তৃতীয় অধ্যায়। বৃষ্টি এল ঝেঁপে

তৃতীয় অধ্যায়। বৃষ্টি এল ঝেঁপে

১৩

‘যথেষ্ট হয়েছে!’ ব্রিটিশ রেসিডেন্ট রাগে চিৎকার করে উঠলেন। তিনি বারান্দায় অস্থির হয়ে পায়চারি করছিলেন, হিসলপ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পিছু পিছু ঘুরছিল। ‘নীল চাষ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ হচ্ছে! ওকে আমি শূলে চড়াব।’

‘হ্যাঁ স্যার, মানে…কী…কী করে স্যার?’ হিসলপ ম্রিয়মান হয়ে জিগ্যেস করল।

‘কী করে মানে?’ স্যার রিচার্ড হাঁটা থামিয়ে হুঙ্কার ছাড়লেন।

‘না স্যার, কী করে…মানে ওই শূলের ব্যাপারটা?’

‘আমি কি ওকে তিরের শয্যার ওপর শুইয়ে দেব? বোকার মতো কথা বলো কেন হিসলপ?’

‘না, না। স্যার, আমি তা বলিনি স্যার। আমি স্যার…’

‘কী আমি স্যার, তুমি স্যার?’

হিসলপ আরও ভয় পেয়ে গেল, ‘আমি ঠিক এটা জিগ্যেস করিনি যে কী করে করবেন। আমি জিগ্যেস করছিলাম যে শূলে, মানে কীভাবে মানে আপনি ঠিক কী…স্যার।’ হিসলপ তোতলাতে আরম্ভ করল।

রেসিডেন্ট এবার থেমে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। ‘তুমি ঠিক কী বলতে চাইছ?’

‘কিছু না স্যার।’ হিসলপ পিছোতে থাকল। এর চেয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমানায় ওয়াজিরিদের গুলি খাওয়া অনেক ভালো। সেখানে অন্তত নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা যায়।

‘হ্যাঁ। আর কিছু বলো না। আমি কিছু ভাবার চেষ্টা করছি আর তুমি অনর্গল বাজে বকে আমার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে দিচ্ছ! এখানে বসে একটু মদ্যপান করো বরং।’ স্যার রিচার্ড মদের বোতলের ট্রলিটার দিকে ইঙ্গিত করলেন। সেটা ইদানীং বারান্দাতেই থাকে।

হিসলপ ভয়ে ভয়ে একটা বেতের চেয়ারের ওপর বসে পড়ল। স্যার রিচার্ড পায়চারি করতে থাকলেন। রাগে তাঁর রগদুটো দপদপ করছে আর সাদা জুলপিদুটো তিরতির করে নড়ছে। ‘এই লোকটা ব্রিটিশ সরকার তথা আমাদের সম্রাটকে অপমান করেছে। আমি তাঁর প্রতিনিধি। তাই আমিও অপমানিত।’

‘আপনি নিজেকে বড্ড বেশি দোষ দিচ্ছেন, স্যার।’

‘চোপরাও!’ তাঁর লাল গালদুটো আরও লাল। মনে হচ্ছিল, যেন ফেটে পড়বে, ‘তোমার বক্তব্য আমি জানতে চাইনি।’

হিসলপ মুখ কালো করে চুপ করে গেল।

‘লোকটা আমাকে অপমান করেছে। এখান থেকে বেতিয়া অব্দি প্রত্যেকটি নীল হান্টার সাহেবদের সামনে হাস্যকর প্রতিপন্ন করেছে।’ রেসিডেন্টের মাথায় আগুন জ্বলছে, ‘আমাদের গোটা পরিবারের জন্য এটা কলঙ্কের ব্যাপার, আমার ভাই ডেভিড, সে পশুপাখির ছবি এঁকে কাল কাটায়, তাকেও এমন অপদস্থ হতে হয়নি।’

রিচার্ড হিসলপের মুখোমুখি দাঁড়ালেন, ‘এই আধা ন্যাংটা লোকটা সবাইকে খেপিয়ে তুলছে আর চাইছে স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতা কেড়ে নিতে। ব্রিটিশ সম্রাটের প্রতিনিধির সামনে দাঁড়িয়ে ও সোজাসুজি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে ওর নিয়ম বহির্ভূত কাজকর্মের বিচার করতে! আবার নাকি নীলচাষের বিরুদ্ধে কমিটিগুলোতে নেতাগিরি করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এই অন্যায়ের শেষ হওয়া উচিত।’

হিসলপ কী একটা বলবে বলে মুখ খুলেছিল, আবার বন্ধ করে দিল।

‘চারিদিকে অরাজকতা বেড়েই চলেছে।’ স্যার রিচার্ড বলে চললেন, ‘নেটিভ উকিলরা আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সভায় আজকাল বক্তব্য রাখছে। হতভাগারা ভুলে গেছে যে বড় বড় পদে তাদের আমরাই নিযুক্ত করেছি। কারণ তারা একসময় ইংরেজদের অনুগত ছিল। আমরা এতদিন নেটিভদের অনেক বিপ্লব দেখেছি। কিন্তু সে সব ছিল ক্ষণস্থায়ী। এই তো আগুন জ্বালিয়ে তার মধ্যে ল্যাঙ্কাশায়ার থেকে আনা সুতির কাপড় সব ফেলে দিয়েছিল বিপ্লবীরা। তারপর সেই বাঙালি উগ্রপন্থী অরবিন্দ তো আমাদের ওপর বোমা ছুড়ে মেরেছিল, কিন্তু তাতে আমাদের খুব একটা ক্ষতি হয়নি। এই গঙ্গা দত্ত কিন্তু একেবারে আলাদা ধরনের লোক। ডেঞ্জারাস!’

‘কেন স্যার?’

‘এ লোকটা আইনকে কাঁচকলা দেখায়। আইনের মারপ্যাঁচ সব জানে। নিজের প্রয়োজনে কৌশলে তা ব্যবহার করে। সে আইন অমান্য করে, বিবেক আর সত্যের দোহাই দিয়ে। এখানকার মানুষ ওকে স্বাভাবিকভাবেই ভয়-ভক্তি করে। স্যুট পরা সাহেবদের সঙ্গে এই নেটিভদের কোনও মিল আছে কি? মোতিহারিতে সব জাতের মানুষ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছে। অছ্যুৎ, মুসলমান, বণিক সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তার সঙ্গে আন্দোলন করেছে। আর সে একটা নেংটি পরে ওদের উপচে পড়া শ্রদ্ধা ভালোবাসায় ডগমগ করছে।’

হিসলপ চুপ করে গেছে।

‘প্ল্যান্টার্স ক্লাব-এর প্রেসিডেন্ট যখন গঙ্গার স্বল্প পোশাক নিয়ে মন্তব্য করেন তখন সে কী বলে জানো?’ স্যার রিচার্ড একটা খবরের কাগজের টুকরো পকেট থেকে বার করলেন, ‘আমি ভারতীয় পোশাক পরি। এখানকার আবহাওয়ার জন্য এটাই উপযুক্ত। এই পোশাক এতই কমদামি এবং সরল যে এর তুলনা আপনি বিশ্বের কোথাও পাবেন না। ইউরোপীয়রা ভ্রান্ত গর্ব এবং বিলাসিতার বশবর্তী বলে এই পোশাকের কদর বোঝে না। এখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে, স্বাস্থ্য এবং পরিচ্ছন্নতার খাতিরে ব্রিটিশদের-ও এই পোশাক পরা উচিত। বুঝলে হিসলপ, গঙ্গা মনে করে ভাইসরয়েরও এই নেংটি পরা উচিত!…এ-একী! তুমি কী শব্দ করছ?’

দিল্লি দরবারে লর্ড চেলমস ফোর্ড-এর নেংটি পরা চেহারাটা মানসচক্ষে কল্পনা করে হিসলপ হাসি চাপতে পারছিল না।

‘এর একটা কঠিন বিহিত চাই। আমি ইয়ার্কি করছি না।’ স্যার রিচার্ড বললেন।

‘কী করে স্যার?’

‘আমিও সেটাই ভাবছি হিসলপ। আমরা অনেকগুলো ভুল আগেই করে ফেলেছি। তুমি পার্টিশন অফ বেঙ্গল-এর কথাটাই ধরো না। আমরা প্রভিন্সটাকে নিজেদের প্রশাসনিক সুবিধের জন্য বিভাজন করলাম আর এখানকার স্বদেশিওয়ালারা রে রে করে তেড়ে এসে আমাদের খুনি প্রতিপন্ন করল। তখন আমরা কী করলাম? পার্টিশনের লাইনটা ভয় পেয়ে মুছে দিলাম। এটা যে কী মারাত্মক ভুল, তা পরে বোঝা যাবে হিসলপ! যেদিন তুমি নির্দেশ ফিরিয়ে নেবে, সেদিন থেকে আর নির্দেশ দিতে পারবে না, এটাই নিয়ম। আমি আর কী করতে পারি? গঙ্গাকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য স্টেটস ডিপার্টমেন্টকে কিছু পরামর্শ দিতে পারি। সে যদি এখনও হস্তিনাপুরের কর্তাব্যক্তি হত, তার চামড়া দিয়ে কার্পেট বানিয়ে ছাড়তাম, এটুকু তোমায় বলতে পারি।’

‘হ্যাঁ, স্যার, যদি না…’

‘কী?’

‘আমরা একটা কৌশল করতে পারি, স্যার।’

‘কীরকম?’

‘গঙ্গা দত্ত যখন হস্তিনাপুরের চাবিকাঠি ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডুর হাতে তুলে দিয়ে আশ্রমে চলে গেলেন, তখন আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সেটা জানিয়ে করেননি। তিনি বোধহয় তাঁর তরুণ দুই পুত্রবতের বিয়ের ব্যবস্থা করতে গিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে ভুলে যান।’

‘ভুলে? মানে?’

‘এমনিতে এটা বড় কিছু নয়। অন্যান্য রাজ্যগুলি কি আর আমাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের শর্তগুলিকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে? আমাদের মতো ভারতীয়দের এখনও অতটা ঠিক-ভুলের জ্ঞান তৈরি হয়নি।’

 স্যার রিচার্ড সন্দেহের চোখে হিসলপের দিকে তাকালেন, ‘হস্তিনাপুরের দরবারে কি কোনও ইংরেজ সচিব নেই? এসব কাজ তো তারই দেখার কথা!’

‘হ্যাঁ, মরিস ফর্স্টার বলে ভদ্রলোকটি কেমব্রিজ থেকে হস্তিনাপুরে এসেছেন বটে তবে তিনি তাঁর দপ্তর সামলাবার চেয়ে ছোট ছেলেদের পড়াতেই বেশি ভালোবাসেন। কাজে তাঁর উৎসাহ কোথায়? ভারতবর্ষকে ভালো করে বোঝার ইচ্ছাও নেই। সে মনে করে এটা ইন্দ্রজাল আর রহস্যের দেশ। নিজের কাজ সহজে শেষ করতে পারে না, বারেবারে ঠেলা ধাক্কা দিতে হয়। গঙ্গাজি যদি আমাদের জানাতে ভুলে গিয়ে থাকেন, ফর্স্টারের ও ব্যাপারটা মাথায় আসেনি।’

‘হুম।’ স্যার রিচার্ড-এর মুখটা উজ্জ্বল দেখাল, ‘তাহলে আমরা গঙ্গাকে কি শাস্তি দিতে পারি?’

‘নোটিশ না দেওয়ার অর্থ, আমাদের চোখে গঙ্গা এখনও হস্তিনাপুরের কার্যনির্বাহী রক্ষক। আপনাকে বোঝাতে পারলাম স্যার?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। বলে যাও—।’

‘তিনি হস্তিনাপুরের রক্ষক হিসেবে—’

‘বুঝেছি। একটা রাজ্যের মাথা হয়েও সে দেশদ্রোহী কাজকর্ম করছে। আমি দারুণ খুশি, হিসলপ।’

‘কিন্তু একটা কথা আছে স্যার।’

‘আর বাগড়া দিও না প্লিজ।’

‘স্যার, গঙ্গা মোতিহারিতে যা করেছে, সেটা কিন্তু কোনও অন্যায় নয়। তার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। স্বয়ং লেফটেন্যান্ট গভর্নর সেই নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর তারপর তাঁকে মোতিহারির চাষিদের দুঃখ কষ্টের ব্যাপারে অনুসন্ধান করবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। দিল্লি যখন তাঁকে দেশদ্রোহী মনে করে না, আমরা কী করব?’

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও।’ স্যার রিচার্ড গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ইন্ডিগো ব্যবসায় ইদানীং তেমন লাভ নেই বলেই তোমাদের ওই দেশপ্রেমী ফকিরটি তার কারসাজি দেখাতে পেরেছে। এদেশের বাবুরা তাকে মাথায় তুলে নাচছে। এটা বুঝছে না যে নীল আইন এমনিতেই উঠে যেতে বসেছিল। এটা তো ঘটনা নয় যে দিল্লিতে সবাই লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্কট-এর মতো নেটিভদের পছন্দ করে। ভুলো না আমাদের একজন ভাইসরয় আছেন। যিনি পায়ের জুতো মাথায় তোলেন না। পল স্কট তাঁর নিজের কাজ করুন। আমাদের প্রিন্সলি সেট-এর ব্যাপারে মাথা ঘামাতে হবে না।’

‘হ্যাঁ স্যার। কিন্তু আমাদের খুব একটা কিছু করার আছে কি?’ হিসলপ ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আমরা তো আর গঙ্গার বহিষ্কার চাইতে পারব না। তিনি তো নিজেই রাজ্যভার থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন।’

‘বহিষ্কার কে চাইছে?’

‘আ…আমার মনে হল…আপনি বলছিলেন যে তিনি যদি হস্তিনাপুরের…’

‘আমি ওর চামড়া দিয়ে কার্পেট বানাতে চাই হিসলপ, তোমায় আগেই বলেছি। আমি কি বোকা যে ওর বহিষ্কার চেয়ে লোক হাসাব? এমন শিক্ষা ওকে দেব আমি যে গোটা দেশ মনে রাখবে সেটা!’

‘কী করবেন স্যার?’

‘হস্তিনাপুরের স্বাধীনতার দিন শেষ। আমি ওই রাজ্যকে সোজাসুজি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে নিয়ে আসব।’

১৪

‘আমি একশোটি সন্তান চাই কিনা বলতে পারব না। কিন্তু তুমি ছ’টি সুস্থ সবল ছেলে আমায় দিলেই আমি খুশি থাকব।’ ধৃতরাষ্ট্র তাঁর সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীকে বলেন।

তাঁরা তাঁদের শোওয়ার ঘরের মাঝখানে বিশাল দোলনায় দুলছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র লম্বা হয়ে শুয়েছিলেন, শরীরের ওপরের কিছুটা অংশ পাশবালিশের ওপর আর কিছুটা গান্ধারীর কোলে। নতুন যুবরানি কিন্তু গম্ভীর হয়েই থাকলেন। যদিও তাঁর আঙুলগুলি আনমনে ধৃতরাষ্ট্রের পাতলা চুলগুলি নিয়ে খেলে চলছিল। গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। সিল্কের কাপড়ে তাঁর চোখ বাঁধা।

‘তোমাকে আমি যে পুত্র সন্তান দেব, সে হবে এক নির্ভীক দলনেতা। তার দূরদৃষ্টির সাহায্যেই আমরা দুজন পৃথিবী দেখব।’

হাত বাড়িয়ে ধৃতরাষ্ট্র একবার গান্ধারীর চোখে বাঁধা সিল্কের কাপড়টা ছুঁয়ে গেলেন, ‘কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ গান্ধারী?’

‘আমি আগেই তোমাকে বলেছি যে তোমার পৃথিবী আমি তোমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। তুমি যা দেখতে পাও না, তা দেখবার অধিকার আমারও নেই। স্ত্রীর অধিকার কখনওই স্বামীর চেয়ে বেশি হতে পারে না।’

হালকা একটা গোলাপ আতরের সৌরভ ধৃতরাষ্ট্রের নাকে গিয়ে লাগল। এই গন্ধটা নাকে পৌঁছোলেই তিনি বুঝতে পারেন যে গান্ধারী তাঁর আশেপাশে আছেন। স্ত্রীর পায়ের নূপুরের নিক্বণ কানে গেলেই তিনি উৎকর্ণ হয়ে ওঠেন।

‘না গান্ধারী! কত বার তোমাকে বলেছি যে তোমার চোখদুটো আমাকে বাঁচতে সাহায্য করবে?’

তিনি তাঁর স্ত্রীর এই ভয়ানক প্রতিজ্ঞার প্রতি শ্রদ্ধাবনত। ওইটুকু মেয়ে বিবাহের সারমর্ম কত নিবিড়ভাবে বুঝেছে! স্বেচ্ছায় অন্ধত্ব মেনে নেওয়া কী সাংঘাতিক এক ব্রত! গল্পগাথায় সতীসাবিত্রীর কথা শোনা যায়। কিন্তু সে-ও যেন গান্ধারীর তুলনায় ফ্যাকাসে। না, প্রেমের জন্য সে এই কঠিন ব্রত নেয়নি। সে তো ধৃতরাষ্ট্রকে চিনতই না বিয়ের আগে। স্বামীর গৌরবের প্রতি আকৃষ্ট হয়েও না। কারণ ধৃতরাষ্ট্রের পরিণত হতে তখনও অনেক দেরি।

কোনও এক গোপন সূত্র ছিল মেয়েটির এই চারিত্রিক দৃঢ়তার। হাসিমুখে কী করে মেয়েটি সূর্যের কিরণ, ফুলের হাসি, রাঙা গুলমোহরের আগুন আর বর্ষার ধেয়ে আসা আঁধারকালো মেঘ—ত্যাগ করল? মেয়েটি শাড়ির গায়ে হাত দিয়েই খুশি। দেখতে চায় না তার রং বা জেল্লা, শব্দ শুনেই সে বুঝে নিতে চেষ্টা করত আকারপ্রকার। মানুষের চেহারার চেয়ে তার গলার স্বর আর কথা শুনেই সে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। গান্ধারী এক অসাধারণ নারীর নাম।

‘আমি তোমার জীবনে নিছক প্রয়োজন হয়ে থাকতে চাই না। প্রয়োজনের জন্য তুমি সচিব, সহায়ক, লেখক, কথক, রাঁধুনি, চাকরবাকর এবং লাস্যময়ী সঙ্গিনীদের ভাড়া করে নাও। তুমি তো প্রয়োজন মতো সেটা করেছ এর আগে।’ কথাগুলো যাতে খুব কঠিন না মনে হয়, তার জন্য গান্ধারী স্বামীর চুলে বিলি কেটে চললেন, ‘ধর্মপত্নী হিসেবে আমি তোমার জীবনকে ভাগ করে নেব। তোমার দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ, জয়-পরাজয়—সব কিছু। তোমার পাশে থাকব, তোমার সন্তানের মা হব।’ তার পরেই কঠিন শোনাল তার গলার স্বর, ‘তোমায় আমি একশোটি পুত্র উপহার দেব।’

ধৃতরাষ্ট্র এইজাতের কোনও মহিলাকে ইংল্যান্ডে দেখেননি। বললেন, ‘একশো সন্তান খুবই ক্লান্তিকর ব্যাপার হবে!’

গান্ধারী হাসলেন না। এইসব ব্যাপারে তিনি লঘু হতে চান না। ‘কে জানে? জ্যোতিষী তো তাই বলেছেন। তবে অনেক সময় লাগবে একশো সন্তান প্রসব করতে।’

‘তা তো বটেই।’ ধৃতরাষ্ট্রের পাশ্চাত্য শিক্ষা তাকে সহজে কোনও কিছু বিশ্বাস করা থেকে বিরত রাখে। গ্রহ-নক্ষত্র গণনার ওপর তার খুব একটা ভরসা ছিল না। হাত বাড়িয়ে সে গান্ধারীকে ছুঁতে চেষ্টা করল। এবারে তার হাত আর শাড়ির ভাঁজে পড়ল না। স্ত্রীর শরীরের ছোঁয়া লাগতেই সে উজ্জীবিত হয়ে উঠল।

‘আমরা আর অপেক্ষা করছি কেন?’

তার আঙুলের ছোঁয়ায় গান্ধারীর রোমাঞ্চ জাগল। সেও হেসে উঠল। দোলনাটাও প্রবলবেগে দুলে উঠল তাদের ভালোবাসার তালে তাল রেখে। দুই নারী পুরুষের মিলনের ছায়া পড়ল দেওয়ালে। তারা তা দেখতে পেল না।

১৫

ভদ্র হয়ে বোসো গণপতি। আমি এত কিছু কী করে জানি সেটা নিয়ে প্রশ্ন করছ কেন? সব কি তোমায় বলতে হবে? আমি এমন অনেক কিছুই জানি, যা লোকে জানে না। এটা তুমি জেনে রাখো।

দুই বউ নিয়ে পাণ্ডুর দিন খুব তৃপ্তিতে কাটছিল। কুন্তি তার পূর্ব কলঙ্ক সত্বেও অত্যন্ত মনোগ্রাহী বিবেচিত হল। বিশাল-বক্ষ মাদ্রী শারীরিক পরিমাপে অসঙ্গতি সত্বেও পাণ্ডুকে সম্ভোগসুখে তৃপ্ত করছিল। পাণ্ডু শরীর সর্বস্ব ছিল। আর দুই বউ থাকার সবরকম আনন্দে সে আপ্লুত ছিল। সর্বদা সে সতর্ক থাকত, যাতে বউরা সন্তানসম্ভবা হয়ে না পড়ে।

কিন্তু এ সুখ বেশিদিন টেকে না। এটাই তো জীবনের নিয়ম, গণপতি! ঠিক যখন তোমার মনে হচ্ছে যে জীবনটা ব্যাটে বলে চৌকো-ছক্কা মেরে মেরে এগিয়ে চলেছে, তখনই কোথা থেকে কে এসে তোমায় বোল্ড আউট করে দেবে তার ঠিক নেই। আমরা হিন্দুরা কর্মফল ব্যাপারটা এত ভালো বুঝি যে জীবনে ওঠা-পড়া খুব সহজে মেনে নিই। আমরা দার্শনিকের মতো ওপরে বসে থাকা সেই আম্পায়ারের অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনের উদ্দেশ্যে নিজেদের উৎসর্গ করি।

তুমি কি ভাবতে পেরেছিলে, আমি ক্রিকেট সম্বন্ধে এত কিছু জানি? আরে আমি যে কত কিছু জানি তার আন্দাজ তুমি পাবে কী করে! রাজপ্রাসাদ থেকে কুঁড়েঘর—সব জায়গাতেই আমার অবাধ যাতায়াত। এই মুহূর্তে আমি গরুর গাড়িতে তো পরমুহূর্তে আমি বিমানে, এই আমি বেদ-উপনিষদ পড়ছি তো পরমুহূর্তে ক্রিকেট-এর রেকর্ড আওড়াচ্ছি।

আমায় ভুল বকা থেকে আটকে রেখো। নয়তো গল্প কখনওই শেষ হবে না। বিধির লিখন খণ্ডাবে কে? একদিন পাণ্ডু তার দুই রানিকে নিয়ে বিছানায় উন্মত্ত অবস্থায় ছিলেন। তারা দুজন স্বামীর সম্ভোগের সুখ বাড়াবার জন্য একেবারে নতুন কিছু উপায় বের করেছিল সেদিন। হঠাৎ একটা ভীষণ ব্যথা তার বুক থেকে হাতের ওপর অবধি তিরের মতো ছুটে চলল। সে বিছানায় পড়ে গেল আর বহু চেষ্টা করেও মুখে কিছু বলে উঠতে পারল না। শুরুতে রানি দুজন ভেবেছিল যে তারা বোধহয় স্বামীকে খুব উত্তেজিত করে দিতে পেরেছে, কিন্তু তার শরীরের নিম্নাঙ্গের দিকে তাকাতেই ভুলটা ধরা পড়ল। তারা ভয়ে চিৎকার করে উঠল।

‘বিরাট হার্ট অ্যাটাক।’ ডাক্তার কিমিনদাসা বললেন। পাণ্ডু আরও রক্তশূন্য অবস্থায় অক্সিজেনের তাঁবুতে শুয়ে রইল। পাণ্ডু এ-যাত্রায় বেঁচে গেল রানি দুজনের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের ফলে। তারা আলুথালু বেশে বিছানার দুপাশে বসেছিল।

পাণ্ডু বেঁচে গেল সে যাত্রায়। কিন্তু সে আর তার আগের জীবনে ফিরতে পারল না। ‘আপনাকে কিন্তু শারীরিক সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখতে হবে যদি আপনি বাঁচতে চান। কারণ আপনার হার্ট-এর অবস্থা ভালো নয়।’

‘তার মানে কী?’

‘মানে মহিলা সঙ্গ করার মতো হার্টের জোর আপনার আর নেই।’

‘এ তো খারাপ খবর!’

‘খুবই খারাপ। এর পরের শারীরিক মিলন আপনার জীবন শেষ করে দেবে।’

ভাবতে পারো গণপতি? দুটি যুবতী কামাতুর মহিলাকে বিয়ে করেও ব্রহ্মচারীর জীবনযাপন করতে হবে পাণ্ডুকে! কিন্তু সে আমার, বেদব্যাসের ছেলে! তার সাজানো বাবার মতো সে অকালে মরতে চায়নি। সে কাম এবং স্ত্রীদের দিকে পিছন ফিরল।

‘এর পিছনে দৈব ইঙ্গিত আছে।’ পাণ্ডু তার দুই শোকজর্জরিত স্ত্রীদের বললেন, ‘আমার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে। আমি মুক্তির পথে হাঁটছি। সংযমই এখন আমার জীবন হবে। আমি শুধু সুকর্মের দিকে মন দেব। আমি এখন থেকে খাটে একা শোব।

১৬

সে কি দুঃখের দিন

পাণ্ডুর মৃত্যুকে করে জয়

পেয়েছিল বড় ভয়

জীবন হল সম্ভোগহীন।

ডাক্তার দিল না কোনও আশা

হয় মরা নয় বাঁচা

কিন্তু বাঁচতে হলে খাসা

মিলন হল জীবনের পাশা।

বোঝো তুমি পাণ্ডুর দশা

সে পারবে সব

শুধু বন্ধ হল তার

বিছানায় হাল চষা।

হায় কুন্তি-মাদ্রী

পাবে শুধু নাকি চুম্বন

করে তারা শুধুই ক্রন্দন।

কেন হয়েছিল পাণ্ডুর পাত্রী?

হায় সে প্রেমলীলার রাত কই

সেই হাসি কামড় আর শীৎকার

বুক চাপড়ে বলে দুই সই

এই রাতে আজ তুমি-আমি কার?

এখন শুধুই করো সুকর্ম

এই হল এখন তাদের ধর্ম

নেই হাসি নেই কোনও খেলা আর

বেঁচে থাকো এখন যে যার।

পাণ্ডু এখন শুধুই শিষ্যবৎ

জীবন এখন ধার্মিক আর সৎ

মাঝে মাঝে করে চলে যোগাসন

গুরুর হাতে জীবনের প্রশাসন।

কামচিন্তা ত্যাগ করে পাণ্ডু গেল গঙ্গার আশ্রমে। শুরুতেই অবশ্য সে সেবায়েত হয়ে থালাবাসন ধোয়া বা বাথরুম পরিষ্কারের কাজে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারল না। সে ছাত্র হয়ে গঙ্গার বক্তৃতা শুনতে শুরু করল। মাঝে মাঝে রাজপ্রাসাদে ভাইয়ের কাছে ফিরে যেত।

এটা মোতিহারি-পরবর্তী ঘটনা। সেসময়ে আশ্রমে অতিথিদের আনাগোনার অভাব ছিল না। পাণ্ডু গঙ্গাজির পায়ের কাছে বসে তাঁর বাণী শুনতেন অন্য ভক্তদের সঙ্গে।

জাত পাত নেই

ভুলে যাবে যেই

দেখবে সবাই ভাই

পাণ্ডু ধ্যান করতে শিখে গেল। তারপর নিজের হাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের ব্যাপারটাও তুলে নিল।

করো রাম ভজন

সবাই আমরা স্বজন

সেবা করো দয়া করো

গাল বাড়িয়ে এগিয়ে মরো।

খুব অল্পদিনের মধ্যেই পাণ্ডু গঙ্গার মতো নিরামিষ ভোজনে অভ্যস্ত হল। দই খেয়ে খেয়ে আরও সাদাটে চেহারা হল তার। পাণ্ডুর এই পরিবর্তন নিয়ে শুধু কবিতা লেখা যায়। গদ্য বড্ড মোটাদাগের মনে হবে। বিশেষ করে সেটা যদি ভারতীয় বিদ্যাভবন থেকে প্রকাশিত জীবনী বা স্কুলের পাঠ্যবই হয়।

ধীরে ধীরে পাণ্ডুর বক্তব্যের মধ্যে তার ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠল, তার ভাষা মার্জিত হল। তর্কে তার জুড়ি ছিল না। তা সে ধর্মই হোক আর সামাজিক বিষয়ই হোক। তার চোখেমুখে শান্ত-সৌম্যভাব ফুটে উঠল। গণপতি তোমার এসব শুনতে ভালো না লাগলেও লিখে যাও। পাণ্ডু কিছুদিনের মধ্যে শাস্ত্রজ্ঞ হয়ে উঠল। জীবনের সবক্ষেত্রে সে শাস্ত্রের আর ধর্মগ্রন্থের উল্লেখ করতে লাগল।

১৭

পাণ্ডুর গল্প এখনই শেষ করা যাবে না। সে মাঝে মাঝেই গল্পগাথা মিশিয়ে তার দুই রানিকে এমন বক্তৃতা দিত যা শুনে কামসূত্রের পাতাগুলিও লজ্জায় গুটিয়ে যেত। কখনও সে মাদ্রীকে বৃহস্পতির নষ্টামির গল্প শোনাত। লজ্জায় লাল হয়ে মাদ্রী শুনত, বৃহস্পতি কেমন করে তার সন্তানসম্ভবা শালী মমতার সঙ্গে সহবাস করতে যান এবং তার ঔরস মমতার জরায়ুতে প্রবেশ করবার সময় পেটের সন্তানের পায়ে গিয়ে আটকে যায়। কখনও আবার পাণ্ডু সেই ব্রাহ্মণ যুবকের গল্প বলত, যে হরিণের ছদ্মবেশ ধরেছিল যথেচ্ছাচার করবে বলে। কখনও সে কুন্তিকে ব্রহ্মচর্যের মহত্ব নিয়ে জ্ঞান দিত।

‘আমার কিন্তু ছেলে চাই।’ পাণ্ডু একদিন বই পড়তে-পড়তে বলল। গঙ্গাজি ছাড়াও ঠাকুমা সত্যবতী আর আমার সঙ্গেও পাণ্ডু অনেকটা সময় কাটাত। স্ত্রীকে সন্তানসম্ভবা করানোর যে বিভিন্ন উপায় আছে, পাণ্ডুর সে বিষয়ে ধারণা একেবারে পরিষ্কার ছিল।

‘আমি নিজেকে গঙ্গাজির মতোই সম্ভোগসুখ থেকে বিরত রাখতে পেরেছি। তাঁর মতো পুণ্য তো আমি করিনি যে সন্তান ছাড়াই আমার স্বর্গলাভ হবে! তিনি একটা বীজ না ছড়িয়েও হাজার হাজার সন্তান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। যারা তাঁর চিতার চারিদিকে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমার সে ভাগ্য নয়, কুন্তি। আমি পুত্রের মাধ্যমেই মোক্ষলাভ করত পারব।’

পাণ্ডুর চোখদুটো ব্যথায় ভরা। কিন্তু তার গলা অবিচল।

‘বড়দের এবং শাস্ত্রের কথা মেনেই বলছি, বারোরকম উপায়ে সন্তান আনা যায়। এর মধ্যে ছয় রকমের সন্তানের উত্তরাধিকারের অধিকার রয়েছে। এক, যে সন্তান স্বাভাবিকভাবে পেটে এসেছে। দুই, স্ত্রী যখন অন্য কোনও ধার্মিক মানুষের সঙ্গে সহবাস করেছে। তিন, যখন কাউকে ভাড়া করে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করানো হয়েছে। চার, পিতার মৃত্যুর পরে যে ছেলের জন্ম হয়েছে। পাঁচ, কুমারী মায়ের ছেলে এবং ছয়, কোনও অসতী মায়ের ছেলে।’

কুন্তি নির্বাক হয়ে শুনে যাচ্ছিল পাণ্ডুর কথাগুলো।

‘যাদের উত্তরাধিকারের অধিকার নেই, তারা হল অন্যের সন্তান। অনাথ দত্তক নেওয়া সন্তান। বিবাহের সময় যে মা সন্তানসম্ভবা থাকে সেই সন্তান। ভাই-এর ছেলে অথবা যদি স্ত্রী নিচু জাতের হয়। আমি উত্তরাধিকারী চাই। কাউকে দত্তক নিতে পারবে না। তোমাকে সন্তান প্রসব করতে হবে।’

কুন্তি ব্যাপারটা আবছা বুঝতে পারছিল। কিন্তু এসব কথা শুনতে তার মোটেই ভালো লাগছিল না।

‘আমি তোমার মধ্যে বীজ বপন করতে পারব না। তুমি ব্যাপারটা কী করে করবে আমি জানি না। কিন্তু এমন কোনও পুরুষ খুঁজে নাও যে আমার সমান বা আমার থেকেও বড় হবে সামাজিক সম্মানের নিরিখে।’

কুন্তির চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে উঠল, ‘আমায় একথা বোলো না। তোমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর থেকে আমি কোনও পুরুষের দিকে তাকাইনি। লোকে এমনিতেই আমায় নিয়ে কানাঘুষো করে। আবার তারা নানারকম কথা বলবে। দুজনে আরেকবার চেষ্টা করি না! ডাক্তাররা অনেক কথাই তো বলে।’

‘না। আমি তা পারব না। এব্যাপারে কোনও ঝুঁকি আমি নেব না। তুমি যে আমার প্রতি এত একনিষ্ঠ, তাতে আমি গর্বিত। তোমায় এটা বুঝতে হবে, একজন ভালো হিন্দু হিসেবে একটা নয়, বেশ কয়েকটা ছেলে আমার প্রয়োজন। আর সেই প্রয়োজনের খাতিরে সতীত্বের বন্ধন থেকে তোমাকে আমি মুক্তি দিলাম।’

কুন্তির অবিশ্বাস তখনও কাটেনি। সে আর পাঁচটা ভারতীয় স্ত্রীলোকের মতোই প্রাচীনপন্থী। পাণ্ডু এত বলার পরেও সে শাস্ত্রের অনুমোদনের অপেক্ষায় রইল।

পাণ্ডু পদ্মাসনে বসে আবার বোঝাতে শুরু করলেন, ‘আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলি পড়লেই বুঝতে পারবে যে একটা সময় ছিল যখন ভারতীয় নারীদের নিজেদের প্রণয়ী খুঁজে নিতে কোনও বাধা ছিল না। এর জন্য মোটেই তাদের অসতী ভাবা হত না। এ নিয়ে কিছু নিয়মকানুনও চালু ছিল। মুনি-ঋষিরা এই বিধান দিয়েছিলেন যে স্ত্রী তার উর্বর দিনগুলোতে স্বামী-সঙ্গ করবে। অন্যান্য দিনে সে তার ইচ্ছামতো সঙ্গী চয়ন করে নিতে পারে। কেরালার নায়ার সম্প্রদায়ের মানুষ দেখে নিতেন যে স্ত্রীর ঘরে বাইরে অন্য পুরুষের চটি খুলে রাখা আছে কি না। ইদানীং আমরা সেই সব সনাতন হিন্দু প্রথা ভুলতে বসেছি। মুসলমান শাসন এবং ইংরেজদের ভিকটোরিয়ান গোঁড়ামিই হল এর কারণ। আমাদের পরদা প্রথা বহুপ্রাচীন। আমরা অন্য সভ্যতার থেকে ঠিক-বেঠিকের পাঠ নেব কেন? এক পুরুষ এবং এক নারীর বিয়ে এবং আজীবন একনিষ্ঠ প্রেম, এ সব হল ইদানীংকালের সংস্কার। আমাকেই দ্যাখো না, আমার কি দুটো বউ নেই? আমি খুশিই হব, যদি তুমি অন্য পুরুষের দ্বারা পুত্রসন্তানের জননী হতে পারো। এটা জেনো যে যত তুমি নিজের সভ্যতার গভীরে অবগাহন করতে পারবে, তত উদার মনের হবে।’

এতেও কুন্তি যখন আশ্বস্ত হল না, তখন পাণ্ডু তাকে একটা গুহ্য কথা শোনাতে বসল, ‘একটা কথা বলি তোমায়, আশ্চর্য হয়ে যাবে শুনলে। এসবের পেছনেই শাস্ত্রের সম্মতি আছে। আমাদের পরিবারের এটা একটা গোপন তথ্য। আমিও জেনেছি পৌরুষপ্রাপ্তির অনেক পরে। বিচিত্রবীর্য, আমার মায়ের স্বামী আমার বা ধৃতরাষ্ট্রের বাবা নন। তাঁর সৎ ভাই, বেদব্যাসের ঔরসে আমাদের জন্ম। বিচিত্রবীর্য মারা যাবার পর এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল বংশবিলুপ্তির ভয়ে। তাহলে দেখতেই পাচ্ছ, তুমিও পরিবারের মর্যাদা রক্ষা করার জন্যেই একটি পুরুষ সঙ্গীকে বেছে নেবে। আমার কথা তুমি সবসময়ে মেনে নিয়েছ। এবার আমিই তোমাকে বলছি, একজন সৎ ব্রাহ্মণ খুঁজে নিয়ে আমায় পুত্রসন্তান এনে দাও।’

কুন্তি আর প্রতিবাদ করল না। মিনমিন করে বলল, ‘একটা কথা বলি তোমায়। আমার একটি পুত্রসন্তান আছে।’

‘কী?’ পাণ্ডু স্তম্ভিত, ‘তোমার ছেলে? কার দ্বারা? কখন? আর তুমিই এতক্ষণ সতীত্বের বড়াই করছিলে!’

‘রেগে যেয়ো না, স্বামী। এখন কথাটা উঠেছে, তাই বললাম। আমি তোমার প্রতি কোনও অন্যায় করিনি। আমার পুত্রসন্তান জন্মেছিল বিয়ে হওয়ার অনেক আগে।’

পাণ্ডুর মনে পড়ে গেল, ‘বুঝেছি। হাপেরিয়ন হেলিওস, সেই আগন্তুক। তাহলে ব্যাপারটা গুজব ছিল না।’

কুন্তি মাথা নিচু করে ফেলল।

‘সে ছেলে এখন কোথায়?’

‘আমি ঠিক জানি না।’ কুন্তিকে খুব করুণ দেখাল, ‘আমি এত লজ্জিত হয়েছিলাম, হয়তো হওয়া উচিত হয়নি, বাচ্চাটা এত সুন্দর ছিল, তার ত্বক যেন সূর্যকিরণ। আমি একটা ঝুড়িতে করে তাকে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম।’

‘নদীতে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে আর তাকে নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন নেই।’

‘কেউ কি তাকে খুঁজে পায়নি?’ কুন্তি মরিয়া হয়ে বলল, ‘সে নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। আমি তাকে দেখলেই চিনতে পারব। তার ত্বকের সেই সোনালি রং এদেশে কারুর নেই। তার জন্মের সেই দাগ! কপালের ঠিক মাঝখানে চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করত। ও নিশ্চয়ই আছে। তোমার তো ছেলে চাই। আমি তাকে খুঁজে নিয়ে আসছি। ওই জায়গার আশেপাশে গিয়ে একটু খুঁজলেই পাব।’

একটা দমকা হাওয়া কোথা থেকে এসে শুকনো পাতাগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে গেল! ছায়াগুলোও নড়ে উঠল। একটা যুগ শুধু আশায় আশায় ঘুরে দাঁড়াল। একটা থমকে যাওয়া দীর্ঘশ্বাস আবার উঠে এল কি?

‘আমি দুঃখিত! কিন্তু যে ছেলে আমাদের বিয়ের আগে জন্মেছে, সে আমার উত্তরাধিকারী হবে না। তোমাকে নতুন পুরুষ সঙ্গী খুঁজে নিতেই হবে। দেখা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে তুমি যথেষ্ট পটু।’ পাণ্ডুর কথাগুলো ছুরির ফলার মতো বেরোল।

কুন্তি মুখ খুলতে গিয়েও পারল না, ‘যা বলবে স্বামী। তুমি ছেলে পাবে।’

১৮

গণপতি, আজও সেই তুফানের রাত আমার মনে আছে। বৃষ্টি পড়ছিল অঝোরে। দৈত্যের মতো একটা বড় গাছের ডাল মড় মড় করে ভেঙে ফেলে দিচ্ছিল। কত কুঁড়েঘরের চাল উড়ে গেছিল সেদিন। বৃষ্টির জল অবাধে ঘরের মধ্যে প্লাবন সৃষ্টি করেছিল। আমি রাজপ্রাসাদে ঢুকে ভিজে ছাতাটা ধরিয়ে দিয়েছিলাম একটি নতমস্তক পরিচারককে। তারপর মহিলা মহলের দিকে এগোলাম। সিঁড়ির মাথায় ওঠামাত্র এক পরিচারিকা গান্ধারীর ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তার মুখ-চোখ দেখে কেমন ভয় লাগল।

‘কেমন আছে?’

‘এখনও প্রসব যন্ত্রণা চলছে স্যার।’

এখনও যন্ত্রণা চলছে? চব্বিশ ঘণ্টা তো পার হয়ে গেছে! আমি মানসচক্ষে দেখতে পেলাম ক্ষীণদেহী মেয়েটিকে। মাটিতে পড়ে আছে পা ছড়িয়ে, দেহ যন্ত্রণায় বেঁকে গেছে, একশো সন্তানের প্রসবের অপেক্ষায়। তার পরেই সেই লম্বা কান্নার শব্দ শুনলাম। সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া বাচ্চার কান্না কিন্তু এ তো ঠিক স্বাভাবিক কান্না নয়! কেমন যেন কামক্লিষ্ট গর্দবের মতো বিকৃত কান্না। সেই আওয়াজ শুনে বাইরে থেকে আরেকটি জন্তু ধ্বনি করে উঠল! তারপর আরও-আরও…ঘোড়া, শেয়াল, কাক পক্ষী, যে যেখানে ছিল চিৎকার জুড়ে দিল। পরিচারিকা ভয়ে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

‘ধৃতরাষ্ট্রের উত্তরাধিকারীর জন্ম হল।’

ডাক্তার ঘরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে খবরটা দিল অবশেষে। তার অবস্থা কাহিল। এত কঠিন কাজ সে এর আগে করেনি। গান্ধারীর ওপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেছে। কিন্তু সে সাহসী। তাই বেঁচে গেছে। তবে তার সন্তানধারণ করবার ক্ষমতা চিরকালের মতো শেষ হয়ে গেছে। এই বাচ্চাটি-ই তার একমাত্র সন্তান।

‘ছেলে তো?’ ধৃতরাষ্ট্রের চোখেমুখে প্রতীক্ষার অধৈর্য ছাপ ফুটে উঠেছে। ধাইরা বলেছিল, তারা ইঙ্গিত পেয়েছে যে গান্ধারীর ছেলে হবেই। অষ্টম মাসে পোয়াতি গান্ধারীর বুক আর নবম মাসে তার বাচ্চাসমেত পেটের গড়ন দেখে বলেছিল।

‘ছেলে কেমন আছে?’

‘মেয়ে। খুব ভালো আছে।’

ধৃতরাষ্ট্রের হাত থেকে ছড়িটা পড়ে গেল শব্দ করে। পরিচারক সেটা তুলে নিল। ধৃতরাষ্ট্র দেওয়ালের দিকে ঠেসান দিয়ে বসল।

আমি গান্ধারীর আঁতুড়ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিলাম, ‘আমার শুভেচ্ছা রইল, গান্ধারী।’

‘মেয়ে হয়েছে আমার!’ গান্ধারীর মাথা বালিশে গুঁজে আছে, মুখ-শরীর ঘামে ভেজা। নিজের সন্তানকে দেখতে চোখের পটি খোলেনি। ওকে খুব পাংশু দেখাচ্ছিল। যেন সব রক্ত বেরিয়ে গেছে শরীর থেকে।

‘তাতঃ! শেষে আমার মেয়ে জন্মাল? আপনি আশীর্বাদ করেছিলেন, আমি একশো ছেলের জন্ম দেব!’

আমি তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। সমবেদনা, তারিফ, স্নেহ আর করুণা সব উথলে উঠল এই সাহসী মেয়েটির জন্যে। কী কষ্ট, কী লড়াই-ই না করেছে সারারাত। আর এখন লজ্জায় মুখ গুঁজে শুয়ে আছে স্বামীকে ছেলে উপহার দিতে পারেনি বলে। ইতিহাস! গণপতি, ইতিহাস এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের জায়গা।

‘তোমার এই কন্যা, হাজার পুত্রের চেয়েও বেশি গৌরবের অধিকারিণী হবে গান্ধারী! আমি তোমায় কথা দিলাম।’

আমি তার বন্ধ চোখের ভাষা পড়তে পারিনি। সে আমায় বিশ্বাস করেনি। সে জানত না তার মেয়ের ললাট লিখন। গান্ধারী তার জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেনি যে তার মেয়ে প্রিয়া দুর্যোধনী একদিন গোটা ভারতবর্ষের নেত্রী হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *