৪
দেবীবাবু আর মনাদার কাছ থেকেই আমরা সোর্স তৈরি করে তাকে কিভাবে লালনপালন করতে হয় তার বিশেষ কায়দা শিখেছি। যখন কাজের চাপ কম থাকত তখন মনাদার কাছ থেকে আমরা অতীতের গোয়েন্দাগিরির গল্প শুনতাম। তাঁরা কি কি উপায়ে জটিল সব কেসের সমাধান করেছেন, কিভাবে দুর্ধর্ষ আসামীদের গ্রেফতার করেছেন, সেইসব মন দিয়ে শুনতাম, শিখতাম। মনাদার কথা মনে পড়লেই এখনও শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। তখন দেবীবাবু আর মনাদাই ছিলেন গোয়েন্দা দফতরের প্রাণপুরুষ। তাঁদের যুগলবন্দিতে কঠিন কাজটাও সহজ হয়ে যেত। কোথায়, কোন স্তরে ছিল না তাঁদের সোর্স! আমরা যখন ষাটের দশকে গোয়েন্দা দফতরে এসেছিলাম, তার আগে তো বটেই, পরবর্তীকালেও আমাদের নিজস্ব সোর্স তৈরি করার আগে পর্যন্ত গোয়েন্দা বিভাগ প্রায় পুরোপুরি ওদের সোর্সের খবরের ওপর নির্ভরশীল ছিল। আমরাও তো আর চটজলদি একদিনেই সোর্সের জাল বুনতে পারিনি, ধীরে ধীরে একটু একটু করে গড়ে তুলেছিলাম। তখনও পর্যন্ত দেবীবাবু আর মনাদার সোর্সই ছিল সম্বল। মনাদা আমাদের প্রত্যেকের কাছেই ভীষণ প্রিয় ছিলেন। মনোরঞ্জন ব্যানার্জির নাম জানত না এমন কোনও ক্রিমিনাল কলকাতা বা তার আশেপাশে ছিল না। অথচ আমরা অবাক হয়ে দেখেছি, এরকম এক দক্ষ কর্মীর বিরুদ্ধেও কিভাবে হিংসার জ্বালায় বদনাম রটাচ্ছে পুলিশেরই কেউ কেউ। তখনকার দিনে সাংবাদিকরা কুৎসা রটনার ব্যাপারে এত উৎসাহী ছিলেন না বলে মনাদা আক্রমণের হাত থেকে বেঁচে গেছেন। মনাদা অবশ্য ওই সব গুজব রটনাকে আমলই দিতেন না। নিজের মত নিজের কাজ নিয়েই থাকতেন। যেমন পূর্ববাংলার ভাষাটা তিনি কোনদিনও ত্যাগ করেননি, ঠিক তেমনি কাজের বেলাতেও কোনদিন অবহেলা করেননি।
সেই মনাদাই হঠাৎ একদিন বিপাকে পড়ে গেলেন। আর বিপাক বলে বিপাক! তখন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর তার আশেপাশে সমাজবিরোধীদের একটা দল খুব সক্রিয় হয়েছিল। মাঠে যেসব প্রেমিক প্রেমিকা মশগুল হয়ে গল্পগুজব করত, ওই গুণ্ডারা তাদের কাছে এসে নানারকম ভয় দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে টাকাপয়সা আদায় করত। তাদের দৌরাত্ম্যে প্রেমিক প্রেমিকারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। গোয়েন্দা বিভাগ থেকে ঠিক করা হল ‘ওই সব সমাজবিরোধীদের হাতে নাতে ধরা হবে। সেই অনুযায়ী তিনজন করে পুরুষ ও মহিলা পুলিশ অফিসারকে প্রেমিক প্রেমিকা সাজিয়ে ভিক্টোরিয়ায় পাঠান হত রোজ। সমাজবিরোধীরা তাদের কাছে এসে টাকাপয়সা চাইলেই হাতেনাতে গ্রেফতার করা হত। এইভাবে বেশ কজনকে ধরা হলেও অত্যাচার কিন্তু চলতেই লাগল। এদিকে আমাদের অভিযানও অব্যাহত রইল।
একদিন মনাদার ওপর প্রেমিক সাজার দায়িত্ব পড়ল। তাঁর সঙ্গে মহিলা অফিসার শোভা দেবীর প্রেমিকা সাজার ডিউটি। মনাদা ও শোভা দেবী অন্য দুজোড়া প্রেমিক প্রেমিকা অফিসারের সঙ্গে লালবাজার থেকে বিকেলে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় মনাদা দোকান থেকে একটা লাল গোলাপ কিনে নিয়ে গেলেন, যাতে জমিয়ে ‘প্রেম প্রেম’ খেলাটা করা যায়। ভিক্টোরিয়ার কাছে এসে আলাদা হয়ে এক এক জোড়া এক এক দিকে গেলেন। মনাদা ও শোভা দেবী ভিক্টোরিয়ার মাঠে ঢুকে একটা গাছতলায় মুখোমুখি বেশ গুছিয়ে বসলেন। মনাদা গোলাপ ফুলটা ঘাসের ওপর রেখে একটা সিগারেট ধরালেন। বললেন, “এ বয়সে কি আর এইসব পোষায়?” মনাদার বেশ বলিষ্ঠ চেহারা ছিল। তিনি বেশিরভাগ সময়ই হাফহাতা জামা পরতেন। সেদিনও তাই-ই পরেছিলেন। তবু পঞ্চাশ বছর পার, বয়সের একটা ছাপ তো পড়বেই। শোভা দেবীরও মোটামুটি বয়স হয়েছিল। বয়স্ক প্রেমিক প্রেমিকার অভিনয়ে তাঁদের বেশ সুন্দর মানিয়েও গিয়েছিল। হয়তো দূর থেকে ছেলে ছোকরারা তাঁদের দেখলে মন্তব্যও করছিল, “বুড়ো বয়সের ভীমরতি।” মনাদা সিগারেটটা শেষ করে টুকরোটা দূরে টস করে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “আপদগুলান কি ঝামেলা যে পাকাইল, অখন মাঠে আইসা বইসা থাক।” শোভা দেবী বললেন, “ভালই তো, এমনিতে তো আর মাঠে আসেন না, এই সুযোগে একটু অক্সিজেন টেনে নিন।” মনাদা উত্তরে বললেন, “অক্সিজেন না ছাই, কেউ যদি আমাগো দেইখ্যা ফেলে তখন কি হইবো।”
মনাদা এবার হাতে গোলাপ ফুলটা তুলে নিলেন, তারপর মাস্তানদের তাড়াতাড়ি কাছে টানার জন্য শোভা দেবীর গালে গোলাপফুলটা বোলাতে লাগলেন। ভালই জমেছিল, হঠাৎ তড়াক করে উঠে “আমি না, আমি না” বলে ছুটতে শুরু করলেন মনাদা। শোভা দেবী ওই ছোটাটাকে অভিনয়ের বিশেষ কৌশল ভেবে মনাদার পেছন পেছন, “ওগো কি হল গো, এমন করে ছুটছ কেন, বল না, কি হল তোমার” বলতে বলতে ছুটতে লাগলেন। মনাদা তবু বলেই চলেছেন, “আমি না, আমি না।” শোভা দেবীও হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “আরে থাম, এমন কোর না, আমি যে আর ছুটতে পারছি না।”
মনাদা ছুটতে ছুটতে বেশ খানিকটা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, গোলাপ ফুলটা তখন কোথায় পড়ে গেছে। শোভা দেবীও ছুটে মনাদার কাছে পৌঁছলেন, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওঁদের সামনে হাজির, না, কোন গুণ্ডা নয়, দুজন ভদ্রমহিলা। সঙ্গে এক যুবক। ভদ্রমহিলাদের মধ্যে একজন মধ্যবয়স্কা, অন্যজন অল্পবয়সী, সম্ভবত সঙ্গের যুবকের স্ত্রী। শোভা দেবী কোনমতে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বললেন, “আরে আমাকে ফেলে ছুটছ কেন?” মনাদা শোভা দেবীকে প্রায় ধমকের সুরে বললেন, “চুপ করেন তো।” শোভা দেবী তখনও অভিনয়ের ঘোরেই রয়েছেন। অবাক হয়ে একটু কান্না কান্না ভাব করে বললেন, “সে কি তুমি আবার আমাকে আপনি আপনি করে কথা বলছ কেন?” মনাদার তখন নিজের মাথার চুল টেনে ছেঁড়ার অবস্থা। মধ্যবয়স্কা ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে বললেন, “শোভা, ইনি আমার স্ত্রী, আর এরা আমার শালা আর শালার বৌ।” মনাদার কথা শুনে শোভা দেবী ভীষণ লজ্জায় পড়ে গিয়ে দুহাত জড়ো করে বললেন, “তাই? নমস্কার বৌদি।” মনাদার স্ত্রী মানে আমাদের বৌদির মাথায় তখন আগুন, শোভা দেবীর দিকে সেই আগুন চোখ ছিটিয়ে দিয়ে মনাদার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আজ বাড়ি এস, দেখছি। ছি ছি, ডিউটির নাম করে এসব করে বেড়ান হচ্ছে। রোজ সকালে বেরনর সময় ভাত দিতে একটু দেরি হলে বল, তাড়াতাড়ি দাও, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিসের দেরি তা তো বুঝতেই পারছি। বাড়ি চল, বুড়ো বয়সের ভিমরতি আজ আমি ছাড়াচ্ছি।”
শোভা দেবী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন, মনাদা বৌদিকে বোঝানর চেষ্টা করে যাচ্ছেন, “বিশ্বাস কর, এটা আমাগো ডিউটি, ইনিও পুলিশ অফিসার, আরও কজন আশে পাশেই আছে।” কিন্তু বৌদি কোনও কথাই শুনছেন না। বললেন, “ছাড়, কি ডিউটি তা তো আমি বুঝতেই পারছি। ভাগ্যিস ভাই আজ বাড়ি এসে বলল, চল দিদি একটু ভিক্টোরিয়ার দিকে বেড়িয়ে আসি, আমিও ওর কথায় রাজি হলাম। নয়তো জানতেই পারতাম না ডুবে ডুবে কত জল খাও তুমি।” শোভা দেবী মনাদার অবস্থাটা বুঝে বৌদিকে বোঝানর চেষ্টা করলেন, “বিশ্বাস করুন বৌদি, সত্যিই আজ আমাদেব এখানে ডিউটি পড়েছিল।” কিন্তু কে কার কথা শোনে, বৌদি ভাই, ভাইয়ের স্ত্রীকে নিয়ে গজরাতে গজরাতে এগিয়ে যেতে লাগলেন। মনাদা বৌদিকে শান্ত করার শেষ চেষ্টা করলেন, ছুটে গিয়ে পেছন থেকে বললেন, “শুনছ, তোমরা কিছু খাইবা?” বৌদি মনাদার কথার কোনও উত্তর তো দিলেনই না, এমন কি পেছন ফিরে তাকালেনও না পর্যন্ত। যেমন হাঁটছিলেন, তেমনভাবেই চলে গেলেন।
অগত্যা মনাদা আর শোভা দেবী গুটিগুটি লালবাজারে ফিরে এলেন। বিধ্বস্ত মনাদা অফিসে এসে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। অন্য দুজোড়া অফিসার যাঁরা মনাদার সঙ্গে ভিক্টোরিয়ায় গিয়েছিলেন, তাঁরা তখনও ফেরেননি। শোভা দেবী তাঁর ঘরের দিকে চলে গেছেন। মনাদা চেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “এ হালার ডিউটি আর করুম না, বুড়া বয়সে কি উৎপাত।” আমরা কয়েকজন অফিসার ওখানে ছিলাম, বুঝলাম, বিশেষ কিছু একটা হয়েছে, নয়তো মনাদার মত ডিউটি অন্ত প্রাণ মানুষের মুখ থেকে ওই রকম কথা বেরবে এটা ভাবাই যায় না। আমাদের মধ্যে থেকে একজন মনাদাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন মনাদা কেউ কি আপনাদের দেখে আওয়াজ দিয়েছে?” মনাদার গলাটা প্রায় খুঁজে এল, “আওয়াজ ফাওয়াজ না, তার জন্য তো রেডিই ছিলাম, এ তার চেয়ে অনেক বড় বিপদ।” আমি প্রশ্ন করলাম, “কিসের বিপদ?”
এতক্ষণে মনাদা খাঁটি মাতৃভাষা ফিরে পেলেন, “আর কইয়ো না, যাওনের সময় আমি একটা গোলাপফুল কিইন্যা লইয়া গেছিলাম। তা ভিক্টোরিয়ার একটা গাছের তলায় আমি আর শোভা গিয়া বইস্যা রইছি, বদমাইসগুলান যাতে তাড়াতাড়ি আইসা আমাগো ধরে তার জইন্য আমি শোভার গালে ফুল বুলাইতে লাগলাম, হঠাৎ মুখ তুইল্লা দেখি কি সামনেই তোমাগো বৌদি!” আমি বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলাম, “বৌদি, ওখানে?” মনাদা হতাশ স্বরে বললেন, “হ, নয়ত আর কইলাম কি? তার ভাই, ভাইয়ের বৌয়ের লগে আর জায়গা পায় নাই ওইখানেই বেড়াইতে গেছে। ওগো দেইখ্যাই আমি আর কোনও দিকে না তাকাইয়া দৌড় দিছি, শোভা ভাবছে আমার দৌড়টাও বোধহয় অভিনয়, সেও ওগো শুনছ, ওগো শুনছ, পলাইও না, পলাইও না কইরা বকতে বকতে আমার পিছন পিছন ছুট দিল। তারপর অ্যাঙ্কারে বাঘের মুখে। তোমাগো বৌদি কোনও কথাই বিশ্বাস করে নাই, বাড়ি গেলে কি যে হইব।” মনে মনে মনাদার ওই হেনস্থার দৃশ্যটা ভেবে আমার হাসি পাচ্ছিল। মুখে বললাম, “ভাববেন না, কিছু হবে না, আমরা সবাই আজ একসঙ্গে আপনার বাড়ি যাব, সবাই মিলে বৌদিকে বুঝিয়ে আসব, আপনি সত্যিই ওখানে ডিউটিতে গিয়েছিলেন, অন্য কোনও ব্যাপার নয়।” মনাদা নিচু স্বরে বললেন, “বোঝলে হয়।”
রাত নটা নাগাদ আমরা পাঁচজন অফিসার মনাদাকে নিয়ে ওঁর বাড়ি গেলাম। দরজা খুললেন মনাদার শালা। আমরা হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকলাম। ঢুকেই বললাম, “বৌদি কোথায়? বৌদিকে একটু ডাকুন তো।” মনাদাও আমাদের সঙ্গে বসে রইলেন। বৌদি এলেন, মুখ থমথমে। আমি বললাম, “বৌদি আমরা আসামী ধরে নিয়ে এসেছি, যা শাস্তি দেবার দিন, বুড়ো বয়সে পদস্খলন, শাস্তি তো পেতেই হবে।” বৌদি ধরা গলায় বললেন, “বুড়ো বয়সে এইসব, আগে কি করেছে কে জানে, তখন তো টের পাইনি, ডিউটির নাম করে রাতবিরেতে কোথায় কোথায় যেত কে জানে।” মনাদা ছাড়া আমরা সবাই বৌদির কথা শুনে মুখ টিপে টিপে হাসছি। আমাদের মুখ দেখে বৌদি বোধহয় আরও রেগে গেলেন, কড়া গলায় প্রশ্ন করলেন, “আপনারা বুঝি ওর হয়ে ওকালতি করতে এসেছেন?” আমি হাসতে হাসতে উত্তর দিলাম, “ওকালতি কেন? আমরা তো আসামীকেই গ্রেফতার করে এনেছি। আপনি বসুন, বিচার করুন, আমরা সাক্ষী দেব।” মনাদা পরিবেশটা একটু হাল্কা করার জন্য শালাকে বললেন, “দেখ তো, এদের জন্য একটু চায়ের ব্যবস্থা করা যায় কিনা।”
আমি এবার বললাম, “বৌদি বসুন।” বৌদি কি বুঝলেন জানি না, সোফায় বসলেন। আমি বৌদিকে তখন আদ্যোপান্ত ঘটনাটা বুঝিয়ে বললাম। এতক্ষণে মেঘ সরল। বৌদি আমার কথা শুনে হেসে ফেলেছেন। জিজ্ঞেস করলেন, “তখন ছুটল কেন?” তারপর হাসতে হাসতে বললেন, “আরে আমি তো প্রথম দেখিনি, আমার ভাই দেখেছে, হঠাৎ আমাকে ভাই বলল, আরে দিদি দেখ দেখ, জামাইবাবু কিরকমভাবে ছুটছে। আমি দেখলাম, তাই তো। আবার পেছন পেছন ওকে ধরার জন্য একজন মহিলাও ছুটছে। তখন আপনারাই বলুন, আমার কি অবস্থা, ভাই, ভাইয়ের বৌয়ের কাছে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। ভাবছি, এমন তো কখনও শুনিনি, ভাবিনি ও কোনদিন, অথচ চোখের সামনেই দেখছি।” আমি বললাম, “আসলে শোভা দেবী মনাদার ছোটাটাকে অভিনয় ভেবে পেছন পেছন ছুটেছিলেন, তিনি তো বোঝেননি মনাদা প্রাণভয়ে ছুটছেন।”
বৌদি আমার কথা শুনে বোধহয় একটু লজ্জা পেলেন। ততক্ষণে আমাদের চা এসে গেছে। বৌদি তখনও হাসছেন, “আবার জানেন, আমি যখন চলে আসছি, পেছন থেকে ছুটে এসে আমাকে বলে কিনা, তোমরা কিছু খাইবা?” বৌদির কথা শুনে আমরা হো হো করে হেসে উঠলাম। তারপর হাসি থামিয়ে বললাম, “আপনি খেলেন না, আমরা কিন্তু একদিন জমিয়ে খাব।” বৌদি বললেন, “নিশ্চয়ই, আপনারা কবে আসবেন বলুন।” আমরা চা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছি। বললাম, “ঠিক আসব, মনাদাকে দিয়ে খবর পাঠাব।”
সেই খাওয়াটা কাজের চাপে আজও খাওয়া হয়নি। যন্ত্রের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মানুষ নিজেও যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে। যন্ত্র সভ্যতার জমকালো রঙিন স্বপ্নে বিভোর মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের কাছ থেকে। আমিও পারছি কই নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে আগের মত ওই খোলামেলা ঘুরে বেড়াতে? আগে যতই কাজ থাকুক বিজয়ার পর সব সিনিয়র অফিসারের বাড়িতে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে আসতাম। যদিও অফিসে আমাদের রোজই দেখা হত কিন্তু বিজয়া অফিসে কখনও সারতাম না, বাড়িতে গিয়ে প্রণাম করতাম। তখনকার দিনে সিনিয়র অফিসার, জুনিয়র অফিসার বা অন্যান্য কর্মচারীদের মধ্যে সম্পর্কটা ছিল দাদা-ভাইয়ের মত। তাই প্রতিটা কাজেই আমরা একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। কে কত ভাল কাজ করতে পারে সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল ঠিকই, কিন্তু সেখানে ঈর্ষার কালো চোখ ছিল না। “ভাল, আরও ভাল কাজ দেখানর” সুস্থ স্বাভাবিক গঠনমূলক ও বন্ধুত্বপূর্ণ পেশাদারী প্রতিযোগিতা ছিল সেটা।