সপ্তদশ অধ্যায়। এক ফোঁটা মধু—অমৃত সমান
১০৮
শেষে মানুষ জেগে উঠল। যে তাদের নেতৃত্ব দিল, আমরা ভেবেছিলাম, সে বোধহয় হারিয়েই গেছে কালের অন্তরালে। জয়প্রকাশ দ্রোণ তার রাজনৈতিক সন্ন্যাস থেকে আত্মপ্রকাশ করল স্বৈরাচারী প্রিয়ার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে।
প্রথমে অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল। কারণ তার ছেলে অশ্বত্থামা তখনো কৌরব পার্টিতে রয়েছে। প্রিয়াও দ্রোণের ভাবমূর্তিকে কখনওই আঘাত করেনি। দ্রোণ একবার চম্বলের ভয়ংকর ডাকাতদের আত্মসমর্পণ করাতে কৌরব সরকারকে সাহায্যও করেছে। তার নিজের অতীত সে ডাকাতদের সামনে মেলে ধরে তাদের অস্ত্র সমর্পণ করে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
কিন্তু সে আর চুপ করে থাকতে পারেনি। তার প্রিয়াকে ডাকাতের চেয়েও বেশি ভয়ংকর মনে হয়েছে।
আমাদের গল্পের নায়করা তখন কে কী করছিল, দেখা যাক। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে দিয়েই শুরু করা যাক। সে তখন বিরোধী দলনেতার আসনে বসেছে। দুর্যোধনীর বিরুদ্ধাচরণ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তার পদত্যাগ, দুই মিলে তার চারধারে একটা ঋষিতুল্য ভাব এনে দিয়েছিল। সে অবশ্য ইদানীং রাজনীতির চেয়ে মুত্রাশয়ের সমস্যা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাচ্ছিল।
ভীম তখনো সামরিক বাহিনীতে ছিল। সে মাথা মোটা হলেও গায়ের জোরে তার সঙ্গে ভূ-ভারতে কেউ পেরে উঠত না।
অর্জুনকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবা হলেও তার মধ্যে অনিশ্চয়তা গভীরভাবে বাসা বেঁধেছিল। সে ঠিক করতে পারছিল না, তার ধর্মাবতার বড় দাদার পার্টিতে থাকবে, না কি দেড়েল অশ্বত্থামার পার্টিতেই থাকবে।
কৃষ্ণ নিজে স্থানীয় রাজনীতিতেই থেকে গেল। বলল, ‘তোমাদের জাতীয় রাজনীতির জল বড় ঘোলা।’ কৃষ্ণের অবশ্য প্রিয়ার দাক্ষিণ্যের দরকার ছিল না। সে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজনীতিবিদ। প্রিয়ার থেকে দূরে থাকতেই সে পছন্দ করত। অর্জুন রাজনীতি ছেড়ে সুভদ্রা আর দ্রৌপদীর ওপর মনোসংযোগ করল। মাঝে মাঝে সাংবাদিকের কাজও করত।
কুন্তির চুল প্রায় সবই সাদা হয়ে গেছে। সে পাণ্ডবদের আলোচনায় জাঁদরেল পান চিবোনো মাতৃমূর্তি হয়ে বসে থাকত। নকুল আমলা হয়েছিল। বিদুর অবসর গ্রহণ করেছে। সহদেব ফরেন সার্ভিসে দুঁদে কূটনীতিবিদ বলে পরিচিত পেয়েছে। আমার তো দাঁত পড়ে গিয়ে মাড়ি দেখা যায় ততদিনে!
১০৯
দ্রোণের আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। মানুষ স্বেচ্ছায় দলে দলে যোগ দিল। বিরোধী পক্ষও এসে জুটল। দুর্যোধনীর সমস্ত অন্যায় দ্রোণ মানুষের সামনে তুলে ধরল। সে সরকারি ভ্রষ্টাচার হোক বা পুলিশের শোষণ, আমলাতন্ত্রের অপারদর্শিতা, কালো বাজারি, মূল্যবৃদ্ধি, ভেজাল, জাতপাত, পণপ্রথা। মজার কথা, প্রধানমন্ত্রী এইসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার কথা নির্বাচনী বক্তৃতায় বলেছিল।
দ্রোণ অচিরেই সরকারের মূলসমেত নাড়িয়ে দিল। নতুন এক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হল। ছাত্রেরা ক্লাস বয়কট করল, কলকারখানায় মজদুরেরা হরতাল করল। দ্রোণ এমএলএ-দের বলল, ইস্তফা দিতে। পুলিশকে বলল, আন্দোলনের নেতাদের গ্রেপ্তার না করতে। মানুষ বুঝে গেল, কর্ণস্থানকে ভেঙে দু-টুকরো করার চেয়েও জরুরি কাজ হল দেশের সাধারণ মানুষের উন্নতি সাধন করা! দুর্যোধনী সেটা পারেনি।
বিরোধী পার্টিগুলি দ্রোণের সঙ্গে একজোট হল। কৌরব (প) আগেই জুটে গিয়েছিল। এবার গণআন্দোলনের লক্ষ্য হল দুর্যোধনীর পার্টির রাজ্য সরকারগুলি। বেশিরভাগ মুখ্যমন্ত্রী দুর্বল ব্যক্তিত্ব। তারা প্রিয়ার নেকনজরে থাকার ফলে চেয়ারগুলি পেয়েছিল। দ্রোণের বাড়ি যে রাজ্যে, সেখানে আন্দোলনের সঙ্গে মোকাবিলা করতে রাজ্য সরকারকে এক লক্ষ টাকা রোজ খরচ করতে হচ্ছিল। হস্তিনাপুরে মহিলা বাহিনী হাতা খুন্তি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে চড়াও হল। সে পদত্যাগ করল। হস্তিনাপুরে রাষ্ট্রপতি শাসন ঘোষণা হল। যুধিষ্ঠির আমরণ অনশনে বসে। দুর্যোধনী প্রমাদ গুণে নির্বাচন ঘোষণা করল হস্তিনাপুরে। বলা বাহুল্য তার পার্টি হেরে গেল। তখন তার রাজনীতির ভিত নড়বড়ে হতে শুরু করেছে।
আমার মন ভেঙে পড়ল গণপতি। এই অরাজকতাকে ডেকে আনার জন্যে কি আমরা স্বাধীনতা এনেছিলাম? মিটিং মিছিল, গ্রেফতার, মারদাঙ্গা এইসব থামাতে সরকারের সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছিল, দেশের উন্নতি হবে কী করে?
দ্রোণ আর যুধিষ্ঠির যদি পরের নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করত, তাহলে প্রিয়া নিজেই ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু তাকে সময়ের আগেই সরিয়ে দেওয়ার জন্য এরা মরিয়া হয়ে উঠল।
সেই সময়ে দুর্যোধনী এমন একটা কাজ করে বসল, যা সংসদীয় গণতন্ত্রে নীতিবিরুদ্ধ। রাষ্ট্রপতি একলব্যকে মঞ্চে রেখে সে আগামী নির্বাচনে নিজের স্বপক্ষে বক্তৃতা দিল। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি রাজনীতির ঊর্ধ্বে। তাকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যে টেনে আনা যায় না।
প্রধানমন্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করল আদালত। গণ-আন্দোলনে দাবি উঠল তার পদত্যাগের। আন্দোলনের নেতারা নানান কর্মসূচি নেওয়ার কথা ঘোষণা করল প্রিয়ার বাড়ির সামনে। প্রিয়ার পার্টির মধ্যে ভাঙন দেখা দিল। অশ্বত্থামার নেতৃত্বে অনেকে প্রিয়াকে আপাতত চেয়ার ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিল। এদের ওপর দ্রোণ তার টোপ ফেলল। এই সময় দুর্যোধনীর সবথেকে কাছের পরামর্শদাতা ছিল বাঙালি ব্যারিস্টার শকুনিশঙ্কর দে। বিশালদেহী শকুনি ছিল চকচকে চেহারার পুরুষ। সিল্কের পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম লাগানো। অনেকগুলি দাঁত তার নকল। একবার মার খেয়ে আসলগুলো ভেঙে গিয়েছিল। উকিল শকুনি সেবার একটা খুনিকে বেকসুর খালাস পাইয়ে দিয়েছিল।
‘তোমার পদত্যাগ করা উচিত নয়। এতে বিরোধীদের সুবিধে হবে।’ সে প্রিয়াকে বলল।
‘আর কোনও উপায় নেই যে।’
‘প্রধানমন্ত্রী এরকম কথা বলে না। পালটা মার দাও!’
‘কিন্তু এইসব রায়টবাজদের জেলে পুরব কীভাবে? তারপর তো টিকতে পারব না!’
‘দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করো। আইন কানুন ভেঙে পড়েছে বলে অজুহাত দাও।’
‘হুঁ।’ আস্তে আস্তে প্রিয়ার অন্ধকার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল।
‘যতগুলো বিরোধী নেতাকে জঙ্গি মনে হচ্ছে, সবাইকে জেলে ভরো।’
‘ঠিকই বলেছ। জরুরি অবস্থায় কী কী করতে হবে, সংবিধানে পরিষ্কার বলা নেই।’
‘খবরের কাগজগুলোর মুখ বন্ধ করো। জরুরি অবস্থার অজুহাত দেখিয়ে, কিছু গণতান্ত্রিক অধিকার মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নাও। আদালতকেও জব্দ করতে হবে।’
‘বলে যাও, বলে যাও।’
‘হ্যাঁ। মনে করে রাষ্ট্রপতি একলব্যর সইটা করিও।’
১১০
যুধিষ্ঠির একপাশে দ্রোণ আর অন্যপাশে বিরোধী নেতাদের নিয়ে বোট ক্লাবে এক বিশাল জনসমাবেশে বক্তৃতা দিল।
‘আপনাদের আশা ভরসারই প্রতীক আমরা। আমরা এক জোট হয়ে দুর্যোধনীর কৌরব পার্টির বিরুদ্ধে লড়তে এসেছি। আপনাদের উচ্ছ্বাস দেখে আমার গর্বে বুক ফুলে উঠছে। একসঙ্গে আমরা লড়ব অন্যায়ের বিরুদ্ধে।’
চারিদিক থেকে কান ফাটানো হাততালি আর সোৎসাহ চিৎকার শোনা গেল, ‘দুর্যোধনী নিপাত যাক!…যুধিষ্ঠির জিন্দাবাদ!’
কোর্টের রায় বিরোধীদের মনে এনে দিয়েছে এক অদ্ভুত জোর। হস্তিনাপুরে দ্রোণের যুব আন্দোলনের সদস্যরা মিলে জনতা মোর্চা সৃষ্টি করল। এর নাম হল জনতাফ্রন্ট।
বিরোধীরা একজোট হয়ে দুর্যোধনীর বাড়ির বাইরে তার পদত্যাগের দাবিতে দিনের পর দিন সত্যাগ্রহ চালাতে লাগল। শকুনি এদের মুখ বন্ধ করার জন্য ট্রাক ভরতি করে চাষিদের এনে সরকারের পক্ষে জনমত তৈরি করার চেষ্টা করত।
বিদেশি ম্যাগাজিনে ভারতের রাজনৈতিক সংকটের বিভিন্ন ব্যাখ্যা বেরোতে লাগল। আপাতদৃষ্টিতে কাহিনির চরিত্রগুলিকে কালো বা সাদা মনে হয়। আসলে ধূসর হল ভারতীয় রাজনীতির রং।
১১১
যুধিষ্ঠিরের বোট ক্লাবের বিশাল জনসভার এক পরেই যবনিকাপাত ঘটল। শকুনির প্ল্যান কার্যকর করা হল। গোটা দেশে গণআন্দোলনের নেতাদের বাড়িতে গভীর রাত্রে পুলিশ কড়া নাড়ল। অন্ধকার কাটার আগেই তাদের কারাগারে বন্দি করে ফেলা হল।
দ্রোণের মুখে সেই সংস্কৃত উক্তি শোনা গেল, যা গঙ্গাজির মুখে বিবিগড়-এর পরে শোনা গিয়েছিল, ‘বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি।’
আমায় দুর্যোধনী গ্রেফতার করাল না। বুড়ো বলে নয়, আমি দ্রোণের এই জনজাগরণের নামে নৈরাজ্য পুরোপুরি সমর্থন করিনি বলে। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। প্রিয়ার অত্যাচারের উত্তর পালটা অরাজকতাকে দিয়ে করা যায় না।
জরুরি অবস্থা জারি রইল। সরকার বাইশ দফা আর্থ-সামাজিক উন্নতির নতুন প্রতিশ্রুতি দিল। স্ট্রাইক আর রাজনৈতিক সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। কাজে নতুন-নতুন গতি এল। এতদিন যারা কাজে না এসে নানান ধরনের রাজনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তারা সময়মতো কাজে ফিরে এল। কঠিন অনুশাসন দেশের মধ্যে একটা বাধ্যতামূলক স্থিতাবস্থা নিয়ে এল। কিছু উন্নতিসাধন অবশ্যই হল। জমি সংস্কার আইন, বন্ডেড লেবার ইত্যাদি দেশ থেকে উঠে গেল। খবরের কাগজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি রইল। সাংবাদিকরা খেপে রইল।
রাজনৈতিক কোলাহল থেমে গিয়ে শ্মশানের নৈঃশব্দ্য বিরাজ করতে লাগল গোটা দেশে। মানুষের বুক নিংড়ানো স্বস্তির নিঃশ্বাসটাই একমাত্র শব্দ।
‘আপনি যাই বলুন ভি ভি জি, এই নৈঃশব্দ্য সহ্য করা যাচ্ছে না। কানে তালা ধরে যায়। অতলান্ত সাগরের জল শুকিয়ে যাওয়া আর ভারতে রাজনীতির গুঞ্জন থেমে যাওয়া দুই-ই এক।’ সাংবাদিক অর্জুন বলল।
‘তোমরা সাংবাদিকরা তাই মনে করো। তোমরা রাজনৈতিক খবরের জন্য যে পরিমাণ জায়গা তোমাদের কাগজে রাখো তার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। আমরা বুড়োরা, যাদের দিন কাটে খবরের কাগজ পড়ে, তাদের কী কষ্ট! এই পাতার পর পাতা র্যালি, বক্তৃতা, রাজনৈতিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, পার্টি পরিবর্তন করা আর বহিষ্কারের খবর—থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়—উঃ, বিরক্তিকর। কাগজ পড়ে মনে হয়, রাজনৈতিক কচকচি ছাড়া ভারতীয় জীবনে যেন কিছুই নেই।’ আমি বলে গেলাম।
‘পাঠক তাই চায়।’
‘বাজে বোকো না। পাঠক এসব ওপর-ওপর পড়ে নিজের মনে একটা ধারণা করে নেয়। তার বেশি কিছু নয়। পাঠকের মনের বিতৃষ্ণা বোঝার ক্ষমতা তোমাদের নেই।’
‘ভি ভি জি, আগে কিন্তু এরকম ছিল না, তাই না?’
‘তখন আমরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছি। আমাদের মনে দেশভক্তির জোয়ার। আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য আপ্রাণ লড়াই করেছি। ধৃতরাষ্ট্র যতই ক্ষুদ্রতার পরিচয় দিক, সে কখনো গণতন্ত্রের শত্রুদের সঙ্গে আপোস করেনি। কিন্তু সে বোঝেনি যে এদেশে গণতন্ত্রের খোলসটা মাত্র তৈরি হয়েছে, ভেতরটা একেবারে ফাঁকা।’
‘অর্জুন! আমরা নামে সংসদীয় গণতন্ত্র। তার মানে বুঝতে পেরেছি কি? আমাদের দেশে যে-কোনও সিদ্ধান্ত মুষ্টিমেয় কয়েকজন রাজনীতিবিদ নিয়ে থাকে। আপামর সংসদদের সে বিষয়ে নিজস্ব মতামত দেওয়ার অধিকার আছে কি?’
বলতে-বলতে আমি হাপাচ্ছিলাম। এক গ্লাস খেয়ে ফের বললাম, ‘আধুনিক গণতন্ত্রের আমরা কতটুকু বুঝি অর্জুন? মানুষ যা চায় আর সরকার যা করে তার মধ্যে অনেক ফারাক। সরকার ভাবলেশহীন এক অতিকায় শক্তি মানুষ! তাকে শুধু ভয় পেতে শিখবে। ভক্তি আসবে কি? গঙ্গাজির কৃতিত্ব ছিল, তিনি মানুষকে তাঁর আন্দোলনে সামিল করতে পেরেছিলেন। আজকের ভারতীয়রা রাজনীতির কথা আলোচনা করে। ভুল সংশোধন করতে এগিয়ে আসে না।’
‘তাহলে আমাদের কী করণীয়?’
‘বেদ-পুরাণের দেশ ভারতবর্ষ। এখানকার মানুষ জন্ম থেকেই ভাগ্যে আর দৈবে বিশ্বাসী। সে জানে, জীবনে অনেক কিছুই পালটানো যায় না। তোমাকে একটা গল্প বলি। একজনকে বাঘে তাড়া করল। সে দৌড়তে দৌড়তে যখন আর পারছিল না, তখন একটা গাছ পেয়ে সেটা বেয়ে উঠে পড়ল। ডালটা দুর্বল আর ঘুণে খাওয়া। ভেঙে গেল। বাঘের মুখে পড়তে পড়তে লোকটা একটা পাতকুয়োয় গিয়ে পড়ল। তাতে জল ছিল না। ছিল সাপ। পড়বার সময় লোকটা একটা ঘাসের শিস দেখতে পেল। তাতে এক ফোঁটা মধু। সে পড়তে পড়তে মধুটা চেটে নিল।’ তাকিয়ে দেখলাম যে অর্জুন উদ্গ্রীব হয়ে গল্পটা শুনছিল, ‘তুমি কি ভাবলে অমিতাভ বচ্চন এসে লোকটাকে বাঁচাবে? বোকা। ভারতীয় মানুষ জানে কখন নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে যা ঘটছে তা মেনে নিতে হয়।’
১১২
আমি আর অর্জুন এরপর জরুরি অবস্থা আর প্রিয়ার স্বৈরাচারী নেতৃত্ব নিয়ে অনেক তর্ক আর আলোচনা করেছি। আমরা নয়, সারা দেশের মানুষ আলোচনায় মত্ত রইল। জোরে জোরে এসব কথা বলতে মানা! ফিসফিস করেই আলোচনা চলল।
দুর্যোধনী প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি কড়া হয়েছিল। খবরের কাগজের মুখ বন্ধ করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। তারা যা খুশি লিখলেও প্রিয়া নিজের ইচ্ছেমতো বুলডোজার চালিয়ে যেতে পারত।
তোমাকে কাহিনির প্রায় শেষে নিয়ে চলে এসেছি, গণপতি। কিন্তু এটা মনে রেখো, গল্পটা বলতে গিয়ে অনেক কিছু চেপে গেছি। সেগুলো বললে আমার মতো করে গল্পটা বলা হত না।
প্রথমেই বলেছি যে এটা আমার গল্প। যেভাবে আমি ভারতবর্ষকে বুঝেছি, সেই কাহিনি। প্রত্যেকের দেখার ভঙ্গি আলাদা, তার উপলব্ধিও আলাদা। ভারতকে কি এক জন্মে জানা বোঝা যায়? কোনও সমাধানসূত্র কি চূড়ান্ত? অর্জুনকে আমি বোঝাচ্ছিলাম, যা গেছে তা গেছে। সবাই এই অত্যাচার মেনে নিয়ে তাদের জীবনকে নতুন করে গুছিয়ে নিচ্ছে।
অর্জুন মুখ খুলল, ‘ভুল ভি ভি জি। আপনার ভুল হচ্ছে। তাই যদি হয়, তবে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না।’
১১৩
ঠিকই বলেছিল অর্জুন। আমি শান্তি খুঁজে পেতে গিয়ে বড্ড বেশি ঢিলে হয়ে পড়েছিলাম। আমি কি কোনও চেষ্টা করেছিলাম অন্যায়-এর সঙ্গে মোকাবিলা করার? নাকি এদিক-ওদিক করে পাশ কাটিয়ে গিয়ে সমস্যাগুলোকে না দেখার ভান করছিলাম? পৃথিবীর সূর্য-চন্দ্রও যে তাদের জ্যোতি হারিয়েছে, তা কি আমি লক্ষ করিনি? না কি মানতে রাজি হইনি? আমি তো ইচ্ছে করে দ্রৌপদীর কথা চেপে গেছি গণপতি!
আমি তার চোখে দুঃখের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলাম। তার হাতে কাটা-পোড়া দাগও দেখেছিলাম কতবার। কিন্তু সেগুলো সবই কি ঘরকন্নার কাজ করতে গিয়ে পাওয়া ছোটখাটো আঘাত? নাকি তার স্বামীরা তার ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে? আর চোখ বুজে থাকতে পারলাম না গণপতি। অর্জুনের কথা আমার চোখ খুলে দিল। আমি জেগে জেগে আবার স্বপ্ন দেখলাম।
১১৪
হস্তিনাপুরে ফিরে গেছি। দেখলাম, ধৃতরাষ্ট্র রাজা হয়ে সিংহাসনে বসে। পাশে রাজকন্যা দুর্যোধনী। চারিদিকে গয়নাগাটি পরে রাজপুত্র-রাজকন্যারা ঘোরাঘুরি করছে। পাণ্ডবরাও রয়েছে সে সভায়।
শকুনিকে দেখলাম, হাত ঘষতে ঘষতে দুর্যোধনীর খুব কাছে চলে গেল। আঙুলের আংটিগুলো ঝকঝক করছে।
‘শোনো, যুধিষ্ঠিরকে যুদ্ধে হারানো যাবে না। ওকে পাশা খেলায় আমন্ত্রণ জানানো হোক। দেখো তারপর কী হয়।’ শকুনি বুদ্ধি দিল।
‘পাশা খেললে কী হবে?’
‘ও কিছুতেই আমন্ত্রণ উপেক্ষা করবে না। আমরা পণ হিসেবে খুব দামি কিছুকে সামনে রাখব। দেখবে কী হয়।’ শকুনি চোখ টিপল। হিস করে চলল।
‘হুঁ। বুঝতে পারছি। হোক হোক! তুমি তো খুব ভালো পাশা খেলো, তাই না?’
‘তা আর বলতে?’ শকুনি খলখল করে হাসল, ‘আমায় কেউ পাশা খেলায় হারাতে পারে না, এ খেলার আমিই জাদুকর।’ আমাদের পুরোনো নিয়ম অনুযায়ী পাশা এবং ঘুঁটি দুটিই আমরা পাণ্ডবদের দেব। কারণ, আমরা তাদের খেলায় ডেকেছি। আমার কাছে বিশেষ পাশা আর তার দান আছে।’
‘তুমি অদ্বিতীয়! আমার কাছে যা যা সাহায্য লাগবে, জানিও।’
‘তুমি ধৃতরাষ্ট্রের থেকে অনুমতি জোগাড় করো যাতে আমরা প্রাসাদে খেলতে পারি। তাতে ব্যাপারটা একটা রাজকীয় পরিণতি পাবে।’
দুর্যোধনীর অনুরোধ নিয়ে সমস্যায় পড়ল বাবা, ‘আমার নৈতিকতার দিক থেকে বাধো বাধো ঠেকছে। দেখি একটু বিদুরকে বলে। ও কী বলে!’
দুর্যোধনী তাকে থামিয়ে দেয়, ‘না না, সে এসব পছন্দ করবে না, সব আনন্দ ফুর্তিতেই সে বাগড়া দেয়। তুমি বরং মন্ত্রীদের বলো। শকুনি নিজেই তো মন্ত্রী!’
‘ঠিক আছে। যা ভালো বোঝো করো।’
আমি স্বপ্ন দেখলাম, বিদুর যুধিষ্ঠিরের প্রাসাদে গিয়ে তাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, ‘আমি আমার কর্তব্য করছি। কিন্তু ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না মোটেই।’
যুধিষ্ঠির বলল, ‘না না। নিশ্চয়ই যাব। আমাদের সম্মান থাকবে না, যদি আমি শকুনির এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করি। আমি মোটেই খারাপ খেলি না।’
পাঁচ ভাই, দ্রৌপদীকে নিয়ে হস্তিনাপুরের দিকে চলল।
যুধিষ্ঠির ডাক পেল সুদূরের
বলল, চলো যাই আমরা সবাই
সাবধানবাণী শুনল না বিদুরের
ভাগ্যের কাছে নেই কোনও অজুহাত
এ কোন খেলা খেলছে অকস্মাৎ
আমরা কালের পাশার ঘুঁটি
এগিয়ে চলি গুটি গুটি।
ওরা ধৃতরাষ্ট্রের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।
‘তোমরা এ খেলায় যোগদান নাও করতে পারো। খেলা ছেড়ে চলে যেতে পারো।’ ধৃতরাষ্ট্র বলল। তার অন্ধ চোখ কি অশনি সংকেত দেখতে পেয়েছিল?
‘না। পাণ্ডবদের সম্মান রক্ষা করা আমার কর্তব্য।’ যুধিষ্ঠির বীরত্ব দেখাল, ‘আমি ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছি।’
‘আমি পাশার দানের ওপর নজর রাখব।’ দুর্যোধনী বলে।
‘আমরা যখন রাজত্ব গড়েছিলাম, এসব হবে ভাবিনি।’ বিদুর সাবধান করার চেষ্টা করে।
‘যাও যুধিষ্ঠির! পাষণ্ড শকুনিকে হারিয়ে কৌরবদের অন্যায়ভাবে জেতা ধনদৌলত কেড়ে নাও।’ দ্রোণ ভিড়ের মধ্যে থেকে উৎসাহ দিল।
‘হ্যাঁ, ঠিকই।’ যুধিষ্ঠির এগিয়ে গেল।
‘শুরু করো শকুনি!’
চারিদিকে যেন মেঘ করে উঠল। ঘোর আঁধার ঘনিয়ে এল দ্রৌপদীর মুখে।
‘কী পণ করছ তুমি, যুধিষ্ঠির?’ শকুনির মুখে শেয়ালের হাসি।
‘আমার প্রাসাদ, কৌরব রাজত্বে আমার অংশ।’ বলল যুধিষ্ঠির।
শকুনি দান চালল। ‘আমি জিতলাম।’
চারিদিকে যেন একটা মরণ কান্না শোনা গেল। দূরের জঙ্গলে যেন অনেক শেয়াল কাঁদছে।
‘তোমার পরের পণ কী?’ শকুনি দান চালবার জন্য উদ্যত হল।
‘আমার স্বাধীনতা। আমার পার্টির দশ হাজার কর্মী…সংবাদ মাধ্যমের সমর্থন…’
‘এই দ্যাখো! আমি জিতলাম…’
‘যাঃ! আমি শেষ হয়ে গেলাম। আমার পণ করার মতো কিছু আর নেই।’ বলে যুধিষ্ঠির স্থির হয়ে বসে রইল।
‘কে বলল? ওই যে ওরা রয়েছে?’ শকুনি পাণ্ডবদের দেখাল।
‘ঠিক আছে। আমি ভাইদের পণ করলাম।’
‘এ খেলা বন্ধ করো!’ বিদুর অনুনয় করল। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র শুনেও শুনল না।
‘বাবা, ওর কথা শুনবে না। পাণ্ডবদের পক্ষে থেকে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করছে তোমার এই সৎ ভাই!’ দুর্যোধনী কর্কশ গলায় বলল।
‘এই জিতলাম!’ শকুনি চিৎকার করে উঠল।
‘ওরা এখন তোমাদের বন্দি।’ যুধিষ্ঠির চোখ নামিয়ে নিল। সে তার ভাইদের দিকে তাকাতে পারছে না লজ্জায়।
‘এখনও দ্রৌপদী আছে। পণ করো!’
হঠাৎ শেয়ালগুলো আবার কেঁদে উঠল। ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছিল। দুর্যোধনী জানলা বন্ধ করতে বলল।
যুধিষ্ঠির স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল না, ‘আমার স্ত্রী…সবথেকে সুন্দরী… প্রেয়সী…পবিত্র। আমি তাকেও পণ করলাম।’
কর্ণের অট্টহাসি শুনলাম। তার কপালের অর্ধচন্দ্র জ্বলে উঠেছে।
‘আমি জিতলাম…দ্রৌপদী আমার।’
দ্রৌপদী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দেওয়ালের দিকে পেছতে লাগল। তারপর অর্জুনের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। সে ভয়ে কাঁপছে।
‘যাও! ওদের ঘরের মাঝখানে নিয়ে এসো।’ দুর্যোধনী আদেশ করল বিদুরকে।
‘সেটা কোনও আমলার কাজ হতে পারে না।’ বিদুর বলল।
দুর্যোধনী একজন গার্ডকে পাঠাল। পাণ্ডবরা ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। শুধু দ্রৌপদী দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ‘যাও দুঃশাসন, ওকে ধরে নিয়ে এসো।’ দুঃশাসনের রক্তচক্ষু আর খড়গ-নাক চোখে পড়ছিল। দ্রৌপদী জেনানামহলের দিকে পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু দুঃশাসন চুলের মুঠি ধরে তাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এল। মুখে খাদকের হাসি, চোখে লোলুপ দৃষ্টি।
‘আমায় ছেড়ে দাও। আমি ঋতুমতী।’
‘সেটা আমাদের দেখার দরকার নেই। তোমায় কিনেছি। তুমি এখন আমাদের সেবাদাসী।’
‘তোমরা কী করে এটা দাঁড়িয়ে দেখছ?’ দ্রৌপদী আর্ত চিৎকার করে স্বামীদের কাছে অনুনয় করল। চারিদিকে তার ভয়ার্ত আর্তনাদ প্রতিশব্দ হয়ে ফিরে ফিরে আসতে লাগল। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ। না শোনার ভান করল, ভীম হাতের মুঠো পাকিয়ে অন্যপাশে মুখ ফেরাল। অর্জুন চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইল, বিদুর কাঁপতে থাকল, দ্রোণ ভেঙে পড়ল।
‘এটা অন্যায়!’ অশ্বত্থামা এগিয়ে এল।
‘গার্ড! ওকে গ্রেপ্তার করো।’ দুর্যোধনী হুঙ্কার দিল।
‘এ কী করছ?’ দ্রৌপদী হাহাকার করে উঠল। দুঃশাসন তাকে সবলে নিজের লালসাভরা দুই হাতের মধ্যে টেনে নিল।
‘আমরা তোমায় জিতেছি, দাসী!’
‘না! না! যুধিষ্ঠির ঠকে গেছে, সে বোঝেনি, ফাঁদ পাতা রয়েছে।’ দ্রৌপদী অনুনয় করে উঠল।
‘চোপ! কোনও কথা নয় বাঁদি! কোন সাহসে মন্ত্রী শকুনি সম্বন্ধে এই কথা বলছ?’
ভীম গর্জে উঠল। তার পেশি ফুলে উঠেছে রাগে, ‘কোনও বেশ্যাকেও এভাবে পাশার পণ করা হয় না। যুধিষ্ঠির এ কী করল আমার স্ত্রীকে নিয়ে! কে অধিকার দিয়েছে ওকে? সহদেব, আমায় আগুন এনে দাও। দিই ওই পাপীর হাত দুটোকে জ্বালিয়ে।’
‘শান্ত হও ভীম। যুধিষ্ঠির ন্যায়ের জন্য যা করার করেছে। তুমি চিৎকার কোরো না।’ অর্জুন ধীর গলায় বলে উঠল।
কর্ণ বলে উঠল, ‘পাণ্ডবরাও তো বন্দি! ওদের কাপড় খুলে নাও।’
‘তার দরকার নেই।’ যুধিষ্ঠির নিজের অঙ্গ বস্ত্র খুলে ধৃতরাষ্ট্রের পায়ে ছুড়ে দিল। অন্য ভাইরাও তাই করল।
‘দুঃশাসন, তুমি দ্রৌপদীকে সাহায্য করো!’ কর্ণ আবার তার সেই শয়তানের হাসিটা হাসল। দুঃশাসন এগোতেই দ্রৌপদী চিৎকার করে উঠল।
‘নাহ! আমায় ছেড়ে দাও!’
ততক্ষণে তার কাঁচুলি খুলে দিয়ে তার স্তনদুটো সকলের সামনে অনাবৃত করে দিয়েছে দুঃশাসন। পাণ্ডবরা চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত ঘষছে। দ্রৌপদী দু-হাতে তার লজ্জা ঢেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।
‘আমাকে এত অপমান কোরো না। আমি তোমাদের ক্রীতদাসী।’
‘চুপ করো। যার পাঁচ স্বামী তাকে ভক্ষণ করে, তার আবার কীসের মান-অপমান?’ কর্ণ বলে উঠল।
‘হে কৃষ্ণ! আমায় বাঁচাও। দ্রৌপদী আর্ত চিৎকার করে উঠল।’ দুঃশাসন তার শাড়ি খুলে নিতে উদ্যত হয়েছে।
তারপর এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখলাম। যতই দ্রৌপদী মাটিতে গড়ায়, তার শাড়ি তত লম্বা হয়ে যায়, দুঃশাসন টেনেই চলে। তবু দ্রৌপদীকে নগ্ন করতে পারে না। বাইরে তুমুল বজ্রবিদ্যুৎ বৃষ্টি। প্রকৃতিও কাঁদছে। ড্রুপ্যাড, স্যার রিচার্ড, ব্যভিচার সিং…আমি এক ঝলক তাদেরও যেন দেখলাম।
দুঃশাসন হাঁপিয়ে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। দ্রৌপদীকে নিরাবরণ সে করতে পারেনি। তার চারধারে কাপড়ের পাহাড়। মনে হল কৃষ্ণর কালো সৌম্য মুখটা দেখা দিল। সে যেন দুঃশাসনকে বলছে, ‘ভারতীয় নারীর লজ্জাবস্ত্র তুমি কেড়ে নিতে পারবে না কোনওদিন।’
‘আর একবার পাশা খেলা হোক।’ অর্জুন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানাল।
ধৃতরাষ্ট্র রাজি হল।
‘যুধিষ্ঠির হেরে গেছে শকুনির কাছে। আমি খেলব দুর্যোধনীর সঙ্গে।’ অর্জুন বলে।
‘কোনও পুরুষ কোনও মেয়ের সঙ্গে পাশা খেলে?’ তোমার লজ্জা করে না?’ কর্ণ তির্যক ভঙ্গিতে বলল।
‘না। পাশাখেলায় স্ত্রী-পুরুষ নেই। সাহস থাকে তো এসো দুর্যোধনী।’
শকুনির ঘুঁটি দুটো তুলতে নিচু হল দুর্যোধনী।
‘না। ওটা নয়। পাশা আর ঘুঁটি আমি দেব। এবারে আমি খেলতে ডেকেছি।’
দুর্যোধনীর মুখ রক্তশূন্য দেখাল। সে কেঁপে উঠল। পাশা আর ঘুঁটি এল অর্জুনের কাছ থেকে। ওগুলো কি পাশা-ঘুঁটি? না কি নির্বাচনী ব্যালট পেপার?
দুর্যোধনী হারার জন্য প্রস্তুত হল।
১১৫
ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখলাম, আমি কী ভুল বুঝেছিলাম। আমার চোখের সামনে প্রমাণের ছড়াছড়ি থাকা সত্বেও আমি কেন এসব দেখতে পাইনি?
আমি অর্জুনকে কৃষ্ণর সঙ্গে কথা বলতে পাঠালাম। নকুলকে পাঠালাম গৃহ মন্ত্রালয় থেকে সেইসব তথ্য নিয়ে আসতে, যা লুকোতে তাকে টাকা দেওয়া হয়েছিল। সহদেবকেও ওয়াশিংটন থেকে তথ্য নিয়ে আসতে বললাম। দুর্যোধনী আর তার কর্মচারীরা দেশকে যে একেবারে বেচে দিয়েছে, এতদিনে বুঝতে পারলাম।
জরুরি অবস্থার নাম করে পুলিশ সাধারণ মানুষের ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার চালিয়েছে। রাতের অন্ধকারে সমাজের শত্রু বলে নিরিহ নারী-পুরুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে জেলে বন্দি করেছে, পরিবার পরিকল্পনার নাম করে গায়ের জোরে পুরুষদের বিকলাঙ্গ করে দিয়েছে। শকুনির বুদ্ধিতে প্রধানমন্ত্রী পরিবার পরিকল্পনার কর্মসূচি সারা দেশে চালু করেছে। আমি ভেবেছিলাম, জরুরি অবস্থার তাগিদে বড়লোকদের সুযোগ সুবিধের ওপরে হস্তক্ষেপ হয়তো হয়েছে। এতে গরিবের মঙ্গল হয়েছে।
সত্যিটা ঠিক উলটো। গরিবরা পুলিশের হাতের ময়লা, বস্তি হটাবার নাম করে বা জবরদখল মুক্ত করার অজুহাতে পুলিশ তাদের বাস্তুহারা জন্তুর পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। বন্ডেড লেবারদের মুক্তি দেওয়ার নাম করে সরকার তৈরি করেছে এক বিপুল বেকার জনসংখ্যা। যে ক্রীতদাস এতদিন খাবার আর মাথার ওপরের ছাদ পেয়েছিল, সে তার স্বাধীনতার বিনিময়ে দুটোই হারাল।
এক বছর ধরে এই তাণ্ডব চলল। মানুষের দুঃখ কষ্টের পাহাড়-পরিমাণ ক্ষোভের কথা বলার কোনও জায়গা ছিল না। কাগজগুলোর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আদালত বলে দিয়েছে যে হ্যাবিয়াস করপাস নাকি সাংবিধানিক অধিকার নয়। এবারে অর্জুন আর কৃষ্ণ দুজনে মিলে রুখে দাঁড়াল।
দুর্যোধনী নিজের সুবিধের জন্য সমস্ত ক্ষমতা সংসদে কেন্দ্রীভূত করে দিয়েছিল। সে বলল, এটা ইংরেজদের থেকে শেখা। দুর্যোধনী এটা বোঝেনি, ইংল্যান্ডের সংসদীয় গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষই রাজা। এদেশে জরুরি অবস্থার আড়ালে সংসদ হয়ে উঠল প্রিয়ার অত্যাচারের হাতিয়ার। সেই সংসদ কখনওই গণতন্ত্রের রক্ষক হতে পারে না। প্রিয়ার সংসদ মানুষের দিকে বন্দুক তাক করে, ভয় দেখিয়ে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। প্রিয়ার গণতন্ত্রকে একনায়কতন্ত্র ছাড়া কিছুই বলা যায় না। সে সময়ে ভারত আর কর্ণস্থানের বিশেষ তফাত ছিল না।
আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলির মুখ বন্ধ করে রাখলেও মার্কিনি সংবাদ মাধ্যমগুলি প্রিয়ার অত্যাচারী সরকারের কথা বহুল প্রচার করছিল। তারা লিখতে লাগল, কীভাবে পৃথিবীর সব থেকে বড় গণতন্ত্রে মানুষের সমস্ত মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বিরোধীপক্ষকে গ্রেফতার করা, সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ করে দেওয়া এসব মার্কিন দুনিয়ায় রাজনৈতিক পাপ হিসেবে গণ্য হত। পরে কলকারখানায় বা অফিস-কাছারির নিয়মানুবর্তিতার কথাও আমেরিকান কাগজগুলি লিখতে লাগল। কারণ মার্কিনি ব্যবসা ভারতে বিস্তার পেতে লাগল। আমেরিকান সাংবাদিকরা ভারত দর্শনে আসতে লাগল। তাদের জন্য এ দেশটা হল অ-কমিউনিস্ট স্বৈরাচারী দেশগুলোর একটি। আমি সহদেবের মাধ্যমে এইসব সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। কিন্তু বুঝেছিলাম, তাদের ভারত সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা থেকে যাচ্ছে।
দ্রৌপদী ভারতীয় নারী। তাকে শাড়ি পরতে হয়। আর সেই শাড়ির আড়ালেই তার লজ্জা নিবারণ হয়। পাশ্চাত্যের মহিলাদের মতো জামা-কাপড় যদি সে পরত, তাহলে তাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে ফেলতে সময় লাগত না।
কৃষ্ণ দুর্যোধনীর বিরুদ্ধে তোপ দাগল। সে অর্জুনকে তার দ্বিধাদ্বন্দ্বের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে তার জীবনের দিক নির্ণয় করতে সাহায্য করল। অর্জুনের মধ্যে এল সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। যুধিষ্ঠির আর দ্রোণ যখন কারাগার থেকে বেরোল, কৃষ্ণ তাদের বোঝাল, কেন তাদের হঠকারী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত নয়। ভীম সামরিক বাহিনী থেকে ইস্তফা দিয়ে বোমা মেরে দুর্যোধনীকে তার বাবার কাছে পাঠাবার কথা ভাবছিল। অর্জুন আর কৃষ্ণ মিলে তাকে বোঝাল, শিঘ্র সময় আসবে।