প্রথম অধ্যায় । সেই পুরোনো গল্পটা

প্রথম অধ্যায় । সেই পুরোনো গল্পটা

ওরা বলে ভারত নাকি অনুন্নত দেশ। ওরা আলোচনা সভায় যায়, টেলিভিশন প্রোগ্রামে গিয়ে বসে, দামি জামাকাপড় পরে, হাতে সাহেবি ব্রিফকেস নিয়ে ঘোরাফেরা করে এসে কেমন সবজান্তা ভাব এনে বলে যে ভারতবর্ষ এখনও অনেক পিছিয়ে আছে।

এসব ফালতু কথায় অবশ্য আমি কান দিই না। এরা সব মূর্খের দল। নিজেদের ঠিকুজিটা অব্দি চেনে না; ভাবে সেটা একটা কুণ্ডলী পাকানো কেঁচো। অর্বাচীনের দল। এরা নিজেদের সভ্যতার, কৃষ্টির খোঁজ রাখে না।

আরে বাবা, রামায়ণ-মহাভারতটা যদি একটু পড়ো, যদি মৌর্য বা গুপ্তদের ইতিহাস ঘাঁটো, এমনকী মুঘল সাম্রাজ্যের কথা পড়ো, তাহলে দেখবে যে ভারতবর্ষ পিছিয়ে পড়া দেশ নয়, বরং অতি পরিণত একটি সভ্যতা, অতি পরিপক্ক—তার ফলে তার পচন ধরেছে।

ওরা আমার দিকে করুণার চোখে তাকায় আর হাসে। ওরা এক পা থেকে আরেক পায়ে শরীরের ভার বদল করতে করতে বুঝিয়ে দেয় ওদের অধৈর্য। আমি কিন্তু ধৈর্য হারাই না। ওদের বোঝাই ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থা, তার রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা এবং সর্বোপরি ভারতীয় নারী সবকিছুই ভীষণ পরিণত। ওরা সময় বুঝে আস্তে আস্তে কেটে পড়ে। মনে মনে আমাকে বুড়ো ভাম বলে টিটকিরিও দেয়।

আমি তো আর পার্টির টিকিট পেয়ে ভোটে দাঁড়াতে যাচ্ছি না বা গভর্নর-এর তকমা আমায় কেউ দিতে আসছে না। আমার জীবন তো ফুরিয়ে এসেছে, আমি আজকাল স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছি। ওই বুড়ো কুকুরটার মতো। ওই লোকগুলোর সঙ্গে আমি তো আর একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি না!

তবে আমি সহজে থামার পাত্র নই। আমি তো সবে শুরু করেছি! ‘আমার অনেক কিছু বলার আছে।’ বন্ধু ব্রাহ্মকে বললাম, ‘এই লোকগুলো যদি শুনতে রাজি না থাকে, আমি আমার কথা আরও অনেক বেশি শ্রোতাকে শোনাব। একটাই সমস্যা। আজকাল বুড়ো হাতটা আর আগের মতো স্থির থাকে না। বড্ড কাঁপে, ঠিক যেমন পার্টির প্রতারক এমপি-র হাতে ব্যালট পেপার কাঁপে। তুমি আমায় এমন একজনকে জোগাড় করে দাও যাকে আমি আমার বক্তব্য বলে যাব আর সে লিখে নেবে।’

ব্রাহ্ম ব্যাপারটাতে মোটেই উৎসাহ দেখাল না। বলল, ‘জানো ভি ভি, তোমার বাজারে বদনাম আছে বদমেজাজি বলে। তোমার সঙ্গে কাজ করা সোজা নয়। শেষ যে মেয়েটিকে তোমার কাছে পাঠিয়েছিলাম, সে তো কান্নাকাটি করে ইস্তফা দেয়। যাওয়ার সময় এ-ও বলে গিয়েছিল যে অপ্সরা এজেন্সির নাম সে আর শুনতে চায় না। আমি আর ঝুঁকি নিচ্ছি না। তুমি আবার বই লিখতে যাবে কেন? এ বয়সে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আরাম করে কোথায় অবসর জীবন কাটাবে, তা না এসব ভাবছ! সারা জীবন অনেক কাজ করেছ। এখন তো বসে তারই সুদটা উপভোগ করার সময়!’

আমি পারলে ব্রাহ্ম-এর মুন্ডুটাই চিবিয়ে খেয়ে ফেলতাম।

‘তোমার তাহলে মনে হচ্ছে যে আমার দ্বারা বই লেখা হবে না, তাই না?’ আমি হুঙ্কার ছাড়ি, ‘আরে, আমি যা বলে যাব তা হল আমার জীবনের কথা, আর সে গল্পগুলো কীরকম, তা তোমার চেয়ে ভালো কে জানে? ব্রাহ্ম! আমার মহাকাব্যে আমি লিখে যাব অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কথা, জীবন এবং জীবনোত্তর-এর কথা, জন্ম এবং ক্ষয়-এর কথা। কী ছিল, কী আছে, এবং কী থাকা উচিত ছিল। তুমি ওই ছিঁচকাঁদুনের মেয়েটি কথা আমায় বোলো না। ওরা তো শর্টহ্যান্ডে ডিকটেশন নিতে গিয়ে নখ ভেঙে ফেলে। আমায় একজন অত্যন্ত পারদর্শী কাউকে দাও, যে শরীর এবং মনে সুস্থ সবল হবে। বুঝবে, আমি কী বলতে চাই।’

ব্রাহ্ম ভেবেচিন্তে রাজি হল, ‘হুমম। আচ্ছা, ঠিক আছে। একটা ছেলে আছে যে প্রায় তোমারই মতো পরিশ্রমী আর কঠিন কঠিন কাজ অনায়াসে করে ফেলে। ছেলেটিকে একটু প্রশ্রয় দিও, দেখবে ঠকবে না।’

পরের দিন ছেলেটি এল। তার নাম গণপতি। বোধহয় দক্ষিণ ভারতীয়। চেহারার মধ্যে তার বিশাল নাক আর খুদে খুদে ঝকঝকে চোখদুটি দেখার মতো।

আমাকে বেশ অণুবীক্ষণের মধ্যে দিয়ে দেখার মতো করে খানিক দেখে নিল। আমি তাকে বললাম, তার কাজটি খুব সহজ নয়। আমি মুখে মুখে যা বলে যাব তা হল আধুনিক ভারতবর্ষের গাথা।

চুপচাপ শুনে নিয়ে সে বলল, ‘আমি কাজ করতে রাজি আছি। কিন্তু আমার শর্ত হল, যতদিন লেখা শেষ না হয়, আমি আপনার সঙ্গেই থাকব। আর আমি যতক্ষণ ক্লান্ত না হচ্ছি, আপনাকে বলে যেতে হবে। থামতে পারবেন না।’

বুঝলাম, ব্রাহ্ম ঠিকই বলেছিল।

ছেলেটার হাতির মতো থপথপিয়ে চলা, চওড়া কপাল, আমায় বেশ আকৃষ্ট করেছিল। আমি রাজি হলাম। সেই দুপুরেই এক বিরাট ট্রাঙ্ক টানতে-টানতে সে এসে হাজির হল। তাতে নিশ্চয়ই একবছরের মতো জিনিসপত্র ভরে এনেছিল। আমি মনে মনে ভাবছিলাম। কিন্তু আমারও একটা শর্ত ছিল। আমি বলেছিলাম, আমার বলে যাওয়া প্রতিটি কথার মানে বুঝে তাকে লিখতে হবে। আমি জানতাম, আমি বকে বকে তাকে ক্লান্ত করে দেব। শুধু যে আমার স্মরণশক্তির ওপর নির্ভর করেই এটা ভেবেছিলাম, তা নয়। আমি ঠিক করেছিলাম যে গণপতি যখন তার বিশাল পেটের পুজো করতে যাবে বা প্রাকৃতিক প্রয়োজনে টয়লেটে যাবে, আমি সময় নষ্ট না করে আমার জাপানি টেপ রেকর্ডার-এ অনর্গল বকে যাব।

হুঁ-হুঁ বাছাধন গণপতি! বুঝতে পেরেছ নিশ্চয়ই, খালি নিছক আক্রমণ আর ব্যক্তিগত অপমানই নয়, তোমাকে প্রযুক্তির সঙ্গেও লড়াই করতে হবে।

তুমি সব লিখে নেবে, আমার বলা প্রতিটি শব্দ তুমি লিপিবদ্ধ করবে। আমরা তো আর হালকা ইংরেজি থ্রিলার লিখছি না। এ হল গিয়ে আজকের বেদব্যাসের গল্প। অষ্টাশি বছরের এই ‘বুড়ো ভাম’-এর কথার মধ্যে অনেক অসংলগ্নতা থাকলেও শেষ অবধি এই গল্পটা হতে চলেছে মহাভারতের মতোই আরেক মহাকাব্য।

গল্পটা তবে আমাকে দিয়েই শুরু করা যাক। এই শতকের গোড়ার দিকেই আমার জন্ম। আমি হলাম আমার মেছুনি মা আর এক ভ্রাম্যমাণ ঋষির জারজ সন্তান। তখনকার দিনে আজকের মতো যানবাহনের সুবন্দোবস্ত ছিল না, কিন্তু তবু ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসীরা অনায়াসে সারা দেশে ঘুরে বেড়াতেন। আর অবশ্যই তাঁরা হোটেল বুকিং নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। যে-কোনও গৃহস্থ বাড়িতে তাঁদের আদর যত্নের ত্রুটি হত না। শুধু পৈতে এবং অগাধ জ্ঞানই ছিল তাঁদের সম্বল। গৃহস্বামীরা অনেক সময়তেই এই ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসীদের খাবার এবং বিছানার সঙ্গে নিজের কন্যাকেও যৌতুক দিতেন। তখনকার দিনের গৃহস্বামীদের ভক্তির সীমা-পরিসীমা ছিল না। সন্ন্যাসীটি আতিথেয়তা গ্রহণে ত্রুটি রাখতেন না। সবই আপনার করে নিতেন ক’দিনের জন্য। তারপর আবার বেরিয়ে পড়তেন। নিজের পায়ের খড়ম ছাড়াও আরও কিছু চিহ্ন অবশ্যই রেখে যেতেন। ভারতবর্ষের চারিদিকে ছড়িয়ে আছে এইসব মোক্ষদানের কর্তাদের ফেলে যাওয়া পদচিহ্ন। আমিও তাদেরই একজন। আমার কোনও সংকোচ নেই। এতে আমি যারপরনাই আহ্লাদিত।

তবে মেছুনিরা সচরাচর সন্ন্যাসীদের কৃপা পেত না। তাই বলতেই হয় যে আমার মা সত্যবতী ছিলেন একেবারে স্বতন্ত্র প্রকৃতির মেছুনি। সেদিন তিনি নদীতে মাছ ধরছিলেন, তাঁর ভিজে পাতলা শাড়ির আঁচলটা কাঁধের একপাশে আলগোছে ফেলা ছিল। পাড়ের কাছটা উঠে গিয়ে উরু দেখা যাচ্ছিল। পরিশ্রমের কারণে গায়ে ঘেমো গন্ধ, মাছের আঁশটে গন্ধের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। মাছগুলি টেনে-টেনে সত্যবতী নৌকোয় তুলছিলেন। যখন সন্ন্যাসী পরাশরের দৃষ্টি তাঁর দিকে পড়ে, তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে সত্যবতীর উদ্ধত সৌন্দর্যের দিকে থাকলেন! ঘেমো-আঁশটে গন্ধকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। ‘সুন্দরী নারী,’ পরাশর বলেন, ‘এসো। আমার আদর গ্রহণ করো।’

কোনও ব্রাহ্মণের এই দান কি কোনও নীচকুলের নারী উপেক্ষা করতে পারে?

আমার মা কিন্তু বেহিসেবি বোকা প্রকৃতির মহিলা ছিলেন না। তিনি বললেন, ‘নদীর দু-ধারের লোক আমাদের দেখছে। এ অবস্থায় কী করে নিজেকে আপনার কাছে সমর্পণ করব?’

ব্রাহ্মণ কামপীড়িত হলেও অর্বাচীন ছিলেন না। তিনি আগেই নদীর মধ্যে এক জনশূন্য দ্বীপের খোঁজ জানতেন। সেই দ্বীপের চারদিকে ঘন জঙ্গল। তিনি সত্যবতীকে ইঙ্গিত দিলেন নৌকো নিয়ে দ্বীপে আসতে আর নিজে সেদিকে সাঁতরে এগিয়ে গেলেন।

সত্যবতী লজ্জায় রাঙা হয়ে পরাশরকে অনুসরণ করলেন। দ্বীপের চারিদিকে কুয়াশার আবরণ কোনওমতে তাঁর লজ্জা নিবারণ করতে সক্ষম হল।

আমায় তিনি অনেক পরে গল্পটা যখন বলেন, তখন এ-ও বলেন যে পরাশর নাকি জাদুবলে ওই কুয়াশার সৃষ্টি করেন যাতে অন্যদের কৌতূহলী দৃষ্টি তাঁদের ওপর না পড়ে। আমি অবশ্য এ যুক্তিকে মেয়েলি অত্যুক্তির বেশি কিছু মনে করিনি।

স্বভাবতই সত্যবতী বাধ্য নারীর মতো আজ্ঞা পালন করেছিলেন। কোনও মেয়েই ব্রাহ্মণের রোষের বলি হতে চায় না। সত্যবতী নির্বোধ ছিলেন না। তিনি খুব ভালোই বুঝতেন, একজন পিপাসু ব্রাহ্মণের কাছে নিজেকে সমর্পণ করাটা বেশ সম্মানের ব্যাপার। কবে নিজের বাবা তাঁকে কারুর লালসার আগুনে বলি চড়াবেন তার জন্য অপেক্ষা করার কোনও মানে হয় না। কারণ মেছুয়াদের বাড়িতে সচরাচর ব্রাহ্মণের আগমন হয় না। আবার পরাশরের মতো উচ্চপদস্থ ব্রাহ্মণের যে সত্যবতীকে বিয়ে করা সম্ভব নয়, সেটাও সবাই জানত।

‘আমি এ কাজ আগে কখনও করিনি।’ সত্যবতী বলেন, ‘আমি কুমারী। আমার বারা অত্যন্ত ক্রোধিত হবেন যদি জানতে পারেন, আমি আর কুমারী নই। আপনার সঙ্গে সহবাসের পর আমার কী হবে বলতে পারেন? আমার সমাজে মুখ দেখাবার জায়গা থাকবে না। কেউ কি আমায় বিয়ে করবে? আমায় দয়া করুন।’ তাঁর ভ্রুভঙ্গি আর চোখের ভাষা এটাই স্পষ্ট করে দেয় যে তাঁর শরীরে বাসনার আগুন জ্বলে উঠলেও মন এখনও দ্বিধাগ্রস্ত।

পরাশর হাসলেন। সে হাসিতে ছিল সত্যবতীর প্রতি তাঁর অদম্য আকর্ষণ আর অভয়। ‘ভয় নেই। তোমার কুমারীত্ব অটুট থাকবে। আমায় সুখ প্রদান করার পরেও কেউ বুঝতে পারবে না, তুমি তোমার কুমারীত্ব হারিয়েছ। আমি কথা দিলাম।’

তাঁরা দুজনে তীব্রভাবে কামঘন হলেন। কথা বন্ধ হল। শুরু হল শরীরী ক্রীড়া।

পুরুষরা, বিশেষ করে পরাশরের মতো অতি-পুরুষেরা, তাঁদের ভালোবাসার জনের প্রতি বিশেষ ভাবে পেলব হন। দুটি দেহের মিলনের পর তাঁরা যখন পাশাপাশি শুয়েছিলেন, পরাশর সত্যবতীকে জিগ্যেস করেন, তাঁর মাসিক ঋতুস্রাব কবে হয়েছিল। সত্যবতীর উত্তর শোনার পরে তিনি বলেন, ‘আমাদের মিলনের ফলস্বরূপ একটি সন্তান জন্মাবে। কিন্তু আমি আমার কথা রাখব। তোমাকে তোমার সমাজের অনূঢ়া কন্যা হিসেবে স-সম্মানে ফিরিয়ে দেব।’

পরাশর সত্যবতীকে নিয়ে তাঁর বাবার কাছে গেলেন। সেখানে তাঁকে যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা দেওয়া হল। ‘আপনার কন্যার সঙ্গে আমার নদীতে দেখা হয়। ওর মধ্যে যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। তাই উচ্চশিক্ষা দিতে আমার দাসী করে ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই। সত্যবতীর বিয়ের বয়স হলে, আপনার কাছে তাকে আবার ফিরিয়ে দেব।

সত্যবতীর বাবা যথেষ্ঠ বুদ্ধিমান পুরুষ। মেছুয়াদের প্রধান। ‘আমি কী করে আশ্বস্ত হব যে সত্যবতীর কোনও বিপদ হবে না?’

‘আমায় সবাই চেনে এখানে। এক বছর পরে আপনার মেয়েকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব, একেবারে অটুট অবস্থায়।’ পরাশর বেশ রেগেই জবাব দিলেন।

তখনকার দিনে মেছুয়ারা, তা তিনি যতই মেছুয়া সর্দার হোন না কেন, ব্রাহ্মণদের কথার অমান্য করতেন না। সত্যবতীর বাবা, মেয়েকে এবার বিদায় জানালেন।

সত্যবতীর শরীর-স্বাস্থ্য ভালোই ছিল। পরাশর তাঁকে অনেক দূরে নিয়ে চলে গেলেন পাছে তাঁর গর্ভের কথা চেনা সমাজে জানাজানি হয়ে যায়। আমি এক গভীর জঙ্গলে এক ধাইমার হাতে প্রসব হই।

‘আমার ছেলের নাম দ্বৈপায়ন দেব। যার সৃষ্টি দ্বীপের মধ্যে হয়েছিল।’ আমার মা বলেন বাবাকে। তিনি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেও এই নামটি মোটেই পছন্দ হয়নি তাঁর।

‘মহিলাদের বুদ্ধি যেমন হয় আর কি! ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কোনও ভ্রাম্যমাণ ব্রাহ্মণের ছেলের এই নাম কি কখনও হয়? তার চেয়ে বেদব্যাস অনেক ভালো।’ তিনি বলেছিলেন। পরে অবশ্য বেদব্যাস ভি ভি নামেই বেশি পরিচিত হল।

আমার মা আমায় এক মাসেরও কম সময় বুকের দুধ দিতে পেরেছিলেন। আমার বাবা সে সময়ে মাকে বেদ-পুরাণ ইত্যাদির শিক্ষা যথাসাধ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এর মধ্যে কিছু গুহ্য মন্ত্রও ছিল, যা থেকে সত্যবতী শিখেছিলেন কুমারীত্ব নিয়ে কিছু গোপন তত্ব। তিনি বাড়ি ফেরার পর তাঁর বাবা তাঁর শারীরিক পরীক্ষা করান। সত্যবতী অটুট অবস্থায় আছেন পরীক্ষার পর জানা যায়।

ব্রাহ্মণরা সেকালে কত কিছুই জানতেন!

বিধির লিখন খণ্ডাবে কে? মাছের আঁশটে গন্ধ গা থেকে বেরোনো সত্বেও সত্যবতীর বিয়ে হল এক রাজার সঙ্গে। তখন পর্যন্ত এদেশে চারশো পঁয়ত্রিশটি রাজা ছিলেন। যাঁদের মহারাজা বা নবাব বলে ডাকা হত। আজকে এসব নাম খালি এয়ারলাইন কোম্পানি অথবা ক্রিকেটারদের মধ্যেই পাওয়া যায়। যদিও এঁরা ব্রিটিশদের দাক্ষিণ্যে রাজত্ব করতেন, কিন্তু তবু, এঁদের রাজ্যপাট, রাজপ্রাসাদ, প্রজা এবং একুশটি গান স্যাল্যুট-এর সম্মান সবই অক্ষুণ্ণ ছিল। সবার জন্য অবশ্য একুশটি গুলি বরাদ্দ ছিল না। সামাজিক সম্মান, প্রতিপত্তি এবং বৈভব অনুযায়ী ঠিক হত কে ক’টা স্যাল্যুট পাবে। আমার মা’র যে রাজার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তিনি ছিলেন বৌদ্ধ অথবা এগারো স্যালুট পাওয়া রাজা। নাম তাঁর শান্তনু। আগেও তাঁর একটি বিয়ে হয়েছিল এক অপরূপা এবং গুণী মহারানির সঙ্গে। কিন্তু সাতবার গর্ভপাতের পরে অষ্টমবার সন্তান প্রসব করেই তিনি মারা যান।

এই রানি সম্পর্কে অনেক গুজব রটেছিল। কেউ বলত যে রানি নাকি শান্তনুর বাবা, ত্রিতপার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। কিন্তু তা সত্বেও শান্তনুকে বিয়ে করেন, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার আশায়। কেউ আবার বলে যে, রানির নাকি বংশমর্যাদা বলতে কিছুই ছিল না; শান্তনু নাকি গঙ্গার ধারে তাঁকে খুঁজে পান। অনেকে বিশ্বাস করতেন যে শান্তনু এবং তাঁর রানির সম্পর্কটা এতই খোলামেলা ছিল যে রানি বাঁধনহীন জীবন যাপন করতেন। কিছু কিছু লোক ফিসফাস করতেন রানির মস্তিষ্ক বিকৃতি নিয়ে, তাঁর সন্তানরা নাকি স্বাভাবিক কারণে মারা যাননি। সব কিছু গুজব বলেও তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ কিছু কিছু প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল—তবে শান্তনু তাঁর রানির সঙ্গে সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন।

অনেক বছর পরে, মাঝবয়সি শান্তনু একদিন গঙ্গার ঘাট থেকে একটি সুন্দর দেখতে ছেলেকে নিয়ে প্রাসাদে ফিরলেন। ছেলেটির নাম গঙ্গা দত্ত। শান্তনু তাকে যুবরাজ ঘোষণা করলেন। এর জন্যে তখনকার দিনে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধির অনুমোদন প্রয়োজন হত। কিন্তু গঙ্গা দত্তের রূপ এবং গুণের কথা কারও অজানা ছিল না। তাঁকে স্বাভাবিকভাবেই সবাই যুবরাজ হিসেবে সানন্দে মেনে নিলেন। অন্তত আমার মা আসার আগে অবধি।

একদিন জঙ্গলে আমার মায়ের সঙ্গে শান্তনুর দেখা হয়। একটা অপূর্ব সুন্দর গন্ধ তাঁর নাকে এসে লাগে। পরাশর সত্যবতীকে শিখিয়েছিলেন কী করে জঙ্গুলে লতা-পাতা, বনৌষধি আর আতর দিয়ে শরীরকে সুরভিত করতে হয়। তাঁর আগের মেছো গন্ধ একেবারে ঢেকে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন সত্যবতী। প্রেমে পাগল হয়ে শান্তনু সত্যবতীর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছিলেন।

‘এ তো সৌভাগ্যের কথা।’ আমার দাদামশাই বলেছিলেন। ‘তবে আমার একটা শর্ত আছে। যদি আপনি সেটা মানেন তাহলে আমি সানন্দে আমার মেয়েকে আপনার হাতে তুলে দেব।’

‘কী আপনার শর্ত? আমি সব না শুনে আপনাকে কথা দেব না।’ রাজা ক্ষুণ্ণ মনে বলেছিলেন।

সত্যবতীর বাবা সাবধানে পরের কথাগুলো বললেন, ‘আপনার থেকে ভালো স্বামী সত্যবতীর আর কে হতে পারে? কিন্তু যিনি ওর স্বামী হবেন, তাঁর সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকার তো ওর সন্তানেরাই হবে! যদি আপনি কথা দেন, সত্যবতীর সন্তান আপনার রাজত্বের উত্তরাধিকারী হবে, আমার এ বিয়েতে কোনও অমত থাকবে না।’

ভগ্ন মনে শান্তনু প্রাসাদে ফিরলেন। তিনি অদ্ভুত ধর্মসংকটে পড়লেন। উত্তরাধিকার থেকে গঙ্গা দত্তকে বাদ দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এদিকে সত্যবতীর প্রতি তাঁর প্রেম তিনি গোপন করতে পারছিলেন না। শান্তনু নিজেকে ঘরের মধ্যে নির্বাসন দিলেন। দুবার ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলেন এবং একদিনও দরবারে দর্শন পর্যন্ত দিতে এলেন না। যুবরাজ গঙ্গা দেখলেন যে গতিক সুবিধের নয়, তিনি বাবার সঙ্গে সোজাসুজি আলোচনায় বসলেন।

‘প্রেম! শুনছি বাবা?’

শান্তনু ছেলের কথা উড়িয়ে দিলেন। ‘আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। তুমি আমার একমাত্র সন্তান। আমায় ভুল বুঝো না। তুমি অমূল্য, কিন্তু তাও তুমি যে একমাত্র সন্তান। তোমার যদি কিছু হয়? যদিও আমরা তোমার ব্যাপারে সবরকম সাবধানতা অবলম্বন করি, কিন্তু তাও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আমি তা বলে বলছি না যে বিদ্যুৎপৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তোমার। এই তো সেদিন ওই ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধির চাকাওয়ালা গাড়ির নীচে পড়ে তিনজনের বেঘোরে প্রাণ গেল। আমি বলছি না যে তোমার তেমন কিছু হবে। কিন্তু ভাগ্যের কথা কেউ কি বলতে পারে? আমি জানি যে তুমি বহুবছর বাঁচবে আর বংশবৃদ্ধি করবে, কিন্তু ছোটবেলা থেকেই একটা কথা শুনেছি যে এক ছেলে থাকা মানে নিঃসন্তান থাকারই সামিল। তোমার কিছু হলে মুহূর্তের মধ্যে তোমার রাজত্বকে ব্রিটিশ সরকার অধিগ্রহণ করবে। এমনিতেই তোমাকে হঠাৎ নিয়ে এসে যুবরাজ ঘোষণা করেছি। তাতে ওদের মনে নানা সন্দেহ দানা বেঁধেছে। একবার ভাবো, যদি কোনও যুদ্ধে বা কোথাও শিকার করতে গিয়ে তুমি যদি নিহত হও, তাহলে কী হবে? আমার বংশ শেষ হয়ে যাবে! এখন বুঝতে পারছ, কেন আমার এই নৈরাশ্য?’

‘মনে হয় কিছুটা পারছি।’ গঙ্গা দত্ত বলেন। ‘আপনি আগামী দিনের জন্যে চিন্তিত।’

‘ঠিক তাই পুত্র। নিজের জন্য কে আর চিন্তা করে!’ শান্তনু বললেন।

গঙ্গা দত্ত অবশ্য সব খবর আগেই পেয়ে গেছেন। জানতেন তাঁর বাবা নিজেকে নিয়েই চিন্তিত। মহারাজও মনে মনে আশা করছিলেন, ছেলে এটা সহজেই বুঝবে। যুবরাজের অবশ্য সব জানতে বিশেষ দেরি হয় না। রাজারা তো আর একা বনবিহারে যান না। ফলে একান্ত গোপনীয় বা ব্যক্তিগত মনোরঞ্জনের সাক্ষী অনেকেই থেকে যায়। বাবার সদ্য বনবিহার নিয়ে কয়েকটি মাত্র প্রশ্ন করেই গঙ্গা দত্ত ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। সময় নষ্ট না করে হাজির হলেন সত্যবতীর বাবার কুটিরে।

গঙ্গা দত্তও একা গেলেন না। অনেক বছর পরে তিনি যখন রেলের থার্ড ক্লাস কমপার্টমেন্টে সত্যাগ্রহীদের নিয়ে যাত্রা করতেন তখন অবশ্য গরিব মানুষের জায়গায় থার্ড ক্লাস কামরা ভরতি থাকত তাঁর ঝকঝকে উচ্চবর্ণের সঙ্গীদের দিয়ে। এখন অবশ্য তিনি মন্ত্রী এবং সভাসদদের নিয়ে গেলেন সত্যবতীর বাবার সঙ্গে দেখা করতে। গঙ্গা দত্ত যে-কোনও জমায়েত-এর সামনে বেশ নাটকীয়ভাবে তাঁর বক্তব্য পেশ করতে পারতেন। শেষে অবশ্য ভিড়ের মাঝেই তিনি মারা যান।

‘তাহলে আপনি এই চান?’ গঙ্গা দত্ত সত্যবতীর বাবাকে বলেন। ‘আপনার এইটুকু চাহিদা? শুনুন। আমি আপনাকে কথা দিলাম, যে যদি আপনি আপনার মেয়ের বিয়ে আমার বাবার সঙ্গে দেন তাহলে তাঁর সন্তানই রাজা হবেন।’

‘আপনি হয়তো কথা দিলেন।’ জেলে সর্দার আমতা আমতা করে বললেন। গঙ্গা দত্তের চারপাশে দাঁড়ানো রক্ষীদের হাতের অস্ত্রগুলির দিকে তিনি একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন, ‘আমি নিশ্চিত আপনি কথা রাখবেন। কিন্তু তাতে কি আর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে? আপনার সন্তানেরা তো আপনার প্রতিজ্ঞার সম্মান নাও করতে পারেন। এবার গঙ্গা দত্তের সঙ্গীরা একটু রাগতভাবেই নড়েচড়ে উঠলেন।

তাই দেখে জেলে সর্দার তড়িঘড়ি সামাল দিতে গিয়ে বললেন, ‘আমায় ক্ষমা করবেন হুজুর। আপনাকে কোনওভাবেই আঘাত করতে চাইনি। আমিও তো বাবা, আমি জানি যে সন্তানরা অবাধ্য হয় অনেক সময়েই।’

‘আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছি তার মর্যাদা রাখার দায়িত্বও আমার। আমি আগেই সিংহাসনের অধিকার অস্বীকার করেছি। এখানে যাঁরা আছেন, তাঁদের সবাইকে সাক্ষী রেখে আমি অঙ্গীকার করছি যে আমি কোনওদিন বিয়ে করব না। তাই সন্তান হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।’

গঙ্গা দত্ত অত্যন্ত আত্মপ্রসাদের সঙ্গে দেখলেন, সবার মুখ হাঁ হয়ে গেছে। ‘আমি জানি আপনারা ভাবছেন যে ছেলের জন্ম না দিয়ে আমি স্বর্গে যাব কী করে। ঘাবড়াবেন না! আমার স্বর্গে যাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।’

জেলে সর্দার ভাবতেও পারেননি তাঁর এতটা সৌভাগ্য হবে। তিনি আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন, ‘সত্যবতী!’ তারপর গঙ্গা দত্তের দিকে ফিরে বলেন, ‘মহারাজ সত্যবতীকে বিয়ে করুন। আমি আনন্দের সঙ্গে মত দিলাম। আমি এক রাজার দাদামশাই হব।’ শেষের বাক্যটি অবশ্য তিনি ফিসফিস করে বললেন।

ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া শনশন করে বইছিল। বর্ষাকাল এগিয়ে আসার ইঙ্গিত পাওয়া গেল। সভাসদদের পোশাক হাওয়ায় আলুথালু হয়ে যাচ্ছিল, তাদের মন এমনিতেই উদ্বেল হয়েছিল। হাওয়ার তোড়ে যেন আরও আনমনা হয়ে গেল। হাওয়ার দাপট কোথা থেকে যেন গঙ্গা দত্তের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি করে গেল। তিনি সেগুলি ঝেড়ে ফেললেন। ‘চলো সবাই, আর দেরি নয়।’

একজন নিচু হয়ে ফুলের পাপড়িগুলি কুড়িয়ে নিলেন। ‘এ এক দৈব ইঙ্গিত গঙ্গা দত্ত। আপনার নির্ভীকতার পরিচয় পেয়ে স্বর্গলোক মুগ্ধ হয়েছে। এখন থেকে আপনার নাম হোক ভীষ্ম, যিনি এক ভীষণ প্রতিজ্ঞা করেছেন।’

‘গঙ্গা উচ্চারণ করা তার থেকে সহজ। আপনাদের দৈবজ্ঞান আমার থেকে বেশি। তবে আমার মনে হয়, এই ঝোড়ো হাওয়ার মানে হল, বৃষ্টি আসন্ন। এখুনি না ফিরে গেলে আমরা সবাই ভিজে যাব।’

রাজপ্রাসাদে ততক্ষণে খবর পৌঁছে গেছিল। গঙ্গাকে তার যোগ্য সম্মান দিয়ে বরণ করে নিলেন তাঁর বাবা। অবশ্যই তিনি এতদিনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছিলেন।

‘শাবাশ গঙ্গা! তুমি যা করে দেখালে তা আমি কোনওদিনই করতে পারতাম না। যদিও ব্রহ্মচর্য সম্পর্কে আমার তেমন জ্ঞান নেই, আমি নিশ্চিত যে এতে তোমার ভালোই হবে। অন্তত, এতে তুমি দীর্ঘজীবী হবে। তুমি নিজে না চাইলে মৃত্যু তোমাকে গ্রাস করতে পারবে না।’

‘আমি ধন্য বাবা। কিন্তু আপাতত আমরা রাজত্বের এই নতুন ব্যবস্থাপনার কথা কোম্পানির রেসিডেন্ট সাহেবকে বুঝিয়ে দিই গে।’

‘এ হতেই পারে না!’ ইংরেজ রেসিডেন্ট সত্যবতীর ঘটনা শুনে বলে উঠলেন, ‘এক জেলের মেয়ে কী করে মহারাজের স্ত্রী হবেন? এতে তো গোটা ইংরেজ সাম্রাজ্যের বদনাম হবে!’

‘আপনি ভুল বলছেন। ইংরেজ সাম্রাজ্যের ভারতীয় খণ্ডের এক অংশের কথা বলছেন হয়তো। তবে উপায়ান্তর নেই। এ ব্যবস্থা না করলে ক্ষতি হতে পারে।’

‘তুমি কী বলছ বুঝতে পারছি না। তুমি ছাড়া আর কোনও উত্তরাধিকারীর কথা ভাবা হবে কেন? তোমার মধ্যে আমি তো কোনও কমতি দেখতে পাচ্ছি না যদি না তোমার…হুম…পূর্বপরিচয়…’

‘চলুন আমার পূর্বপরিচয় নিয়ে আপনার অজানা কিছু তথ্য দিই।’ গঙ্গা গলা নামিয়ে বললেন।

কী কথা হয়েছিল দুজনের মধ্যে তা জানা যায় না কিন্তু সভাসদ যাঁরা দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা বলেন যে ‘দক্ষিণ আফ্রিকা’, ‘ইংরেজ বিরোধিতা’, ‘গ্রেফতার’, ‘জেল’ এবং ‘বহিষ্কার’, ইত্যাদি কথাগুলো তাঁদের কানে মাঝে মাঝে চলে আসছিল। তবে আলোচনার শেষে গঙ্গা দত্ত শান্তনুর উত্তরাধিকারী রইলেন না এবং সত্যবতীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধন নিয়ে কোম্পানির এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ধন্ধ অনায়াসেই কেটে গেল।

গঙ্গা দত্তের নাম রাজত্বের সব দলিল-দস্তাবেজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। তারপর একদিন গঙ্গা দত্ত তাঁর রাজকীয় পোশাক খুলে ফেলে, নেংটি পরে দেশের সেবা করতে বেরিয়ে পড়লেন। রাজপুত্র গঙ্গা দত্ত কিন্তু গঙ্গাজি হয়েই বেশি নাম করেছিলেন, পরবর্তীকালে।

কিন্তু সে আরেক গল্প, গণপতি। আমরা সেই গল্পে পরে আসছি। তখন না হয় তোমার লম্বা নাক সেই কাহিনিতে গলিয়ে দিও। তার আগে চলো আমরা কিছু পারিবারিক ইতিহাস ঘেঁটে নিই।

সত্যবতী শান্তনুকে প্রভূত সুখ সম্ভোগ এবং দুটি পুত্র উপহার দিয়েছিলেন। আমাদের দেশে তো সংক্ষিপ্ত এবং সহজ নাম দেওয়ার একটা চল আছে। তাই সে নিয়ম মেনেই আমার দুই সৎ ভাই-এর নাম দেওয়া হয়েছিল চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্য। যাই হোক, আমার পরবর্তী কাহিনিতেও এদের তেমন ভূমিকা না থাকায়, এদের নাম না মনে রাখলেও চলবে। চিত্রাঙ্গদের বুদ্ধি এবং বিক্রম দুই-ই ছিল কিন্তু তিনি খুব কম দিনই রাজ্য শাসন করতে পেরেছিলেন। এ পৃথিবীর যাবতীয় সুখ এবং মোহ তাঁকে সহজেই গ্রাস করে। বিচিত্রবীর্য সিংহাসনে বসলে, গঙ্গাজি হলেন তাঁর প্রধান অভিভাবক এবং বেনারসি চিকের আড়ালে থাকা সদ্যবিধবা সত্যবতী হলেন তাঁর পরামর্শদাত্রী।

বিচিত্রবীর্যের বিয়ের বয়স হলে, গঙ্গাজি ব্রহ্মচারীর উৎসাহ নিয়ে খুঁজে বের করলেন এক নয়, তিন-তিনটি রাজকন্যা। এই তিন বোন রূপেগুণে এমনই সমৃদ্ধা, যে তাদের বাবাকে পাত্র খুঁজতে রাজপ্রাসাদের বাইরে পা রাখতে হয়নি। তবু, সবাই বেশ অবাক হলেন, যখন গঙ্গা তাঁর সৎভাইয়ের জন্য পাত্রী খুঁজতে সে রাজ্যে যাওয়ার কথা ঘোষণা করলেন।

উত্তরাধিকার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এতদিন গঙ্গা প্রচুর ইতিহাস এবং দর্শন নিয়ে পড়াশোনায় ডুবে গিয়েছিলেন। বেদ-উপনিষদ থেকে টলস্টয়, মনুস্মৃতি থেকে রাসপুটিন-এর দর্শন কিছুই বাদ ছিল না। সময় পেলেই অবশ্য তিনি রাজত্বের কাজেও সৎভাইকে সাহায্য করতেন। ভেতরে ভেতরে গঙ্গা হয়ে উঠলেন আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক। যদিও দৈনন্দিন কাজকর্মের খাতিরে তাঁকে সহজ-সরল ভাষার ব্যবহার করতে হত। কিন্তু কখনও কখনও গঙ্গা এমন সব গভীর দর্শনের বাণী দিয়ে ফেলতেন যে মানুষ চমকে গিয়ে ভাবতেন তাঁরা কোন যুগে বাস করছেন। তবে একটা ব্যাপারে কোনও দ্বিমত ছিল না। গঙ্গাজি সত্যিই কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করতেন। ধীরে ধীরে তাঁর ধার্মিকতা এবং ব্রহ্মচর্য নিয়ে মুখে মুখে লোকে ছড়া কাটা শুরু করল।

‘গঙ্গাজি হিন্দু

গোমাতার বন্ধু’

সেই গঙ্গাজি যখন তাঁর সৎভাই-এর বিয়ে নিয়ে এমন মাতামাতি আরম্ভ করলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই সবাই বেশ অবাক হলেন এবং কানাঘুষো চলতে লাগল। তিনি যখন রাজসভায় উপস্থিত হলেন, বেশ কিছু কটূক্তি এবং তিরস্কারও ভেসে এসেছিল তাঁর দিকে। সে যুগে অবশ্য তিনজনকে বিয়ে করা কোনও রাজার পক্ষে অনুচিত কাজ বলে মনে করা হত না। একজনকে বিয়ে করে সুখী হওয়ার বর্বর প্রথা তো এই সেদিন স্বাধীনতার পরবর্তী যুগে চালু হয়েছিল। কিন্তু টাক মাথা গঙ্গাজি তাঁর গোল চশমা পরে তিন রাজকন্যার স্বয়ম্বরে হাজির হওয়ায়, ব্যাপারটা খানিকটা বেমানান দেখাচ্ছিল বইকি!

‘আরে ওই তো ভীষ্ম! কী ভীষণ প্রতিজ্ঞা নিয়েছিল না? তাহলে এখানে কেন?’ সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

‘কেউ বোধহয় কামসূত্রের কিছু পাতা ওঁর বেদের বই-এর মধ্যে গুঁজে দিয়েছিল।’ একজন টিটকিরি করে উঠল।

‘আপনি কি নিজের জন্য একটু বেশি-ই প্রশস্ত বিছানা খুঁজতে চাইছেন?’ সভায় উপস্থিত এক ইংরেজ বলে উঠলেন।

গঙ্গা চোখ পিটপিট করলেন কিছুক্ষণ। তারপর খাটো ধুতি, সরু সরু পায়ের ওপর আরও খানিকটা তুলে নিয়ে যথেষ্ট প্রত্যয়ের সঙ্গে সামনে বসে থাকা রাজা এবং বাকি উপস্থিত সম্ভ্রান্তজনদের উদ্দেশ্যে এই ভাষণ দিলেন।

‘আমাদের দেশ অত্যন্ত ঐতিহ্যশালী। এমনকী ব্রিটিশরাও এ নিয়ে আমাদের ঘাঁটায় না। আমাদের কন্যাদানের বিভিন্ন প্রথা আছে। কখনও তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে পণ সমেত কোনও নিমন্ত্রিত অতিথির হাতে প্রদান করা হয়। কখনও আবার তার বিনিময়ে গরুর পণ গ্রহণ করা হয়, আবার শাস্ত্র মেনে স্বয়ম্বর করে কখনও কন্যাটি নিজের সঙ্গী নিজেই বেছে নেয়। কেউ টাকাপয়সা লেনদেনের মাধ্যমে বিবাহ স্থির করেন। কেউ বা জামাকাপড়, জমি-বাড়ি আদানপ্রদান করেন, কেউ আবার গায়ের জোর ফলান, এমনকী মেয়েটিকে নেশা ধরিয়ে দিয়ে তার সহমত নিয়ে থাকেন। কেউ কেউ আবার দু-পক্ষের পারিবারিক অনুমতি নিয়ে থাকেন। পুরোনো যুগে মেয়েদের ব্রাহ্মণের হাতে তুলে দেওয়া হত তাঁদের শাস্ত্রীয় কাজকর্মে সাহায্য করার জন্য। আমাদের পূজ্য গ্রন্থগুলিতে কিন্তু সবথেকে বেশি প্রশংসা করা হয়েছে সেই বিবাহগুলিকে যেখানে বলপ্রয়োগ করে অনূঢ়া মেয়েটিকে রাজসজ্জা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি নিজেকে সেই প্রশংসার অংশীদার হিসেবে দেখতে চাই। আমি এই তিন কন্যাকে নিয়ে চললাম। আমায় পারলে আটকাও।’

তিনি তাঁর গোল কাঁচের চশমার ভেতর থেকে রাজা থেকে নিমন্ত্রিত অতিথি, সভাসদ এবং পর্ষদ একে একে সবার ওপরে চোখ বোলালেন। তাঁর সম্মোহনী দৃষ্টির কথা পরে ইতিহাসে লেখা হয়েছিল, যা কিনা একদিন ইংরেজদেরও দুর্বল করে দিয়ে দেশ ছাড়া করেছিল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো একে একে তিনটি রাজকন্যা, চিকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে গঙ্গার পিছু পিছু চললেন। যাঁরা বলবার জন্য মুখ খুলেছিলেন, কেমন নির্বাক হয়ে গেলেন। যাঁরা হাত উদ্ধত করেছিলেন, তাঁদের হাত আপনা থেকেই দুপাশে ঝুলে পড়ল। দ্বাররক্ষীরা সরে দাঁড়ালেন আর গঙ্গাজি দৃপ্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন। তিন কন্যাকে নিয়ে!

খুব সহজেই গঙ্গা জয়ী হলেন। সেই থেকেই তাঁর জয়জয়কার ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। শান্তির এবং অহিংসার পথ ধরে বিজয়ী হওয়ার এক নতুন রাস্তা দেখালেন তিনি। পুরো পথটা অবশ্যই নিষ্কণ্টক ছিল না। সৌবাল-এর রাজা সালভা, কেমব্রিজ-এর ফেনসিং চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। তিনি গঙ্গাজিকে তাড়া করতে উদ্যত হলেন। গঙ্গার রাজসিক রোলস গাড়িটি বেরিয়ে যাওয়ার পর সালভা হুঙ্কার ছেড়ে নিজের গাড়ির খোঁজ করতে লাগলেন। তারপর তাঁর হিসপানো স্যুইজা গাড়িতে লাফ দিয়ে চড়ে রোলস-এর পেছনে ধাওয়া করলেন।

গঙ্গার মধ্যে কোনও পরিবর্তন দেখা গেল না। তাঁর বিশাল গাড়ি স্বচ্ছন্দে এগিয়ে চলল, পিছনে বিকট গতিতে ধেয়ে আসা আধুনিক গাড়িটিকে গ্রাহ্য না করেই। সালভার গাড়ির দরজায় তাঁর রাজ্য সৌবাল-এর রাজকীয় ছাপগুলি জ্বলজ্বল করছিল। খুব শিগগির সালভার গাড়ি রোলস-এর আগে এগিয়ে গেল এবং সালভা স্টিয়ারিং কায়দা করে কাটিয়ে তাঁর গাড়ি এমন করে দাঁড় করালেন যে রোলস দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হল।

‘রুক যাও তস্কর!’ সালভা লাফ দিয়ে নেমে পড়ল দরজা খুলে।

তারপর খুব চটপট কয়েকটা ঘটনা ঘটল। টায়ারের বিকট আওয়াজের ওপর দিয়ে খুব একটা কিছু শোনা যায়নি। কিন্তু গঙ্গার হাতটা খুব অল্পসময়ের জন্য জানলার অর্ধেক নামানো কাচের ওপর দিয়ে বেরিয়েছিল আর সালভা থমকে গিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। তার হিসপানো স্যুইজা কেমন যেন কেতরে পড়ল আর টায়ার থেকে হাওয়া বেরিয়ে গেল। রোলসটি আবার তার রাজকীয় ভঙ্গিতে এগিয়ে চলল আর সৌবাল-এর রাজা নিষ্ফল ক্রোধে অন্ধ হয়ে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল।

‘এই মাথা গরম, অধৈর্য লোকগুলোকে নিয়ে আর পারা যায় না!’ গঙ্গা শান্তভাবে বললেন। নিজের সিটে গা এলিয়ে বসে, ভ্রু থেকে ঘাম মুছলেন।

বিচিত্রবীর্য তিন রাজকন্যার দিকে একবার তাকিয়েই আহ্লাদিত হয়ে তাঁর সৎভাই-এর প্রতি কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হলেন। কিন্তু একদিন, যখন সত্যবতীর সঙ্গে পরামর্শ করে বিয়ের কার্ড ছাপা হয়ে গেছে, ক্ষণ-তারিখ সব কিছু জ্যোতিষ পণ্ডিতের আজ্ঞা অনুযায়ী স্থির হয়েছে, তখন অম্বা হঠাৎ গঙ্গার পড়ার ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে দাঁড়ালেন।

‘কী করছ তুমি, মেয়ে?’ ঋষিতুল্য গঙ্গা বেশ বিরক্তির সঙ্গে বই বন্ধ করে বললেন। তিনি চেতনার শুদ্ধতা কী করে অর্জন করতে হয়, তাই নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন (পরে একদিন অবশ্য তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল যে পেট পরিষ্কার থাকলেই মন পরিষ্কার থাকে)। তুমি জানো না আমি কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করি? তার ওপর তুমি অন্যের বাগদত্তা!’

‘না, না, আমি তার জন্য আসিনি।’ অম্বা কিছুটা থতমত খেয়ে বললেন, ‘আমি অন্য কথা বলতে এসেছিলাম।’

‘কী কথা?’ গঙ্গা অবাক হলেন। গভীর জ্ঞান এবং স্বল্প অভিজ্ঞতা তাঁর বাকরোধ করেছিল। ‘আমি অন্যের বাগদত্তা।’ অম্বা ধীরে ধীরে দরজার দিকে পেছোলেন।

‘ও, তাই বলো। ভয় কোরো না, কাছে এসে এই বৃদ্ধকে তোমার দুশ্চিন্তার কথা বলো।’

অম্বা ভয়ে ও দুশ্চিন্তায় হাত মোচড়াতে থাকলেন আর মাথা নিচু করে নিজের হাতের চুড়িগুলি দেখতে লাগলেন, ‘আমি…আমার মন দিয়েছি ওই রাজা সালভাকে। বাবাও জানতেন, ওই দিনেই ঘোষণা হওয়ার কথা ছিল, যখন…যখন,’ অম্বা আর বলতে পারলেন না। ‘ও তাই জন্য সেদিন উনি আমাদের পিছু নিয়েছিলেন। চিন্তা কোরো না, তোমার ঘরে গিয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। পরের ট্রেনেই তোমায় রাজার কাছে ফিরিয়ে দেব।’

এখানেই ওই গল্পের ইতি হওয়ার কথা গণপতি। আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ো না। আমার জীবনটাই বাঁকে বাঁকে ভরা যে! তোমার বাঁকা চাউনি আমার ভালো লাগছে না। তুমি এখানে এসেছ আমার জীবনের এই সব মোড়গুলির কথা নথিবদ্ধ করবে বলেই। হ্যাঁ, আমরা কোথায় ছিলাম যেন? হ্যাঁ, অম্বার সঙ্গে রেলের রাজকীয় কামরায়। সে ফিরে যাচ্ছিল তার প্রেমিকের কাছে।

গঙ্গাজি কি ভেবেছিলেন যে বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র আবার ছাপাতে হবে? তাহলে তিনি ভুল ভেবেছিলেন। কারণ, অম্বা সৌবাল-এ পৌঁছে দেখেন যে তাঁর প্রেমিক হাতছাড়া হয়ে গেছে।

‘ওই পাগল লোকটা আমায় সর্বসমক্ষে মেরে অপমান করে তোমায় নিয়ে পালিয়েছিল। আর গাড়ির ভগ্নস্তূপের ওপরে আমি পড়ে রইলাম। তুমি এত রাত্রি ওদের প্রাসাদে কীভাবে কাটিয়েছ তার কোনও ঠিক নেই। এখন বলছ সব ভুলে গিয়ে তোমায় ফিরিয়ে নিতে? তুমি ফিরতি ট্রেনেই গঙ্গার কাছে ফিরে যাও। সে-ই ঠিক করুক তোমার ভবিষ্যৎ! আমি নয়।’

কাঁদতে কাঁদতে অম্বা ট্রেনের বাইরে চাঁদ আর রুক্ষ প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে হস্তিনাপুরে ফিরে চলল।

‘তুমি কি মশকরা করছ গঙ্গা ভাই? আমি ওকে বিয়ে করব না।’ ‘বিচিত্রবীর্য পাখির মাংসে কামড় বসিয়ে বলল। মদে চুর হয়েছিল সে। ‘ও অন্যের বাগদত্তা। ট্রেনে চড়ে গোটা দুনিয়ার চোখের সামনে সৌবাল থেকে যাতায়াত করল, সবাই ওর কলঙ্কের কথা জানে।’

‘আমি বিচিত্রবীর্য! মহারাজা শান্তনু আর মহারানি সত্যবতীর পুত্র, ওরকম এঁটো কাঁটা নিয়ে ঘর করতে পারব না। ওসব পোরবন্দরের ব্যবসায়ীরা পারে।’ বলে বিচিত্রবীর্য হাততালি দিয়ে নাচিয়েদের ডেকে নিলেন।

‘আপনি আমায় বিয়ে করুন।’ অম্বা নিরুপায় হয়ে গঙ্গাকে বললেন। ‘আপনি আমার এ অবস্থার জন্য দায়ী। আমার সর্বনাশ হয়েছে। এখন সারা জীবন অনূঢ়া থাকার হাত থেকে আমায় বাঁচান।’

গঙ্গাজি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না।

‘আমি পারব না। কোনও কিছুর বিনিময়ে আমার প্রতিজ্ঞা আমি ভাঙতে পারব না, যদিও তোমার দুঃখ আমি বুঝি।’

‘নিকুচি করেছে তোমার প্রতিজ্ঞা। আমার কী হবে? কেউ আমায় বিয়ে করবে না! আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে আপনার জন্য।’

‘আমি তোমার জায়গায় থাকলে এত বিমর্ষ হতাম না। ব্রহ্মচর্য বেঁচে থাকার শ্রেষ্ঠ উপায়। চেষ্টা করে দ্যাখো, খুব আনন্দে থাকবে। দেখবে তোমার আধ্যাত্মিক উত্তরণ ঘটবে।’

‘বেজন্মা কোথাকার! তোমার মতো নেংটি পরে মোটা মোটা বই পড়ব আমি? কোনওদিন না!’ পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে অম্বা দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

তারপর ছয় বছর ধরে অম্বা একবার বিচিত্রবীর্য আর একবার সালভাকে অনুনয় করেও যখন বিফল হলেন তখন তার মনে জ্বলে উঠল প্রতিহিংসার আগুন। সে খুঁজতে লাগল এমন কাউকে যে গঙ্গাকে খুন করবে। কিন্তু ততদিনে গঙ্গার নাম হস্তিনাপুর ছাড়িয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই কেউ তাঁকে খুন করার কন্ট্র্যাক্ট নিতে চাইল না। অম্বা কাজটা নিজে করবে ঠিক করল।

বিচিত্রবীর্য তাঁর রাত্রিকালীন আমোদপ্রমোদ নিয়েই বেশি মজে থাকতেন। গঙ্গার জাগতিক বোধ খানিকটা কম থাকায় বোধহয় ব্যাপারটা অতটা বুঝতে পারেননি। অম্বিকা এবং অম্বালিকা দুজনে মিলে বিচিত্রবীর্যকে এমনিতেই কামদাহে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল। ওই শিখরবক্ষ, কদলী-উর। এবং নিতম্বের ভারেই সে হল কুপোকাত। শেষে কামোন্মাদ হয়ে তার প্রাণটাই গেল। কেউ কেউ বলল, রাজার নাকি যক্ষ্মা হয়েছে। কোনও ডাক্তার-বদ্যি-হাকিমের ওষুধেই সে রোগ সারানো গেল না। সাত বছর রাজত্ব চালানোর পর বিচিত্রবীর্য শেষে প্রাণত্যাগ করে। আক্ষেপ করে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট সাহেব লিখলেন, রাজা যৌবনেই চলে গেলেন। বিচিত্রবীর্যের কোনও সন্তান হয়নি। আর সেই জন্যেই আবার আমি এই গল্পের মধ্যে পদার্পণ করব।

রাজারা সন্তান না রেখে মারা গেলে ব্যাপারটা খুব গোলমেলে হয়ে যেত। ব্রিটিশরা এদেশে আসার আগে, এই অবস্থায় রাজপরিবারটি একটি পুত্রসন্তান দত্তক নিয়ে নিলেই চলত। কিন্তু ব্রিটিশরা এরকম অবস্থায় চেষ্টা করত সিংহাসনকে খালি ঘোষণা করতে এবং নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নিতে। সত্যবতী এতদিন নিজের সন্তানকে সিংহাসনে দেখবে বলে গঙ্গাকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল। কিন্তু এখন উপায়ান্তর না দেখে, গঙ্গাকে অবলম্বন করতে বাধ্য হল।

‘তোমার ওপরেই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে গঙ্গা।’ সত্যবতী এসে বলল, ‘ব্রিটিশরা হস্তিনাপুর যে-কোনওদিন নিয়ে নেবে। কিন্তু যদি তুমি তাদের বলো যে বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর আগেই তার এক রানি সন্তানসম্ভবা হয়েছেন, তাহলে আমরা রক্ষা পেতে পারি। তুমি তোমার ভাইয়ের প্রতি, আমার স্বামীর প্রতি আর এই পরিবারের প্রতি তোমার দায়িত্ব পালন করো। অম্বিকা এবং অম্বালিকাকে সন্তান সুখ দাও।’

সত্যবতী দেখলেন গঙ্গার মুখভঙ্গির পরিবর্তন ঘটছে। ‘হায় ভগবান! তুমি নিশ্চয়ই আমায় তোমার প্রতিজ্ঞার কথা বলবে। তুমি তো সে প্রতিজ্ঞা আমার জন্যেই করেছিলে! এখন সেই আমিই বলছি তোমাকে সেসব ভুলতে তোমার পরিবারের জন্য, তোমার বাবার রাজত্ব রক্ষার খাতিরে।’

‘আমি পারব না মা! এ রাজত্ব তার প্রতি আমার দায়িত্ব এমনকী আমার প্রাণ-এর বিনিময়েও আমি এ প্রতিজ্ঞা ভাঙতে পারব না।’

‘কিন্তু কেউ তো জানবে না।’ সত্যবতী তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন। থেমে একটু ভেবে বললেন, ‘শুধু ওই মেয়ে দুটি ছাড়া।’

‘সেটা খুবই খারাপ। আর কে জানল, সেটা বড় কথা নয়। সত্যে অটুট থাকাটাই আমার লক্ষ্য। আমার আর পরীক্ষা নেবেন না মা। কিন্তু আমি আমার প্রতিজ্ঞা কিছুতেই ভাঙব না। মা, আমি ছাড়াও অনেকেই আপনাকে সাহায্য করতে পারে। আগেকার দিনে কত ব্রাহ্মণ-এর সাহায্য নেওয়া হত, সন্তানহীন ক্ষত্রিয়দের সমস্যা মেটাতে। আজকাল হয়তো অতটা এই প্রথার ব্যবহার নেই। কিন্তু আবার উজ্জীবিত করতে ক্ষতি কি?’

‘দ্বৈপায়ন!’ সত্যবতী খুশিতে ঝলমল করে উঠলেন, ‘আমার সন্তান বেদব্যাস-এর কথা এতক্ষণ কেন ভাবিনি? সে যদি তার বাবার মতো হয়ে থাকে তো নিশ্চয়ই পারবে!’

আলবাত পারব। আমি ব্রাহ্মণপুত্র! মায়ের ডাকে সাড়া দিতে দেরি করিনি। ডাকামাত্র হাজির হলাম।

বুড়ো হয়েছি। খানিকক্ষণ তো পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করতেই পারি! হস্তিনাপুর রাজবাড়িটির স্থাপত্যের প্রশংসা দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের স্থাপত্যকলার এমন মেলবন্ধন সে যুগে সচরাচর দেখা যেত না। হলদেটে এবং গোলাপি পাথরে তৈরি এই বিশাল প্রাসাদ-এর উঁচু ছাদের ঘর এবং আলোকিত অলিন্দ যেন ফুলের পাপড়ির মতো একটার পর-একটা খুলে খুলে যেত। মাঝে ছিল মার্বেল এবং মোজেক-এর অপূর্ব কারুকাজ। নীচে পোর্টিকো পেরিয়ে আরও একটু এগোলে দেখা যেত রাজপরিবারের শখের সেই লম্বা সিডান গাড়িটিকে, যার গুঁফো চালক কাজের ফাঁকে ফাঁকে স্টিয়ারিং-এ মাথা রেখে ঘুমিয়ে নিত। অন্যান্য গাড়িগুলিও যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকত। একতলার পরিচারকদের ঘরগুলির সামনে সারিবদ্ধ ঝুলত কাচা জামাকাপড়। শাড়ি, ধুতি, ইউনিফর্ম সব লাল দেওয়ালের গায়ে রোদে শুকোত। পেতলের বোতামগুলোর ওপর রোদ পড়ে ঝকঝক করত। প্রাসাদের চারপাশে কেয়ারি করা বাগান আর ফুলগাছের সারি দেওয়া রাস্তা। যে-কোনও অতিথির তাক লেগে যাওয়ার কথা।

এদেশের ঘিঞ্জি জীবনের সঙ্গে রাজপরিবারের স্বতন্ত্র জীবনের কোনও মিল নেই। প্রাসাদের ভেতরকার ঠান্ডা মার্বেল, বড় বড় সিঁড়ি, বিরাট হলঘরগুলি আর পুরোনো আসবাব কেমন যেন রাজতন্ত্রের গুরুভারের কিছুটা মনের মধ্যে আপনা-আপনি চালান করে দিত। এই শান্ত পরিবেশে নিজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। কানে আসত প্রায় নিঃশব্দ পায়ে পরিচারকদের চলাফেরা, জেনানা মহল থেকে মেয়েদের কলভাষ, বাগানে পাখিদের কাকলি। দুপুরের ঝিরঝিরে হাওয়া আলতো করে শরীর-মন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেত। আর আমার অপূর্বসুন্দরী বুড়িমা কখনও মনের খেয়ালে হস্তিনাপুরের একমাত্র গ্রামোফোনখানি চালিয়ে দিতেন। আর সেই যান্ত্রিক ওয়াল্টস-এর সঙ্গে একা একটা বৃদ্ধ মাথা তালে-তালে দুলে দুলে উঠত।

রাত্রে যখন এইসব শব্দ মুছে যেত, একরাশ নতুন শব্দের জন্ম হত বন্ধ দরজার পিছনে। বিশ্রী হাসিতে ভরে যেত রাজপ্রাসাদ। সবাই বুঝত যে রাজা তাঁর নিশিযাপনের এলাহি আয়োজন করেছেন। এক মোটা মেয়ে মানুষ হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়া ঠোঁটের ফাঁকে প্রেমের গান গাইত আর লাস্যময়ী সব নাচিয়েরা পায়েলের নিক্বণ তুলে নেচে যেত শরীরে আগুন ধরানো সব নাচ। বিচিত্রবীর্য থেকে থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে হেসে উঠে তালি বাজাত। তারপর কখনও মোহর আর কখনও রত্নালঙ্কার উপহার দিত হুরিদের। কখনও আবার সুরায় বেসামাল হয়ে গিয়ে সেগুলি তাদের অর্ধোন্মোচিত বুকে গুঁজে দিয়ে কামে উদ্বেল হয়ে উঠত। এতেই তার মৃত্যু হল।

আমি এহেন রাজপ্রাসাদে এসে পৌঁছোলাম, মাকে আশ্বস্ত করলাম, আমি দুই রানিকে নিশ্চয়ই সাহায্য করব, যদি তাঁরা রাজি থাকেন। এতবছর মাটেঘাটে ঘুরে বেড়িয়েছি ব্রাহ্মণ সাধু হিসেবে। এতবছর ধরে লোককে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে শিক্ষা দিয়েছি যে আমার চেহারা দেখে কারুর পছন্দ না হলে কিছু বলার ছিল না।

মা আমার ঘামে ভেজা পাঞ্জাবিটা নিলেন। তারপর ভালো করে দেখলেন আমার রোদে ঝলসানো মুখ, আমার হেঁটে বেড়ানো ফাটা পা আর সেই দগদগে ঘা-টা। কিছুদিন আগেই তো ব্রিটিশদের পোষা পুলিশদের সঙ্গে একটা মারামারি করতে গিয়ে মার খেয়েছিলাম।

তিনি আর গঙ্গা মিলে বিধবা দুজনের সম্মতি জোগাড় করেছিলেন। রাজপরিবারের উত্তরাধিকারের ব্যাপারে অসম্মত হওয়ার কোনও কারণ ছিল কি! কৌশলে কিছু খবর নিলাম আর আমার বাবার শিক্ষাও খুব কাজে লাগল। একটু খেটে কয়েকটি তারিখ বার করে ফেললাম যেগুলিতে আমি অম্বিকা আর অম্বালিকাকে মাতৃত্ব প্রদান করব।

স্নান করে সেজেগুজে অম্বিকা এক ছত্রিওয়ালা খাটে শুয়েছিল ঠিক দিনটিতে। আমিও তার ভিতরে অনায়াসে প্রবেশ করলাম। কিন্তু সে আমার চেহারা দেখেই চোখ বন্ধ করে ফেলল আর গোটা প্রক্রিয়ার সময়টা সে ভাবেই পড়ে রইল। তার অবস্থা দেখে আমার আমেরিকানদের কংগ্রেস রচনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।

অম্বালিকা বোধহয় নিজেকে একটু বেশি আগ্রহী রেখেছিল। কিন্তু আমায় দেখে বেচারিও ভয়ে সাদা হয়ে গেল।

আমার মাকে আমি বলেছিলাম যে এই মিলনের ফলস্বরূপ যে সন্তানরা জন্মাবে তারা অন্ধ এবং পাণ্ডুরবর্ণ হতে বাধ্য। মা তাই অম্বিকাকে আবার পাঠালেন। কিন্তু অম্বিকা কায়দা করে নিজের জামাকাপড় পরিয়ে এক পরিচারিকাকে পাঠিয়েছিল। আমি ব্যাপারটা অনেক পরে বুঝতে পারি কিন্তু পরিচারিকাটিকে নিয়ে মোটেই অখুশি হইনি। সে আমার সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল। পরদিন হস্তিনাপুর ছেড়ে চুপচাপ চলে আসি। তিনটি যোনিতে আমার বীর্যচিহ্ন এঁকে দিয়ে।

অম্বিকা জন্ম দিয়েছিল অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে, যে হস্তিনাপুরের সিংহাসনের উত্তরাধিকারি হয়। অম্বালিকা জন্ম দিয়েছিল ফ্যাকাসে বর্ণ পাণ্ডুকে। পরিচারিকাটি জন্ম দিয়েছিল বুদ্ধিমান বিদুরকে। সে একদিন রাজাদের পরামর্শদাতা হয়েছিল। এদের তিনজনের অজ্ঞাত পিতা আমি। হ্যাঁ গণপতি, এই আমার স্বীকারোক্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *