২৪
জানা না থাকলে কি করা যায়? জানতে পারলে তার প্রতিকার করার জন্য এগিয়ে যাওয়া যায়।
তখন নকশাল আন্দোলনের সময়। সে সময় অনেক পেশাদার অপরাধী আমাদের নকশাল আন্দোলনের মোকাবিলায় বেশি ব্যস্ত থাকার সুযোগটা নিয়েছিল। অনেক কুকীর্তি অবাধে বহু দিন ধরে চালিয়ে গেছে তারা।
দমদম এলাকার এক ওয়াগন ব্রেকারের এমন কুকীর্তির কথা আমার এক সোর্সের মাধ্যমে প্রথম জেনেছিলাম।
সে আবার ওয়াগনের মালপত্র অদ্ভুতভাবে পাচার করত। বিশেষভাবে বানানো লোহার এক যন্ত্র দিয়ে মালবোঝাই ওয়াগন তলায় ফুটো করে নিচে রাখা নিজেদের বস্তা ভর্তি করে নিত। ওদের অপারেশনের জায়গা ছিল ঘেঁষের মাঠের পাশে। সেখানে ওয়াগন দাঁড়ালেই রক্ষীরা রাতের অন্ধকারে টর্চ জ্বালিয়ে সিগন্যাল দিত। তখন তারা সেখানে যেত। রক্ষীরাই জানিয়ে দিত কোন ওয়াগনে কি কি মাল আছে। যাতে দামী মাল পাওয়া যায় তাই এই ব্যবস্থা।
আবার রক্ষীদের সহায়তায় ওয়াগনের সিল ভেঙেও জিনিসপত্র সরিয়ে ওরা আবার নতুন করে ওয়াগন সিল করে দিত। এমনভাবে করত যাতে বোঝাই যেত না ওয়াগন ভাঙা হয়েছে। রক্ষীদের সাথে দর কষাকষি করেও ওয়াগনের মাল নিজের ডেরায় তুলে বিক্রি করে সেই টাকার হিস্যা পার্টনারদের দিত।
সেই ছেলেটার বয়স বেশি ছিল না। দেখতে সুন্দর, কিন্তু শেঠবাগান, শেঠ কলোনী, লালগড় অঞ্চলে একচ্ছত্র “দাদা” হয়ে গিয়েছিল। এলাকায় সে “প্রিন্স” নামে খ্যাত ছিল।
তাকে আবার মদত দিত অঞ্চলের এক ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা। আর সে যে অঞ্চলে থাকত, সেখানে ঢোকার মুখেই নকশাল আন্দোলনের মোকাবিলার জন্য একটা সি. আর. পি. ক্যাম্প বসান হয়েছিল। সে সেই ক্যাম্পের সিপাইদের হাত করে নিয়েছিল। তাদের সে প্রতি সন্ধেবেলায় খানাপিনার জন্য ভেট পাঠাত। ফলে তার বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বলা বা প্রতিরোধ গড়ার সাহস দেখাতে পারত না।
এইসব কাজ করতে গেলে স্থানীয় পুলিশকে হাতে রাখতেই হয়। সেই কাজটা সে ভালভাবেই করেছিল। তার বিরুদ্ধে তারা কোন ব্যবস্থাই নিত না।
ওই এলাকা আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে। তবু টিপ্স যখন পাওয়া গেছে তখন সোর্সের মাধ্যমে আস্তে আস্তে তার সব খবর সংগ্রহ করতে লাগলাম।
ইতিমধ্যে সে অনেকগুলো খুন করে ফেলেছে। সে ছিল প্রিন্স। হ্যাঁ, তার আচার আচরণ সামন্তযুগের প্রিন্সদের মতই সে করে তুলেছিল। কোন প্রতিবাদ বা তার কথার অমান্যতা সে সহ্য করতে পারত না। আর তার দরবারে তাকে অমান্য করার একটা অঘোষিত শাস্তি ছিল, তা হচ্ছে—মৃত্যু।
খোকা নামে একটা ছেলে তার দলে ছিল। সে বখরা নিয়ে একদিন প্রতিবাদ করল। তাকে দুপুরবেলা লীলা সিনেমা হলের কাছে তুলে নিয়ে এসে খুন করে ফেলে দিল। কিন্তু প্রিন্সের বিরুদ্ধে কেউ কোন আওয়াজ তুলল না।
রতন নামে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশের এক কনস্টেবল ব্যারাকপুরের লাটবাগানে পুলিশের আর্মারির এক রক্ষী হিসাবে পোস্টেড ছিল। সে সেই প্রিন্সকে বুলেট যোগান দিত।
একবার রতনের সঙ্গে প্রিন্সের টাকাপয়সা নিয়ে গণ্ডগোল বাধল। প্রিন্স রতনকে তার বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে এল। রতন আর কোনদিন বাড়ি ফিরল না। প্রিন্স তাকে তার ঔদ্ধত্যের সাজা দিয়ে ইহলোক থেকে সরিয়ে দিল।
যশোহর রোডের ওপর একদিন ওর দলের লোকেরা একটা লরি লুঠ করল। পাওয়া গেল প্রচুর কম্বল। আর কম্বলের ভেতর থেকে ওদেরই অবাক করে বের হল লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি টাকা।
টাকার বেশিটা নিয়ে নেয় গোবিন্দ আর লক্ষ্মী তালুকদার। সে কথাটা প্রিন্সের দলের এক সদস্য অজিত সাহা বলে দিল তাকে। কদিন পর লক্ষ্মী তালুকদারের লাশ গলাকাটা অবস্থায় পাওয়া গেল দমদমের বাগজলা খালে।
এইভাবে সে চালিয়ে যাচ্ছিল তার সাম্রাজ্য। তার অঞ্চলে সে তার দলবল নিয়ে খোলাখুলি কাঁধে রাইফেল নিয়ে ঘুরে বেড়াত। কে কি বলবে? বললেই তো তাকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হবে।
যখন আমার কাছে গোপনে খবর আসে, তার আগে কতজনকে যে প্রিন্স খুন করেছে তার হিসাব পাওয়া যায়নি।
লীলা সিনেমা হল ছিল তার অফিস ঘর। আর চাষীর মাঠ ছিল তার খেলার মাঠ। পেশার জায়গা হচ্ছে রেল লাইন।
ঠিক করলাম, প্রথমে প্রিন্সকে চিনতে হবে। কি করা যায়? একদিন ম্যাটিনি শোতে আমি ও আমার এক সোর্স দুটো টিকিট কেটে আলাদা আলাদা ভাবে লীলা হলে সিনেমা দেখার ভান করে ঢুকে পড়লাম।
সোর্স আমাকে প্রিন্সের চেহারার বর্ণনা দিয়েই রেখেছিল। আমি হলে ঢুকে এদিক ওদিক এক চক্কর ঘুরে নিলাম। না, তেমন কোনও চেহারা আমার নজরে এল না।
বাধ্য হয়ে হলে ঢুকে সিনেমা দেখতে শুরু করলাম। মিনিট দশেক পর আমার সোর্স ছেলেটা আমার পাশের সিটে এসে বলল, “প্রিন্স নেই।”
হল থেকে আবার আলাদা আলাদা ভাবে বেরিয়ে এলাম দুজনেই। যাতে সোর্স সব সময় সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকে। সোর্স এসে জানাল, প্রিন্স সওদা করতে বড়বাজার গেছে।
বড়বাজার শুনে আমার মনটা নেচে উঠল। বড়বাজারে কার কাছে সে চোরাই মাল বিক্রি করে জানতে হবে। সেখানকার তেমন কতগুলো ক্রেতাকে চিনি।
আমি সেসব জায়গায় খোঁজ করতে শুরু করলাম। না, প্রিন্সের মাল সরাসরি ওরা কেউ কেনে না, “ভায়া” হয়ে আসে। কে সেই “ভায়া”?
কদিন পর খবর পেলাম, ওয়াগন ভাঙতে গিয়ে প্রিন্সের পেটে রেল পুলিশের গুলি লেগেছে। কোথায় আছে কেউ বলতে পারল না।
ভাবলাম, এই সুযোগ, এবার ওকে ধরা যেতে পারে। কিন্তু একদিকে নকশাল আন্দোলনের টানাপোড়েন, অন্যদিকে প্রিন্সের খোঁজ নেওয়া, দুইয়ের মাঝে প্রিন্স যে কোথায় পেট থেকে গুলি বার করতে অপারেশন করাল বা তারপর সে কোথায় গেল কিছুই খবর পেলাম না।
প্রিন্স বেশ কিছুদিন আমার সূত্রের কাছ থেকে হাওয়া হয়ে রইল।
মাসখানেক এভাবে চলে যাওয়ার পর আমার সোর্স এসে খবর দিল, প্রিন্স ভালই আছে। পেট থেকে অপারেশন করে গুলি বার করে নিয়েছে। আর জানাল, কোন রক্ষীর গুলি তার লাগেনি। পিস্তল নিয়ে খেলতে গিয়ে নিজের পিস্তল থেকেই গুলি হঠাৎ বের হয়ে ওর পেটে লাগে। কিন্তু নিজে দলের কাছে হিরো সাজার জন্য রক্ষীদের গুলি লেগেছে বলে প্রচার করে দেয়।
সারাদিন মদ খাওয়ার পরিণতিতেই নেশার ঘোরে. অসাবধানে পিস্তলের ট্রিগারে তার আঙুল পড়ে যায়, আর গুলি বেরিয়ে পেটে ঢোকে।
তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে ওর দলের দেবু ব্যানার্জি ওরফে গোঁসাই দলের নেতা হতে চাইল। সে তার ইচ্ছার কথা শচীন, দিলীপ, অজিত, মাধবকে জানাল।
দেবু সবাইকে বোঝাল, কেন তারা প্রিন্সের সব কিছু মেনে নেবে? তারাও তো ওয়াগনের লুঠের মালের ব্যবসা কেমন করে চালাতে হয় তা সবই জানে। তারাই তো নিজেদের হাতে সব কাজ করে। তারাই ওয়াগনের নিচে ফুটো করে চিনি, চাল, গম ইত্যাদি বস্তা বস্তা ভর্তি করে পিঠে বয়ে নিয়ে আসে। অথচ প্রিন্স পুরো ব্যবসার থেকে বেশি টাকা নিয়ে নেয়। সেই টাকা নিয়ে সে তার খুশিমত যা ইচ্ছা তাই করে বেড়ায়।
মাধব, দিলীপ, গোঁসাই, নরেশরা ওই অঞ্চলের ছেলে ছিল না, তারা বাইরে থেকে আসত। কাজ করত, কাজ শেষে বখরা নিয়ে চলে যেত।
দলের বাচ্চু, তিনা, হারাধন, নিতাইরা ছিল প্রিন্সের এলাকার ছেলে। প্রিন্স ফিরে আসতেই তারা তাকে দেবু ব্যানার্জির কথা জানাল।
ক্ষমতার লোভে দল দুভাগ হয়ে গেল। একদিকে পুরনো প্রিন্স সুধীর, অন্যদিকে নতুন অধিপতি দেবু ব্যানার্জি। দেবু সে অঞ্চলেই থাকতে শুরু করল।
কাজকর্মও দুভাগ হয়ে গেল। তাদের এতদিনের পার্টনার রেলরক্ষীরাও সেইরকম ভাবে কাজ শুরু করল। প্রিন্সের এতে আঁতে ঘা লাগল। এতদিন যে নিয়মে সে দল পরিচালনা করেছে, তাতে সেই ছিল দলের সর্বময় কর্তা। সেই-ই ছিল রাজা, সেই-ই মন্ত্রী, সেই-ই বিচারক, সেই-ই জহ্লাদ। তাতে কিনা তার দলের এক নগণ্য সদস্য ভাগ বসিয়েছে! এতে সে প্রচণ্ড রেগে গেল।
প্রিন্স দেখল, পার্টনারদের সে লুঠের মালের যা দাম বলে আসে, দেবু গিয়ে তার চেয়ে বেশি দাম দিয়ে মাল নিয়ে চলে যায়। দেবুর এই কাজ সে সহ্য করবে কেন?
দেবু রাতে নিজের বাড়িতে থাকত না। সে প্রিন্সকে ভালভাবেই চেনে। প্রিন্সের উত্থান থেকে সে তার সাথে আছে। সুতরাং তার কাজ যে প্রিন্স মেনে নিতে পারবে না তা তার জানা ছিল। তাই সে বাড়ির বাইরে রাত কাটাত।
দেবু শেঠবাগানের পোস্ট অফিসের ছাদে রাতে শুয়ে থাকত। দেবুর রাতের ঠিকানাটা প্রিন্সের কানে পৌঁছতেই প্রিন্স তার শাগরেদ বাচ্চু, তিনা, নিতাই আর পরেশকে নিয়ে একদিন রাতে উঠে পড়ল পোস্ট অফিসের ছাদে। তখন দেবু মদের নেশায় অঘোরে ঘুমচ্ছে। প্রিন্সরা দেবুকে তার বিছানাপত্র, মাদুর সমেত সেখানেই বেঁধে ফেলল। দেবু কোনও বাধাই দিতে পারল না। শীতকালেও মৃত্যুভয়ে সে ছাদে শুয়ে থাকত। কিন্তু তাতেও প্রিন্সের হাত থেকে সে রেহাই পেল না।
দেবু জেগে গিয়ে একবার তার পুরনো দোস্তকে অনুরোধ করল, “প্রিল আমায় ছেড়ে দে, তোর কথামত এবার চলব।”
প্রিন্স দেবুর অনুরোধ শুনে মুখে মারল সজোরে এক লাথি। দেবুর কথা বন্ধ হয়ে গেল। প্রিন্সের সঙ্গীরা একটা গামছা দিয়ে দেবুর মুখ পেঁচিয়ে বেঁধে দিল। প্রিন্সের লাথি খেয়ে দেবুর নাক-মুখ দিয়ে তখন রক্ত বের হচ্ছিল। তা গামছায় লেগে মাখামাখি হয়ে গেল।
প্রিন্সরা দেবুকে ওই অবস্থায় পোস্ট অফিসের ছাদ থেকে নামিয়ে নিয়ে এল। নিয়ে চলল তার খেলার মাঠে। তারপর জায়গা মত নামিয়ে রাখল দেবুকে।
চাষীর মাঠে এসে আগে থেকে রাখা কোদাল, শাবল নিয়ে মাঠের মাঝখানে খুঁড়তে শুরু করল গর্ত। বাচ্চু, তিনা, পরেশরা দ্রুত হাতে নরম মাটি খুঁড়ে সাজিয়ে ফেলল দেবুর কবরস্থান। একটু দূর থেকে দেবু বাঁধা অবস্থায় শুয়ে শুয়ে সবই দেখতে লাগল। কিন্তু তখন তার ছটফট করার অবস্থাও তো নেই। আষ্টেপৃষ্ঠে কাঁথা-মাদুর দিয়ে বাঁধা।
সে কি তখন ভেবেছিল, এমন কবর সেও কতবার প্রিন্সের হয়ে খুঁড়েছে, অন্য অনেক শত্রুদের জন্য। তাদেরও কি তার মত অবস্থা হয়েছিল? তখন তাদের কান্না সে দেখেছিল কি?
চারদিকে কচুগাছের বন। ব্যাঙ আর ঝিঁঝি পোকার ডাক। জোনাকির দেওয়া আলো ছাড়া দেবুর সামনে সব অন্ধকার।
গর্ত খোঁড়া সম্পূর্ণ হলে প্রিন্স ও তার সঙ্গীরা মিলে দেবুকে ওই অবস্থায় নামিয়ে দিল তার জন্য তৈরি কবরে।
জ্যান্ত দেবুর শরীর ধুপ করে একটা আওয়াজ করে পড়ে গেল গর্তে। প্রিন্সরা দ্রুত হাতে মাটি দিয়ে বুজিয়ে দিল গর্ত। নিচে চিরদিনের জন্য শুয়ে পড়ল তার শত্রু দেবু ব্যানার্জি। মাঠের মাঝখানেই একটা মসজিদ আছে। সেই মসজিদ নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
নিশ্চিন্ত প্রিন্স জায়গা মত রেখে দিল কোদাল শাবল। সে তার দলের
অন্য ছেলেদের দেখাল যে, তার দল ভেঙে নতুন দল গড়ার যে স্বপ্ন দেখবে তার পরিণতিও দেবুর মতই হবে। তারও স্থান হবে সজ্ঞানে, কবরে। দেবুকে খুন করে, প্রিন্স রটিয়ে দিল দেবু পালিয়ে গেছে। কেউ কোথাও তাকে পাচ্ছে না।
খবর গেল রেল লাইনে, তার পার্টনারদের কাছে। তারাও দেখল, সত্যিই দেবুর কোনও খোঁজ নেই। লুঠের মালের দাম প্রিন্সই ঠিক করতে লাগল।
দেবু হারিয়ে যাওয়ার দিন দুই পর দেবুর স্ত্রী পদ্মা বাড়িতে আর দেবুর জন্য অপেক্ষা করতে না পেরে প্রিন্সের কাছেই দেবুর খোঁজ করতে গেল।
প্রিন্স দেবুর স্ত্রীকে পেয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠল। তাকে বলল, দেবুকে সে এক জায়গায় পাঠিয়েছে। একটু পরেই আসবে। তাকে লালগড়ের হরি শীলের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলল। সেই বাড়িতে দেবুর স্ত্রীকে একটা ঘরে প্রিন্স আটকে দিল। পাহারাদারীতে বহাল হল ওই বাড়ির লোকেরা।
সেখানে প্রিন্স আর তার শাগরেদ পাঁচ ছ’জন মিলে পদ্মার ওপর শুরু করল পালা করে দৈহিক অত্যাচার, দেবুর কাছে তাকে পাঠিয়ে দেওয়ার মাশুল হিসাবে।
লালগড়ের সেই বাড়ি থেকে পদ্মার কান্না কেউ শুনতে পেলেও প্রিন্সের ওপর কথা বলার সাহস দেখাতে পারল না। এমন কি সেই বাড়ির লোকেরাও ছিল প্রিন্সের পদানত প্ৰজা।
পদ্মার ওপর এইভাবে চলল ক্রমাগত অত্যাচার। পদ্মার শরীর নিংড়ে নিংড়ে তিন চারদিনেই ছিবড়ে বানিয়ে দিল। তার আর তখন নড়বার শক্তি নেই।
প্রিন্সরা বাইরের কাজ শেষ করেই লালগড়ের সেই বাড়িতে এসে প্রচণ্ড মদ্যপান করে ঝাঁপিয়ে পড়ত পদ্মার ওপর। পদ্মার প্রতিরোধের শক্তি কোথায়? সে তখন যেন মরতে পারলেই বাঁচে।
চারদিন পর গভীর অন্ধকার রাতে প্রিন্সরা পদ্মাকে নিয়ে চলল সেই চাষীর মাঠে। যেখানে কদিন আগে রেখে এসেছে তার স্বামীকে। ওরা দেবুর কবরস্থানটাই দ্বিতীয়বার খুঁড়ে ফেলল। পদ্মাকে হাতমুখ বেঁধে বসিয়ে রেখেছে মাঠে। পদ্মা দেখছে ওরা মাটি খুঁড়ছে, কিছু একটা করার জন্য।
একটু পরে তুলে আনল দেবুর পচা গলা লাশ। তারপর সেই লাশের সাথে পদ্মাকে বেঁধে দিল ইলেকট্রিক তার দিয়ে জড়িয়ে। দয়া করে প্রিন্স পদ্মাকে জুড়ে দিল তার স্বামীর সাথে। নামিয়ে দিল কবরে।
দুজনের দেহ নামিয়ে ঝপঝপ করে ফেলতে লাগল আলগা মাটি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ভর্তি হয়ে গেল গর্ত। প্রিন্সের মুখে ফুটে উঠল হাসি। সে মদের বোতল খুলে মদ ঢালতে লাগল গলায়।
এই ঘটনার কিছুদিন পর আলমবাজারের সি.পি.আই (এম) পার্টির এক ছোট নেতা, যে আমাদের এক দক্ষ অফিসার প্রদ্যুৎ দাসের সোর্স ছিল, সে লালবাজারে এসে তাকে প্রিন্সের কথা জানাল।
তার বর্ণনায় আমরা স্তম্ভিত। স্থানীয় পুলিশ যখন গ্রেফতার করে তার তাণ্ডব বন্ধ করছে না, তখন আমরাই এগিয়ে গিয়ে ব্যবস্থা নেব ঠিক করলাম।
আমরা যখন তাকে ধরবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, ওই অঞ্চলে আমাদের জাল বিস্তার করে প্রিন্স কোথায় কখন যায়, তার সঙ্গীরা কে কে ওর সাথে সবসময় থাকে এই সব খবরাখবর নিচ্ছি, ওর গতিবিধিকে আমাদের জালে ফাঁসিয়ে ওকে তুলে নিতে চাইছি, এমন সময় একদিন এলাকার সমস্ত মানুষ ওর ওপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওকে আর ওর দলের ছেলেদের তাড়া করল।
সে তখন লালগড়ে ছিল। ওই হরি শীলের বাড়িতে। ওই রকম মানুষের ঢল দেখে সে পালাল। মানুষের হাতে ধরা পড়ল পরেশ। ক্ষিপ্ত জনতা হরি শীলের বাড়ি তছনছ করে দিল।
এইসব ঘটনা যখন দ্রুতগতিতে ঘটছে, তখন আমাদের কাছে খবর এল। আমরা ছুটলাম।
গিয়ে দেখি জনতা স্থানীয় থানার লোকজনকে তাড়া করছে। তারা এতদিন নিষ্ক্রিয় ছিল, এই তাদের বিরুদ্ধে জনতার অভিযোগ।
আমরা গিয়ে সেটা সামাল দিই। তারপর শুরু করি চাষীর মাঠে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে লাশ খোঁজা।
মাঠ নামে পরিচিত হলেও আসলে সেটা ছিল নিচু জমি। আর তা বড় বড় কচুগাছ আর বিছুটি গাছে ভরা। মাঠের মাঝখানটায় মসজিদের সামনে কিছুটা জমি ফাঁকা। আমরা কচুগাছ টান দিয়ে তুলতেই ঝুরঝুর করে পড়তে লাগল আলগা মাটি।
পরেশের কথা মত শুরু হল অনুসন্ধান। সে দেখাতে লাগল, কোথায় কোথায় প্রিন্স খুন করে পুঁতে দিয়েছে। আমাদের লোকেরা সেই অনুযায়ী গর্ত খুঁড়ে একটার পর একটা কঙ্কাল তুলতে লাগল।
মাঠের চারপাশে তখন মানুষের ভিড়। একটা করে কঙ্কাল উঠলে তারা সেই কঙ্কাল সম্বন্ধে আলোচনা করছে, সেই সব কথা কানে আসছে। কেউ বলছে, এটা অমুকের কঙ্কাল, কেউ বলছে না, তার নয়, সে আরও লম্বা ছিল, এটা তমুকের। কেউ বলছে এটা ওই দুজনের একজনেরও নয়, এটা অমুকের, যাকে বছর দেড়েক ধরে পাওয়া যাচ্ছে না।
সেদিন দু চারটে কঙ্কাল তুলতেই সন্ধে নেমে গেল। আমরা সেই মাঠে পাহারা বসিয়ে চলে এলাম।
প্রিন্সের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া গেল একটা জাপানী হাইড্রোলিক কাঁচি যা দিয়ে হাইভোল্টেজ ইলেকট্রিক তার কাটা যায়।
পরেশের কাছ থেকে জানতে পারলাম, যখন “ওয়াগনের কাজ” তাদের কম হত, তখন তারা রেল লাইনের ওপরের তার ও রাস্তার ইলেকট্রিক তামার তার কাটত, সেগুলো প্রিন্সের নির্দেশে বিক্রি করে এসে “অসময়ের দিনগুলো” চালাত। তাছাড়া তারা অঞ্চলের বিভিন্ন বাড়িতে ডাকাতিও করত।
পরদিন সকালেই আমরা লোকজন নিয়ে চাষীর মাঠে হাজির। কচুগাছ সরিয়ে সরিয়ে পরেশ দেখাতে লাগল কোথায় কোথায় গর্ত করতে হবে। শুরু হল আবার গর্ত খোঁড়া। সি.আই.ডি.র অফিসাররাও হাজির। হাজির আমাদের ফটোগ্রাফাররা।
লম্বায় দশ ফুট, চওড়ায় পাঁচ ফুট আর ছ’ফুট সাত ফুট গভীর গর্ত খুঁড়তে বেশি সময় লাগছে না।
প্রথমেই উঠল একটা পুরুষের কঙ্কাল, বাঁদিকের হাতের হাড়ে তখনও রয়েছে শিখ পুরুষের মত পেতলের বালা।
ফটোগ্রাফাররা ফটাফট ফটো তুলে রাখল। পরেশ একটা নাম বলল, তাতে জানা গেল যার কঙ্কাল, সেও ছিল পুরনো এক ওয়াগন ব্রেকার প্রিন্সের সাথে ঝগড়ার পরিণতিতে মাটির তলায় শুয়ে পড়েছে চাষীর মাঠে।
সকাল থেকেই হাজার হাজার কৌতূহলী মানুষের ঢল নেমেছে চাষীর মাঠে, সবাই প্রিন্স আর তার সঙ্গীসাথীদের কীর্তি দেখতে এসেছে। স্থানীয় থানার সিপাইরা ঘিরে রেখেছে মাঠ। যাতে মানুষজন সামনে এসে আমাদের কাজের ব্যাঘাত না ঘটায়।
একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলাম, কয়েকজন ফেরিওয়ালা, চায়ের দোকানদার ভিড় দেখে অস্থায়ী দোকান বসিয়ে দিয়েছে, দর্শকরাও তাদের থেকে কিনে এটা ওটা খাচ্ছে আর ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন মেলা বসেছে। একটা করে কঙ্কাল উঠছে আর সবাই হৈ হৈ করে উঠছে।
মানুষের চরিত্র বোঝা দায়, আগের দিন যারা সাহস নিয়ে ক্ষোভে ফেটে প্রিন্সকে আক্রমণ করতে গিয়েছিল, তারাই পরদিন মজা দেখতে ভিড় জমিয়েছে।
পরেশের নির্দেশ মত এবার যে গর্তটা খোঁড়া হচ্ছিল, তার চার-পাঁচ ফুট তলাতেই কোদাল আটকে গেল একটা গাঢ় নীল রঙের কার্ডিগানে। কোদাল সরিয়ে রেখে আস্তে আস্তে ছোট শাবল দিয়ে সরান হল মাটি।
পদ্মা। গর্ত আরও চওড়া করতে হল। ইলেকট্রিক তার দিয়ে বাঁধা রয়েছে নিচে আরও একটা লাশের সাথে।
পরেশ জানাল, ওই পচা গলা দেহটা হচ্ছে দেবু ব্যানার্জির। দুটো লাশ একসঙ্গে তুলতেই দুর্গন্ধে মাঠের পরিবেশ অসহ্য হয়ে উঠল।
ফটো তুলেই লাশ দুটো পাঠিয়ে দেওয়া হল থানায়, সেখান থেকে যাবে পোস্ট মর্টেমে।
পদ্মা আর দেবু ব্যানার্জির জোড়া লাশ দেখে জনতা আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। দেবুর ডান হাতের মধ্যমায় একটা আংটি ছিল। তাতে খোদাই করা ছিল ইংরেজিতে “ডি”। তা দেখে চিহ্নিত করা হল ওই পচা লাশটা দেবুর। জনতা প্রিন্সকে না পেয়ে পরেশের দিকেই ধেয়ে আসতে চাইল প্রতিশোধের ইচ্ছায়।
অবস্থা আয়ত্তে আনতে আমাদের হিমসিম খেতে হল। পরেশ ভয়ে কুঁকড়ে আছে আর বলে যাচ্ছে, “আমি মারিনি, আমি মারিনি।”
পদ্মার বাঁ হাতের অনামিকায় রয়েছে দেখলাম একটা মুক্তার আংটি। হাতে শাঁখা আর পলা। স্বামীর সঙ্গে ঠিক সহমরণে নয়, সহকবরে সজ্ঞানে স্থান হয়েছে তার চাষীর মাঠের কচুবনে। স্বামীর কাছে যাওয়ার পথটা তার মসৃণ তো হয়ই নি, বরং সে প্রিন্স ও তার শাগরেদদের হাতে চারদিন ধরে ধর্ষিতা, লাঞ্ছিতা, চরম অপমানিতা হয়ে বীভৎস ভাবে স্বামীর কাছে এসে পৌঁছেছে। লালগড়ের যে বাড়িতে তাকে প্রিন্সরা নরক যন্ত্রণা দিয়েছিল, সেই বাড়ি জনতার রোষে আগেই তছনছ হয়ে গেছে।
প্রিন্সের টাকার লোভের সাথে আমাদেরই একাংশের লোভ যোগ হয়ে ছিল বলে এ রকম ঘটনা দিনের পর দিন সম্ভব হয়েছে। তাই জনতার রাগ তাদেরও ওপর আছড়ে পড়ছে।
হ্যাঁ, আমাদের পুলিশের মধ্যেও এই লোভের শিকার অনেকেই হয়।
স্থানীয় থানার কেউ কেউ এই অতিরিক্ত লোভের শিকার হয়ে পড়েছিল বলেই প্রিন্সের রাজত্ব রমরম করে চলেছিল। তাই যখন এক একটা করে কঙ্কাল ও পচাগলা লাশ উঠছে, তখন জনতার রাগ গিয়ে পড়ছে প্রিন্সের ওপর ছাড়াও স্থানীয় থানার লোকের ওপর।
প্রতি কবরের ওপর প্রিন্স লাগিয়ে দিয়েছিল কচু গাছ। সেই গাছ পরিষ্কার করে গর্ত করে করে মোট আটটা মানুষের কঙ্কাল ও লাশ উঠল।
তিনদিন ধরে আমরা চাষীর মাঠ চষে ফিরে এলাম লালবাজার। সি.আই.ডি.-র অফিসাররা ফিরে গেলেন তাঁদের দফতরে। কঙ্কালগুলো পরীক্ষার জন্য চলে গেল ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে।
প্রিন্সকে ধরতেই হবে। তখন আমাদের দফতরে অন্য কাজ কমিয়ে এটাই শীর্ষে চলে এল। সি.আই.ডি. অফিসাররাও খোঁজ খবর শুরু করেছেন, কোথায় প্রিন্স?
কলকাতা, উত্তর-দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলির সব সোর্সকে প্রিন্সের বর্ণনা জানিয়ে দেওয়া হল। প্রিন্সের খোঁজের জন্য তারাও নেমে পড়ল কাজে।
প্রিন্স যেদিন পালাল, তার তিনদিন পর খোঁজ পেলাম, তার দলের গোলগাল, অল্পবয়সী হারাধন আমহার্স্ট স্ট্রিট অঞ্চলে ঘোরাফেরা করছে। নজর রাখতে শুরু করলাম। কোথায় থাকে সে? তবে কি প্রিন্সও আছে তার সাথে? যে খবর দিল, তার সাথে আমি আমাদের দুজন নজরদারও লাগালাম। হারাধনের সমস্ত গতিবিধির খবর রাখতে যাতে সুবিধা হয়।
সারাদিন ওরা ওই অঞ্চল চষে ফেলল, কিন্তু পেল না। কোথায় সে সারাদিন?
নজরদার পরদিন সকালে দেখতে পেল তাকে। খবর দিল কোথায় আছে, আমরা তাকে সকাল এগারটা নাগাদ মারোয়াড়ি হাসপাতালের উল্টোদিকে এক বাড়ির পাশের রকে আড্ডা মারার সময় ধরে নিয়ে এলাম। তাকে আর সুযোগ দিলাম না পালিয়ে বেড়াবার। একসঙ্গে প্রিন্সকে ধরবার ইচ্ছায় সেও যদি হাত ছাড়া হয়ে যায়, তখন আমাদের হাত কামড়াতে হবে। তাই প্রথম সুযোগেই গ্রেফতার করলাম। তার থেকে আমরা প্রিন্সের কার্যকলাপের আরও খবর পেলাম।
কিন্তু প্রিন্স কোথায়, সেই খবর সে দিতে পারল না। আমরাও খাওয়া-ঘুম বন্ধ করে হন্যে হয়ে তার খোঁজ করতে লাগলাম।
হারাধনকে নিয়ে প্রিন্সের খোঁজ চারদিকে শুরু করলাম। সে যে সব জায়গায় গোপন আস্তানা নিত, হারাধন আমাদের সেই সব জায়গা দেখাল। গেলাম উত্তর চব্বিশ পরগনার বহু জায়গায়, ডানলপ থেকে বনগাঁ পর্যন্ত। হাওড়ার বিভিন্ন স্থানে, কোন্নগর, রিষড়া প্রভৃতি শিল্পাঞ্চলেও হানা দিলাম।
কলকাতারও অনেক ডেরায় হারাধন নিয়ে গেল, প্রিন্সের পরিচিত রেড লাইট এলাকায়, মদের ঠেকে, যেখানে নিয়মিত তার যাতায়াত ছিল। কিন্তু. কোথাও তাকে পেলাম না। ব্যর্থ হলাম। যদিও সব জায়গায় নজরদার রেখে দিলাম, যাতে ওকে দেখতে পেলেই আমরা খবর পাই।
তখন আলিপুর কোর্টে অনন্তবাবুদের চতুর্থ ট্রাইব্যুনাল মামলা চলছিল। কোর্টে ছিলেন তপেনদা, মনাদা ও রাজকুমার। রাজকুমার হঠাৎ দেখল, কোর্টঘর থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তায় মনাদা একটা লোকের সাথে ফুসফুস করে কথা বলছেন।
মিনিট দশেক ওই ভাবে কথা বলার পর লোকটা চলে গেল। রাজকুমার মনাদার সামনে এগিয়ে যেতেই মনাদা বললেন, “কিছু বুঝলা?” রাজকুমার নিচু স্বরে চটপট উত্তর দিল, “বুঝেছি, ওই খুনীটার খোঁজ পেয়েছেন তো?” মনাদা একটা সিগারেট ধরিয়ে রাজকুমারকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “কি কইরা বুঝলা?” রাজকুমার বলল, “আপনার মুখের খুশি খুশি ভাব দেখে স্যার।”
মনাদা সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, “হ, তুমি ঠিকই ধরছো। তা যাইবা না কি তারে ধরতে, প্লেনে কইরা যাইতে হইবো।” অন্য লোক আসছে দেখে রাজকুমার কথা থামিয়ে দিল।
সেদিন কোর্ট শেষ হওয়ার পর তারা লালবাজারে ফিরে এলে মনাদার কাছে জানা গেল, প্রিন্স আছে গুয়াহাটিতে। ঠিক হল গুয়াহাটিতে প্রিন্সকে ধরতে যাবে অফিসার দীপক রায় ও সুকমল।
পরদিন ভোরের বিমান ধরে ওরা যখন গুয়াহাটি বিমানবন্দবে পৌঁছল, তখন প্রায় দশটা বাজে। দুজনে ছুটল যে কোন একটা হোটেলের খোঁজে। হোটেলে কোনমতে জিনিসপত্র রেখে দুজনে বেরিয়ে গেল দুদিকে।
মনাদার কাছে খবর এসেছিল, প্রিন্স প্রতিদিন শহরের একটা জায়গায় এক বিশেষ চায়ের দোকানে সকাল এগারটা নাগাদ চা খেতে আসে। হোটেল থেকে যখন তারা বের হচ্ছে তখনই এগারটা বাজে, তবু তারা চায়ের দোকানটা আর খবরের সত্যাসত্য যাচাই করতে বেরিয়ে পড়ল।
সুকমল যখন নির্দিষ্ট চায়ের দোকানের সামনে গেল, দেখল, দীপক দোকানের ভেতর একটা টেবিলে বসে চা খাচ্ছে। সুকমলও অন্য একটা টেবিলে বসে চায়ের অর্ডার দিল। তখন প্রায় বারটা বাজে। দীপক দাম মিটিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। একটু পর সুকমলও। প্রিন্স সেখানে এলেও সম্ভবত আগেই চলে গেছে।
দোকান থেকে বেশ খানিকটা দূরে তারা দুজনে এক জায়গায় রাস্তার ওপরেই মিলল। ঠিক করল, যে বাড়িতে প্রিন্স আত্মগোপন করেছে বলে মনাদা বলে দিয়েছে, সেখানে সেদিন রাতেই তারা স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় হানা দেবে।
সেই অনুযায়ী তারা স্থানীয় থানায় গিয়ে নিজেদের পরিচয় দিয়ে দারোগাবাবুকে বলল, তারা কলকাতা থেকে পালিয়ে আসা এক নকশাল নেতাকে ধরতে এসেছে। প্রিন্সকে থানায় নকশাল নেতা বানানোটা একটা কৌশল। প্রথমত, স্থানীয় পুলিশ তাহলে বিশেষ গুরুত্ব দেবে। দ্বিতীয়ত, খুনীর কাছে যদি কোনরকমে কলকাতা পুলিশের গুয়াহাটিতে পৌঁছনর খবরও যায়, তবু সে জানবে, তাকে নয়, তারা এসেছে নকশাল ধরতে। সে নিশ্চিন্ত মনে নিজের আস্তানাতেই থাকবে।
ঠিক হল, দীপক আর সুকমল রাত বারটায় থানায় যাবে, সেখান থেকে ফোর্স নিয়ে সেই বাড়িতে হানা দেবে, যেখানে প্রিন্স আছে। তারা কিন্তু থানায় সেই বাড়ির ঠিকানা জানাল না।
থানা থেকে বেরিয়ে তারা রিকসা করে গুয়াহাটি শহর কিছুটা ঘুরে হোটেলে ফিরে এল। অপেক্ষা করতে লাগল রাত বারটার। সময় হলে তারা হোটেল থেকে বেরিয়ে ঠিক বারটায় থানায় এসে দেখল বিশাল বাহিনী নিয়ে অফিসাররা “নকশাল নেতা” ধরতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ওদের যুদ্ধের মত সাজগোজ দেখে দীপকদের হাসি পেল।
রাত ঠিক সাড়ে বারটায় বেশ কয়েকটা জিপ আর ভ্যান ছুটল প্রিন্সকে ধরতে। দীপক স্থানীয় পুলিশের এক অফিসারকে তখন জানাল ঠিকানাটা। সেই অফিসারের নির্দেশে গাড়িগুলো চলতে লাগল। মিনিট কুড়ি-পঁচিশের মধ্যে পৌঁছে গেল তারা নির্দিষ্ট বাড়ির কাছে। অফিসারের নির্দেশে বাহিনীর সিপাইরা দ্রুত ঘিরে ফেলল বাড়িটা। সবাই রাইফেল উঁচিয়ে তাক করে রইল।
দীপক আর সুকমল অন্য অফিসারদের নিয়ে বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাড়ল। এক ভদ্রলোক একটু পরে দরজা খুলে দিতেই দীপকরা লাফ মেরে ঢুকে গেল বাড়ির ভেতর। বাড়ির কর্তার সঙ্গে স্থানীয় অফিসাররা অসমিয়া ভাষায় কি কথাবার্তা বলছে, দীপকরা সেদিকে পাত্তা না দিয়েই এঘর, সেখর তল্লাশি করে চলল। একটা ঘরে পেয়ে গেল প্রিন্সকে।
প্রিন্সের চেহারার বর্ণনা তারা জানতই, তবু নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য দীপক একটানে তার গেঞ্জিটা তুলে দেখে নিল পেটের অপারেশনের দাগটা। দীপক প্রিন্সকে বলল, “সুধীর, তোকে জন্ম দিয়েছিল কে রে?” প্রিন্স উত্তরে বলল, “আমার নাম সুধীর নয়।” সুকমল ওর ডান হাতটা ধরে এক হ্যাঁচকা টান মেরে বলল, “তোর নাম, তোর বাপের নাম সব লালবাজারে
গিয়ে জানতে পারবি, এখন চল। নিজে নিজেই তো নিজের নাম রেখেছিলি প্রিন্স, সেই প্রিন্সের মুকুটটা এবার তোর হাতে ধরিয়ে দেব।”
তারা প্রিন্সকে নিয়ে ফিরে এল থানায়। তাকে হাজতে পুরে দেওয়া হল। থানার অফিসাররা বিশাল বাহিনী দিয়ে পুরো এলাকাটা ঘিরে রাখল, যাতে আসামী না পালিয়ে যেতে পারে। আসলে তারা তো জানে যে যাকে তারা গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছে, সে কলকাতার একটা নকশাল নেতা। আর নকশাল মানে তাদের কাছে বিরাট আতঙ্কের ব্যাপার, তাই এত সাবধানতা। ব্যবস্থা দেখে দীপক আর সুকমল হোটেলে ফিরে এল। হোটেলে ফিরে তারা লালবাজারে টেলিফোনে জানিয়ে দিল, মনাদার খবরটা একেবারে পাক্কা, প্রিন্স এখন হাজতে।
পরদিন অসমের সব পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হল, “কলকাতার এক নকশাল নেতা কলকাতার পুলিশের হাতে গুয়াহাটিতে গ্রেফতার।” তা দেখে দীপকদের আর এক চোট হাসি। কোর্টে গিয়ে দীপকরা প্রিন্সকে শিয়ালদহ কোর্টে হাজির করার নির্দেশ পেয়ে গেল। কিন্তু তারা আর প্রিন্সকে কলকাতায় নিয়ে এল না। তারা তাকে গুয়াহাটির জেলে রেখে চলে গেল শিলং বেড়াতে।
দিন দুই পর এখান থেকে আমাদের অন্য দুই অফিসার প্রিন্সকে আনতে গেলেন গুয়াহাটি। সেখানে আমাদের অফিসারদের কাছে নিজের সব অপরাধ স্বীকার করে একটা অনুরোধ করল সে, “যার কাছেই নিয়ে যান না কেন, প্লেন থেকেও ফেলে দিন, তবু আমায় আপনারা রুণুবাবুর কাছে হাজির করাবেন না।”
তারা জবাবে বলল, “তুই কি ভেবেছিস, আমরা তোকে জামাই আদরে রাখব?”
সুধীর চুপ করে রইল। সেদিনই প্লেনে করে প্রিন্সকে তারা নিয়ে এল লালবাজার। লালবাজারে ওকে যখন জেরা করা হচ্ছে, আমি তখন তার কৃতকর্মের ফটোগুলো একটার পর একটা দেখাতে লাগলাম। যে ফটোগুলো আমরা চাষীর মাঠে তুলেছিলাম।
দেখতে দেখতে একসময় সে চিৎকার করে বলে উঠল, “দেখাবেন না, দেখাবেন না, আমি আর দেখতে পারছি না।” বললাম, “মানুষকে খুন করে পুঁতে ফেলার সময় মনে ছিল না, এখন নিজের কীর্তি দেখতেই ভয় পাচ্ছিস!” ফটো দেখতে দেখতেই সে সব স্বীকার করল। জানাল কোথায় আছে তার রাইফেলগুলো।
পরদিন প্রদ্যুৎদা আমাদের বাহিনী নিয়ে গিয়ে শেঠবাগানের এক পাতকুয়ার নিচ থেকে তুলে নিয়ে এলেন চারটে রাইফেল।
আমরা প্রিন্সকে রাজ্য পুলিশের হাতে তুলে দিলাম, তার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য। রাজ্য পুলিশের তরফে সি. আই. ডি.-র এক অফিসার মামলা পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু মামলায় প্রিন্সের সাজা হল না, সে জেল থেকে বেরিয়ে গেল।
জেল থেকে বেরিয়ে সে দমদমে ফিরে গেল না। চলে গেল হিন্দ মটরে। দমদম সেন্ট্রাল জেলে থাকার সময়ই জেলের ভেতর তার দোস্তি হয় আলমবাজারের মাস্তান হীরার সাথে। সেই দোস্তির সূত্র ধরে বামফ্রন্টের এক প্রাক্তন মন্ত্রীর সহায়তায় সে পেয়ে গেল হিন্দ মটর কারখানা থেকে অ্যাম্বাসাডর গাড়ি বিভিন্ন প্রদেশে পৌঁছে দেওয়ার কাজ।
সে পনের-কুড়িটা গাড়ির ফ্লিটের নেতা হয়ে বিভিন্ন প্রদেশে পৌঁছনর কাজ করতে লাগল। আবার হিন্দ মটরে সেই প্রাক্তন মন্ত্রীর দলের হয়ে ইউনিয়নের নেতা বনে গেল। সেখানে অন্যান্য পার্টির ইউনিয়নও ছিল এবং তাদের মধ্যে ছিল প্রচণ্ড রেষারেষি।
একবার সে তার গাড়ির ফ্লিট নিয়ে চলল হায়দারাবাদ। তার আগেই একই জায়গায় অন্য একটা ফ্লিট নিয়ে অনেকটা আগে আগে যাচ্ছিল কংগ্রেস ইউনিয়নের নেতা রঞ্জিত সিং।
অন্ধ্র প্রদেশ এলাকায় প্রিন্স গাড়ি নিয়ে যেতে যেতে দেখল, রাস্তায় একটা ধাবার ধারে রঞ্জিত সিং গাড়ি লাগিয়ে, জানালার কাঁচ তুলে দিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে ঘুমচ্ছে। রঞ্জিতের সাথে তার ইউনিয়নগত বিরোধ ছিল। সে দেখল, এই সুযোগ, রঞ্জিত সিংকে সরিয়ে ফেলার।
সাথে সাথে সে তার গাড়ি থামাল। সঙ্গী বন্ধু আলমবাজারের ইজাহারকে নিয়ে এগিয়ে গেল রঞ্জিত সিংয়ের গাড়ির দিকে। প্রিন্স হাতুড়ির এক আঘাতে গাড়ির জানালার কাঁচ ভেঙে ফেলল। ইজাহার হাত ঢুকিয়ে খুলে দিল দরজার লক। প্রিন্স একটা বড় স্ক্রু ড্রাইভার ঢুকিয়ে দিল রঞ্জিতের পেটে। জানালা ভাঙার সাথে সাথে রঞ্জিত জেগে উঠলেও প্রিন্সদের প্রতিরোধ করার কোনও সুযোগ পায়নি।
পেটে স্ক্রু ড্রাইভার ঢুকিয়ে দিতে রঞ্জিত চিৎকার করে উঠল। প্রিন্স পেট থেকে সেটা বের করে ঢুকিয়ে দিল গলায়। গল গল করে পড়তে লাগল রক্ত। নতুন গাড়ির সিট রঞ্জিতের রক্তে ভেসে যেতে লাগল। রঞ্জিত পড়ে যেতে চাইল, প্রিন্স মাথার চুল ধরে তাকে বসিয়ে স্ক্রু ড্রাইভারটা এবার ঢুকিয়ে দিল চোখে। রঞ্জিতের চিৎকার করারও ক্ষমতা নেই। প্রিন্স দ্বিতীয় চোখটাও স্ক্রু ড্রাইভারের খোঁচায় বের করে আনল বাইরে। আবার সেটা ঢুকিয়ে দিল গলায়। প্রিন্স তার গলা থেকে স্ক্রু ড্রাইভার বের করে ঢুকিয়ে দিল বুকে। রঞ্জিত এবার শুয়ে পড়েছে। প্রিন্স তবু স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে ক্রমাগত খুঁচিয়েই যেতে লাগল পেটে। পেট থেকে বের করে নিল নাড়িভুঁড়ি। সেখানেই মারা গেল রঞ্জিত।
পেশাদার খুনী প্রিন্স রাজনৈতিক দাদাদের উস্কানিতে হিন্দ মটরে নিজের প্রভাব বাড়ানব জন্য, বিরোধী নেতাকে সরিয়ে ফেলার প্রবল বাসনায় রঞ্জিতকে পেয়ে তার কদর্য জান্তব রূপটা বের করে ফেলল। মদ তো সে খেয়েই থাকে। মদের সাথে বক্তের গন্ধ পেলে সে যেন হয়ে উঠত হিংস্র ক্ষুধার্ত হায়না। আব বহুদিন সে ছিল নির্জলা, রক্তহীন, শুকনো। বঞ্জিতের রক্ত পেয়ে নেচে উঠল তার মন। ক্ষুধার্ত প্রিন্স ক্ষুধা মিটিয়ে উঠে দাঁড়াল।
রঞ্জিতকে খুন করে প্রিন্স আর ইজাহার তাদের হাতে লাগা রক্ত ধুয়ে পুঁছে এগিয়ে গেল গাড়ি নিয়ে। যেন কিছুই হয়নি।
এ জ্যাকেল ক্যান চেঞ্জ হিজ কালার, বাট ক্যান নট চেঞ্জ হিস নেচার। ধূর্ত শেয়ালরা চালচলন বদলালেও অভ্যাস বদলাতে পারে না। যেখানেই সুযোগ আসে সেখানেই বেরিয়ে পড়ে তার স্বরূপ।
প্রিন্স খুন করে কবে ম্যানিয়াক হয়ে গিয়েছিল। তার ওপর কুকর্মের জন্য শাস্তি না হওয়াতে খুনের অভ্যাসটাও বদলাতে পারে নি 1
আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত এ-জাতীয় রোগগ্রস্ত খুনী দেখা গেছে, তার চেয়ে প্রিন্সেব রোগ কোন অংশে কম ছিল না। হিচকক যদি জানতে পারতেন প্রিন্সের সম্পূর্ণ কাহিনীটা, তবে হয়ত তিনি তা নিয়ে একটা থ্রিলারই বানিয়ে ফেলতেন, যা দুনিয়াতে আলোড়ন সৃষ্টি করত। নৃশংসতার সেই রূপ দেখে মানুষ কেঁপে উঠত।
লালবাজারে আমার কাছে তার কৃতকর্মের ফটোগুলো দেখতে দেখতে যখন চিৎকার করে উঠেছিল, “দেখাবেন না, দেখাবেন না,” তখন সে কিন্তু তার মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য চিৎকার করেনি, চিৎকার করেছিল ভয়ে। পেশাদার অপরাধীরাও তার আগের কাজের ফলের বিকৃত রূপটা পেছন ফিরে দেখতে চায় না। ভয় পায়, ভাবে এই রূপগুলো দেখলে যদি তার মানসিক পরিবর্তন হয়, তবে সে আর পারবে না অপরাধ করতে।
রঞ্জিতকে খুন করে কিন্তু প্রিন্স বাঁচল না। ধরা পড়ল। তারপর আমরা যা পারিনি, সেটাই করে দেখাল অন্ধ্র প্রদেশের পুলিশ। সেই খুনের মামলায় তার ও ইজাহারের যাবজ্জীবন জেল হয়ে গেল। কম হলেও সাজা প্রিন্স।
যেদিন খবর পেলাম প্রিন্সের সাজা হয়েছে, মনটা খুশিতে ভরে গেল। সেই মন নিয়ে রাতে ফিরে গেলাম লালবাজারে আমার কোয়ার্টারে।
কোয়ার্টারে ঢুকেই শুনছি টেলিফোন বাজছে। তাড়াতাড়ি সেটা তুলে কানে লাগালাম। ওপারে ডি. সি. ডি. ডি. দেবী রায়। বললাম, “স্যার।” তাঁর কথা শোনামাত্রই আমি বললাম, “আমি এক্ষুনি যাচ্ছি, আপনাকে কাল সকালেই রিপোর্ট দেব।” ফোন নামিয়ে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে “গুড নাইট” জানিয়ে বেরিয়ে এলাম কোয়ার্টার থেকে কলকাতার রাস্তায়, তখন রাত প্রায় বারটা!
১ম খণ্ড সমাপ্ত