দ্বাদশ অধ্যায়। যে রাজা হতে পারল না

দ্বাদশ অধ্যায়। যে রাজা হতে পারল না

৭১

তাহলে কি মৃত্যু, ধ্বংস আর হতাশা ছাড়া স্বাধীনতার সেই প্রথম দিনগুলোর কিছুই আমার মনে নেই? না গণপতি, সেই মাতাল আনন্দের কথা মনে আছে বই কি! ১৯৪৭-এর কিছু ছোট ছোট ঘটনা মনে আছে, যা বুঝিয়ে দিয়েছিল যে অবস্থা পালটে গেছে। দেখলাম ইংরেজ সম্পাদকরা হঠাৎই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গুণ গাইছেন।

আগেকার সেই সব নোটিস বোর্ড, যাতে লেখা থাকত, ‘ভারতীয় এবং কুকুর এই সীমানার বাইরে থাকবে’, সেসব খুলে নেওয়া হল। স্বাধীনতার সময়ে মধ্যরাত্রে যে বাচ্চারা জন্মাল, তাদের দিয়ে একটা গোটা প্রজন্ম চিহ্নিত হল এবং সাহিত্যে তাদের নাম হল, ‘মধ্যরাতের সন্তানেরা’। সাহেব আমলারা তাড়াতাড়ি নিজেদের অবসর এগিয়ে এনে দেশে পাড়ি দিল। দেখল, ভারতীয়রা হঠাৎ-ই তাদের ওপরে গিয়ে বসেছে।

জয়প্রকাশ দ্রোণ’র কথাই ধরা যাক। সে হয়েছিল প্রশাসনিক সংস্কার বিষয়ক মন্ত্রী। গেরুয়া পোশাক পরে, কালো লম্বা দাড়ি টেবিলের ওপর অগোছালো ভাবে রেখে সে গম্ভীর হয়ে বিচার করত, কোন কাগজে সই করবে আর কোনটায় করবে না।

‘এ সব রুটিন কাগজ, স্যার। বার্ষিক ছুটির তালিকা। এই ছুটিগুলো নেওয়া হয়ে গেছে…।’ আমলারা বোঝাত।

‘তাই নাকি?’ দ্রোণ সন্দেহের সঙ্গে বলত।

‘এই ফাইলে রয়েছে, কীভাবে সাহেব আমলাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তাদের ক্যারিয়ারে হঠাৎ করে ছেদ পড়ে গেল তো স্যার!’

‘না।’

‘কিন্তু স্যার, সব হিসেব-নিকেশ করেই এটা করা হয়েছে। কতদিন চাকরি বাকি আছে, বা অফিসার কত সিনিয়র, সব ধরেছি স্যার।’

‘না।’

আমলাটি ঢোঁক গিলে কাগজটিকে ‘পেন্ডিং’ ট্রেতে রেখে দিল।

‘এই ব্যাপারটা খুবই সামান্য, স্যার। এই ব্রিটিশ অফিসারটির সবই প্রায় খোয়া গেছে পার্টিশনের রায়টে। আজ সকালেও সে এখানে এসেছিল আবেদন করতে। আমরা যদি একে একটা বিশেষ অনুদান দিই, যেমন ছয় মাসের মাইনে যদি তাকে দিয়ে দিই আর তার মালপত্র, যেগুলো আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে, সেগুলো জাহাজে নিয়ে যেতে গেলে যা খরচ হয় তা যদি দিয়ে দিই, তাহলে হিসলপ আবার জীবন শুরু করতে পারে, স্যার।’

দ্রোণ পেন তুলে নিয়েছিল। হিসলপ নামটা শুনেই হাত তুলে নিল!

‘হিসলপ?’

‘হ্যাঁ, স্যার।’

‘রোনাল্ড হিসলপ?’

সেক্রেটারি মাথা নাড়ল।

‘সে এখন এখানে আছে? তাকে পাঠিয়ে দাও। আমি কথা বলব।’

রোনাল্ড হিসলপ ঘরে ঢুকল। সে একটা বড় সাইজের স্যুট পরে আছে। তার নিজেরগুলো আগুনে পুড়ে গেছে, এটা তার বন্ধুর। বোধহয় খানিকটা খর্বুটেও হয়ে গেছে।

‘মিঃ হিসলপ, আমায় চিনতে পারছেন?’

প্রথমে সাহেব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে তার মনের অতল থেকে কিছু উঠে এল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। দেবী হিল-এর ঘটনা। তুমি ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা নিয়ে অনেক কথা বলেছিলে আমাকে।’

‘তোমার পরিবর্তন দেখে খুশি হলাম।’ দ্রোণ ইংরেজিটাকে যতটা পারল ভারতীয় উচ্চারণে বলল, সে যে স্বদেশি নেতা সেটাকে আরও প্রকট করার জন্য, ‘তারপর আমাদের আবার দেখা হয়েছিল। মনে আছে?’

হিসলপ এবার লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।

‘তোমায় মনে করিয়ে দিই, মিঃ হিসলপ? সেই ভিজিটিং কার্ড, তারপর, গৌস মহম্মদ পার্স লাও? মনে পড়ল?’

হিসলপ কী একটা বলতে চেষ্টা করল। তার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না।

‘এবারে তোমার পালা।’ দ্রোণ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আমার কি করা উচিত? ঘাউস মহম্মদকে ডাকব?’

হিসলপ লাল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

দ্রোণ বেল বাজাল। একজন পিয়ন ছুটে এল।

‘সেক্রেটারি সাহাবকে ডাকো।’

স্যার বেডারলি ট্যুইট তৎপর হয়ে ঘরে ঢুকলেন। মুখে আশঙ্কা।

‘স্যার বেডারলি, আপনি এই সাহেবটির, অর্থাৎ শ্রীহিসলপের ফাইলটাই দেখাচ্ছিলেন না?’

স্যার বেডারলি ফাইলটা এগিয়ে দিলেন।

‘হুঁ। বিশেষ এককালীন ভাতা দেওয়া হোক যাতে মিঃ হিসলপের আংশিক ক্ষতিপূরণ করা যায়। ডিউটি করতে গিয়ে তার প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল পার্টিশনের রায়টে।’ এই বলে দ্রোণ বেডারলির দিকে তাকালেন, ‘আমাদের এইভাবে লেখা শিখতে হবে ইংরেজদের থেকে! আচ্ছা, শ্রীহিসলপের ঠিক কী কী ক্ষতি হয়েছিল? সেইসময়ে তিনি ঠিক কী কাজ করছিলেন?’

‘ওরা আমার বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। আমার সব জিনিসপত্র জ্বলে গেছিল। আমি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলাম। জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়ি। নাকে পোড়া গন্ধ পেয়ে আমি জেগে যাই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সব ভস্মীভূত হয়।’

‘খুবই খারাপ।’ দ্রোণ জিভ দিয়ে দুঃখসূচক শব্দ করল, ‘তা আপনি তখন ঘুমোচ্ছিলেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনি ডিউটিতে ঘুমোচ্ছিলেন?’ হিসলপ কিছু বলতে পারল না।

বেডারলি চেষ্টা করল তাকে সাহায্য করতে, ‘স্যার, ঘুমোতে তো সকলকেই হবে!’

দ্রোণ কথাটায় কান দিল না, ‘তখন শহরে রায়ট হচ্ছিল?’

‘হ্যাঁ।’ হিসলপ উজ্জীবিত হয়ে বলল, ‘কী বীভৎস ব্যাপার হয়েছিল! হিন্দু-মুসলমান দু-পক্ষ একে অপরকে খুন করছিল। মুসলমানেরা হিংস্রতা দেখিয়েছিল।’ হিসলপ তাড়াতাড়ি বলল, দ্রোণের গেরুয়া পোশাক লক্ষ্য করে, ‘তারপর দু-পক্ষই ইংরেজদের আক্রমণ করল।’

‘খুব বড় রায়ট, তাই না?’

‘হ্যাঁ, ভীষণ বড়।’

‘আর আপনি ঘুমোচ্ছিলেন? একটা বড় রায়ট বাধল হিজ ম্যাজেস্টির রাজত্বে আর আপনি ঘুমোচ্ছিলেন? আপনার তো দু-পক্ষকে বুঝিয়ে শান্ত করা উচিত ছিল। সেটাই তো আপনার ডিউটি ছিল, তাই না?’

‘কিন্তু—’ হিসলপ তোতলাতে লাগল। তারপর যখন সে দেখল দ্রোণ তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে তখন আবার বলে উঠল, ‘অ্যাঁ, হ্যাঁ, আ-আমি…ঠিকই বলেছেন…উচিত ছিল…আমি দুঃখিত।’

এবারে দ্রোণের মুখে খুশির ছোঁয়া দেখা দিল, ‘আপনার সঙ্গে সেদিন দেখা হওয়ার পর আমি অনেক কিছু শিখেছিলাম, মিঃ হিসলপ। সেদিন আপনি ওই ব্যবহার না করলে, আজ আমি এখানে থাকতাম না। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।’ দ্রোণ হাসল। তারপর সে ফাইলের কাগজগুলো ভালো করে পড়ে নিয়ে আবার তাকাল হিসলপের দিকে। ‘আপনার দুর্ভাগ্যের কথা পড়ে আমি খুবই দুঃখিত হলাম। স্যার বেডারলি আপনার হয়ে যা যা অনুরোধ করেছেন আমি নিশ্চই তা অনুমোদন করব।’

‘এই অনুরোধও করা হয়েছে, আপনাকে যেন নতুন দিল্লিতে ট্রান্সফার করা হয়। আমি সেটাও অনুমোদন করছি।’

‘হ্যাঁ, এতে আমার মঙ্গল হবে। আমার জেলায় এত গন্ডগোল হয়েছে যে সেখানে আর ফিরে যেতে চাই না।’ হিসলপ মাঝপথে থেমে গেল। তার পক্ষে ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘আপনাকে আমার ডিপার্টমেন্টে ট্রান্সফার করছি। আপনি যতদিন ইচ্ছে এই সরকারের চাকরি করতে পারেন। আপনাকে স্বাগত জানাই। আশা করি, আমরা একসঙ্গে অনেক কাজ করতে পারব।’

হিসলপ দাঁড়িয়ে উঠে হাত বাড়িয়ে দিয়ে দেখল যে মন্ত্রী নমস্কার-এর ভঙ্গিতে দু-হাত জোড় করে রেখেছেন। সে বাড়ানো হাত গুটিয়ে নিয়ে প্রতি নমস্কার জানাল।

৭২

বলাই বাহুল্য, স্বাধীনতার সেই প্রথম আনন্দ-উচ্ছল দিনগুলিতে জর্জিনা ড্রুপ্যাড নিয়মিত আমার অন্ধ ছেলের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হত। তার স্বামী তখন নিজের ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল টাইটেল দুটি হস্তান্তরে ব্যস্ত। আমি-ই হলাম তাঁর প্রথম ভারতীয় উত্তরসূরি। কিন্তু প্রথম ভারতীয় গভর্নর জেনারেল হিসেবে ফিতে কাটা আর নারকোল ফাটানো শেষ হওয়ার আগেই ভারতে এল তার প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, এভরি ডগ হ্যাজ হিজ ডে, কিন্তু তোমার এই টেরিয়ারটির জীবনে সন্ধে নেমে এল বিকেলের চা খাওয়ার অনেক আগেই।

জর্জিনা ড্রুপ্যাড কিন্তু ইংরেজ ফিরে যাওয়ার পরেও বারে বারে ভারতে এসেছে। প্রতিবারই ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে বিদায়ী সম্বর্ধনা নিয়ে ফিরে গেলেও খুব শিগগির দেশের প্রথম পর্যটক হয়ে ফিরে আসে। প্রিয়া দুর্যোধনীর বাবা ছিল তার প্রধান লক্ষ্য।

মিলন বিফলে গেল না তাদের। সে আবার ফিরে এল। এবারে তার অজ্ঞাতবাসে। পরনে বেশিরভাগ সময়ে বড় বড় কাফতান। ২৫ জানুয়ারি, ১৯৫০ সাল। যেদিন স্বাধীন ভারত তার নিজের সংবিধান পেল, সেদিন জর্জিনা ড্রুপ্যাড সময়ের অনেক আগেই শিশু সন্তান প্রসব করলেন।

বাচ্চাটির গায়ের রং ভারতীয় এবং ইউরোপীয় মেশানো। তাকে মানুষ করার দায়িত্ব দেওয়া হল একজন নীচু জাতের কর্মচারীকে। বাচ্চাটির নিজের বাবা-মা’র ক্ষমতা ছিল না তাকে সর্বসমক্ষে স্বীকৃতি দেবার। তাই তাকে দত্তক নিল মোকড়াশি পদবিধারী এক ভদ্রলোক। বাচ্চার নাম ড্রুপ্যাডের অপভ্রংশ দ্রৌপদী রাখা হল। দ্রৌপদী মোকড়াশি। গণপতি, আমরা তাকে দেখতে পাব এর পরের অধ্যায়গুলিতে।

৭৩

সবই পরিবর্তনশীল, গণপতি। পৃথিবী ভাঙছে, গড়া হচ্ছে, আবার ভাঙছে। ভারতও জন্মেছে। জন্মের পরিণতি ঘটেছে তারপর আবার পুনর্জন্ম হয়েছে। ভারত এক এবং অনন্ত।

ধৃতরাষ্ট্র যে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিল, সেই ভারতের উত্থান হয়েছিল এক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। সেটাও এই জন্ম এবং পুনর্জন্মের একটি অধ্যায়। পার্টিশন এবং তার পরবর্তী দুঃখ-দুর্দশাও এই বিবর্তনের একটি অঙ্গ। পৃথিবীর ঘটনাপ্রবাহ বেশিরভাগই হল হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া ঘটনা, নাটকীয় মুহূর্ত, সমাপতন এবং দুর্ঘটনার এক সমষ্টি।

আমি যত সহজে বলছি, ব্যাপারটা যে তত সহজ নয় তা তুমি পার্টিশন আর রায়টের ধারাবিবরণী শুনে এতদিনে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ। এই জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্মের যে বৃত্ত তা আজকের অনিশ্চয়তার গর্ভ থেকে, অজস্র রক্তপাতের মধ্য দিয়ে আগামী কাল হয়ে জন্মগ্রহণ করে।

তাহলে গল্পটা এইরকম দাঁড়াল—গঙ্গাজি মারা গেলেন, তাঁর খুনি শিখণ্ডিনকে ফাঁসি দেওয়া হল, কর্ণস্থানকে ভারত থেকে কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হল, ধৃতরাষ্ট্র প্রধানমন্ত্রী হল একটা অশান্ত, ক্ষুধার্ত এবং রক্তাক্ত দেশের। আর এই সবের মধ্যে থেকে দ্রৌপদী মোকড়াশি বেড়ে উঠল একটি সুন্দরী, প্রশংসনীয়, কমনীয় এবং জটিল একটি রমণীতে। আমাদের গল্পের অনেকখানি জুড়ে সে থাকবে।

সেই শুরুর দিনগুলোতে ভারত ছিল সতত পরিবর্তনশীল।

রাজা এবং তাদের রাজত্বগুলির ভবিষ্যৎ কী হবে তাই নিয়ে প্রচুর তর্ক ছিল। এগুলির বেশিরভাগ ছিল ব্রিটিশের আয়ত্বের বাইরে। হস্তিনাপুরের কথা ছিল আলাদা। কারণ গঙ্গাজি ব্রিটিশদের রাগিয়ে দিয়েছিলেন বলে হস্তিনাপুরকে তারা রাজ-এর সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে শিক্ষা দেওয়া। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার আগে এই সব রাজাদের বুঝিয়েছিল যে তাদের হয় ভারত নয়তো কর্ণস্থানের সঙ্গে জুড়ে যেতে হবে। বেশিরভাগ রাজাই তার ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে ঠিক করে নিল কোনদিকে যাবে। কোনও কোনও খুব বড় রাজ্য আবার ঠিক করে নিল যে তারা নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রাখবে। মনিমির তেমনই একটা রাজ্য।

ছয় শতক থেকেই মনিমির রাজনৈতিকভাবে ভারতের অঙ্গ। তার সবুজ উপত্যকা এবং বরফে ঢাকা চুড়ো নিয়ে মনিমির এক অতি মনোরম রাজ্য। এখানকার রাজা ছিল রাজপুত। ভারতের পশ্চিম উপকূল থেকে আসা রাজপুতদের এক প্রশাখার বংশধর। রাজা যদিও তাঁর বংশের একটা দৈব চেহারা দেওয়ার জন্য নিজেকে শিবের বংশধর বলতেন। সে যাই হোক না কেন, মহারাজ ব্যভিচার সিং তাঁর নামমাহাত্ম্য বজায় রাখতে এমন সব কাণ্ড করেছিলেন যে ব্রিটিশ আদালতে তাঁকে দেখা যায়।

মনিমিদের চারিপাশের রাজ্যগুলি হয় ভারত নয় কর্ণস্থানের সঙ্গে মিলিত হল। তাদের রাজারা পার্লামেন্টে সিট পেয়ে অত্যন্ত খুশি হল। কিন্তু ব্যাভিচার সিং সেসব চান না, তিনি সিংহাসন আঁকড়ে বসে রইলেন। নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করে তিনি ভারত এবং কর্ণস্থানে ‘অ্যাম্বাসাডার’ পাঠিয়ে দিলেন, বলাই বাহুল্য তাদের কেউ পাত্তা দিল না।

মনিমির নিয়ে তেমন মাথা ঘামানোর কিছু ছিল না, যদি না সে রাজ্যটি ভারত এবং মিঃ নিকোলাস-এর গড়ে দেওয়া কর্ণস্থান-এর মধ্যে দ হয়ে থাকত। আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, রাজা হিন্দু হলেও, এখানকার বেশিরভাগ মানুষ মুসলমান।

‘ওই শরীরসর্বস্ব ব্যভিচার সিংকে আর সময় দেওয়া যাবে না।’ মহম্মদ রফি বললেন, ‘ও সিদ্ধান্ত নিতে এত দেরি করে দিচ্ছে যে কর্ণ সময়টা ব্যবহার করছে সাম্প্রদায়িক হাওয়া তুলে দিয়ে রাজ্যটাকে কর্ণস্থানের সঙ্গে যুক্ত করতে। আমরা মনিমিরকে কিছুতেই হারাতে পারি না।’

কর্ণর দিকে এক বিরাট সংখ্যক মনিমিরবাসী মুসলমান জনসাধারণ একত্রিত হয়েছিল। তার তুলনায় কৌরব পার্টির মুসলমান সদস্যদের বা পার্টি প্রেসিডেন্সি মহম্মদ রফির খুব একটা সমর্থন ছিল না জনসাধারণের মধ্যে। রফি বুঝতে পেরেছিল, নতুন ভারত এই একটা মুসলমান-প্রধান রাজ্য দিয়ে দেখিয়ে দেবে যে কর্ণর দাবি সম্পূর্ণ ভুল।

‘মহারাজার ইচ্ছের প্রতি যথেষ্ট সম্মান জানিয়েই বলছি যে তিনি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার খুব একটা বাস্তবতা নেই। তিনি স্বাধীন থাকতে চাইছেন।’ বিদুর বলে উঠল গম্ভীর স্বরে। সে এখন অত্যন্ত বরিষ্ঠ একজন আমলা।

‘ও একটা গর্দভ।’ ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘আমরা অনেক বছর শেখ আজারুদ্দিনের মনিমির ন্যাশনাল কংগ্রেসকে সমর্থন দিয়েছি। ব্যভিচারের অরাজকতার বিরুদ্ধে আমাদের এই পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেখের পায়ের তলার জমি কেড়ে নিতে এগিয়ে এসেছে কর্ণস্থান। আমরা কী করব বিদুর?’

‘খুব বেশি কিছু নয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।’ বিদুর সরকারি মিটিংগুলোতে এই গাম্ভীর্য বজায় রাখত। সে এখন দেশের একীভূতকরণ বিষয়ক সচিব।

‘১৯৪৭ সালে যখন আমি এইসব রাজাদের সঙ্গে বৈঠক করি, তাদের বোঝাই যে দুটি বড় দেশের বাইরে থেকে তারা বেশিদিন শান্তিতে থাকতে পারবে না। সামরিক বাহিনী বলতে এই সব রাজ্যের প্যালেস গার্ড ছাড়া প্রায় কিছুই ছিল না। কাছাকাছি থানা থেকে একদল পুলিশ পৌঁছে গেলেই রাজ্যের স্বাধীনতার দফারফা হয়ে যাবে। মনিমিরের তো প্যালেস গার্ডও খুব একটা শক্তিশালী নয়।’

‘আমরা সোজা ঢুকে যেতে পারি তো?’ রফির গলায় তাড়া।

‘ব্যাপারটা একটু সংবেদনশীল। তাই আমাদের ধৈর্য ধরা উচিত।’ বিদুর প্রায় ডাক্তারের মতো করে বলল, ‘যদি মনিমির এমন একটি রাজ্য হত যার চারদিক ভারতের সীমানা দিয়ে মোড়া, তাহলে আমরা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে পারতাম। কিন্তু মনিমির-এর সীমানার চারিদিকে কর্ণস্থানের বেষ্টনী রয়েছে। আমাদের সাবধানে পা ফেলতে হবে।’

‘তাহলে?’

‘আমাদের অপেক্ষা করা উচিত। চুপচাপ লক্ষ করা উচিত রাজনৈতিক গতি প্রকৃতি।’ বিদুরের মুখটা করুণ দেখাল। ‘যে-কোনও মুহূর্তে এমন কিছু একটা ঘটবে যাতে বরফ গলতে শুরু করবে।’

‘থামলে কেন? বলে যাও!’

‘আমরা মনিমিরে শেখ আজারুদ্দিনের সাহায্যে একটা অভ্যন্তরীণ গন্ডগোল বাধিয়ে দিতে পারি। আমি অবশ্য নিশ্চিত নই যে আজারুদ্দিন এটা করতে পারবে। ওটা হলে মহারাজার সরকার পড়ে যাবে। শেখের সাহায্যে মনিমির আমাদের দখলে চলে আসবে। এই গোলযোগ যদি বাধে, তাহলে আমরা শেখ-এর দিকে আর্থিক এবং সামরিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি। কিন্তু তার জন্য তো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আপনাদের নিতে হবে!’

‘তাহলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা যাক।’

‘আমরা এই রাস্তায় হাঁটলেও ব্যাপারটা হতে সময় লাগবে, তাই না বিদুর? তুমি বলছ যে আজারুদ্দিনকে দিয়ে সংগঠিত মনিমিরকে করায়ত্ব করার একটা উপায় মাত্র। কিন্তু এটা সঠিক পদক্ষেপ নাও হতে পারে। তাই না? তোমার গুপ্তচরেরা তো ভুলও করে থাকতে পারে।’ ধৃতরাষ্ট্র বুঝিয়ে দিল যে সে ভেবেচিন্তে কাজ করতে চায়। ঠকতে চায় না।

বিদুরের মুখ দেখে বোঝা গেল, সে অসন্তুষ্ট হয়েছে।

‘স্যার, আমরা তো অনেকগুলো সম্ভাবনা নিয়েই কথা বলছি এখানে। আমার গুপ্তচরেরা যেমন ভুল করে থাকতে পারে, তেমনি আজারুদ্দিন যে বিদ্রোহে সফল হবে তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই, আবার সফল হলেই যে সে ভারতের সঙ্গে একীভূত হতে চাইবে সে ব্যাপারে তো কোনও অঙ্গীকার সে করেনি, তাই না? ক্ষমতার লোভে সে ভারতের সঙ্গে মিলিত হতে চায়। সেই ক্ষমতার আশ্বাস যদি তাকে অন্য কেউ দিয়ে দেয়, তাহলে সে আমাদের নাও চাইতে পারে।’ বিদুর গলা খাঁকারি দিল।

‘আর কী কী সম্ভাবনা আছে?’ ধৃতরাষ্ট্র জিগ্যেস করল।

‘কর্ণস্থান থেকে যদি অধিগ্রহণের প্রশ্ন ওঠে তাহলে আমরা রাজার হয়ে যুদ্ধ করতে পারি, যদি আমাদের সাহায্য চাওয়া হয়।’

‘তার মানে রাজা যতক্ষণ না আমাদের সাহায্য চাইছে আমরা চুপ করে দেখব, কর্ণস্থান মনিমির অধিগ্রহণ করতে ঢুকে পড়েছে?’

‘না হলে আমরা হামলাকারী বা আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত হব এবং সেটা সামরিক, প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক দিক থেকে কাম্য নয়।’ বিদুর বলল।

‘আমি শেখ আজারুদ্দিনের অবস্থানটা জানতে চাই।’ ধৃতরাষ্ট্র বলল।

‘ব্যাপারটা খুব পরিষ্কার নয়। শুরুতে সে কৌরবদের পক্ষেই ছিল। কিন্তু এখন তার বিশ্বাস খানিকটা টলে গেছে। সে মনে করছে, ভারত মনিমিরের হিন্দু রাজার প্রতি সহানুভূতিশীল। কর্ণ এই সুযোগে যদি শেখকে ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে মনিমির দখলের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে ওই রাজ্য চিরকালের মতো আমাদের হাতের বাইরে চলে যাবে।’

‘সেটা কখনও হবে না। ওরা দুজন দুজনকে সহ্য করতে পারে না।’ রফি বলল।

‘আরও কারণ আছে। কর্ণস্থান-এ কর্ণই একচ্ছত্র রাজা, সে অন্য একটা কোণে অন্য কাউকে নেতা হিসেবে বেড়ে উঠতে দেবে না। কারণ সে আগামী দিনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে। কর্ণ যদি মনিমির দখল করতে চায়, তাহলে নিজের অধিনায়কত্ব বজায় রেখেই করবে।’ ধৃতরাষ্ট্র ভেবে বলল।

এই সময় দরজায় টোকা পড়ল।

গণপতি, এই গল্প বলতে গিয়ে আমি তোমায় খুব বেশি সমাপতনের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাইনি। এটা তোমায় মানতেই হবে। দরজা খুলে ঢুকে এল একজন ঘর্মাক্ত রানার। তার কাজ জরুরি খবর পৌঁছোনো। মনিমিরকে আক্রমণ করেছে কর্ণস্থানীয় সৈন্য।

ভালো লাগল না শুনতে? নাটকীয় লাগল? আচ্ছা লেখো এবার। একজন দপ্তর সচিব ঘরে ঢুকে বলল, ‘প্রধানমন্ত্রী সাহেব। আমায় মাফ করবেন। কিন্তু আমার মনে হল ব্যাপারটা খুবই জরুরি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক খবর পাঠিয়েছে, কর্ণস্থান মনিমিরকে আক্রমণ করেছে।’

গণপতি ভাবতে পারো, যারা আক্রমণ করেছে তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাও নয়। সব কাঁচা যোদ্ধা।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, খুশকিসমত সিং হাসল। সে অবশ্য সব ব্যপারেই হাসত, ‘ওরা কেউ সৈন্য নয়। সব পাঠান উপজাতির লোক, যদিও ওদের অস্ত্র সরবরাহ করেছে কর্ণ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাদের উদ্দেশ্য হল মনিমির-এর মুসলমান ভাইদের স্বৈরচারী হিন্দু রাজার কবল থেকে মুক্ত করে মনিমিরকে কর্ণস্থানের সঙ্গে যোগ করা।’

‘এখন আমাদের কী করা উচিত?’ রফি বলে উঠল,

‘আমরা যদি সামরিক আক্রমণ করি, ঠিক কতটা সময় লাগবে মনিমির সীমানায় পৌঁছোতে?’ ধৃতরাষ্ট্র জিগ্যেস করল।

‘আমি সেনা প্রধানের সঙ্গে কথা বলেছি।’ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বললেন, ‘সেনাকে জড়ো করে, সমরাষ্ট্রগুলিকে সাজিয়ে যদি আমরা এখনি রওনা হই তাহলেও বারো ঘণ্টা লাগবে পৌঁছোতে।’

‘তাহলে তাই হোক।’ বলে প্রধানমন্ত্রী তাঁর একীভূতকরণ সচিবের দিকে ঘুরলেন, ‘ওই সময়ের আগেই মনিমিরে ঢুকে পড়ো। তারপর মহারাজাকে বলো ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে। সে রাজি হওয়া মানে যুদ্ধটা হবে কর্ণের সঙ্গে আমাদের।’

‘আমি এখুনি যাচ্ছি।’ বলে বিদুর গলা নামিয়ে আমতা আমতা করে ধৃতরাষ্ট্রকে বলল, ‘কিন্তু রাজাকে যদি রাজি না করতে পারি?…’

‘আমি নির্দেশ ফিরিয়ে নেব না।’ ধৃতরাষ্ট্র দৃঢ়স্বরে বলল, ‘আমাদের সেনা এগিয়ে যাক, তুমি যদি তোমার কাজটা ঠিক মতো করো তাহলে আমাদের আক্রমণটা বেআইনি মনে হবে না। তা না হলে…’

বিদুর আর অপেক্ষা করল না, ‘আমি চেষ্টা করব, স্যার…।’

কাগজপত্র, ফাইল ইত্যদি গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

৭৪

বিদুরের ছোট্ট প্লেন যখন মনিমির-এর রাজধানী দেবপুর ছুঁল, তখন বরফ পড়ছে। চারিদিকে ময়লা আর জীর্ণতার ওপর বরফের চাদর দেখে মনে হচ্ছিল যে বাসি বরফির ওপর রাঙতার আবরণ। বিদুর পরিচ্ছন্ন শহর আর রাঙতাবিহীন বরফি পছন্দ করে। তার ঘেন্না লাগছিল। সে রেডিওতে আগেই খবর পাঠিয়েছিল। সেটা বোধহয় যথাস্থানে পৌঁছেছে। একজন উর্দি পরা অফিসার এয়ারপোর্ট-এ এসেছিল তাকে নিতে। লোকটাকে দামি হোটেলের দারোয়ান ছাড়া বেশি কিছু মনে হচ্ছিল না।

‘প্রধান সচিব মশাই?’ লোকটা হাত গোল করে এমন স্যালুট মারল যে তার টাইট হয়ে যাওয়া ইউনিফর্ম-এর পেতলের বোতামগুলো ধাক্কা খেয়ে প্রায় ঝুলে গেল। বোঝাই যাচ্ছে, লোকটা ইদানীংকালে একটু বেশিই মুটিয়ে গেছে।

‘আমার নাম বেওকুফ জান। আমি গার্ডদের কর্নেল। মনিমিরে স্বাগত স্যার! আপনার ব্যাগ?’

বিদুর একটা কালো ব্রিফকেস দেখিয়ে দিল, ‘আমি বেশি কিছু আনিনি।’ তার স্বর শুনে মনে হচ্ছিল সে একজন ডাক্তার। প্রসূতিকে সন্তান প্রসবে সাহায্য করতে এসেছে।

‘খুব বেশি সময় নেই।’

‘সময়…নেই? স্যার, আপনি তো কালকে মহারাজ-এর সঙ্গে দেখা করবেন?’

‘না। আজকেই করব।’

‘আজ রাতে? অসম্ভব! তাঁর সঙ্গে আজ একজন মাননীয় অতিথি রয়েছেন। মহারাজ বলেছেন যেন আমরা আজ তাঁকে কোনওভাবেই বিরক্ত না করি।’

‘তাহলে বলে দেবেন, তিনি যেন তৈরি থাকেন। পাঠানদের রাইফেলের আওয়াজে কাল তাঁর ঘুম ভাঙবে। আমি আর সময় নষ্ট না করে দিল্লি ফিরে যাচ্ছি। দেখি, আমার প্লেনটায় তেল ভরা হল কি না।’

‘না, না। তার দরকার হবে না। চলুন স্যার।’ কর্নেল বলল। বাইরে বরফ পড়ছিল। এয়ারপোর্ট-এও হিটারের ব্যবস্থা ছিল না, কিন্তু তবুও সে ঘামছিল। বিড়বিড় করে বলছিল, ‘হিজ হাইনেস খুব অসন্তুষ্ট হবেন। তবু…আপনি আমার সঙ্গে চলুন। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।’

বিদুর একটুও নড়ল না, ‘আমি মহারাজের সঙ্গে এক্ষনি দেখা করেই দিল্লি ফিরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভোরের আগেই দেখা করব।’

‘ভোরবেলা?’

‘হ্যাঁ।’ বিদুর আবার বলল, ‘শুধু শুধু তাহলে রাজপ্রাসাদ অবধি গিয়ে কী আর হবে? আমি যাই কর্নেল।’

কর্নেল বেওকুফ জান ঢোঁক গিলল। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন দৈব নির্দেশের প্রত্যাশায় রইল খানিকক্ষণ, ‘নাঃ! দেখি মহারাজকে ডেকে দেওয়া যায় কি না।’

‘আমি নিশ্চিত। তিনি বুঝতে পারবেন।’ বিদুর জোর দিল। কর্নেল মাথা নেড়ে সায় দেওয়ার চেষ্টা করল। একটা বিশাল লিমুজিনে চড়ে ওরা প্রাসাদে পৌঁছোল। গাড়িটা লন্ডনের ট্যাক্সি আর দিল্লির বাসের মাঝামাঝি একটা যান। বিদুর মুগ্ধ হয়ে গেল গোলাপি আর সোনালি মেশানো বিশাল দেবপুর রাজপ্রাসাদ দেখে। ঠিক হস্তিনাপুরের প্রাসাদের মতোই এটিও নির্মাণ শিল্পের কী অপূর্ব নিদর্শন। কোথাও অসমান পাথরের কাজ কোথাও আবার খিলান আর থামের সংমিশ্রণ, যার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে মার্বেলের থামগুলি।

বিদুর কর্নেলের সঙ্গে লাল কার্পেট বেছানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে, কার্পেটে মোড়া একটার পর একটা অলিন্দ পেরিয়ে পৌঁছোল ব্যভিচার সিং-এ নিজস্ব মহলে। গার্ডরা কর্নেলকে দেখে তটস্থ হয়ে দাঁড়াল। একটা বিশাল কাঠের দরজা খুলে দিল দুজন সুবেদার। তাদের গোঁফজোড়া দেখবার মতো, বিদুর লক্ষ করল।

সেই দরজা পেরিয়ে কার্পেট মোড়া কয়েকটি প্যাসেজ অতিক্রম করে ওরা গিয়ে দাঁড়াল একটা কারুকার্য করা দরজার সামনে। সেটা থেকে চন্দনকাঠের অপূর্ব সুবাস পাওয়া যাচ্ছিল।

‘এটাই মহারাজের শয়নকক্ষ।’ কর্নেল ফিসফিস করে বলল।

‘আপনি এত আস্তে বলছেন কেন?’

‘যাতে মহারাজের ঘুম না ভাঙে।’

‘কিন্তু আমরা তো ওঁকে জাগাতেই এসেছি!’

এক মহিলার উচ্ছল গলার আওয়াজ পাওয়া গেল ভেতর থেকে। বোঝা গেল রাজা জেগে আছে এবং সামনে ফরাসি প্রমোদ সামগ্রী প্রস্তুত।

কর্নেলের মুখ সংকোচে পাঁশুটে হয়ে গেছে, ‘হিজ হাইনেস একজন বিদেশি অতিথিকে নিয়ে ব্যস্ত আছেন। আমার মনে হয় পরে ফিরে আসাই ঠিক।’ সে বলে উঠল মরিয়া হয়ে।

‘পরে উনি ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। এখন যে জেগে আছেন, তা তো দেখাই যাচ্ছে। আমার সময় নেই। হয় আপনি দরজায় করাঘাত করুন, নয়তো আমি করছি।’

খানিকক্ষণ দোনোমনো করে বেওকুফ আলতো আওয়াজ করল দরজায়। একটা লাস্যময়ী হাসির শব্দ ভেসে এল ভেতর থেকে।

‘ওরা শুনতে পায়নি। আমায় করতে দিন।’ বিদুর দরজায় বিকটজোরে একটা আওয়াজ করল।

সব আওয়াজ থেমে গেল। তারপর একটা খুব রাগী কণ্ঠে হুঙ্কার ছাড়ল, ‘কোন শালা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে?’

কর্নেল ভয়ে আমসি হয়ে গেছে, ‘আ-আমি, স্যার।’

‘কোন গাধার বাচ্চা?’

‘আমি, স্যার! কর্নেল বেওকুফজান। আর…’

‘বেওকুফ! আমি কি তোমাকে বলিনি যে আমাকে আজকে বিরক্ত করবে না?’

‘হ্যাঁ স্যার, ক-কিন্তু…’

‘কোনও কিন্তু নয়, শুয়োরের বাচ্চা!’ রাজা চিৎকার করে উঠল, ‘কোন সাহসে তুমি আমার আদেশ অমান্য করো, বেওকুফ?’

‘আমি দুঃখিত স্যার। কিন্তু…’

‘দুঃখিত? হিজড়ের পেছন-চাটা ছোটলোক। আমি ঘুমোতে চেষ্টা করছি আর তুমি আমার দরজা ভাঙতে বসেছ?’

‘আমি নয়। উনি…’

‘উনি? তার মানে আরেকটা হিজড়ের বাচ্চাকে নিয়ে এসে মোচ্ছোব করছ? সবক’টা গার্ডকে চাবুক মারব কালকে। তোমার জন্য সারা রাত ভেবে একটা শাস্তি ঠিক করব। তোমার ছায়াও দেখতে চাই না! বুঝেছ?’

‘হ্যাঁ স্যার।’ সে কাঁদতে কাঁদতে বলল।

‘এক মিনিট, ইওর হাইনেস।’ বিদুর বলে উঠল, ‘আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমিই কর্নেলকে জোর করে এখানে নিয়ে এসেছি।’

নতুন গলাটা শুনে রাজা যে অবাক হয়েছে সেটা বোঝা গেল কিছুক্ষণ উত্তর না আসায়। তারপর রাগী গলায় রাজা বলল, ‘তুমি কে হে?’

‘বিদুর হস্তিনাপুরী। ভারত সরকারের একীভূতকরণ বিষয়ক সচিব। আমাকে প্রধানমন্ত্রী ধৃতরাষ্ট্র পাঠিয়েছেন।’ বিদুর গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমার হাতে সময় অল্প। আপনার সঙ্গে দেখা করেই আমায় দিল্লি ফিরতে হবে।’

‘তাই নাকি? এখন ক’টা বাজল?’ বাজখাঁই আওয়াজ একটু স্তিমিত মনে হল।

‘এটা এমার্জেন্সি, স্যার।’ বিদুর বিরক্তি চাপতে পারল না।

একটা হালকা থাপ্পড় আর চাপা হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল।

‘ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ। আমায় এক মিনিট সময় দাও।’ ভেতরে কাপড় বা চাদর টানার আওয়াজ পাওয়া গেল। চাপা গলার কথাও শোনা গেল।

‘তুমি ভেতরে এসো।’

দরজা খোলা ছিল। বিদুর ঠেলে ঢুকে পড়ল। কর্নেল কী করবে বুঝতে না পেরে এক পা রাখল ঘরের মধ্যে।

‘বাইরে যাও, বেওকুফ!’

কর্নেল চমকে এক লাফে বেরিয়ে গেল।

৭৫

বিদুর ভেবেছিল দেখবে রাজা ড্রেসিং গাউন পরে একজন সঙ্গিনীকে নিয়ে ঘরের মধ্যে। কিন্তু সে অবাক হয়ে গেল! রাজা থুতনি অবধি কম্বল ঢাকা দিয়ে একাই বিছানায় বসে আছে। আর কোমরের দিকে কম্বল একাই উঁচু ঢিবি হয়ে আছে। ঘরে আর কেউ নেই।

‘আমি দুঃখিত। আপনি শুয়ে পড়েছিলেন জানতাম না। গলা পাচ্ছিলাম, ভেবেছিলাম আপনি জেগে আছেন।’

‘আমি জেগে আছি। আমার অতিথি…ওই আর কী…ঘুমিয়ে পড়েছে। আপনি বসুন।’ এবার একটা চাপা হাসির আওয়াজ রাজার নীচের দিক থেকে এল যেন।

বিদুর সবচেয়ে কাছের চেয়ারটার দিকে এগিয়ে গেল। এটি একটি লুই-কুঞ্জি স্টাইলের চেয়ার। এর ওপরে একটা মহিলার অন্তর্বাস রাখা আছে। বিদুর সেটিকে সযত্নে সরাতে গিয়ে দেখল যে সেটি স্যাটিনের তৈরি সায়া। বিদুর থ।

‘যেখানে হোক রেখে দাও।’ রাজা বলল। বিদুর সেটিকে আরেকটি চেয়ারের ওপর রাখতে গিয়ে দেখল, সেখানেও এ ধরনের কয়েকটি সায়া। সায়াটাকে চেয়ারে ফেলে দিতেই চেয়ারের ওপর থেকে একটা লেসের ব্রেসিয়ার পড়ে গেল মাটিতে। বিদুর লজ্জায় কুঁকড়ে গেল।

‘বলো, আমি কী করতে পারি।’ নির্বিকারভাবে বলে হাতটাকে কম্বলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল রাজা।

‘আমি বলতে এসেছিলাম, ভারত সরকার আপনার জন্য কী করতে পারে!’ বিদুর চমকে উঠে শুনল চাপা হাসিটা এবার ব্যভিচারের নীচের দিক থেকে আসছে।

‘তুমি কী বলতে চাইছ?’

‘আমার কাছে খবর আছে পাঠান সৈন্যরা আপনার সীমানা পেরিয়ে মনিমির দখল করতে এসে পড়েছে। তাদের আটকাবার মতো সেপাই-সান্ত্রী আপনার নেই।’

‘আমি জানি।’ বলে রাজা আরেকটা হাত কম্বলের তলায় ঢুকিয়ে দিল। মনে হচ্ছিল, সে কী একটা টানাটানি করছে কম্বলের নীচে।

‘এই পাঠান-উপজাতির লোকেরা চাইছে মনিমিরকে আপনার রাজত্ব থেকে মুক্ত করতে। তাদেরকে অবশ্য চালাচ্ছে মহম্মদ আলি কর্ণ। সে মনিমিরকে দখল করতে চায়।’

রাজা হঠাৎ আঁকুপাঁকু করে উঠল। তবে বিদুরের কথায় কিনা, সন্দেহ আছে।

‘কী সাংঘাতিক!’ বলে রাজা তার কম্বলের নীচে প্রায় মাথাসমেত ঢুকে গেল, ‘কিন্তু আমার লোকেরা আমায় এটা জানাল না কেন?’

আবার ঝটকা মেরে বেরিয়ে এল কম্বলের ভেতর থেকে। এবারে একটা ফরসা ছোট বুক বিদুর দেখতে পাচ্ছিল।

‘তারা এ ঘরের মধ্যে আসতে সাহস পাচ্ছে না।’ বিদুর থাকতে না পেরে বলল, ‘ইওর হাইনেস, আপনি যদি এক্ষুনি একটা সিদ্ধান্ত না নেন তাহলে কালকে এই রাজপ্রাসাদ কর্ণস্থানের দখলে থাকবে।’

একটা চাপা হাসি আবার শোনা গেল! বিদুর নিশ্চিত, সেটা রাজার মুখ থেকে বেরোয়নি।

‘এটা হাসির ব্যাপার নয়।’ বিদুর কড়া গলায় বলল।

‘না। কখনওই নয়।’ মহারাজা হাঁপাতে হাঁপতে বলল, ‘আমি দুঃখিত।’ বলে কম্বলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা থাপ্পড় মারল, ‘ছারপোকা উফ’।

‘বুঝেছি।’ বিদুর কিছুই না বুঝে বলল, ‘আপনার সাহায্য দরকার।’

‘ঠিক আছে। কাল বিছানা বদলে দিলেই হবে।’

‘আমি সামরিক সাহায্যের কথা বলছিলাম। আর সেইজন্যেই আমি এসেছি।’

‘আমি কৃতজ্ঞ।’ মহারাজের মুখ হঠাৎ যেন আলোয় ভরে গেল।

‘আপনি…আমাদের…ভারতীয়…সেনা…পাঠাতে…পারেন?’ রাজা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।

‘নিশ্চয়ই। আপনার শরীর ভালো আছে তো?’

তার কোমরের নীচের ঢিবিটা নড়ে উঠল। তালে তালে ওপর নীচে নড়তে থাকল সেটা…বিদুর হতবাক হয়ে দেখছে।

‘এক্সারসাইজ…আপনি মাথা ঘামাবেন না-আহ…হ্যাঁ, হ্যাঁ! ব্যভিচার চোখ বন্ধ করেছে…আবেগে চোখ বুজে মাথা এপাশ ওপাশ নাড়াতে থাকল।

‘হ্যাঁ…হ্যাঁ…সেনা…’ কম্বলটা আরও জোরে জোরে ওপর নীচে নড়ছে। ব্যভিচারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল।

‘আপনার থেকে একটা লিখিত অনুরোধ চাই এর জন্য।’

‘আহ…কোনও সমস্যা নেই…অনুরোধ…আহ, কাগজটা আনো, আমি সই করব…হ্যাঁ…আহ…আহ…হ্যাঁ, আ…আ…হা…!’

বিদুরের চোখদুটো মেঝের দিকে। সে হড়বড় করে বলে যাচ্ছে, ‘আপনাকে সরকারি ভাবে একটা ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন-এ সই করতে হবে, তারপর দিল্লির কাছে সাহায্য চাইতে হবে।’ আপনি সাহায্য চাইলে, ভারতীয় সেনা বৈধভাবে মনিমিরে প্রবেশ করতে পারবে।’

‘না!’ রাজা আধা বসা-আধা শোয়া অবস্থায় চিৎকার করে উঠল, ‘না না, অ্যাকসেশন বা অধিগ্রহণ একেবারেই নয়। বন্ধুত্বের খাতিরে, আহ… আহ…সেনা…না…হ্যাঁ…হ্যাঁ, না, না, কিন্তু অ্যাকসেশন, ওহ…ওহ…কেন?’

‘আমায় ক্ষমা করবেন। কী বললেন?’

‘হ্যাঁ…মানে না-না, থেমো না…হ্যাঁ…হ্যাঁ!’ রাজা ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বলল, ‘পাঠাও…সেনা…আমার রাজত্ব বাঁচাও…আ…হ…তারপর চলে যাও…অধিগ্রহণ… অ্যাকসেশন নয়…আহ…বুঝলে?’

‘আপনি মনে হয় বুঝতে পারছেন না, মহারাজ।’ বিদুর দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘আমরা শুধু বন্ধুত্বের খাতিরে সেনা পাঠাব তারপর আপনার রাজত্ব আপনাকে দিয়ে চলে যাব? আপনি বোকার মতো কথা বলছেন!’

বলেই বিদুর জিভ কামড়াল। যতই নির্বোধ হোক, রাজা তো! কিন্তু মনে হল সে শুনতেই পায়নি। ভাগ্যিস!

সে ‘আ..হ…!’ করে এমন শীৎকার করে যাচ্ছিল যে-কোনও কিছুই শোনার অবস্থায় ছিল না। কম্বলের একটা বিশেষ অংশে রাজার হাত নড়াচাড়া করছিল।

‘মহারাজ!’

‘হ্যাঁ…হ্যাঁ…হ্যাঁ…হ্যাঁ…হ্যাঁ!’ ব্যভিচার চিৎকার করে উঠল। একটা তীব্র ঝটকার পর কম্বলের নীচের দিকে একজোড়া নেলপালিশ করা কোমল পা বেরিয়েই ঢুকে গেল।

‘আঃ…আঃ…আঃ…’ রাজা অনেকটা হাওয়া বের করে এবার উঠে বসল। কম্বলটা গলা অব্দি টেনে নিল।

‘আঃ! দারুণ লাগছে। একটু এক্সারসাইজ সবার দরকার রাত্রে, কী বলো!’

বিদুর মাথা নাড়ল। তার বাকরোধ হয়ে গেছে।

‘আচ্ছা, সচিব সাহেব, আপনি বলছিলেন…’

‘আমি বলছিলাম মনিমির যদি ভারতের সঙ্গে যোগ দেয় তবেই আমরা সেনা পাঠাব।’

‘আপনি কি জানেন কী বলছেন?’

‘জানি। বুঝেই বলছি।’

‘আপনি বলছেন, পাঠানদের সঙ্গে আমাকে একাই যুঝতে হবে আর তারপর কর্ণের হাতে মনিমিরকে তুলে দিতে হবে, যদি না আমি আমার সিংহাসন ছেড়ে ভারতের সঙ্গে যোগ দিই?’

‘ঠিক তাই। প্রধানমন্ত্রী আপনার সিংহাসন রক্ষার জন্য সেনা পাঠাচ্ছেন না। কিন্তু ভারতের সার্বভৌমত্বের জন্য আমরা আপনার পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করব। চলে যাচ্ছি ইওর হাইনেস। পাঠানরা এসে পড়লে আমার দেবপুরে থাকা ঠিক হবে না।

‘আমি—’ ব্যভিচার কিছু বলার আগেই কম্বল তুলে এক শ্বেতাঙ্গ নগ্ন মহিলা ছিটকে বেরিয়ে এল, ‘তুমি কি মনে করছ, খুনে পাঠানদের হাতে আমায় তুলে দেবে? এখুনি সই করো।’

সে বিদুরের দিকে পিছন ফিরে রাজার সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলতে লাগল, ‘সই করো!’ চোখের সামনে মহিলার পশ্চাদদেশ। মনে পড়ে যাচ্ছিল কলকাতার একটা প্রাইভেট ক্লাবে দেখা একটা ক্যাবারে শো। ‘হায় কলকাতা!’

মানেটা তবে এইরকম দাঁড়াচ্ছে, আমি যদি আপনাদের সাহায্য না পাই তাহলে সিংহাসন হারাব, আর যদি পাই তাহলেও হারাব। আমি সই করি আর না করি, মহারাজ আর থাকব না।’

‘আপনি সই করলে আমি আপনাকে আমার প্লেনে চড়িয়ে নিয়ে যাব আপনার শীতকালীন রাজপ্রাসাদ মারমুতে। এর মধ্যে ভারতীয় সেনা এখানে ঢুকে পড়ে পাঠানদের শায়েস্তা করে আপনার সম্পত্তি রক্ষা করবে। দিল্লির ক্যাবিনেট আপনার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিশ্চয়ই জানাবে।’

‘আমাকে নিশ্চয়ই অ্যাম্বাসাডার করা হবে?’

‘আমি নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীকে বলব। আপনি যদি সই না করেন তাহলে পাঠানরা আপনার গার্ডদের মাছির মতো মেরে ফেলে আপনাকে এবং আপনার সঙ্গীদের বেঁধে ফেলবে। উত্তর-পশ্চিমের পাঠানদের তো আপনি জানেন, তারা খুব হিংস্র হয়।

‘আমাকে একটু ভাবতে দিন।’

‘আমার হাতে একেবারে সময় নেই। আমার প্লেন রেডি আছে, আমি দিল্লি ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরি। আপনি যদি মারমু যেতে চান, আমি ব্রিফকেস থেকে ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশনটা দিচ্ছি, আপনি সই করুন। ভারতীয় সেনারা মনিমিরের দিকে এগিয়ে আসুক। নইলে…’

চার ঘণ্টা পরে বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের টেবিলে গিয়ে সই করা কাগজটা ফেলে দিল। সারা রাত এটার জন্যেই তার সৎভাই বসে ছিল।

‘এই নিন।’ বিদুর বলল। তারপর সে যা বলল তা ভারতের আমলাতন্ত্রে ইতিহাস হয়ে গেছে, ‘আমরা মনিমির পেয়ে গেছি। রাজা ইন্সট্রুমেন্ট সই করেছে। আশাকরি, সেনাবাহিনী তার কাজ করবে।’

৭৬

গণপতি, বিদুর যখন সরকারি মিটিং করত তখন সে একেবারে পোশাকি ভাষায় কথা বলত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। বিদুর কখনওই ভুল তথ্য বা ব্যাখ্যা দেয়নি। পাঠানদের আক্রমণ নিয়ে সে ব্যভিচারকে যা বলেছিল তাই হয়েছিল। পাঠানরা রে-রে করে মনিমিরের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে ধর্ষণ, লুঠ আর ধ্বংসলীলা চালিয়ে গেল। তারা যদি ঠিকমতো এগোত তাহলে ভারতীয় সেনা ঢোকার আগেই মনিমির কর্ণস্থানের দখলে চলে যেত। পাঠানরা দোকানপাট তছনছ, লুঠ করে আর পুরুষদের খুন করে, তরুণীদের নির্বিচারে ধর্ষণ করে প্রচুর সময় নষ্ট করল। ততক্ষণে ভারতের প্রথম শিখ রেজিমেন্ট আর নয় মেট্রিক টন গোলা বারুদ দেবপুরে পৌঁছে গেল।

কর্ণ যখন শুনল, ব্যভিচার ভারতকে মনিমির অধিগ্রহণ করতে দিতে রাজি হয়েছে, তখন সে খেপে উঠল। সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য পাঠাল। প্রথম ইন্ডো-কর্ণস্থান যুদ্ধ শুরু হল।

শেখ আজারুদ্দিনও ভারতকে স্বাগত জানাল। মনিমির ন্যাশনাল কংগ্রেসের এই নেতা দেবপুরের একটি জনসভায় এটা ঘোষণা করে বলল, যে কর্ণস্থান মনিমিরের প্রাণনাশ এবং ইজ্জত লুণ্ঠন করছে ইসলামের নামে। সেই দেশ শত্রু ছাড়া অন্য কিছু হতেই পারে না। ‘ভারত অত্যাচারী কর্ণস্থানের হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়েছে। ভারত আমাদের জীবনে গণতন্ত্রের স্বাদ এনে দিয়েছে। আমি প্রার্থনা করি যে ভারত সাফল্য পাক।’

আজারুদ্দিনকে সঙ্গে পাওয়ায় ভারতের অনেক সুবিধে হল। অর্ধেক যুদ্ধ জয় বলা যেতে পারে। মনিমিরের মানুষ সর্বান্তকরণে ভারতের প্রাধান্য মেনে নিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ভারতীয় সেনা থেমে গেল। তারা প্রায় পাঠানদের এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্ণস্থানী সেনাদের মনিমির থেকে বের করে দিয়েছিল। হঠাৎ ভারত সরকার ‘সিজ ফায়ার’, বা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করল। আমার অন্ধ ছেলে হঠাৎ করে ইউ এন এর কাছে আপিল করল।

আমরা ধৃতরাষ্ট্রকে এর জন্য ক্ষমা করিনি। কেউ কেউ বলেছিল, সে সময়ে জর্জিনা ড্রুপ্যাড ভারতে এবং কর্ণস্থানে বেড়াতে এসেছিল। তার স্বামীর কাছ থেকে একটা বার্তা এসেছিল, যা ধৃতরাষ্ট্র ফেলতে পারেনি। অনেকে মনে করেছিল যে ধৃতরাষ্ট্রের ইংল্যান্ডের শিক্ষা তার স্বাভাবিক রাজনৈতিকবোধের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ইউ এন এর প্রতিনিধিরাও একই শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল—পরের ব্যাপারে নাক গলানোর শিক্ষা। এই সব সমালোচকেরা ভুলে যায়, ধৃতরাষ্ট্র মহাগুরুর শিষ্য। তার বিবেকযন্ত্রণা হচ্ছিল সেনাদের এই হত্যালীলা দেখে। একটু জমির অধিগ্রহণ নিয়ে এই হিংসা ঠিক নয়। ধৃতরাষ্ট্র নিশ্চিত ছিল, মনিমির সে খুব সহজেই ফিরে পাবে আন্তর্জাতিক আদালতের সাহায্যে।

মনিমির হয়ে গেল, ‘বিতর্কিত প্রদেশ।’ কিছুটা কর্ণস্থানের হাতে আর বেশিটাই ভারতের কাছে। ভারতের সঙ্গে জুড়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করে মনিমির বুঝিয়ে দিয়েছিল, ধর্মের ভিত্তিতে যে পার্টিশন হয়েছিল তা কত অন্যায়। কিন্তু সেই সাহস দেখানোর ফলে তার যে এই করুণ পরিণতি হবে, তা কে জানত? আজও মনিমিরকে ক্ষতবিক্ষত করে রেখেছে যুদ্ধজাহাজের চাকার দাগ আর সিজফায়ারের জন্য দাগানো সীমানা।

এই মনিমিরের ঘটনায় ধৃতরাষ্ট্র দেখিয়ে দিল, রাজনীতিতে সে তার নিজের ছাপ রেখে যাবে। চারিদিক থেকে যখন প্রতিবাদের রোল উঠল, ধৃতরাষ্ট্র তখন পদত্যাগ করার কথা ঘোষণা করল। সে জানত, গঙ্গাজি নেই, পাণ্ডু মারা গেছে, রফি মুসলমানদের মধ্যেই ব্রাত্য হয়ে পড়েছে এবং সীমান্তে কর্ণ হুঙ্কার ছাড়ছে। এরকম অবস্থায় ধৃতরাষ্ট্র ছাড়া কৌরবদের আর গতি নেই। নিন্দুকরা মুখ বন্ধ করল। ধৃতরাষ্ট্র বুঝে গেল, সে যা খুশি তাই করতে পারে।

নৈতিক এবং রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব শাসন এবং ইচ্ছার পক্ষে সমর্থন কী করে আদায় করে নিতে হয়, তার পাঠ একমাত্র সন্তান প্রিয়া দুর্যোধনী শিখে নিচ্ছিল। সে তার বাবার একান্ত সচিব। চুপচাপ শুনে, দেখে বুঝে নিচ্ছিল, আগামী দিনে তাকে ঠিক কী আচরণ করতে হবে। মনিমির থেকেই সে তার প্রথম পাঠ পেয়েছিল।

৭৭

সেই ছোট্ট মেয়েটার কী হল? যার জন্ম হয়েছিল অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে আর ইংরেজ জর্জিনা ড্রুপ্যাডের জঠরে, সেই দ্রৌপদী মোকড়াশির?

ছোট্ট, রোগা, রুগ্ন বাচ্চা থেকে সে হয়ে উঠল পরমা সুন্দরী এক রমণী। ধৃতরাষ্ট্র তার প্রতি নিজের দায়িত্ব পালন করত চেক বই-এর পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে। তার চোখধাঁধানো রূপে কত পুরুষ যে অন্ধ হয়েছিল!

তার এক শিক্ষক, ইংরেজ প্রফেসর জেনিংস একবার দ্রৌপদীকে বর্ণনা করেছিল নিজের রসকসহীন কায়দায়।

‘সে শুধু সুন্দরীই ছিল না, দ্রৌপদী যে-কোনও অবস্থাতে সহজেই মানিয়ে নিত। উঁচু-নিচু ভেদাভেদ না করে সবার সঙ্গে মিশত।’ তারপর অবশ্য আসল কথায় এসেছিল জেনিংস, ‘মিস মোকড়াশি কিন্তু বড্ড বেশি কথা বলত। কখনো মনে হত তার পরিমিতি বোধ বড্ড কম। পড়াশোনায় সে খারাপ ছিল না। নিজের ওপর গভীর আত্মবিশ্বাস ছিল। সে জানত, সবসময়তে সে প্রথম হবে না। পাশ যে করে যাবে সেটা নিয়ে তার কোনও সন্দেহ ছিল না।’

ভারতের আদর্শ কন্যা, মিস মোকড়াশি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *