চতুর্দশ অধ্যায়। বেদের কালিমা

চতুর্দশ অধ্যায়। বেদের কালিমা

৮২

‘খুব খুশি হয়েছি স্যার, আপনারা এসেছেন বলে!’ হোটেলের মালিক খুশি হয়ে বললেন। তার সোনার দাঁত ঝকমক করছে, ‘আমার নাম পুরোচন লাল, আমার গরিবখানায় আপনাদের স্বগত। আপনারা কি অনেকদিন থাকবেন?’

‘হ্যাঁ, কিছুদিন।’ যুধিষ্ঠির বলল।

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। তদ্দিনে ঘুরে ফিরে দেখে, আমাদের শহর সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হবে।’

‘আমাদের মা কোন ঘরে আছেন?’

‘আপনাদের মা? ও হ্যাঁ!’ সে রেজিস্টারের পাতা ওলটাতে লাগল, ‘ওঁর নাম কী?’

‘কুন্তিদেবী। গতকাল হস্তিনাপুর থেকে এসেছেন।’

‘আপনারা তাঁর ছেলে?’

‘আমি সবার বড়—যুধিষ্ঠির। এই আমার ভাইরা—ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব।’

‘আমার কী সৌভাগ্য! প্রয়াত পাণ্ডু মহান বীর। তাঁর ছেলে আপনারা! আপনাদের ইচ্ছেই আমার হুকুম।’

যুধিষ্ঠিরকে অপ্রস্তুত দেখাল, ‘আমাদের ঘর দেখিয়ে দিলেই হবে। মায়ের সঙ্গে এখনই দেখা করব।’

‘আমাকে আপনারা ধন্য করলেন। হায় আমার কপাল! আমার হোটেল খুবই সাধারণ, আপনাদের যোগ্য নয়।’

সে মাথা নাড়তে লাগল। হঠাৎ তার মুখটা আলোকিত হয়ে উঠল, ‘আরে তাই তো! আমার একটা নতুন বাড়ি আছে! কাছেই। আপনারা বরং সেখানেই চলুন। আমার পরিবার দেওয়ালির আগে সেখানে যাবে না।’

‘না না।’ এই তো বেশ আছি। আবার আপনাকে ঝামেলা—’

‘ঝামেলা আবার কী? এ তো আমার ভাগ্য! আপনারা মায়ের সঙ্গে দেখা করুন। স্নান করে তাজা হন। ততক্ষণে আমি নতুন বাড়ি আপনাদের থাকার উপযুক্ত করে দিচ্ছি।’

পরদিন সকালে গৃহসচিব একটা তার টেলিগ্রাম পেলেন, ‘পাওয়া গেছে। বিশ্বাস করেছে। কালকে নতুন বাড়িতে ঢুকিয়ে দেব। সব বন্দোবস্ত পাকা। আপনার আজ্ঞার অপেক্ষায় রইলাম। আমাদের টাকাকড়ির ব্যাপারটা চালু রাখবেন। পুরোচন লাল।’

এই টেলিগ্রামটা বারণাবত থেকে প্রিয়া দুর্যোধনীর কাছে পাঠানো হয়েছিল।

বিদুর কিছুক্ষণ স্তব্ধ! সে ফিরতি টেলিগ্রামে তিনটে নির্দেশ পাঠাল।

‘পুরোচন লাল। যতদিন না আমি বলছি কিচ্ছু করবে না। টাকার চিন্তা করার দরকার নেই।’ বিদুর লিখে প্রিয়া দুর্যোধনী নাম টাইপ করে দিল।

এরপরে তার নির্দেশ গেল পোস্টমাস্টারের কাছে, ‘পুরোচন লালকে কোনও টেলিগ্রাম পৌঁছে দেবে না।’ বিদুর নিজের নাম সই করে দিল।

ওর শেষ তারটা ছিল সবথেকে বিদঘুটে, দুর্বোধ্য।

‘যুধিষ্ঠির, কেয়ার অফ জিপিও, বারণাবত। তোমার আজকের ভাগ্যফল গণনা করে জানা যাচ্ছে, ট্রয়-এর গল্পটা মাথায় রেখে বাড়িটা সম্বন্ধে বিবেচনা করো। মুণ্ডহীন কোনও কিছু থেকে সাবধান থেকে, কোনও নতুন করে সাজানো বাগানে যাবে না, আমি খরগোশ পাঠাচ্ছি গর্ত খুঁড়তে। ভ্রমণে জ্ঞান বাড়ে। তোমাদের পথ তারার আলোয় আলোকিত হোক। তোমাদের বিদুর কাকা।

যুধিষ্ঠির বুঝল, আকারে ইঙ্গিতে বিদুর নতুন গৃহ থেকে সাবধান থাকতে বলছেন।

৮৩

‘এই বাগানে কি ভয় থাকতে পারে, বোঝা যাচ্ছে না।’ ভীম অর্জুনকে বলল, ‘কয়েকটা ঝোপঝাড় ছাড়া বাগানে তেমন কিছুই নেই।

‘খরগোশ পাঠাচ্ছি মাটি খুঁড়তে কথার মানে হল বিদুর কাকা কাউকে পাঠাচ্ছে আমাদের কোনও নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে।’ যুধিষ্টির বলল।

‘এই বাগানে আর কী হবে? কাঁটাগাছ ছাড়া কিছু আছে নাকি?’

‘ভ্রমণে জ্ঞান বাড়ে। অর্থাৎ পালাবার জন্য তৈরি হও। তারার আলো মানে রাত্রিবেলায়।’ যুধিষ্ঠির বলল।

‘কী যে বাগান, আগুন, রাতের তারার আলো আর পালানোর কথা বলছে, বুঝিয়ে বলবে কী?’ ভীম অধৈর্য হয়ে পড়েছে।

‘দাঁড়াও ভীম-ভাই! আমরা আগে বুঝে নিই। বার্তাটা পড়ে দেখো না!’ অর্জুন বলল।

ভীম গোলাপি কাগজটা তুলে নিয়ে তার ওপরে লাগানো সাদা কাগজের টুকরোর ওপর লেখা লাইনগুলো খানিকক্ষণ পড়ল। তারপর মাথা চুলকোতে লাগল।

‘কিছু বুঝলে?’ যুধিষ্ঠির হেসে বলল।

‘হুঁ। সাংকেতিক বাক্য।’

‘ঠিক বলেছ। কিন্তু সংকেতের মানেটা বুঝেছ?’

‘হ্যাঁ ট্রয়-এর গল্পে একটা ঘোড়ার কথা ছিল না? সেই ঘোড়াটাকে খুঁজতে হবে। আসলে তো ঘোড়া নয়। কোনও নতুন লোক। মনে হয়, কাজের মেয়েটা! ওর থেকে আমাদের সাবধানে থাকতে হবে’ ভীম বলল।

বাহ! দারুণ! ঠিকই বলেছ। ওই ষাট বছর বয়সি ফোকলা দাঁতের পার্বতী হল সিক্রেট এজেন্ট।’ বলে অর্জুন মাথা নাড়ল।

‘ওই মাথাহীন বস্তুটা নিশ্চই কোনও পাদ্রি হবে।’ ভীম আরও ভেবে বলল।

‘কিন্তু মাথাহীন কেন?’

‘পাগল বলে। নিশ্চয়ই ওকে পূর্ণিমা-অমাবস্যায় পাগলামিতে পায়।’

‘ঠিক আছে ভীম-ভাইয়া, তাহলে আমরা পার্বতী আর পাগলা পাদ্রির ব্যাপারে সতর্ক থাকব, কী বলো?’

‘কিন্তু ভীম, পাগলা পাদ্রি কি কথা শুনবে?’ এবার যুধিষ্ঠির যোগ দিল।

‘সেটাই ভাবছি। হয়তো বাগানটা যদি একটু ওলটপালট করে দিই তাহলে বিপদ কেটে যাবে। কিন্তু এই কুচ্ছিৎ বাগানটায় বেশি ওলটপালট করার মতো কিছুই নেই।’

এই সময় কুন্তি বাগানে নেমে এলেন। সবাই চুপ করে গেল। আজ তাঁর চালচলন, বেশভূষা একেবারে অন্যরকম। পরনে একটা সাধারণ সুতির শাড়ি। কপালে চিন্তার ভাঁজ। কুন্তি ছেলেদের মাঝে এসে বসলেন।

‘আচ্ছা তোমাদের কি এই বাড়িটা একটু অদ্ভুত লাগছে না?’ কুন্তি সোজাসুজি জিগ্যেস করল। যুধিষ্ঠির এবং অর্জুন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

‘কেন মা?’

‘আমি দেওয়াল আর মেঝে থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছি।’

‘আমারও এটা মনে হয়েছিল।’

‘কিন্তু ভেবেছিলাম নতুন বাড়ি, তাই রঙের গন্ধ বেরোচ্ছে।’

‘মেঝেতে কোনো রং নেই। তবু সেখানেও তো একই গন্ধ।’

‘আমি দেখছি মা’, অর্জুন বলল।

‘দেখবে আবার কী? শুঁকবে!’ ভীম বলে উঠল উত্তেজিত হয়ে।

‘তোমাদের হাতে ওটা কী? টেলিগ্রাম?’

‘হ্যাঁ, বিদুর কাকা পাঠিয়েছে। সাংকেতিক ভাষায় লেখা তার।’

‘তাই? বিদুর! কী লিখেছে?’

‘কয়েকটা সাবধান বাণী। ও কিছু নয় মা। ‘ওই খ্যাপা পাদ্রি আর ট্রয়ের কাজের মেয়েটাকে আমার হাতে ছেড়ে দাও। সাজা করে দেব।’

কুন্তি কিছু বলতে যাবে, অর্জুন গম্ভীরমুখে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

‘আমি ঘরের মধ্যে গালার গন্ধ পেলাম।’

‘গালা! কী সেটা?’

‘গালা আঠার কাজ করে। জলের মতো স্বচ্ছ। একটু লালচে ভাব আছে। গালা একটি ভেষদ পদার্থ। কাঠের পাটাতন জুড়তে কাজে লাগে।’ অর্জুন বলল।

কুন্তির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, ‘তাহলে ভয়ের কিছু নেই। যাই দেখি, সকলের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করা যায় কি না।’

‘দাঁড়াও মা’, অর্জুন বলল। ‘স্টোভটাকে দেওয়াল আর মেঝে থেকে দূরে রেখো। গালা কিন্তু দাহ্যপদার্থ। সহজেই আগুনকে আকর্ষণ করে। ধরে নাও আমরা পেট্রোলের ক্যানের মধ্যে সবাই রয়েছি।’

৮৪

‘ওদের রিপোর্ট?’ বিদুর চেয়ারে হেলান দিয়ে জিগ্যেস করল।

সেখানে গিয়ে তড়িঘড়ি

পাঁচজনকে তাড়াতাড়ি

বলি, যদি বাঁচতে চাও

এখান থেকে পালাও

আপনার তার পেয়ে,

পুরোচন ঘেমে নেয়ে,

পড়ল জালে যেই;

পাণ্ডব বাঁচল সেই।

জাল ফেলে পুরোচন,

ঢেলে দিল প্রাণমন,

আপনার পোষ্যেরা সব;

যেন মৃত্যু পথযাত্রী শব।

আগুনের ছোট ফুলকি,

গালায় দিত দুলকি,

জ্বলে হত ছারখার;

পুরোচন নির্বিকার।

সে অপেক্ষা করে রয়,

দুর্যোধনীর আদেশ কবে পায়।

কেন পেছোচ্ছে দিন;

পুরোচনের আশা হল ক্ষীণ।

আমরা গর্ত খুঁড়ে যাই—

কোদাল, কাস্তে যা পাই তাই,

দেরি হচ্ছিল ভাগ্যিস;

না হলে কি বাঁচতে পারতিস?

দেখে পাণ্ডবদের অক্ষত অঙ্গে,

আমরা মন দিলাম সুরঙ্গে,

ভীম অসুরের মতো খেয়ে;

কেঁদে চলত ঘেমে নেয়ে।

আমরা বানালাম সুরঙ্গ—

টের পেল না কীট পতঙ্গ।

সে কী বিশাল এক গর্ত;

আলো হাওয়া খেলত অব্যর্থ,

তারপর করলাম তাকে আড়াল,

ঘাস, মাটি টেনে টেনে দিল কুড়াল;

আমরা পালাতে প্রস্তুত;

নৈশ ভোজের নিমন্ত্রণ নিয়ে চলল ওদের দূত।

পুরোচন এল সেই ভোজে;

বন্ধুরা এল তার খোঁজে,

কুন্তির মদে দিল নেশাঘুম;

মাটিতে শুয়ে পড়ায় সে কী ধুম।

আমার সংকেত তারা পেয়ে,

পাঁচ জন গর্তে ঢুকল গিয়ে,

প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচল শেষে;

আমি আগুন ধরালাম দরজা ঘেঁষে।

পুরোচন জ্বলে গেল জতুগৃহে তার—

পাণ্ডবরা পালিয়ে গেল যে যার,

রাতের আঁধারে তারার আলোয়;

তারা খুঁজে নিল আরেক নিলয়।

‘ধন্যবাদ।’ বিদুর বলল। ‘আমি এইখান থেকে গল্পটা নিজের হাতে তুলে নেব।’

কাগজগুলো ছাপল সে দুর্ঘটনা—

খুন বলে হল রটনা!

পাণ্ডুর পুত্রদের হয়েছে বিনাশ,

পুরোচনেরও হয়েছে সর্বনাশ;

দেওয়ালে ছিল গালা, প্ল্যাস্টার না।

প্রধানমন্ত্রী বলল দুঃখে অপার,

কাগজগুলি হল ধিক্কারে একাকার,

আর প্রিয়া দুর্যোধনী?

তার মনের কথা আমরা জানি।

ছেলেদের বললাম থাক চুপচাপ,

কেটে যাক সব দৌড়ঝাঁপ,

ছদ্মবেশ ধরো;

অপেক্ষা করো।

ফিরে আসতে এখনি দিয়ো না লাফ।

তারা ঘুরে বেড়ায় প্রান্ত থেকে প্রান্তে,

সুন্দর কুন্তি খেটে মরে দিনান্তে,

দেশের কথা জানল তারা এতদিনে;

ছদ্মবেশ ধরে, ভারতীয় সেজে প্রতিদিনে,

সূর্য ওঠে, চলে যায় দিগন্তে।

তারা ছদ্মবেশে করে যায় কাজ,

ফিরতে তাদের হবে না তো আজ,

পাণ্ডুরা রইল নির্ভয়ে।

জনমানুষ বিহীন আশ্রয়ে;

পরতে দেরি আছে তাদের রণসাজ।

হল সব সমস্যার-ই সমাধান,

দুর্যোধনী হয়ে গেল সাবধান,

দ্রোণ পড়ে গেল একা।

পাণ্ডবের সঙ্গে হয় না যে দেখা;

আন্দোলনের হয়ে গেল তিরোধান।

ধৃতরাষ্ট্রের সে কী আনন্দ,

পার্টিতে আর রইল না ধন্ধ,

শত্রুর মুখে দিয়ে ছাই;

সে রইল মধ্যমণি একাই,

তার প্রেমে সকলে হল অন্ধ।

৮৫

‘তার মানে তারা নিরাপদে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর এখানে আমরাও নিরাপদ! ব্রিলিয়ান্ট, বিদুর!’ প্রধানমন্ত্রী প্রশংসায় ফেটে পড়ল, ‘দেখো কণিকা, বিদুর কেমন সব সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। এতটুকু হিংসার আশ্রয় নেয়নি!’

‘নিশ্চয়ই। কিন্তু পুরোচন লাল আর তার বন্ধুদের ব্যাপারটা?’ কণিকা মেনন সর্বদাই কঠিন সত্য বা অপ্রিয় সত্য বলে।

‘অ্যাঁ…হ্যাঁ।’ ধৃতরাষ্ট্র অল্প অপ্রতিভ, ‘ওটা বোধহয় অবশ্যম্ভাবী ছিল, তাই না বিদুর?’

‘ঠিক তাই, প্রধানমন্ত্রী।’ বিদুর তার গলায় একটা সরকারি ভাব এনে বলল, ‘পুলিশের কয়েকটা মরদেহ দরকার ছিল, এদিকে ভাইপো আর বউদিকেও তো বাঁচাতে হবে!’

‘কণিকা এবার তুমি বলো, স্বাধীন দেশকে কেমন দেখছ?’

‘কোথায় যে শুরু করি! তোমার চারিদিকে গুণধরদের অভাব নেই। ওই প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর কথাটাই ধরা যাক না। সর্দার খুশকিসমত সিং সম্প্রতি লন্ডনে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি নৈশভোজে চার্চিল স্বীকার করেন, যৌবনে তিনি সাত বছর একটি মহিলার সঙ্গে সহবাস করেছেন। সবাই হতবাক হয়ে চার্চিলের দিকে তাকাতেই তিনি কৌতুকটি শেষ করলেন এই বলে যে মহিলাটি তাঁর মা। সবাই একসঙ্গে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

ক’দিন আগে আরেকটি নৈশভোজে সর্দার কৌতুকটি নিজের মতো করে বললেন, আমার যৌবনে আমি সাত বছর এক মহিলার সঙ্গে সহবাস করেছি, যিনি আমার স্ত্রী নন।

হতবাক হয়ে সর্দারের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে সর্দার কৌতূহল করল, ‘তিনি হলেন চার্চিলের মা।’

ধৃতরাষ্ট্র হো হো করে হেসে উঠল, ‘ওহঃ কণিকা! তোমায় ছাড়া দিল্লিতে বাঁচব কী করে? আবার তোমায় ছাড়া বিদেশের সামনেও তো মুখ দেখানো যাবে না! ইউনাইটেড নেশনস-এর সামনে মনিমির নিয়ে আমাদের হয়ে তর্ক করবে কে?

‘কণিকা, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে কর্ণস্থানীরা ইউনাইটেড নেশনস-এর কাছে মণিমিরের ব্যাপারে আমাদের এইভাবে কোণঠাসা করতে পারবে! এটা জানলে আমি কোনওদিনই এই ব্যাপারে ইউ এন এর হস্তক্ষেপ চাইতাম না।’

‘প্রধানমন্ত্রী, আপনি ভুল করেছেন।’ কণিকা বলল।

‘বিদেশিরা আমাদের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি কিছুই জানে না কিন্তু আমরা না বললেও কর্ণস্থান তাদের হস্তক্ষেপ চাইত। এ ব্যাপারে ওদের দোষ দেওয়া যায় না। মনিমির মুসলমানপ্রধান রাজ্য এবং কর্ণস্থান তৈরি হয়েছিল মুসলমানদের জন্যেই। ফলে কর্ণস্থানের এটা ন্যায্য চাহিদা। আমি অবশ্য ইউএন-কে জোর গলায় বলি, ভারত ধর্মভিত্তিক এই বিভাজনে বিশ্বাস করে না। আমি এও বলি, মনিমির ভারতের সঙ্গে সন্ধি করেছে কর্ণস্থানের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে। কিন্তু তারা তখন বলে, মনিমির ভারতের বন্ধু, শেখ আজারুদ্দিনকে ভারত কারাবন্দি করল কেন? তবে?’

‘আমার উপায় ছিল না কণিকা। সে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল।’

‘আমি জানি। আমিই তো উত্তরগুলো তৈরি করে বিদেশিদের এতদিন ধরে বোঝাচ্ছি। আমার তো এর মধ্যেই রেকর্ড রয়েছে সব থেকে লম্বা বক্তৃতা দেওয়ার। সেখানে আমি প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর দিয়েইছি। উপরন্তু বলেছি যে যদি শেখ আজারুদ্দিনের মতো কোনও লোক, তাদের দেশের একটা কোনায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তারা কী করত?’

‘আমি জানি, কণিকা। তুমি দারুণ কাজ করেছ। কিন্তু এখন তোমাকে আমি আমার পাশে ক্যাবিনেটে চাই। পরের ভোটে তুমি লড়বে।’ ধৃতরাষ্ট্র বলে।

আমার জন্য কি বিদেশমন্ত্রক বরাদ্দ করেছ? আমি সাউথ ব্লকের ভামগুলোকে ছেড়ে কথা বলব না কিন্তু!’

‘না কণিকা। ওই মন্ত্রক তো আমি নিজের জন্য রেখেছি। বিদেশ সংক্রান্ত ব্যাপারে, অন্ধত্ব সত্বেও আমি স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারি। অন্য ব্যাপারে চোখ দুটোর খুব দরকার। তোমার জন্য সর্দার খুশ কিসমত সিং-এর মন্ত্রকটাই আমি বরাদ্দ করেছি।’

৮৬

পাণ্ডবরা দক্ষিণের দিকে যাত্রা করল। কখনওই তারা একজায়গায় বেশিদিন থাকছিল না। তাদের দেখে আমেরিকার কাউবয়দের কথা মনে পড়ে যায়। কাউবয়রা যেমন গ্রামে ঢুকে বন্দুক চালিয়ে অন্যয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে শান্তি এনে দিয়ে তারপর হারিয়ে যেত দিগন্তে, পাণ্ডবদের গল্পও অনেকটা সেরকমই ছিল।

তারা কখনো একটা গ্রামে গিয়ে দেখত, ভারতের সংবিধানকে অবজ্ঞা করে কোনো গ্রাম্য পণ্ডিত হরিজনদের মন্দিরে ঢুকতে দিচ্ছে না, অথবা কোনো বাড়ির মালিক অন্যায়ভাবে অসহায় ভাড়াটেদের উৎখাত করছে, আবার কোথাও কোনও পুলিশ বা স্থানীয় কর্তা মানুষের ওপর অত্যাচার করছে।

যুধিষ্ঠির প্রথমে ভালো কথায় বুঝিয়ে সুঝিয়ে ব্যাপারটা মেটাতে চেষ্টা করত। যখন দেখত যে কাজ হচ্ছে না তখন অর্জুন এগিয়ে যেত ন্যায়বিচারের চেষ্টায়। কিন্তু সেটাও কার্যকর না হলে ভীম নিজস্ব ভঙ্গিতে সমস্যার মীমাংসা করে দিত। অর্জুনকে ফের সেখানে দেখা যেত, উভয়পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া করাচ্ছে। গ্রামের মানুষরা অভিভূত হয়ে পাণ্ডবদের গ্রামের বাসিন্দা হয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করত। এর কিছুদিনের মধ্যেই তাদের দেখা যেত সেখান থেকে সরে যেতে। কখনও বাসে কখনও গরুর গাড়ি বা লরিতে এবং বেশিরভাগই পায়ে হেঁটে, তাদের দিগন্তে মিলিয়ে যেতে দেখা যেত, পড়ে রইত পাণ্ডবদের ঘিরে গড়ে ওঠা অবিশ্বাস্য সব গল্প।

আজও গাঙ্গেয় ভারতবর্ষের গ্রামে সন্ধেবেলায় গরিব মানুষ দাওয়ায় বসে বসে সব গল্প বলে। বুড়ি ঠাকুমারা গল্পের রেশ রেখে যায় তাদের নাতি-নাতনিদের মধ্যে বংশপরম্পরায়। গল্পগুলি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একেবারে রূপকথায় পরিণত হয়ে গেছে, পাঁচ ভাই-এর বীরত্বের কাহিনি। অন্যয়ের বিরুদ্ধে লড়াই-এর কাহিনি। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গল্পগুলির এত রকম রং যে কখনও মনে হয় আলাদা আলাদা মানুষদের নিয়ে বলা। কখনো হস্তিনাপুরের পাঁচ কুমার হয়ে গেছে মুনি-ঋষি, কখনও নির্বাসিত গুণীজন, কখনও আবার তাদের স্বর্গের প্রেরিত দূত বলা হয়েছে। গল্পগুলোতে কুন্তিকে পাওয়া যায়, মা, বোন, রাঁধুনি অথবা দেবী হিসেবে। সব ভালোরই তো শেষ আছে গণপতি! পাণ্ডবরা একটা জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই অন্যায় কিন্তু ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠত।

একটু অন্যরকমভাবে বলি গণপতি? পাণ্ডবরা পাঁচটা ভালো কাজ করলে তার মধ্যে চারটে মানুষ ভুলে গেলেও এমন এক-একটা শিষ্য তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিল, যারা পরে সমাজ সংস্কারের কাজে হাল ধরেছে। স্বাধীন ভারত এগিয়ে চলল। সংসদ একটার পর একটা আইন পাশ করতে লাগল। একেবারেই কি কোনও উন্নতি হল না? সংখ্যালঘু কিছু মানুষের জীবন অগ্রসর হল বই কী!

দিল্লিতে ধৃতরাষ্ট্র প্রিয়া দুর্যোধনীকে পাশে নিয়ে দেশ শাসন করতে লাগল। ইংল্যান্ডে ফেবিয়ানরা যেমন গ্যাস আর গরম জল নিয়ে আন্দোলন করেছিল, ধৃতরাষ্ট্র একটু বদলে দিয়ে ধোঁয়া আর বাষ্প নিয়ে গড়ে তুলল কারখানা-ভিত্তিক বিপ্লব। চতুর্দিকে কারখানা গড়ে উঠতে লাগল। জলের বাঁধ গড়ে উঠল পাতকুয়ার পাশে। ভারত কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তর শিল্পশক্তি হিসেবে পরিগণিত হল। এটাও সত্যি যে ৮০ শতাংশ মানুষ তখনো ইলেকট্রিসিটি বা স্বচ্ছ পানীয় জল পায়নি।

গড়ে উঠল বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট কলেজ। ব্রিটিশরা গ্রামে শিক্ষার প্রসার ঘটায়নি। তারা শহরে শিক্ষার আলো এনে নিজেদের প্রয়োজনে কেরানি আর আমলা তৈরি করেছিল। আমরাও স্বাধীনতার পরে শহরভিত্তিক সভ্যতার প্রসারে গ্রামকে ভুলে থাকলাম। কিছুদিনের মধ্যেই ভারত সবথেকে বেশি বৈজ্ঞানিক তৈরি করতে পারল। আবার এটাও বাস্তব, এদেশেই সবথেকে বেশি শিক্ষিত বেকার। আমাদের মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রেরাই লন্ডনের হাসপাতাল চালাত। কী আশ্চর্য, আমাদেরই গ্রামের পর গ্রামে একটাও স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই! চিকিৎসার অভাবে আজও মানুষ মারা যায়। আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের পড়াশোনার জন্য সরকার ভর্তুকি দেয়। পাশ করে তার এদেশে নয়, আমেরিকার কোম্পানিগুলির চেয়ার আলোকিত করে। কলেজের নতুন ভবন তৈরি করার জন্য আজও গরিব মেয়েরা পিঠে শিশু বেঁধে নিয়ে মাথায় ইট বয়ে চলে। আজকাল অবশ্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কিছুটা গ্রামোন্নয়নের দিকে মন দিয়েছে। দিলে হবে কী, কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করে ছেলেরা এদেশের অনুর্বর জমি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সোজা গিয়ে হাজির হচ্ছে আরবের মরুভূমিতে ফুল ফোটাতে!

আঃ গণপতি, আমি আবার হারিয়ে গেছি। বলছিলাম পঞ্চপাণ্ডবের গল্প। তারা পাহাড়, বন-জঙ্গল উপত্যকা পেরিয়ে দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে ঘুরে বেড়াতে থাকল।

৮৭

পঞ্চপাণ্ডব পৌঁছোল এক অঞ্চলে। সেখানে দুই জমিদার পিনাকা এবং সারাঙ্গা দুজনের জাত শত্রু। পিনাকা খুবই শক্তিশালী। নিজেকে জাহির করার জন্য একটা ঈগল কাঁধে নিয়ে ঘোরে। তার জমিতে যারা চাষ করে, তাদের সে ভালো দাম দিলেও জমির স্বত্ব তাদের দেয় না। সারাঙ্গা তার ভাগচাষিদের জমির আংশিক মালিকানা দিলেও তাদের থেকে জোর করে তোলা আদায় করে। দুজনেই পোষা গুন্ডা রেখেছিল নিজেদের সীমানা পাহারা দেওয়ার জন্য।

পাণ্ডবরা এখানে এসে বসবাস করতে থাকল। কোনও পক্ষের দিকে ঘেঁষল না। এরা প্রথমে পাণ্ডবদের সন্দেহ করল। পরে বন্ধুত্ব করতে চাইল।

‘তোমরা সারাঙ্গার বিরুদ্ধে কথা বলছ না কেন? সে গরিব হাঙ্গারি দাশকে মেরে, তার স্ত্রীকে ভোগ করছে। ছেলেমেয়েদের গুম করেছে! বেচারা হাঙ্গারি শুধু নিজের ফসল পরিবারের জন্য রাখতে চেয়েছিল।’ পিনাকা পাণ্ডবদের জিগ্যেস করেছিল।

‘আমরা ধিক্কার জানালে কি হাঙ্গারির শরীরের ক্ষত, তার স্ত্রীর সম্মান এবং বাচ্চারা ফিরে আসত?’

‘পিনাকা তার ভাগচাষিদের জমির অধিকার দেয় না। নিজেই সব মুনাফা লোটে। কোনও ভাগচাষি যদি তার মনের মতো ফসল না ফলাতে পারে, তাকে সরিয়ে দিয়ে অন্য চাষিকে চাষ করতে দেয়। তাও তোমরা আমার পক্ষে থাকছ না কেন?’

‘তাতে কোনো সুরাহা হবে কি? পিনাকা কি জমির স্বত্ব দেবে তার চাষিদের?’

দু-পক্ষই পাণ্ডবদের পছন্দ করছিল না। পাণ্ডবরাও বুঝল এই অঞ্চলে তাদের খুব কিছু করার নেই। সরে গেল।

চলো গণপতি, এই ফাঁকে একটু দিল্লিতে গিয়ে দেখি দেশের রাজধানীতে কী হচ্ছে! ইতিমধ্যে কোল্ড ওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। পৃথিবী দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। ধৃতরাষ্ট্র এবং কণিকা সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভারতের নিষ্পৃহ থাকার কথা ‘নন অ্যালাইনমেন্ট’-এর মাধ্যমে ঘোষণা করেছে। দুজনেই কোল্ড ওয়ারকে বর্বরোচিত আচরণ বলে মনে করে মানুষের বৃহত্তর মঙ্গলের কথা বলে লম্বা-লম্বা বক্তৃতা দিল। ডলার তখন প্রায় ভগবানের পর্যায় পৌঁছে গেছে! ভারত কী করে ভাবলেশহীন হয়ে থাকতে পারে, তা নিয়ে বিস্তর জল্পনা চলতে লাগল। কণিকাকে এক বিদেশি ম্যাগাজিনের কভারে দেখা গেল কেউটে সাপের কার্টুনে। অন্য পক্ষও ভারতকে বিশ্বাস করল। তাদের কাছে ভারত তখনো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ছায়াসঙ্গী। মুখে নন-অ্যালাইনমেন্ট-এর কথা বললেও ভারত আসলে ধনতন্ত্রের সাধক। ধৃতরাষ্ট্র এবং কণিকা নন অ্যালাইনমেন্ট-এ বিশ্বাসী হলেও যারা আইন তৈরি করেছিল বা কার্যকর করেছিল, তারা কি এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিল?

ধৃতরাষ্ট্র আর কণিকা কি তাদের সাম্রাজ্যবাদের সুপ্ত বাসনা বেশিদিন গোপন রাখতে পেরেছিল? ভারত অহিংসার প্রচার করেও তার দুর্বল পড়শির দিকে হাত বাড়াল কেন? পর্তুগিজ কলোনি কোমিয়াকে ভারতের বশ্যতা মানতেই হল। সে দেশের সমুদ্রতট, ডাগর মহিলাদের দিকে ভারতের দৃষ্টি ছিল স্বাধীনতার পর থেকেই।

যখন কোমিয়াকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পারল না, তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কণিকা ময়দানে নামল। ভারতীয় সৈন্যরা তাদের প্রথম বিদেশি লুঠ ঘরে তুলল।

৮৮

পাণ্ডবরা হাঁটতে-হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একদিন জঙ্গলে রাত কাটাবে ঠিক করল। কুন্তি আর যমজ ভাই দুজন হাঁটতে হাঁটতে এত শ্রান্ত, আর পারছিল না। ভীম তাদের কোলে তুলে নিয়ে চলতে লাগল। তারপর জঙ্গলে পৌঁছে একটা ফাঁকা জায়গায় ঝপ করে ফেলে দিল। সেও পরিশ্রান্ত। কাছেই একটা সাইন বোর্ড-এ লেখা ছিল—’নিজস্ব সম্পত্তি, ভেতরে ঢোকা বারণ।’ ভীম একটানে উপড়ে ফেলে দিল।

‘অ্যাই! কে রে?’ একটা গর্জন শোনা গেল। এই জঙ্গল আর বাড়িটার মালিকের দৈত্যের মতো বিশাল শরীর, ছাগল দাড়ি হিড়িম্ব। তার ঘুম ভেঙে গেছে।

হাই তুলে, ভুঁড়িতে চাপড় মেরে সে তার বোনকে ডাকল, ‘গিয়ে দ্যাখ, কে আওয়াজ করল? যদি কোনও জন্তু বা বাতাস হয়, আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ব। যদি কোনও মানুষ হয়, আমি তাকে নিয়ে ফুটবল খেলব!’

ছোট্ট বোন তার দানব ভাইয়ের ঠিক উলটো স্বভাবের। দেখতেও ভারি মিষ্টি।

মেয়েটা ভয়ে-ভয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর একটু এগিয়ে ফাঁকা জায়গাটায় পৌঁছোল। দেখল, একজন মহিলা আর চারজন যুবক ঘাসের ওপর শুয়ে ঘুমোচ্ছে। ভীম একা একটা গাছে ঠেসান দিয়ে বসে পাহারা দিচ্ছিল। তার চওড়া বুক, সুঠাম বাহু, আর শক্তিশালী চওড়া কাঁধ দেখে মেয়েটি তার প্রেমে পড়ে গেল।

মেয়েটি চুপিসারে এল বেরিয়ে,

ভীম মোহিত হয়ে রইল তাকিয়ে,

‘কে তুমি?’ মিষ্টি হেসে বলল সে মেয়ে

‘এটা নিজস্ব জমি, দেখনি কি চেয়ে?

ভাই যদি জেনে যায় চিবিয়ে তোমায় খাবে,

বাঁচতে যদি চাও তবে আমার সঙ্গে যাবে।

হিড়িম্ব কেন, কেউ সেখানে মোদের পাবে না খুঁজে,

চলো যাই, দুজনে থাকব না আর মুখ বুজে।’

বলতে বলতে কোমর দুলিয়ে রতির ইশারা করে

মেয়ে নয়, ভরা যুবতী, ভীম দেখল দুচোখ ভরে।

‘কথা কয়ো না, চলে এসো’, ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ায়,

‘ভাই এসে না ধরে ফেলে অনর্থ বাঁধায়—

দাসী বাঁদি আমি তার হায় এ কী জীবন!

তুমি এসে বাঁচালে আমায় নয়তো ছিল মরণ

এসো প্রাণনাথ দাও আমাকে মুক্তির স্বাদ

ভরা যৌবনে কেন আমার এহেন বিষাদ?

‘সে এক দানব হেথায় থাকে সে, তুলে তার আগল,

তোমাদের যদি দেখতে সে পায় রাগে হবে পাগল।

আমাকে সে পাঠিয়েছিল দেখতে আওয়াজ পেয়ে,

যদি জানতে পারে সত্যি নেবে এখনি খেয়ে।

কিন্তু যদি আমার সঙ্গে চলে আসো এখনি;

তোমাদের আমি লুকিয়ে ফেলে বাঁচিয়ে দেব তখনি।’

মেয়েটির সে আকুতি ভীম নিল না আর কানে,

এটা রতি-বিলাসের সময় না যে, ভীম সেটা জানে।

হোক সে যতই সুন্দরী ঠোঁট থেকে বুকে,

ভীম এখন বসে পাহারায়, যাবে সে কোন সুখে?

হরিণ যেন চকিত রয় হরিণীর পাশে,

ঘুমন্তদের পাশে জেগে সে নিরাপদ আশ্বাসে।

‘বোকা মেয়ে, সুন্দরী বটে ডেকো না আমায় এখন,

সতর্ক থাকি এদের পাশে বিপদ আসে কখন।

ভাইকে গিয়ে বলে দাও যে শক্তিশালী ভীম—

লড়াই করার পথ চেয়ে রয় সাহস তার অসীম।’

কিন্তু মেয়ে শুনল না যে বসন খুলে দেয়,

অপলক ভীম চেয়ে রয় তার এ কী ভীষণ দায়!

বুক যেন তার দুটি শঙ্খ, সরু কটিদেশ তার,

চওড়া নিতম্ব, সুঠাম উরু, মাঝে বিস্ময় অপার।

ভীমের পৌরুষ জেগে উঠেছে বাঁধন মানে না আর,

কিন্তু হঠাৎ দানব হাজির সেথায়, এক হুঙ্কার!

‘বেশ্যা মাগী’, দস্যু চেঁচায় রক্তচক্ষু বিস্ফারিত,

নাক দিয়ে তার আগুন ঝরে, বোনকে করবে দলিত।

ভয়ে কাঁপে সে ভীমের আড়ালে, দানব থেকে বাঁচতে

‘তুমি কি পুরুষ? ছিঃ ছিঃ নীচ তুমি বাধ্য করলে হাসতে।

এসো লড়ো তুমি আমার সঙ্গে দেখি গায়ে কত জোর’,

দানব চেঁচায়, ‘দেখে নেব তোকে হিম্মত দেখি তোর

মেয়েটাকে চাবুক মেরে বন্ধ করব খাঁচায়

তারপর তোর হাত-পা ছিঁড়ব, দেখি কে তোকে বাঁচায়!’

‘চল তবে আর দেরি কেন করিস, লড়ি অথবা মরি—’

ভীম হাঁটু চালায় দানবের পেটে ব্যথায় গেল সে পড়ি।

উঠে ফের লড়তে লাগল ঘুম ভেঙে দেখে সবে,

নগ্ন মেয়ে উৎসাহ দেয় ভীম জিতছে যবে।

কুন্তি তার পরিচয় চায়, ‘কে তুমি মেয়ে?’

‘আমি হিড়িম্বর বোন’, বলে কাপড়ে নিজেকে ছেয়ে

‘ভাই রেগে যায় এখানে যদি নতুন মানুষ আসে’,

‘আমার ছেলেও রাগী ভীষণ’, কুন্তি অল্প হাসে।

‘জানি আমি, এমন শক্তি দেখিনি আমি আগে’,

‘আর কতজনে দেখেছ বাছা, প্রশ্ন মনে জাগে!’

‘মাত্র দুজন, এই পুরুষ আর ওই ভীষণ ভাই,

ওই পুরুষের দেখছি এখন কোনো তুলনা নাই।’

দানব তখন দেখছে চোখে সূর্য তারার আলো

কুন্তি বলে, ‘শোন মেয়ে বসন পরো ভালো’

লজ্জায় রেঙে মেয়েটি বলে ‘ভীমকে ভালোবাসি

সে যদি আমায় গ্রহণ করে, মুখে ফোটাবই হাসি।

কাজ সব পারি, শরীরে সুস্থ আমাকে সঙ্গে নিন’,

হিড়িম্ব হয়েছে ধরাশায়ী, কাতরায় শক্তিহীন।

কুন্তি ডাকে, ‘ভীম এবার সময় হয়েছে বিয়ের

মেয়েটিকে দাও দায়িত্ব তোমার স্ত্রীয়ের

লড়েছ তুমি তারই জন্যে পালাতে পারোনি ছেড়ে

মিষ্টি মেয়ের, সুস্থ সবল হাসি নিও না কেড়ে

আমার হবে সঙ্গী মেয়ে, তোমরা বোঝো না যে

এই জীবন কি এ বয়সে সয়, ফেলে চলে গেছে সে!’

‘এত তাড়াহুড়ো সময় দিলে না তোমরা সবাই মিলে,

জীবনের গতি ঘণ্টার মধ্যে পালটাল এক ঢিলে!’

‘আমি তোমায় দুঃখ দেব না কথা দিলাম নাথ’,

মেয়ে হেসে কয়, সরল চোখে বাড়িয়ে দেয় হাত,

ভীম চেয়ে দেখে, মনে পড়ে যায় তার সৌন্দর্য অপার।

সেই নিতম্ব আর বক্ষ চোখে ভাসে আবার,

ভালোবেসে সে নিজেকে করেছিল অর্পণ;

দুচোখে তার ভীমের ছবি যেন দুই দর্পণ।

ঠিক আছে তবে তুমি হলে স্ত্রী, আমি তোমার স্বামী,

স্বর্গ হল তুষ্ট বড়, হাসলেন অন্তর্যামী।

৮৯

কোমিয়া হেরে গেল। ভারতীয়রা আনন্দে রাস্তায় নাচ-গান জুড়ে দিল। দেশ থেকে শেষ ঔপনিবেশিক শক্তিকে বহিষ্কার করা গেছে। একমাত্র এরাই এতদিন ধরে আস্তানা গেড়ে বসেছিল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কণিকার নেতৃত্বে ভারত এই জয় হাসিল করল। গোটা দেশে সে হয়ে উঠল জাতীয় নায়ক। ধৃতরাষ্ট্র কোমিয়া জয় থেকে একটা বড় শিক্ষা পেল। মনিমির-এর ক্ষেত্রে যে দোনোমনো সে দেখিয়েছিল, তার ফলে দেশের চিরদিনের জন্য মনিমির কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকবে।

উত্তরের দিকের একটি দেশ অবশ্যই ভারতের এই সাফল্যে খুশি হয়নি। ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল পৃথিবীর সবথেকে জনবহুল রাজনৈতিক অত্যাচারের দেশ, পিপলস রিপাবলিক অফ চক্রর।

‘ওরা বড্ড বাড়াবাড়ি আরম্ভ করেছে’, বলেছিল দেশের চেয়ারম্যান। চারিদিকে বসা মুখগুলোকে আলাদা করে চেনা যায় না। তারা পুতুলের মতো মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল।

ভারত আর চক্রর মধ্যেকার দেশ টিবিয়া। দু-হাজার বছর ধরে ভারত সভ্যতার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছে, তা সে বৌদ্ধ ধর্মের নির্যাসই হোক কি হিন্দুধর্মের মন্ত্রতন্ত্র হোক। চক্রর চোখ টিবিয়ার ওপরে ঘোরাফেরা করছিল। টিবিয়া নিজের স্বাধীনতা বজায় রাখতে পেরেছিল অনেকদিন। ইংরেজরা তাকে অধিগ্রহণ করে স্যার ফ্রান্সিস ওল্ড ওয়াইফ-এর সময়ে। কিন্তু বুঝেছিল যে টিবিয়া অধিগ্রহণ করে বিশেষ লাভ নেই। তাই শান্তির চুক্তি করেছিল সে দেশের সঙ্গে। ভারত টিবিয়াকে আলাদা করার জন্য আঁকা হল নতুন সীমারেখা। ম্যাকডোনাল্ড বলে এক স্কটিশ ভদ্রলোক সে রেখা এঁকেছিল। সে লাইনকে বিগ ম্যাক লাইন নাম দেওয়া হল।

চক্রর সামরিক শাসন যখন চেয়ারম্যানের অধিনায়কত্বের কাছে নতি স্বীকার করে কমিউনিজমকে বরণ করে নিল, তখন ধৃতরাষ্ট্র ভারতের তরফ থেকে চক্রকে অভিনন্দন জানাল। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সভায় ভারতকে চক্রের পাশে দেখা গেল। চক্রর রাজধানী স্নুপিং-এর সঙ্গে দিল্লির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলতে লাগল। ‘হিন্দি-চক্র ভাই ভাই’, স্লোগান উঠল। ধৃতরাষ্ট্র-কণিকাকে দেখা গেল চক্র নেতাদের পাশে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে ছবি তুলতে। তারা বোঝেনি, ‘হিন্দি চক্র ভাই ভাই’ শিগগির হয়ে উঠবে ‘হিন্দি-চক্র বাই বাই’।

চক্রের লোকেরা যতই কমিউনিজম-এ বিশ্বাস করুক, অন্য দেশকে নিজের কবজায় করতে কে না চায়! কিছুদিনের মধ্যেই তারা অনায়াসে টিবিয়া জয় করল। তারপর ভারতের সীমান্তে পৌঁছে গেল। বিগ ম্যাক লাইনটা এবার ভারত এবং চক্রের মাঝখানে।

ব্যাপারটা স্নুপিং-এর ভালো লাগছিল না। একে তো বিগ ম্যাক লাইনটা তৈরি করেছিল ঔপনিবেশিক শক্তি, যার অস্তিত্ব নেই। পিপলস রিপাবলিক যখন টিবিয়াকে অধিগ্রহণ করেই নিয়েছে, তখন সীমান্ত রেখা ঠিক করার স্বাধীনতা তারই থাকা উচিত। ম্যাক ডোনাল্ড লাইনটা এমন ভাবে কেটেছিল যে টিবিয়ায় পৌঁছোতে চক্রকে প্রচুর বেগ পেতে হত। এখন তো সেই কষ্ট করার প্রশ্ন ওঠে না। স্নুপিং তাই সীমান্তে কিছু রদবদল চাইল।

চক্র ভারতের সঙ্গে কিছু বন্ধুত্বপূর্ণ বোঝাপড়া চাইতেই পারত। ভারত যে বিগ ম্যাক লাইন নিয়ে খুব খুশি, তা তো নয়। আমি তখন ধৃতরাষ্ট্রের সরকারের ক্যাবিনেটে রয়েছি। আমরা অনেকেই মনে করতাম বিগ ম্যাক লাইনটি কোনও আধুনিক বৈজ্ঞানিক মতে তৈরি করা হয়নি। চক্র যা চাইল, তাতে ভারতের মানচিত্রের একটা অংশে ক্ষত তৈরি হত। ভারত ভেবেছিল, চক্রের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সদ্য কোমিয়া জয় করে কণিকার তখন আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। সে ভুলে গিয়েছিল, কোমিয়া আর চক্র এক নয়। কোমিয়ায় একটা বড় বাহিনী পাঠিয়েই কাজ হয়েছিল। মাত্র একটা গুলি চলেছিল অধিগ্রহণের সময়।

এই সাফল্যে কণিকার মধ্যে একটা অহংবোধ এসে গিয়েছিল। সে বক্তৃতা দিয়ে আর অন্যদের চারিত্রিক দুর্বলতা নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে হাসাহাসি করে দিন কাটাচ্ছিল। সে খেয়াল না করে একটা ফাইলকে ‘পেণ্ডিং’ ট্রেতে রেখে দিল। সে ফাইলে ছিল একটা জরুরি রিপোর্ট!

ভারতীয় সৈনিকদের প্রবল পাহাড়ি ঠান্ডায় লড়াই করার উপযুক্ত পোশাক পরিচ্ছদ নেই। তারা কাপড়ের টেনিস খেলার জুতো পরে বরফে মোড়া হিমালয়ে পাহারা দিচ্ছে, ধৃতরাষ্ট্র তখন অন্ধত্বের অবলম্বন হিসেবে কণিকাকে আঁকড়ে ধরেছে। সে যা ঠিক করে, ধৃতরাষ্ট্র তাই অনুমোদন করে। কোমিয়ায় পরের বছরে ভোটে দারুণ ভাবে জিতল কণিকা।

গণপতি, একদিকে আমাদের ঢাল তলোয়ারহীন বেচারা সৈনিকরা পাহাড়ে চলল পাহারা দিতে, অন্যদিকে কণিকা দিনের পর দিন নিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হল। ধৃতরাষ্ট্র সময় কাটাতে লাগল নন-অ্যালাইনমেন্ট নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে। চক্র কুতকুতে বাঁকা চোখে তাক করেছে নতুন দিল্লিকে।

৯০

পাণ্ডবরা একাচক্র বলে একটা আধা শহরে এসে পৌঁছোল। ততদিনে ভীমের ছেলে ঘটোৎকচের জন্ম হয়েছে। ‘কিছুদিন সংসার করলে ভালো লাগবে’, ভীম কুন্তিকে বলায় তিনি যারপরনাই খুশি হলেন। তারা এক অতিথিবৎসল ব্রাহ্মণের বাড়িতে ভাড়া থাকতে লাগল। ক’দিনের মধ্যেই তাদের কানে এল যে বকাসুর এক কুস্তির প্রতিযোগিতা ঘোষণা করেছে।

‘শহরের চারদিকে পোস্টার পড়েছে। যে কেউ একশো টাকা খরচ করে বকাসুরের সঙ্গে কুস্তি করতে নামতে পারে।’

নকুল বলল, ‘যদি বকাসুর হেরে যায় তাহলে নাকি পাঁচ হাজার টাকা দেবে। এখানকার অনেক পালোয়ান চেষ্টা করেছে। কেউ সফল হয়নি।’

‘অতগুলো টাকা আমাদের খুব কাজে লাগবে।’ যুধিষ্ঠির বলল।

‘ভীম-ভাইয়া, যাও না! বকাশুরকে হারিয়ে এসো।’ অর্জুন বলল।

‘আজ নয়। আজ আমি সারাদিন ঘটোৎকচকে নিয়ে খেলব।’ স্নেহশীল বাবা ভীম বলে।

‘কিন্তু আর তো সময় নেই। বকাসুর লড়ার মতো কাউকে না পেয়ে, অন্য গ্রামে যাচ্ছে।’ নকুল বিমর্ষভাবে বলল।

‘সহদেব যাক না।’ ভীম বলল, ‘আমরা যা রণকৌশল এবং শারীরিক কসরত শিখেছি তাতে বকাসুরকে হারানো কঠিন হবে না।’

পাণ্ডবদের সবথেকে ছোট ভাই গিয়ে দাঁড়াল বকাসুরের বিরুদ্ধে লড়তে। একহারা বলিষ্ঠ সহদেবের প্রতিপক্ষ পাহাড়ের মতো বকাসুর। সহদেব সবে দর্শকদের নমস্কার জানিয়েছে। তখনই গর্জন করে বকাসুর তাকে নিমেষে মাথার ওপর তুলে খেলনা হেলিকপ্টারের মতো বনবন করে ঘুরিয়ে সামনের চেয়ারের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘আয় এবার কে আসবি।’

‘আমায় ও সতর্ক করেনি।’ সহদেব মায়ের কাছে শুয়ে চুন হলুদের পুলটিশ লাগাতে লাগাতে বলল।

‘কুস্তিতে কেউ সতর্ক করে না।’ অর্জুন বলল।

‘ভাবছি বকাসুরের পিছু ধরে অন্য গ্রামে গিয়ে ওকে এমন শিক্ষা দেব যে ও পালাতে পথ পাবে না।’ ভীম বলল।

‘খবরদার! কিছুই করবে না!’ কুন্তি রেগে উঠে বলল, ‘একবারে শিক্ষা হয়নি? আমি জানলে কিছুতেই যেতে দিতাম না।’

৯১

ধৃতরাষ্ট্র এ ভুল করল কী করে? চক্র হঠাৎ হানা দিল সীমান্তে। এবং খুব সহজেই আমাদের অর্ধনগ্ন নিরস্ত্র সৈন্যদের ছিন্নভিন্ন করে সুবিধামতন সীমানা বাড়িয়ে নিয়ে বিগ ম্যাক লাইন মুছে দিয়ে নতুন লাইন কেটে দিল। এই নতুন জমিতে তারা বড় রাজপথ বানিয়ে টিবিয়ার সঙ্গে নতুন যোগসূত্র স্থাপন করল। ধৃতরাষ্ট্র তখনও চুপ। নিজের নন অ্যালাইনমেন্টের পক্ষে সওয়াল করে বিদেশি শক্তির কাছ থেকে সাহায্য নিল না।

পার্টিতে ধিক্কারের ঝড় উঠল। কৌরব এমপিরা বিরোধীপক্ষের সঙ্গে মিলিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে স্লোগান দিল। ধৃতরাষ্ট্র এই প্রথম পদত্যাগের কথা তুলল না! সে ক্ষুরধার চাল চালল। বাধ্য করল কণিকাকে পদত্যাগ করতে। কোমিয়ার নায়ককে সবাই একমুহূর্তে ভুলে গেল।

কিন্তু এই মর্মান্তিক পরাজয়ের পরে ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যে এর আমূল পরিবর্তন দেখা গেল। সে আর বক্তৃতাগুলো দিতে যেত না। আস্তে আস্তে নন অ্যালাইনমেন্টের কথাও কমে এল।

ধৃতরাষ্ট্র খাওয়া কমিয়ে দিল। যাবতীয় জাগতিক সুখ ত্যাগ করল। সে খাট ছেড়ে মেঝেতে ঘুমোতে লাগল। মাঝে মাঝে কৌপিন পরে প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থান ছেড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। ওই সময় আমাকে একদিন বলেছিল, তার বাণপ্রস্থে যাওয়ার সময় হয়েছে। আমি বুঝলাম, আমাদের কেম্ব্রিজে পড়া সাহেবের মন ভেঙে গেছে।

একদিন সে হেঁটে জঙ্গলে ঢুকল। তারপর একটা বড় শ্বাস নিয়ে শেষবারের মতো শুধু ফুটন্ত ফুলগুলির ঘ্রাণ নিল। তারপর গাছে ঠেসান দিয়ে পদ্মাসনে বসল পূর্বদিকে মুখ করে।

কয়েক ঘণ্টা পরে আমি ওই অবস্থাতেই তাকে খুঁজে পাই। তার পায়ের কাছে খালি শিশিটা পড়ে ছিল। তার চোখের কালো চশমাটা খুলে দিয়েছিলাম। স্থির হয়ে যাওয়া চোখ দুটোতে যেন সূর্যের আলো এসে পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *