নবম অধ্যায়। ধৃতরাষ্ট্র না পাণ্ডু?

নবম অধ্যায়। ধৃতরাষ্ট্র না পাণ্ডু?

৪৮

পাণ্ডু যে শুধু নির্বাচনে দাঁড়াল, তাই নয়, জেতার জন্য পাগলের মতো লড়াই চালাতে লাগল। কৌরব কমিটির বেশিরভাগ লোক তার জন্যে লড়াইয়ে নেমে পড়ল। যারা পাণ্ডুর সঙ্গে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছে, যারা তার সঙ্গে লাঠির মার খেয়েছে, যারা তার কথায় ধুলো-মাটি-ঘাম মেখে লড়াই করেছে, সবাই তার মধ্যে খুঁজে পেল সেই বহু প্রতীক্ষিত নেতা। এতদিন নেতৃস্থানীয় মানুষেরা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং সুবক্তা ছিলেন। তাঁদের কখনও হেটোমেঠো মানুষদের মাঝে দেখা যেত না। গঙ্গাজি খুব চেষ্টা করেও হরিজন বা সাধারণ মানুষদের সঙ্গে পার্টির ওপরের দিকের নেতাদের আত্মিক যোগাযোগ ঘটাতে পারেননি। পার্টির ওপরের দিকে মুষ্টিমেয় শীর্ষ নেতারাই থেকে গেল যাদের ইংরেজরা বলত ‘পার্টি বস’।

মনে রেখো গণপতি, ওপরের দিকে যে অল্প সংখ্যক মানুষ থাকেন তারা সবসময়তেই আন্দোলনকে চালিয়ে নিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ কোনওদিনই সেই পর্যায়ে উঠতে পারে না, সে চালকের আসনে উন্নীত হতে পারে না। পাণ্ডুর মধ্যে সেই স্তরের মানুষ নিজের সাফল্য দেখতে পেয়েছিল। নির্বাচন যত এগিয়ে এল, পাণ্ডুকে ঘিরে উন্মাদনা ততই বাড়তে লাগল। গঙ্গাজি মৌনব্রত নিলেন। শেষে পাণ্ডু নির্বাচিত হল।

সেই সময়ে মনে হয়েছিল, ব্যাপারটা ধৃতরাষ্ট্রগামীরা সহজে মেনে নেবে না। জেতার পরে পাণ্ডু পার্টির কর্মীদের কাছে অঙ্গীকার করল যে সে কাজ করবে, শুধু অনুনয় আর বক্তৃতা করেই কাল কাটাবে না। মহাগুরু সম্বন্ধে কোনও অসম্মানজনক উক্তি সে করল না। বরং তাঁর প্রতি তার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা-ভালোবাসা প্রকাশ করল বক্তৃতার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু ভাষার মারপ্যাঁচের মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে দিল যে মহাগুরুর পদ্ধতির সঙ্গে সে সহমত নয়। তার যুক্তি পার্টির শীর্ষ নেতারা মেনে নিতে পারল না। কারণ তারা সবাই মহাগুরু এবং ধৃতরাষ্ট্রের অনুগামী। শত শত সাধারণ কর্মীরা সিটি বাজিয়ে, হাততালি দিয়ে পাণ্ডুর নেতৃত্ব মেনে নিল।

খুব বেশিদিন অবশ্য এভাবে চলল না। গঙ্গাজি যতই বলুন, পার্টির সব থেকে শক্তিশালী পদটির কোনও গুরুত্ব নেই, পাণ্ডুর এই উত্থান এবং জনপ্রিয়তা তিনি আটকাতে পারলেন না। ধীরে ধীরে মহাগুরুর অনুগামীরা ব্যাপারটার মধ্যে অশনি সংকেত-এর আভাস পেল। তাদের মুখ দেখে বুঝতে পারলাম যে পাণ্ডুর মধ্যে তারা তাদের এবং মহাগুরুর পতন দেখতে পাচ্ছে।

মহাগুরু যে কোনওরকম বিভাজন সহ্য করবেন না, সেটা বোঝা গিয়েছিল। তিনি একটা জটিল এবং বড় চিঠি লিখলেন পার্টির নতুন প্রেসিডেন্টকে। পাণ্ডু অবশ্য সেই চিঠি আগেই খবরের কাগজে পেয়ে গেলেন।

‘আপনি ঠিকই বলেছেন মহাগুরু!’ পাণ্ডু জবাব দিয়েছিল চিঠিতে, ‘ওদের উচিত ওদের প্রেসিডেন্টের হাত শক্ত করা। তা না করে ওরা ব্যবধান বাড়াচ্ছে।’ চিঠিটা আশ্রমে পাঠিয়েই পাণ্ডু খবরের কাগজে পৌঁছে দিয়েছিল।

গঙ্গাজি উত্তরের অপেক্ষায় ছিলেন না। তিনি একটা খবরের কাগজের সম্পাদকীয়তে লিখলেন, ‘এই ভাঙনের শিকড় একেবারে মাটির মধ্যে চারিয়ে গেছে, ডালপালা ছেঁটে কিছু হবে না।’

‘সূর্যের আলো ঠিকমতো ঢুকতে দিলে, পচন ধরে না।’ পাণ্ডু চাষিদের একটা সভায় বলেছিল, ‘বড় প্রাচীন বটগাছের ছায়াতেই আগাছারা বেড়ে ওঠে।’

দুই পক্ষের লড়াই দেখে দাবার ছকের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। স্নায়ুর চাপ প্রতক্ষদর্শীরাও অনুভব করতে পারছিল। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, লড়াই-এর দুই অধিনায়ক বোধহয় দাবা না খেলে বক্সিং-এর এরিনায় ঢুকে পড়েছে। কিন্তু ড্র হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ দু-পক্ষই নক আউট পাঞ্চ-এর দিকে তাকিয়ে।

‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল।’ গঙ্গাজি লাইফ পত্রিকায় ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন।

ঠিক সেই সময় পাণ্ডু টাইম ম্যাগাজিনকে একটা ইন্টারভিউ দিচ্ছিল। একজন তরুণ কবি, লখনউতে থাকেন, তিনি এই প্রজন্মকে নিয়ে সম্প্রতি একটা কবিতা লিখেছেন। আমি তর্জমা করে দিচ্ছি :

আমি তোমাকে বর্জন করিনি তাতঃ

আমি তো তোমার-ই জাত

তোমার প্রাজ্ঞ মাথার প্রতি রইল নমন

নিজের চুলও তো আঁচড়াব তেমন!

‘ভারতের সাহিত্যের ইতিহাসে ব্যঙ্গের তেমন জায়গা নেই।’ সারা বহিন একদিন গঙ্গাজিকে বলেছিলেন। সেদিন তাঁর মৌনব্রত চলছিল। ‘ভারতীয় রাজনীতিতেও তো নবীনদের তেমন জায়গা নেই। প্রবীণদের তৈরি সংস্কৃতিরই জয় জয়কার। কিন্তু মানুষের দুঃখকষ্টের ছবি কি এই রাজনীতি তুলে ধরে?’ সারা জিগ্যেস করেছিল।

‘মানুষ কী চায়, তা ভোটের শেষে, সংখ্যাগুলো দেখলেই বোঝা যায়।’ পাণ্ডু একটা সাহসী চাল দিল।

‘ইতিহাস বলে যে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের উৎসাহকে আপামর জনতার রায় মনে না করাই উচিত।’

ঠিক তখনই দাবার ছকে রাজার পতন হল। চিঠির পর চিঠি পাণ্ডুর হাতে পৌঁছোতে লাগল অজানা সব নাম-ঠিকানা থেকে। কিছু চিঠি পৌঁছে গেল খবরের কাগজগুলোতেও। সব চিঠিতে একই ভাষা। তাতে লেখা ছিল, কেমন করে কিছু মানুষের প্ররোচনায় কৌরব পার্টি তার সনাতন পথ, গঙ্গাজির দেখানো অহিংসার পথ থেকে সরে যাচ্ছে।

‘মাত্র তিন মাস হল আমি পার্টির প্রেসিডেন্ট হয়েছি। এরা বলছেটা কী?’ পাণ্ডু বন্ধুদের বলল।

‘আমাদের আন্দোলনের একটা নতুন দিক খুলে গেছে।’ পাণ্ডু সমুদ্র উপকূলে কৌরব পার্টির একটা সভায় বলে, ‘তোমরা যদি আমার পথকে শ্রেয় বলে মনে করো, তাহলে পুরোনো পক্ষীদের গলা ছাপিয়ে গিয়ে চিৎকার করে বলো, তোমরা আমার সঙ্গে আছো?’ পাণ্ডু ডাক দিল।

‘না-না-না…।’ রব উঠল।

উপায়ান্তর না দেখে পাণ্ডু গুরুকে চিঠি লিখল, ‘আমার বিরুদ্ধে পার্টিতে মতবাদ তৈরি করা হচ্ছে। ওরা আপনার মৌনতার সুবিধা নিচ্ছে। অনেকেই পার্টিবিরোধী কার্যকলাপ করছে। আপনাকে বিনীত অনুরোধ যে আপনি আমাদের সপক্ষে কিছু বলুন, যাতে পার্টিকে আমি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। আপনি যদি বলেন যে ওরা বাড়াবাড়ি করছে, তাতেই কাজ হবে।’

খামটা বন্ধ করে, ‘জরুরি’ লিখে পাণ্ডু গঙ্গাজির কাছে পাঠিয়ে দিল। খবরের কাগজে কোনও কপি গেল না। মহাগুরু কিন্তু তাঁর উত্তর খবরের কাগজের মাধ্যমেই দিলেন, ‘আমি কৌরব পার্টির একনিষ্ঠ কর্মীদের কী করে বলব তাদের বিবেক বুদ্ধির বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করতে?’

পাণ্ডুর চারপাশ ফাঁকা হয়ে গেল। সে বলেছিল, ‘আমি পার্টি প্রেসিডেন্ট হিসেবে কৌরব ওয়ার্কিং কমিটির কাছে ভোট অফ কনফিডেন্স আনতে চাই। আমার পদমর্যাদা এবং রাজনৈতিক মতবাদের ওপরে আঘাত হানা হয়েছে যোগসাজস করে।’

পাণ্ডু আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল। তার অসহায় চোখদুটোর দিকে আমি দেখতে পারিনি। শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডি এবার উলটে গেল। সিজার ব্রুটাসকে ছুরি মারল।

‘আমাদের কাছে এই আশা তুমি রেখো না।’ আমার গলা ধরে গেল। ভোট অফ কনফিডেন্স হলে সে হেরে যাবে, বেচারা বুঝে গেল। সে পদত্যাগ করল।

৪৯

গঙ্গাজি যে উৎসব করেছিলেন, তা নয়। খবরের কাগজেও কিছু লেখেননি। যে হরিজনটিকে হারিয়ে পাণ্ডু মসনদে বসেছিল, তাকে ফিরিয়ে এনে কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্ট করা হল। পরের বছর সে বিনা বাধায় জিতে যায়। আজ ইতিহাস বইতে ছাড়া কেউ তার নাম মনে রাখে না।

গণপতি! বিচলিত হয়ো না। তুমি ভাবছ গঙ্গাজির মতো এক সাধুপুরুষ সত্যান্বেষী কী করে তাঁরই দ্বারা লালিত একটি বাচ্চা ছেলেকে ক্ষমতাচ্যুত করবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন?

দুঃখ করো না। লক্ষ্যে একনিষ্ঠ থাকলেই কি মহান হওয়া যায়? গঙ্গাজি যে সত্যের কথা বলতেন, সেটা তাঁর দেখানো পথের সত্য। পাণ্ডু সে পথে অন্তরায় ছিল। ‘আমার ওপর বিশ্বাস রাখো,’ গঙ্গাজি তাকে আম্র সত্যাগ্রহের আগে বলেছিলেন। পাণ্ডু পারেনি। আম্র সত্যাগ্রহ যখন তুলে নেওয়া হল, দুই ভাইয়ের মধ্যে বিশ্বাসের মৃত্যু ঘটেছে। মহাগুরু ধৃতরাষ্ট্রকে তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষণা করবার সময় পাণ্ডুর সমর্থন চেয়েছিলেন। সে মহাগুরু এবং নিজের অন্ধ ভাই-এর সহগামী হতে পারত। মানেনি। উলটো পথে হেঁটেছিল।

ধর্মের পথ ধরে গঙ্গাজি রাস্তার কাঁটা সরিয়ে দিলেন। আমাদের দেশের পুরোনো গ্রন্থ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং বেদব্যাসের শান্তিপর্ব পড়লেই জানতে পারবে, গঙ্গাজি কী করে শান্তিপূর্ণ ঠান্ডা লড়াইয়ে পাণ্ডুকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। অনেক আগে রাজা সালভাকেও প্রায় এভাবেই তো নিজের পথের থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন মহাগুরু। সত্যের নামে যে দুঃখ-কষ্টের জোয়ার বয়ে গেল কে তার হিসেব রাখে!

আমার পাংশু ছেলের দুঃখে আমার বুক ভেঙে যায়, গণপতি। তার গল্পের বাকিটুকু দেখে নিই। সেটা লেখা হয়ে গেলে আমার মন হালকা হবে। একটা বিরাট দায়িত্বের পালন হবে। একজন অস্বীকৃত অসহায় বাবার দায়িত্ব।

৫০

বলব পাণ্ডুর গল্প

সময় লাগবে অল্প

সে বলত করে দেখাও

ধরল গান লেখাও

ও তো রক্ত নয় মদ

ইতিহাসের নায়ক বধ

জানতে না কি কেউ

করুণ কাহিনির সে ঢেউ

পাণ্ডুর ছিল প্রাণস্ফুর্তি

পার্টি দেখল রুগ্নমূর্তি

সে দিল ছেড়ে সব

‘গেল গেল’ উঠল না কোনও রব।

বিদায় বন্ধুগণ-জলভরা চোখে বলি

তোমার শব নিয়ে খেলছে ওরা প্রেমের হোলি

তুমি চাও স্বাধীনতা দিতে

ভারতের বন্ধন কেড়ে নিতে

কিন্তু এটা কি জানো

কাজটা কঠিন, সেটা তো মানো?

বলা, লেখা, হাঁটা অনশন

করবে কি এরা ভারতের উপশম?

কিন্তু একথা ওরা না মানে

অন্য মন্ত্র রয়েছে যে কানে!

আমরা সত্য আমরা ভালোর দল

আমরা ইংরেজের শাসনে পাই বল

ভাঙলে আইন যেতেই হবে জেলে

মাথা নিচু করে যাব হেসে খেলে

সময় এসেছে সবাই হও তৈরি

ঘোমটা সরিয়ে দেখাও তুমি বৈরী

পৌরুষ বলে অস্ত্র নিয়ে হাতে

রক্ত ঝরাও ওরাও ভয় পায় যাতে

আজ থেকে শান্ত পাণ্ডু হল মৃত

জেগে উঠে করবে সে দেশকে প্রীত

হবে কঠিন শক্ত রেখে মন

সন্তান জাগবে, মায়ের বুকের ধন

সরে যাও যত টলস্টয়, রাসকিন, বুদ্ধ

এখন যে হবে শুধুই সম্মুখ যুদ্ধ

এবার কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার পালা

চল, হিটলারে দেখি আটকায় কোন শালা!

সেই থেকে পাণ্ডু হল রাগী

ঘর ছেড়ে ফ্যাসিস্ট ছেলে হল বিবাগী

হিটলার-মুসোলিনির মতো তাই

হাতের মুঠো শক্ত যে হওয়া চাই!

এগিয়ে চল ফরওয়ার্ড মার্চ করে

মিলিটারি পোশাকে পা ফেলো জোরে

ইংরেজের শত্রুকে করে বন্ধু এবার

পাণ্ডুর সেনা বাইরে চলল সেবার

পোল্যান্ড গেল, ভয়ে সিঁটিয়ে ইংরেজ

হিটলারের মার থেকে বাঁচায় তোদের কোন কোবরেজ?

এইবার পাণ্ডু নেবে সেই প্রতিশোধ

কৌরবদের আছে কি সেই বোধ?

পাণ্ডু চলল বার্লিন প্রান্তে

ঘুমের ঘোরে কৌরব পারল কি জানতে?

৫১

কিন্তু যেই সে পৌঁছোল তার লক্ষ্যে

ইংরেজ যুদ্ধ ঘোষণা করল বার্লিন-রোম কক্ষে

পাণ্ডু পড়ে গেল ধরা ভাগ্যের পরিহাসে

আবার করবে চেষ্টা, এতে কী যায় আসে?

হাতকড়া পরে পাণ্ডু চলল জেলে

ইংরেজ চায় না সে বেরোক ঠেলে

পাণ্ডু ছাড়া অন্য কেউ হলে

প্রাণ মন ভেঙে পরলোকে যেত চলে

জানো সে কী ধাতুতে গড়া

পালাবার পথ ছিল তার লেখাপড়া

করাত না ছুরি এ নিয়ে ভাবত অহর্নিশ

ভালো যে চেনা জেলার করল কুর্নিশ।

প্রণাম জানাই পাণ্ডুজি বারবার

আপনি এখানে কৌরবদের এ কী কারবার

ভারতমাতার সত্যিই হত সর্বনাশ

চক্রবর্তী যদি না দিত আশ্বাস

চক্রবর্তী অনওয়ার্ড অর্গানাইজেশন-এর নেতা

তার দয়াতেই পাণ্ডুর স্বাধীনতা জেতা

জেলার ছিল চক্রবর্তী অনুরাগী

পাণ্ডুকে ছেড়ে দিতেই হবে স্বাধীনতা লাগি

প্রথমে তার ছিল সংশয়

চাকরির প্রতি নেমকহারামির ভয়

কিন্তু দেশের প্রতিও দায়িত্ব করতে হবে

পাণ্ডুকে সে ছেড়ে দেবে যবে

ক্ষমা করো আমায় করেছি যে দেরি

চাবির গোছায় রয়েছে চাবি এরই

তোমায় পাঁচিলপারে দেব পাঠিয়ে আমি

স্বাধীনতার আগে কোথাও কি যাব থামি?

চারিদিকে বিপদ সংকেত বাজে

প্রতি বন্দরে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে

পাণ্ডু এবার ঠিক ফসকে গেল

নেকড়েকে এবার কেউ কি ধরতে পেল?

ছদ্মবেশে বেগম জাহান সেজে

চেকপোস্ট পেরিয়ে ইংরেজকে বেঁধে লেজে

কাবুলে গিয়ে তবে নিঃশ্বাস ফেলে

সেখানে কেউ এল না ভর্তে তাকে জেলে।

আফগানিস্তানে আবার পোশাক পরে

চলল পাণ্ডু জার্মানি প্লেনে চড়ে

কিন্তু খেয়াল ছিল না টিকিটের সাথে

কোনও ভিসা নেই তখনও হাতে।

নিয়ম তা কারো জন্যেই যাবে না ভাঙা

পাংশু পাণ্ডু যতই হোক না রেগে রাঙা

‘জার্মান এম্বাসিকে বলে দেখুন বরং

হিটলার আসবে নিতে আপনাকে স্বয়ং

শেষে পাণ্ডু নামতে হল বাধ্য

জার্মানি যাওয়া হয়ে গেল অসাধ্য

সোজা গেল কনসাল জেনারেলের কাছে

বার্লিনের কোনও উত্তর কি আছে?

‘জানো আমি কে?’ বলল জার্মান কনসাল

হিটলারের প্রিয় বন্ধু, হয়ো না বেসামাল

তুমি জানো কি আমি ফ্যাসিবাদী, নাৎজি মোর নাম

পাণ্ডুর বলল, ‘গিভ, মি আ গান!’

ফ্যাসিবাদকে করে নিয়ে সাথী

সাময়িক ছিল সেটা, নয় রাতারাতি

বউদের বোঝাল বসে

শত্রুর শত্রু, আমার মিত্র সে

দেব তোমায় আমরা ভিসা

আশাকরি পাবে তোমার দিশা

কনসাল শুধু বলল না ভুলতে

হিটলার এলে স্যালুট হাত তুলতে…

৫২

পাণ্ডুর সেই স্যালুটে লাগল হিটলারের

চোখে সর্ষে ফুল দেখল ফুয়ারারে

‘আমি দুঃখিত’ বলে পাণ্ডু পার পেল

‘আরটু হলেই তোমার প্রাণটা গেল।’

‘আমাদের রেডিয়োতে তুমি ভাষণ দাও

ট্যাঙ্ক না দিয়ে জার্মান বলল, ‘এটাই নাও’

আক্রমণ না করে দুঃখিত পাণ্ডু তাই

রেডিওতে বলল, শুনল ভারতে তার সব ভাই

প্রতি রবি-বৃহস্পতি জার্মান রেডিয়োতে

পাণ্ডু ডাক দিত ঘর ছেড়ে বেরোতে

‘চলো দিল্লি!’ বলত আর্তনাদে

মনে হত কোনও পশু পড়েছে খাদে

‘কিছু বোঝা যায় না—এটা কোন গান—

না কি আমেরিকার আহ্বান!

কেউ বলে রেডিয়োর সেই মেয়েটা

বাংলা বলছে, চালাও বি বি সি-টা।’

পাণ্ডু পেল না কারো কাছে সাড়া

কেউ তো শুনতে পেল না তার নাড়া

দূর দেশে থেকে হল সে অধৈর্য

নির্বাসন যে তার কেড়ে নিয়েছিল স্থৈর্য

তারপর দিগন্তে উদয় হল জাপান

বেঁধে দিল ভারতের সঙ্গে সোপান

ইংরেজ যেন ভয়ে থর থর কাঁপে

জাপানি উঠল শীর্ষে এক লাফে

সেই দেখে আশা জাগল এদেশে

ইংরেজ এবার যাবে ফিরে স্বদেশে।

ল্যাজ গুটিয়ে যুদ্ধের ময়দানে

পালাতে হল ইংরেজ শয়তানে

পাণ্ডু চলল এবার জাপান পানে

মুখর হল যে তাদের জয়গানে

‘আমরা মিলিত হলে হবেই আমাদের জিত

বন্ধুত্বের তাই এখনই পাকা করি ভিত।’

৫৩

শেষে পৌঁছোল সে বহুদূর

ব্রিটিশের হাতে এতদিন ছিল সিঙ্গাপুর

জাপানিরা তাকে সেখানে করল বরণ

পাণ্ডু যে তাদের করেছিল আর্ত স্মরণ

পাণ্ডু তাদের ভুল ভাঙিয়ে দিল

‘ভারতীয় সৈনিক ইংরেজদের যত ছিল

ভারতীয় কোটি কোটি, চায় স্বাধীনতা

ইংরেজ তাড়িয়ে মোদের ঘোচাব পরাধীনতা।

তোমাদের জেলে যত ভারতীয় বন্দি

মুক্তি দাও, করো তাদের সাথে সন্ধি

সেই ছেলেদের নিয়ে তৈরি করব এক সেনা

তোজোকে বলো যাবে না তাদের আর চেনা

আমি তাদের মধ্যে জাগাব উচ্ছ্বাস

দেশপ্রেমে গড়ে উঠবে তাদের বিশ্বাস

জাপানকে করে আমাদের নতুন বন্ধু

আমরা পেরোব পরাধীনতার এই সিন্ধু

‘তবে তাই হোক’ বলল জাপানি সমর নেতা

‘তোমাকে দেব সব, কাজ হবে শুধু জেতা

পরিচয় পত্র, জিপ, ম্যাপ সব পাবে,

তারপর তুমি ইংরেজ হটাতে যাবে…’

পাণ্ডু আবার মিলিটারি পোশাকে

টুপি চড়িয়ে জাগিয়ে তুলল আশাকে

কুচকাওয়াজ থেকে অফিসার কোয়ার্টার

তার বুটের আওয়াজে হল সব একাকার।

নমস্কার! আমি বলছি শোনো সবে

বন্দি নেই কেউ জেলে কেন আর রবে?

ওঠো জাগো চলো ডাকে ওই জন্মভূমি

আর কতদিন ঘুমিয়ে থাকবে তুমি?

বন্দি থেকে দুমুঠো ভাতের জন্যে

কেন চেয়ে রবে, কাজ করে করে হন্যে?

করবে কেন জাপানি সেনার গোলামি

তার চেয়ে চলো দেশের করি সেলামি

‘কিন্তু আমরা ইংরেজের অধীন যে

পালিয়ে গেলে নেমকহারামি হবে সে’

‘ইংরেজ তোমাদের বাঁচাতে পারল কি?

এত বড় যুদ্ধে প্রতিজ্ঞা কি ইয়ার্কি!’

এইবারে তাদের বাঁধ গেল একেবারে ধসে

দলে দলে তারা পাণ্ডুকে নেতা করল এসে

তৈরি হল স্বতন্ত্র সেনা যেদিন

মাছ-ভাত-এর লোভই কি শুধু ছিল সেদিন?

গর্বে পাণ্ডুর ছাতি ফুলে দশ হাত

যুদ্ধে যেন ইংরেজ কবেই হয়েছে কাত

স্বতন্ত্র সেনাকে দিল বাকি শিক্ষার

যুদ্ধ জয় করার সাধ্য কি শুধু দীক্ষার

কুচকাওয়াজ, প্যারেড ইউনিফর্মের তালে

প্রস্তুতি চলল সেনার কালে কালে

কিন্তু যুদ্ধ জেতা কি অত সহজ কাজ?

অল্পই এগোল পাণ্ডুর এই রণসাজ…

জাপানিরা শুরুতে বেশ খুশি হল রণসংজ্জা দেখে

কিন্তু যখন দেখল তারা অঙ্ক সামনে রেখে

পরাজয়ের পাল্লা যখনি হয়ে গেল ভারি

জাপানি রেগে শুরু করল কথার মারামারি

‘ওরা ইংরেজের সৈন্য, বিশ্বাস করে হয়েছে ভীষণ ভুল

ওরা সংগ্রামী বলেছ তুমি, করেছ জান কবুল

ইংরেজকে করা অঙ্গীকার ওরা ভেঙেছে আজ

কালকে আবার ভাঙবে না কি? এটাই ওদের কাজ!’

‘কারা থেকে বেরোব বলে যোগ দিয়েছে ওরা

সামরিক কোনও শিক্ষা নেই সবাই দিশেহারা

পাণ্ডু সেনার সঙ্গে রইল অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই

আজ জাপানি জয়ী হয়েছে, আসবে হারবে যেই।

৫৪

একা না থেকে পাণ্ডু এবার মাদ্রীকে দিল ডাক

জাপানি চর চিঠি পৌঁছোল স্ত্রী তার এসে যাক

কুন্তির হাতে ছেলেদের সঁপে মাদ্রী করল যাত্রা

সিঙ্গাপুরে পৌঁছে স্বামীর সঙ্গ পেয়ে দাড়াল মাত্রা

‘সব ভালো যার শেষ ভালো’, স্ত্রীকে বলল স্বামী,

‘এইবার সব সহ্য হবে, পাশে থাকলে তুমি।’

জাপানি পাছে সন্দেহ করে, প্রশ্ন করে তাকে

মাদ্রীও হল সেনায় ভর্তি, ডরায় না আর কাকে

ক্যাপটেন করে নিজের বউকে গর্বে ফোলায় বুক

খাকি পোশাকে কেমন দেখায় মাদ্রী জানতে উন্মুখ

হস্তিনী সে, আগে যা ছিল, সেনার পোশাকে বেমানান,

প্রেমে পাগল পতি কিছুতে বোঝে না স্ত্রীর অসম্মান

সব সাবধানী বাণী ভুলে এবার পাণ্ডু হল উদ্দাম

এত বছরের ব্রহ্মচর্য হবে ফুতকারে হতোদ্যম?

মাদ্রীর প্রলোভনে সাড়া দেয় যদি হবেই সর্বনাশ

এই মুহূর্তে সবচে’ জরুরি ইংরেজ রাজ নাশ

জাপান এবার হল ধরাশায়ী ইংরেজ মহাদানব হাসে

‘অ্যাটাক ইন্ডিয়া’ ছেড়ে জাপানি ‘বাঁচা সিঙ্গাপুর’ ভালোবাসে

শেষে পাণ্ডুর ডাক পড়ে যাবে কঠিন যুদ্ধ বাঁধে

যুদ্ধ ক্লান্ত সৈনিক সব বন্দুক তোলে কাঁধে।

কে মরে কে বাঁচে ভয়ানক রণ বাঁধল যে জঙ্গলে

ইংরেজরা ভারতীয় সেনা ঢোকাল দল দঙ্গলে।

ভাই-ভাইকে মারার শিক্ষা পাণ্ডু দেয়নি তাদের

কেউ পালাল, ধরা দিলে কেউ, এত লাশ পড়ে কাদের?

জাপান বলল, যুদ্ধ থামাও হার এখন অনিবার্য

এ হেন লজ্জা মাথা পেতে নিয়ে পাণ্ডু চাইল না সাহায্য

সিঙ্গাপুরে ছেড়ে চলে গেল বীর ঝড় বইছে মনে

ছোট ভাঙা প্লেন উড়ে গেল নিয়ে, জলটা চোখের কোণে

৫৫

‘কী থেকে কী হল,

হায় মাদ্রী জয় হল পরাজয়

স্বস্তিক থেকে উদীয় সূর্য কেউ-ই কারো নয়

ভেবেছিলাম শিক্ষা দেব ইংরেজে আর দেব কৌরবে

গঙ্গাজি তাহলে নিশ্চয়ই আমায় মেনে নেবেন গৌরবে

ইংরেজে তাড়িয়ে হতাম রাজা মানুষের প্রাণে মনে

না মানুক কৌরব বা গঙ্গাজি, তখন কে কার কথা শোনে?

কিন্তু মাদ্রী দর্প আমার চূর্ণ হয়েছে আজ

তোমার স্বপ্ন পূর্ণ হল না, বৃথা হল রণসাজ

ইংরেজরা এ যাত্রা জিতে প্রথমেই আমাকে দেবে ফাঁসি

আমি যে মানুষ খেপিয়ে কেড়ে নিয়েছি তাদের হাসি!

তোমায় বড় দুঃখ দিলাম, লজ্জায় কাটাবে তুমি

এহেন স্বামী কেন যে তোমার, বলবে মাতৃভূমি!

‘চুপ করো নাথ, ও কথা বলে না,’ মাদ্রী ওঠে কেঁদে

বড় ভালোবাসি সাহসী-বীর এগোও তুমি জেদে

ভগবান না করুন, যদি অকালে তোমার মৃত্যু আসে

দেব এ প্রাণ বিসর্জনে, হাসুক ইংরেজ উল্লাসে

আমরণ তোমার পাশেতে থাকব করেছি এই শপথ

স্বামী ছাড়া আমি জানি না প্রভু আছে আর কোন পথ।

মাদ্রীকে ধরে চুম্বন করে লালসা জাগল মনে

ভুলে গেল সেই ডাক্তারি বাণী মারা যাবে প্রাণ ধনে।

মাদ্রী বারে বারে সাবধান করে এবার গেল হেরে

পাণ্ডু তখন জাগ্রত পশু, মত্ত কামের জেরে

‘তোমায় চাই এই মুহূর্তে’, বলে করে চলে সহবাস

মাদ্রী এবার সব কিছু ভুলে খুলে ফেলে বেশবাস

‘আরও জোরে, আরও জোরে’, বলে শীৎকার করে সে

‘জানি জানি সব, সামলাও এবার বুঝবে আমি কে’,

‘অপূর্ব! আমি তৃপ্ত, স্বামী, তোমার কথা বলো,’

তারপর পাণ্ডুর দিকে তাকিয়ে তার সম্বিত ফিরল।

‘কী হল তোমার? নিথর কেন? হায় হায় হায়!

হে ভগবান, নিষ্ঠুর তুমি, আমায় কেন নয়?’

স্বর্গ থেকে এল এক জ্যোতি অনির্বাণ

প্লেন না কি এ কোন এক স্বর্গযান?

মাদ্রী এবার বুঝল বিধির ইশারা ইঙ্গিত

বোমা, গুলি চলল, মনে হল সঙ্গীত

বুকে রেখে পাণ্ডুর মাথা হাসে রানি অবশেষে

স্বামীর সঙ্গে স্বর্গবাসের এবার সুযোগ আসে

গুলি এসে সোজা বিঁধে গেল মাদ্রীর বুকে

তারপর গোলা এসে জ্বালিয়ে দিল প্লেনটিকে

মাদ্রী চলল সহমরণে নিয়ে স্বর্গের আশীর্বাদ

শেষ হল সব কোন্দল যত রাজনৈতিক বিবাদ…

পাণ্ডু হয়তো বীরের সমাধি পেয়ে খুশি হয়েছিল। একজন ধর্মনিষ্ঠ হিন্দু, নিজের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে স্বর্গলাভ করার থেকে আর বেশি কী চাইতে পারে? সারা জীবনের গঞ্জনা, গ্লানি আর বিফলতার হাত থেকে গৌরবময় মুক্তি।

আমাদের কাছে খবরটা যখন পৌঁছোল, আমরা গভীরভাবে আহত হলাম। পার্টিতে ধৃতরাষ্ট্রের পদ আরও পাকা হল। কিন্তু সে এক মর্মস্পর্শী বক্তব্য রেখেছিল সেদিন। পাণ্ডুর চলে যাওয়াটাকে সে ‘সীমাহীন দুঃখ’ আর ‘দেশের অপূরণীয় ক্ষতি’র সঙ্গে তুলনা করেছিল। সে শপথ নিয়েছিল, ‘আমার ভাইয়ের স্বাধীনতা সংগ্রাম আমি বাঁচিয়ে রাখব।’ সে যে ধৃতরাষ্ট্র! দেশের সুবক্তাদের একজন।

আর গঙ্গাজি? মহাগুরু মৌনী হয়ে চরকা কেটে চললেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কাপড় বুনে তিনি পাণ্ডুর বিধবা প্রথমা স্ত্রী কুন্তীকে দেন। কিন্তু কাপড়টা ব্যবহারযোগ্য ছিল না, বুনোটে গন্ডগোল ছিল। বোঝা গেল, তিনি অন্যমনস্ক ছিলেন। পাণ্ডুর মৃত্যু আমাদের মন ভেঙে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *