২০
পরিণতি যাই হোক আমাদের সবরকম পরিস্থিতির মোকাবিলা করে অপরাধী ধরবার জন্য তদন্তের স্বার্থে এগিয়ে যেতেই হবে। সেদিন ছিল রবিবার, তাড়া নেই। সকালে কোয়ার্টারে বসে জড়তা কাটাচ্ছি। এগারটা নাগাদ ফোন বেজে উঠল। অলস হাতে তুলে কানে রাখতেই ওপার থেকে তৎকালীন ডি.সি. হেড কোয়ার্টার কমলকুমার মজুমদারের গলা পেলাম। সাথে সাথেই বুঝলাম ছুটির হাওয়া আর খাওয়া যাবে না। বললাম, “বলুন স্যার।” তিনি বললেন, “কন্ট্রোল রুমে একটা ছেলে এসে সেখান থেকে ফোনে আমায় বলল, তার কাছে ইন্টারন্যাশানালি ওয়ান্টেড একটা লোকের খোঁজ আছে, সেই লোকটা নাকি আজ কলকাতায় থাকবে। আপনি গিয়ে ব্যাপারটা দেখুন তো।” আমি জানতে চাইলাম, “লোকটার নাম, ঠিকানাটা ছেলেটা বলেনি?” তিনি জানালেন, “না, ছেলেটা বলছে, সে কথা বলবে শুধু কোন উঁচুস্তরের অফিসারেরই সঙ্গেই। কন্ট্রোল রুমের কোনও অফিসারকে ও কিছু বলেনি, তারা তখন ফোনে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছে।” বললাম, “ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।” ফোন নামিয়ে রেখে ভাবলাম, সকালবেলাতেই আবার কোন আন্তর্জাতিক অপরাধীর খবর এল রে বাবা, রোববারটাই মাটি করবে না কি?
কন্ট্রোল রুম বিল্ডিংয়ের ওপরেই চারতলায় আমার কোয়ার্টার। রেসিডেনসিয়াল অফিসার হিসাবে ওখানে থাকি। মজুমদার সাহেবের নির্দেশ পেয়ে সিঁড়ি দিয়ে পায়ে পায়ে নেমে এলাম দোতলায় কন্ট্রোল রুমে। কন্ট্রোল রুমের গোল টেবিলের গোটা পঞ্চাশেক ফোনের সামনে একটা চেয়ারে বসে আছে একটা অচেনা আঠাশ-তিরিশ বছরের যুবক। গায়ের রঙ মাজা, চোখ মুখ বেশ ধারাল। সাদা ফুলহাতা জামার সাথে গাঢ় নীল রঙের জিনসের প্যান্ট। এক ঝলকেই বোঝা যায় বেশ স্মার্ট।
ডিউটি অফিসারের কাছে জানতে চাইলাম, কে এসেছেন বিশেষ খবর নিয়ে? তিনি আমায় সেই যুবককে দেখিয়ে দিলেন। আমি সরাসরি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “বলুন কি খবর এনেছেন?” সে আমার দিকে তাকিয়ে চোস্ত ইংরেজতে বলল, “কিন্তু আপনি কে? কি নাম আপনার? পরিচয়ে খুশি হলে তবে কথা বলব।”
এতদিন পুলিশে চাকরি করছি, প্রশ্নের জবাবে কেউ ওই ভাবে উত্তর এড়িয়ে নাম জিজ্ঞেস করেনি। ছেলেটার উদ্ধত ভাব আর ঝরঝরে ইংরেজি আমাকে ভেতরে ভেতরে নাড়া দিলেও সেটা লুকিয়ে আমি তাঁর বিশ্বাসভাজন হওয়ার জন্য বললাম, “আপনি আমাকে আপনার কথা বলতে পারেন, আমার নাম রুণু গুহ নিয়োগী।” আমার নাম শুনে সে একটু চিন্তা করেই বলল, “হ্যাঁ, আপনার নাম শুনেছি, আপনাকে বলা যেতে পারে। কিন্তু এখানে আমি কোনও কথাই বলব না, আলাদা ঘরে চলুন যেখান থেকে কোনও কথা বাইরে আসবে না।” আমি পাশের কাঁচে ঘেরা ওয়্যারলেস রুমটার দিকে তাকাতে সে বলল, “না ওখানেও হবে না, অন্য লোক আছে।”
আমি অগত্যা কন্ট্রোল রুমের পাশে উঁচুপদের অফিসারের যে বড় চেম্বারটা আছে সেখানে নিয়ে গেলাম তাঁকে। ছেলেটা ঘন ঘন একটার পর একটা সিগারেট টেনে যাচ্ছে। তাঁকে একটা চেয়ারে বসতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “বলুন কি বিশেষ খবর?” ছেলেটা বলল, “ইন্টারন্যাশানালি হটলি ওয়ান্টেড একজন আজ রাতে কলকাতায় থাকবে, কোথায় থাকবে আমি জানি, তাকে চিনিয়ে দিতে পারি, কিন্তু আমার শর্ত অনুযায়ী চললে, তবেই।” প্রশ্ন করলাম, “কি শর্ত?” সে বলল, “সে ঠিক আজ রাত বারটায় একটা বাড়িতে থাকবে, আপনারা সেই বাড়ি ঘিরে ফেলবেন, আমি তার সাথে দু-চার মিনিট কথা বলব, তারপর আপনারা আপনাদের কাজ করবেন।” জানতে চাইলাম, “কি নাম তার?” ছেলেটা বলল, “তা আমি এখন জানাব না, জায়গায় গিয়ে জানাব।”
আমার প্রশ্ন, “লোকটা স্মাগলার না খুনী, কি?” ছেলেটা বলল, “সে আপনি যা ইচ্ছা ভাবতে পারেন, বলেছি তো সে ইন্টারন্যাশানালি হটলি ওয়ান্টেড।” বললাম, “তার মানে ইন্টারপোলও তাকে খুঁজছে?” সে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ইন্টারপোল, সি-আই-এ, কে-জি-বি সবার কাছেই সে হাইলি ওয়ান্টেড।” জানতে চাইলাম, “তা আপনি তাঁকে কি ভাবে চেনেন? কি করে জানলেন সে আজ রাতে কলকাতায় থাকবে?” সে দৃঢ় স্বরে বলল, “এসব কোন কথাই আমি এখন বলব না। ভুল বলে থাকলে আমাকে আপনি গ্রেফতার করবেন, আমি তো আপনাদের হেফাজতেই থাকছি, আর তো কোথাও যাচ্ছি না।” জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার নামটা কি, কোথায় থাকেন?” ছেলেটা এবারও বলল, “সেটাও এখন আমি জানাব না, কাজ হয়ে গেলে সবই জানতে পারবেন। আমি তো পালাচ্ছি না।”
মনে মনে ভাবলাম, কি ফ্যাসাদেই না পড়েছি, নিজের নাম, • অপরাধীব নাম কোনও পরিচয়ই বলছে না, কিন্তু কিছু না জেনে এগিয়ে যাই কি করে? রোববারটাই মনে হচ্ছে মাটি করে দেবে। বড়সাহেবরা তো দিব্যি চলয়িত্ব দিযে ছুটি উপভোগ করছেন। এদিকে ছেলেটার ঝকঝকে ইংরেজি ও বাংলা, কথাবার্তায় আমি বেশ ইমপ্রেড। এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
আমাকে নীরব থাকতে দেখে ছেলেটা ‘বলে উঠল, “দেখুন, আপনারা তাকে হাতে পেয়েও যদি কিছু না করেন তো আমার কিছু বলাব নেই। আমার কথায় বিশ্বাস না করলে কলকাতা পুলিশ একটা বিরাট গৌরবের থেকে বঞ্চিত হবে, আমার আর কি?” বললাম, “ঠিক আছে, আপনি শুধু তার নাম, কি ধবনের অপরাধী সে, রাতে কোথায় আসবে তা বলুন না, দেখবেন আমরা তাকে গ্রেফতার করি কি না করি।” ছেলেটা বলল, “আমি তো বলেইছি এখন আমি কিছু জানাব না, কারণ যার কথা আমি বলছি, সে অসম্ভব বুদ্ধিমান, উচ্চশিক্ষিত, তুখোড়, তাঁর বিস্তার সর্বত্র।” প্রশ্ন করলাম, “তার মানে আপনি কি ভয় পাচ্ছেন আমাকে জানালে, সেই খবরটা তাঁর কাছে পৌঁছে যেতে পারে?” ছেলেটা বলল, “হ্যাঁ, তাই আমি কিছুতেই বলব না।” বললাম, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, তেমন কোন সম্ভাবনা নেই।” সে সাথে সাথে উত্তর দিল, “হয়ত আপনার কাছে নেই, কিন্তু আমার কাছে আছে, আমি সেই সম্ভাবনাটা রাখব কেন?”
কন্ট্রোল রুমের ডিউটি অফিসার আমায় এসে বললেন, আমার ফোন এসেছে। আমি কন্ট্রোল রুমে গিয়ে ফোন ধরতেই, ওপার থেকে মজুমদার সাহেব প্রশ্ন করলেন, “কি হল রুণুবাবু কিছু জানতে পারলেন?” বললাম, “না স্যার, কিছুই বুঝতে পারছি না।” তারপর ছেলেটার সমস্ত বক্তব্য তাঁকে জানালে তিনি বললেন, “দেখুন, কতটা জানতে পারেন, কিছু জানলে আমাকে জানাবেন। আমি চিন্তায় থাকব।” বললাম, “ঠিক আছে, নিশ্চয়ই জানাব।”
কন্ট্রোল রুমে সেদিন ডিউটি অফিসার যে ছিল সে বহু বাংলা ছবিতে জাঁদরেল পুলিশ অফিসার হিসাবে অভিনয় করেছে। তাকে বললাম, ““যাও না, ছেলেটাকে গিয়ে জেরা করে ার কর রহস্যটা কি। সিনেমা ‘তো আকছার কবছ।” সে হেসে বলল, “দূর, ওগুলো সিনেমাতেই হয়, ওসব সংলাপ আর দৃশ্য চিত্রনাট্যকাররা লিখে দেন, আর পরিচালকরা আমাদের দিয়ে সেগুলো করিয়ে নেন। এখানে; আর ছবির সংলাপ বললে চলবে না, এটা যে একেবারে বাস্তব। এখানে অভিনেতার বদলে তোমরা।” ‘ওর কথা শেষ হতে না হতে ফোন, ফোন তুলেই অফিসার” আমার হাতে দিয়ে বলল, “ডি.সি. ডি.ডি.।” আমি ফোন ধরে বললাম, “স্যার।” তিনিও জানতে চাইলেন ওই ছেলেটার খবর। আমি যা যা ঘটেছে সব কথা তাঁকে বলতে তিনি বললেন, “আমি বাড়ি থেকে একটু বেরচ্ছি, তুমি সব চিন্তা করে সাবধানে এগবে।”
ফোন রেখে আমি বিভিন্ন দিক. ভারছি। একবার মনে হচ্ছে ছেলেটার কথামত যাই-ই না, দেখি কাকে পাওয়া যায়। আবার ভাবছি; দূর, মা জেনে না বুঝে একটা অচেনা, অজানা ছেলের কথা বিশ্বাস করে কাকে গ্রেফতার করে কি বিপদে জড়িয়ে পড়ব, ওই রকম ছেলেমানুষী কি আর আমাদের সাজে? তবে একটা কোনখানে রহস্য আছে, সেই ‘রহস্যটাই ভেদ করতে হবে। কিন্তু ছেলেটা ফোন একগুঁয়ে, তাকে ভাঙাটা অত সহজ হবে না। ওর কথাবার্তায় ব্যাপারটা ফালতু বলে উড়িয়েও দিতে পারছি না। তবে ছেলেটা যে লালবাজার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় সেটা বুঝে গৈছি, কারণ সে জানলে অপরাধীর খবর দিতে কন্ট্রোল রুমে না এসে গোয়েন্দা বিভাগে যেত। তার মানে ছেলেটা অপরাধ জগতের লোক নয়, কারণ অপরাধ জগতের লোকেরা এগুলো ভালই জানে। অথচ অপরাধ জগতের লোক না হয়ে সে কি করে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধীর খোঁজ নিয়ে এল? কি সেই রহস্য?
ছেলেটাকে প্রশ্ন করলাম, “আপনি যেখানে আমাদের নিয়ে যেতে চাইছেন তা কি কলকাতার উত্তরে না দক্ষিণে বা অন্য কোন দিকে?” ছেলেটা আমার প্রশ্ন শুনে একটু চুপ করে থেকে কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল, “দক্ষিণে।” জানতে চাইলাম, “এখান থেকে কতদূর?” সে বলল, “তা এখন বলব না, আপনারা গেলেই তা জানতে পারবেন, আমি তো আপনাদের সঙ্গেই যাব।” বললাম; “কতক্ষণ লাগবে যেতে?” সে বলল, “বললাম তো এখন কিছু জানাব না, কতক্ষণ লাগবে জার্নালেই তো আপনারা বুঝতে পারবেন দূরত্বটা কতখানি।”
ভাবলাম, কি টেটিয়া রে বাবা! কিছুতেই ভাঙছে না। আমি ভাল করে ওর শরীরের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছি। চেন স্মোকার। মাঝেমাঝে রুমাল দিয়ে মুখ মুছছে। গরমকাল, ঘাম: হতেই পারে। আমি উঠে চেম্বারের এয়ারকন্ডিশন মেশিনটা চালিয়ে দিলাম। ততক্ষণে বৈশাখের বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা প্রায় ছুঁয়েছে। আবার ফোন।
কন্ট্রোল রুমে গিয়ে ধরলাম, মজুমদার সাহেব জানতে চাইলেন কতদূর এগিয়েছে। বললাম, “একটুও না।” তিনি বললেন, “আমি কিছুক্ষণ কোয়ার্টারে থাকব না, আপনি ফোর্স লাগলে নিয়ে যাবেন, কি হল না হল জানাবেন। চিন্তায় থাকব।”
ফোন রেখে একা একা দাঁড়িয়ে ভাবছি, কি করা যায়? ছেলেটার কথায় একটা ঝুঁকি নেব কি? পেলেও তো পেতে পারি কোনও “অমূল্যরতন।” একটা দিন আমার নষ্ট করল অথচ কোনও কথাই তার থেকে আমি বার করতে পারিনি। বিরক্ত লাগছে, এইভাবে প্রায় উড়ো খবরের ভিত্তিতে ফোর্স নিয়ে কোথায় গিয়ে পড়ব, কে জানে? আবার ছেলেটার দৃঢ়তা দেখেও তাচ্ছিল্য করা যাচ্ছে না। যদি বিশেষ অপরাধীর খবর পেয়েও ধরতে না পারি তবে আমাদের বড় বড় সাহেবরা জানতে পারলে সম্পূর্ণ দোষটা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে। আর তার চেয়ে বড় হল, তখন নিজেকেই নিজে দোষী মনে করব। এইরকম দোটানা মন নিয়ে ছেলেটার সামনে এসে বসলাম।
বললাম, “আপনি তো ভাই কোন কথাই বলছেন না, অথচ আমাদের সমস্যাটাও বুঝতে পারছেন না।” ছেলেটা বলল, “দেখুন, আপনি ফোর্স রেডি করুন, সে কিন্তু বেশিক্ষণ সেখানে থাকবে না, ওখান থেকে চলে গেলে আপনারাই পস্তাবেন; তখন কিন্তু আমাকে কিছু বলতে পারবেন না।” দুজনের মধ্যে পরস্পরের কথা এড়িয়ে গিয়ে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাওয়ার যেন আড়াআড়ি যুদ্ধ চলছে। বললাম, “আপনি তো তার আস্তানাটা বলছেন না, আচ্ছা আপনি কোথায় থাকেন, মানে কলকাতার কোন্ দিকে?” সে একটু ভেবে বলল, “উত্তরে।”
যেন শুনিনি এমন ভাব করে অন্য কথা পাড়লাম, ওর উদ্দেশ্যের সঙ্গে যার কোন সম্পর্ক নেই। আমি ইচ্ছে করেই সময় কাটাচ্ছি যাতে তার উত্তেজনা বাড়ে। আমরা জানি যতবড় চতুরই হোক না কেন, অনবরত কথা বলার মাঝে দু একটা বেফাঁস কথা লোকে বলে ফেলে, যা আমাদের কাজে লেগে যায়। আর সেই ফাঁক দিয়েই আমরা তীর ছুঁড়ে করি লক্ষ্যভেদ। কথার মাঝে চট করে জিজ্ঞেস করলাম, “কতক্ষণ লাগবে সেখানে যেতে?” সে এবার বলে ফেলল, “দশ-পনের মিনিট।” বুঝলাম তার ভেতর ভেতর উত্তেজনা বাড়ছে। এতক্ষণ দূরত্বটাও বলছিল না। বললাম, “ও, তাহলে তো বেশি দূর নয়। এখনও তো অনেক দেরি আছে। ইতিমধ্যে আপনি আপনার বাড়ি ঘুরে আসতে পারবেন।” সে বলল, “না, আমি আর কোথাও যাব না, একবারে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরব।” আমার প্রচেষ্টা ছিল তাকে যদি বের করতে পারি, তবে সে কোথায় কোথায় যায়, কার সাথে কথা বলে, বাড়িটাই বা কোথায় তা এক নজরদার ওর পেছনে লাগিয়ে জেনে নেব। তার জন্য একটা নজরদারও ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু সে যেতে অস্বীকার করাতে, আমার পরিকল্পনাকে গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হলাম।
রাত বাড়ছে। সে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর আমাকে বলছে, “আপনি কিন্তু ফোর্স রেডি করছেন না।” আমি ওর কথার কোনও গুরুত্ব না দিয়ে প্রশ্ন করলাম, “আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?” সে জানাল। আমি ঝট করে উঠে কন্ট্রোল রুমের দিকে চলতে শুরু করলাম, যাতে তার উত্তেজনা আরও বাড়ে। উত্তেজনা বাড়ার লক্ষণ তো দেখছিই। ঘরে এয়ার-কন্ডিশন চলছে, তবু তার কপালে ঘাম হচ্ছে, আর সে রুমাল দিয়ে মাঝেমধ্যে মুছছে।
কন্ট্রোল রুমে দাঁড়িয়ে ভাবছি, কেন সে আমাদের আগে অপরাধীর সাথে দেখা করাতে চায়? কি কারণে? সেটা কি তার ব্যক্তিগত কোনও প্রতিশোধস্পৃহার জ্বালায়? কি হতে পারে তার সেই জ্বালার কারণ?
চা আনলাম। চা নিয়ে গেলাম ছেলেটার কাছে। কাপটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “এই যে আপনি আমাদের আগে তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন, তখন যদি সে আপনাকে আঘাত করে বা খুন করে তার দায় কে নেবে?” সে বলল, “না-না, তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই, সম্ভাবনা থাকলে তো আমি বলতামই, তিনি হাইলি হাইলি ইন্টেলেকচুয়াল লোক। এত বুদ্ধি যে আপনারা ভাবতেই পারবেন না। তাছাড়া একটা বিখ্যাত ব্যক্তির বাড়িতে এসে থাকবে। আমি তাকে চিনিয়ে দেব, আমি তো আছিই আপনাদের সঙ্গে।”
আমি ওর উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছি। চা শেষ করে আবার আমি ফিরে এলাম কন্ট্রোল রুমে। রাত তখন প্রায় পৌনে এগারটা। কন্ট্রোল রুম, ওয়্যারলেস রুমের ডিউটি অফিসার ও কর্মীরা পাল্টে গেছেন। মাথার মধ্যে চিন্তার কাটাকুটি খেলতে খেলতে কন্ট্রোল রুমের টেবিলে এক পাশে পড়ে থাকা সেদিনের বাংলা পত্রিকাটা চোখের সামনে মেলে ধরে এলোমেলো ভাবে পড়তে পড়তে হঠাৎ একটা ছোট খবরের ওপর চোখ আটকে গেল। আমি সেই খবরের চারদিকটা দাগ দিয়ে দিলাম।
কন্ট্রোল রুম থেকে ছেলেটার কাছে গিয়ে প্রথমেই তাকে প্রশ্ন করলাম, “আপনার গান-বাজনা, সাহিত্য কেমন লাগে?” আমার হঠাৎ প্রসঙ্গহীন প্রশ্নে সে একটু চমকে উঠে বলল, “ভাল লাগে। কিন্তু দেরি হচ্ছে, এখনও প্রস্তুত হচ্ছেন না?” তার কথার উত্তর না দিয়ে বললাম, “চলুন আপনার বাড়িটা দেখে আসি।” সে বলল, “সে কি? আমার রাড়ি গিয়ে ফিরে এসে সেখানে যেতে যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে, দেখছেন, না, এখনই এগারটা বাজে।” গম্ভীর ভাবে বললাম, “সে চিন্তা আমার, এখান থেকে তো মাত্র দশ মিনিট সময় লাগবে, আমি সব রেডি রাখছি, আপনার বাড়ি থেকে ফিরে এসেও অনেক সময় থাকবে। আমি আপনার বাড়ি না চিনে: অপরাধী ধরতে যাব না, আপনি যদি পালিয়ে যান; তখন কি করব?” ছেলেটা উত্তেজিত হয়ে বলল, “না না, আমি পালাব না; আর পালাব কি করে, আপনারা তো বাড়িটা ঘিরে রাখবেন। তবু যদি কোন ভুল করি তবে আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে আমার বাড়ি থেকে বাবা-মাকেও নয়। গ্রেফতার করে নিয়ে আসবেন, কিন্তু এখন আপনারা রেডি হন।”
বললাম, “না, আপনার বাড়ি না দেখে আমি কোথাও যাব না। কারণ, তাকে গ্রেফতারের পর জেরা করে জানতে এবং সাক্ষ্য প্রমাণের জন্য আপনাকে আমাদের দরকার হবে; তখন আপনাকে আমরা কোথায় পাব? তাছাড়া আপনি যে সত্যিই এখানকার লোক তা জানব কি করে? অন্যখান থেকে এসেও আমাদের ফ্যাসাদে ফেলতে পারেন।” ছেলেটা আমার কথায় একটু ভেঙে পড়ে বলল, “ঠিক আছে চলুন, কিন্তু গাড়িতে আপনি ছাড়া আর কেউ থাকবে না, আমি গাড়ি থেকেই আপনাকে বাড়ি দেখিয়ে দিয়ে সোজা চলে আসব, যাতে ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারি।” বললাম, “তাই-ই হবে। কিন্তু সেই বাড়িটা যে আপনার তা বুঝব কি করে? আপনি তো অন্য কোন বাড়িও দেখিয়ে দিতে পারেন।” সে বলল, “আমার বাড়ির সামনে আমার বাবার নামে একটা নেমপ্লেট লাগান আছে।” তারপর সে. তাঁর বাবার নামটা বলল। এই প্রথম সে কোনও নাম বলল।
দ্রুত কন্ট্রোল রুমে এসে আমাদের গোয়েন্দা বিভাগে ফোন করলাম। ধরলাম শচীকে। ওকে বললাম, “এক্ষুণি আমাদের একটা বুদ্ধিমান কনস্টেবল নিয়ে কন্ট্রোল রুমে আমার কাছে এস।” লালবাজারের পশ্চিম দিকের গোয়েন্দা দফতরের বিল্ডিং থেকে কন্ট্রোল রুমের উত্তর দিকের বাড়িতে শচী ও কনস্টেবল, অসিত যেন উড়ে আমার সামনে এসে হাজির। আমি ওদের কাজ বুঝিয়ে দিতে অসিত নেমে চলে গেল। আমি শচীকে নিয়ে ছেলেটার কাছে এসে বললাম, “আমাদের এই অফিসার” আপনার সঙ্গে যাবেন, ‘ একেই আপনি বাড়ি চিনিয়ে দিয়ে সোজা আসামীর জায়গায় চলে যাবেন।” তারপর শচীর দিকে ফিরে ‘ওকে একটা পোর্টেবল ওয়্যারলেস দিয়ে বললাম, “তুমি বাড়ি দেখে ফেরার পথে আমায় ওয়্যারলেসে জানিয়ে দেবে, আমি এখান থেকে ফোর্স নিয়ে সেই জায়গায় পৌঁছে যাব।” ছেলেটাকে আর কোনও কথা বলতে না দিয়ে, তাড়া দিলাম তাড়াতাড়ি যেতে। শচী আর ছেলেটা কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে নিচে অপেক্ষমান আমাদের এক প্রাইভেট গাড়িতে গিয়ে পেছনের সিটে বসল। ড্রাইভারের পাশে সামনের সিটে অন্য কয়েকজন কনস্টেবল বসেছে। আর বাঁদিকে দরজার দিকে অসিত। অসিতও ড্রাইভারকে ততক্ষণে আমার নির্দেশ পৌঁছে দিয়েছে।
তাদের গাড়ি বেরিয়ে যেতে আমি নেমে এসে আমাদের একটা ট্যাক্সিতে উঠে ওদের পেছন পেছন ছুটলাম। তখন আমরা গোয়েন্দাগিরির কাজে ট্যাক্সি ব্যবহার করতাম। তাতে নজরদারী করার সুবিধা পাওয়া যেত, যার ওপর নজর রাখা হচ্ছে সে বুঝতে না পারে হাজারও ট্যাক্সির ভিড়ে কোনও এক ট্যাক্সির আরোহীর শাণিত দৃষ্টি রয়েছে তার ওপর।
আমার ট্যাক্সির নম্বরটা দেওয়া আছে অসিতকে। সঙ্গে রেখেছি একটা পোর্টেবল ওয়্যারলেস সেট, শচীর সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য। ট্যাক্সির ড্রাইভার দারুণ দক্ষ। অন্য গাড়ির থেকে কতটা দূরত্ব রেখে নজর রাখতে রাখতে যেতে হবে তার কুশলী হাত যেন সেই জন্যই তৈরি। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে এগিয়ে চলেছে রাত বারটার দিকে, সাথে হৃদযন্ত্রের ধকধক শব্দও বোধহয় শোনা যাবে। আসামী ধরতে যাব কলকাতার দক্ষিণ দিকে, অথচ যাচ্ছি উত্তরের দিকে।
বের হওয়ার আগে আরও দুতিনবার মজুমদার সাহেব কন্ট্রোল রুমে ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন আমার অগ্রগতির ফল, কিন্তু একটুও এগোয়নি ছাড়া কোন উত্তরই তাঁকে দিতে পারিনি। আমি যে কোথায় চলেছি তাও জানেন না। কোথাও আলো কোথাও অন্ধকার রাস্তা চিরে চিরে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে দুটো গাড়ি দ্রুত ছুটছে কলকাতার উত্তর দিক পার হয়ে, এখন বরানগরে। বরানগরের এদিক ওদিক ঘুরে একটা অন্ধকার রাস্তায়, দূর থেকে দেখলাম আমাদের প্রাইভেট গাড়ি একটু আস্তে হয়েই আবার জোরে ছুটতে শুরু করল। আমিও ট্যাক্সিটা ওইখানে রাখতে বললাম।
আমার নির্দেশ মত অসিতও গাড়ি থেকে স্লিপ করে নেমে গেছে। শচীরা এগিয়ে যাচ্ছে। অসিত আমার কাছে এসে জানাল কোন বাড়িটা ছেলেটা দেখিয়েছে।
আমি আর অসিত সেই একতলা বাড়িটার সামনে এসে প্রথমে নেমপ্লেটের নামটা মিলিয়ে দেখে সদর দরজার কড়া নাড়লাম। দরজা খুললেন একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা। তিনি আমাদের দেখে অবাক হয়ে গেলেন। বললাম, “ভয় নেই মাসীমা, আমরা লালবাজার থেকে এসেছি, আপনার ছেলের নামটা কি?” তিনি লালবাজার শুনে কোনমতে ছেলের নাম বলেই কেঁদে ফেলে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন কি হয়েছে ওর?” বললাম, “কিছু হয়নি, আমরা একটু ওর ঘরটা দেখব।” তিনি আমাদের ছেলেটার ঘরের দিকে নিয়ে গেলেন। দরজাটা ভেজানো ছিল, ধাক্কা দিয়ে খুলে লাইটের সুইচটা টিপে দিতেই আমি চমকে উঠে ঘরের চারদিক দেখতে লাগলাম।
সারা ঘরের দেওয়াল জুড়ে শুধু একজনেরই ছবি। শুধু দেওয়ালে নয়, টেবিলে, খাটে, চেয়ারের সর্বত্র শুধু তাঁর বিভিন্ন রকমের ছবি। টেবিলের ওপর দেখলাম পড়ে আছে সেদিনের পত্রিকাটা। সেটা খুলে দেখলাম, আমি যে খবরটার ওপর লালবাজারে দাগ দিয়ে এসেছি, এখানেও ঠিক সেই খবরের ওপর ছেলেটা লালকালি দিয়ে দাগ দিয়ে রেখেছে। তার পাশে অনেক হিজিবিজি লেখা।
আমার সাথে সাথে ভদ্রমহিলাও ঘরে ঘুরছেন। ছবিগুলো দেখিয়ে বললেন, “সারাদিন খালি ওঁরই ধ্যান, জ্ঞান, ওঁরই ফটো আগলে নিয়ে বসে থাকে। আজ সকাল থেকে দেখলাম ওর মনটা কেমন যেন অস্থির, কোন কথারই ঠিক মত উত্তর দিল না। সকালে প্রায় কিছু না খেয়েই বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় বলল, ফিরতে রাত হবে।” আমি তাঁর কথা শুনতে শুনতে শচীকে ওয়্যারলেসে নির্দেশ দিয়ে দিলাম, “দাঁড়াও, আর এগবে না।”
শচী অবশ্য আমার কথামত খারাপ হয়ে যাওয়ার বাহানায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। ড্রাইভার গাড়ির বনেট খুলে সারানর অভিনয় করে যাচ্ছে। ছেলেটা অস্থির, ড্রাইভারকে বারবার বলছে, “কি হল? ঠিক হয়েছে?” ড্রাইভার বলছে, “তেল আসছে না ঠিকমত, আমি দেখছি, ঠিক হয়ে যাবে।” ছেলেটা উত্তেজনার চরমে পৌঁছে গেছে, শচীকে বলছে, “কি হবে?” শচী বলছে, “হবে, হবে, ঠিক হবে।”
আমরা ছেলেটার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে চেপে বসলাম। ট্যাক্সি দাঁড় করালাম শচীদের গাড়ির সামনে। ট্যাক্সি থেকে আমাকে নামতে দেখে ছেলেটা যেন ভূত দেখল, বলে উঠল, “আপনি?” তার কথার উত্তর না দিয়ে বললাম, “আপনি গাড়ি থেকে নেমে আসুন।” ছেলেটা বলল, “কেন, যাবেন না?” বললাম, “যাব, তবে আপনাকে নিয়ে নয়। আপনি নামুন।” আমার গলার স্বরে এমন ঝাঁঝ ছিল যে ছেলেটা আর দ্বিরুক্তি না করে গাড়ি থেকে নেমে এল। বললাম, “আপনি আমাদের যেখানে নিয়ে যেতেন তার ঠিকানা আমি পেয়ে গেছি; ওখানে আমরাই যাব, আপনার প্রয়োজন নেই।” আমার কথা শুনে সে ঝট করে আমার হাতটা ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলল, “আমার সব স্বপ্ন আপনি ভেঙে দিলেন? একটাই স্বপ্ন ছিল, তা আর পূর্ণ হে হবে না? কি নিয়ে বাঁচব?”
আমি গাড়িতে শচীর পাশে বসতে বসতে বললাম, “ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি যান।” আমাদের ট্যাক্সিচালককে সেই নির্দেশ দিয়ে দিলাম। আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়ি বেশ কিছুটা চলার পর শচী আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার বলুন তো, ছেলেটা আসতে আসতে বলল, ইন্টারন্যাশানালি হটলি ওয়ান্টেড একটা লোকের খবর আছে ওর কাছে, আর তারপর দেখলাম সোর্সই আপনার হাত ধরে কাঁদছে।”
শচীর কথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলাম। গাড়ি ছুটছে কলকাতার দিকে। হঠাৎ একটা চায়ের দোকান দেখে গাড়ি থামিয়ে চায়ের অর্ডার দিয়ে শচীকে বললাম, “কি শুনতে চাইছ?” শচী বলল, “ব্যাপারটা আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না, তাই জানতে চাইছি, কে ছেলেটা?” সবাই আমার দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি তাদের সকাল থেকে যা যা ঘটেছে সব বললাম। শচী বলল, “তারপর?” বললাম, “ছেলেটার মতিগতি কোন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। একবার ভাবলাম, ব্যর্থ প্রেমিক-টেমিক নাকি, ব্যর্থতার জ্বালায় কাউকে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে, কারণ সে শর্ত রেখেছিল, আমাদের দিয়ে বাড়ির দরজা খোলানর পর সে প্রথমে অপরাধীর সাথে কথা বলতে চায়। তারপর পত্রিকার খবরটা দাগ দিয়ে আমি ঠিক করি তার বাড়ি আমি আগে যাবই যাব। তখন ওকে রাজি করিয়ে ফোন করি তোমায়। এরপর তো তোমরা সবই জান।” শচীর প্রশ্ন, “তারপর?” বললাম, “ওর বাড়িতে বাবার নেমপ্লেটটা মিলিয়ে দেখে ভাবলাম, সে তাহলে মিথ্যা বলেনি। তারপর ওর ঘরে গিয়ে সারা ঘরময় একজনের ফটো দেখলাম আর পত্রিকায় আমি যেভাবে দাগ দিয়ে এসেছি লালবাজারে ঠিক তেমনভাবেই ওর টেবিলে দেখলাম রয়েছে খবরটার ওপর দাগ। তখন আমি বুঝে গেলাম আমার ধারণাই সত্যি, কোথায় সে আমাদের নিয়ে যেতে চেয়েছিল।”
শচী উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল, “কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল?”
বললাম, “বিশপ লেফ্রয় রোডের একটা বাড়িতে।”
শচী জিজ্ঞেস করল, “সেখানে কার বাড়িতে?” আমি কিছু বলার আগেই অসিত বলল, “সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। ওর সারা ঘরে শুধু সত্যজিৎ রায়ের ফটো।”
শচী জানতে চাইল, “সেখানে কেন?” বললাম, “পত্রিকায় ছোট্ট খবরটা ছিল আগামীকাল সোমবার, ১৮ই বৈশাখ সত্যজিৎবাবু জন্মদিন, তিনি বাড়িতে সারাদিন অনাড়ম্বরভাবে কাটিয়ে দেবেন।”
শচী বলল, এই খবরের সঙ্গে স্মাগলারের কি সম্পর্ক?” বললাম, “খবরটা পড়েই আমার মনে হয় রাত বারটার সঙ্গে খবরটার একটা সম্পর্ক আছে। সঙ্গে সঙ্গেই ওর ঘরটা দেখব বলে ঠিক করে নিই।”
শচী জানতে চাইল, “কিন্তু কি উদ্দেশ্য ছিল ছেলেটার?” বললাম, “উদ্দেশ্য ছিল আমাদের দিয়ে তাঁর বাড়িটা ঘিরিয়ে ফেলবে, আমাদের দিয়ে সদর দরজা খোলাবে, কারণ এমনিতে তো অত রাতে অজানা লোকের জন্য ওই বাড়ির দরজা কেউ খুলবে না। তারপর পুলিশ তল্লাশিতে এসেছে শুনলে সত্যজিৎবাবু নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে আসতেন। আর তখন রাত বারটা বেজে যেত, তারিখ পাল্টে যেত, সত্যজিৎবাবুর জন্মদিন এসে যেত। তখন সেই সুযোগে ছেলেটা সত্যজিৎবাবুকে তাঁর জন্মদিনের প্রথম অভিনন্দন জানাত। এটাই ছিল ওর বিরাট আনন্দ, এতে সে নিজেও খ্যাত হতে চেয়েছিল।”
শচী বলল, “আমাদের গাড্ডায় ফেলে সে এতবড় একটা পরিকল্পনা করেছিল?”
বললাম, “পাগল ফ্যানের পাগলামি আর কি! হটলি ওয়ান্টেড-ফোয়ান্টেড গল্প ফেঁদে আজ আমার চাকরিটা খেয়েছিল আর কি।”
রাত বারটা বেজে গেছে। লালবাজারে পৌঁছে মজুমদার সাহেবকে ফোন করে সব জানালে তিনি বললেন, “দারুণ সামলেছেন তো ব্যাপারটা, একটা বিরাট বদনামের হাত থেকে আমরা বেঁচে গেলাম!”
সেই ছেলেটা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। সুপ্রতিষ্ঠিত বামপন্থী সাহিত্যিক। প্রায় প্রতিদিনই নন্দন-রবীন্দ্রসদন-শিশির মঞ্চ এলাকায় তাঁকে দেখা যায়!