একাদশ অধ্যায়। ত্যাগীর শরশয্যা

একাদশ অধ্যায়। ত্যাগীর শরশয্যা

৬৫

‘ভদ্রমহোদয়গণ।’ ডিকাউন্ট ড্রুপ্যাড বললেন, ‘আপনাদের আমি আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে চাই, ইংল্যান্ডের সরকার এবং আমি মনে করি যে যথেষ্ট হয়েছে!’

তিনি টেবিলের চারিদিকে বসা ভারতের তিনটি পার্টির নেতাদের ওপরে চোখ বোলালেন। কৌরবদের হয়ে ছিলাম ধৃতরাষ্ট্র, মহম্মদ রফি এবং আমি, শিখদের হয়ে দিল সর্দার খুশকিসমত সিং আর ছিল মুসলিম গ্রুপ—কর্ণ, এক মোল্লা এবং গাগা শাহর এক প্রতিনিধি। আমরা সবাই ভাইসরয়ের কথা শুনে হাঁ হয়ে গেলাম।

‘হোয়াইট হল-এর নেতৃত্বে কয়েকটি ক্যাবিনেট মিশন তৈরি হয়েছিল, যারা আপনাদের ক্ষমতা হস্তান্তরের বেশ কিছু উপায় বাতলে ছিল। ইংরেজদের শাসন থেকে ভারতের স্বশাসন। আপনারা প্রত্যেকটাই নাকচ করেছেন।’ বলে ভাইসরয় থামলেন।

তিনি বেশিরভাগ সময়টাই সর্দারটির দিকে তাকিয়ে কথা বলে যাচ্ছিলেন। কারণ সর্দারটি এর আগে সবকটি উপায়কেই স্বাগত জানিয়েছিল। কর্ণকে এই প্রতিনিধি দলে রাখার ব্যাপারে আমাদের মধ্যে মতান্তর থাকলেও আমরা মেনে নিয়েছিলাম।

অনেকগুলো ফর্মুলার কথাই ভাবা হয়েছিল; মুসলমান প্রভিন্সগুলিকে নিয়ে একটি আলাদা সমষ্টি তৈরি করা, মুসলমানদের অস্তিত্ব যেসব রাজ্যে কম সেখানে তাদের সংখ্যালঘু বলে চিহ্নিত করে আলাদা ভাবে সুরক্ষা ও উন্নতির ব্যবস্থা করা, তারা যাতে সমান অধিকার পায় বা সরকারে তাদের প্রতিনিধিত্ব বজায় থাকে, তার অঙ্গীকার করা, আরও কত কী!

কিন্তু কর্ণ সেই অনড়। গঙ্গাজি এইসব মিটিং-এ আসতেন না। তিনি বাইরে থেকে আমাদের অভিভাবকত্ব করতেন। একবার তিনি এও বলেছিলেন, মহম্মদ আলি কর্ণকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীত্ব দিয়ে দিলে সমস্যার সমাধান হতে পারে। হয়তো কর্ণর রাজনৈতিক উচ্চাশার উপশম হত। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র বাধ সাধল।

ড্রুপ্যাড আমাদের মনের কথাটাই তুলে ধরল।

‘আমরা এই অনিশ্চয়তা নিয়ে আর কতদিন কাটাব?’ কর্ণ চুপ করে শোনার পাত্র নয়, ‘আমরা দুষ্টু বাচ্চাদের মতো টিচারের লেকচার শোনবার জন্য এখানে আসিনি।’ সে ঝাঁঝিয়ে উঠল।

‘আমি শেষ করিনি এখনও।’ ড্রুপ্যাড কর্ণের দিকে ফিরলেন, আমি আপনাদের জানাতে চাই আপনাদের এই ঝগড়ায় আমাদের কোনও ভূমিকা নেই। আপনারা চান যে ইংরেজরা ভারত ছেড়ে চলে যাক। তাই হবে। আমরা পনেরোই আগস্ট, ১৯৪৭-এ ভারত ছাড়ব, আপনারা প্রস্তুত হন।’

আমাদের মুখ হাঁ হয়ে গেল। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম ড্রুপ্যাড-এর দিকে।

‘মাত্র আট মাস পরে!’ কর্ণই প্রথম কথা বলতে পেরেছিল, ‘এই তারিখটা কেন বেছে নিলেন আপনি?’

‘আমার বিয়ের তারিখ বলে।’ ড্রুপ্যাড-এর গলায় যেন শিশুর সারল্য।

‘আপনি এইরকম একপেশে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না!’ মহম্মদ রফি চেঁচিয়ে উঠল।

‘হ্যাঁ পারি,’ বলে নিজের কাগজপত্র সামলে উঠে দাঁড়ালেন ড্রুপ্যাড। তারপর ঘর থেকে লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন।

আট মাসের মধ্যে ধাক্কা সামলে ওঠা সোজা নয়। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। ক্যুইট ইন্ডিয়া ডাক দিয়ে গঙ্গাজি যখন গ্রেপ্তার হলেন, তখন তিনি ড্রুপ্যাড-এর পূর্বসূরিকে লিখেছিলেন, ‘আমাদের ভগবান-এর হাতেই হোক কি নৈরাজ্যের হাতেই হোক, সঁপে দিয়ে তোমরা চলে যাও এদেশ ছেড়ে।’

কিন্তু বাস্তবে সেটা হলে, সামলানো দায়! ভয়ে হাত-পা পেটের ভেতর ঢুকে গেল আমাদের।

পরের দিন কৌরব ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং-এ গঙ্গাজির পায়ের কাছে গিয়ে বসলাম। সেদিন তাঁর মৌনব্রতের দিন। আমরা বলব, তিনি শুনবেন। বক্তব্য কিছু থাকলে কাগজে লিখে সারা বহিনকে দেবেন পড়ে শোনানোর জন্যে।

‘এটা কি এত বড় জরুরি মিটিং-এর প্রধানকে মানায়?’ মহম্মদ রফি ফিসফিস করে আমায় বলল। যদিও আক্ষরিক অর্থে রফিই পার্টির প্রেসিডেন্ট হিসেবে মিটিং-এর প্রধান, তবু আমরা সবাই জানি, গঙ্গাজির কথাই শেষ কথা।

‘ড্রুপ্যাড মুখে যা বললেন, তা কি নিজে বিশ্বাস করেন?’ একজন জিগ্যেস করল।

‘আমি ড্রুপ্যাডকে যতটা জেনেছি বা বুঝেছি, তাতে মনে হয় ও ঠিকই বলছে।’ ধৃতরাষ্ট্রকে খুব চিন্তিত ও ক্লান্ত শোনাল।

‘আমাদের পিঠ ঠেকে গেছে দেওয়ালে।’ রফি বলল।

‘কর্ণ এবার দেশভাগ নিয়ে চাপ দেবে। ব্রিটিশরা ঠিক করে ফেলেছে যে আট মাস পরে তারা দেশ ছাড়বে। তারা জানে কৌরবদের সামনে কোনও রাস্তা নেই।

রফির কষ্ট আমরা বুঝতে পারছিলাম। একজন কৌরব মুসলমান হিসেবে সে সর্বান্তকরণে কর্ণস্থান-এর বিরুদ্ধে। মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ তৈরি হলে, তার মতো যারা আছে, তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে বাধ্য।

সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করে দিল। রফির সঙ্গে সকলে একমত। গঙ্গাজি হাত তুলে সবাইকে থামালেন। তারপর একটা কাগজে পেনসিলে কিছু লিখে আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন।

‘কোনওদিন দেশভাগের কথা মাথায় আনবে না।’ সারা বহিন পড়ে দিলেন।

‘গঙ্গাজি, আমরা আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি।’ ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘আপনার কাছ থেকেই আমরা লড়াই-এর অনুপ্রেরণা পেয়েছি, আপনার দেখানো আদর্শেই আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছি। আপনিই আমাদের জয়ের দোড়গোড়ায় নিয়ে এসেছেন।’ এই বলে ধৃতরাষ্ট্র থামল।

তার পরের কথাগুলি আরও কোমল শোনাল, ‘কিন্তু এইবার সেই আদর্শেই অগ্নিপরীক্ষার সময় এসেছে। রফি ঠিকই বলেছে। কর্ণ আর তাঁর বন্ধুরা চাপ বাড়াবে। ওরা এর আগে কর্ণের ডাকে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নৈরাজ্য কী বীভৎস হতে পারে। ব্রিটিশরা এখান থেকে চলে গেলে সেই নৈরাজ্য বিভীষিকাময় হবে। আমার মনে হয়, দেশভাগ-এর ব্যাপারে সম্মতি জানালে, আমরা শান্তি বজায় রাখতে পারব।’

গঙ্গাজি কথা শেষ হওয়ার আগেই লিখতে শুরু করেছিলেন। ‘দেশভাগের ব্যাপারে রাজি হলে তোমরা আমার হৃদয় বিদীর্ণ করবে।

‘আমাদেরও এই কথা বলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে, গঙ্গাজি। কিন্তু আমাদের আর কোনও উপায় নেই।’

‘আমি তাহলে তোমাদের ছেড়ে যেতে বাধ্য হব, বাচ্চারা।’ সারা বহিন পড়ে চললেন, ‘এই সিদ্ধান্তে, তোমাদের সঙ্গে আমি নেই। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুন।’

পড়া শেষ হলে গঙ্গাজি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। তাঁর কণ্ঠের ওঠাপড়া দেখে বোঝা যাচ্ছিল ভেতরের কষ্টটা। আস্তে আস্তে উঠে, সারা বহিনের কাঁধে হাত রেখে, ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন তিনি। কেউ তাঁকে আটকাবার চেষ্টা করল না।

এতে অবশ্য বাকি মিটিং নির্বিঘ্নে করা গেল। অনেকের গলাতেই আশঙ্কা প্রকাশ পেল। তবে সবাই একমত হল, স্বাধীনতা যখন দোরগোড়ায়, তখন তাকে যে কোনও মূল্যে স্বাগত জানাতে হবে। কর্ণকে তার চাহিদা অনুযায়ী যা দেওয়ার দিয়ে, শান্তিতে দেশ গড়ার কাজে এগোতে হবে।

সেই সন্ধের মিটিং-এ কৌরব পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশভাগের সিদ্ধান্ত নিল। সেই প্রথম কৌরব পার্টি মহাগুরুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিল। তাঁর সময় শেষ হয়েছে যে।

৬৬

পরে অবশ্য সমালোচকরা বলেছে, আমরা ক্ষমতার লোভে দেশভাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমরা যদি তাড়াহুড়ো না করতাম তা হলে নাকি দেশভাগ হত না। কর্ণ নাকি দেশভাগের জুজু দেখিয়ে স্বশাসন পাকা করে নিচ্ছিল।

আমি তোমায় বলি গণপতি, ওরা কিচ্ছু জানে না। কর্ণের অটল জেদ এবং ড্রুপ্যাডের হুড়োহুড়ি—এই দুই মিলে গিয়ে আমাদের দেশভাগের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল।

আমরা অবশ্য সেই সময়ে অনেক কিছুই জানতাম না। আমরা বুঝতে পারিনি যে কর্ণ কেমন ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে মেরে যাচ্ছে। আমরা ভেবেছিলাম, পার্টিশন হলে বোধহয় শান্তি বজায় থাকবে। আমরা জানতাম না, পার্টিশনের পরে রক্তের স্রোত আর হাহাকার শুরু হবে। এর চেয়ে বোধহয় স্বাধীনতা নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল তা অনেক ভালো ছিল। আমরা তখন এটাও বুঝিনি যে দেশভাগ করতে রাজি হওয়ার এক ভৌগোলিক বাস্তবতাও আছে। দুটি দেশের মধ্যবর্তী বিচ্ছেদরেখা কেটে দিয়েছিল এমন একটি লোক, যার এই দুই দেশ সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না।

‘ব্যাপারটা বেশ সহজ।’ চশমাপরা লোকটি একটা ম্যাপ দেখিয়ে বলেছিল, ‘যে-কোনও একটা জায়গা বেছে নাও ম্যাপের ওপর। তারপর একটা সরল ফর্মুলা অ্যাপ্লাই করো—প্রথমে দেখো সেখানকার জনগণনার হিসেব কী বলছে এবং তারা কতগুলি ধর্মীয় ভাগে বিভক্ত। তারপর দেখো অঞ্চলটির প্রাকৃতিক কোনও বিশেষত্ব আছে কিনা, যেমন উচ্চতা, নদী, রাস্তা ইত্যাদি। এখানে এই রংগুলি মন দিয়ে দেখো—এইবার এই ভাবে বাউন্ডারি লাইন টেনে দাও—ব্যস!’

বলেই খুব মনোযোগ দিয়ে সে একটি সরু লাইন কেটে দিল ম্যাপের ওপর। দেশভাগ হয়ে গেল! লোকটি বাহবা কুড়োবার ভঙ্গিতে সবার দিকে তাকিয়ে রইল।

‘বাঃ, মিঃ নিকোলাস। আপনাকে তারিফ না করে পারছি না।’ বলে উঠলেন একজন অভিজ্ঞ ইংরেজ বাশাম, ‘আমি ঠিক ওই জায়গায় প্রায় দশ বছর থেকেছি, কাজ-ও করেছি। তাই আপনাকে প্রশংসা করতে বাধ্য হচ্ছি। আপনার বাউন্ডারি লাইনটা একটি মার্কেট-এর ঠিক মাঝখান দিয়ে গেছে। ধান-জমিগুলো সবই দিয়েছেন কর্ণস্থানকে আর সব ধানের গোলা ভারতকে। শুয়োরের খোঁয়াড়গুলো অবশ্যই মুসলমান দেশটা পাচ্ছে আর মাদ্রাসা পেয়েছে ভারত। দেখি দেখি…’

বলে তিনি পয়েন্টারটা নিয়ে ম্যাপের একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, ‘বাঃ লাইনটা এমন করে কেটেছেন, এই স্কুলের হেডমাস্টারকে টয়লেটে যেতে গেলে পাসপোর্ট দেখাতে হবে। কী সহজে আপনি এ সব করে ফেললেন!’

নিকোলস-এর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল, ‘না, মানে…খুব তাড়াতাড়িতে বোধহয়।’

‘ঠিকই।’ প্রাজ্ঞ লোকটি বললেন।

‘সেখানে গিয়ে ঘুরে দেখে পরখ করে তো কাজটা করা যায়নি! ম্যাপের ওপর ভিত্তি করেই সব করতে হয়েছে।’

‘ঠিকই বলেছেন, নিকোলাস। শুধু রবার্ট ক্লাইভ যদি এইভাবে ভাবতেন পলাশিযুদ্ধের সময়ে তাহলে আপনার সামনে এই সমস্যাটাই খাড়া হত না।’

তার পরেও নিকোলাস তার লাইন এঁকে চলল। এই লাইনগুলো মানুষকে ঘরছাড়া করল। নিজের দেশে তারা সহসা বিদেশি হয়ে গেল। দুর্গত, কাতর উদ্বাস্তু মানুষ চলেছিল তাদের এতকালের ঘর ছেড়ে। নতুন আস্তানার সন্ধানে। ওই লাইনেই লুকিয়ে রইল তাদের রক্ত, আর্তনাদ, ধর্ষণ অর মৃত্যুর সেই ভয়াল কাহিনি।

৬৭

ভাইসরয়ের ডাকা চোখধাঁধানো পার্টিগুলিতে নেমন্তন্ন পাওয়ার জন্যে লালায়িত ছিল রহিস পরিবারগুলি। ড্রুপ্যাড-এর বাড়িতে রিপোর্টার আর ফটোগ্রাফারদের ভিড়ও ছিল দেখবার মতো। তিনি এক-একটা মিটিং করতেন। তার পরেই তাঁকে ঘিরে খবরদাতাদের ভিড় জমে উঠত। ড্রুপ্যাড গোটা দেশে ঝড়ের বেগে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। ওঁর প্ল্যানটা কেড়ে নেওয়ার আগে সব যেন দেখে নিতে চান উনি। নবাব, মহারাজাদের ভিড় লেগেই থাকত তাঁর চারিদিকে। তারা তাঁর কাছ থেকে শেষ মুহূর্তের আশ্বাস চাইছিল যাতে তাদের রাজত্ব কেড়ে নিয়ে তাদের ভারত বা কর্ণস্থানের সঙ্গে জুড়ে না দেওয়া হয়।

বিদুরকে এবার দেখা গেল। সে এতদিনে স্টেটস ডিপার্টমেন্টে অনেক উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আগেই বলেছি, বিভিন্ন রাজাদের রাজত্ব নিয়েই ছিল এই ডিপার্টমেন্টের কাজকর্ম। দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে ড্রুপ্যাডের বিদুরের মতো একজন অফিসারকে ভীষণ দরকার ছিল। কয়েকদিনের মধ্যে বিদুর, ড্রুপ্যাডের সব থেকে কাছের পরামর্শদাতা হয়ে উঠল। সে ড্রুপ্যাডের সমস্ত কাগজপত্র, নথি, বয়ান ইত্যাদি তৈরি করত। রাজা এবং তাদের রাজত্বগুলি নিয়ে ভাইসরয়ের সেই সব বিস্ফোরক ঘোষণাগুলির পিছনে তারই হাত ছিল। বিদুর সাহেবকে বোঝাত, তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্বগুলো। তবে তার আগে সে ধৃতরাষ্ট্র আর আমার কাছে এসে কী ঘটতে চলেছে তার আগাম খবর দিয়ে দিত। আর সেই কারণেই যখন সামরিক বাহিনী এবং সরকারি সম্পত্তির ভাগ হল, তখন ভারত কর্ণস্থানের তুলনায় খারাপ কিছু পেল না।

বাবা হিসেবে আমার চেয়ে গর্বিত বোধহয় সেদিন কেউ ছিল না। অবশ্য বাবা হিসেবে আমার সামাজিক কোনও স্বীকৃতি ছিল না। এক ছেলে দেশের প্রথম স্বাধীন দেশের কান্ডারি হতে চলেছে, একজন দেশের স্বাধীনতা আনতে গিয়ে শহিদ হয়ে ঘরে ঘরে পূজিত হচ্ছে, আর একজন ভাইসরয়কে হাত ধরে দেশের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা দেখাচ্ছে।

কিন্তু আমি ইতিহাসের জন্ম দিয়ে থাকলেও, ইতিহাস নিজে বড় নির্মম নিষ্ঠুর। ১৯৪৭-এর সেই দিনগুলো আমার চোখের সামনে আজও ভেসে ওঠে! আমি আতঙ্কিত হই। এত খুন এত বদলা এত রক্ত দেখে দেখে আমার অন্তরাত্মার মৃত্যু ঘটেছিল। আমি আজও বুঝিনি, কেন একজনের শাণিয়ে ধরা ছুরির ফলা আরেকজনের বুকে গেঁথে যায়!

শুধু সে অন্য ভগবানের পুজো করে, সেইজন্যে? একজন কেন তার পড়শির শিশুকে খুন করবে? কেন একজন মানুষ একটি মেয়েকে ছুরি দেখিয়ে ধর্ষিত হতে বাধ্য করবে? কোথাও, কোনও ধর্মগ্রন্থে কি লেখা আছে যে, মুসলমান হলে সে ভারতে শান্তিতে চাষ করে খেতে পারবে না, বা হিন্দু হলে তার কর্মস্থানে বসবাসের অধিকার নেই?

এ পাগলামির শেষ কোথায় কেউ জানত না। আমাদের চোখের সামনে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল। আমরা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা ছাড়া কিচ্ছু করতে পারছিলাম না। আমরা নিজেদের মতো চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আমাদের চারিদিকের অশুভ শক্তির সামনে তা ফুৎকারে উড়ে যাচ্ছিল। মানুষের মধ্যে গিয়ে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। গঙ্গাজির মতো। প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছি।

আমরা সত্যিই যদি ড্রু্যপাডকে না বলতে পারতাম! তাহলে অন্তত অতগুলো লোক ঘরছাড়া হত না। মানুষ যখন খুঁটিছাড়া হয়, তখন সে বড় অসহায়, নিরাপত্তাহীন। তখন তারা নরখাদকের নিশানা। কালে-কালে সেই মানুষের মনের গভীরে জিঘাংসা জন্মায়। সে প্রতিশোধ নেয়। ভিটে মাটি ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হওয়ার প্রতিশোধ। কেউ কারো দুঃখে কাঁদে না।

একা ড্রুপ্যাডকে দোষ দিয়ে লাভ কী? আমরাও তো ভুল করেছি! আমরা কেন তার গড়ে তোলা ছায়ার সঙ্গে লড়াই করতে গেলাম? গঙ্গাজি নিজেকে দোষ দিয়েছিলেন এই ভুলের জন্য। হঠাৎ তাঁকে দেখে খুব বুড়ো মনে হতে লাগল।

এর পরে গঙ্গাজি একটা নৈশ পরীক্ষা করলেন। সে নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হল। কোথায় গেল সেই নির্ভীক শান্তির প্রতীক, যিনি ধুতি পরে ইংল্যান্ডের শীতকে তুচ্ছ করে বাকিংহাম প্যালেসে চলে যেতে পেরেছিলেন? ইদানীং বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাত্রে হঠাৎ হঠাৎ কাঁপুনি হত তাঁর। সেজন্যেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক একদিন তিনি সকলের সামনে একটা কথা বলে সবাইকে চমকে দিলেন।

‘আজ রাত্রি থেকে আমার শোয়ার ব্যবস্থায় একটু পরিবর্তন আনছি।’ বলে তিনি সকলের দিকে চেয়ে দেখলেন। ‘সারা বহিন নগ্ন অবস্থায় আমার বিছানায় শোবেন এবং আমাকে আদর করবেন। এতে আমার কোনও উত্তেজনা আসবে না। আমি যদি নিজের ওপর এই অনুশাসন আনতে পারি, তাহলে একদিন ওই দুর্বিনীত কর্ণকে নিশ্চই হারাতে পারব।’

মহাগুরুর এ বয়সে এ কী ভীমরতি! সবাই কানাঘুঁষো, গুজগুজ ফুসফুস করতে লাগল। ওঁর যা বয়স, তাতে নাতি-নাতনিকে কোলে নিয়ে খেলার বয়স। একটা বুড়ো মানুষকে জড়িয়ে ধরে এক নগ্ন মেম বিছানায় শুয়ে আছে, এই দৃশ্য গঙ্গাজির শিষ্যদের সহ্যের বাইরে ছিল। কেউ কেউ বলল, তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কেউ ভাবল, গঙ্গাজি তাঁর চেয়ে কম বয়সি মহিলার দ্বারা উজ্জীবিত হতে চাইছেন। আমরা বুঝলাম না কোন উত্তরটা সঠিক। কিন্তু ঠিক করলাম যে কাগজের কাছ থেকে ব্যপারটা আড়াল করতে হবে।

এত করেও গুজব চাপা গেল না। যদিও কাগজে ছাপার মতো তথ্যপ্রমাণ কেউ পেল না। খোশগল্প করার মতো মালমশলা অনেকেই পেল। একজন আমেরিকান মনোবিদ মহাগুরুকে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনি যেহেতু অখণ্ড ভারতের পিতা হতে পারেননি, তাই কি ব্রিটিশ মহিলার মাতৃত্বের মধ্যে দিয়ে সান্ত্বনা খুঁজছেন?’

৬৮

একমাত্র ধৃতরাষ্ট্র পেরেছিল ব্যাপারটা সহ্য করতে। তার অন্ধত্ব যেন আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াল। সেইসব বীভৎসতা তাকে দেখতে হয়নি! গ্রামের পর গ্রাম জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে, শববাহী ট্রেন স্টেশনে এসে ঢুকছে।

ধৃতরাষ্ট্র মিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকত। সেখানে কমিটি তৈরি হত যারা ঠিক করবে দেশের গঠন এবং ভবিষ্যৎ। তার যাতায়াত ছিল এমন সব নিয়ন্ত্রণ কক্ষে, যেখান থেকে সে দেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করতে পারবে। অবশ্য ভাইসরয়ের বাড়িতেও তার অবাধ যাতায়াত ছিল। লেডি ড্রুপ্যাড তাঁর প্রতি বিশেষ দাক্ষিণ্য দেখাতেন যে!

ওই অসম জুটি গোলাপবাগানে গভীর আলোচনায় মগ্ন থাকতেন—অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র এবং মেম ড্রুপ্যাড। দেশে তখন আগুন জ্বলছে। কখনও দুজনে হেঁটে বেড়াতেন। আমি দেখতাম আস্তে আস্তে ধৃতরাষ্ট্রের কপালে প্রশান্তির চিহ্ন। শুনতাম লেডি ড্রুপ্যাড হাসছে।

সেই লাস্যময়ী জর্জিনা ড্রুপ্যাডের খুব একটা সামাজিক সুখ্যাতি না থাকলেও সে ভারতের ওপরে তার ছাপ রেখে গিয়েছিল বই কি! সে না থাকলে ধৃতরাষ্ট্র এই হাহাকারের মুখে শক্ত থাকতে পারত কি? মেমসাহেব তার অন্ধ প্রণয়ীর মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিল আত্মপ্রত্যয়।

দুঃখের বিষয়, যে জর্জিনার বিয়ে হয়েছিল এমন একজনের সঙ্গে যার চামড়া কাজিরাঙার গন্ডারের চেয়েও মোটা, যার মানসিক প্রসার এবং গভীরতা বলতে কিছু ছিল না। জর্জিনা সারাদিন আর্তদের মাঝে নিজের মনেই কাজ করে যেত। আধমরা, আহত রুগিদের দেখাশোনা করার জন্য সে হাসপাতালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত। কখনও আবার তাকে জিপে চড়ে বস্তির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত।

বাকি সময়টা জর্জিনার উষ্ণতায় জেগে উঠত ধৃতরাষ্ট্র। আর সে উষ্ণতার তাপ যে ধীরে ধীরে দুজনকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে, তাতে আর সন্দেহ আছে কি?

তারা দুজনে যখন মিলিত হত জর্জিনার নরম প্রশস্ত বিছানায়, তখন চন্দনের সুগন্ধে চারিদিক ম-ম করত। মনে হত যেন প্রকৃতিই গূঢ় অভিসন্ধি করে তাদের দুই শরীর-মনের মিলন ঘটিয়েছে। আর নিয়মিত মিলন যখন শীৎকারে, আপ্লেষে তীব্র হল, ধৃতরাষ্ট্র যখন জলপ্রপাতের উচ্ছ্বাস টের পেল, তখন মনের আয়নায় সেই প্রপাতের রং দেখল গেরুয়া, সাদা আর সবুজ। মধ্যরাত্রি যখন ভোরের সঙ্গে মিলিত হল, স্বাধীনতা এল।

৬৯

সংগ্রাম শেষ হল, আমরা জিতে গেলাম। ভারত ইংল্যান্ডকে জয় করল। গঙ্গাজির খাদি পরা কুলিরা পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী শক্তিকে পরাস্ত করতে পারল। গণপতি, সে অবিশ্বাস্য আনন্দ! মধ্যরাত্রের স্বাধীনতার উদ্দাম জোয়ারে আমরা সবাই ডুব দিলাম। জাতীয় পতাকা যখন তোলা হল, ধৃতরাষ্ট্রের বিহ্বল গলা আনন্দে ভেঙে গেল, ‘এই অন্ধকার মুহূর্তে, গোটা পৃথিবী যখন নিদ্রায় নিমগ্ন, ভারতে স্বাধীনতার নতুন সূর্যোদয় হল।’

ঘড়িতে রাত বারোটার ঘণ্টা আমাদের হৃদয়ে নতুন আশার সংকেত নিয়ে এল। বিধায়কদের আনন্দোচ্ছ্বাস গিয়ে মিলিত হল জনতার উন্মাদনায়। সেই কোলাহলের অনুরণন শোনা গেল প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে, প্রতিটি লরির মাথায় আর ট্রেনে। এ যেন এক বিরাট রামলীলা, যেন রাবণ পোড়ানো হয়ে গেছে! যে বিদেশি রাজা সমুদ্র পার থেকে এসে ভারতকে পরাধীন করে দিয়েছিল তাকে বহিষ্কার করা গেছে। সবার সমবেত হাস্যোল্লাস মনে করিয়ে দিচ্ছিল, সত্য আর ন্যায়ের জয় কেউ রুখতে পারে না।

শুধু একজন এই উৎসবে যোগ দেননি। গঙ্গাজি একটা অন্ধকার ঘরের ঠান্ডা মেঝের ওপর বসে ছিলেন। তাঁর ঠোঁট ঝুলে আছে, হাত দুটো অন্যমনস্কভাবে দুপাশে ঝুলছে। এই আনন্দের ছবি তাঁর মনে রেখাপাত করতে পারেনি। তাঁর চোখের সামনে ভাসছে দাঙ্গার বিভীষিকা। আমরা উপলব্ধি করছি স্বাধীনতা, তিনি উপলব্ধি করছেন দেশভাগ। চারদিকের আলোর রোশনাই তাঁর চোখে প্রতিফলিত হল না। তিনি যে নিভে গেছেন। আজ তাঁর এমন লাগছে যে তিনি যেন আমাদের কিছুই শেখাতে পারেননি।

একটা ছায়ামূর্তি দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। গঙ্গাজি মুখ তুলে দেখলেন, লম্বা খেঁকুরে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।

‘কে?’ সারা বহিন জিজ্ঞাসা করলেন।

লোকটির কাশির দমক উঠল। যন্ত্রণায় তার শরীর কুঁচকে গেছে।

‘আমার নাম শিখণ্ডিন—যাকে ভগবান ত্যাগ করেছে।’ বলে লোকটি ক্রুর একটা হাসি দিল, ‘ভীষ্মকে বলো আমি অম্বা। সে আমাকে চেনে।’

গঙ্গাজি বুঝতে পারলেন। মুখে কিছু বললেন না।

‘এখানে পৌঁছোতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে, ভীষ্ম।’ তার গলায় যন্ত্রণার ছাপ। একহাতে পেটটা চেপে ধরে রেখেছে যেন নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসবে, ‘ওই কসাইটা আমার ওপর ছুরি চালিয়ে নারীত্ব নষ্ট করতে গিয়ে, জীবনটাই কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু এই পুরুষ ভেক ধরতে না পারলে তো এই জ্বলন্ত শহর পেরিয়ে তোমার কাছে পৌঁছোতে পারতাম না, ভীষ্ম।’

সারা বহিন এবং ঘরের অন্যান্যরা আতঙ্কিত হয়ে ওই চেহারাটার দিকে তাকিয়ে ছিল। তারা যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছে। কিন্তু গঙ্গাজির মুখে প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে আবার।

‘তুমি তো ভগ্নপুরুষ ভীষ্ম! যতই নিজের আদর্শ আর ভারতের ঐতিহ্য নিয়ে জ্ঞান দিয়ে বেড়াও, নিজে কি একজনকেও স্ত্রী বা সঙ্গিনী হিসেবে পাশে পেয়েছ? যতই তোমাকে লোকে জাতির জনক বলুক, কোথায় সেই ছেলে যে তোমার চিতায় আগুন দেবে?’

শিখণ্ডিন-রক্ত মিশ্রিত থুতু, অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গে মাটিতে ছেটাল, ‘তোমাকে দেখলে আমার ঘৃণা হয়, ভীষ্ম। তোমার নষ্ট জীবনের কোনও ফল তুমি রেখে যেতে পারলে না। তুমি এক ধ্বজভঙ্গ বুড়ো কচ্ছপ যে অন্যদের ডিম নিয়ে কাড়কাড়ি করে। তুমি অনুর্বর! তাই বাছুরের মতো বিদেশি গরুর বাঁট তোমার ভালো লাগে। এই দেশের করুণ কাহিনির খলনায়ক তুমি। তোমার চিতা জ্বলছে। অনেক বেঁচ্ছে তুমি!’

বলতে বলতে তার শরীর ব্যথায় কুঁকড়ে গেল। কাতরাতে-কাতরাতে অম্বা আবার উঠে দাঁড়াল, ‘ভীষ্ম, ওরা বলে যে তুমি তখনি মরবে, যখন তোমার আর বাঁচবার ইচ্ছে থাকবে না। তোমার বাঁচার কি আর ইচ্ছে আছে? চারিদিক তাকিয়ে দ্যাখো কী হাহাকারের আগুন জ্বলছে!’

গঙ্গাজি তার দিকে সোজা তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন।

‘আমি জানতাম।’ শিখণ্ডিন চকিতে বন্দুক বের করে আনল।

সারা বহিন চিৎকার করে উঠল।

কিন্তু তার মধ্যেই তিনটে গুলি চালিয়ে দিয়েছে। চিৎকার থামল না। অন্যরাও এখন যোগ দিয়েছে, সব মিলিয়ে গেল কান্নার শব্দে। কয়েক মুহূর্ত আতঙ্কে সবাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। সারা বহিন ছুটে গঙ্গাজির কাছে গেলেন। ছেলেরা খুনিকে ধরে ফেলল। সে পালাবার চেষ্টাও করেনি। অত্যন্ত তৃপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল মহাগুরুর দিকে। তিনি কুঁকড়ে পড়ে ছিলেন মাটিতে। রক্তের সঙ্গে সঙ্গে জীবন তাঁকে ছেড়ে যাচ্ছিল।

‘গঙ্গাজি।’ সারা বহিন-যতটা সম্ভব নিজেকে শক্ত রেখে বললেন, ‘চিন্তা করবেন না। ডাক্তার আসছে, সব ঠিক হয়ে যাবে!’

মহাগুরু কষ্ট করে হাসলেন। আমি সেখানে ছিলাম না গণপতি। আমার শোনা। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা গঙ্গাজির পাশে থেকেছি, তাঁর সঙ্গে নীল আন্দোলনের সময়ে মোতিহারিতে আর আম্র সত্যাগ্রহের সময়ে চৌরাস্তায় হেঁটেছি। কিন্তু সেদিন, তাঁর শেষ সময়ে আমি তাঁর পাশে ছিলাম না।

তারপর থেকে অনেক দুঃস্বপ্ন দেখেছি। গঙ্গাজি পড়ে যাচ্ছেন, তাঁর বুক ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে গুলি নয়, তির। ‘গঙ্গা দত্তকে বীরের মৃত্যুবরণ করতে দাও,’ যেন স্বর্গ থেকে দৈববাণী শুনেছি। তারপর কয়েকশো হাত তাঁকে মাটি থেকে তুলে নিয়ে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল। স্বপ্নের মধ্যে দেখলাম, সেটা খাট নয়, শরশয্যা। তিরের খোঁচায় তাঁর পিঠে ক্ষত তৈরি হয়েছে যা থেকে বেরোচ্ছে তাজা রক্ত। সে রক্ত গিয়ে মিশছে গুলির ক্ষত’র গাঢ় রক্তের সঙ্গে।

দুঃস্বপ্নের মধ্যেই দেখেছি, কীভাবে তাঁর জীবনীশক্তি চলে যাচ্ছে। তিনি হাত, এমনকী একটা আঙুলও তুলতে পারছেন না। কিন্তু তাঁর মধ্যে কোনও কষ্টের লেশমাত্র নেই। তিনি শান্তভাবে যিশুর মতো মৃত্যুবরণ করে নিলেন। তিনি যখন শেষবারের মতো জল খেতে চাইলেন, একটি যুবক মাটিতে তির নিক্ষেপ করল। তিরটি গিয়ে জমিতে আটকে গিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। আর মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল জল যা সমস্ত গ্লানির সঙ্গে গঙ্গাজির ক্ষত’র ব্যথা ধুয়ে দিল। কয়েক ফোঁটা গিয়ে তাঁর শুকনো গলা ভিজিয়ে দিল।

তারপর স্বপ্ন মিলিয়ে গেল বাস্তব দৃশ্যে। দেখলাম, গঙ্গাজি তাঁর স্কটিশ বোনের কোলে শুয়ে আছেন। গুলির ক্ষত থেকে বেরোনো রক্ত তাঁর প্রাণ নিয়ে যাচ্ছে।

‘তেষ্টা…জল।’ খুব ক্ষীণ গলায় বললেন তিনি। একটি যুবক ঘটি নিয়ে এগিয়ে এল।

‘আমি অর্জুন। পাণ্ডুর ছেলে।’ সে আস্তে বলল, ‘আমি গুলির আওয়াজ শুনেছিলাম। দেখুন আপনার জন্য জল এনেছি। হস্তিনাপুর থেকে গঙ্গাজল। আপনি খান।’

গঙ্গা দত্ত জল খেয়ে তৃপ্ত হলেন। হাত রাখলেন ছেলেটির মাথায়। তারপর তাঁর গভীর আহত চোখদুটি ফেরালেন তাঁর ছায়াসঙ্গিনীর দিকে।

‘আমি…আমি হেরে গেছি।’ তিনি ফিসফিস করে বললেন।

তারপর তিনি চলে গেলেন। ধৃতরাষ্ট্র বলেছিল, ‘আমাদের জীবনের আলো নিভে গেল।’

৭০

আমি শোকবার্তা লিখতে বসিনি গণপতি। সেগুলি তো লাইব্রেরিতে গিয়ে খবরের কাগজগুলি দেখলেই পাওয়া যাবে। ‘আগামী প্রজন্ম বিস্ময়ের সঙ্গে জানবে যে রক্ত মাংসের এমন মানুষ কোনওদিন পৃথিবীতে এসেছিল’ (আইনস্টাইন)। ‘সব থেকে বড় রোমান।’ আখ্যা দিয়েছিলেন স্যার রিচার্ড। ‘হিন্দুদের বড় ক্ষতি হয়ে গেল।’ লিখল কর্ণ। আমার কথা আমি কয়েক লাইন লিখে বোঝাতে পারব না। এতক্ষণ যা বলেছি এ সবই ধরে নাও তাঁর মৃত্যু উপলক্ষে বলা।

শিখণ্ডিন কি একাই দায়ী ছিল তাঁর মৃত্যুর জন্য? নাকি ভারত নিজেকে দ্বিখণ্ডিত করে তাঁর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী করে তুলল? নাকি গঙ্গা দত্ত এত বছর ধরে তাঁর মৃত্যু কামনারই পরিণতির দিকে এগিয়েছিলেন, নিজের হন্তাকে তিনি নিজেই তৈরি এবং লালন করেছিলেন? যখন দেখলেন, তাঁর জীবনদর্শন আসলে মিথ্যা হয়ে গেছে, তখন তিনি মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন এই নিষ্ফল জীবনকে শেষ করে দিতে।

একটা গল্প তোমাকে বলি গণপতি। আমি নিজে সেটা বিশ্বাস করি না।

হস্তিনাপুরের গ্রামের মানুষ, শীতের রাতে আগুনে হাত সেঁকতে সেঁকতে বলে, গঙ্গাজি যখন মৃত্যুশয্যায় শুয়েছিলেন, একটা লম্বা লোক, তার কপালে অর্ধচন্দ্র জ্বলজ্বল করছে, সে তাঁর পাশে এসে বসেছিল।

হ্যাঁ গণপতি, সে আর কেউ নয়—কর্ণ।

সে যা বলেছিল তা রাজস্থানের লঙ্গ এবং মঙ্ঘানিয়ার প্রজাতিদের গানে আজও শোনা যায়। কর্ণ নাকি মহাগুরুর থেকে ক্ষমা ও আশীর্বাদ দুই-ই চেয়েছিল। মহাগুরুর মতো দার্শনিক জানতেন কর্ণ যা করছে সেটা তার কর্ম। যা ঘটবার তা তো ঘটবেই! একেই বলে ভবিতব্য।

গল্পে এও আছে, কুন্তির অবাঞ্ছিত সন্তান যখন শয্যার পাশ থেকে উঠে পড়ল, তখন নাকি তাঁর কাঁধে মহাগুরু হাত রেখেছিলেন। তিনি কর্ণের বিরোধ করেছেন কিন্তু তাকে আশীর্বাদ দেওয়ার মতো শক্তিও তাঁর মধ্যে ছিল।

এটা গল্প, তুমি বিশ্বাস নাও করতে পারো, গণপতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *