সপ্তম অধ্যায়। পুত্রের উত্থান

সপ্তম অধ্যায়। পুত্রের উত্থান

৩৬

গণপতি, আমরা অন্যান্য চরিত্রের কথা বলব ভেবেছিলাম। কিন্তু গঙ্গাজি কোথা থেকে এসে আবার সব চিন্তা অধিকার করে নিয়েছিলেন। পাণ্ডুর পাঁচ ছেলে, গান্ধারীর নিঠুর নিয়তি, মাদ্রী এদের কথা বলাই হচ্ছে না। আমাদের মহাকাব্য রচয়িতারা অনেক সময়েই প্রধান গল্প থেকে সরে গিয়ে অন্যান্য চরিত্রদের কথা বলতে বসতেন। কিন্তু আজকের যুগ অন্য। গঙ্গার কথা ছেড়ে কচ ও দেবযানীর গল্প বলতে বসলে কেউ আর শুনতে চাইবে না। যদি তাদের যথেষ্ট পরিমাণে যৌন কাহিনি দাও তাহলে অবশ্য অন্য কথা।

গল্প চলতে শুরু করার আগেই বলে রাখি যে ইতিমধ্যে কাহিনিতে গঙ্গাজি ছাড়াও অন্যদের গুরুত্ব আগের থেকে খানিকটা বেড়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ততদিনে মুসলমান গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে। তাদের নেতা ছিল এক সুপুরুষ ব্যক্তি, যার ত্বক সূর্যের মতো সোনালি। কপালে অর্ধেক চাঁদের তিলক। এটাই পরে তার পার্টির প্রতীক হয়েছিল।

হিন্দুদের মতো মুসলমানরাও সে সময়ে বহু গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। হিন্দুদের মধ্যে যেমন ছিল ব্রাহ্মণ, ঠাকুর, মারোয়াড়ি, নায়ার, লিঙ্গায়াত, অছ্যুৎ ইত্যাদি, খ্রিশ্চানদের যেমন ছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, ক্যাথলিক, সিরিয়ান খ্রিশ্চান, তেমনই ছিল জৈন, ইহুদি, কেশধারী ও মাজহাবি শিখ, ট্রাইবাল ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষরা; মুসলমানদের মধ্যে সেইরকম নানা ভাগ ছিল—সুন্নি, সিয়া, মোপলা, বোরা, খোজা, ইসমাইলি, কাদিয়ানি, আহমেদিয়া, কাচ্চি মেমন আরও কত কী! ঠিক ফল-সব্জি-ফুলের মতোই আমাদের জাতবৈচিত্র্য।

আমাদের এতবড় দেশের কোটি কোটি মানুষকে অবশ্য এভাবেই চিহ্নিত করা ছাড়া উপায়ও নেই। এতে মানুষের নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে একটা ভরসা জাগে। প্রতিটি গোষ্ঠীর নিজের অস্তিত্বের বিশেষত্ব রয়েছে, আর নামকরণের মাধ্যমে সেইগুলি চিহ্নিত করা হয়।

ভারতীয়রা নিজেদের এই বৈচিত্র্যের কথা জানে, এবং কখনওই চায় না এগুলি ঢাকা পড়ে যাক। একই ধরনের নাম, পোশাক, খাবার আর ভাষার গণ্ডির মধ্যে ভারতবর্ষের এই রঙিন চিত্রকে আঁকা যায় না। আমরা ফরাসিদের মতোই ভীষণভাবে স্বতন্ত্র।

আমাদের পারস্পরিক বিভেদ ছিল বলেই যে আমাদের মধ্যে বৈরীভাব ছিল তা নয়। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যথেষ্ট সুস্থ আদানপ্রদান ছিল। গঙ্গাজি আমাদের পরে শিখিয়েছিলেন, জাতপাতের ভিত্তিতে ভেদাভেদ কতটা ক্ষতিকারক। আমরা তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন না করলেও আমাদের মধ্যেকার ভেদাভেদ লুকোতে শিখেছিলাম।

আসলে গণপতি, আমরা আমাদের সামাজিক বৈপরীত্য কখনও রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে নিয়ে যাইনি। রাজা বা সুলতানেরা তাদের মন্ত্রী বা সেনাপতিদের দায়িত্ব দেওয়ার সময় জাত-পাত বা ধর্মের ভেদ দেখেননি। ঔরঙ্গজেব নিজে খাঁটি মুসলমান হলেও রাজপুত সেনাপতিরাই তাঁর সৈন্যদের চালনা করেছে মুসলমান শত্রুর বিরুদ্ধে, আবার মারাঠা পেশওয়ারা তুর্কি থেকে অস্ত্রবীজ নিয়ে এসেছে। ধর্মের ভেদ কোনওদিন আমাদের রাজনীতিকে কলুষিত করেনি। ওটা ইংরেজ সরকারের দান।

ওরা চেয়েছিল আমাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে আমাদের একজোট না হতে দিতে। ওরা কৌশল করে ভারতীয় গোষ্ঠীগুলির মধ্যে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, হিংসা ঢুকিয়ে দিল যাতে আমরা একত্রিত শক্তি হয়ে উঠতে না পারি। ১৮৫৭-এর সিপাই বিদ্রোহ ইংরেজদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। সেই প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের নাম করে সাদা চামড়ার ঐতিহাসিকরা কায়দা করে সিপাই বিদ্রোহ রেখেছিল। আর তারপরেই ওরা উঠে পড়ে লাগল ভারতীয়দের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করতে। সবথেকে সহজ ছিল ধর্মের নামে ভেদাভেদের বীজ বপন করা।

ওরা সব থেকে সহজ উপায়টা বেছে নিল। হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে ঘৃণার সৃষ্টি করল। ভারতের ইতিহাসে কখনও এই দুই গোষ্ঠী দুটো মেরু হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি। ইংল্যান্ড আমাদের ইতিহাস কী করে জানবে? কিন্তু আমরা কেন তাকে সুযোগ দিলাম আমাদের দুইভাগে ভাগ করে এইভাবে ভেঙে দিতে?

ইংল্যান্ড নিজে একভাবে গণতন্ত্রকে দেখলেও, ভারতের বেলায় অন্যরকম করত। নির্বাচনের ব্যাপারটাই দেখো না। বহুদিন ভারতে নির্বাচন করতে দেওয়া হয়নি এই বলে যে ভারতীয়দের এই ব্যাপারে ভরসা করা যায় না। তারপর যখন সীমিত ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা হল, তখন সম্পত্তির জোর আছে দেখে তবেই ভোট দিতে দেওয়া হত। এতে ৯০ শতাংশ মানুষ ভোটের আওতার বাইরের রইল।

যখন দেখা গেল, সম্ভ্রান্ত বংশের মানুষেরা সবাই কৌরব পার্টির প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন, তখন ইংরেজরা মুসলমানদের জন্য আলাদা ভোটাধিকার তৈরি করল। ইংল্যান্ডে কোনওদিন কেউ ভাবতে পেরেছে যে ইহুদিরা আলাদা লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেদের প্রতিনিধির জন্য ভোট দিচ্ছেন যাতে তিনি হাউস অফ কমনস-এ ঢুকতে পারেন? কিন্তু ভারতবর্ষ হল কালা আদমির দেশ! তাদের জন্য আইন তো সাদা মানুষের দেশের তুলনায় আলাদা হবেই! আজকে শিক্ষিত মানুষ গণতন্ত্রকে কেন এত হেয় চোখে দেখে, বুঝতে পারলে তো গণপতি?

কিছুদিনের মধ্যেই ইংরেজরা দুই ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে আলাদা রাজনৈতিক পরিচিতির সৃষ্টি করল। কয়েকজন মুসলমান নেতাকে হাত করে ওই সম্প্রদায়ের জন্য দল তৈরি হল। এই মুসলমান নেতাদের দেওয়া হল বিভিন্ন খেতাব এবং খুলে দেওয়া হল রোজগারের বিভিন্ন পথ। এই গাগা সাহ-এর কথাই ধরো না। গাগার মুসলমান দল ইংরেজদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে কী, তারা কৃতজ্ঞতায় প্রভুর পা-ই ছাড়ে না। এতে আপামর মুসলমান জনতা একেবারেই খুশি হল না। গাগার দল এদিক-ওদিক বক্তৃতা দিত আর ইংরেজদের কাছে দরখাস্ত দিত যাতে মুসলমানদের জন্যে গড়া আলাদা ভোটাধিকার ব্যবস্থা বহাল থাকে। গরম পড়লে এইসব নেতাদের ইংল্যান্ডের রেসের মাঠে পাওয়া যেত। কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে চিন্তাশীল মুসলমান, পারসি এবং ক্রিশ্চান নেতারা দলে দলে কৌরব পার্টিতে গিয়ে যোগ দিলেন।

একদিন মুসলমান গোষ্ঠীর যিনি সবথেকে বরিষ্ঠ নেতা হবে, সেই কর্ণ, কৌরবদের মধ্যে কোথা থেকে যেন উদয় হল। শুরুতে এই অত্যন্ত সুপুরুষ এবং স্বল্পবাক অথচ ধারালো যুবাটিকে দেখে সবাই নড়েচড়ে বসেছিল। সে তার পূর্ব পরিচয় সম্পর্কে কখনও আলোচনা করত না। ঠিক যেন তাঁর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এই দুটি-ই সত্যি, অতীতটা নয়। কিন্তু স্থৈর্যে, পাণ্ডিত্যে, অধিনায়কত্বে এবং বাচনভঙ্গিতে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল তার তেজস্বিতা।

সবার নজর যখন তার দিকে গিয়ে পড়ল, তখন সে বম্বের এক নামকরা উকিল এবং মালাবার হিল-এ তার বিশাল বাসস্থান। তার ইংরেজি বলার ঢং আর ইংল্যান্ডে তৈরি স্যুট, দুই-ই তাকে দারুণ মানিয়ে যেত। সে একা থাকত। তার পিতৃপরিচয় নিয়ে কেমন ধোঁয়াশা ছিল।

কিছু গুজব ছিল, লোকে তাঁর পূর্বপরিচয় নিয়ে ফিসফাস করত কিন্তু নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারত না। এমনই একটা ধারণা সে লোকের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিল যেন বর্তমান অবস্থাটাই তার অস্তিত্বের শেষ কথা।

কত গল্পই না তাকে ঘিরে তৈরি হল। মহিলারা তাঁর জন্যে পাগল হয়ে গেল। তাঁর ঔদাসিন্যের আকর্ষণ ছিল তীব্র। তার বাড়ির উলটোদিকে যে মাঝবয়সি মহিলা থাকতেন, তিনি বলতেন যে কর্ণের ঘরের জানালা থেকে তিনি রোজ সূর্যোদয় দেখেন। মেঘলা দুপুরে সে বারান্দায় বেরিয়ে এলেই মেঘ সরে গিয়ে রোদ আসে। সে যখন হেঁটে যেত, তখন ভিড় আপনি সরে যেত, যেন তার জ্যোতিতে সবাই জ্বলেপুড়ে যাবে। বাড়ির পরিচারকরা বলত সে নাকি কোনও সাবান বা প্রসাধনী ছাড়াই তার ঔজ্জ্বল্য বজায় রাখত। তাঁকে সবাই পৌরাণিক কাহিনির বীরের সঙ্গে তুলনা করতে লাগল। সে নাকি বাগানে তির-ধনুক ছোড়া অভ্যেস করত। সব ঘোড়াই নাকি তার প্রভুত্ব মেনে নিত। কোনও আলোচনার মাঝে কেউ যদি একবারও তাঁর পূর্বপরিচয় নিয়ে কথা তুলত, সবাই রে রে করে উঠে বলত যে নদীর বিশালত্বটাই আসল! কোথায় তার শুরু সেটা নয়।

নিজে সে কখনওই চেষ্টা করেনি এই সব গল্প থামাতে। খুব শিগগির সে বম্বের আইন দুনিয়ার শীর্ষে পৌঁছে গেল।

কর্ণর সঙ্গে তর্ক করতে কেউ সাহস করত না। মুহূর্তে তাঁর ছুরির ফলার মতো জিভ দিয়ে শত্রুপক্ষকে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলত। আদালতে তাঁর সাফল্য দেখে তাবড় তাবড় লোক তাঁর কাছে সমস্যা নিয়ে আসতে লাগল। বড় বড় মিটিং-এ বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তাঁর ডাক আসতে লাগল। বড় বড় কমিটিতে তাঁকে সদস্যপদ দেওয়া হল। শেষে এমন বলা হতে লাগল, ভারতবর্ষে তাঁর প্রজন্মে, মহম্মদ আলি কর্ণর মতো কোনও নেতা আগে জন্মায়নি।

কর্ণ লন্ডন থেকে ফিরে বম্বেতে ব্যারিস্টার হয়ে কাজে যোগ দিলেন। কৌরব পার্টির সদস্য হলেন। কিন্তু তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রাম গঙ্গাজির থেকে আলাদা ছিল।

কর্ণ বিশ্বাস করতেন, ভারতীয়রা কীভাবে শাসিত হবে তা ঠিক করবার স্বাধীনতা তাদের আছে। এই অধিকার ন্যায়গতভাবে ইংরেজদের থেকে আদায় করতে হবে। গঙ্গাজির মতো তিনি পদযাত্রায় বিশ্বাসী ছিলেন না।

গঙ্গাজির থেকে তাঁর পথ আলাদা হওয়ারই কথা। কিন্তু একটা ঘটনায় তিনি কৌরব পার্টি থেকে একেবারে ছিটকে গেলেন। সারা দেশে যেন আগুন ধরে গেল।

৩৭

কৌরব পার্টির ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং-এ ভবিষ্যতের কৌশলনীতি স্থির করা হচ্ছিল। কর্ণ সেখানে চেষ্টা করে যাচ্ছিল গঙ্গাজির গোষ্ঠীর সম্মুখ বিরোধিতা করার। ‘খালি ভিড় জোগাড় করে হেঁটেই কি এই পার্টি ইংরেজ তাড়াবে নাকি?’ সে বলছিল, ‘পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী দেশকে পরাস্ত করা এত সোজা নাকি? এ কি ফরাসি বিপ্লবের বাস্তিল কারা ভাঙার গল্প? এদের হাতে কত সৈন্য। একটা অত্যন্ত উন্নত এবং আধুনিক প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ ব্যবস্থাপনা যাদের হাতে, তাদের হারাতে গেলে আমাদের সমকক্ষ হতে হবে তো!

কর্ণর কথাগুলো তিরের মতো গিয়ে শ্রোতাদের মনে বিঁধছিল। তার কপালের অর্ধচন্দ্র যেন জ্বলে উঠছিল সেই তেজি বক্তৃতায়, ‘আমাদের ন্যায়, সাংবিধানিক অধিকার এবং সংসদীয় রাজনীতির পাঠ পেয়েছি ওদের থেকে। সেই শিক্ষার জোরে ইংরেজদের দেখিয়ে দেব যে ভারতের মানুষকে কেমন অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করছে ওরা।’

কর্ণ চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিল, সবাই তার কথা শুনছে কি না। ধৃতরাষ্ট্রের মুখটা পুরো দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছিল, উৎকর্ণ হয়ে শুনছে। ‘আমরা যদি খালি গাদা গাদা মানুষ নিয়ে হেঁটে বেড়াই, তাহলে কোনওদিনই স্বশাসন পাব না। তার কারণ এদের কারও স্বশাসন বা স্বাধীনতা সম্বন্ধে কোনও ধারণা নেই। শয়ে শয়ে মানুষকে সঙ্গে পেলেই যে সংসদীয় রাজনীতিতে খুব সুবিধে হয় তা নয়। আইন ভাঙলেই যে আমরা একদিন আইন তৈরি করতে পারব তা নয়। একটা রাজপরিবারের উত্তরাধিকারচ্যুত রাজকুমারদের দেশ চালাবার প্রচেষ্টা বা রাজনীতিটা আমি বুঝি না। জনতা কখনও দেশ চালায় না, নেতারা চালায়। তার কারণ হল তাদের উন্নত বুদ্ধি এবং শিক্ষা। জনতা তার নিজের জায়গায় থাক। আমরা বরং চেষ্টা করি কী করে পার্টিকে আরও শক্তিশালী করে তোলা যায়। সেটা কোনওদিনই সম্ভব হবে না, যদি আমরা নেতা নির্বাচনে কোনও ভুল করি।’

কর্ণের ঔদ্ধত্য সবাই সহ্য করছিল এতক্ষণ। হঠাৎ সেই ঘটনাটা ঘটল। বন্ধ দরজার বাইরে একটা টোকা পড়ল।

দারোয়ান কাঁচুমাচু মুখ করে ঢুকল, ‘কর্ণ স্যার, একজন বয়স্ক ড্রাইভারের পোশাক পরা লোক বলছে যে আপনার বাবা…আমি থামাতে চেষ্টা করেছিলাম, স্যার। কিন্তু…কিন্তু…’

কর্ণকে ফ্যাকাসে দেখাল।

‘আমাকে ঢুকতে দাও। আমার ছেলে আমাকে চিনতে পারবে।’ বলতে বলতে একটি ঝোড়ো চেহারার মানুষ ঢুকে এল। তার পরনে ড্রাইভারের সাদা পোশাক। হাতে টুপি আর মুখে গভীর উদ্বেগের দাগ।

‘কর্ণ! তোমার মা…’

‘আমি এক্ষুনি আসছি, আব্বাজান।’ কর্ণ, তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল বৃদ্ধ মানুষটির দিকে। মুখ তখনও ফ্যাকাসে।

‘তাই তো বলি,’ ধৃতরাষ্ট্র এবার বলে উঠল, ‘একজন ড্রাইভারের ছেলে এতক্ষণ জনতার অপকারিতা নিয়ে আমাদের জ্ঞান দিচ্ছিল!

‘কী অকৃতজ্ঞ!’ একজন চাটুকার যোগ দিল।

‘ও ভাবছে যে নিজের বাবা-মা’র তুলনায় অনেক বড় হয়ে গেছে।’ ধৃতরাষ্ট্র বলে উঠল। কর্ণ ঘৃণাভরে তার দিকে তাকাল। যদিও কালো চশমা ভেদ করে তা ধৃতরাষ্ট্রকে ছুঁতে পারল না। তার নিজের বন্ধুরা তার পক্ষ ধরে গুঞ্জন শুরু করতেই দুম করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। কর্ণ তার পিতৃপরিচয়ের দ্বারা পরাজিত হল।

আমার দেশের এটাই রীতি, গণপতি। গুণী মানুষকে যখন ধরাশায়ী করা যায় না, তখন তার পূর্বপরিচয়ের কৌলিন্যের বিচার করা হয়।

কর্ণ বেরিয়ে গেলে, আমি তার পিছু ধরলাম, হঠাৎ দেখি কুন্তির মাথা ঘুরে গেছে, সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে গিয়ে তাকে ধরে ফেললাম।

আমি তাকে সোফায় শুইয়ে দিলাম। একজন অবিবাহিত পুরুষের অস্বস্তি নিয়ে ভাবতে লাগলাম তার চোখে মুখে জল ছেটাব কিনা! একটু পরে সে নিজেই চোখ খুলল।

‘ওই তো সে!’ সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।

‘কে? সে?’

‘যে ছেলেটা এখুনি বেরিয়ে গেল।’

‘মহম্মদ আলি কর্ণ?’

‘ওই তাহলে কর্ণ? আমি লোককে ওর কথা বলতে শুনেছি, কিন্তু কখনও দেখিনি।’ কুন্তি উঠে বসল, তার ফ্যাকাসে মুখ আবার আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এল, ‘ওর সম্বন্ধে আর কী জানেন ভি ভি মশাই?’

‘খুব একটা বেশি কিছু নয়। ও একজন সফল উকিল। লন্ডনে পড়াশোনা করেছে, বেশ উদ্ধত। এখুনি জানলাম একজন ড্রাইভারের ছেলে।’

কুন্তি এক মুহূর্ত দম বন্ধ করে রইল, ‘ড্রাইভার?’

‘হ্যাঁ। কর্ণ তার সঙ্গেই বেরিয়ে গেল। তার মা খুবই অসুস্থ।

‘ওর মা,’ বলে কুন্তি মুখের ওপর থেকে অবিন্যস্ত চুল সরিয়ে দিল, এখন ভালো বোধ করছে।

এবার আমার চমকানোর পালা। হঠাৎ মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। একমুহূর্তে কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

কুন্তির ছোট বয়সের ভুল, সেই বিদেশি পর্যটকের সঙ্গে ক্ষণিকের শরীরী খেলা, সেই বাচ্চা যাকে একটা ঝুড়িতে করে কুমারী কুন্তি ভাসিয়ে দেয় নদীতে, জীবনের লড়াই-এ সে বেঁচে আছে। আজ সে মহম্মদ আলি কর্ণ।

‘কুন্তি!’ আমি বললাম।

‘ও বেঁচে আছে বাবা। আমার কী যে আনন্দ হচ্ছে, বলে বোঝাতে পারব না।’

আমি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘ওকে স্বীকার কোরো না, কুন্তি।’

‘আমি জানি।’ কুন্তি ব্যথাভরা গলায় বলেছিল, ‘কিন্তু আপনি আমাকে ওর সম্বন্ধে আরও জেনে দিন। কে এই ড্রাইভার? কী হয়েছিল?’

‘নিশ্চয়ই।’

জেনেছি, মুসলমান দম্পতিটি বাচ্চাটাকে পেয়ে আনন্দে হাত দুটি তুলে আল্লাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল। বাচ্চাটিও ক্রমে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হল আর কালে কালে মুসলমান গ্রুপের একমেবদ্বিতীয়ম নেতা পরিগণিত হল।

বাকি ছক সব মিলে গেল। সবাই তাকে ইংলন্ডফেরত ব্যারিস্টার মনে করত। এটা জানত না যে সে বড় হয়ে উঠেছিল একটা বস্তিতে। মেধাবী হওয়ার ফলে স্কুল ও কলেজে পড়ার বৃত্তি পেয়েছিল। তার লন্ডনে পড়ার খরচ জোগান তার বাবা যার কাছে কাজ করতেন, সেই মহানুভব ভদ্রলোক। কর্ণর ধমনীতে রাজরক্ত থাকলেও সে দারিদ্র্যের মধ্যেই বড় হয়েছিল। কিন্তু আমি যত অনুসন্ধান করলাম, ততই যেন কর্ণর জীবন নিয়ে রহস্য আরও ঘনীভূত হল। কৌরব পার্টির মিটিং-এ ড্রাইভারটির আসার ঘটনা চারিদিকে রাষ্ট্র হওয়ার পর গুলতানি আর গুজব চলতে লাগল। কিন্তু তাতে সেই তেজস্বী যুবকের আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমল না। যেমন একদিকে তার বাবা-মা এবং দারিদ্র্যের গল্প চাউর হল। অন্যদিকে তার অসাধারণ সব ক্ষমতা নিয়েও লোকে আলোচনা করতে লাগল!

তার অসাধারণ মেধা নিয়ে সে তার লক্ষে স্থির থাকল, একটা গোটা দেশ গড়ার লক্ষ। গণপতি, চলো দেখি কর্ণ তার এই অসাধারণ নাম কী করে পেল!

তার বাবা, নিজে গোঁড়া মুসলমান হয়েও ছেলের সুন্নত করাননি। একদিন নদীতে চান করার সময় মহম্মদ আলি তার বাবাকে জিগ্যেস করে কেন সে এই ব্যাপারে আলাদা।

‘তুমি আমার ঔরসজাত পুত্র নও। তাই আল্লাহ তোমাকে যে ভাবে পাঠিয়েছেন আমিও তোমায় সেইভাবে গ্রহণ এবং পালন করেছি।’ মাঝবয়সি ড্রাইভারটি বলেন।

‘আমি তোমারই ছেলে আব্বাজান। তুমিই আমার পালকপিতা। আমার অতীত আমাকে বর্জন করেছিল, তুমি আমায় আশ্রয় দিয়েছ। আমি তোমার মতোই হতে চাই।’ এই বলে ছুরি নিয়ে সে নিজের শিশ্ন নিজেই কেটে দেয়। এই কথা শুনে মহম্মদ আলির বাবার সেই ধনী গাড়ির মালিক ছেলেটির নামকরণ করেন ‘কর্ণ’।

কালে কালে সেই হল, মহম্মদ আলি কর্ণ।

তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না গণপতি? আমারও শুরুতে বিশ্বাস হয়নি।

৩৮

ইতিহাস কি শুধু ঘটনাপ্রবাহ?

সেই ড্রাইভারের হঠাৎ আবির্ভাবের কারণেই যে কর্ণ কৌরব পার্টি থেকে ইস্তফা দিয়েছিল, তা নয়। আরও হাজারটা জটিল কারণ ছিল এর পিছনে।

একটা কারণ অবশ্যই এই যে গঙ্গাজির দেখানো অহিংসার রাজনীতি, যার সঙ্গী হিসেবে ছিল অসহযোগ, অনশন এবং পদযাত্রা, এটাই কৌরব পার্টির প্রধান হাতিয়ার ছিল। কর্ণ এর মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন আনতে পারেনি। হস্তিনাপুরীদের হাত থেকে পার্টিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। কৌরব পার্টিতে থাকলে তাঁকে গঙ্গাজির অধীনে থাকতে হত, ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুদের সঙ্গে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হত। কর্ণ এমনই একজন ব্যক্তিত্ব ছিল, যে একটা ছোট্ট দ্বীপের রাজা হয়ে কাটিয়ে দিতে পারে। বিশাল রাজত্বের মন্ত্রী হিসেবে তাঁকে মানায় না।

মুসলমান হিসেবেও তার দাড়ি বা পোশাক-আশাক নিয়ে গোঁড়ামি ছিল না। বরং সে মোল্লাদের দেওয়া ফতোয়া নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত। ধৃতরাষ্ট্র যখন ইংল্যান্ডে দার্জিলিং চা বানাতে শিখেছিল তখন কর্ণ স্কচ হুইস্কি আর ককটেল সসেজ খেতে শিখেছিল। পাঁচবার প্রার্থনা তো দূরের কথা, সে বৈজ্ঞানিক যুক্তি তক্কের বাইরে কোনও কিছুই বিশ্বাস করত না। সে তার বয়েসি ইংরেজদের মতো করে ভাবনাচিন্তা করত। তাই তাকে সর্বৈবভাবে আধুনিক বলা যেতে পারে। বাস্তববাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ। ইসলামের কারণে সে গঙ্গাজির থেকে দূরে সরে থাকেনি। বরং গঙ্গাজির হিন্দুত্ব তাদের মধ্যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

অবাক হয়ো না গণপতি। কর্ণ গোঁড়া মুসলমান ছিল না। কিন্তু সে গঙ্গাজির মধ্যে গোঁড়া হিন্দুয়ানির ছায়া দেখতে পেত। গঙ্গাজির পোশাক, তাঁর আধ্যাত্মিকতা, হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থপাঠ, আশ্রমের জীবন এবং তাঁর প্রাক-ইংরেজ যুগ নিয়ে বিভোর হয়ে থাকা…এসব কর্ণর মনে সন্দেহ জাগাত।

তাঁকে সবাই মহাগুরু বললে কর্ণর অস্বস্তি হত। সে বিশ্বাস করত যে পৃথিবীতে শুধু পণ্ডিত ব্যক্তির প্রয়োজন আছে, গুরুদেবের নেই। কৌরব পার্টির প্রার্থনা সভা আর ভিড়ের রাজনীতির সঙ্গে সে তাই বেশিদিন খাপ খাওয়াতে পরেনি।

কর্ণ গঙ্গাজিকে ধর্মনিরপেক্ষ মনে করত না। গঙ্গাজি চেষ্টা করতেন তাঁর হিন্দু ভাবমূর্তির ঊর্ধ্বে উঠতে। সেটা সবসময় তেমন ছাপ ফেলত না। অনেক সময় উলটো ফলও হত। তিনি সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে গিয়ে বলেন, তিনি হিন্দু, মুসলমান, ক্রিশ্চান, পার্সি এবং ইহুদি—সব। এতে কর্ণ বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ‘একেবারে হিন্দুর মতো কথা!’

কর্ণর অবর্তমানে যে কৌরব পার্টি নির্ধারণ করল, গঙ্গাজির দেখানো পথই শ্রেষ্ঠ পথ, এতে কর্ণ অত্যন্ত অপমানিত বোধ করে পার্টি ছেড়ে দিল। সে মনে মনে এটাও জানত জাতীয় রাজনীতিতে সেই মুহূর্তে কৌরব পার্টি ছাড়া অন্য কোনও আশার আলো নেই। মনক্ষুণ্ণ হয়ে সে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল।

৩৯

কর্ণকে যে বেশিদিন রাজনীতির বাইরে রাখা যাবে না, তা আগেই বোঝা গিয়েছিল। সে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স-এর সময় লন্ডনে ছিল। একজন রিপোর্টার-এর সঙ্গে কথা বলার সময় ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি তাঁর অবজ্ঞা এবং ঘৃণা উথলে উঠল।

‘আমার লজ্জা হচ্ছে ভাবতে, আমার দেশের ভাগ্য নির্ধারণে বসেছে একদল চালচুলোহীন লোক।’

‘তাহলে আপনি ভারতের রাজনীতিতে ফিরছেন না কেন?’

‘সঠিক যোগাযোগ-এর অপেক্ষায় আছি।’

কর্ণকে রাজনীতিতে ফিরে আসার নেমন্তন্ন জানাতে পারত কনজারভেটিভ ন্যাশনালিস্ট পার্টি। তারা কৌরব পার্টির থেকে নীতিগত দিক থেকে আলাদা ছিল। কিন্তু সে ডাক পেল গাগা শাহ-এর কাছ থেকে। সে ছিল মুসলমান গোষ্ঠীর প্রধান। সোনালি বর্ডার দেওয়া কার্ড পাঠিয়ে সে কর্ণকে স্যাভয় হোটেলে চায়ের নেমন্তন্ন জানাল।

৪০

‘খুব খুশি হয়েছি তুমি আসায়।’ গাগা তার বিশাল চেয়ার থেকে খুব কষ্ট করে কিছুটা উঠে হাত বাড়িয়ে দিল। কর্ণ না হেসে হাত মেলাল।

‘বসো, বসো, চা খাবে তো?’

গরম ধূমায়িত চা কাপে ঢেলে দিল গাগার পরিচারক। স্যাভয়-এর ওয়েটারদের ধারে কাছে দেখা গেল না। রুপোর ট্রেতে ভরে কেক-পেস্ট্রি এলে হাতের একটা ইঙ্গিতে কর্ণ বুঝিয়ে দিল যে সে ওসব খায় না।

‘কী যে করো! এসব তো অমৃত!’

কর্ণ গম্ভীর হয়ে থাকল।

‘খুব খেতে হবে, বুঝলে? আমার চেলারা আমার ওজন করে বাটখারার অন্য দিকে সোনা-মণি-মাণিক্য দিয়ে। প্রতি জন্মদিনে। রোগা হয়ে গেলে ওরা কষ্ট পাবে।’

গাগা নিজের রসিকতায়, নিজেই হো হো করে হেসে উঠল। কর্ণ ভদ্রতার হাসিটুকুও হাসল না।

গাগা আবার চেষ্টা করল, ‘জানো, আমার এক বউ, মনে পড়ছে না কোনজন, সে সবসময় টিক টিক করত, এটা খাবে না, ওটা রেখে দাও এই সব। তারপর একদিন তাকে আমি বললাম, আমার এক-একটা গ্রাসের জন্য সে একটা করে নীলা পাবে। তারপর থেকে নিজেই পেট ভরতি করে খেতে দেয়! হা হা হা!’

তারপর হঠাৎ কর্ণর মুখটা দেখে তার হাসি থেমে গেল। কর্ণ টান টান হয়ে বসেছিল, পাশে রাখা চায়ের কাপে অবধি হাত দেয়নি।

তাড়াতাড়ি গাগা কাজের কথায় এল। ‘ভাবছ কেন তোমাকে এখানে ডেকেছি, তাই না?’ গাগা বলল। তারপর একটি চকোলেটের টফি মুখে পুরে দিল, ‘আমরা চাই তুমি আবার দেশে ফেরো।’

‘আমরা?’

‘মুসলিম গ্রুপ। আমাদের পার্টিতে তোমার মতো লোক দরকার।’

‘আচ্ছা!’ কর্ণ ছোট্ট করে বলল। গাগা ভাবছিল যে রেসের মাঠের লোকগুলো কী অল্পে সন্তুষ্ট থাকে। মাঝে মাঝে তাদের কাঁধে একটু চাপড় মারো বা একটু টাকা ছাড়ো, ব্যাস! এই কেঠো, গম্ভীর উকিলটাকে তো একেবারেই কবজা করা যাচ্ছে না!

‘ভারতবর্ষের এই মুহূর্তের রাজনৈতিক বাতাবরণ সম্পর্কে তুমি ওয়াকিবহাল নিশ্চয়ই।’ গাগা জিগ্যেস করল।

‘হ্যাঁ। আমি খোঁজ রাখি।’

গাগা কর্ণকে কথা বলাতে পেরে খুশি হল, ‘পরিস্থিতি নিয়ে কী মনে হচ্ছে?’

‘জঘন্য। গঙ্গা দত্ত আর তাঁর গোষ্ঠীই তো কৌরব পার্টিকে চালাচ্ছে। তাঁরা যেভাবে এগোচ্ছে তা পিছিয়ে যাওয়ারই সামিল। ওই গোষ্ঠী যদি ভারতের কর্ণধার হয় তাহলে গণতন্ত্র বা উন্নতির বদলে অরাজকতা আর ভিড়ের রাজনীতিই প্রাধান্য পাবে।’

‘হিন্দু মবোক্রেসী।’ গাগা বলল।

‘বোধহয়। দাঙ্গাবাজদের অবশ্য কোনও জাত বা ধর্ম নেই। সেটা আমরা আম সত্যাগ্রহর সময়ে ভালোই টের পেয়েছি। ভারতের নেতারা আমের রসে হাত ধুচ্ছে, ভাবলেই রাগ হয়।’

‘ঠিকই বলেছ! আমের শ্রাদ্ধ করে ছেড়েছিল ওরা। কত আম নষ্ট হয়েছিল।’ গাগা দুঃখ করে বলল। আম তার প্রিয় ফল। প্রতি বছর এক ঝুড়ি করে আলফনসো আম সে তার চেনা ইউরোপীয় বন্ধুদের পাঠায়। এই অপূর্ব উপহারের ঝুড়িতে অবশ্যই গাগার গিল্টি করা কার্ডটা থাকত। বলাই বাহুল্য যে এই উপহারের জেরেই ইংল্যান্ডের বড়বড় অট্টালিকার দুয়ার তার জন্য অবারিত ছিল। এ বছর অবশ্য গঙ্গার কল্যাণে কয়েক ঝুড়ি আম ফেরত এসেছিল। ইংল্যান্ডের মানুষ এখন ভারতীয় আম রাজদ্রোহিতার প্রতীক হিসেবে গণ্য করছিল।

‘অন্য পার্টিগুলোকেও আমার ভালো লাগে না! মুসলিম গ্রুপ…’

‘…মরার মুখে! কিন্তু তুমি তো এটাও বোঝো, জমিদার বা নবাব দিয়ে কি পার্টি গড়া যায়? আমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে কিন্তু উদ্যম নেই। ঠিক সেই জন্যেই তোমাকে দরকার।’ গাগা বলল।

কর্ণ তার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল, ‘তুমি কী চাও বলো তো?’

‘তুমি দেশে ফিরে আমাদের পার্টিতে যোগ দাও। তোমার অভিমত খুব জরুরি।’ গাগা বলল।

‘অভিমত…উপদেশ?’ কর্ণ দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইল গাগার দিকে। গাগা দেখল, কর্ণের কপালের অর্ধচন্দ্র কীরকম জ্বলজ্বল করছে, তৃতীয় নয়নের মতো।

‘হ্যাঁ, উপদেশ…আর উপায়, দুটোই।’

কর্ণ দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘আমার এ ব্যাপারে কিছু করার নেই। আপনার প্রস্তাব আমায় আকর্ষণ করছে না। শুভদিন।’

গাগা বড় বড় তাকিয়ার মধ্যে জড়িয়ে গিয়ে হাঁসফাঁস করছিল। কিন্তু উঠতে আর পারছিল না, ‘আরে শোনো, শোনো, কোথায় যাচ্ছ? আমি বুঝতে পারছি না।’

‘আমি পরিষ্কার করে বলছি। কয়েকজন বুড়ো অকেজো মানুষকে জ্ঞান দেওয়ার কোনও বাসনা আমার নেই। আশাকরি আপনি আমার ভাষাকে মার্জনা করবেন। আমার আরও জরুরি কাজ আছে।’

কর্ণকে অবাক করে দিয়ে মোটা নরম হাত বাড়িয়ে গাগা খপ করে কর্ণর হাত ধরল, ‘ক্ষমা! মার্জনা! আরে এইরকম কড়া ভাষাই তো আমরা শুনতে চাই। বোসো। আমায় বলো। আমাদের জন্যে তুমি কী করতে পারো? অভিমত, উপদেশ ছাড়া আরও কী কী করতে পারো তুমি?’

গাগা খুশিতে হেসে উঠল। আরও পেস্ট্রি নিয়ে আসতে বলল। কর্ণ এবার শান্ত হল, তার অর্ধচন্দ্র সোনালি চামড়ার সঙ্গে আস্তে আস্তে আবার মিশে গেল। কর্ণ বসে পড়ল।

‘তুমি বলো।’ গাগা আবার তাকিয়ার পাহাড়ে মিশে গেছে।

‘আমি খানিকটা ভেবেছি এ নিয়ে। শুরুতে আমি একটু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম আপনার নিমন্ত্রণ নিয়ে, যদিও আপনাদের পার্টির কিছু সদস্যকে আমি যথেষ্ট পছন্দ করি। এমনিতেই কোনও ধর্মগোষ্ঠীর সঙ্গে আমি যোগ দিতে চাই না, কিন্তু কৌরব পার্টি যে দিকে এগোচ্ছে তাতে আমার খুব বেশি বাছবিচারের জায়গা নেই। ইংরেজরা মুসলিম গ্রুপকে কিছুটা হলেও সম্মান দেয়।’

গাগার মুখ ভরতি লেমন টার্ট!

‘আপনার পার্টির কিছু সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এখন যে অবস্থায় পার্টি রয়েছে তাতে বড়লোক মুসলমানদের নানারকম সুবিধের কথা আর ধর্ম নিরপেক্ষ কিছু বক্তব্য ছাড়া খুব একটা রাজনৈতিক শক্তি নেই। মুসলিম গ্রুপ-এর নেতাদের ইংরেজরা কিছু কিছু কমিটিতে রেখেছে। তার মানে এই নয় যে এই গোষ্ঠী রাজনৈতিকভাবে খুব কিছু অর্জন করেছে।’

‘ঠিকই, ঠিকই।’ গাগা বলল।

‘আমরা ব্রিটিশদের শাসনে বেশ নিরাপদে আছি। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ কী? গঙ্গা দত্তর কৌরবদের শাসন কি আমরা মেনে নিতে পারব? আপনার আমার সে ভারতে কোনও জায়গা হবে না।’

‘আমি একমত। তুমি বলে যাও।’

‘এটা আমাদের রণকৌশল তৈরি করার সময়। উপদেশ দেওয়ার নয়। আপনাদের প্রকৃত নেতা দরকার, যে এই যুদ্ধ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।’

‘তুমি সেই হাল ধরবে?’

‘আমিই একমাত্র নেতৃত্ব দেব।’

গাগা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। যেন কিছু বলার আগে ভালো করে পরখ করে নিচ্ছে, ‘ঠিক আছে। তোমার শর্ত বলো। আমরা রাজি আছি।’

কর্ণ তার স্যুটের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে আনল। ‘আমি ভেবেছিলাম এটার দরকার হবে। আমার সব শর্ত এখানে লেখা আছে।’

গাগা কাগজটা নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু তাতে কী লেখা ছিল, আমি হুবহু বলতে পারব না। অত দূরে দাঁড়িয়ে গাগার পরিচারকটি কিছু শুনতে পাচ্ছিল না। আমি তোমায় বলেছিলাম না গণপতি, যে আমার লোক চারিদিকে ছড়ানো ছিল! এইবার তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি, তোমার ধন্ধ কাটছে। একটু বিশ্বাস আর ভরসা রাখো গণপতি! দেখবে তাহলে তোমাকে বোঝাতে আমার যে সময়টা নষ্ট হচ্ছে, সেটাও কাজে লাগাতে পারব।

৪১

সেই কাগজের টুকরোটাতে কী লেখা ছিল, তা বোঝাই যায়। কর্ণ দেশে ফিরে আসার পর তড়িঘড়ি তাকে মুসলিম গ্রুপের প্রেসিডেন্ট করে দেওয়া হল। পার্টির বড়রা সবাই কর্ণের নির্দেশে অভিভাবক বা পরামর্শদাতা পদে উন্নীত হলেন। পার্টির সংবিধানকেও কিছুটা বদলানো হল। প্রেসিডেন্টের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হল। মুসলিম গ্রুপ এগিয়ে চলল তার নতুন উদ্দেশ্য নিয়ে। ভারতের মুসলমানদের উন্নতি সাধনের উদ্দেশ্যে। চারিদিকে অফিস খুলে, জেলায় জেলায় কর্মসূচি চালিয়ে সদস্যদের পার্টিতে দাখিল করা হল। কর্ণ তার নিজের রাজত্ব বিস্তার করতে লাগল।

সেই প্রথম কর্ণের উচ্চকিত কণ্ঠে ঘোষিত হল স্বাধীন ভারতের কথা। অনুনয় প্রার্থনার দিন শেষ করে জাতীয় আন্দোলনের পথে হাঁটতে শুরু করল দেশ।

‘হিন্দু প্রভুত্ব ছাড়াই স্বাধীনতা চাই।’ এই ছিল কর্ণের স্লোগান। আগেকার কর্ণ কখনও ধর্ম গোষ্ঠীভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিল না। কিন্তু এখন সে সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং উন্নতি সাধনের মধ্যে দিয়ে নিজের বদলে যাওয়া রাজনৈতিক চিন্তার খাত বইয়ে দিল।

‘ও দেশের একটা ভাগের ওপরে প্রভুত্ব করতে চায়। আগেও তাই চাইত।’ ধৃতরাষ্ট্র বলে।

ব্যাপারটা বোঝো গণপতি। কৌরব পার্টিতে পাণ্ডুগামীরা ভাঙন ধরিয়েছে, অসহযোগ আন্দোলন চৌরাস্তার ঘটনার পরে ভেস্তে গেছে, আর এদিকে মুসলিম গ্রুপ, যাকে ইংরেজরা বেশ পছন্দই করত, ধীরে ধীরে শক্তি অর্জন করছে রাজনীতির ময়দানে। দু-পক্ষে লড়াই তো হবেই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *