পঞ্চম অধ্যায়। নিস্তব্ধতার শক্তি
২৩
গণপতি, তুমি আমার গল্পের বিস্তারটা এবার বুঝতে পেরেছ নিশ্চয়ই। তোমার পক্ষে এত চরিত্র এবং তাদের গতি-প্রকৃতি-পরিণতি, বুঝতে পারা কষ্ট বই কি! কিন্তু এটাও বোঝো, আমরা এই বিশাল দেশের ইতিহাস ঘাঁটতে বসেছি—৮০ কোটি মানুষের ইতিহাস। গল্পটা আরও ঘোরালো হতে পারত।
গঙ্গাজির কথা বলে শেষ করা যায় না। আমি এ গল্পে অবশ্য তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের কথা বলতে বসিনি। তবু কিছু কথা ইতিহাসের স্বার্থে লিখে যেতেই হবে। তাঁর সম্পর্কে বহু মানুষ বই লিখেছিলেন, ফিল্ম বানিয়েছেন, আমি তাদের ভিড়ে ঢুকতে চাই না। আমি শুধু বলে যাব গঙ্গাজি তাঁর অহিংস রাজনীতি কী করে দেশের গভীরে ছড়িয়ে দিলেন, এবং অহিংসার আর সত্যের জন্য আত্মত্যাগের কোন পর্যায়ে পৌঁছোলেন। গণপতি, তুমি শুধু লিখে যাও।
মোতিহারির পরের ঘটনা এটা। এবারে আর নীল চাষ নয়। গঙ্গাজি গিয়েছিলেন কলকাতার বাইরে বজবজের পাট কলের কর্মীদের ডাক পেয়ে। পাট-এর সুতো তৈরি হত বাংলার পাট গাছ থেকে এবং স্কটল্যান্ডের উন্নতির পিছনে এর অবদান অনবদ্য। বেশিরভাগ পাট চাষ হত পূর্ববঙ্গের জলাভূমিতে। আর জাহাজে করে চলে যেত স্কটল্যান্ডের ডান্ডিতে। সেখানে পাটের সুতো থেকে তৈরি হত ব্যাগ, বস্তা আর শতরঞ্চি। সেগুলো তারপর ভারতে ফিরিয়ে এনে বিক্রি করা হত বিরাট মুনাফার পরিবর্তে। বাঙালিরা পাটগাছ আবিষ্কার করল আর ইংরেজরা তাদেরকেই পাটের জিনিস তৈরি করে বিক্রি করল। এই অতীব সুন্দর ব্যবস্থাটাই অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকত, যদি না কাইজাই উইলহেলম ২ বেলজিয়ামে ঢুকে গিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বাধাতেন। বাঙালিরা এর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকুন।
যুদ্ধের প্রয়োজনে পাটের চাহিদা চারগুণ বেড়ে গেল। যুদ্ধবাজ দেশগুলো তখন চারিদিকে খাল কেটে সেনাদের লুকোবার ব্যবস্থা করছিল আর সেগুলিতে বালির বস্তা ভরে ঠেসে দিচ্ছিল। এই বালির বস্তা তৈরি করতে পাটের প্রয়োজন হত। ইংরেজরা বুঝল, পাটগাছ থেকে তৈরি সুতো বানাবার কারখানাগুলি যদি এখানে বসানো যায় তাহলে কম খরচে বেশি ফল পাওয়া যাবে। ডান্ডি থেকে দমদমে উঠে এল পাটশিল্প।
মুনাফার ভাগটা কিন্তু ইংরেজরা ভারতীয়দের হাতে দিল না। এই কারখানার মালিকরা কেউ বাঙালি ছিলেন না। অবশ্যই স্কটিশ ছিলেন। এখানকার গরিব মানুষের ছিল কারখানায় কাজ করবার অধিকার। আর সেই কাজের জন্য তারা যা টাকা পেত, তাতে তাদের দু-বেলা পেটে ভাত জুটত না। গঙ্গাজি তাদের বস্তির দুর্গন্ধময় জীবন দেখে আতঙ্কিত হলেন।
হাই তোলা বন্ধ করো গণপতি! মন দিয়ে শোনো আমি যা বলছি। আমি যতটা পারি সংক্ষেপে বলব। ঐতিহাসিকরা, পাটওয়ালারা, ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা, আর সমালোচকরা যা মনে করে করুক। একজন শিক্ষিত ইংরেজ মহিলা, সারা মুর তার নাম, সে কিন্তু শ্রমিক-দরদী মনোভাব দেখিয়েছিল। তার ভাই ছিল জুটমিল মালিক। সে সময়ে হঠাৎ প্লেগ রোগে বাংলায় মড়ক লাগে। বর্ষার শেষে, অপরিষ্কার বস্তিগুলো রোগের ডিপোয় পরিণত হত। সারা তার ভাইকে বুঝিয়ে শ্রমিকদের জন্য একটা বিশেষ ভাতা চালু করল। বেশ মোটা অঙ্কের টাকা সেটা, তাদের মাইনের প্রায় ৮০ শতাংশ। মড়ক অগ্রাহ্য করে কাজে আসার পুরস্কার।
মড়ক শেষ হলে মিল মালিকরা ভাতাটি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু সারাকে নেত্রী বানিয়ে মজুররা আন্দোলন শুরু করল। তারা দাবি তুলল, ভাতা যদি না দেওয়া হয় তাহলে তাদের মাইনে বাড়িয়ে দেওয়া হোক। ৮০ শতাংশ যদি না বাড়ানো যায়, অন্তত ৫০ শতাংশ বাড়াতেই হবে। মিল মালিকরা লক আউট ঘোষণা করল।
গঙ্গাজি বজবজে গিয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। লক আউট হওয়া মিলগুলির কর্মীরা কোনও মাইনে পাচ্ছিল না। তাদের পরিবারগুলো, বলাই বাহুল্য উপোস করতে বাধ্য হচ্ছিল। বস্তিগুলোতে অবর্জনা আর ময়লা উপচে পড়ছে, বাচ্চারা পচা নর্দমায় বসে খেলছে, পায়রার খোপের মতো কোনওমতে খাড়া করা ঘরগুলিতে জল ও বিদ্যুৎ ছাড়া গাদাগাদি করে মানুষ বাস করছে। ভারতের এই ছবি ইদানীংকালে তো বাইরে কত দামে বিক্রি হয়! কত ফরাসি ফিল্ম ডিরেক্টর এই চলচ্চিত্র তোলবার জন্য নিজের দেশের স্বল্পবেশ যুবতীদের ছেড়ে দিয়ে ভারতের নগ্ন শিশু খুঁজে বেড়ায়। কী মায়া তাদের আমাদের দেশের গরিবদের জন্যে! ইংরেজ রাজত্বের সময়ে এদের বা লেখকদের দেখা যেত না। তখন তো সবাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মহিমা নিয়ে লিখতে ব্যস্ত। তারা কেউ কি একবারও আমাদের দেশের তাঁতিদের কথা লিখেছিল, যাদের বুড়ো আঙুল ইংরেজরা কেটে দিয়েছিল যাতে ল্যাঙ্কাশায়ারে তাদের মিলগুলি মুনাফা লুটতে পারে? কেউ আমাদের চাষিদের কথাও লেখেনি, যাদের জমি জমিদাররা আস্তে আস্তে হজম করে নিল। তার বদলে ইংরেজদের গোলামি করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হল।
গণপতি, রাগে আমার সারা শরীর জ্বলছে! ইংরেজরা তো আমাদের শিল্পগুলোকে জ্যান্ত মেরে ফেলল, ভূমিহীন কৃষকের জন্ম দিল। আমাদের কর্মক্ষমতা শোষণ করে তারা ভারতে দারিদ্র্যের বীজ পুঁতে দিল।
আজকের ভারতবর্ষের হতাশা আর দারিদ্র্য দেখে তুমি কখনওই বিশ্বাস করতে পারবে না, ভারতবর্ষ একদিন অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত এবং বর্ধিষ্ণু ছিল। অভাবের কথা তখন এদেশের মানুষ শোনেনি। আমরা ধনী ছিলাম বলেই না ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বণিকরা আমাদের দেশে ব্যবসা করতে এসেছিল? তারা এসেছিল আমাদের ধনদৌলতের মোহে। তারা সব লুঠ করে নিয়ে গেল আমাদের কাঙাল করে দিয়ে। গঙ্গাজি বস্তিগুলোর পচা গন্ধ আর আবর্জনার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে বুঝতে পেরেছিলেন, এ ভারতবর্ষ সৃষ্টি হয়েছে ইংরেজদের আসবার পরে।
শহরের দারিদ্র্যের চেহারা জঘন্য, কদাকার। মোতিহারিতেও তিনি দারিদ্র্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে হিমালয়ের কোলের গ্রামগুলো কী ছবির মতো সুন্দর। সূর্যের কিরণে সবুজ আর হলুদের কী অপূর্ব মায়া চারিদিকে। দারিদ্র্য যেন এক স্বতন্ত্র ব্যাপার সেখানে।
কিন্তু বজবজের বস্তিগুলোর চেহারা কী ভয়ানক হতকুচ্ছিত, তা বলে বোঝানো যায় না। প্রকৃতি কোথাও নেই। সরু দম বন্ধ করা নোংরা এঁদো গলিগুলো যেন চারিদিক থেকে গিলতে আসছে। হস্তিনাপুরের বিধাতা পুরুষ, মোতিহারির পরিত্রাতা গঙ্গাজি এই প্রথম আরেক অন্য সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ালেন, তারপর বহুক্ষণ তিনি কথা বলতে পারলেন না।
তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ করে দিল বন্ধ হয়ে যাওয়া মিলের কর্মীদের হতাশ চোখগুলি। চারিদিকে দারিদ্র্যের প্রকট ছবি। এত শূন্যতা যে থাকতে পারে, গঙ্গাজি জানতেন না। টাকা নেই, খাবার নেই, কাপড় নেই, কাজ নেই, মাইনে নেই, ভবিষ্যৎ নেই—বেঁচে থাকার কোনও কারণই নেই। গঙ্গাজি ভয় পেয়ে গেলেন।
গঙ্গা সারা মুরকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর ভাই এবং অন্যান্য মিল মালিকদের সঙ্গে কথা বলতে চললেন। কী অসম সে দৃশ্য! একজন দৃঢ়চেতা, বড়সড় চেহারার ইংরেজ মহিলা এবং একজন ক্ষীণদেহী টাকমাথা ভারতীয় সাধু চললেন এতগুলো মানুষের জন্য প্রাণভিক্ষা চাইতে।
‘আপনি কেন এই সমস্যায় নিজেকে জড়াচ্ছেন, মিঃ দত্ত?’ মনন্টেগ রাওলাট গঙ্গাজিকে তার ঠান্ডা বিশাল অফিসে বসে জিগ্যেস করল, ‘আমার আর আমার কর্মচারীদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এটা। আমার কোনও আত্মীয়েরও সাহায্য চাই না আমি।’ সে তার বোনের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ‘কিন্তু আপনি এসেছেন বলে আপনাকে বলি, যে আমার ব্যবসার অংশীদার মরলির সঙ্গে কথা বলে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে ওদের মাইনে ৮০ বা ৫০ নয়, ২০ শতাংশ বাড়াব।’
‘কুড়ি?’ সারা দাঁড়িয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন, তাঁর চোখ জ্বলছে, ‘আমি এটা মানতে পারছি না মন্টেগ! চলুন মিঃ দত্ত, আমরা এদের একটু শিক্ষা দিই।’
গঙ্গাজি তাঁর খাটো ধুতি ঠিক করে নিয়ে ইংরেজ মহিলাটির পিছন পিছন বেরিয়ে গেলেন। তিনি ততক্ষণে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করছেন শ্রমিকদের জন্য লড়াই করবেন।
২৪
গঙ্গাজি ব্যাপারটাকে নিজের মতো করে সাজালেন। তিনি একটি অশ্বত্থ গাছের নীচে সবাইকে জড়ো করলেন। জায়গাটা ছিল বজবজের গঙ্গার ধারে। ঠিক যেখানে নদীটা বেঁকে গিয়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেছে। তিনি যেই সকলকে জিগ্যেস করলেন যে তারা ওঁর সঙ্গে থেকে লড়াই করতে রাজি কি না, তারা স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চস্বরে, ‘হ্যাঁ’ বলল।
‘তাহলে শোনো। আমরা আমাদের দাবির একটু রদবদল করব। সারা বহিনের মাধ্যমে তোমরা ৫০ শতাংশ মজুরি বাড়ানোর কথা বলেছ। আমরা সত্যের খাতিরে ততটাই চাইব, যা ন্যায্য। আমরা ৩৫ শতাংশ চাইব, এটা ওরা দিতে পারবে। তোমরা এতদিন যা পেতে তার থেকে এটা যথেষ্ট বেশি।’
শ্রমিকদের থেকে এবারে কিছুটা স্তিমিত উত্তর পাওয়া গেল। কিন্তু যেহেতু তারা গঙ্গার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল কেউ প্রতিবাদ করল না। আন্দোলন চালু রইল।
গঙ্গা তার নিজের মতো করে যুদ্ধ চালিয়ে গেল। এবারের লড়াইটা মোতিহারির চেয়ে একটু অন্যরকম—বস্তির অলিগলিতে ঘুরে দুর্গত মানুষদের উজ্জীবিত করা, কখনও কারও শীর্ণ হাত নিজের হাতের মধ্যে নেওয়া, কারও বা কপাল থেকে ঘাম মুছিয়ে দেওয়া। দিনের শেষে তাঁর শ্রান্ত ছোট্ট শরীরটা সারা মুরের বাড়ির একটা বিশাল বিছানায় যেন হারিয়ে যেত। সারা তাঁকে থাকবার জায়গা দিয়েছিলেন। বিকেল ঠিক পাঁচটায় একটা বড় অশ্বত্থ গাছের নীচে গঙ্গাজি শ্রমিকদের নিয়ে বসতেন। সারা মুরের গাড়ি তাঁকে সেখানে নিয়ে অসত। শান্ত-সৌম্য অবিচল মুখে গঙ্গা নামতেন গাড়ি থেকে। তাঁর ইংরেজ বহিনও নামতেন তাঁর পরে। সারা শুধু বোন নয়, ততদিনে গঙ্গার বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী, অভয়দাত্রী এবং শিষ্যও হয়ে গিয়েছিলেন। সেটা ছিল শীতকাল। বাংলার স্যাঁতস্যাঁতে ঠান্ডা থেকে নিজেকে বাঁচাতে গঙ্গা কখনও কখনও তাঁর হাড়গোড় বার করা শরীরে শাল জড়িয়ে নিতেন। তারপর নাকের ওপর চশমাটা ঠেলে দিয়ে কথা বলতে শুরু করতেন।
খুবই আস্তে, শান্তভাবে কথা বলতেন তিনি। এতই আস্তে যে ভিড়ের শেষপ্রান্তে সব কথা শোনা যেত না। কিন্তু কথা শোনার দরকার নেই। তাঁর সব কথা এরা বুঝতও না। শুধু তাঁর উপস্থিতিই যথেষ্ট ছিল। তাঁর উপস্থিতির জোরেই ক্ষুধার্ত শ্রমিকরা উজ্জীবিত হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল।
তোমার ভুরু কুঁচকে আছে কেন গণপতি? তুমি কি ভাবছ এ এক অন্য গঙ্গা? সেই থার্ড ক্লাস রেলের কামরার গঙ্গা এ নয়? তুমি ভাবছ, কোনও বস্তিতে না থেকে সে সারা মুর-এর বাড়ির আরাম উপভোগ করত, হেঁটে না গিয়ে গাড়ি চড়ে অশ্বত্থগাছ অবধি যেত! কিন্তু যাই ভাবো না কেন, তার আর শ্রমিকদের মাঝে কোনও ব্যবধান ছিল না।
দু-সপ্তাহ এভাবেই চলল। শ্রমিকরা মরিয়া হয়ে উঠল। মিল মালিকদের তেমন ভাবান্তর দেখা গেল না। কতদিন এভাবে চলবে বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু ভাগ্যদেবী ঠিক সময়ে এসে হাত ধরেন। পৃথিবীর যত বড় আবিষ্কার, সবই কিন্তু আচমকা কোনও ভুলভ্রান্তির হাত ধরেই এসেছে! তা সে নিউটনের ঘুমন্ত মাথায় আপেল পড়ার গল্পই হোক বা কলম্বাস-এর আমেরিকা দর্শনই হোক।
মিল মালিকরা যখন দেখল, তাদের কর্মচারীরা একেবারে সহ্যের শেষ সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে, তখন ঘোষণা করল যে লক আউট উঠে যাচ্ছে। আর শ্রমিকদের মাইনে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিকেল পাঁচটার সভায় গঙ্গা ঘোষণা করলেন যে শ্রমিকরা হরতাল শুরু করছে, যতদিন না মাইনে ৩৫ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে। কিছু হাততালি আর স্তিমিত উচ্ছ্বাসের আভাস পাওয়া গেল। খিদে যে কোনও বাধা মানে না!
শ্রমিকরা যে আন্দোলন করতে অরাজি ছিল তা নয়। তারা তো প্রতিদিন গঙ্গার ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের নিজেদের হতাশা ভুলে এগিয়ে আসত। আন্দোলনকে মনোগ্রাহী করার জন্য কিছু গানও বেঁধেছিল।
আহা কী আনন্দ দিলে সেদিন
ছিলাম যখন স্বাধীন
কাজ করে, গান গেয়ে সবাই
নাচতাম তা ধিন তা ধিন
স্বপ্ন কবে সত্যি হবে
জানি না ভাই সকল,
গঙ্গাজির পায়ে পণ করেছি
হবই আমরা সফল।
ন্যায় অন্যায় করেন বিচার
ভক্তের ভগবান
আমরা শুধু নির্ভয়ে করি
আশার জয়গান…
খুবই সাধারণ ভাষা, গণপতি। বেসুরো খসখসে গলায় তারা সমবেতভাবে গেয়ে যেত প্রতি সন্ধেবেলা। গঙ্গাজির বাণীরা তাদের গানের মধ্য থেকে উঠে আসত।
গঙ্গা পরিষ্কার বুঝতে পারছিল, যদি কয়েকজন শ্রমিকও মিলে ফিরে যায়, এতদিনের পরিশ্রম বিফলে যাবে। তাই তিনি একটা ছোট্ট কৌশল করলেন। মিটিং-এর সময়টা বিকেল পাঁচটা থেকে সকাল সাড়ে সাতটায় নিয়ে এলেন। ঠিক যখন সাইরেন বাজিয়ে গেট খোলার সময় হত, তখন।
বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। অশ্বত্থ গাছটির উলটোদিকে মিলের গেট। গঙ্গাজি ক্ষুধার্ত শ্রমিকদের নিয়ে সেখানে জড়ো হয়ে ফ্যাক্টরির মালিকদের দেখিয়ে দিলেন, শত লোভ দেখালেও অন্যায়ের সঙ্গে তাঁরা আপোস করবেন না।
প্রথম দিন কেউ ফ্যাক্টরির গেটের দিকে পা বাড়াল না। গেট খুলে গেল। ফোরম্যান খাকি হাফট্যান্ট পরে শ্রমিকদের দিকে তাকিয়ে রইল। পেটে খিদে যেন তাদের টেনে নিয়ে যেতে চাইল গেটের ভেতরে। কিন্তু কেউ গেল না তাদের প্রতিবাদের মঞ্চ ছেড়ে। ট্রেড ইউনিয়নের কথা তখনও কেউ শোনেনি। তাই এই অভিনব লড়াই দেখে সবাই অবাক হয়েছিল। গঙ্গাজির আপাত নিষ্পৃহতার একটা নেতিবাচক দিক ছিল বই কি! তিনি তাঁর বোধবুদ্ধি দিয়ে সত্যকে যেভাবে অনুধাবন করতেন সেইভাবেই লড়াই চালিয়ে গেছেন অন্যদের দিয়ে। কিন্তু সেই মানুষগুলির কথা কি কেউ ভেবেছে যারা অনাহারে নিজেদের প্রাণ সঁপে দিয়েছিল?
২৫
সেদিন দুপুরবেলা। গঙ্গাজির এক ভলান্টিয়ার, ধরে নাও আমিই, বস্তির কুঁড়ে ঘরগুলোর মধ্যে ঘুরছিলাম। তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কেমন মনমরা হয়েছিল মানুষগুলো। আমার চোখে চোখ রেখে কথা অবধি বলবার ইচ্ছা ছিল না। তারপর একটা লোক তার বাচ্চা মেয়েটিকে বুকে করে বেরিয়ে এল। বাচ্চাটি বহুদিন ধরে অসুস্থ।
‘গঙ্গাজির পক্ষে বলা খুব সোজা। ওঁর কি আসে যায় বলুন? মুর মেমসাহেবের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করে তাঁর গাড়িতে চড়ে তিনি কাটাচ্ছেন। আমাদের কষ্ট কি করে বুঝবেন?’
কেউ যেন এক মুহূর্তে আমাদের চোখের সামনের পরদাটা সরিয়ে দিল। গঙ্গাজি কি ভেবেছিলেন যে তাঁর সৎ উদ্দেশ্য সত্বেও মানুষ তাঁকে অবিশ্বাস করবে? আমি দৌড়োলাম মুর মেমসাহেবের বাড়িতে। গঙ্গাকে খবরটা দিতে। আমরা হলে হয়তো ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করতাম বা আমাদের স্বপক্ষে যুক্তি খাড়া করে শ্রমিকদের বোঝাতাম। আজকের রাজনীতিবিদরা হয়তো কোনও ধনী মানুষের থেকে অনুদান নিয়ে অভুক্তদের পেটে খাবার জোগাতেন। কিন্তু গঙ্গাজি চাইতেন, শ্রমিকরা তাদের নিজেদের লড়াই নিজেরাই চালিয়ে যাক। তিনি বিশ্বাস করতেন যে খিদে-দারিদ্র্য সহ্য করেও এরা যদি জয়ী হয়, তবেই সেটা হবে সত্যের জয়। এই শক্তি একমাত্র তাঁরই ছিল। যদি তিনি বুঝতেন, শ্রমিকদের সেই মনের জোর নেই, তিনি লড়াই শুরুই করতেন না।
‘আমি এই মুহূর্ত থেকে এক ফোঁটা জল বা এক দানা খাবারও গ্রহণ করব না। যতক্ষণ না শ্রমিকদের দাবি মালিকরা মেনে নেয় আমি অনশন করব।’ তিনি বললেন। কী ভীষণ প্রতিজ্ঞা!
‘না না! এ আপনি কী বলছেন? আপনাকে ভালো থাকতে হবে। আমাদের জন্যে, শ্রমিকদের জন্যে।’
সারা বহিন আর অন্য ভলান্টিয়াররাও বলল তাঁর জায়গায় তারা অনশন করবে। গঙ্গাজি রাজি হলেন না। আমাদের তাঁর অনশনের সঙ্গী করতেও রাজি হলেন না।
‘শ্রমিকরা আমাকে তাদের নেতা মেনে নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এখন যখন তাদের বিশ্বাস টলে গেছে, আমাকেই এগিয়ে গিয়ে হাল ধরতে হবে।’ তারপর সেই বজ্রকঠিন অথচ শান্তগলায় তিনি যা বললেন তা আজও ইতিহাসের বই-এ লেখা আছে—’অনশন, আমার পন্থা।’ তিনি কীভাবে কথাটি বলেছিলেন সেটা বড় কথা নয়, তার গূঢ় গম্ভীর তত্বটাই আসল। আজ তো এটা মুখে মুখে ফেরা একটা স্লোগানে পর্যবসিত হয়েছে। গঙ্গাজি কিন্তু এই কথাটা আর কখনও বলেননি।
পরের দিন ভোরে তিনি সারা বহিনের বাড়ি থেকে হেঁটে মিলের পথে অশ্বত্থগাছ অবধি পৌঁছোলেন।
তাঁর এবার একটা লাঠির দরকার হচ্ছিল। কিন্তু সেটা তাঁর শারীরিক প্রয়োজনে কতটা লাগছিল, জানি না। আমরা সবাই তাঁর সঙ্গে ছিলাম। আমরা মিছিল করে বস্তির মধ্যে দিয়ে চললাম। বাচ্চারা দৌড়ে বেরিয়ে এসে আমাদের দেখেই তাদের বাবাদের খবর দিতে ছুটল।
‘গঙ্গাজি একটা ভীষণ প্রতিজ্ঞা করেছেন,’ সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। ‘ভীষ্ম একটা ভীষণ প্রতিজ্ঞা করেছেন।’ সকাল ৭-২৫-এ তিনি অশ্বত্থ গাছটার নীচে পৌঁছোলেন। তাঁর চারিদিকে বিশাল জনতার ভিড়।
‘আমার ভাইবোনেরা,’ গঙ্গা বললেন হাতজোড় করে, ‘আমি জানি আপনাদের কাছ থেকে অনেক আত্মত্যাগ চেয়েছি এতদিন। কারুর হয়তো মনে হয়েছে এ যুদ্ধ বড়ই অসম। কিন্তু আমি তাও আপনাদের বলেছি শক্তি সঞ্চয় করে রুখে দাঁড়াতে। এই মুহূর্তে একজনও দুর্বল হয়ে পড়লে, অন্যদের মনোবল ভেঙে পড়বে। আপনারা বলতে পারেন, আমার কথা আপনারা মানবেন কেন? আমি আপনাদের কাছে ভগবানের নামে শপথ করছি, যতদিন আপনাদের মাইনে ৩৫ শতাংশ না বাড়ানো হচ্ছে, ততদিন এক ফোঁটা জল অবধি গ্রহণ করব না।’
সবার সমবেত দীর্ঘশ্বাসে মনে হল যেন কোনও আগ্নেয়গিরি উদ্গারের অপেক্ষায় রয়েছে। তারপর সবাই শ্বাস বন্ধ করে রইল গঙ্গার পরের কথাগুলো শোনার জন্য।
‘আমি আপনাদের বলেছি যে সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য মৃত্যুপণ করুন। এ শুধু কথা নয়, আমার বিশ্বাস। যদি শেষ অবধি আপনারা ন্যায়বিচার না পান আমি মৃত্যুবরণ করতে ডরাই না।’
আগ্নেয়গিরি এবার উদগার করল। সবাই দাঁড়িয়ে উঠে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল। প্রার্থনা, প্রশংসা, স্লোগান, সব মিলিয়ে মনে হতে লাগল যে গঙ্গাজিকে ঘিরে এক মহাযজ্ঞ হচ্ছে। এর মধ্যে এক মুসলমান ভাই, লাল ফেজ টুপি পরে লাফিয়ে উঠে একটা ছুরি বের করল। মনে হল এই বুঝি প্রাণটা দেয় আর কি! নাকি সে ইংরেজদের প্রাণ নেওয়ার কথা বলছিল? সবাই তাকে উৎসাহ দিতে থাকল। বোঝাই গেল গঙ্গার দর্শন তখনও সবার বোধগম্য হয়নি।
গোটা দেশ উৎকর্ণ হয়ে গঙ্গার কর্মকাণ্ড দেখতে লাগল। বাংলার বজবজ বিখ্যাত হয়ে উঠল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ততদিনে প্রতিবাদ, বয়কট, আগুনে বিদেশি জিনিসপত্র নিক্ষেপ, নেতাদের বাণী, ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ, বোমা ইত্যাদি সবই দেখেছে। কিন্তু কেউ কখনও অনশন করে মৃত্যুবরণ করার কথা বলেনি। গোটা দেশ উৎকর্ণ হল। অনেকেই ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে চাইল না। কিছু উগ্রপন্থী ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মেসের হলগুলিতে আগুন ধরিয়ে দিল গঙ্গাজির প্রতি তাদের সহানুভূতি দেখাতে। কেউ কেউ বলছিল, তাদের মেসের রান্না পছন্দ হচ্ছিল না বলে তারা রেগে ছিল অনেকদিন ধরে। ইন্ডো-আইরিশ হোমরুল লিগের প্রধান, এক স্কটিশ ভদ্রমহিলা গঙ্গাজিকে বললেন, এই সামান্য কারণে প্রাণত্যাগ করার কোনও মানে হয় না। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সবচেয়ে বড় ইংরেজি কাগজ অবশ্য এই ঘটনাকে ভেতরের পাতায় মাত্র তিন ইঞ্চি জায়গা দিয়েছিল। একজন সৌম্যকান্তি আমেরিকান অধ্যাপক গঙ্গাজিকে জিগ্যেস করেন, তিনি তাঁর বাবার ওপর রাগ করেছিলেন কি না।
স্কটিশ মিল মালিকরা ব্যাপারটা বুঝতেই পারল না। ‘ও বোকামি করছে সারা,’ মন্টেগ বোনকে বললেন, ‘এ তো বাচ্চা মেয়ে ললিপপ না পেলে করে। শ্বাস বন্ধ করে থাকে যতক্ষণ না নীল হয়ে যায়। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে ও নিজেকে জড়াচ্ছে কেন? এ তো আমাদের আর শ্রমিকদের সমস্যা। ওর কী যায় আসে?’
২৬
‘ব্ল্যাকমেল।’ সারা বহিন গঙ্গাজিকে বললেন। তিনি অশ্বত্থ গাছের নীচে ঝুঁকে পড়ে বই পড়ছিলেন। ‘মিল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশন বলছে আপনি ব্ল্যাকমেল করছেন।’
‘ওরা ভুল বলছে।’ গঙ্গার গলা তেষ্টায় খসখসে। স্বর ক্ষীণ, আমার অনশনের সঙ্গে ওদের সিদ্ধান্তের কোনও সম্পর্ক নেই। আমি ওদের মত পালটাব বলে অনশন করছি না। সেটা হবে ব্ল্যাকমেল। আমার প্রাণ বাঁচাতে ওদের ৩৫ শতাংশ মাইনে বাড়াতে হবে না। ওইভাবে আমি জিততে চাই না। আমি অনশন করছি শ্রমিকদের মনের বল বাড়াতে। যাতে তারা সত্যের জন্যে, ন্যায়ের জন্যে লড়াই করতে শেখে। আমি কাউকে হুমকি দিচ্ছি না। তুমি তোমার ভাইদের আর মিল মালিকদের সেটা বলতে পারো।’
সারা চেষ্টা করেছিলেন। তিনি এই ফকিরটির কথা, তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সহজেই বুঝেছিলেন। এটা রহস্য থেকেই যাবে যে গঙ্গাজির হস্তিনাপুরের আত্মীয়দের চেয়েও অনেক সহজে এই বিদেশি মহিলা কী করে তাঁর মনোভাব বুঝতে পারতেন। ভারতীয় দরিদ্র্যের করুণ ছবিটা সারা নিজেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। বস্তির মানুষের দুঃখে তাঁর প্রাণ, গঙ্গাজির সংস্পর্শে আসার অনেক আগেই কেঁদেছিল। তাই হয়তো ওঁদের পরস্পরের বোঝাপড়া এত সহজ হয়েছিল।
ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে গরিব আর নিম্ন মধ্যবিত্তদের কথা গঙ্গাজির আগে কেউ কি বলেছিল? সারা নিয়মিত মিলের কেরানিদের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করতেন। তিনি ভারতীয় সভ্যতার অঙ্গ, স্বার্থহীন জীবনযাপনকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছিলেন। ভারতীয়রা হাসিমুখে উপোস করে, নিজেদের সব থেকে প্রিয় খাবার থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে, এমনকী অত্যন্ত জরুরি খাদ্যবস্তুও দিনের পর দিন দূরে ঠেলে রাখে—কী জন্যে? তাদের কাছে আধ্যাত্মিকতার দাম শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে অনেক বেশি। পাশ্চাত্যের মহিলারা নিজেদের ফিগার ঠিক রাখার জন্য ডায়েটিং করেন ভারতীয় মহিলারা উপোস করেন সংসারে স্বামী-পুত্রের মঙ্গল কামনা করে।
সারা বুঝেছিলেন, গঙ্গা ব্ল্যাকমেল করছেন না। তার ভাই আর মিল মালিকেরা এ সব কী করে বুঝবেন? তাঁরা এ সব হিঁদুয়ানির গূঢ় তত্বের ধার ধারতেন কি?
গঙ্গার শরীর ভাঙতে থাকল। তিনি একেবারে শীর্ণকায় হয়ে পড়লেন। তাঁর নিষ্পলক চোখ আর অস্থিচর্মসার শরীরের কাঠামো নিয়ে বেঁচে রইলেন। সারা দেশ থেকে মানুষ তাঁকে দেখতে আসতেন। খবরের কাগজে বড় বড় করে খবর ছাপা হতে লাগল। তাঁর চারপাশে জড়ো হওয়া ভারতীয়দের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে থাকল। ভয় পেয়ে মিল মালিকরা ডাক্তার পাঠাল। তারা গঙ্গাজিকে দেখে বললেন, তাঁর শরীরের অবস্থা গুরুতর। যদি এই মুহূর্তে কিছু না করা হয়, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম শিগগিরি তার প্রথম অহিংস শহিদকে পুরষ্কার হিসেবে পাবে।
আমরা রাতদিন এক করে তাঁকে শুধু শুধু বোঝাবার চেষ্টা করতাম। তিনি কোনও মধ্যবর্তী পথের কথা কানে তুললেন না। কিছুদিন পরে তিনি সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। আমাদের দেখলে মুখ ফিরিয়ে নিতেন। দশম দিনে আমরা হাল ছেড়ে দিলাম। সারা বহিন কাঁদতে কাঁদতে মুখ লুকিয়ে চলে গেলেন।
এবার সরকার নড়ে চড়ে বসল। ইংরেজ সরকার বুঝতে পেরেছিল, একটা সাংঘাতিক পরিণতির দিকে ব্যাপারটা এগোচ্ছে। একটা স্পষ্ট কড়া বার্তা গেল মিল মালিকদের কাছে। ‘মেনে নাও।’
‘পঁয়ত্রিশ শতাংশ।’ সারা বহিন হাঁপাতে হাঁপাতে একটা কাগজ হাতে নিয়ে পাগলের মতো ছুটে এল অশ্বত্থ গাছটার নীচে—’তুমি জিতলে গঙ্গাজি!’
‘না, আমার বোন।’ ক্ষীণ গলায় বললেন তিনি। শীর্ণ হাতটি বাড়িয়ে দেখিয়ে দিলেন আনন্দে আত্মহারা শ্রমিকদের দিকে, ‘ওরা জিতেছে।’
এক গেলাস কমলালেবুর রস এনে দেওয়া হল তাঁকে। সারা বোন গেলাসটি তাঁর মুখে ধরলেন। এতদিনের শুকনো গলা আর্দ্র হয়ে উঠল। আর তাই দেখে উন্মাদ উল্লাসে মেতে উঠল এই ঋষি পুরুষটির সঙ্গীরা। তাঁর কণ্ঠের ওঠানামা দেখে মনে হচ্ছিল তিনি এবং বাকি সবাই আবার জীবন ফিরে পেল। কমলা লেবুর ফলন সে বছর টক হয়েছিল। কিন্তু সেদিন সবই কী মিষ্টি লেগেছিল, গণপতি!
সেদিন কী নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম গণপতি কী বলব! গঙ্গাজি পরে তাঁর জীবনীতে বলেছিলেন, তাঁর হঠাৎ করে অনশনের সিদ্ধান্তের পিছনে দৈবকারণ ছিল। তিনি বলেছেন, তাঁর অন্তরাত্মা তাঁকে এই পথে চালিত করেছিল। এ ছিল তাঁর অগ্নিপরীক্ষা। শ্রমিকরা তাঁর দ্বারা চালিত হচ্ছিল। তাই তিনি অনশন করে তাদের শপথ ভঙ্গ থেকে বিরত রেখেছিলেন। এই অনশন তাঁর আগামী দিনের সংগ্রামের পথ ঠিক করে দিল। ‘মিটিং করে যে ফল আমি পাইনি, অনশনের সিদ্ধান্ত মুহূর্তের মধ্যে তা সম্ভব করে দিল।’ তিনি লিখেছিলেন।
কিন্তু আসলে কী হল জানো? ওরা প্রথম দিনের কাজের জন্য মাত্র পঁয়ত্রিশ শতাংশ মাইনে বাড়াল। সরকারি যে ফরমুলা তৈরি হয়েছিল তা হল এই যে দ্বিতীয় দিনে হবে ২০ শতাংশ এবং বাকি দিনগুলিতে ২৭.৫ শতাংশ। ব্যাপারটা সরকারের হাতে চলে গেল। কী অভিনব কৌশল বলো তো! ৩৫ শতাংশে গঙ্গাজির অনশন ভাঙল। ২০ শতাংশে মিল মালিক খুশি রইল। অন্য কোনও শ্রমিক হরতালের সুযোগ পেল না ২৭.৫ শতাংশে। মনে হল কী মহানুভব এই সরকার! গঙ্গা ওদের অশুভ শক্তি ভেঙে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাঁর অঙ্ক সবসময় মেলেনি।
কিন্তু অঙ্কের উনিশ-বিশ নিয়ে শ্রমিকরা মাথা ঘামায়নি। তারা নেচে-গেয়ে তাদের জয়ে আনন্দ উপভোগ করতে লাগল। গঙ্গার পায়ে পড়ে গিয়ে, তাঁকে মালা পরিয়ে এক অভিনব উৎসব শুরু করল শ্রমিকরা। তাঁর ভলান্টিয়াররা ভেট পেল নারকোল আর নদীর মাছ। সারা বহিনকে একটা সরু কালোপাড়ের শান্তিপুরি তাঁতের শাড়ি উপহার দিয়েছিল শ্রমিকরা। তিনি আনন্দে কেঁদে ফেললেন। তিনি সেই সন্ধেতেই শাড়িটা পরেছিলেন। তার পরে কখনও আর পাশ্চাত্যের কোনও পোশাক পরেননি।
আমি তোমায় বোঝাতে পারব না গণপতি, সেই প্রথম জয় আমাদের কী আনন্দ দিয়েছিল! আমাদের সংগ্রামকে কতটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। যদিও ফলস্বরূপ আমরা মাত্র ২৭.৫ শতাংশ মাইনে বাড়াতে সফল হয়েছিলাম। কিন্তু সেই অন্ধকার সময়ে ওই জয়টুকুকে পাথেয় করে আমরা এগিয়ে চললাম। আমাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হল। অহিংস পন্থা একটি আন্দোলনের আকার নিল, খুব দ্রুত।
অনশনকে অস্ত্র করে নিতে শেখালেন গঙ্গাজি। এ অস্ত্র তো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না! নিজের দুর্বলতা যখন অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায় তখন মানুষ দুর্জয়, অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। গঙ্গাজির অনশনের অহিংসপন্থা সারা দেশকে সংগ্রামের একটা নতুন রাস্তা দেখিয়ে দিল। যা কোনও বক্তৃতা, কোনও প্রার্থনা, কোনও বোমা এতদিন করতে পারেনি।
গঙ্গাজির অনশন-এর সাথী হল সারা দেশের ছাত্র-যুবা। গ্রামগুলিতে লণ্ঠন জ্বলল না। সবাই তাঁর সঙ্গে দুর্যোগের আঁধার ভাগ করে নিল। গঙ্গাজি বুঝেছিলেন, অশুভকে জয় করতে গেলে মরণপণ করে এগিয়ে যেতে হয়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের এটাই হয়ে গেল মূলমন্ত্র। গঙ্গাজি প্রতিবার তাঁর নিজের জীবনকে বাজি রাখতেন। সেই স্নায়ুর লড়াই-এ ইংরেজরা পিছু হটছিল, কারণ গঙ্গাজির সঙ্গে লড়াই করতে গেলে তাদের যে দাম দিতে হত, তা দেওয়ার ক্ষমতা ওই স্বৈরাচারীদের ছিল না।
নিজের ক্ষতি করে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করতে একমাত্র ভারতীয়রাই পারে। তাই বোধহয় গঙ্গাজির অনশন-এর রাজনীতি এখানে এত সাড়া ফেলে দিয়েছিল। অপরের ক্ষতি তো সবাই করতে পারে কিন্তু নিজের ক্ষতি করার শক্তি ক’জন রাখে? দুঃখের ব্যাপার, পরবর্তীকালে অনশনকে অনেক মানুষ নির্লজ্জের মতো নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করেছেন। অনশন তখনই কার্যকরী হবে যখন শত্রুপক্ষ সংগ্রামকারীর জীবনের দাম নিজের সংস্কারের তুলনায় বেশি মনে করবে। সমাজ সংগ্রামকারীকে সামগ্রিকভাবে যখন নেতা মেনে নেয়, তখনই এটা সম্ভব। গঙ্গাজির নিজের জীবনটাই একটা উদাহরণ। তাঁর মতো সত্যান্বেষী যখন অনশন করেন, তখন সবাই তটস্থ হয়ে থাকে। শত্রু পক্ষ ভয় পায়। কিন্তু অন্য কোনও সাধারণ নেতা সেটা করলে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হয় না। তখন, ব্ল্যাকমেল মনে হয়। অগ্নিপরীক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা কি সবার থাকে?
কত ভণ্ড তপস্বী আছে যারা অনশনে নামে। পরদার আড়ালে গিয়ে মাঝে মাঝেই উদরপূর্তি করে আসেন। নিজের অন্তরাত্মাকে জয় করা কি এতই সহজ? সেই জন্যেই সরকার এইসব নেতাদের দাবিগুলোর প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয় না। তারা জানে, অনশনকারী কোনওদিনই আমৃত্যু অনশন করবে না।
আজ তো অনশন ব্যাপারটা প্রতীকী হয়ে দাঁড়িয়েছে। রিলে অনশন নামক উদ্ভট জিনিসের কথা গঙ্গাজি কি ভেবেছিলেন? গঙ্গাজির মন্ত্রটা এই সব লঘু ব্যাপারের মধ্যে হারিয়ে গেল! আজ শুধু রাজনীতির নামে নাটক হয়—কেউ আত্মত্যাগ করে না।