ত্রয়োদশ অধ্যায়। ভারত দর্শন

ত্রয়োদশ অধ্যায়। ভারত দর্শন

৭৮

দ্রৌপদীর সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডব বেড়ে উঠে পৃথিবীতে পা রাখল। তারা তাদের বাবা এবং শিক্ষকের মতেই রাজনীতিতে প্রবেশ করল।

দ্রোণ রাজনীতিতে সাফল্য পায়নি। সে বড্ড বেশি একরোখা। কয়েকদিনের মধ্যে সে পদত্যাগ করল এই বলে যে সে গ্রামোন্নয়নের কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তার ছেলে এবং পঞ্চপাণ্ডবরাও তার সঙ্গে গ্রামে যেতে প্রস্তুত হল। দ্রোণ রাজি হল না। বলল, ‘আমি এটা চাই না। অশ্বত্থামার ব্যাপারটা আলাদা। সে আমার ছেলে। তোমরা হস্তিনাপুরের রাজকুমার। তোমরা কেন গ্রামোন্নয়নের কাজে জড়িয়ে পড়বে? অশ্বত্থামা আর আমি গ্রামে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছি। তোমাদের সে অভ্যেস নেই।’

‘আমরা ভেবেছিলাম আপনি আমাদের সকলকে এক চোখে দেখেন।’ নকুল বলল।

‘তোমরা সবাই এক। কিন্তু গ্রামে থাকা সহজ নয়।’

‘আমরা পারব গুরুদেব। আপনি আমাদের সুযোগ দিন।’ যুধিষ্ঠির বলল।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ দ্রোণ রাগ-রাগ ভাব দেখালেও, মনে মনে ভীষণ খুশি।

পাঁচ ভাই কুন্তির কাছে বিদায় নিতে গেল। দেখল মা বসার ঘরে বসে তুর্কি থেকে আনানো সিগারেট খাচ্ছে। কুন্তির আভিজাত্য ফুটে বেরোচ্ছিল তার বেনারসী শাড়ি, কপালের ক’গাছি সাদা চুল, রং করা হাতের নখ, ব্যাঙ্গালোর থেকে আনা চটি এবং বেরেলির চুড়ি থেকে। শুধু ঘনঘন সিগারেট টানার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে, সে চাপে আছে।

‘তোমাদের দেখে ভালো লাগছে।’ কুন্তি বলে উঠল। যুধিষ্ঠির কিছু বলার আগেই সে আবার বলল, ‘তোমাদের মনে ছিল, আজ আমার জন্ম দিন?’

‘কিন্তু সে তো পরের মাসে, মা!’

‘তাহলে নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে গল্প করতে এসেছ নাকি পাশা বা তাস খেলতে? স্ক্রাবেল, মনোবালি, সলিটেয়ার, কী খেলবে?’

‘না, মা।’ যুধিষ্ঠির বলল।

‘না মানে? তাহলে কি তোমরা ওই পাগলাটে দ্রোণের সঙ্গে গ্রামোন্নয়ন করতে চললে নাকি?’ কুন্তি আবার ক’টা সুখটান দিয়ে নিল, ‘আমি রাজি হচ্ছি না।’

‘আপনি তো জানতেন মা!’ যুধিষ্ঠির বোঝাবার চেষ্টা করল।

‘কখনও নয়। সারাটা জীবন আমি কাটিয়েছি তোমাদের মুখের দিকে চেয়ে। এখন তোমাদের স্বার্থপর বাবার মতো তোমরাও আমায় একা ফেলে রেখে চলে যাবে?’

‘মা, আমরা কখনও অবাধ্য হইনি। আপনি বারণ করলে আমরা যাব না।’ যুধিষ্ঠির নরম সুরে বলল।

‘বারণ করব?’ বলে কুন্তি নিজের চোখের জল লুকোল, ‘তারপর তোমরা দামড়া ছেলেরা ঘুরবে, ফিরবে আর আমায় দুষবে। যাও যেখানে ইচ্ছে।’

‘মা, আপনি ঠিক থাকতে পারবেন তো?’ ভীম জিগ্যেস করল।

‘ঠিক আছে।’ কুন্তি হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছল, ‘তোমরা কি এতদিন আমাকে সঙ্গ দিয়েছ? তোমরা থাকা না থাকা, দুই-ই সমান!’

‘মা, আমরা কথা দিচ্ছি, কখনও আপনার কথা অমান্য করব না। আপনি ডাকলেই ফিরে আসব,’ যুধিষ্ঠির বলল।

কুন্তি উদ্ভাসিত।

‘মা, আমাদের আশীর্বাদ দিন।’

‘ঠিক আছে বাবারা।’ বলতে বলতে কুন্তী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, ‘যাও। আমাকে এ অবস্থায় তোমরা দেখো, আমি চাই না।’

পাঁচ ভাই একে একে বেরিয়ে গেলে সূর্যের দিকে কান্না ভেজা চোখে কুন্তি তাকাল।

‘হে ভগবান, যাকেই আমি আঁকড়ে ধরি সেই আমায় ছেড়ে চলে যায়!’

এটা কুন্তির কল্পনাও হতে পারে।

৭৯

‘আরে কণিকা যে? এত পা টিপে টিপে হাঁটো যে বুঝতেই পারি না।’

‘হ্যাঁ প্রধানমন্ত্রী! আমি আমার চটি বাইরে রেখে এসেছি। ইংল্যান্ডে জুতো পরে পরে পায়ে কড়া পড়ে গেছে। বাড়ি ফিরে পা-দুটোকে স্বাধীনতা দিতে চাই।’

আগন্তুক কাছে আসতেই ধৃতরাষ্ট্র তার আফটার শেভ আর দক্ষিণী খাবারের গন্ধ পেল।

‘কেমন আছেন, প্রধানমন্ত্রী?’ ভি. কণিকা মেনন শ্বাস নিল, তারপর ধৃতরাষ্ট্রকে জড়িয়ে ধরল।

মেনন ছিল ধৃতরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

‘সমুদ্রপারের সব খবর ভালো তো?

‘ভালো আর কী? যত রাজ্যের বুড়ো শালিখদের নিয়ে এক্সটারনাল এফেয়ার্স মন্ত্রক কাজ করে যে কী বলব! তুমি কোত্থেকে এই সব রোবটগুলোকে জোগাড় করো? এরা ইংরেজদের থেকে ভালো ইংরেজি বলে আর তিন পিস স্যুট পরে। কিন্তু কাজের কথা বললেই কোথায় পালাবে বুঝে পায় না।’

ধৃতরাষ্ট্র হেসে উঠল, ‘আমাদের সম্পর্কে রাশিয়ার ধারণা তুমি খারাপ করে দিচ্ছ যে!’

‘আমি?’ মেনন দম নিল, ‘আমার কোনও রাশিয়ান বন্ধু নেই, কিছু চেনা লোক অবশ্য আছে। মন্ত্রকের সব খবর তারা রাখে। আমাকে মাঝে মাঝেই শোনাতে চেষ্টা করে সেসব গুহ্য কথা।’

‘ওহ কণিকা।’ প্রধানমন্ত্রী হেসে উঠল, ‘তোমাকে ছাড়া দিল্লিতে আমি কী করে যে কাল কাটাচ্ছি! ভাগ্যিস তুমি ছুটি নিয়ে এসেছ! তুমি আমার ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন।’

‘কী হয়েছে? সমস্যা কিছু?’

‘হ্যাঁ। তবে তেমন বড় কিছু নয়। আমাদের কৌরব পার্টির লোকজন মনে করছে যে একটা সমস্যা হয়েছে।’

‘তুমি ধাঁধা তৈরি করছ। পরিষ্কার করে বলো। আমি সবটা জানি না।’

‘তুমি বোধহয় জয়প্রকাশ দ্রোণকে চেনো না।’ ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘সে কি সেই ঋষিতুল্য উগ্রপন্থী, তাই না? তার কথা শুনেছি মাত্র।’

‘তার সম্বন্ধে বাইরে কি ভালো কথা শোনো?’

‘হ্যাঁ। দেশভক্ত, নীতিবান মানুষ, সামনে থেকে লড়াই করেছে ক্যুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট-এর সময়…আমি তার কথা একজন আমেরিকান সামরিক প্রধান-এর কাছ থেকে শুনেছি।’

‘বাঃ বাঃ! আমেরিকানরাও ক্যুইট ইন্ডিয়ার কথা জানে?’

‘নিশ্চয়ই! তারা গঙ্গাজির এই স্লোগানটাকে আমেরিকান ধাঁচের মনে করেছিল। ‘ক্যুইট’ নাকি মার্কিনি ভাষা।’

ধৃতরাষ্ট্র হা হা করে হেসে উঠল। তারপর বলল, ‘দ্রোণ হঠাৎ মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করে পাণ্ডুর পাঁচ ছেলে আর নিজের ছেলে অশ্বত্থামাকে নিয়ে গ্রাম সেবার কাজ করতে গেছে।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এরকম কী একটা শুনেছিলাম।’ কণিকা জবাব দিল, ‘খবরটা আমি দেরিতে পেয়েছিলাম। ইংল্যান্ডের কাগজে এটা বেরোয়নি আর ভারতের কাগজ পাঁচসপ্তাহ পরে আমার কাছে পৌঁছোয়। কিন্তু দ্রোণ এটা করল কেন?’

‘সে নাকি গ্রামোন্নয়ন করবে। তুমি ঠিকই বলেছ, ভারতের কাগজেও খুব বেশি লেখেনি। কারণ শহর আর উঁচু শ্রেণির মানুষের খবর ছাড়া, খবরের কাগজগুলো বেশি কিছু লেখে না। দ্রোণ এ দুটোর মধ্যে পড়ে না।’

‘দাঁড়াও না! গ্রামে গিয়ে জুটমিল মালিকদের বিরদ্ধে একটা-দুটো স্লোগান দিক, ঠিক খবরের কাগজে বেরিয়ে যাবে। আরে দেশের অর্ধেক খবরের কাগজ তো জুটমিল মালিকরা চালায়! মনে নেই গঙ্গাজির অহিংস আন্দোলন কীভাবে শুরু হল? সেই যে তিনি প্রেসের মনোযোগ পেলেন, তারপর সারাজীবন তারা হাঁ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকল। যাক গে, দ্রোণের কথা বলো।’

‘দ্রোণ এর মধ্যেই গ্রামে গ্রামে মানুষকে জাগিয়ে তুলেছে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলে। চাষিদের বুঝিয়েছে, জমির মালিক তাদের বঞ্চনা করছে। জমি সংস্কার আইন চাই। পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনের জালিয়াতি ধরে ফেলে আন্দোলন চালাচ্ছে দ্রোণ এবং তার ছোটসেবক দল।’

‘তুমি কি চিন্তিত?’

‘না। আমি আহ্লাদিত। এই সবই ছিল কৌরব পার্টির মূলমন্ত্র। সমাজ সংস্কার এবং সমাজতন্ত্র নিয়েই তো আমাদের কাজ। সারাজীবন তো এই নিয়েই লিখে চলেছি।’

‘তাহলে সমস্যা কোথায়?’

‘আমার পার্টির লোকেরা মনে করছে যে দ্রোণ খুব জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছে। তারা চায় আমি ওকে নিয়ন্ত্রণে রাখি। এমন কিছু করি যাতে তারা সমস্যায় পড়ে। তোমার পরামর্শ চাই, কণিকা।’

‘প্রধানমন্ত্রী, আমি এই ব্যাপারে বেশ পুরোনোপন্থী। তুমি অর্থশাস্ত্র পড়ে নাও। ম্যাকিয়াভেলি তো এখান থেকেই টুকে অত বড় মনীষী হল রে বাবা। অথবা তুমি বেদ ব্যাসের শান্তিপর্বও পড়ে নিতে পারো। দুটোই কয়েক শতক ধরে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে।

‘রাজা হওয়া কি অতই সোজা?

শাসন করতে যত প্রজা;

জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তুমি,

চুমবে তোমার নিজভূমি।

রাজার ওপর কেউ তো নেই,

এ কথা তুমি ভুলবে যেই,

পাবে দণ্ড ছাড়ান নেই;

রাজায় শুরু, শেষও সেই।

রাজাকে হতে হবে পরাক্রমী—

বাঘের মতো সে যে ব্যতিক্রমী—

সব দুর্বলতা লুকিয়ে রেখে;

ভয় পাবে না মাথা ঢেকে।

গভীরে সে আঁটে ফন্দি,

মাথার মধ্যে রয় তা বন্দি,

চালাক রাজা চুপ করে রয়;

অন্যে জানে রহস্যময়।

ভণিতা! গোপন! অনুসন্ধান! সন্দেহ!

এর ওপরে রয়েছে রাজার দেহ,

বাইরে থেকে হাস্যময়;

আসল রাজা কখনো নয়।

রাজা সদা চুপ করে রয়,

তার মন কেউ জানতে না পায়,

সঙ্গে তার অস্ত্র যে রয়;

লুকিয়ে বটে দৃশ্যত নয়।

আদেশ দেওয়া রাজার সাজে,

পূর্ণ হোক তা সকল কাজে,

রাজা হয় সদাই খাঁটি;

সন্দেহের মাথায় লাঠি।

ছোট্ট কাঁটাও বড় হয়

শত্রু কখনো সুবিধের নয়

সরিয়ে তাকে মুক্ত হও

সব বাধা নিপাত যাও

সামনে অরি দেখে রাজা

হুমকির শুধু বাজনা বাজা

এই ভুল কভু করে কি কেউ

শত্রু মেরে মারো ফেউ

অতর্কিতে হামলা করে

শত্রুর সব বিনাশ সেরে

হাসবে শেষে নিশ্চিন্তি

দেশে ফিরে আসুক শান্তি

উলটো বোঝাও, রেগে হাসো

স্বল্প বলা ভালোবাসো

তারপর কেঁদে ভাসিয়ে দাও

শত্রু নাশে দুঃখ পাও

যত পারো ধন করো সঞ্চয়

টাকা, মোহর, সোনা নয়ছয়

ধনী-ই পারে রাজা হতে

বৈভবেতেই কেল্লা ফতে

লাঠি তোমায় ধরতে হবে

শক্ত হাতে বজ্র ভাবে

তোমার দূত ছড়িয়ে দাও

চারিদিকের খবর নাও

ধীবর যেমন মাছকে ধরে

ছাড়িয়ে কেটে শেষ করে

তুমিও তেমন বিনাশ করো

শত্রুকে আগে মেরেই মরো।

ভবিষ্যতের পানে চাও

ভয় কি কোনও আছে কোথাও?

নিজের মনকে শক্ত করো

আঘাত পানে ঢালটা ধরো।

ধৃতরাষ্ট্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আমি জানি কণিকা, তুমি আমার ভালো চাও। কিন্তু এটা আমি করতে পারব না।’

‘তুমি আমার পরামর্শ চেয়েছিলে। এটাই আমার পরামর্শ।’

‘থাক ওসব কথা।’

‘ঠিক আছে। আমি চুপ করলাম।’

কিন্তু ততক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর ঘরের লাগোয়া ছোট্ট স্টাডিটাতে বসে প্রিয়া দুর্যোধনী বই পড়ার অছিলায় সব শুনে নিয়েছে। হাই কমিশনার আঙ্কেলের কথাগুলো তার খুব মনে ধরেছিল। এগুলি মনের মণিকোঠায় তুলে রাখল সে। ভবিষ্যতের জন্য।

৮০

সরকারি জিপটি গ্রামের রাস্তায় ঢুকে পড়ার আগে দাঁড়িয়ে পড়ে একটু ইতস্তত করল। তারপর ধুলোর রাস্তায় পড়তেই বোঝা গেল, কেন তার এই অনিচ্ছা। একে তো গায়ে গায়ে কুঁড়ের মাঝে সংকীর্ণ পথ। তার ওপরে রাস্তা এতই খারাপ যে কহতব্য নয়। জিপটা দুমদাম গর্তে পড়তে পড়তে এগোতে লাগল। দুপাশে বাচ্চারা আর মুরগিগুলো ছিটকে পালাতে লাগল।

জিপটা আওয়াজ করে গিয়ে দাঁড়াল গ্রামের একটা খোলা ময়দানে, কিছু লাল সাদা ব্যানারের সামনে। তাতে লেখা ছিল, ‘জমি সংস্কার মিছিল।’ একজন দাড়িওলা মানুষ বক্তৃতা দিচ্ছিল মাইক বা হাতে লেখা কোনও কাগজ ছাড়াই। কিছু মানুষ জড়ো হয়ে কথাগুলো শুনে হাততালি দিয়ে বক্তাকে উৎসাহ জোগাচ্ছিল। জিপ থেকে তাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল।

জিপ থেকে ক্রিম রং-এর স্যুট পরে, ব্রিফকেস হাতে একজন নেমে এল। তার চোখে মুখে ধুলোর আস্তরণ।

‘বিদুর কাকা!’ এক যুবক উল্লাসে চিৎকার করে উঠল। তার যমজ ভাই এবার যোগ দিল, ‘বিদুর কাকা!’

লম্বা সুপুরুষ যুবা, এগিয়ে এল।

‘বিদুর কাকা!’ যুধিষ্ঠির বলল, ‘কী আনন্দ! আপনি এখানে?’

‘বাকিরা কোথায়?’ বিদুর কুশল নিবেদনের মধ্যে না গিয়ে তড়িঘড়ি বলল, ‘তোমাদের জরুরি একটা কথা বলতে এসেছি।’

‘দ্রোণজি স্টেজের ওপরে আছেন। ভীম একটা পায়া ধরে রেখেছে। সেটা ভেঙে গেছে। মনে হয় জমিদারের লোক রাতের অন্ধকারে এই কাজ করেছে। অর্জুন সবার ওপর চোখ রাখছে। এখানে ক’দিনে কিছু নোংরা ঘটনা ঘটেছে। আপনি একটু অপেক্ষা করুন। এখনি শেষ হতে চলেছে।’

‘আমার হাতে সময় অল্প।’

দ্রোণ বক্তৃতা দিয়ে চলেছে, ‘দিল্লির সরকার আমাদের সমাজতন্ত্রের গল্প বলে। আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো নাকি সাধারণ মানুষের কথা ভেবে করা হয়েছে। কিন্তু ওই যে জাহাজগুলো ইস্পাত দিয়ে তৈরি হচ্ছে ওতে কি আমরা চড়ব? আমাদের ঘরে কি কোনওদিন বিদ্যুৎ আসবে? ব্যাঙ্কে কি আমরা কোনওদিন টাকা রাখতে পারব? জমি নিয়ে কেউ তো কথা বলছে না? প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষ তো এই জমিতে চাষ করেই সারা দেশকে খাওয়াচ্ছে! দিল্লির মন্ত্রীরা আর আমলারা তাদের অর্থনীতি ঠিক করুক আর গরিব চাষিরা না খেতে পেয়ে মরে যাক! সরকার কি জানে গ্রামে জমিদারেরা কী অত্যাচার চালায়? আমাদের প্রধানমন্ত্রী, যাকে আমি খুব সম্মান করি, বলে যে দেশে নাকি নতুন মন্দির গড়েছে। এই সব কলকারখানা নাকি নতুন মন্দির। তা আমি বলি, আমরা আমাদের পুরোনো মন্দির অর্থাৎ মানুষ এবং জমি এই নিয়েই মাথা ঘামাব। আমরা আন্দোলন গড়ে তুলব, যাতে কৌরব সরকার জমি সংস্কার করে। চাষিকে বাঁচাতে হবে, তবেই দেশ বাঁচবে। অত্যাচারী জমিদার নিপাত যাক! চাষি জিন্দাবাদ!

চারিদিকে হাততালি আর উচ্ছ্বাসের রোল উঠল। দ্রোণ চট করে স্টেজ থেকে নেমে অতিথির দিকে এগিয়ে গেল।

‘বলো, কেমন লাগল, বিদুর!’

‘খারাপ না।’ কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রকে দোষ দিয়ে লাভ কী? সেও তোমারই মতো জমি সংস্কার, চাষির অধিকার নিয়েই মাথা ঘামায়। কিন্তু এক রাত্রে তো সে জাদুকরের মতো সব পালটাতে পারবে না! তাকে তো আর পার্টি আর দেশ, দুটোই চালাতে হবে!’

‘সে এবার তাড়াতাড়ি বুঝুক মানুষের ওপরে আর কিছু নেই। তুমি এতদূর থেকে কি রাজনীতি নিয়ে তর্ক করতে এসেছ?’

‘না, না। চলো কোথাও বসি।’

‘ওরকম পোশাক পরে গ্রামে এসো না। তাহলে কেউ তোমায় প্রাইভেসি দেবে না।’ দ্রোণ হাসল, ‘চলো তোমায় নিয়ে একজায়গায় বসি। জুতো কিন্তু খুলতে হবে। শিব মন্দির এখন বন্ধ থাকে। পূজারি পিছনের গেটের চাবি আমায় দিয়ে রেখেছেন। আমরা বটগাছের নীচে, শ্যাওলা পচা পুকুরটার ধারে বসে কথা বলব।’

জিপটার দিকে চোখ পড়তেই দাঁড়িয়ে গেল, ‘ভারত সরকার, সিবিআই! বা বা! তুমি কি এই দপ্তরে এখন?’

‘সিবিআই অনেকগুলো ডিপার্টমেন্টের একটা।’ বিদুর জবাব দিল, ‘আমি একটা গোপন ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।’

সবাই গোল হয়ে বসে পড়েছে।

‘আপনাদের ঘোর বিপদ। একজন খুব শক্তিশালী মানুষ, প্রিয়া দুর্যোধনীও হতে পারে, হুকুম দিয়েছে পঞ্চপাণ্ডবকে খুন করার। আমায় যদি জিগ্যেস করো, এটা কী করে জানতে পেরেছি, বা এ ব্যাপারে কিছু করছি না কেন, তাহলে তার উত্তর দিতে পারব না। সময় হলে নিশ্চয়ই আমি ধৃতরাষ্ট্রকে বলে বা প্রিয়া দুর্যোধনীকে বোঝাবার চেষ্টা করব। কিন্তু এই মুহূর্তে তা সম্ভব নয়। দ্রোণের এই আন্দোলনের কারণেই তোমাদের এই বিপদ ঘনিয়ে এসেছে।’

‘দেখি আমাদের কে ক্ষতি করতে পারে! তাকে আর তার বাপকেও দেখে নেব।’ ভীম বলে উঠল।

‘বোকার মতো কথা বলো না ভীম। তোমার পিঠে যদি কেউ গুলি করে, বা ভিড় থেকে কেউ যদি তাক করে ছুরি ছুড়ে দেয়, তাহলে কী করবে? আমি এতদূর থেকে কেন ছুটে এসেছি বোঝার চেষ্টা করো।’

‘নিশ্চয়ই বিদুর কাকা। আপনি বলে যান।’ যুধিষ্ঠির বলে।

‘তোমরা পাঁচ জন আমার সঙ্গে জিপে ওঠো। একটু দূরে গঙ্গার ঘাটে একটা লোক অপেক্ষা করবে, যে তোমাদের বারণাবতে নিয়ে যাবে। জায়গাটা বড়। সহজেই ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারবে তোমরা। স্থানীয় পোস্টমাস্টারের মাধ্যমে আমি যোগাযোগ রাখব। হয়তো ভাষাটা একটু গোলমেলে লাগবে।’

‘আমরা ঠিক পারব, বিদুর কাকা।’ যুধিষ্ঠির বলে, ‘কিন্তু দ্রোণজির কী হবে?’

‘আপনি এই মুহূর্তে নিরাপদ আছেন। ওদের পাঁচজনের ভয় বেশি। আমার ধারণা এটা ব্যক্তিগত আক্রমণ, রাজনৈতিক নয়।’

‘আমি দুর্যোধনীর এই আচরণে হতবাক হয়ে যাচ্ছি।’ যুধিষ্ঠির বলল।

‘আমরা কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছি’, নকুল বলল।

‘আমি কোনওদিনই মেয়েটাকে বুঝব না।’ বিদুর দুঃখের সঙ্গে বলল, ‘আমার মন সায় দিল না। নয়তো আমি সরাসরি তাকে জিগ্যেস করতাম। গোপনে তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটাই শ্রেয়।’

‘আপনি ঠিকই বলছেন বিদুর কাকা।’ যুধিষ্ঠির বলে উঠল।

‘ওহ, আরও একটা ব্যাপার আছে। তোমাদের জন্য এক আপনজন বারণাবতে অপেক্ষা করছেন। তার সঙ্গ ছেড়ো না।’

‘কে? মা?’ অর্জুন জিগ্যেস করল।

‘হ্যাঁ। তিনি বড় দুঃখী।’

৮১

কর্ণর মৃত্যু সংবাদ ধৃতরাষ্ট্রর কাছে সকালে পৌঁছেছিল। সে তখন মালিশ করাচ্ছে। এক পালোয়ান তার ঘাড়েপিঠে মালিশ করে দিচ্ছে আর বিদুর তাঁর টেলিগ্রামগুলি পড়ে শোনাচ্ছে।

‘কী করে হল এটা?’ বুকের ওপর শুয়ে কালো চশমা আর শর্টস পরা ধৃতরাষ্ট্র বলল।

‘অনেকদিনই তার শরীর ভালো ছিল না। পার্টিশনের সময়তে তার সোনালি গায়ের রং হলদেটে মেরে গিয়েছিল। কপালের অর্ধচন্দ্রর ভেতর দিয়ে যেন তার মাথার জট পাকানো বুদ্ধিগুলোও দেখা যেত।’

বিদুর থামল। তারপর বলল, ‘যা হয়েছিল সেটা খুবই অবিশ্বাস্য। কর্ণের জিপের চাকা একটা পরিদর্শনে গিয়ে কাদায় আটকে যায়। চালক ইঞ্জিনের তেজ বাড়ালে চাকাগুলি আরও কাদায় বসে যায়। রেগে গিয়ে কর্ণ চাকা ধরে নিজেই তুলতে চেষ্টা করে, চালকের সাহায্য ছাড়াই। আশেপাশের লোক কর্ণর কাছে ঘেঁষার সাহস পেল না।’

‘তারপর?’

‘তারপর চাকা টেনে যখন কিছু হল না, তখন সূর্যের দিকে তাকিয়ে রাগতস্বরে কর্ণ কিছু বলল। পরমুহূর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার হাত দুটো তখনো গাড়ির চাকায় আটকে।’

ধৃতরাষ্ট্র চুপ করে রইল।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘আমি কর্ণকে পছন্দ করতাম না। সে ইসলামের তোয়াক্কা না করেও ধর্মান্ধতাকে সঙ্গী করে কাজ হাসিল করেছে। কিন্তু তাও…কখনো কখনো মনে হয় যে তাকে যদি কৌরব পার্টি সম্মান দিত তাহলে সে আজ শ্রেষ্ঠ ভারতীয়দের একজন বলে গণ্য হত।’

তখন অনেক দূরে বারণাবতের একটি হোটেল ঘরে কুন্তি কাঁদছিল তার প্রথম সন্তানের জন্য। তার মনে পড়ে যাচ্ছিল কেমন করে কুমারিত্ব বলি দিয়েছিল হাইপেরিয়ন হেলিওস-এর সান্নিধ্যে এসে। যে মা তার সন্তানের মৃত্যু দেখে যায়, তার চেয়ে অভাগী আর কেউ আছে কি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *