সাদা আমি কালো আমি – ১.১২

১২

শুধুমাত্র সত্তর সালে এই কলকাতা শহরেই নকশালদের হাতে সতের জন পুলিশ খুন হয়ে গেল। ফলে নিচুতলার পুলিশকর্মীদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক ছড়িয়ে গিয়েছিল। সন্ধে হতেই কলকাতার রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের ডিউটি বন্ধ হয়ে গেল। চূড়ান্ত অরাজকতা একাত্তরের আগেই পশ্চিমবঙ্গকে গ্রাস করেছিল। যে সব লুম্পেনরা নকশালদের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল তারা সাধারণ নাগরিকদের ভয় দেখিয়ে যখন তখন চাঁদা তুলতে লাগল। মানুষ ভয়ে কোনও প্রতিবাদ করতে পারত না। প্রতিবাদ করলেই যদি চারুবাবুর “শ্রেণীশত্রু”র তালিকায় নাম উঠে যায়! আতঙ্কে, অত্যাচারে বহু লোক বাড়ি-সম্পত্তি ছেড়ে পালাতে লাগল। আর সেইসব অঞ্চলে গুণ্ডারা খেয়ালখুশি মত রাজত্ব করতে লাগল। বিদেশী পর্যটক তো দূরের কথা, প্রবাসী বাঙালিরা পর্যন্ত ভয়ে বছরান্তে এরাজ্যে বেড়াতে আসা প্রায় বন্ধ করে দিল।

.

চারুবাবু তাঁর “লাইনের” কবর নিজেই খুঁড়ে দিলেন। তিনি দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে “বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থা” বলে ঘোষণা করলেন। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজকে ভেঙে ফেলতে, পুড়িয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন। ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত মনীষীদেরই, কারোকে ব্রিটিশের দালাল, কারোকে সামন্ততন্ত্রের প্রতিভূ, কারোকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে চিহ্নিত করে তাঁদের মূর্তি ভেঙে ফেলতে বললেন। নকশালরা “সাংস্কৃতিক বিপ্লবের” নামে শুরু করল স্কুল কলেজ পোড়ান, মনীষীদের মূর্তি ও সরকারি অফিস ভাঙচুর। অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনো জলাঞ্জলি দিয়ে হাতেখড়ি দিতে লাগল এসব কাজে। এগুলো করলে তবেই মূল দলে ঢোকার ছাড়পত্র মিলত। শহুরে মধ্যবিত্তের সমর্থন পুরোপুরি হারাল নকশালরা। শ্রমিকদের মধ্যে নকশালদের প্রভাব কোনদিনই বেশি ছিল না। যেটুকু ছিল তা ওই আবেগতাড়িত মধ্যবিত্তের মধ্যেই। বাস্তবের শিলনোড়ায় পিষে গিয়ে তাদের স্বপ্নের ধোঁয়াশা মিলিয়ে গেল। নকশালরা এই সময় থেকেই পায়ের তলার জমি হারাতে শুরু করেছিল।

হেমন্তবসুর খুনের রেশ কাটতে না কাটতেই মার্চ মাসের তিরিশ তারিখে দুপুর বারটা চল্লিশ নাগাদ কংগ্রেসের এম. এল. এ. নেপাল রায়কে তাঁর চিৎপুর রোডের অফিসে ঢুকে পাইপগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিল নকশালরা। বোমা মেরে উড়িয়ে দিল অফিস।

পয়লা এপ্রিল সাঁইত্রিশ বছরের তরুণ ইঞ্জিনিয়ার, অমৃতবাজার পত্রিকার ডিরেক্টর সুচারুকান্তি ঘোষ খুন হলেন। ভোর ছটা নাগাদ নিজের গাড়ি করে উত্তর কলকাতার পঞ্চাননতলা লেন দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখনও জানতেন না এটাই তাঁর জীবনের শেষ এপ্রিল ফুল! যখন জানলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, নকশালরা ততক্ষণে ওঁর গাড়ি ঘিরে ধরে ওঁকে টেনে নামিয়ে বুকে, পেটে, পিঠে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে। আর. জি. কর হাসপাতালে ভর্তির কিছুক্ষণের মধ্যেই ওঁর দেহ নিষ্প্রাণ হয়ে গেল।

ছয় এপ্রিল সকাল দশটা পনের মিনিটে কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি কিরণলাল রায়কে অভয় মিত্র লেনে তাঁর বাড়ির সামনে পাইপগান দিয়ে আক্রমণ করল নকশালরা। পরদিন রাত এগারটায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আঠেরই মে শ্যামপুকুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের প্রার্থী ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা অজিত বিশ্বাসকে রাত সাড়ে আটটায় বিডন স্ট্রিটে রিভলবার দিয়ে গুলি করল নকশালরা। তিনি তখন একটা বাড়িতে পার্টির মিটিং সেরে রাস্তায় দাঁড়ান জিপে উঠতে যাচ্ছিলেন। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মারা গেলেন।

মধ্য কলকাতার যুব কংগ্রেসের সভাপতি নারায়ণ করকে বেলেঘাটা মেন রোডে তাঁর বাড়িতে ঢুকে নকশালরা রিভলবার দিয়ে গুলি করে খুন করল। উত্তর কলকাতাতে বিখ্যাত খেলোয়াড় জ্যোতিষ মিত্রকে ন্যশংসভাবে খুন করল নকশালরা।

দশই আগস্ট বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সেন্ট্রাল এক্সাইজের প্রশাসনিক অফিসার এন. কে. পালকে ক্লাইভ রোতে তাঁর পাঁচ তলার অফিস ঘরে বীভৎস ভাবে গলা ও পেট ছুরি দিয়ে কাটা অবস্থায় মৃতদেহ পাওয়া গেল। ওই অফিসের কর্মচারীদের ড্রয়ার ও অন্যান্য জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া গেল চারুবাবুদের “দেশব্রতী” পত্রিকা।

হত্যার রাজনীতির পরিণামে নকশালদের হাতে শুধু কলকাতায় নয়, পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র বহু বিখ্যাত ও সাধারণ মানুষ, পুলিশ, হোমগার্ড নির্বিচারে খুন হতে থাকল। খুন হয়ে গেলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোপাল সেনসহ আরও অনেক নামকরা ব্যক্তি। এই একাত্তর সালেই শুধুমাত্র কলকাতা শহরে নকশালরা খুন করেছিল কংগ্রেসের সতের জন, সি. পি. আই (এম)-এর পঁচিশ জন, সি. পি. আইয়ের একজন, পি. এস. পি.র একজন, হোমগার্ড সাতজন, ব্যবসায়ী ছজন, পুলিশ ষোলজন, অন্যান্য মানুষ সাঁইত্রিশ জন- সব মিলিয়ে একশ আঠের জনকে। একাত্তরে সারা সিঁথি অঞ্চল জুড়ে হত্যালীলা চালায় নকশালরা। পনেরই জানুয়ারি হোমগার্ড প্রদীপ চক্রবর্তী, দমদম রোডে অসীম ভৌমিক খুন হয়ে গেল। দুদিন পর হিমালয়ান পেপার মিলের ঠিকাদার রামবিলাস সিংকে জি. টি. রোডে তাঁর গাড়ি থামিয়ে নকশালরা গুলি করে মারল। তাঁর কাছে খুনের আগের দিন টাকা চেয়েছিল শঙ্কুরা, তিনি দিতে অস্বীকার করেছিলেন, আর তারই পরিণতিতে মৃত্যু। একমাস পরে ৩০বি বাসের কর্মচারি সি. পি. আই (এম) সমর্থক অশোক দাসকে বাস থেকে টেনে নামিয়ে বুকে, পেটে ছুরি বসিয়ে খুন করল নকশালরা।

ইতিমধ্যে কালীচরণ শেঠ লেনে পুলিশের গুপ্তচর সন্দেহে কটা ভিখিরিকে খুন করে ওরা। মার্চ মাসের তেইশ তারিখে কালীচরণ শেঠ লেনেই খুন করল হার্ডওয়ার ব্যবসায়ী স্বরূপবিকাশ শেঠকে। পরদিনই খুন হলেন চিনি ব্যবসায়ী পুরিন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি। তাঁর গাড়িতে গুলি চালিয়ে, বোমা মেরে তাঁকে খুন করল নকশালরা, ড্রাইভার বেঁচে গেল কোনমতে। একত্রিশ তারিখে তারিণীচরণ স্কুলের মাস্টার মদনমোহন চৌধুরীকে গোখনারা ভোজালি দিয়ে কুপিয়ে, গুলি করে একটা ঝোপের মধ্যে ফেলে চলে গেল। এপ্রিলের চার তারিখে কলকাতা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর নির্মল চক্রবর্তী কাশীপুরের রাজাবাগান লেনে নকশালদের বোমা, পাইপগানের মুখে মারা গেল। সেদিনের সংঘর্ষে আহত সিপাই বীরেন চ্যাটার্জি কদিন পর মারা গেল হাসপাতালে। ওরা ওখানে ইন্সপেক্টর মুখার্জির নেতৃত্বে গিয়েছিল একটা তদন্ত করতে। শঙ্কু, সমীর, অমূল্য, আনসারিরা ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খুন করে চলে গেল। চব্বিশ তারিখ রাতে পাহারাদার হরিপ্রসাদ সরকারকে পুলিশের নজরদার সন্দেহে খুন করল ওরা। ছাব্বিশ তারিখ সকালে কলকাতা সশস্ত্র পুলিশের সিপাই মুক্তিপ্রসাদ দেকেকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিল, সে তখন ডিউটিতে যাচ্ছিল।

তার পরের কমাস ধরে ওরা খুন করল এলোপাথাড়ি। হোমগার্ড সমীর ভট্টাচার্যকে বাড়ির সামনে থেকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল শঙ্কু ও নীলেরা। ৩০বি চলন্ত বাস থেকে জোর করে টেনে নামিয়ে খুন করল সিপাই প্রবীরকুমার ঘোষকে। পুলিশের এক গাড়ির ড্রাইভার জীবন সিং রতনবাবু রোডে নকশালদের হামলায় মারা গেল। রুস্তমজী পার্সি লেনে শ্যামল, শঙ্কুরা পরপর কটা কাগজকুড়ানিকে পুলিশের গুপ্তচর সন্দেহে খুন করে ফেলল। সি. পি. আই (এম)-এর বিশ্বম্ভর সরকারকে বেদিয়াপাড়া লেন থেকে নিয়ে এসে রামকৃষ্ণ ঘোষ রোডে খুন করল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী সি. পি. আই (এম) সমর্থক বনমালী নিয়োগীকে সিঁথির মোড়ের কাছে হেম দে লেনে প্রথমে ছুরি দিয়ে মেরে, তারপর গুলি করে হত্যা করল।

খুনের পর খুনের মালা সাজিয়ে ওরা পুরোপুরি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। দু-একটা ক্ষেত্রে বদলার ঘটনাও যে ঘটেনি তা নয়। সি. পি. আই (এম)-এর ছেলেরা নকশাল বলে চোদ্দ বছরের বাচ্চা ছেলে বিক্রমজিৎকে খুন করল। ফলে বেদিয়াপাড়ার দিকের মানুষেরা সি. পি. আই (এম)-এর থেকে বেশি নকশাল সমর্থক হয়ে গেল। একাত্তরের প্রথম দিক থেকেই সিঁথি অঞ্চলে তল্লাশি ও ধরপাকড়ের চাপ বেড়ে গেল। একদিন চিরুনি তল্লাশির মধ্যে ‘গুলে’ নামে এক তরুণ নকশাল সি. আর. পি. বোঝাই লরিতে বোমা ছুঁড়ে মারল। বোমার আঘাতে দুজন সি. আর. পি. জওয়ান আহত হল। সি. আর. পি.র পাল্টা গুলিতে গুলে রাস্তার ওপরেই লুটিয়ে পড়ে মারা গেল।

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পোস্ট অফিসেই বেশি আক্রমণ করেছিল নকশালরা। তাই বেশিরভাগ পোস্ট অফিসে পুলিশ থেকে গার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। সিঁথির ফকির ঘোষ লেনের পোস্ট অফিসেও তেমন ব্যবস্থা ছিল। সেখানে একজন রাইফেলধারী সিপাই পাহারাদার হিসেবে থাকত। একদিন সকালবেলা শ্যাম, গোখনা আর বাপী ওই সিপাইকে খুন করার ষড়যন্ত্র করল। ছোটবেলা থেকেই শ্যামের বন্দুকে ভীষণ ভাল নিশানা ছিল। শ্যাম উচ্চবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া ছেলে। এমনিতে সে সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিল, কিন্তু পড়াশুনো না করে খুব অল্প বয়সেই সে পাখিমারা বন্দুক নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াত, গুণ্ডামি করত। নকশালদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর দাদাগিরির ভাল সুযোগ পেয়ে সে নিজেও নকশাল হয়ে গিয়েছিল। ওই শ্যামই পোস্ট অফিসের সিপাইকে মারার মূল ছকটা করেছিল।

ডাকঘরের পাশেই একটা পাঁচিল ঘেরা খাটাল ছিল। পুরনো পাঁচিলের জায়গায় জায়গায় ইঁট খসে গিয়ে বহু গর্ত তৈরি হয়েছিল। ছক অনুযায়ী শ্যাম, গোখনা ও বাপী খাটালের ভেতর ঢুকে পড়ল। শ্যামের হাতে একটা রাইফেল। গোখনা আর বাপীর কাছে গ্রেনেড আর বোমা। ওদের দেখে খাটালের গোয়ালারা ভয়ে পালাতে চেষ্টা করল। না, নকশালরা ওদের পালাতে দিল না, একটা জায়গায় আটকে রাখল। তারপর শ্যাম পাঁচিলের গর্ত দিয়ে রাইফেলের নল ঢুকিয়ে দিল। উল্টো দিকে পোস্ট অফিসে একটা টুলে বসে সিপাই তখন পাহারা দিচ্ছে। তার কল্পনাতেও নেই ভাঙা গর্ত দিয়ে বেরিয়ে আসছে। তার মৃত্যুর পরোয়ানা। ও বেচারা জানে না ভারতবর্ষের “মুক্তির” জন্য তার মৃত্যুটা বড় বেশি জরুরী। দড়াম, দড়াম, দুটো গুলির শব্দে চারদিক হৈ হৈ করে মানুষজন ছোটাছুটি করতে শুরু করল। কোনখান থেকে রাইফেলের গুলি ছুটে এল কিছুই বুঝতে পারছে না। ওদিকে তখন পোস্ট অফিসের ভেতর সেই সিপাইয়ের বুকে গুলি এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গিয়েছে, লুটিয়ে পড়েছে সে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। একটু পরই নিথর, নিস্পন্দ হয়ে গেল তার শরীর। না, ওকে কেউ কোনদিন শহীদ বলবে না, ওর নামে কোনও বেদীও তৈরি হবে না, সে তো “শ্রেণীশত্রু”। মুর্শিদাবাদের যে গরিব চাষীর ঘর থেকে সে এসেছিল চাকরি করতে, বৃদ্ধ বাবা মা যারা তার মানি-অর্ডারের দিকে তাকিয়ে থাকত সারা মাস, তারা জানতেও পারল না, তাদের “শ্রেণীশত্রু” সন্তান সিঁথির পোস্ট অফিসের মেঝেতে চারুবাবুদের “বিপ্লবের” প্রয়োজনে বুকে গুলি খেয়ে শুয়ে পড়েছে চিরকালের জন্য। অন্যদিকে শ্যাম, গোখনা, বাপীরা সেই “বিপ্লবের” পতাকা তুলে বিজয়ীর ভঙ্গিতে রায়পাড়ার দিকে চলে গেল।

এর কিছুদিনের মধ্যে আমরা পরপর অভিযান চালিয়ে অনেক রাইফেল, পাইপগান, বোমা উদ্ধার করলাম। কিন্তু বড়সড় কোনও নকশালকে ধরতে পারলাম না। আসলে পুলিশের সোর্সগুলো ঠিকমত কাজ করছিল না। ইতিমধ্যে জানতে পেরেছি শেঠবাগানের এক তরুণী ডি. ব্যানার্জি সেখানকারই এক সি. পি. আই (এম) সদস্যার চোখে মুখে ব্লেড দিয়ে আঘাত হেনে “বিপ্লবী হিংসার” পরীক্ষায় উতরে সিঁথির মূল নকশালদের দলে যোগ দিয়েছে।

ডি. ব্যানার্জি দলে যোগ দেওয়ার আগেই বাপী বিয়ে করে ফেলেছিল বিপাশাকে। কালীবাড়ির পুরোহিতের মেয়ে ও তার ভাই কেলো আগের থেকেই মূল দলে ছিল। কেলো এই সুযোগে বিয়ে করে ফেলল বিপাশার ছোট বোনকে। নকশালদের এক প্রবীণ নেতা একবার এসব দেখেশুনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বলে ফেলেছিলেন, “এ কি প্রজাপতির অফিস হয়ে গেল নাকি?” সে রকমই এরা করে ফেলেছিল। বিপ্লবের নামে এত অবাধ সুযোগ লুম্পেনরা আর কোথায় পাবে? এক সমর্থকের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার নাম করে ঢুকে এক বড় নকশাল নেতা তার স্ত্রীকে নিয়েই ভেগে গিয়েছিল। স্বদেশী আমলের সন্ত্রাসবাদীদের চরিত্রগত যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা মূল্যবোধ ছিল, নকশালদের বেশির ভাগের মধ্যেই তার ছিটেফোঁটাও ছিল না।

একদিন সকালে খবর পাওয়া গেল, শ্যাম কালীতলায় নিজের বাড়িতে এসেছে। খবর পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বাড়ি ঘিরে ফেলা হল। পুলিশ বাড়ি ঘিরে ফেলেছে বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই শ্যাম দোতলা বাড়ির ছাদে উঠে গিয়েছিল। ওখান থেকেই পিস্তল দিয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। বেশ কিছুক্ষণ গুলি বিনিময়ের পর, খুব সম্ভবত শ্যামের পিস্তলের গুলি শেষ হয়ে গেল। সে আর উপায় না দেখে নিজের বাড়ির ছাদের রেলিং উপড়ে ফেলে পাশের বাড়ির ছাদে লাফ দিয়ে পালাতে চেষ্টা করল। আর তখনই পুলিশের বন্দুক গর্জে উঠল। শ্যামের বিশাল সুঠাম দেহটা লুটিয়ে পড়ল ছাদের ওপর।

নকশালরা সিঁথির সব রাস্তার আলো সন্ধের পর থেকেই নিভিয়ে রেখে দিত। পুরোপুরি ব্ল্যাক আউট। একদিন সন্ধেবেলায় রায়পাড়ার মুখে আর্মির একটা জিপ হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। জিপে ড্রাইভার ছাড়া সেনাবাহিনীর তিনজন ছিলেন। তাঁরা জিপটা ঠেলে রাস্তার একধারে নিয়ে এলেন। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, তার মধ্যেই তাঁরা ইঞ্জিন খুলে দেখতে লাগলেন, কি গণ্ডগোল হয়েছে। নায়েক মোহন সিং গাড়ি সম্পর্কে কিছু বোঝেন না। তাই একটু দূরে শিবনাথ স্মৃতি সংঘের ক্লাব ঘরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। ড্রাইভার ও অন্য দুজন জওয়ান মিলে গাড়ি ঠিক করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অন্ধকারে তাদের ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে। সাথে টর্চও নেই। আশেপাশের বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ, তারই ফাঁক দিয়ে অল্প অল্প আলো বেরিয়ে আসছে, তাই ভরসা। ধারেকাছে কোনও দোকানও খোলা নেই যে মোমবাতি কিনে আনা যাবে। অগত্যা ওঁরা মাঝে মাঝে দেশলাই জ্বালিয়ে, কাগজ পুড়িয়ে ইঞ্জিনের ভেতরটা দেখছেন।

একটু দূরে রায়পাড়ায় একটা গলির ভেতর বসেছিল গোখনা, পুতুল, বিপাশা, কেলো, শম্ভু। অন্য কোথাও গিয়েছিল বাপী। সে তার কমরেডদের কাছে ফিরে আসতে গিয়ে দেখতে পেল মোহন সিংকে। ক্লাবঘরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আর দেখল রাস্তার ধারে জিপ নিয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছে জওয়ান দুজন। চারদিক জনমানবশূন্য। মাঝে মধ্যে দু-একটা লরি হুস হুস করে চলে যাচ্ছে। লরির হেডলাইটের আলো সরে যেতেই আবার গভীর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে চারদিক। সন্ধে তখন সবে মাত্র সাতটা-সাড়ে সাতটা। দূর থেকে ভেসে আসছে বোমার বিকট আওয়াজ, হয়ত অন্য কোনখানে অন্য কোন নকশাল দল “শ্রেণীশত্রু” খতম করছে। বাপীর রক্ত নেচে উঠল, সামনেই রয়েছে শিকার। বাপী গোখনাদের কাছে এসে বলল, “এক্ষুণি দেখে এলাম, ক্লাব ঘরের দেওয়ালে পিঠ দিয়ে একটা মিলিটারি দাঁড়িয়ে আছে। আমি মালটাকে খতম করে দিয়ে আসছি, তোরা আমার পেছনে থাকবি, যাতে কেউ এসে পড়লে বোমা মারতে পারিস।” শঙ্কু, গোখনারা তো একপায়ে খাড়া।

বাপী অন্ধকারের মধ্যে হাতে একটা মাংস কাটার চপার নিয়ে বেড়ালের মত নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে লাগল। একটু তফাতে পেছন পেছন আসতে লাগল গোখনা, শঙ্কু, বিপাশারা। মোহন সিং টেরও পাচ্ছেন না। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক অক্লান্ত কর্মী, বিদেশী শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। তিনি কি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন এই কলকাতার অলিতে গলিতে লুকিয়ে আছে আততায়ীরা? যাদের নিশ্চিন্তে বাঁচার জন্য বহিরাক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয় তাদের ভিতরই রয়েছে পরম শত্রু, সে অত সব বোঝেনি, বুঝলে, একান্তভাবে এ ক্লাবঘরের দেওয়ালে পিঠ দিয়ে তার সাথীদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে জীপ সারানোর কাজ দেখত না। বাপীর বিড়ালের মত চোখ, হরিণের মত ক্ষিপ্রতা, হায়নার মত রক্তে হিংস্রতা। মোহন সিংয়ের একেবারে কাছে গিয়ে বাপী শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সাঁই করে গলা লক্ষ্য করে চালিয়ে দিল চপার। দ্বিতীয়বারের কোপ সামলানর জন্য মোহন সিং একবার ডানহাতটা তোলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ছোট্ট একটা আঃ শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা গেল না। ধুপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। ততক্ষণে বাপীর চপার তাঁর গলায় আরও দুবার আঘাত করে ফেলেছে। লুটিয়ে পড়া মোহনের দেহটা বাপী পা দিয়ে ঠেলে দেখে নিল, “মহান” কর্তব্য পুরোপুরি পালন করতে পেরেছে কিনা। হয়েছে, মোহন আর বেঁচে নেই, গলা থেকে শরীর প্রায় পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। “শ্রেণীশত্রু” মোহন সিং খতম। বাপীর এই নিষ্ঠা নিদর্শন হিসেবে দেখিয়ে আগামীকালই হয়ত তাদের “শ্রদ্ধেয় নেতা” চারু মজুমদার লিখে ফেলবেন আগুনঝরা প্রবন্ধ, যা লিফলেটের মত পার্টির মধ্যে বিলি হয়ে গিয়ে কমরেডদের উদ্বুদ্ধ করবে। বাপী তার সঙ্গীদের নিয়ে ঢুকে গেল রায়পাড়ার ভেতর।

ওদিকে মোহনের সঙ্গী অন্য জওয়ানরা জানতেও পারেনি, তিনি ক্লাব ঘরের সামনে খুন হয়ে শুয়ে আছেন রক্তাক্ত মাটির বিছানায়। জিপ সারানর পর ওরা মোহনকে ডাকতে লাগল। ডাকাডাকিতে কোনও সাড়া না পেয়ে ওরা ক্লাব ঘরের সামনে চলে এল, আবিষ্কার করল গলা কাটা মোহনকে। ওরা হতবাক। কলকাতার বুকে বিনা প্ররোচনায়, বিনা শত্রুতায় মোহন সিং এইভাবে খুন হয়ে যাবেন এ তো চোখে দেখেও বিশ্বাস করা যায় না। ওরা জওয়ান, সদা সতর্ক, মোহন কি নিহত হওয়ার আগে এতটুকুও আভাস পাননি আততায়ী আসছে? জিপ নিয়ে তাড়াতাড়ি ওরা চলে গেল কাশীপুর থানায়। পুলিশ গিয়ে তুলে নিয়ে এল মোহন সিংয়ের মৃতদেহ।

সিঁথির নকশাল মেয়েরা যথেষ্ট নারীবাদী ছিল। বাপীর একক প্রচেষ্টার এই সাফল্যে তারা উৎসাহ পেল। নারীরা যে পুরুষদের সমান “বিপ্লবী”, তা হাতেনাতে দেখান দরকার বলে হঠাৎ মনে হল তাদের। বিপাশা, ডি. ব্যানার্জি ও অন্যান্যরা মিলে শিকার ঠিক করল। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর প্রদীপ ভট্টাচার্য। সে পেয়ারাবাগান- রাজাবাগানের মোড়ের কাছে সরু গলির ভেতর বিধবা মাকে নিয়ে একটা ছোট ঘর ভাড়া করে থাকত। বহু বছর ধরে ওরা ওখানে আছে। সবাই ওকে চেনে, তাই নকশালদের মুক্তাঞ্চল হিসেবে কুখ্যাত হলেও পাড়া ছেড়ে উঠে যাওয়ার গরজ দেখায়নি। যতই ওরা পুলিশ খুন করুক, সে কখনও নিজে পাড়ার মধ্যে পরিচিত কারও হাতে খুন হতে পারে, সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি।

প্রতিদিনের মত সেদিনও প্রদীপ সকালবেলা মায়ের রান্না করা ভাত খেয়ে ডিউটিতে যাচ্ছিল। একটু দেরি হয়ে গেছে, তাই দ্রুত পা চালিয়ে যাচ্ছে বাস রাস্তার দিকে। সেভেন ট্যাঙ্কস লেনের মোড়ে আসতেই পেছন থেকে মাথার ওপর পড়ল লোহার রডের বাড়ি। প্রদীপ আছাড় খেয়ে পড়ল রাস্তায়। উঠতে চেষ্টা করল একবার, কিন্তু আবার মাথায় আঘাত, তারপর ক্রমাগত চপার আর তরোয়ালের ঝড়। প্রদীপের দেহ থেকে বেরিয়ে গেছে প্রাণ। তবু বিপাশা, ডি. ব্যানার্জিরা প্রদীপের মাথাটা খাসী কাটার কায়দায় চপারের এক কোপে বিচ্ছিন্ন করে দিল দেহ থেকে। রাস্তায় পড়ে রইল প্রদীপের মুণ্ডুহীন দেহ। কিছুটা দূরে ছিটকে পড়ে আছে মায়ের সাজিয়ে দেওয়া টিফিন কৌটোটা। বিপাশারা সবাই মিলে প্রদীপের রক্ত নিজেদের পায়ে আলতার মত পরে নিল। তারপর প্রদীপের কাটা মাথাটা নিয়ে উল্লাসে লোফালুফি খেলতে লাগল। হাতে মুখে যত ছিটকে ছিটকে রক্ত লাগল তত ওদের উল্লাস বাড়তে থাকল।

চারপাশের লোকজন বিস্ময়ে হতবাক। নকশাল তাণ্ডবে তাঁরা অভ্যস্ত কিন্তু বাঙালি তরুণীরা এমন কাজ করতে পারে এটা স্বপ্নের অতীত ছিল। চারদিকের বাড়ির দরজা জানালা দ্রুত বন্ধ হয়ে গেল। নকশাল তরুণীদের স্লোগানে স্লোগানে ঝরে পড়ছে বিপ্লবের বীভৎস রস। এরপর ওরা নিয়ে এল একটা প্লাস্টিকের তারের ব্যাগ। সেই ব্যাগের ভেতর প্রদীপের কাটা মাথাটা ঢুকিয়ে পাড়ার মধ্যে মিছিল করে ঘুরল। তারপর একটা লাইটপোস্টের মাথায় প্রদীপের মুণ্ডু সমেত ব্যাগটা ঝুলিয়ে দিয়ে চলে গেল রায়পাড়ার দিকে নিজেদের গোপন আস্তানায়। খবর পেয়ে প্রদীপের মা ছুটতে ছুটতে এসে পাগলের মত আছড়ে পড়লেন প্রদীপের বিকৃত দেহে, হাহাকার করতে করতে বারবার চোখ তুলে দেখতে লাগলেন, ঝোলান মুণ্ডুটা কি সত্যিই তাঁর ছেলের? অভাগিনী মায়ের শেষ আশা, যদি ওটা প্রদীপের না হয়ে অন্য কারও হয়।

এরপর গোপালের পালা। পাইকপাড়ার গোপাল শীল সি পি এম করত। তাই ওর ওপর রাগ ছিল নকশালদের। সিঁথির নকশাল নেতা শ্যামল চৌধুরী একদিন পাইকপাড়ায় গিয়েছিল কোন কাজে। দেখল, গোপাল অন্য একটা বাড়ি থেকে বেরচ্ছে, তার মানে বোঝা গেল সেই বাড়িতে সে রাতে গোপনে থাকে। খবরটা চিটকে, বিপাশাদের দিল শ্যামল। তারপর তারা শুরু করল পরিকল্পনা কিভাবে গোপালের মত “শ্রেণীশত্রুকে” খতম করা যায়। পাইকপাড়ার নকশাল পার্থকে ডাকা হল কারণ সে ওই দিককার সব গলি ঘুপচি চেনে। ঠিক হল, ভোরবেলায় বিপাশা গোপালকে বাড়িতে গিয়ে ডাকবে। গোপাল বাড়ি থেকে বেরলে বিপাশা ইনিয়ে বিনিয়ে তাকে বলবে, নর্দার্ন অ্যাভিন্যুয়ের দিকে যাওয়ার সময় কটা ছেলে তাকে ধরবার চেষ্টা করছিল, কোনমতে পালিয়ে এসেছে। গোপাল যেন ওকে একটু এগিয়ে দেয়। গোপাল কোনরকম সন্দেহই করবে না, বিপাশাকে গোপাল ভালভাবে চেনে। গোপালকে নিয়ে বিপাশা একটা পয়েন্টে পৌঁছলেই শ্যামল, চিটকেরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

ছক অনুযায়ী একদিন কাকভোরে বিপাশা গোপালের বাড়ির সামনে গিয়ে ডাকতে শুরু করল, “গোপালদা, গোপালদা।” গোপাল মেয়েলি গলার ডাক শুনে বেরিয়ে এসে বিপাশাকে দেখে একটু আশ্চর্য হয়ে গেল, “কি ব্যাপার বিপাশা, এত ভোরে এখানে? আর আমি এই বাড়িতে থাকি তুমি জানলেই বা কি করে?” বিপাশা ভয়ার্ত গলায় বলল, “আমি প্রায়ই রাতের দিকে এদিকে আসি, আপনাকে দেখি এই বাড়িতে ঢুকতে, তাই। গতরাতেও এসেছিলাম, আজ ফেরার পথে শীতলা মন্দিরের কাছে কতগুলো ছেলে আমাকে তাড়া করল। আমি কোনওমতে পালিয়ে এসেছি। আপনি যদি একটু এগিয়ে দেন, খুব ভাল হয়।” গোপাল সরল বিশ্বাসে বলল, “চল, তোমায় এগিয়ে দিয়ে আসি।” গোপাল আর বিপাশা নর্দান অ্যাভিন্যু ধরে এগিয়ে শীতলা মন্দিরের সামনে আসতেই শ্যামল, চিটকে, পার্থ তরোয়াল আর ছুরি নিয়ে গোপালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পেটে, বুকে, গলায় কোপের পর কোপ। গোপালের গলার স্বর নর্দার্ন অ্যাভিন্যুয়ের কোনও বাড়িতে পৌঁছনর আগেই সে লুটিয়ে পড়ল রাস্তায়। কাজ শেষ। পাশেই রাস্তার কলে শ্যামলরা ধুয়ে নিল তরোয়াল, ছুরি, হাতের রক্ত। তারপর সিগারেট ধরিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল সিঁথির দিকে। ভোরবেলা পাইকপাড়ার মানুষ বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখল শীতলা মন্দিরের সামনে পড়ে আছে রক্তাক্ত এক দেহ। মুখে মুখে প্রশ্ন, মন্দিরের সামনে বিংশ শতাব্দীর শেষে কে দিয়ে গেল নরবলি?

বেদিয়াপাড়াতে পুলিশের গুপ্তচর সন্দেহে সি. পি. আই (এম) ক্যাডার বাচ্চা নামে একটা অল্পবয়সী ছেলেকে গোখনা, বাপীরা নৃশংসভাবে খুন করল। সন্ধেবেলা তার বাড়ির সামনে জাপটে ধরে, কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বুকে পিঠে পরপর ছুরি চালিয়ে খুন করে চলে গেল।

সি. পি. আই (এম)-এরই সদস্য ন্যাশনাল কার্বন কোম্পানির কর্মী শক্তিপদ মজুমদারকে রতনবাবু রোডে ধরে একটা গলির ভেতর টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে নীলুরা খুন করল।

সাউথ সিঁথি রোডে কুণ্ডু ফার্মাসির কাছে শঙ্কু, বাপী মিলে খুন করল সিপাই সাহিন্দার সিংকে। পুলিশের গুপ্তচর বানিয়ে নাইটগার্ড সলিল দেকে খুন করল নকশালরা।

সিঁথি ও কাশীপুর অঞ্চলে নকশালদের তাণ্ডবের বিরুদ্ধে প্রতিদিনই আমাদের অভিযান চালাতে হত। কোনদিন কারোকে ধরতে পারতাম, কোনদিন শূন্য হাতে ফিরতে হত। কোনদিন অস্ত্র উদ্ধার করতে পারতাম, কোনদিন পারতাম না। সিঁথির বেণী কলোনি, বিশ্বনাথ কলোনি, অপূর্বকৃষ্ণ লেন, রামকৃষ্ণ ঘোষ লেনের সবচেয়ে বেশি মানুষ বাড়ি-সম্পত্তি ফেলে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। যারা ওখানেই রয়ে গিয়েছিল, তাদের নিরাপত্তার জন্য আমরা চেষ্টার ত্রুটি রাখতাম না।

আগস্ট মাসের এক রাতে কাশীপুরে একটা ঝোপঝাড় ভরা এলাকায় তল্লাশি চালাতে গেছি, হঠাৎ দেখি একটা সরু গলির ভেতর থেকে তিনটে ছেলে ছুটে আসছে। চারপাশে পুলিশ ঘিরে রেখেছে বুঝতে পেরে এলোপাথাড়ি বোমা মারতে শুরু করল। আমরাও গুলি চালালাম। বোমা গুলির শব্দে সারা এলাকা কাঁপতে লাগল। কিছুক্ষণ পর রণে ভাঙ্গ দিল ওরা। গলির ভেতর এগিয়ে দেখি তিনজনের মধ্যে দুজন পালিয়েছে, একজন পড়ে আছে। সে সিঁথির নকশাল নেতা শ্যামল চৌধুরী।

সিঁথির কিছু বাড়ি সেসময় ফাঁকা পড়ে থাকত। আসলে বাইরে থেকে দেখলে মনে হত ফাঁকা, কিন্তু নকশালরা ওখানে আত্মগোপন করত। সেইসব ফাঁকা বাড়িতে দিনে অভিযান চালাতাম আর মাঝে মধ্যে কিছু সিপাই রেখে আসতাম, যাতে নকশালরা রাতে আত্মগোপন করতে এলে আমাদের ফাঁদে ধরা পড়ে। রাতে আবার আমরা ওই এলাকায় অপারেশন চালাতে গেলে সিপাইরা বেরিয়ে আসত।

আমাকে হত্যা করার জন্য গোখনারা একবার পরিকল্পনা করল। আমি সাধারণত জিপ নিয়ে যেতাম। কোনদিক দিয়ে ঢুকব, আগে থেকে নিজে চিন্তা করে রাখলেও কারোকে সেটা বলতাম না। একদিন ওরা রায়পাড়ার মুখে ৩০বি বাসস্ট্যাণ্ডের কাছে, কালীতলার মোড়ে ও বেদিয়াপাড়ার মোড়ে মূল তিনদিকের রাস্তাই পুরো খুঁড়ে রেখে দিল। সন্ধের আগেই রাস্তার সব আলো খুলে ফেলে এলাকায় কার্ফু জারি করে দিল, যাতে কোনও সাধারণ লোক ওই দিকে না আসে। আশেপাশের দোকানগুলো এমনিতেই সন্ধেবেলায় বন্ধ হয়ে যেত, সেদিন ওরা আরও আগে বন্ধ করে দিল। এলাকার বাড়িগুলোতে আলো জ্বালাতে বারণ করে দিল। তারপর তিনটে ট্রেঞ্চেরই দুদিকে বোমা, গ্রেনেড, রাইফেল, পিস্তল নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কখন আমি আর অন্যান্য অফিসাররা যাই। ট্রেঞ্চের ওপর দরমা জাতীয় জিনিস দিয়ে তার ওপর মাটি ছড়িয়ে দিয়েছিল, যাতে দূর থেকে জিপের হেডলাইটে বোঝা না যায় ওখানে রাস্তা কাটা আছে।

ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর একটা জিপ গিয়ে বেদিয়াপাড়ার ট্রেঞ্চের মুখে উল্টে পড়ল। “বাপরে বাপ” বলে চিৎকার করে ড্রাইভার আর এক মাতাল আরোহী ছিটকে রাস্তায়। ওদের দেখে গোখনাদের কেমন সন্দেহ হল। ওরা বোমা না মেরে, টর্চ জ্বালিয়ে দেখে নিল পুলিশ কিনা। না, পুলিশ নয়, আর যাকে মারার জন্য ফাঁদ পাতা হয়েছে সে তো নয়ই। গালাগালি দিয়ে তাড়াতাড়ি দুজনকে তুলে আটকে পড়া জিপটা ট্রেঞ্চ থেকে ঠেলে রাস্তা পার করিয়ে দিয়ে আবার অপেক্ষা করতে লাগল ওরা। সেদিন অবশ্য ওখানে আমি যাইনি, গেলে যে আর ফিরে আসতে পারতাম না সেবিষয়ে আজ এত বছর পরও আমি নিশ্চিত। নকশালদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হল। এরকম বহুবারই আমি নকশালদের হাতে খুন হতে হতে অদ্ভুতভাবে বেঁচে গিয়েছি।

একবার কুমোরটুলি অঞ্চল ঘেরাও করে সারারাত ধরে তল্লাশি চলছিল। ভোর চারটে নাগাদ সি. আর. পি. বাহিনী চলে যাওয়ার পরও আমরা টহল দিচ্ছিলাম। আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটে উঠছে। ফিরে যাব লালবাজারে। আমি আর কনস্টেবল শচীন চক্রবর্তী অন্যদের থেকে একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে আমি নর্দমার দিকে এগচ্ছি, একটু দূর থেকে একটা ছেলেকে ঠোঙায় মুড়ি খেতে খেতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। এত ভোরে ওইভাবে মুড়ি খেতে দেখে আমার কেমন যেন সন্দেহ হল, আমি শচীনকে বললাম ছেলেটার গতিবিধি লক্ষ্য করতে। ছেলেটা একটা ঠোঙা বাঁ হাতের তালুতে রেখে ডান হাত দিয়ে ঠোঙা থেকে অল্প অল্প মুড়ি নিয়ে চিবতে চিবতে আমাদের পেরিয়ে চলে গেল। শচীনও ঠিক খেয়াল রেখেছে, ছেলেটার পেছন পেছন যেতে লাগল। আমার থেকে বিশ মিটার মত এগিয়ে ছেলেটা মুড়ি খাওয়া থামিয়ে ঠোঙাটা আমার দিকে ছুঁড়তে যেতেই শচীন এক লাফে ওর হাত ধরে ফেলল ধরার সঙ্গে সঙ্গে বিকট আওয়াজে কুমোরটুলি কেঁপে উঠল। দেখি শচীনও নেই, ছেলেটাও নেই। শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। আমি রাস্তার পাশে একটা বাড়ির দেওয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলাম। ধোঁয়া না কাটলে কিছুই বোঝা যাবে না। আমার অনুমান তবে ঠিকই ছিল, ছেলেটা মুড়ির ঠোঙার তলার দিকে বোমা রেখে, তার ওপরে মুড়ি ভরে খেতে খেতে আসছিল। আমিই যে তার আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিলাম তাও ততক্ষণে বুঝে গিয়েছি। অন্য কারোকে মারতে হলে সে আমাদের অতিক্রম না করে দূর থেকেই বোমাটা ছুঁড়ে দিতে পারত। কিন্তু তা দেয়নি। আমাকে পেরিয়ে গিয়ে ভালভাবে দেখে নিশ্চিত হয়ে তবেই বোমাটা ছুঁড়তে গিয়েছিল। ধোঁয়া অল্প হাল্কা হতেই দেখলাম, শচীন আর ছেলেটা দুজনেই রাস্তায় পড়ে আছে, কাতরাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে শচীনকে তুললাম। শচীনের ডান হাতটা প্রচণ্ড জখম হয়েছে, এছাড়াও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত। বোমার আওয়াজে আমাদের লোকেরা গাড়ি নিয়ে দেখতে এসেছে কি হয়েছে। সবাই মিলে শচীন আর আহত ছেলেটাকে গাড়িতে তুলে হাসপাতালের দিকে ছুটলাম। হাসপাতালে শচীনকে বহুদিন থাকতে হয়েছিল। আর নকশাল গৌরের একটা হাত উড়ে গিয়েছিল।

মধ্য কলকাতায় নকশালদের ভেতরে আমার এক ভাল সোর্স ছিল। একদিন সে লালবাজারে এসে খবর দিল, রামকান্ত মিস্ত্রি লেনের একটা বাড়িতে পরের দিন সন্ধেবেলায় নকশালরা মিটিং করবে। সেই খবর অনুযায়ী আমি অন্য কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে গেলাম। রামকান্ত মিস্ত্রি লেনের সরু গলির মধ্যে ঢুকে বাড়িটার খোঁজ করতে শুরু করলাম। নকশালরাই আগে থেকে এলাকাটা অন্ধকার করে রেখেছিল। আমরা গলির ভেতর একটা তিনতলা বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাড়লাম। দরজাটা ভেজান ছিল, আস্তে খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড শব্দে বোমা পড়তে শুরু করল। আমরা চারজন গলির ভেতর ছিলাম। বোমা পড়ার শব্দে চোখের পলকে বাড়ির ভেতর ঢুকে সদর দরজা বন্ধ করে দিলাম। বুঝলাম, আমাদের মিটিংয়ের খবর দিয়ে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। তখন বোমার আওয়াজে কানে তালা ধরার অবস্থা, গলির ভেতর সমস্ত বাড়ি কাঁপছে। ভাবছি বোমার শব্দ পেয়ে বড় রাস্তায় দাঁড়ান আমাদের ওয়ারলেস ভ্যান থেকে লালবাজারে নিশ্চয়ই এতক্ষণে খবর পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমরা রামকান্ত মিস্ত্রি শেনে আক্রান্ত।

আমরা চারজন ততক্ষণে বাড়িটার ছাদে উঠে গিয়েছি। উঠতে উঠতে বাড়িটার দু-একটা ঘরে আলো জ্বালান দেখেছি। কিন্তু কোনও লোক দেখতে পাইনি। সবাই বোমার ভয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা ছাদে উঠে উকি মেরে দেখলাম নকশালরা বাড়িটা ঘিরে ফেলেছে। আমরা যে এখানে আছি সেটা ওদের বুঝতে দেওয়া চলবে না। সেজন্য ছাদ থেকে ওদের লক্ষ্য করে গুলিও ছুঁড়তে পারছি না। একবার জানতে পারলে ওরা ছাদের ওপরই বোমা ছুঁড়বে। একটু পর দেখলাম আমাদের ফোর্স গলির মধ্যে ঢুকে রাইফেল থেকে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছে। নকশালরা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পিছু হটছে। এই সুবর্ণ সুযোগ। আমরাও ছাদ থেকে ওদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে লাগলাম।

ওদিকে লালবাজার থেকে এসে গেছে আরও ফোর্স। তারা ঢুকে পড়েছে গলির ভেতর। নকশালরা বোমা ছোঁড়া অব্যাহত রেখেছে। পাল্টা গুলি চলছে আমাদের দিক থেকেও। নকশালরা এবার পালাতে শুরু করেছে। থেমে গেছে বোমা বৃষ্টি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমরা ছাদ থেকে নেমে এলাম। যাঁদের আশ্রয়ে আমরা বেঁচে গেলাম, আমাদের জন্য যাঁদের বাড়ি বোমার আঘাতে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল, সেই লোকেদের সঙ্গে দেখা না করে যাওয়াটা অভদ্রতা মনে হল। আমরা দোতলার একটা ঘরে কয়েকজন বাসিন্দাকে পেয়ে গেলাম। মোট চারজন ছিলেন। তাঁরা সবাই ঘরে ঢুকে একটা কাঠের চৌকি ঘরের দেওয়ালে আড়াআড়িভাবে ঠেস দিয়ে তার পেছনে বসে কাঁপছিলেন। আমরা যেতে তাঁরা বেরিয়ে এলেন বটে, কিন্তু কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না কেউই। ভয়ে, বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছিলেন। আমি বললাম, “আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনাদের বাড়িতে ভুল করে ঢুকে পড়েছিলাম বলে আমরা বেঁচে গেলাম। আপনাদের বাড়ির বোধহয় অনেক ক্ষতি হয়েছে, সেজন্য আমাদের ক্ষমা করে দেবেন।” চারজনের মধ্যে যিনি একটু বয়স্ক তিনি কোনমতে একটু বিড়বিড় করলেন, বোধহয় বোঝাতে চাইলেন ধন্যবাদ গ্রহণ করেছেন।

আমরা দ্রুত গলিতে নেমে এলাম, দেখলাম বাড়িটার অল্প দূরেই পড়ে আছে তিনটি তরুণের মৃত দেহ। নিহত তিন তরুণের নাম অনুপ, অশোক ও বাবলু। এদের প্রত্যেকেরই বিরুদ্ধে ছিল গ্রেফতারি পরোয়ানা। ওরা আমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। সেইমত আমার সোর্সকে দিয়ে মিটিংয়ের ভুয়ো খবর পাঠিয়ে আমাকে ফাঁদে ফেলে বোমায় উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি ঠিক গলিতে গিয়েও ভুল বাড়িতে ঢুকতে যাচ্ছি দেখে, ওরা ধৈর্য হারিয়ে বোমা মারতে শুরু করেছিল। ভাবা যায় শুধু এই কারণেই আমি বেঁচে গিয়েছি!

এই ঘটনার থেকে আমি একটা শিক্ষা পেলাম। সোর্সকে কখনও লালবাজারে বা কোনও থানায় ডেকে খবর জানা উচিত নয়, তাহলে তার চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। তখন সোর্স সঠিক খবর আনতে ব্যর্থ হয়। সোর্সকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করতেই হবে, তার কোন বিপদ যাতে না হয় সে খেয়ালও রাখতে হবে। আমার সেই নকশাল সোর্স অতি উৎসাহে লালবাজারে চলে আসত, তাই সে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল, নকশালরা সেই সুযোগ নিয়ে মিটিংয়ের ভুল খবর পাঠিয়েছিল।

রামকৃষ্ণ মিস্ত্রি লেনের ঘটনার পরদিনই আমার সেই সোর্সকে নকশালরা গলা কেটে কুপিয়ে হত্যা করল। ছুরি দিয়ে বুক ও পিঠের মাংস খাবলে খাবলে তুলে নিল ব্যর্থতার জ্বালায়। আমি একটা দিন সময় পেলেই তাকে কলকাতার বাইরে পাঠিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু সে সুযোগ আমাকে নকশালরা দিল না। “বিশ্বাসঘাতককে” খুঁজে বের করে সাথে সাথেই খুন করে দিল।

ঠিক এই রকম না হলেও আরও একবার আমি নকশালদের ফাঁদে পা দিয়েও অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছি। সেদিন গভীর রাতে একটা খবর পেয়ে পটলডাঙায় নকশালদের আস্তানায় হানা দিতে গিয়েছি। আমি, একজন অফিসার আর আমাদের দফতরের তিনজন সিপাই জিপে করে পটলডাঙ্গার মোড়ে পৌঁছনর সঙ্গে সঙ্গেই শুনলাম কাছাকাছি কোথাও প্রচণ্ড জোরে বোমা পড়ল। আমরা জিপটা কিছুটা দূরে রেখে নেমে পড়লাম। এগিয়ে গিয়ে দেখি কোথাও কিছু নেই, কতগুলো অল্পবয়সী ছেলে এদিক ওদিক ছুটে পালাচ্ছে। আমরাও তাদের পেছন পেছন একজন দুজন করে ছুটতে লাগলাম। আমি যার পেছনে ছুটছিলাম সে একটা ভীষণ সরু গলির মধ্যে ঢুকে গেল। তার ডান হাতে ধরা রিভলবার। আমিও হাতে রিভলবার নিয়ে ছুটছি।

গলিটা এত সরু যে একজনের বেশি যাওয়া যায় না, উল্টো দিক থেকে কেউ এলে দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে একজনকে সরে দাঁড়াতে হবে। গলির মধ্যে আবার ডাইনে বাঁয়ে শাখাপ্রশাখা, তস্য গলি। চারদিক নিঝুম, রাত প্রায় আড়াইটে হবে। দু একটা নেড়ি কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে এদিক থেকে ওদিক দৌড়ে পালাচ্ছে। আমি সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছি, অন্ধকারে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। গলির ভেতর যাচ্ছি তো যাচ্ছি, আমার সামনে যে দৌড়চ্ছে, তার জুতোর আওয়াজ পাচ্ছি। সামনে একটা বাড়ি, দুদিকে গলির দুটো শাখা চলে গেছে।

আমি গলির মুখটায় এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কোনদিকে গেছে ছেলেটা, বাঁদিকে না ডানদিকে? জুতোর আওয়াজও আর শুনতে পাচ্ছি না, সে কি জুতো খুলে ফেলল পা থেকে? নাকি অন্ধকারে কোনও বাড়িতে চট করে ঢুকে পড়েছে? আমি গলির মুখটায় একটা বাড়ির দেওয়ালে পিঠ দিয়ে রিভলবার উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, কি করব, ফিরে যাব? ফিরতে গেলে পেছন থেকে আততায়ী এসে আমাকে গুলি করে দিতে পারে পেছনে আততায়ী রেখে ফিরে যাওয়াটা বুদ্ধিমান গোয়েন্দার কাজ নয়। দু এক মিনিট দাঁড়িয়ে ভাবলাম। বেশিক্ষণ ভাবার সময় কোথায়? এখানে এভাবে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ আততায়ীকে বেশি সুযোগ দেওয়া। সেও নতুন কৌশল ভেবে আমাকে আক্রমণ করবে। তার ওপর সে এই অঞ্চলের ছেলে, এখানকার সমস্ত গলি ঘুপচি তার নখদর্পণে। তাছাড়া যে কোনও বাড়িতে সে সুযোগমত ঢুকে পড়তে পারে, তারপর জানালা দিয়ে বা দরজার কোণে লুকিয়ে থেকে আমাকে গুলি করার সুযোগ নিতে পারে। আবার ঝট করে এখান থেকে বেরতেও পারছি না। বাঁ না ডান, গলির কোন দিকে সে আছে? হঠাৎ বাঁ দিকে জুতোর আওয়াজ পেলাম। শুনশান রাতে সেই অল্প শব্দটাই ভয়ঙ্কর হয়ে কানে বাজল। সারা কলকাতা ঘুমচ্ছে। এখানে ডুয়েল লড়ব আমি আর সেই ছেলেটা। পৃথিবীর কেউ তা জানে না, দেখছে না। পটলডাঙার মোড় থেকে হঠাৎ পরপর দুটো বোমার আওয়াজ পেয়ে বোধহয় কিছুটা চঞ্চল হয়েছিল। জুতোর খটমট শব্দ শুনেই আমি রিভলবার উঁচিয়ে নিমেষে বাঁ দিকের গলির মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়েই দেখি ছেলেটা হাত পাঁচেক দূরে রিভলবার উঁচিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে আছে। এবার দুজনে দুজনের মুখোমুখি, সামনাসামনি। কারও পালানর পথ নেই, হয় আমি মরব, নয়তো সে। অন্ধকারে দুটো ছায়ামূর্তি। দুজনেই একসঙ্গে গুলি ছুঁড়লাম। ছেলেটা আর্তনাদ করে টলতে টলতে পড়ে গেল। তার হাত থেকে খসে গেল রিভলবার। আমি দাঁড়িয়ে আছি। ছেলেটার রিভলবার থেকে খট করে একটা আওয়াজ হয়েছিল শুধু, গুলিটা খারাপ ছিল, ফাটেনি। আর দ্বিতীয়বার ট্রিগার টেপার আগেই আমার রিভলবারের গুলি তার শরীর ছুঁয়ে ফেলেছে। ধাতস্থ হয়ে, আস্তে আস্তে ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলাম। কে এই ছেলেটা যে আমাকে মারতে চেয়েছিল? অন্ধকারে আমি ঝুঁকে পড়ে তার মুখটা দেখলাম। দেখেই চমকে উঠলাম, এ তো শেখর, নকশাল নেতা শেখর গুহ। যাকে আমরা অনেকদিন ধরে খুঁজছি। ডানহাতটা তুলে নাড়ি দেখলাম, কোনও সাড়া নেই, মনে হচ্ছে বেঁচে নেই। নাকের সামনে হাত নিলাম, নাঃ প্রাণের কোনও স্পন্দনই নেই। ওর রিভলবারটা তুলে নিয়ে পেছন ফিরলাম।

আশ্চর্য, কেউ কোথাও নেই। এত সরু গলির ভেতর গুলির শব্দে কোনও বাড়ির একটা জানালা থেকেও কেউ উঁকি মেরে দেখল না, এখানে কি হয়ে গেল। তখন কলকাতার মানুষ বোমা, গুলির শব্দে এত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে বিশেষ কোনও ভাবান্তর হত না। এই রাতে বিছানা ছেড়ে কে উঠে দেখবে গলির ভেতর কি ঘটছে? অথচ ওরাই পরের দিন, গল্প আর গল্পের শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে গুজব ছড়িয়ে ছড়িয়ে বলতে থাকবে, “এই” ঘটনাটা “এই” ভাবে হয়েছে, আমি তখন “এই” করছিলাম, একদম চোখের সামনে ঘটনা ঘটল। আর সেই গল্পই প্রচার হয়ে এমন একটা আকার ধারণ করবে যে ওদের মিথ্যা গুজবটা একদিন সত্যে পরিণত হবে। এবং সত্যে পরিণত হওয়ার পর সাধারণ মানুষ সেই কথাটাই বিশ্বাস করবে। না, দোষ দিচ্ছি না, কে আর গোলাগুলির সামনে এসে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘটনার সাক্ষী হতে চায়? তার ওপর ওই গভীর রাতের অন্ধকারের ভেতর। আমি পটলডাঙার মোড়ে আমার সঙ্গীদের ডাকতে চললাম।

সত্যি কথা বলতে কি এভাবে কাউকে আমি মারতে চাইনি। এমনকি বহু খুনের ফেরারী নকশাল নেতা শেখরকেও নয়। কিন্তু উদ্যত রিভলবারের সামনে পরস্পরের মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে দাঁড়িয়ে দুজনের যে কোনও একজনকে মরতেই হত। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমি মরিনি, সে মারা পড়ল। আমার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত কোন শত্রুতা তো ছিল না যে তাকে আমি গুলি করে মারব।

লালবাজারে বসে দুচারদিনের অনুসন্ধানেই জানতে পারলাম, শেখরই আমাকে মারার জন্য রামকান্ত মিস্ত্রি লেনে মিটিংয়ের খবর পাঠিয়ে ফাঁদ পেতেছিল। বোমা মেরে আমাকে উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল। সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় সে পরদিনই আমার সোর্স বাবুরামকে খুন করেছিল। কিন্তু তারপরও সে চুপ করে বসে থাকেনি, আবার আমাকে খুন করার ছক কষতে শুরু করেছিল। এবার মিটিংয়ের খবর না পাঠিয়ে গোপন আস্তানার খবর পাঠিয়েছিল, যাতে আমি ওদের ওখানে হানা দিয়ে গ্রেফতার করতে যাই। এই ছকে শেখর সফল প্রায় হয়েই গিয়েছিল। আর একটু ধৈর্য ধরে থাকতে পারলেই আমি ওদের ঠিক করা বাড়িতে ঢুকে যেতাম। বোমার আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে রামকান্ত মিস্ত্রি লেনেই শুয়ে থাকত আমার শরীর। কিন্তু হাতের কাছে শিকার পেয়ে, সেটা ফস্কে যাওয়ার আশঙ্কায় ওদের মধ্যে কেউ ধৈর্য হারিয়ে প্রথম বোমাটা ছুঁড়ে দিয়েছিল। প্রথম বোমাটা যখন ছোঁড়া হয়েই গেছে, তখন আর অপেক্ষা করা অর্থহীন ভেবে পরপর ওরা আমাদের লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু প্রথম বোমাটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হতেই আমরা দ্রুত তিনতলা বাড়িটার মধ্যে ঢুকে শেলটার নিয়েছিলাম।

আর দ্বিতীয়বার শেখর ব্যর্থ হল নিজেরই ভুলে। যখন আমাকে ফাঁদে ফেলে গলির পর গলিতে ঢুকিয়ে নিয়ে গেল তখন কেন সে একা আমাকে খুন করার দায়িত্ব নিল? তার সঙ্গে আরও দুতিনজনকে নিতে পারত। হয়ত সেই পরিকল্পনাই সে করেছিল, কিন্তু আমাদের তাড়ায় তার সঙ্গীরা এদিক ওদিক ছিটকে যায়। ফলে আমি আর শেখর ডুয়েল লড়াইয়ে নামতে বাধ্য হই। কিন্তু তার ভাগ্য খারাপ, রিভলবারের গুলিটা ফাটল না, পরিস্থিতি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল। আমি অক্ষত রইলাম, শেখর শুয়ে পড়ল।

এভাবে বহুবার আমি ও আমার আরও অনেক সহকর্মী বেঁচে গেছি। কিন্তু এতবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও কখনও আমরা ভয়ে পালিয়ে যাইনি। বরং প্রতিবারই নতুন জীবন পেয়ে নতুন উদ্যমে আবার যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছি। যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে মৃত্যুর মুখোমুখি তো দাঁড়াতেই হবে, মৃত্যুও বরণ করে নিতে হবে। এটা চিরকালের সত্য। নকশালরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করেছিল, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার ইচ্ছায়। আর যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তারা “বিপ্লব” শুরু করেছিল, তার ক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন তাঁরা নিশ্চয়ই “বধূবরণের” মত তাঁদের বরণ করে নিজেদের ক্ষমতা তাদের হাতে দিয়ে বাড়ি চলে যাবেন না। তাঁরা তাঁদের রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগ করে অভ্যুত্থান বা বিপ্লব দমন করবেন, এটাই নিয়ম, এটাই প্রক্রিয়া। আর ক্ষমতাহীন রাষ্ট্র পরিচালকরা রাষ্ট্রের রক্ষীবাহিনীকে দিয়েই বিপ্লব কিংবা বিদ্রোহকে দমন করে। সুতরাং রক্ষীবাহিনীর অনেককে যেমন মৃত্যুবরণ করতে হয়, তেমনি যারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ইচ্ছায় যুদ্ধ শুরু করে তাদেরও মৃত্যুকে স্বীকার করে নিতে হয়। আমরা যারা রাষ্ট্রের রক্ষীবাহিনীতে চাকরি করি, তারা পালাই কি করে? যদি পালিয়েই যেতাম, তবে কি সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কাজের দায়িত্বে থেকে সেই কাজটা না করার অভিযোগে অভিযুক্ত হতাম না? তাঁদের সাথে সেটা কি বিশ্বাসঘাতকতা হত না? আমরা যারা প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নকশালদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বাধ্য হয়েছিলাম, তারা কিন্তু কখনও মা-বাবা, স্ত্রী, পরিজনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করেনি। আমাদের যেসব সহকর্মী সেদিন নকশালদের হাতে খুন হয়েছিলেন, সরকার কিন্তু তাঁদের পরিবারের জন্য প্রায় কিছুই করেননি। জানি, আমরা মারা গেলেও আমাদের পরিবার একইভাবে ভেসে যেত। তবু আমরা পালিয়ে যাইনি, দায়িত্ব এড়িয়ে যাইনি। সেই সময় কলকাতা পুলিশের কমিশনার রঞ্জিত গুপ্ত, রবীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি ও সুনীল চৌধুরীর দক্ষ নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ চালিয়েছি। দিন নেই, রাত নেই, কখনও লালবাজারে, কখনও রণক্ষেত্রে। বাড়ির লোকেরা আতঙ্কে দিন কাটাত, বেঁচে আছি শুধু এটুকুই জানত, খুন হলে তো খবর আসবেই!

গোখনারা আমার জন্য ফাঁদ পেতে সারারাত অপেক্ষা করল, আমিও গেলাম না, লালবাজার থেকে সেদিন অন্য কেউও গেল না। ভোরবেলা ওরা মন খারাপ করে চলে গেল। ট্রেঞ্চ কাটার পরিশ্রমই মাঠে মারা গেল। সকালে স্থানীয় লোক মাটি ফেলে ট্রেঞ্চগুলো বন্ধ করে দিলে আবার গাড়ি চলাচল শুরু হল।

সিঁথি অঞ্চলে নকশালদের নেতৃত্ব দিত শ্যামল চৌধুরী, ডি. চক্রবর্তীরা। কিন্তু ওই সব অঞ্চলে ওদের পার্টির দায়িত্বে থাকা সোমনাথ ও দিলীপ ব্যানার্জিই ছিল আসল নেতা। এরা সিঁথিতে থাকত না, অন্য অঞ্চলে আত্মগোপন করে থাকত। পার্টির নির্দেশ এদের মাধ্যমেই আসত। ওরা একাত্তরের জুলাইয়ের শেষদিকে গোখনাদের বলল, “শুধুমাত্র সি. পি. আই (এম)এর বিরুদ্ধে লড়াই করলেই চলবে না, কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও আমাদের লড়াই করতে হবে। ওরাও আমাদের সমান শত্রু।” আর নকশালদের লড়াই মানেই খুন। এতদিন অন্য অঞ্চলে কংগ্রেসী নেতাদের নকশালরা খুন করলেও সিঁথির নকশালরা কিন্তু কংগ্রেসীদের ওপর খুব একটা হামলা চালায়নি। গোখনারা নেতাদের নির্দেশ মত ক্যুরিয়ার ডলির মারফৎ চারদিকে খবর পাঠিয়ে দিল। কংগ্রেসী নেতাদের গতিবিধির খবর নিতে হবে আগে।

খবর আসতে লাগল, কিন্তু সবই ছোটখাটো কর্মীদের। গোখনাদের ঠিক মনঃপূত হচ্ছিল না। দুএকদিনের মধ্যে সৎচাষী পাড়ার বাবলু আর স্বপন গোখনাদের খবর দিল, কংগ্রেসের নেতা নির্মল চ্যাটার্জি প্রতিদিন সন্ধেবেলা কাশীপুর রোড ও রতনবাবু রোডের সংযোগস্থলে নবজীবন সংঘের কাছে চায়ের দোকানে আসেন। ওখানে বসে আড্ডা দেন, গল্পগুজব করেন, লোকজনের সঙ্গে দেখা করেন। নির্মল চ্যাটার্জি ওই এলাকার খুবই জনপ্রিয় “ন্যাচারাল লিডার” ছিলেন। গোখনারা এবার শিকার পেয়ে গেল।

স্বপন ও বাবলুকে নিয়ে তারা আগস্টের প্রথমে একদিন সন্ধেবেলায় চায়ের দোকানে বসা নির্মল চ্যাটার্জিকে দূর থেকে দেখে এল। তারপর খুনের পরিকল্পনা শুরু করল। একাত্তর সালের বারই আগস্ট সন্ধে সাতটা নাগাদ গোখনা, শঙ্কু, বাপী, চিটকে, কেলো আলাদা আলাদা ভাবে নবজীবন সংঘের কাছে জড় হল। প্রত্যেকের কাছেই রয়েছে বিভিন্ন রকম আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা, ছুরি, চপার ইত্যাদি। ওদিকে নির্মলবাবু নিশ্চিন্তে চা খেতে খেতে আড্ডা মারছেন। হঠাৎ পরপর গুলির আওয়াজ, বোমা পড়ছে, নির্মলবাবু কিছু বোঝার আগেই চায়ের দোকানের সামনে লুটিয়ে পড়লেন। লোকজন সব ভয়ে পালিয়ে গেল। নকশালরা স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহে আরও দুবার গুলি করে ছুটে পালিয়ে গেল।

নকশালরা চলে যেতেই চারদিক থেকে হৈ হৈ করে লোকজন এসে পড়ল। নির্মলবাবুর দেহ দেখে থমকে দাঁড়াল জনতা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা, নির্মলবাবু নেই, শুধুমাত্র প্রাণহীন দেহটা পড়ে আছে তাঁর সাধের নবজীবন সংঘের সামনে।

নির্মলবাবুর মৃত্যুসংবাদে কাশীপুর-সিঁথি অঞ্চলে জনগণের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিল। শত ঘোষের নেতৃত্বে কংগ্রেস কর্মীরা কাশীপুর থানায় গিয়ে পুলিশের “নিষ্ক্রিয়তার” অভিযোগ তুলে তুমুল হট্টগোল করল। কিন্তু আসল ঘটনা ঘটল তার পরদিন। অতীতের কংগ্রেস নেতা গণপতি শূরের ছেলের নেতৃত্বে শত ঘোষের দলের লোকেরা ও নবজীবন সংঘের ছেলেরা শ্রীচক্রবর্তীর পরিচালনায় সাধারণ মানুষকে ডাক দিল নিজেদের হাতে আইন তুলে নেওয়ার জন্য। কাশীপুর-সিঁথি অঞ্চলে শুধু নকশাল বা তাদের পরিবার নয়, নকশাল মনোভাবাপন্ন তরুণ ও সমর্থকদের ওপরও ব্যাপক হামলা শুরু হল। সি. পি. আই (এম) ক্যাডারদেরও মারধর করল কংগ্রেসীরা। নকশাল সন্ত্রাসে ওই এলাকার মানুষজন এমনিতেই অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল, ফলে কংগ্রেসীদের ওই হামলাকে তারা পূর্ণ সমর্থন তো জানালই, এমনকি তারা নিজেরাও “নকশাল তাড়াও, নকশাল মার” স্লোগানে মেতে উঠল। মানুষ “গণধোলাইয়ে” সামিল হয়ে ব্যাপক সন্ত্রাস সৃষ্টি করল। সেই ঢেউ বরানগর অঞ্চলেও আছড়ে পড়ল। আর সেখানে কংগ্রেসীদের সাথে হাত মিলিয়ে সি. পি. আই (এম) ক্যাডাররা নকশালদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদের এলাকা থেকে তাড়াতে লাগল। বেশ কিছু নকশাল সমর্থক তরুণ কাশীপুর -সিঁথি-বরানগরের এলাকায় কংগ্রেস-সি. পি. আই. (এম) এবং সাধারণ মানুষের সশস্ত্র হামলায় মারা গেল। এই অভিযান দুদিন ধরে চলেছিল।

যারা এই গণরোষের শিকার হয়েছিল, তার মধ্যে একমাত্র বাবলু বিশ্বাস ছাড়া আর কেউ কট্টর নকশাল ছিল না। সেই চোদ্দ পনের জন ছেলে অল্পবিস্তর নকশাল সমর্থক ছিল হয়ত। কিন্তু যাদের কার্যকলাপে সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি হয়েছিল, তারা ঠিকই নিজেদের লুকিয়ে রাখল গোপন আস্তানায়। পরবর্তীকালে যেসব নকশাল নেতা কুম্ভীরাশ্রু ঝরিয়েছে, তারাই কি ওই সব নকশাল সমর্থক তরুণদের মৃত্যুর জন্য প্রকৃত অর্থে দায়ী নয়? তাদের কর্মফলই কি নিরপরাধ যুবকদের ভোগ করতে হয়নি? তাদের “ব্যক্তিহত্যার রাজনীতির” পরিণতি হিসেবেই কি দেখা যায়নি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পাল্টা সন্ত্রাস? জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু ভবঘুরে লুম্পেনের কীর্তিকলাপের জন্যই কি এই অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি? আর ওই সব লুম্পেনদের তাণ্ডবকে যারা “রাজনৈতিক মতাদর্শের” মুখোশ পরিয়ে “বিপ্লবী কর্মকাণ্ড” বলে চালাতে চাইছিল, তারা কি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে কোনদিন সচেতন ছিল? তারাই কি কাশীপুর-সিঁথি-বরানগরের দাঙ্গার জন্য দায়ী নয়? আগামী দিনের ইতিহাস কিন্তু তাদের কখনও ক্ষমা করবে না। আজ বিংশ শতাব্দীর শেষে যতই গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে ভোটের বাজার তারা মাত করার চেষ্টা করুক না কেন, যতই দেশ আর জনগণকে প্রতারণা করে নিজের পিঠ বাঁচিয়ে তথাকথিত প্রগতিশীলতার ঢাক বাজাক না কেন তারা, ইতিহাসের চাকাকে নিজের অনুকূলে কখনও কেউ আনতে পারেনি, আগামীদিনেও পারবে না। এই আদিম সত্যটাকে অস্বীকার করবে কে? মৃত্যুর কারবারীরা নিজের মৃত্যু দেখে ভয় পাবে কেন?

নির্মল চ্যাটার্জিকে খুন করে নকশালরা নিজেদের ফাঁদে নিজেরাই জড়িয়ে পড়েছিল। নির্মল চ্যাটার্জি কাশীপুর অঞ্চলে এত জনপ্রিয় ছিলেন যে কংগ্রেসীরা তাঁর মৃত্যুকে পুরোপুরি কাজে লাগাল। ওই অঞ্চলের জনসাধারণকে নকশালদের বিরুদ্ধে তাতিয়ে তুলতে তাদের কোনও অসুবিধাই হয়নি। নির্মলবাবু মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তিনি কখনও রাজনৈতিক দলের ছাপ দেখে মানুষকে বিচার করতেন না, সবার পাশেই দাঁড়াতেন। ফলে তাঁর খুনটাই নকশালদের বিপক্ষে সাধারণ মানুষকে লেলিয়ে দেওয়ার প্রকৃষ্ট পন্থা হিসাবে কংগ্রেসীরা নিয়েছিল। আর সেই আবেগে এলাকার মানুষ ভেসে গিয়ে বেশ কিছু নকশাল সমর্থক তরুণকে হত্যা করে, এলাকা ছাড়া করে দিল। সেই গণ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রথমেই পুলিশের আরও শক্ত হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু প্রথমদিকে পুলিশও দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। সেই ভাবটা কাটিয়ে প্রচণ্ড লড়াই করে দুদিনের মধ্যে গণরোষকে স্তিমিত করা গেল। কলকাতা পুলিশ কখনও চায়নি সাধারণ নাগরিক নিজের হাতে আইন তুলে নিক, কারোকে হত্যা করুক। তাই কলকাতা পুলিশ নিজেদের এলাকা ঘিরে রেখেছিল, দুর্ঘটনা যা ঘটার তা প্রায় সবই হয়েছিল কলকাতা পুলিশের এলাকার বাইরে। বেদিয়া পাড়ায় বাপী, গোখনা, পুতুলেরা একটা বহু পুরনো বাড়িতে আস্তানা গেড়েছিল। সেখানে একরাতে আমরা অতর্কিতে হানা দিলাম। পালানর সময় পুরনো বাড়ির পাঁচিল ভেঙে বাপীর ডান পা জখম হল। গোখনারা বাপীকে নিয়ে ওখান থেকে পালিয়ে গেল। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিন্যুয়ের একটা নার্সিং হোমে রেখে এল তাকে।

একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই সিঁথি অঞ্চলে নকশালদের শক্তি ক্রমশ কমে আসছিল। কিন্তু তখনও ওরা মাঝেমধ্যে নানা জায়গায় হানা দিতে লাগল। আমরা অভিযান চালালেই ওরা রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে রেল লাইন পার হয়ে দমদমের দিকে চলে যেত। আবার আমরা ফিরে গেলে ক্যুরিয়ার মারফৎ খবর নিয়ে ফিরে আসত সিঁথি অঞ্চলে। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে আমরা ঠিক করলাম, যেভাবেই হক সিঁথির আসল হার্ডকোর নকশালদের ধরে ওই অঞ্চলে তাদের রাজত্ব বন্ধ করব।

তিরিশে সেপ্টেম্বর বেদিয়া পাড়া, রায় পাড়া ঘিরে ফেললাম। রেল লাইন পার হয়ে যেদিক দিয়ে নকশালরা পালায় সেদিকে থমসন মেশিন গান নিয়ে লাহিড়ী আর রাজকুমার চ্যাটার্জি অন্যান্যদের সাথে একটা কাঠগোলায় লুকিয়ে রইল। ওরা দুজন সিঁথি দিয়ে না গিয়ে দমদমের দিক দিয়ে চাদরের ভেতর মেশিন গান নিয়ে ওখানে গেল। আমরা সিঁথির মূল রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলাম। আমার সঙ্গে সেদিন ছিলেন আরও কয়েকজন অফিসার ও সেপাই, তাছাড়া ছিলেন পরবর্তীকালের আই. পি. এস অফিসার রজত মজুমদার। তিনি তখন পুলিশেই চাকরি করতেন না। একটা বিশেষ মামলার সূত্রে তাঁর সঙ্গে লালবাজারের গোয়েন্দা দফতরের অনেক অফিসারের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তিনি একটু অ্যাডভেঞ্চারাস্ ধরনের ছিলেন, তাই যখন শুনলেন আমরা ওই রাতে সিঁথিতে নকশালদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযানে যাচ্ছি, তিনিও জোর করে আমাদের সঙ্গী হয়ে গেলেন। গুলিগোলার মধ্যে তাঁকে যেতে আমরা অনেক নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু তিনি কোন কথাই কানে না তুলে আমাদের গাড়িতে উঠে বসলেন।

আমরা তল্লাশি করে করে এগিয়ে চলেছি, রাত প্রায় দুটো নাগাদ একটা গলির ভেতর থেকে একটা ছেলে আমাদের দিকে পরপর দুটো বোমা ছুঁড়ে মারল। আমাদের গাড়ির কিছু হল না। ছেলেটা বোমা ছুঁড়েই গলির ভেতর পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তেই আমাদের সেপাইদের রাইফেল গর্জে উঠল। ছেলেটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আমরা তাড়াতাড়ি ছুটে গেলাম। চিনতে পারলাম না। বুলেট তার শরীর ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। পরে জেনেছিলাম তার নাম বেনু, হার্ডকোর নকশাল। বহু অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। সে যদি না তার আস্তানা থেকে বেরিয়ে আমাদের বোমা নিয়ে আক্রমণ করত, তবে ওইভাবে মারা পড়ত না। মৃত্যুই বোধহয় তাকে টেনে এনেছিল, নয়ত কেউ শুধু দুটো বোমা নিয়ে এত বড় ফোর্সের বিরুদ্ধে লড়তে আসে?

আমরা আরও এগিয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু না, কোন নকশাল ডেরা থেকে বেরই হল না, কারোকেই গ্রেফতার করতে পারলাম না। দমদমের দিকে রেল লাইন পার হয়ে কেউ পালানর চেষ্টাও করল না। মনে হল, আমরা যে ওদের বিরুদ্ধে অভিযানে যাব এবং ওদের পালানর রাস্তাতেও যে আমরা পাহারা বসিয়ে রাখব, ‘সেই খবরটা ওরা আগেই পেয়ে গিয়েছিল, তাই আমরা আসার আগেই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল। এদিকে ভোর হয়ে আসছে, আমরা লালবাজারে ফিরে আসব ঠিক করেছি। হঠাৎ কেদারনাথ দাস লেনের একটা বাড়ির সদর দরজা খুলে গেল। আমাদের থেকে বাড়িটা পঁচিশ তিরিশ মিটার দূরে। দরজা খুলে প্রথমে বেরিয়ে এল একটা ছেলে, তার পেছন পেছন একটা মেয়ে। মেয়েটা ছেলেটার আড়ালে হাঁটছে। ছেলেটা আমাদের দেখেই একটু থমকে গিয়ে কোমরে গোঁজা রিভলবার চট করে বার করে গুলি চালাতে গেল। না, তার হাত ট্রিগারে পৌঁছনর আগেই আমাদের রিভলবার আর রাইফেলের গুলি ওকে বিদ্ধ করল। ছেলেটার হাত থেকে রিভলবার মাটিতে পড়ে গেল। মেয়েটা চিৎকার করে ওকে জাপটে ধরার চেষ্টা করল, পারল না। ছেলেটা মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে গেল। আমরা ততক্ষণে এগিয়ে গেছি। মেয়েটাকে আমার চেনা চেনা লাগছে। এই সেই আটাপাড়া লেনের মেয়েটা না, পুতুল? যার বাবা আর মাকে দেবীবাবু আর আমি গিয়ে অনুরোধ করেছিলাম, মেয়েকে আমাদের কাছে নিয়ে আসতে, যাতে আমরা বুঝিয়ে বলতে পারি আগুন নিয়ে না খেলে সাধারণ জীবনযাপন করতে? মেয়েটা তখন হাউমাউ করে কাঁদছে। গুলির আওয়াজে, মেয়েটার চিৎকারে, ওই বাড়ি থেকে এক ভদ্রলোক উকি দিলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, “ওই ছেলেটার নাম গোখনা তো?” ভদ্রলোক বললেন, “হ্যাঁ, কিন্তু মাপ করবেন, আমার বাড়িতে গতরাতে ওরা জোর করে ছিল, ভোরবেলা চলে যাবে বলেছিল, কথা মত বেরিয়েও যাচ্ছিল, সেই সময় এই কাণ্ড।” জানতাম, তখন নকশালরা নিজেদের সব গোপন ডেরা হারিয়ে বাধ্য হয়ে রাতের দিকে বিভিন্ন বাড়িতে জোর করে ঢুকে যেত, ভোরবেলায় বেরিয়ে আসত। অনেক সময় বাড়ির মেয়েদের বিছানায় ঢুকে পড়ত যাতে তল্লাশিতে ছাড় পেয়ে যায়। সেই রাতে গোখনারা ওই বাড়িতে ঢুকেছিল। আমরা ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বাড়ি তল্লাশি করলাম, পেলাম একটা রাইফেল, যা গোধনাই রেখেছিল।

পুতুলের কাছে এগিয়ে এলাম, বললাম, “চল, এখন লালবাজারে যেতে হবে।” গোখনার মৃতদেহ পোস্ট মর্টেমে পাঠিয়ে দিয়ে, পুতুলকে লালবাজারের সেন্ট্রাল লক আপে ঢুকিয়ে সেদিনের মত অভিযানের ইতি টানলাম।

গোখনা আর বেনু একই দিনে মারা যেতে সিঁথির হার্ডকোর নকশাল বাহিনী ভেঙে গেল। তার আগেই কংগ্রেসীদের আক্রমণে এবং কিছু কিছু জায়গায় সি. পি. আই (এম) ক্যাডারদের সহযোগিতায় অন্যান্য নকশালরা কেউ মারা গিয়েছিল, কেউ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। নকশাল আন্দোলন সিঁথি-কাশীপুর অঞ্চলে প্রায় বন্ধই হয়ে আসছিল। যারা বেঁচে ছিল তারাও এদিক ওদিক ছিটকে লুকিয়ে ছিল।

এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর বিপাশার ছোট বোনকে যে নকশাল ছেলেটা বিয়ে করেছিল, সেই কেলো একদিন বিপাশার বাবার কাছে পাঁচ হাজার টাকা দাবি করল। বিপাশার বাবা জামাইকে বললেন, “আমার কাছে অত টাকা নেই। তুমি যখন তখন আমার কাছে আসবে আর টাকা চাইবে, তা হতে পারে না।” কেলোর তখন মাথা আগুন, জুয়া খেলে সব হেরে শ্বশুরমশাইয়ের কাছে টাকা চাইতে এসেছিল। আবার জুয়া খেলতে যাবে, সে কোন কথা শুনতে নারাজ। ধমক দিয়ে বলল, “আমি কোন কথা শুনব না, এক্ষুনি আমার টাকা চাই-ই চাই।” ভদ্রলোক বোধহয় একটু রেগেই উত্তর দিয়েছিলেন, “নেই, বলছি তো নেই।” কেলো তার মুখের ওপর “এতবড় কথা” শুনে, বুকের ভেতর লুকনো রিভলবার বার করে ভদ্রলোকের মাথা লক্ষ্য করে ছটা গুলিই চালিয়ে দিল। ভদ্রলোক এতক্ষণ খেতে খেতে কেলোর কথার উত্তর দিচ্ছিলেন, লুম্পেন নকশাল জামাইয়ের হাতে গুলি খেয়ে থালার ওপরেই লুটিয়ে পড়লেন। শ্বশুরকে হত্যা করে কেলো ওখান থেকে পালাল। কিন্তু বেশিদিন সে পালিয়ে থাকতে পারেনি। শ্বশুর হত্যা মামলায় তার যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল।

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত নকশাল আন্দোলনের মত এত বড় ঝড় পশ্চিমবঙ্গ দেখেনি। আর আমাদের কাঁধে ছিল সেই ঝড়ের মোকাবিলা করার গুরুদায়িত্ব। এমন কোনও দিন বা রাত ছিল না, বোমা গুলির আওয়াজ ছাড়া কেটেছে। আমরা শুধু ছুটেছি আর ছুটেছি। পুরো বাহিনীই যন্ত্রের মত হয়ে গিয়েছিল। কখনও কখনও অবশ্য হঠাৎ থমকে যেত ছোটা, যখন আমাদের সোর্সগুলো ঠিকমত কাজ করত না। নকশালদের মধ্যে যেসব সমাজবিরোধী লুম্পেন ঢুকে পড়েছিল, তারাই ছিল আমাদের সোর্স। আসলে নকশাল পার্টিটা অনন্ত সিংয়ের দলের মত ঠাস বুনোট ছিল না। বরং ছিল অগোছাল, অপরিপক্ক, আলগা। তাই অনেক ভাল ভাল শিক্ষিত ছেলেমেয়ের সঙ্গে সমাজবিরোধীরাও পার্টিতে জায়গা করে নিয়েছিল। এইসব সমাজবিরোধীদের অনেককেই আমরা আগের থেকে চিনতাম। সোর্সগুলো খবর পাঠাতে ব্যর্থ হলে যেখানে সেখানে “ছাই” উড়িয়ে “অমূল্য রতন” খুঁজতে হত। শিকারীদের মত ফাঁদ পেতে বসে থাকতে হত। শিকারীরা ফাঁদ পাতে কোথায়? যেখানে তার শিকার আসার সম্ভাবনা আছে সেখানে। যেখানে তার কাঙ্খিত লক্ষ্যবস্তু হাতে আসতে পারে সেখানে। আমরাও আমাদের লক্ষ্যবস্তু আমাদের ফাঁদে পা দেওয়ার সম্ভাবনা যেখানে যেখানে আছে, সেইসব জায়গাতে ফাঁদ পেতে রাখতাম। সেই সব জায়গা কলকাতা আর তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল যেখানেই হোক না কেন। সেই সময় নকশালরা অনেক জায়গাকেই তাদের মুক্তাঞ্চল ভাবত। সিঁথি, বরানগর, বেলেঘাটার কিছু কিছু এলাকা এইসব মুক্তাঞ্চলের মধ্যে পড়ত। আসলে এখানকার অনেক বাসিন্দাই বোমা গুলির উৎপাত, অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাড়িঘর ছেড়ে অন্য নিরাপদ জায়গায় চলে গিয়েছিল। তারা অনেকেই আমাকে তাদের বাড়ির চাবি দিয়ে গিয়েছিল। আমার কাছে এমন এক-দেড়শ চাবি ছিল। এইসব অঞ্চল যেমন নকশালদের বিচরণভূমি ছিল তেমন আমাদেরও ছিল তাদের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ের যুদ্ধক্ষেত্র। এলাকায় সাধারণ নাগরিক নেই বললেই চলে, যুদ্ধক্ষেত্রের একেবারে আদর্শ পটভূমি। ওরা যেমন আমাদের গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করত, আমরাও পাল্টা আক্রমণ করতাম। আর যুদ্ধক্ষেত্রে যা হয়, দুপক্ষেরই ক্ষয়, এখানেও তাই হয়েছিল। আমিও আমার বহু সহকর্মীকে হারিয়েছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *