাকাতি করে বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। উনি আরও জানালেন, নকশালরা বেশ কিছুদিন হল আর ওদিকে আসছে না। খোকন মজুমদারের খবরও তিনি দিতে পারলেন না। বুঝলাম, খোকন বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। আসলে খোকন ছিল মুসলিম, হিন্দু নামটা তার ছদ্মনাম। আর এই নামে নিজেকে আড়াল করতে তার সুবিধা হয়েছিল। বাংলাদেশের সাথে তার খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, যখন তখন বাংলাদেশে পালিয়ে যেত। ব্যর্থ হয়ে আমরা রায়গঞ্জ থেকে শিলিগুড়ি ফেরার পথে হাঁটতে শুরু করলাম।

সীমান্ত অঞ্চলের একটার পর একটা গ্রাম পার হয়ে যাচ্ছি। জীবনযাত্রা ওখানে প্রচণ্ড কষ্টসাধ্য। একটা গ্রামে এসে শুনলাম, আগের দিন রাতে একটা লোককে চুরির দায়ে ধরে তাকে সাথে সাথে গ্রামের লোকেরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। যুক্তি হল, সেখান থেকে পনের কুড়ি কিলোমিটার হেঁটে থানায় খবর দেওয়া বিরাট পরিশ্রমের, তাছাড়া থানায় খবর দিলে থানা থেকে তদন্ত করতে আসবে খুব তাড়াতাড়ি হলে পনেরো-কুড়ি দিন পর অথবা কোনদিন নাও আসতে পারে। তাই তাদের কাছে মেরে ফেলাই শ্রেষ্ঠ উপায়, কোন আর ঝুট ঝামেলা রইল না। ওদের যুক্তি শুনে আমরা তো তাজ্জব, আরে এ তো খুন, খুনের দায়ে ধরা পড়ে যাবজ্জীবন জেল খাটতে হতে পারে, ফাঁসি হতে পারে। ওরা নির্বিকার, কারণ ওরা জানে যেমন চুরির খবরও কেউ থানায় দিতে যায় না, খুনের খবরও কেউ থানায় দিতে যাবে না। সুতরাং কিসের মামলা, কিসের সাজা? এত কঠিন, নিষ্ঠুর ওখানকার জীবনযাত্রা!

আমরা ফিরে এলাম নিউ জলপাইগুড়ির রেলওয়ে স্টেশনে। স্টেশনে বাসুদেবকে নিয়ে বসে আছি। আগের দিনই আমরা বিশ্রামাগারের ঘর দুটো ছেড়ে দিয়েছি। শিলিগুড়ি থানার ভেতর সরকারী ভবনে চলে গেছি। কারণ আমরা যে কলকাতা থেকে এখানে এসে কমলেশ, বাসুদেব ও চারুবাবুর “পোস্ট অফিস” সেই দোকানদারকে গ্রেফতার করেছি তা নকশালদের জানা হয়ে গেছে। চারুবাবুর ক্যুরিয়ার যে দোকানদারকে চারুবাবুর চিঠি পৌঁছে দিত, তার থেকে আমরা বিশেষ কিছুই জানতে পারিনি।

বাসুদেবকে নিয়ে স্টেশনের ভেতর একটা বেঞ্চে বসে আছি, হঠাৎ সারা স্টেশন জুড়ে হৈ চৈ। লোকেরা চারদিকে ছুটে পালাচ্ছে। একজনকে ধরে জানতে চাইলাম, ব্যাপার কি? কি হয়েছে? তার কাছ থেকে শুনলাম, নকশালরা বিশ্রামাগার আক্রমণ করে ছিল, দুটো ঘর বোমা মেরে তছনছ করে দিয়েছে। বুঝলাম, আমরা যে ঘর দুটোতে ছিলাম সেখানেই ওরা আক্রমণ করে চলে গেছে অর্থাৎ আমরা যদি ওখানে থাকতাম তাহলে এতক্ষণে বোমার আঘাতে উত্তরবঙ্গ থেকে সোজা চলে যেতাম দক্ষিণ দুয়ারের রঙ্গভূমিতে। এরপর স্টেশনে আর অপেক্ষা না করে সোজা বাসুদেবকে নিয়ে চলে এলাম শিলিগুড়ি থানায়।

পরদিন আমরা উত্তরবঙ্গ সফর গুটিয়ে কমলেশ, বাসুদেব আর দোকানদারকে নিয়ে কলকাতার দিকে পা বাড়িয়ে দিলাম।

কলকাতায় ফিরে এসে দেখলাম, চারুবাবু ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যে তাঁর সাথে দেখা করে গেছেন তৎকালীন পুলিশমন্ত্রী সুব্রত মুখার্জি। দেখা করেছেন তাঁর স্ত্রী, একমাত্র ছেলে অভিজিৎ, ছোট মেয়ে মধুমিতা ও বড়মেয়ে মেডিকেলের ছাত্রী অনীতা।

কিন্তু জীর্ণশীর্ণ চরম অসুস্থ, চূড়ান্তভাবে মানসিক বিপর্যস্ত, হতাশায় নিমগ্ন একটা দুর্বল মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা সত্যিই কঠিন। বাধ্য হয়েই লালবাজারের ডাক্তাররা ওঁকে সাতাশে জুলাই বিকেলে শেঠ সুকলাল কারনারি মেমোরিয়াল হাসপাতালের কারডিওলজি বিভাগে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আঠাশে জুলাই ভোর চারটে পঞ্চান্ন মিনিটে তিনি মারা গেলেন। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসের একটা খণ্ডিত অধ্যায় শেষ হল।

শুধু সেদিন যখন রাত দশটা নাগাদ তাঁর ছেলে মুখাগ্নি করার পর তাঁর দেহ কেওড়াতলার ইলেকট্রিক চুল্লিতে তুলে দেওয়া হল, তখন আমি ভাবলাম, তিনি সত্যিই আমাদের শিক্ষক ছিলেন, হ্যাঁ, অবশ্যই তা নেগেটিভ অর্থে। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেলেন কোন কিছু না বুঝে ছেলেমানুষী খেলায় কিংবা ভুলপথে চালিত হলে পরিণতি কি হয়। এরপর আর কেউ না ভেবে তাঁর খেলায় মাতবে না। এই আশা নিয়ে কেওড়াতলা থেকে লালবাজারে ফিরে এলাম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *