৩
ষাট সত্তরের দশক জুড়ে অদ্ভুত ভুতুড়ে কাণ্ড ঘটছিল মালদার একটা অঞ্চলে। উত্তরবঙ্গ থেকে চা, মশলা কিংবা অন্য দামি জিনিস নিয়ে যে সব লরি রাতে দক্ষিণবঙ্গের দিকে আসত, তার মধ্যে মাসে দু তিনটে ফারাক্কা পার হয়ে বেশ কিছুটা আসার পরই হাইওয়ের একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, নিঝুম জায়গায় উধাও হয়ে যেত। সেখানে পৌঁছলেই ড্রাইভারদের কি যে হত, লরি নিয়ে তারা নির্দিষ্ট পথে না গিয়ে অন্য পথে চলে যেত, যার খোঁজ কখনও কেউ পেত না। আতসবাজির ফুলঝুরির মত শূন্যে মিলিয়ে যেত, যেন বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল। লরির মালিকেরা পুলিশের সাহায্যে বহু খোঁজ নিয়েও ড্রাইভার, খালাসি কিংবা লরির হদিস পেত না। ড্রাইভার, খালাসিরা তাদের বাড়িতেও আর ফিরে আসত না, কোনও টাকাপয়সা, চিঠিপত্র, কিছুই পাঠাত না। এইভাবে চলে যেত দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। মালিকও ড্রাইভার, খালাসিদের বিরুদ্ধে লরি নিয়ে বেপাত্তা হওয়ার অভিযোগ থানায় ডায়েরি করে অপেক্ষা করত কবে পুলিশ তার হারিয়ে যাওয়া লরি উদ্ধার করে নিয়ে আসবে। কিন্তু অপেক্ষাই সার হত। তারপর সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানে একসময় নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে ভুলে যেত সব।
পুলিশও কিছু বুঝতে পারত না, কোথায় কখন লরির ড্রাইভার লরি নিয়ে পালিয়ে গেল। তার ওপর মালিকেরা তো আর এক থানায় ডায়েরি করছে না। যে যে থানার এলাকা থেকে তারা গাড়ি ছেড়েছে, নিখোঁজের খবর লিখিয়ে আসছে সেই সেই থানায়। আর থানার কাছে লরি নিখোঁজের কেস খুব গুরুত্বপূর্ণ কেস নয়। সুতরাং পুলিশকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনুসন্ধান করতে দেখা যেত না। কোনও কোনও মালিক ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু খবরাখবর হয়ত পেত, ফারাক্কা পর্যন্ত তার লরি দেখা গেছে এইটুকু খবর, তার বেশি কিছু তারা আর জানতে পারত না। তারা ড্রাইভার, খালাসিদের ধরার জন্য বিহার, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি করতে যেত। ড্রাইভারদের মহল্লায় মহল্লায়, বাড়িতে, মদের আড্ডায়, কিংবা হাইওয়ের ধারে ধাবা ও গণিকালয়ে হানা দিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসত। মালিকেরা ভেবে পেত না তাদের এতদিনের বিশ্বস্ত ড্রাইভার, খালাসিরা কি করে এতবড় বেইমানি করল?
ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীদের নিজেদের মধ্যে ভালই যোগাযোগ থাকে, তাদের নিজস্ব খুব বড় এবং শক্ত সংগঠন আছে, তারাও নিখোঁজ হয়ে যাওয়া লরির কোনও খোঁজ দিতে পারত না। ড্রাইভারদেরও পরস্পরের সঙ্গে জানপহচান থাকে, কিন্তু কোনও ড্রাইভারই হারিয়ে যাওয়া অন্য ড্রাইভারদের হদিশ দিতে পারত না। আর এসব খবর কোনও পত্রপত্রিকাতে প্রকাশও হত না। ড্রাইভার লরি নিয়ে পালিয়ে গেছে, এটা কোনও খবরের মধ্যেই পড়ে না। ড্রাইভাররা তাদের অপরাধের কোনও চিহ্নই ফেলে রেখে যেত না। এত নিখুঁতভাবে তারা লরি ও শরির জিনিসপত্র নিয়ে অন্তর্ধান করত যে, ওই সব লরির কোনও অংশবিশেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যেত না। এমন কি যে সব বাজারে পুরনো ইঞ্জিন ও পার্টস বিক্রি হয় সেখানেও ওই সব লরির কোন কিছু পাওয়া যেত না।
এইসব নিখোঁজ হয়ে যাওয়া লরির কোনও খবরই কলকাতা পুলিশ রাখত না। কারণ এইসব কেসগুলো সবই রাজ্য পুলিশ এলাকায় হত। কলকাতা পুলিশের কেউ কেউ উড়ো খবরের মত এ খবরটা শুনেছিল, তার বেশি কিছু না। কিন্তু দায়িত্বশীল পুলিশের কাজই হচ্ছে শোনা খবরটা গুরুত্ব সহকারে সযত্নে মনে রাখা, যতদিন না সেই খবরের সত্যাসত্য সঠিকভাবে জানা যাচ্ছে।
এভাবে দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, ওদিকে ম্যাজিকের মত একের পর এক উবে যায় লরি নিয়ে ড্রাইভাররা। সেসময় পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, সত্তর দশকের নকশাল অভ্যুত্থানের ডামাডোলের মধ্যে কে, কোথায় লরি চুরি করে পালাল কে আর রাখে তার খোঁজ?
আমার তখন অনেকদিন মুচিপাড়া, বড়বাজার, জোড়াসাঁকো থানা হয়ে লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগে পোস্টিং হয়েছে। গোয়েন্দা দফতরের সোর্সের বিরাট জাল ছড়িয়ে ছিল কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলির বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। তখন আমরা লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের সর্বস্তরের কর্মচারী একটা টিম হিসেবে কাজ করতাম। কে কোন বিভাগ তার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতাম না। মার্ডার স্কোয়াডের, কি ডাকাতি, কি ছিনতাই বা অন্য ডিপার্টমেন্টের সেরকম হলেও কেস এলে সবাই মিলে একসঙ্গে তার মোকাবিলা করার চেষ্টা করতাম। আমরা সবাই এক পরিবারের সদস্য হিসেবে নিজেদের ভাবতাম ও অপরাধী ধরতে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। তাই তখন সোর্সের জালটাও খুব ভালভাবে বিস্তার করা সম্ভব হয়েছিল।
একদিন কলকাতার এক নামজাদা মাস্তান, আমার সোর্স, আমায় খবর দিল, মধ্যমগ্রাম অঞ্চলের একটা লোক তার কাছে জার্মানির তৈরি ‘বেটাগন’ পিস্তল বিক্রি করতে নিয়ে এসেছিল। পিস্তলটা অত্যাধুনিক মডেলের, তাকে সে পিস্তলটা দেখিয়েওছে। আমার বিশ্বস্ত মাস্তান সোর্সটি অবশ্য সেটা কেনেনি, তাকে ফেরত দিয়ে দিয়েছে।
খবর তো পেলাম। এবার যার খবর পেলাম তার গতিবিধি, কাজকর্ম, দলবলের পাত্তা লাগাতে তার পেছনে আমাদের লোক লাগিয়ে দিলাম। কদিন বাদে খবর পেলাম, সেই লোকটি অতি সাধারণ চেহারার, মাঝারি উচ্চতার। চোখে এত হাই পাওয়ারের চশমা যে মনে হয় কাঁচের বোতলের পেছনের দিকের দুটো ভাঙা কাঁচ যেন চোখে পরে আছে। নিচু স্বরে, বিনয়ের সাথে মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে। সে আবার মধ্যমগ্রাম অঞ্চলের কংগ্রেস পার্টির মাঝারি মাপের নেতা! তাকে একডাকে ওই অঞ্চলে সবাই চেনে। কিন্তু সে কি করে, ঠিক কোন কাজের সঙ্গে জড়িত তা কেউ
বলতে পারল না। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, ভয়েই হোক কিংবা শ্রদ্ধায়ই হোক তার বিরুদ্ধে কোনও কথা কেউ বলে না। প্রায় প্রতিদিনই সে ছ’সাত ঘণ্টার জন্য মধ্যমগ্রামের বাইরে কোথায় চলে যায় কেউ তা জানে না। কদিন বাদে আরও খবর পেলাম, তাকে কখনও দেখা গেছে নৈহাটি, কখনও বনগাঁ, কখনও বর্ধমান বা কলকাতা ও উত্তর চব্বিশ পরগনার বিভিন্ন অঞ্চলে। কিন্তু কোনও পুলিশের খাতায়ই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে এসব খবরাখবর নিতে লাগলাম, বিভাগের অন্য কেউ জানে না। আমার লক্ষ্য ‘বেটাগন’ পিস্তলের সূত্র ধরে আরও বেশি অস্ত্র উদ্ধার করা যায় কিনা।
একদিন সকালবেলা আমি গাড়িতে করে আমার এক ওয়াচম্যানকে সঙ্গে নিয়ে মধ্যমগ্রামের দিকে রওনা দিলাম। আমার সেই ওয়াচম্যান জানে সকালে সেই লোকটি কখন একটা চায়ের দোকানে আড্ডা মারতে আসে। আমরা চায়ের দোকানের কাছাকাছি আসতে ওয়াচম্যান লোকটাকে দেখিয়ে দিল। দেখে কেউ ভাবতেই পারবে না, ওই লোকটা বেআইনি অস্ত্রের ব্যবসা করে। বরং পাঞ্জাবি, পায়জামা পরা লোকটাকে দেখে মনে হতে পারে গ্রামের কোনও প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। হাত দুটো কোলের কাছে জড়ো করে নম্র গলায় মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে কথা বলে। আমি আমাদের ওয়াচম্যানকে নিয়ে ফিরতে ফিরতে ভাবলাম, ওর ওপর নজর রাখাটা দরকার।
অস্ত্র সমেত হাতেনাতে ধরতে হবে ওকে, কারণ ওর সাথে কংগ্রেসের বড় বড় নেতার ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে। তাছাড়া শুধুমাত্র একটা খবরের ভিত্তিতে ওকে ধরা যাবে না। চারদিকে হৈচৈ ফেলে দেবে কংগ্রেসীরা। অন্যদিকে বুঝতে হবে, ওই লোকটা কোনও একটা জায়গায় হঠাৎ একটা পিস্তল পেয়ে বিক্রি করে দিতে চেয়েছে, নাকি অস্ত্রের কালোবাজারীটাই ওর আসল ব্যবসা। যদি হঠাৎ একটা অস্ত্র পেয়ে কারোকে বিক্রি করে হাত ধুয়ে ফেলে তাহলে ওকে ধরে কোনও লাভ হবে না, ছেড়ে দিতে হবে প্রমাণের অভাবে, উল্টে আমাদেরই বদনাম হবে। আর যারা ওই ব্যবসায় ওর সাথে জড়িত তারা তো আর বোকার মত আমাদের হাতে এসে ধরা দেবে না। গোটা দলকে ধরার জন্য ফাঁদ পাততে হবে, ধৈর্য ধরে এগিয়ে যেতে হবে, তবেই পাখি ধরা পড়তে পারে।
লোকটাকে মধ্যমগ্রামে দেখে আসার পর মাথায় শুধু ঘুরতে লাগল কিভাবে ওই লোকটাকে ফাঁদে ফেলে ধরা যায়। নজরদাররা নতুন কোনও তথ্য দিতে পারছে না, শুধু কখন মধ্যমগ্রাম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, কখন ফিরছে, এসব খবর পাচ্ছি। অপেক্ষা করছি নতুন কোনও তথ্যের। এইভাবেই কটা দিন কেটে গেল। হঠাৎ বনগাঁ থেকে একটা ডাকাতির মামলায় একটা ছেলেকে গ্রেফতার করা হল। সেই ছেলেটা আমাদের প্রচণ্ড জেরার মুখে এমন সব অজানা তথ্য দিল যা শোনার জন্য আমরা নিজেরাই প্রস্তুত ছিলাম না। সেই তথ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় চমক ছিল মধ্যমগ্রামের সেই লোকটার সম্পর্কে।
আগেই খবর পেয়েছি, প্রদেশ কংগ্রেসের পুরনো অফিসে প্রায়দিনই সে মধ্যমগ্রাম থেকে সন্ধেবেলায় আসে। নজরদারদের কাছে খবর নিলাম সে দিনও এসেছে। আমি আর দেরি না করে একটা প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে সোজা প্রদেশ কংগ্রেসের ওই অফিসে চলে গেলাম। অফিসে ঢুকে খুঁজতে লাগলাম মধ্যমগ্রামের সেই পুরু চশমা লাগানো বিনয়ী লোকটাকে। এদিক ওদিক খুঁজতেই তাকে দেখতে পেলাম। কাছে গিয়ে বললাম, “এই যে মিঃ সমাদ্দার, আপনার সাথে আমার একটু প্রয়োজন ছিল।” সে আমাকে তাজ্জব বানিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, “কি ব্যাপার রুণুদা?” আমি ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলাম, ও আমাকে চিনল কি করে? কোনদিন তো ওর সাথে আমার পরিচয় হয়নি। তবে বুঝলাম, আমি ঠিক লোককেই ধরতে এসেছি, কারণ পেশাদার অপরাধী না হলে পুলিশ অফিসারকে চিনে রাখার প্রয়োজন কি? আমি তাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে শুধু বললাম, “একটু অফিসের বাইরে আসুন, বলছি।” সে ঘাড় নাড়ল, “চলুন।” সে আমার সঙ্গে কংগ্রেস অফিসের বাইরে আসতে আমি বললাম, “আপনাকে আমার সাথে একটু লালবাজারে যেতে হবে, একটা আসামীকে ধরেছি, সে বলছে সে নাকি মধ্যমগ্রামে কংগ্রেস পার্টি করে, তার কথাটা ঠিক কিনা আপনি দূর থেকে ছেলেটাকে দেখে বলে দেবেন।” বিনয়ী সমাদ্দার বলল, “এই কথা, এর জন্য আপনি আবার ছুটে এলেন কেন, কারোকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দিলেই তো আমি চলে যেতাম।” কথা বলতে বলতে সে আমার গাড়িতে উঠে বসল।
গাড়ি ছুটে চলল লালবাজারের দিকে। সমাদ্দার চুপচাপ, নিশ্চয়ই কিছু ভাবছে, মুখ দেখে ওর মনের প্রতিক্রিয়া আমি জানতে পারছি না। কিন্তু আমার মনের মধ্যেও অসংখ্য প্রশ্ন জাগছে। ভাবছি, যে কারণে ওকে ধরে নিয়ে এলাম, সেই চেষ্টায় সফল হব তো? উদ্ধার করতে পারব তো ওর থেকে অস্ত্রশস্ত্র, ধরতে পারব তো দলের অন্য সব লোকেদের? তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার, সমাদ্দার খুব ঠাণ্ডা মাথার ক্রিমিনাল, আমাকে সে আগের থেকে চিনে রেখেছে, হয়ত আমার মত বহু অফিসারকেই সে চেনে। সবচেয়ে বড় কথা সে যে চিনে রেখেছে তা কিন্তু তার আচরণে বিন্দুমাত্র প্রকাশ পাচ্ছে না, উল্টে মৌনীবাবা হয়ে আমার সঙ্গে লালবাজারে যাচ্ছে। এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন এক প্রকৃত দেশসেবক গান্ধীবাদী কংগ্রেসী, পুলিশকে সাহায্য করার জন্য নিজের কাজ ফেলে দেশের সেবায় লাগতে যাচ্ছে।
গাড়ি এসে থামল লালবাজাবের গোয়েন্দা বিভাগের বড় বিল্ডিংটার নিচে। দুজনেই গাড়ি থেকে নামলাম। সমাদ্দারকে বললাম, “চলুন।” সমাদ্দার সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে শুরু করল। আমি তার পেছন পেছন উঠতে লাগলাম। অফিসে ঢুকতেই সমাদ্দার জিজ্ঞেস করল, “কোথায় সেই ছেলেটা রুণুদা?” আমি তার কথার কোনও উত্তর না দিয়ে আমাদের বিভাগের অন্য অফিসারদের দিকে তাকিয়ে বললাম, “এই হচ্ছে মিঃ সমাদ্দার, একে পেছনের অফিস ঘরটায় নিয়ে যাও, চা খেতে দিও, বেশি যদি ওর খিদে পায় তবে ‘টা’ও দিও।” সমাদ্দার আমার কথা শুনে খুব নম্র স্বরে বলল, “না, না, আমার খিদে পায়নি, কিছুক্ষণ আগেই খেয়েছি।” আমি আবারও ওর কথার জবাব না দিয়ে অফিসারদের বললাম, “আমি একটু বেরচ্ছি, ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ফিরে আসব।”
গাড়ি নিয়ে ঘুরছি এদিক ওদিক, চলে গেলাম গঙ্গার ধারে, ভাবছি, আমাদের অফিসাররা সমাদ্দারের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করতে পেরেছে কি না। যদিও জানি অফিসাররা প্রত্যেকেই প্রচণ্ড দক্ষ, সমাদ্দারের কাছ থেকে সত্যি কথাটা বের করে ছাড়বেই, সমাদ্দারের পালানর পথ নেই। গঙ্গার হাওয়ায় উত্তেজনা কিছুটা ঠাণ্ডা করে ফিরে এলাম লালবাজারে। ততক্ষণে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। নিজের ঘরে ঢুকতেই এক অফিসার এসে বললেন, “সমাদ্দার সব স্বীকার করেছে।” যে ঘরে সমাদ্দার ছিল সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি, সমাদ্দার বিধ্বস্ত, ওর চশমাটা টেবিলের ওপর রাখা। বুঝলাম শুধু ‘চা-য়ে’ সে স্বীকার করেনি, ‘টা’ও কিছু খেয়েছে। আমাকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, “আমাকে বাঁচান রুণুদা, আমি আর কিছু করব না, সব ছেড়েছুড়ে দেওয়ার মুখেই আমি ধরা পড়লাম।” আমি কড়া গলায় বললাম, “বাঁচতে চাস তো কোথায় কোথায় তোর আর্মস রাখা আছে, আজ রাতেই দেখিয়ে দে। আর তোর দলের লোকেদের কোথায় পাওযা যাবে আমাদের বল।” সমাদ্দার বলল, “ঠিক আছে, বলছি।”
এরপর সমাদ্দারকে নিয়ে আমাদের একটা দল চলে গেল গোপন অস্ত্র উদ্ধার করতে, অন্য একটা দল গেল সমাদ্দারের দেওয়া ঠিকানা নিয়ে ওর শাগরেদদের সন্ধানে। গভীর রাতে প্রথম দলটা লালবাজারে ফিরে এল বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করে, সমাদ্দারই তার গুপ্ত ডেরায় নিয়ে গিয়ে সেইসব দেখিয়ে দিয়েছিল। তার মধ্যে ছিল রিভলবার, পিস্তল, কার্বাইন ভোজালি। অস্ত্রগুলো দেখে বললাম, “আর কোথায় কি আছে সমাদ্দার?” সমাদ্দার মাথা নিচু করে বলল, “আর নেই, যা ছিল সবই দেখিয়ে দিয়েছি।” আমাদের দ্বিতীয় দলটা ফিরে এল তারও অনেক পরে। তারা কারোকে গ্রেফতার করতে পারেনি, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র নিয়ে এসেছে। সেই সূত্র ধরেই কয়েকদিনের মধ্যে মধ্যমগ্রামের এক জায়গা থেকে গ্রেফতার করলাম দুবে নামে একটা ছেলেকে আর নৈহাটির এক পাড়া থেকে ধরলাম ভাইয়াকে। দলের অন্য লোকেরা ওদের ধরা পড়ার খবর শুনে কোথায় আত্মগোপন করেছে, তার খোঁজে আমাদের একটা দল ব্যস্ত রইল।
এবার আমরা ধৃত তিনজনকে নিয়ে পড়লাম, আসল রহস্য উদ্ধারে। আমরা তিনজনকে আলাদা আলাদা ভাবে জেরা করতে শুরু করলাম, যাতে কে কি বলছে, তা অন্যজনে জানতে না পারে। একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনকে খেপিয়ে দিলাম, যাতে সত্যি কথা সব বেরিয়ে আসে। এটা পুলিশের একটা চালু পদ্ধতি। আমাদের জেরায় জেরবার হয়ে ওরা ওদের কীর্তিকাহিনী যা শোনাল তা পুলিশ মহলকে স্তম্ভিত করে দেওয়ার মত।
ওই বিনয়ী তাত্ত্বিক নেতার ভডং ধরা সমাদ্দারই ছিল ওদের দলের একচ্ছত্র নেতা। পুরো দলটাই তার হাতে তৈরি। বেকার ছেলেদের এক এক করে লোভ দেখিয়ে টেনে এনে নিজের দল তৈরি করেছে। নিজেই টাকা যোগাড় করে রিভলবার, পিস্তল কিনেছে। দল যখন তৈরি হল, অস্ত্রও কেনা হল, তখন সমাদ্দার দলের সব ছেলেকে একদিন মধ্যমগ্রামের একটা মাঠে গভীর রাতে ডাকল। ওর পরিকল্পনার কথা বলল। সমাদ্দার তাদের বোঝাল, সাধারণ ডাকাতি করলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু শহর থেকে অনেক দূরে ডাকাতি করে এখানে পালিয়ে এলে কেউ কিছু বুঝতেই পারবে না। সে বলল, “তাই আমি ঠিক করেছি বহুদূরে কোথাও গিয়ে আমরা আমাদের কাজ করে রাতারাতি ফিরে আসব। সেই অনুযায়ী সব তৈরি, তোমরা আগামীকাল সন্ধে ছটার মধ্যে এখানে সবাই চলে আসবে, তারপর আমরা রওনা দেব।”
সমাদ্দারের কথায় সবাই রাজি হয়ে গেল। পরদিন সন্ধে হুটার আগেই সবাই হাজির। সমাদ্দার সঙ্গে এনেছে দুটো বড় বড় কিট্স ব্যাগ। তার ভেতরেই সে নিয়ে এসেছে অস্ত্রশস্ত্র। সমাদ্দার দলে নিয়েছিল দুটো পাকা লরি ড্রাইভারকে। তাদের নিয়ে সে এগিয়ে গেল কিছুটা দূরে দাঁড় করান একটা লরির দিকে। একজন ড্রাইভারের হাতে লরির চাবিটা দিল, ছেলেদের বলল লরিতে উঠে পড়তে, তারপর সে ড্রাইভারের পাশে বসে বলল, “চল।” রাস্তায় একটা পেট্রল পাম্প থেকে ট্যাঙ্কভর্তি ডিজেল নিয়ে নিল। কৃষ্ণনগর ছাড়িয়ে একটা জায়গায় সমাদ্দার গাড়ি দাঁড় করিয়ে দলের সমস্ত লোককে ডেকে ওর পুরো ছকটা বলল। সবাইকে কাজের ভার বুঝিয়ে দিয়ে আবার লরি ছেড়ে দিল। লরি দ্রুতগতিতে ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়ল মালদা জেলায়।
ফারাক্কা থেকে বেশ খানিকটা আগে হাইওয়ের ওপর একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার জায়গায় সমাদ্দার ড্রাইভারকে বলল গাড়ি থামাতে, তারপর গাড়ি থেকে নেমে প্রত্যেককে হুঁশিয়ার করে বলল, “যখন তখন আমাদের মাল এসে যেতে পারে, সবাই রেডি হয়ে নাও।” এরপর কিটস ব্যাগ খুলে সবার হাতে ধরিয়ে দিল অস্ত্র, নিজে রাখল একটা পিস্তল, আর কোমরে গুঁজে নিল একটা ভোজালি। অন্ধকার রাত চিরে ওদের লরির পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে অন্য লরির দল। সমাদ্দার আর ওদের দলের প্রত্যেকেই রাস্তার ওপর নজর রাখছে। এইভাবে কেটে গেল আধঘণ্টা। হঠাৎ একটা লরিকে দ্রুতগতিতে হেড লাইটের তীব্র আলো জ্বেলে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। তক্ষুণি সমাদ্দার বলে উঠল, “চার্জ।” ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করল। হেডলাইটটা একবার জ্বালাচ্ছে, একবার নেবাচ্ছে, যাতে উল্টো দিক থেকে ছুটে আসা লরিটা ওর সিগন্যালে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে নিজের গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়। সমাদ্দারের নির্দেশে ড্রাইভার রাস্তার ডানপাশ চেপে লরি নিয়ে চলেছে, যাতে বিপরীত দিকের লরিটা পাশ কাটিয়ে বের হওয়ার জায়গা না পায়।
উত্তরবঙ্গের দিক থেকে আসা লরিটা বাধ্য হয়ে গতি কমিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সমাদ্দারদের লরিটা ওই গাড়ির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেতেই সবাই লাফ মেরে রাস্তায় নেমে ঘিরে ধরল লরিটাকে। সবার হাতেই কিছু না কিছু আগ্নেয়াস্ত্র। ঝটপট ড্রাইভার আর খালাসিকে টেনে নামিয়ে নিল ওরা। চিৎকার করে উঠতেই দুটো ভোজালি নেমে এল দুজনের গলায়। বন্ধ হয়ে গেল চিৎকার, লুটিয়ে পড়ল দুটো রক্তাক্ত দেহ। কাটা পাঁঠার মত দুবার হাত পা ঝটকা দিয়ে স্থির হয়ে গেল। তারপর ওদেরই কাপড় দিয়ে জড়িয়ে ছুঁড়ে তুলে দেওয়া হল নিজেদের ফাঁকা লরিতে। সমস্ত কাজটাই হয়ে গেল তিন চার মিনিটের মধ্যে। ওদিকে মালবোঝাই গাড়িতে উঠে গেছে সমাদ্দারের ড্রাইভার। গাড়িতে বোঝাই চায়ের বাক্স। নিজেদের গাড়ি একটু পিছিয়ে নিয়ে এসে ওই গাড়িটাকে জায়গা দিল বেরিয়ে যাওয়ার। লাশ দুটোকে ঢেকে দেওয়া হল ত্রিপল দিয়ে। দুটো গাড়িই বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। সমাদ্দার চা বোঝাই লরিতে ড্রাইভারের সাথে অন্য একটা ছেলেকে তুলে দিল, তারা তার নির্দেশ মত চলে গেল বিহারে। সমাদ্দার নিজেদের লরিটা নিয়ে মধ্যমগ্রামের রাস্তা ধরল। বেশ অনেকটা আসার পর রাস্তার ধারে একটা পানাভর্তি খালে চটের বস্তায় লাশ দুটো ভরে, ইঁট বেঁধে ফেলে সে রাতেই ওরা ফিরে এল মধ্যমগ্রাম।
কিন্তু এই ডাকাতিটা সমাদ্দারের নিজের তেমন পছন্দ হল না। লাশ দুটো দিন দশ পর ইঁটের বস্তার বাঁধন ছিঁড়ে জলে ভেসে উঠেছিল, অবশ্য এত পচাগলা হয়ে গিয়েছিল যে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে চায়ের দামও ভাল পাওয়া যাযনি, ডাকাতি করা লরিটা প্রায স্ক্র্যাপের দরে বিক্রি করতে হযেছিল।
সমাদ্দার এবার তার ছকটা পাল্টে ফেলল। প্রথম যে লরি নিয়ে ডাকাতি করতে গিয়েছিল, সেটা ছিল ভাড়া করা। এটা তার ঘোর অপছন্দ। এবার তাই সে একটা পুরনো লরি কিনে নিল। তারপর চলে গেল বিহারে। সেখানে গিযে সে এবার লরি ও ডাকাতির জিনিস কেনাব লোক আগে থেকেই ঠিক করে এল।
সমস্ত ছকটা আবার নতুনভাবে সাজিয়ে এক অমাবস্যার রাতে লরি নিয়ে সমাদ্দারের দল পৌঁছে গেল আবার মালদা জেলার হাইওয়ের ওপর সেই জায়গাটায। তারপর নিজেদের গাড়িটার মুখ ঘুরিযে দক্ষিণে করে গাড়ির আলো নিবিয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগল কখন আসবে একা কোনও মালবোঝাই লরি। সাধারণত রাতে হাইওয়েতে দল বেঁধে লরি যাতায়াত করে ডাকাতির ভয়ে। কিন্তু মাঝে মাঝে দুএকটা লরি দলছুট হয়েও ছোটে, আর সেগুলোই সমাদ্দারের লক্ষ্যবস্তু। ওরা গাড়ি নিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে রাস্তায় নেমে সমাদ্দার দেখছে শিকার ফাঁদে পা দিতে এল কিনা। রাত দশটা নাগাদ দেখতে পেল একটা গাড়ি দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে। তার ইশারায় ড্রাইভার গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে রাখল। যেই ওই মালবোঝাই গাড়িটা ওদের গাড়িকে টপকে বেরিয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে সমাদ্দারদের গাড়িও ওই লরিটার পিছু ধাওয়া করল।
প্রায় আধ কিলোমিটার পথ পার হয়ে সমাদ্দারদের গাড়ি মালবোঝাই লরিটাকে ওভারটেক করে দাঁড়িয়ে পড়ল তার সামনে। লরিটা প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষে দাঁড়াতে বাধ্য হল। সমাদ্দারদের লরির পেছন থেকে নেমে দাঁড়াল দুজন লোক ওই লরির ড্রাইভারের দিকে স্টেনগান তাক করে, আর অন্য চারজন পিস্তল, রিভলবার উঁচিয়ে ঘিরে ফেলল ড্রাইভারের কেবিন। সমাদ্দার ড্রাইভারের কেবিনে উঠেই তার মাথায় সজোরে আঘাত করল রিভলবারের বাঁট দিয়ে। ড্রাইভাব নেতিয়ে পড়তেই ওকে সমাদ্দার টেনে নামিয়ে নিল রাস্তায়। অন্যদিকে খালাসি ও একটা বাচ্চা ছেলেকে ততক্ষণে নামিয়ে নিয়েছে শাগরেদরা। বাচ্চা ছেলেটা ড্রাইভারের ভাই, লরিতে করে যাচ্ছিল কলকাতা দেখতে। তিনজনকেই ওরা টানতে টানতে নিয়ে গেল নিজেদের লরির পেছনে, খালাসি একবার কি বলে উঠতেই ধাঁই করে ওর মুখে পড়ল সমাদ্দারের ঘুষি। চাপা গলায় সমাদ্দার বলে উঠল, “চোপরাও দোনস্ববী মাল লেকে যাতা হ্যায়, ফিন বাত নিকালতা।” ড্রাইভার আধো চেতনায় কোনওমতে বলল, “দুনম্বরী মাল নয়, কেবিনে সব চালান আছে।” সমাদ্দার আর ওর শাগরেদরা ততক্ষণে ওদের ঠেলে তুলে দিয়েছে নিজেদের লরিতে। তারপর পিছমোড়া করে হাত বেঁধে দিয়ে একই দড়ি দিয়ে তিনজনকে বেঁধে বসিয়ে দিয়ে লবি ছুটিয়ে দিয়েছে। মালবোঝাই লরিটা নিয়ে তখন সমাদ্দারের পাকা ড্রাইভার আর এক শাগরেদ চলতে শুরু করেছে বিহারের দিকে। বিহারে কথাবার্তা সব পাকা আছে। এবার দামও ভাল পাওয়া যাবে। লরিতে আছে মশলাপাতি। সমাদ্দারের ড্রাইভারের গলা দিয়ে গান বেরিয়ে এল।
ওদিকে সমাদ্দার তার গাড়ি নিয়ে ছুটছে মধ্যমগ্রামের দিকে। পেছনে তার লোকেরা স্টেনগান উঁচিয়ে পাহারা দিচ্ছে তিনজন বন্দিকে। ড্রাইভারটা একবার কাতর গলায় জিজ্ঞেস করল, “আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন বাবু?” সমাদ্দারের পাহারাদার শাগরেদ বলল, “কলকাতা।” লরি চলেছে প্রচণ্ড গতিতে। বাচ্চাটা ভয়ে কুঁকড়ে আছে। মাঝে মাঝে চোখ বড় করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, হয়ত ভাবছে কলকাতায় বেড়াতে গেলে এইভাবেই যেতে হয়। ড্রাইভার একবার কোনমতে মিনমিন করে বলল, “আমাদের যা ইচ্ছে করুন, আমার ভাইকে ছেড়ে দিন।” পাহারাদার ওকে যাচ্ছেতাই গালাগালি দিয়ে মুখে মারল পরপর কটা ঘুষি। নাক, মুখ ফেটে গেল ড্রাইভারের, সে কথা বন্ধ করে দিল।
অন্ধকার রাস্তায় হু হু করে ছুটছে লরি। মধ্যরাত পার করে লরি এসে পৌঁছল মধ্যমগ্রামে। ড্রাইভারের পাশে বসে আছে সর্বাধিনায়ক সমাদ্দার। এবার লরি মধ্যমগ্রামের মূল রাস্তা ছেড়ে বাঁদিকে একটা কাঁচা রাস্তা ধরল। গাড়ি এবার আর আগের মত গতিতে ছুটতে পারছে না। আস্তে আস্তে বসতি শেষ হয়ে গেল। রাস্তার দুধারে বড় বড় প্রাচীন গাছ। গাছে বাসা বেঁধেছে অসংখ্য পাখি, কাঠবেড়ালি, গিরগিটি, তক্ষক সাপ যারা প্রহরে প্রহরে ডাক দিয়ে সঙ্গীসাথীদের জানায় ভোর হতে আর ঠিক কত দেরি। এই গভীর গহন রাতে আচমকা লরির আওয়াজের আক্রমণে আর হেডলাইটের তীব্র আলোয় ওরা ভয় পেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে ডাকতে শুরু করল। লরির সামনে দিয়ে ছুটে চলে গেল দুটো শেয়াল। যেন পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কাঁচা রাস্তায় সমাদ্দারের লরি দুলতে দুলতে এগিয়ে চলল।
কালো আকাশের গায়ে মেঘের আস্তরণ সরিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে কিছু নক্ষত্র, যেন ত!বা গভীর কৌতূহলে দেখছে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সমাদ্দাররা ওই অসহায় তিনটি প্রাণীকে। এভাবে প্রায় দু কিলোমিটার চলার পর লরি থামল একটা জায়গায়। জায়গাটা ঘিরে আছে জংলি ঝোপ, বড় বড় গাছগুলোকে মুড়ে রেখেছে লতানো গাছ, অসংখ্য বাঁশ ঝাড়। বাঁশে বাঁশে ঘষা লেগে মাঝেমাঝে নিঃস্তব্ধতা ভেঙে শব্দ হচ্ছে ক্যাঁকর ক্যাঁকর, ক্যাঁকর ক্যাঁক। চারদিকে থমথমে জমাটবাঁধা অন্ধকার। সমাদ্দার আর তার সঙ্গিরা লরি থেকে নামিয়ে নিল বন্দিদের। তারপর তাদের কোমরের লম্বা দড়ি ধরে টানতে টানতে লাইন দিয়ে নিয়ে চলল অন্ধকার পথ ধরে। দড়ির সামনের দিক ধরে আছে একজন, পেছন দিক অন্যজন। যেন তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোনও আদালতে বিচারের জন্য। সমাদ্দার খোলা রিভলবার হাতে সবার সামনে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার শাগরেদদের সবার হাতেই স্টেনগান, নয়তো রিভলবার কি পিস্তল।
অন্ধকারে চোখ সইতেই দেখা গেল কিছুটা খোলা জায়গা, চারদিক জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। জমিটা অসমান। মাঝে মাঝে পুরনো খুঁজে যাওয়া গর্ত। প্রখর দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে বহুদিন আগেকার আধপোড়া কাঠ। মাঠের চারপাশে স্তূপ স্তূপ অন্ধকার ঝোপে ঝোপে আটকে আছে। বোঝাই যায় এ মাঠে দিনের বেলাতেও যাতায়াত করে না মানুষজন। হঠাৎ এই অমাবস্যার নিশুতরাতে অনাহূতের আগমনে আতঙ্কিত হয়ে ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে বেজি, ব্যাঙ, শেয়াল। সমাদ্দাররা তাদের তিন বন্দিকে নিয়ে এসে দাঁড়াল ওই মাঠের মাঝখানে। খালাসিটা জিজ্ঞেস করল, “এ আমাদের কোথায় নিয়ে এসেছেন বাবু?” সমাদ্দারের এক শাগরেদ তার উত্তরে খালাসিটার ঘাড়ে একটা রদ্দা মেরে বলল, “যমদুয়ারে।” সত্যিই ওটা যমদুয়ার। ওটা একটা প্রাচীন পরিত্যক্ত শ্মশান। সাঁঝেরহাট শ্মশান।
শ্মশানের মাঝখানে একটা গাছের তলায় ওদের এনে বসিয়ে দিল সমাদ্দাররা। দড়ির দুই প্রান্ত বেঁধে দিল গাছের দুই বিপরীত ডালে, যাতে ওরা ছুটে পালিয়ে না যেতে পারে। বাচ্চা ছেলেটা তার ড্রাইভার দাদাকে কি একটা বলতে যেতেই সমাদ্দারের বুটের সপাট কিক খেয়ে ককিয়ে উঠে শুয়ে পড়ল মাটিতে। তারপর সমাদ্দাররা শ্মশানের বাঁদিকে চলে গেল, ওখানে ঝোপের আড়ালে রাখা আছে স্তূপীকৃত নতুন কাঠ। কাঠের পাশেই কোদাল, কুডুল, শাবল ইত্যাদি মজুদ। সমাদ্দারের নির্দেশে ওর দুই শাগরেদ পাশের দুই পুরনো গর্তকে কোদাল দিয়ে নতুন করে খুঁড়তে শুরু করল। হাতখানেক গর্ত হতেই সমাদ্দার তাদের থামিয়ে দিল। তারপর দ্রুত হাতে দুটো গর্তের ওপর কাঠ দিয়ে সাজাতে লাগল চিতা। দুটো চিতাই সাজান হয়ে গেলে ওরা ফিরে এল বন্দীদের কাছে। বন্দি তিনজন তখন বলির পাঁঠার মত দড়ি বাঁধা অবস্থায় অন্ধকার মাঠে বসে কাঁপছে। ভয়ে ওরা বসে আছে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। এরাই রাতের অন্ধকারে অসীম সাহসে বুক বেঁধে হাইওয়ে দিয়ে বড় বড় মালবোঝাই লরি চালিয়ে দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে যায়, এখন দেখলে বোঝা মুশকিল।
সমাদ্দাররা ওদের টানতে টানতে নিয়ে এল চিতার কাছাকাছি। ড্রাইভারটা কাতর কণ্ঠে সমাদ্দারকে বলল, “বাবু আমাদের যা ইচ্ছা হয় করুন, কিন্তু আমার ছোট ভাইটাকে ছেড়ে দিন।” উত্তরে সমাদ্দারের হাতের স্টেনগান গর্জে উঠল। ধুপ ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেল পরপর তিনটি দেহ। চিতা তৈরি করাই আছে। শাগরেদরা দেহগুলো তুলে দিল চিতায়। ড্রাইভার আর তার আদরের ভাইকে সমাদ্দার দয়া করে একটা চিতায় তুলল, খালাসিকে অন্য চিতায়। টপটপ করে রক্ত পড়ছে চিতার কাঠে। সবাই মিলে দ্রুত হাতে লাশ দুটোর ওপর চাপাতে লাগল আরও কাঠ। তারপর দুটো চিতায় ধরিয়ে দেওয়া হল আগুন। আস্তে আস্তে চিতা দুটোর কাঠ জ্বলে উঠল, আগুনের আভায় দেখা যেতে লাগল শ্মশানের চারদিক।
অন্ধকারের বুক চিরে হঠাৎ আগুনের লেলিহান শিখায় চারদিকের ঝোপে আর গাছে ঘুমিয়ে থাকা পাখিরা, ছোট ছোট জন্তু-জানোয়াররা ভয় পেয়ে বেরিয়ে এল। ডাকতে লাগল এমন স্বরে যেন বলতে চাইছে, এ কোন নতুন পশু আমাদের আস্তানায় রাতের অন্ধকারে হানা দিল?” তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে বাচ্চাটার দেহ। নতুন কাঠ পেয়ে আগুনের তীব্রতা বেড়ে গেল। পুরো শ্মশানের চিত্রটাই দেখা যাচ্ছে। চিতার শিখা হাওয়ার দোলায় পাশের ঝোপঝাড়েও ধরিয়ে দিল আগুন। পাখিদের ক্রমাগত আর্তনাদে নিঃঝুম অঞ্চলটা খানখান। তাঁরা যেন আর্তনাদে জানতে চাইছে পৃথিবীর কাছে, কেউ কি কখনও দেখেছে এমন নিষ্ঠুর, হিংস্র, চরম পাশবিক মৃত্যু। নিজের জন্য বানানো চিতার সামনে দাঁড়িয়ে খুন হয়ে সাথে সাথে সেই চিতায় পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া? সমাদ্দারের এক সঙ্গী বলল, “ড্রাইভার দাদার চিতায় ভালই মানিয়েছে ওকে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে চিতার আগুনে ড্রাইভার, খালাসি আর বাচ্চার দেহ পুড়ে ছাই হয়ে গেল। তক্ষক সাপটা প্রহর শেষের ডাক দিয়ে জানান দিল ভোর হল বলে। সমাদ্দারের শাগরেদরা শ্মশানের পাশের পুকুর থেকে বালতি করে করে জল এনে নিবিয়ে দিল চিতা দুটো। তারপর সবাই হাত ধুয়ে দেখে নিল সব কাজ ঠিকঠাক শেষ হয়েছে কিনা। ওদের নিয়ে লরি ছেড়ে দিল। ভোরের হাওয়ায় চিতার ছাই উড়ে ছড়িয়ে পড়ল সারা শ্মশানের মাঠে, আশেপাশের ঝোপঝাড় ও বড়বড় গাছের পাতায়। ওই ছাইয়ের মধ্যেই মিশে রইল ড্রাইভার, খালাসি আর বাচ্চাটার মৃত্যুযন্ত্রণা।
লরি ফিরতে শুরু করলে সমাদ্দারের মন অনেকটা শান্ত হল। সে তার অস্ত্রশস্ত্রের কিট্স ব্যাগ গুছিয়ে নিল। মুখে অল্প অল্প হাসি দেখা দিতে শাগরেদরাও আশ্চর্য হয়ে গেল। কাজের মধ্যে কোনরকম হাসিঠাট্টা চলবে না, এরকমই নির্দেশ ছিল দলের ছেলেদের ওপর। লরি মধ্যমগ্রামে পৌঁছলে তারা নেমে যে যার বাড়ির পথ ধরল। দিন দুই পর সন্ধেবেলায় সমাদ্দারের দুই শাগরেদ বিহার থেকে ফিরে এল লরি ও মশলাপাতি বিক্রির টাকা নিয়ে। তখন সমাদ্দার কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে, লম্বা খদ্দরের পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরে একটা মিটিংয়ে যাচ্ছিল গান্ধীজীর অহিংস নীতি সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে। সমাদ্দার শাগরেদদের কাছ থেকে টাকাপয়সা নিয়ে, যথাস্থানে রেখে, ওদের নির্দেশ দিয়ে দিল কে, কোথায়, কখন তার সাথে দেখা করবে।
নির্দিষ্ট দিনে সবাই মিলে খুব খানাপিনা হল। গ্যারেজে তখন নিজেদের লরি চেকআপ করা হচ্ছে, চুটিয়ে ব্যবসা করতে হলে বাহনকে চাবুক ফর্মে রাখতে হবে তো। ওদিকে তখন বিহারে আড়তদারের কাছে বিক্রি করা মশলাপাতি চালান হয়ে গেছে বিভিন্ন দোকানে। দোকান থেকে সেসব সাধারণ মানুষ কিনে নিয়ে যাচ্ছে বাড়িতে বান্নার স্বাদ বাড়ানর জন্য। কেউ কি জানে ওই মশলায় মিশে আছে তিন তিনটে তাজা প্রাণের রক্ত? বিক্রি করা লরিটার পাল্টে গেছে নম্বর প্লেট, দেহের সাজসজ্জায় এমন পরিবর্তন হয়েছে যে খোদ মালিকও চিনতে পারবে না। যদিও সে তখন হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার লরি, ড্রাইভার আর খালাসিকে।
মাসখানেক বাদে আবার এক রাতে সমাদ্দাররা পৌঁছে গেল মালদার হাইওয়ের সেই জায়গায়। সেদিন আর ওদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। এবার যে লরিটা তারা ওই একই কায়দায় আটকাল, সেটা একদম ঝকঝকে নতুন চা বোঝাই টাটা গাড়ি। ভেতরে বড় কেবিন। লরিতে ড্রাইভার ও খালাসি ছাড়াও ছিল আরও চারজন, সঙ্গে একটা একেবারে দুধের শিশু। ওই চারজনের মধ্যে দুজন পুরুষ, দুজন মহিলা। এরা সবাই ওই লরিতে উঠেছিল প্যাসেঞ্জার হিসেবে। শেষ বাস চলে যেতে তারা বাড়ি ফেরার জন্য রাস্তায় হাত দেখিয়ে থামিয়ে লরিটাতে উঠেছিল, যেরকম হাইওয়েতে আকছার হয়।
সমাদ্দাররা ড্রাইভার আর খালাসিকে প্রথমে টেনে নামিয়ে নিল রাস্তায়, ওরা কিছু বলতে যাচ্ছিল, সাথে সাথে ওদের মুখের ওপর পড়ল সমাদ্দারের ঘুঁষি। স্টেনগান, পিস্তল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমাদ্দারের শাগরেদরা। কে পাল্টা মারাব সাহস পাবে? ঘুষি খেয়ে ড্রাইভাররা চুপ করতেই তাদের তুলে দেওয়া হল নিজেদের লরিতে। পিছমোড়া করে বেঁধে দেওয়া হল হাত। ওদেরই গামছা দিয়ে ওদের মুখ বেঁধে দেওয়া হল। ওদিকে কেবিন থেকে সমাদ্দার ও তার শাগরেদরা টেনে নামাল চারজনকে। তারা ভয় পেয়ে চিৎকার করতে লাগল। চারপাশে খোলা ধূ-ধূ অন্ধকার মাঠ, জোনাকিরা মাঝে মাঝে টুকটুক আলো জ্বালিয়ে আরও ভয়ার্ত করে তুলেছে পরিবেশ। অন্ধকার ভেদ করে ওদের আর্তনাদ এমন কোনও জায়গায় পৌঁছবে না যাতে সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসতে পারে। তবু সাবধানের মার নেই। ওদের এলোপাথাড়ি ঘুষি মেরে চুপ করিয়ে দিল সমাদ্দাররা। এইসব গণ্ডগোলের মধ্যে দুধের বাচ্চাটা ঘুম-ভাঙা কান্না জুড়ে দিয়েছে। সেই কান্না শুনে কোনও এক রাতজাগা পাখি মাথার উপর ঠ্যাঁ ঠ্যাঁ করে ডাকতে শুরু করল, বোধহয় ঈশ্বরকে।
চা বোঝাই লরি নিয়ে ততক্ষণে সমাদ্দারের ড্রাইভার ছুটতে শুরু করে দিয়েছে বিহারের দিকে। এখন আর কারোকে কিছু বলতে হয় না। শাগরেদরা জানে কার কি ডিউটি। এদিকে চার যাত্রীকে রিভলবার উঁচিয়ে টানতে টানতে সমাদ্দার তুলে ফেলেছে নিজের লরিতে। তারপর ড্রাইভার আর খালাসিকে যেমনভাবে পিছমোড়া করে বেঁধে, মুখ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল তেমনি এদেরও জোড়ায় জোড়ায় বেঁধে দেওয়া হল। লরি ছাড়া হল মধ্যমগ্রামের দিকে। হু হু করে লরি ছুটছে, বাচ্চাটা বলের মত এদিক ওদিক ওলোট- পালোট খাচ্ছে। ওর কান্না বন্ধ হয়ে এল, বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেছে।’ ওর মা তখন অন্য মহিলার সাথে একই দড়িতে বাঁধা, অঝোরে কাঁদছে, কিন্তু বাচ্চার ওই অবস্থা দেখেও কিছুই করতে পারছে না। এমনকি চিৎকার করে কাঁদতেও পারছে না, মুখ বাঁধা। সমাদ্দারের শাগরেদরা স্টেনগান, রিভলবার নিয়ে পাহারা দিচ্ছে।
মধ্যরাতের আগেই এসে গেল মধ্যমগ্রাম। তারপর সেই সাঁঝেরহাট শ্মশানের পথ ধরল লরি। গাড়ির গতি এবার কমে গেল। কিছুটা সেই কাঁচা রাস্তায় চলতেই পাশের একটা নিচু গাছের ডালে ধাক্কা লাগল। গাছের মধ্যে ঝুলে থাকা বাদুড়গুলো উড়তে লাগল। একটা বাদুড় ঝুপ করে পড়ল লরির মধ্যে। এর গায়ে ওর গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে উড়ে গেল অন্ধকার জঙ্গলের দিকে। বাঁশঝাড়ের শব্দ, পাতার খসখস আওয়াজ আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল। ঘন অন্ধকার বাঁশ ঝাড় থেকে শেয়ালরা বেরিয়ে ছুটতে লাগল এদিক ওদিক। ভয়ে সিঁটিয়ে গেল বন্দিরা। লরি পৌঁছে গেল শ্মশানের কাছে। লরির ডালা খুলে দুজন দুজন করে নামিয়ে কোমরের দড়ি ধরে নিয়ে যাওয়া হল শ্মশানের মাঠে। মাঠের পাশে বেঁধে রাখা হল তাদের। তারপর যে ঝোপের আড়ালে কাঠের স্তূপ সাজিয়ে রেখেছে সমাদ্দার, সেখানে গিয়ে তিনটে চিতা দ্রুত সাজাতে লাগল শাগরেদরা। আগের দুটো চিতার থেকে কিছু আধপোড়া কাঠ পাওয়া গেল। চিতায় কাঠ চাপিয়ে তাতে ঢেলে দিল পেট্রোল। আগেরবার পেট্রোল না আনাতে চিতা জ্বালাতে সমাদ্দারের একটু অসুবিধে হয়েছিল।
চিতা সাজান হলে পরপর দাঁড় করিয়ে স্টেনগান দিয়ে গুলি করে মারল হতভাগ্য ওই ছ’জনকে। তিনটে চিতাতে তুলে দিল লাশগুলো। তখন চারদিকে এক দমচাপা নৈঃশব্দ। পাখিরা, শেয়ালরা, বেজিরাও লজ্জায় লুকিয়ে পড়েছে কোথায়। আকাশের নক্ষত্ররা কেন জেগে আছে? কি দেখছে তারা? আগুনের শিখা লকলকিয়ে উঠতে লাগল আকাশের দিকে। সমাদ্দার শ্মশানের মাঠ পেরিয়ে চলে এল লরির কাছে। লরির ওপর পড়ে আছে কচি শিশুটা। তার মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। ডালা খোলাই আছে। সমাদ্দার নিচ থেকেই বাচ্চাটার পা ধরে টেনে নামিয়ে নিল। তারপর কাটা মুরগির মত ঝুলিয়ে নিয়ে চলল। তৃতীয় চিতার সামনে এসে ফুটবলের মত ছুঁড়ে দিল তাকে। বাচ্চাটা আগুনের মধ্যে হয়ত খুঁজে পেল তার মৃত মায়ের কোল। কয়েকটা কাঠ ফাটার আওয়াজ হল, শাগরেদরা বাঁশ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পোড়াতে লাগল লাশগুলো। তিনটে চিতার দাউদাউ আগুনে চারদিক উদ্ভাসিত, সাঁঝেরহাট শ্মশান যেন তার হারানো দিন ফিরে পেয়েছে। সেই আগুনের শিখায় সমাদ্দারদের জান্তব চোখগুলো চকচক করছে।
এদিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে ভোর। দাউদাউ আগুণ নিভে গমগম করে জ্বলছে কাঠ। চিতা সাজাতে আর তাতে সময়মত কাঠের যোগান দিয়ে চিতাকে সক্রিয় রাখতে ওরা যে কোনও শ্মশান কর্মচারীর থেকেও বোধহয় দক্ষ ছিল। সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে চিতায় জল ঢেলে ওরা লরি নিয়ে চলে এল, অস্ত্র পাঠিয়ে দিল গোপন ডেরায়। তারপর নিশ্চিন্ত মনে মিশে গেল সমাজে।
ঠিক সময়ে বিহার থেকে চা ও নতুন লরি বিক্রির টাকাও চলে এল সমাদ্দারের হাতে। রাতে ঢালাও ফূর্তি। কিন্তু দিনে সাবধান, একদম ভদ্রলোক সেজে থাক যে যার এলাকায়। কোনও লোকের সাথে কখনও ঝগড়া করবে না। দলের সবাইকে সাবধান করে দিয়েছিল সমাদ্দার, “এ লাইনে টিকে থাকতে হলে, কারও সাথে চোখ তুলে কথা বলবে না, অপরিচিত কারও সাথে আড্ডায় বসবে না, আর কোথায় কখন কি করতে যাচ্ছ কারোকে বলবে না, এমনকি বাড়ির লোকজনকেও না।”
কিন্তু যাদের আপনজন হারিয়ে যাচ্ছে তারা কি করবে? চারদিকে খোঁজখবর করে, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরেও কোনও লাভ হচ্ছে না।
বছরের পর বছর, একের পর এক সমাদ্দাররা চালিয়ে গেছে নৃশংস অভিযান। মালদার ওই অঞ্চল থেকে হাওয়া করে দিয়েছে লরি, ড্রাইভার, খালাসি আর যাত্রীসমেত। ততদিনে সাঁঝেরহাট শ্মশানের নাম খ্যাত হয়ে গেছে সমাদ্দার শ্মশান নামে। শ্মশানের চারদিকে এমনিতেই কোনও বাড়িঘরদোর ছিল না। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝখান দিয়ে চিতার আগুন জ্বলছে মানুষ দূর থেকে দেখত। কিন্তু কারও কোনদিন সাহস হয়নি, সামনে এসে দেখে কাকে দাহ করা হচ্ছে। সমাদ্দার ছিল সাক্ষাৎ নরখাদক যমদূত। ওর কাজের সাক্ষী হয়ে থাকার কোনও সুযোগ কাউকে দিত না। “তুমি ওর কাজ দেখে ফেলেছো, তাহলে চলে যাও বয়ান দিতে সোজা যমরাজের কাছে।” সমাদ্দারের ঐ রকম সাদাসিধা ভোলেভালা চেহারাটা ডাকাতি আর খুন করার সময় হয়ে উঠত হিংস্র রাক্ষুসে। ক্ষমাহীন শক্তিধর পশুর মতন। চোখের পলকে মানুষের গলায় চালিয়ে দিত ভোজালী কিংবা পিস্তল।
ওদের নৃশংসতা বাড়ছিল দিনের পর দিন। একবার সমাদ্দার একই কায়দায় মালদার ওই একই অঞ্চলে হাইওয়ের ওপর থামাল একটা লরি। লরিটা গাড়ির নানা পার্টস নিয়ে কলকাতা থেকে যাচ্ছিল উত্তরবঙ্গের দিকে। সেই গাড়ি থেকে সমাদ্দাররা নামাল ছজনকে। তারপর তাদের মারতে মারতে নিয়ে গেল নিজেদের লরির কাছে। টেনে তুলে নিল লরিতে। বাঁধাছাদা করে নিয়ে এল সেই সাঁঝেরহাট শ্মশানে। তারপর ক্ষিপ্র হাতে সাজিয়ে ফেলল পাশাপাশি তিনটে চিতা। সমাদ্দার তার শাগরেদদের নির্দেশ দিল ছজনকে নিয়ে এসে একই দড়ি দিয়ে পরপর বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিতে। ওরা তাই করল। এবার মারার কায়দাটা আরও চমৎকার! সমাদ্দার রাইফেল বের করল, তারপর প্রথম জনের বুকে রাইফেলের নল ঠেকিয়ে চালিয়ে দিল গুলি। একসঙ্গে পড়ে গেল বাঁধা ছটা দেহ। রাইফেলের একটা মাত্র গুলি পরপর ছজনের বুক ভেদ করে চলে গেছে। সমাদ্দারের কাছে এটা একটা এক্সপেরিমেন্ট। ছজনই মাটিতে পড়ে যেতে রাইফেলটা কাঠের স্তূপের পাশে রেখে উল্লাসে নেচে উঠল সে। তারপর চিতায় তুলে দেওয়া হল লাশগুলো।
সমাদ্দারের রাজত্ব ভালই চলছিল। দিনে মধ্যমগ্রামের মানুষের কাছে কংগ্রেসের শ্রদ্ধেয় নেতা। আর অন্ধকারে নিজের বানান জগতে সে হিটলার। কত লরি যে সে ডাকাতি করেছে, কত মানুষকে খুন করেছে, সে নিজেও সঠিক হিসেব বলতে পারবে না। কিন্তু মুশকিল বাধল যখন সে তার কারবার গুটিয়ে আনার চেষ্টা শুরু করল। প্রায় দু দশক ধরে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে সমাদ্দার যখন দেখল বয়স বেড়ে গেছে, অনেক টাকা করে ফেলেছে, তখন সে গোটাতে গেল তার ব্যবসা। সে তার অতিরিক্ত অস্ত্র বিক্রি করতে শুরু করল। ওই অস্ত্র বিক্রি করতেই সমাদ্দার এসেছিল কলকাতার এক কুখ্যাত মাস্তানের কাছে, যার কাছ থেকে আমি প্রথম তার খবর জানতে পারি। তারপর বনগাঁর ছেলেটার কাছ থেকে পাই ওর আসল কাজের হদিস। এরপরই আমি গ্রেফতার করি ওকে।
আমরা সমাদ্দারের বিরুদ্ধে বেআইনি অস্ত্র রাখার অভিযোগে আদালতে চার্জশিট দিলাম। সেই মামলায় ওর আর ওর দলবলের সাজা হল। তারপর সমাদ্দারদের আমরা পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হাতে তুলে দিলাম, হাইওয়েতে লরি ডাকাতি ও খুন করার অভিযোগে মামলা করার জন্য। তখন এক জুনিয়র অফিসার আমাকে বলল, “স্যার একে যদি সত্তর দশকে ধরতে পেতাম!” আমি জুনিয়র অফিসারের মুখের দিকে তাকালাম, তারপর ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, “তোমার মনের কথাটা আমি বুঝি, কয়েকশ লোককে খুন করে দিব্যি ভাল মানুষ হয়ে আদালতে যাচ্ছে, তা তোমার মন মানতে চাইছে না, কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। দেখো, ও বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে, কারণ কোনও জায়গাতেই ওর বিরুদ্ধে কোনও ডায়েরি নেই, সাক্ষী তো নেইই। কিসের ভিত্তিতে মামলা হবে?” আমার কথাটাই সত্যি প্রমাণিত হল, সমাদ্দাররা খালাস পেয়ে গেল। কারণ ওদের বিরুদ্ধে কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও সাক্ষী পাওয়া গেল না। শুধুমাত্র অস্ত্র রাখার অপরাধে যেটুকু সাজা হয়েছিল, তা খেটেই জেল থেকে বেরিয়ে এল ওরা।
জেল থেকে বেরিয়ে সমাদ্দার অবশ্য আর অপরাধ জগতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। আমি কিন্তু আমার সেই মাস্তান সোর্সকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানালাম। ওর জন্যই বেঁচে গেল আরও অনেকগুলো জীবন আর ওর জন্যই উদ্ঘাটিত হল মালদা – ফারাক্কা বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলের রহস্য।
প্রকৃতপক্ষে, পুলিশকে কাজের স্বার্থেই সমাজের সব স্তরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। সেখানে বাছবিচার করলেই মুশকিল। আসল কথা হল, পেশাদারি মনোভাব। সেখানে ঘাটতি হলেই অপরাধীরা সুযোগ নিয়ে নেবে। একটা ঘটনা বলি। একবার লালবাজারের গোয়েন্দা দফতরের তখনকার অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার দেবী রায় এক পুরনো সিপাইকে ডেকে নির্দেশ দিলেন এক ছিঁচকে চোরকে ধরে নিয়ে আসার। সিপাইটা তক্ষুণি লালবাজার থেকে বেরিয়ে সন্ধের সময় ঐ ছিঁচকে চোরটাকে ধরে নিয়ে এসে সোজা দেবীবাবুর সামনে হাজির করল। চোরের তখনও ঘোর কাটেনি, তার আগের দিনই সিপাইটা তার কাছ থেকে একশ টাকা ঘুষ নিয়ে এসেছে। দেবীবাবুর সামনে এসে সে তাই সরাসরি সিপাইয়ের বিরুদ্ধে নালিশ জানাল, “স্যার, গতকালই ও আমার কাছ থেকে একশ টাকা নিয়ে এসেছে, আর আজ দেখুন আমায় ধরে নিয়ে এল।” সিপাইটা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তোমার কাছ থেকে একশ টাকা নিয়েছিলাম কারণ গতকাল তোমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ ছিল না। কিন্তু আজ আছে, সাহেবের নির্দেশে তোমাকে ধরে নিয়ে এসেছি।” ছিঁচকে চোরটা ছিল ওই সিপাইয়ের চেনা, সিপাইটা মাঝেমধ্যেই ওর কাছ থেকে টাকা নিত। সে ভাবত সিপাইকে যখন টাকা দিচ্ছে, তখন সে নিরাপদ। যখন তাকে সিপাইটা ধরে নিয়ে এল সে প্রথমে বুঝতেই পারেনি সত্যি তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। সিপাইটা ওর থেকে টাকা নিত ঠিকই, কিন্তু নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে চোরকে গ্রেফতার করে নিয়ে এসে সে পেশাদারি আনুগত্য দেখাল। তার কাছ থেকে সব চুরির মালই পাওয়া গেল। একদিন আমি দেবীবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “সিপাইটাকে সাজা দিলেন না কেন?” দেবীবাবু বললেন, “একশ টাকা সে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারচেয়ে আনুগত্যের মূল্য অনেক বেশি। তাই ওকে সাজা দিলাম না।”
অন্য একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। তখন বড়বাজার এলাকায় ডকের থেকে আসা বিদেশি চোরাই জিনিসপত্র, জামাকাপড়, যন্ত্রাংশ ও প্রসাধনের হরেকরকম সামগ্রীর বিরাট বাজার ছিল। অভিযান চালিয়ে ওই সব স্মাগলিং করা জিনিসপত্রের ব্যবসায়ী নরসিং লাখোটিয়াকে ধরলাম। একেবারে অল্প বয়স। পরে ওকে আমি আমার সোর্স বানিয়ে ফেলেছিলাম। ওর মাধ্যমে ডক অঞ্চলের অনেক খবর পেয়েছিলাম। সেইসব খবরের ভিত্তিতে বিভিন্ন দিনে হানা দিয়ে প্রচুর চোরাই জিনিস উদ্ধার করেছিলাম। নরসিং লাখোটিয়ার মত অতুল সাহাও একই ব্যবসা করত। তখন অবশ্য তার বয়স হয়ে গেছে, সে ছিল আমাদের সিনিয়র অফিসার মনোরঞ্জন ব্যানার্জির সোর্স। সেও একসময় মনাদাকে অনেক খবর দিয়েছিল।
একদিন সকালবেলা দেবীবাবু আমাকে ডেকে বললেন, “রুণু, অতুল সাহাকে চেন?” আমি বললাম, “হ্যাঁ স্যার চিনি।” দেবীবাবু বললেন, “ওকে এক্ষুণি ধরে নিয়ে এস, ওকে পি. ডি. অ্যাক্টে অ্যারেস্ট করার অর্ডার এসেছে।” তখন প্রভিশন্যাল ডিটেনশন অ্যাক্টে বিনা বিচারেই জেলে কমপক্ষে একবছর আটকে রাখা যেত। আমি দেবীবাবুর নির্দেশ শুনে তক্ষুণি একটা জিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বেরিয়েই আমার মনে হল, অতুল সাহার মত নরসিংয়ের বিরুদ্ধেও নিশ্চয়ই পি. ডি. অ্যাক্টে গ্রেপ্তার করার আদেশ আছে। আরও মনে হল, যেহেতু সে আমার সোর্স সেজন্য দেবীবাবু ওকে গ্রেফতারের দায়িত্ব আমাকে না দিয়ে মনাদার সোর্স অতুল সাহাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছেন। এটা মনে হতে প্রথমেই আমি সোজা চলে গেলাম নরসিংয়ের বাড়ি, তাকে বাঁচানর উদ্দেশে। নরসিংকে গিয়ে বললাম, “এক্ষুণি কলকাতা ছেড়ে পালাও, তোমাকে বোধহয় পি.ডি. অ্যাক্টে অ্যারেস্ট করার আদেশ আছে।” নরসিং আমার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে বলল, “কিন্তু স্যার, আমি তো আপনাদের সাহায্য করছি। সব খবরাখবর দিচ্ছি।” আমি বললাম, “সেজন্যই আমি তোমাকে আগাম সতর্ক করে দিলাম, যাতে তুমি পালিযে যেতে পার। একবার অ্যারেস্টের নির্দেশ এসে গেলে কারও কিছু করার থাকবে না, তাই বলছি পালাও।”
আমি নরসিংকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা অতুল সাহার বাড়িতে গেলাম। ওকে গ্রেফতার করে লালবাজারে নিয়ে এসে দেবীবাবুর চেম্বারে হাজির করলাম। অতুল সাহা দেবীবাবুকে বলল, “স্যার, আমি কি দোষ করেছি? আমি তো আপনাদেরই একজন, মনোরঞ্জনবাবুকে জিজ্ঞেস করবেন, আমি কতদিন ধরে আপনাদের কাজ করে আসছি।” দেবীবাবু উত্তরে বললেন, “তা জানি, কিন্তু আমরা সরকারের নির্দেশ অমান্য করতে পারি না। এখন জেলে থাকুন, উপায় নেই।”
অতুল সাহা আর কি করবে, আমার সঙ্গে দেবীবাবুর চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল। আমি তাকে আমাদের অফিস ঘরে বসিয়ে রাখলাম। তখনই দেখি মনাদা বাইরে থেকে এসে সোজা দেবীবাবুর ঘরের দিকে যাচ্ছেন।
আমার কৌতূহল হল, মনে হল, দেবীবাবু যেমন অতুল সাহাকে আমায় ধরতে পাঠিয়েছেন, ঠিক তেমনি মনাদাকে নিশ্চয়ই পাঠিয়েছেন নরসিংকে গ্রেফতার করতে। আমি তাই মনাদার পেছন পেছন দেবীবাবুর চেম্বারে ঢুকলাম। মনাদা ঢুকেই দেবীবাবুকে বললেন, “নরসিংহরে পাইলাম না, ব্যাটা বোধহয় পলাইছে, বাড়ি নাই।” মনাদা খাঁটি পূর্ববঙ্গের লোক, সবসময় বাঙাল ভাষায় কথা বলতেন।
আমার আশঙ্কাই ঠিক হল, দেবীবাবু মনাদাকে পাঠিয়েছিলেন নরসিংকে গ্রেফতার করতে। যাক, এ যাত্রায় আমি আমার সোর্সকে বাঁচিয়ে দিলাম। কিন্তু মুখে আমি বললাম, “সে কি, পেলেন না?” দেবীবাবু মনাদাকে বললেন, “আপনি নরসিংকে পেলেন না, কিন্তু রুণু তো অতুল সাহাকে ধরে এনেছে।” আমি দেবীবাবুকে বললাম, “স্যার আমি একবার দেখব, নবসিংকে পাই কিনা?” মনাদা বললেন, “পাইবা না।” দেবীবাবু বললেন, “চেষ্টা করতে দোষ কি, দেখ তো রুণু তুমি নরসিংকে পাও কিনা।”
আমি তো জানি নরসিংকে পাব না, কিন্তু মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করছেই। সেটা ঢাকার জন্যই দেবীবাবুকে কথাটা বললাম। তাঁর নির্দেশ পেয়ে আমি তখন মনাদার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জমাদার গৌরকে নিয়ে একটা জিপে করে বেরিয়ে পড়লাম। গৌরকে সঙ্গে নিলাম এই জন্য যে, আমি সত্যিই নরসিংকে ধরতে নরসিংয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম, যেন গৌরের মাধ্যমে মনাদা খবরটা পান।
নরসিংয়ের বাড়িতে গৌরকে নিয়ে পৌঁছে গেলাম। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার নরসিংকে পেয়ে গেলাম। বললাম, “চল, নরসিং আমার সাথে লালবাজার।” নরসিং আমার কথা শুনে বোকা বনে গেল, কোনমতে বলল, “সে কি স্যার, আমি আপনার কথা মতই তো পালিয়ে গিয়েছিলাম, আর এখন ধরে নিয়ে যেতে এসেছেন!” গৌর আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে না, দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি চাপা গলায় বললাম, “তখন তোমাকে ধরার নির্দেশ আমাকে দেওয়া হয়নি, আমি একটা অনুমান করে তোমায় সাবধান হতে বলেছিলাম, এখন আর উপায় নেই, আমার সঙ্গে যেতেই হবে।” নরসিং প্রায় কেঁদেই ফেলল, “স্যার আমি বালি ব্রিজ পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম, কিন্তু দেখি পালাবার তাড়াহুড়োতে টাকাপয়সা নিতেই ভুলে গিয়েছি। আবার বাড়ি ফিরে এসে সেসব গুছিয়ে নিচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময় আপনি এলেন।”
আমি হাসব না কি করব বুঝতে পারছি না, তবু মুখটাকে যথাসম্ভব গম্ভীর করে বললাম, “তখন পালাতে পারলে পালাতে, এখন আর উপায় নেই, একবছর জেলে থাক, তারপর দেখা যাবে।” নরসিং আর কি বলবে, আমার সঙ্গে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি নিয়ে আমরা ছুটলাম লালবাজার। লালবাজারে এসে নরসিংকে নিয়ে সোজা দেবীবাবুর চেম্বারে। দেবীবাবু নরসিংকে দেখে বললেন, “এই তো রুণু পেয়ে গেছে।” তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় পেলে?” আমি বললাম, “কেন স্যার, ওর বাড়িতেই।” গৌরের কাছ থেকে মনাদা খবর পেয়ে গেছেন ততক্ষণে, আমি নরসিংকে ধরে নিয়ে এসেছি। মনাদাও দেবীবাবুর চেম্বারে এসে ঢুকলেন। মনাদা নরসিংকে দেখে অবাক।
আমাদের পেশাদারীত্বের আনুগত্যই ছিল এরকম। নিজেদের কাজের স্বাে সোর্সকে বাঁচানোর চেষ্টা করব ঠিকই কিন্তু সরকারী আদেশ কখনও অমান্য করব না। অপরাধীকে অবাধে অপরাধ করতে কখনও দেব না। সে তুমি হুলোই হও, সোর্সই হও, এমন কি নিজেদের বাড়ির লোকই হও না কেন।