অষ্টাদশ অধ্যায় । মোক্ষলাভের পথে

অষ্টাদশ অধ্যায় । মোক্ষলাভের পথে

১১৬

সত্যিই এসে গেল সময়। দুর্যোধনীর প্রতাপ যখন তুঙ্গে, হঠাৎ সে জরুরি অবস্থা তুলে দিল। নির্বাচনের ডাক দিল।

কেন তার এমন মন পরিবর্তন, তা নিয়ে অনেক গল্প আছে। কেউ বলে, তার সঙ্গে এক কালো সাধু দেখা করতে আসার পর থেকে তার এই মন বদল। কেউ বলে কৃষ্ণ নামে এক জ্যোতিষী তাকে বুঝিয়েছিল, নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন করলে তার জয় নিশ্চিত।

গণপতি, আমাদের দেশে মেয়ের বিয়ে থেকে বিমানে ওড়ার টিকিট সবই জ্যোতিষ মেনে হয়। আমি খুব একটা অবিশ্বাস করতে পারলাম না। একজন ভারতীয়ের কোষ্ঠি না থাকা আর একজন আমেরিকানের ক্রেডিট কার্ড না থাকা, দুটোই এক। কেউ বলে প্রিয়ার গোয়েন্দারা তাকে খবর দিয়েছিল যে নির্বাচন হলে তার জয় নিশ্চিত। কেউ কেউ মনে করত, পাশের দেশ কর্ণস্থানে সেই সময়ে জলি শাহ ঝুটা সামরিকতন্ত্রের ওপর ঘোমটা টানতে যেহেতু নির্বাচন ঘোষণা করে সারা পৃথিবীতে হইচই ফেলে দিয়েছিল, প্রিয়া হীনম্মন্যতায় ভুগছিল। পৃথিবীর সবথেকে বড় গণতন্ত্রে এক বছর ধরে জরুরি অবস্থা চালু রেখে সে নিজের হাতে গণতন্ত্রেরই হত্যা করেছিল!

নির্বাচন ঘোষণা হল। জেল থেকে রাজনৈতিক বন্দিদের ছেড়ে দেওয়া হল, সংবাদমাধ্যমের ওপরে লাগানো তালা খুলে দেওয়া হল। মানুষ আবার শ্বাস নিতে পেরে আনন্দে আত্মহারা হল। তারা বুঝল, নষ্ট করার মতো সময় এটা নয়। বাঁচতে হলে দুর্যোধনীকে ক্ষমতাচ্যুত করতেই হবে।

নির্বাচন হচ্ছে এক ভারতীয় যাত্রাপালা। তাতে মহা হইচই হয়ে থাকে। কত গাছ যে কাটা হয় কোটি কোটি ব্যালট পেপার ছাপতে, তার কোনও হিসেব আছে?

খবরের কাগজগুলো লিখে চলে কীভাবে নদী সাঁতরে, বরফের চুড়ো পেরিয়ে সবথেকে প্রত্যন্ত গ্রামেও ব্যালট বাক্স পৌঁছে দেওয়া হল। তারপর সেই বৃদ্ধার গল্প তো আছেই। যিনি বয়সের ভারে কোলে চড়ে ভোট দিতে এসেছেন। তারপর ছাপ্পা ভোট, বুথ ক্যাপচার, বোমা ছোঁড়াছুঁড়ি, খুন, জখম আর অপহরণ…

নির্বাচনকে ভারত অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছে। ভারতীয় ভোটার অশিক্ষিত, গ্রাম্য। কিন্তু সে বারে বারে ভোট দিয়ে রাজ্যে এবং কেন্দ্রে আলাদা-আলাদা সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে। এটাও সত্যি যে প্রত্যেক নির্বাচনে একটা নতুন পদার্থ আবিষ্কার হয়। তা দিয়ে আঙুলে ভোট দেওয়ার কালি উঠিয়ে দেওয়া যায়। প্রতিটি নির্বাচনেই শোনা যায় যে ভোটার তালিকা থেকে বহু মানুষের নাম কাটা পড়েছে বা একজনের ভোট অন্য কেউ আগেই দিয়ে দিয়েছে। শেষপর্যন্ত সবাই খুশি মনে বাড়ি ফেরে!

এ নির্বাচনটা ছিল একেবারে আলাদা। এটাতেও কিছু লঘু মুহূর্ত ছিল যেমন যুধিষ্ঠিরের দলবল দুর্যোধনীর কর্মচারীদের বলল, নিজেদের খোজাকরণের প্রমাণপত্র দেখাতে!

একজন সাংবাদিক আমাকে বলেছিল, এ নির্বাচনটা যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ।

আমার মাথা গরম হয়ে গেল, ‘ভুলো না মহাভারতের যুদ্ধে কেউ জেতেনি। সেটা একটা দুর্ঘটনা, দুঃখ, যন্ত্রণা আর মৃত্যুর কাহিনি। সেখানে সবাই শেষ পর্যন্ত হেরেছে মহাকালের কাছে।’

‘কিন্তু কৌরব-পাণ্ডবরা তো যুদ্ধ করেছিল। ধর্ম-অধর্মের যুদ্ধ।’

‘ভায়ে ভায়ে—জ্ঞাতিদের মধ্যে যুদ্ধ ছিল সেটা। মিথ্যা, লোক ঠকানো, বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি সেটা। কোনও জয়ের আনন্দ নেই সেখানে।’

সেই দিনগুলোতে আমি দেখতে পেলাম ভারতের মানুষকে আবারও স্বাধীন হতে। সেই আবেগ-উচ্ছ্বাস, যা আমি গঙ্গাজির আন্দোলনে দেখেছিলাম, আবার যেন ফিরে এসেছে। সাংবাদিকরা নতুন উচ্ছ্বাসে সংবিধানকে জানতে-বুঝতে শিখল। দেখলাম, দ্রৌপদী আবার আগের মতো সুন্দরী হয়ে উঠেছে।

কৃষ্ণ এই নির্বাচনের মধ্যমণি হল। দু-পক্ষই তার কাছে গেল পরামর্শ চাইতে। দু-পক্ষকেই সে বুঝিয়ে দিল সে সংসদের ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে না। সে নিজের এলাকাতেই ভালো আছে। শেষপর্যন্ত এত বড় নির্বাচনে সে নিষ্পৃহ হয়ে থাকতে পারল না।

দু-পক্ষই কৃষ্ণকে সঙ্গে থাকার আবেদন জানাল। প্রিয়ার কৌরব পার্টির সেক্রেটারি কৃষ্ণ। তাই তার গোষ্ঠী মনে করল, কৃষ্ণের ওপর তাদের জোর বেশি।

‘তোমরা দুজনে দুজনকে দোষারোপ করছ। তোমাদের দুজনেরই কিছু কিছু কথা ঠিক। আমার নিজস্ব মতামত এখানে জানাচ্ছি না। আমার পক্ষে তোমাদের একজনের দিকে থাকা কঠিন। আমি কৌরব পার্টির সচিব, সেটা যেমন ঠিক, তেমন এটাও ঠিক যে আমার নিজস্ব কিছু নীতি রয়েছে। আমি তোমাদের একটা শর্ত দিচ্ছি। তোমরা একপক্ষ আমাকে নাও অন্যপক্ষ আমার হাতে তৈরি শতশত রাজনৈতিক কর্মচারীদের পাও। ভি ভি জি, আপনি বয়ঃজ্যেষ্ঠ! আপনি বলুন কী চান?’

আমি বিরোধী পক্ষের হয়ে ঠিক করলাম, আমরা কৃষ্ণকে চাই। কৃষ্ণ বিরোধীদের নির্বাচনের কর্মসূচিতে নিয়ে এল তার হাসি, তার বুদ্ধিমত্বা এবং তার ঠান্ডা মাথার বিশ্লেষণ। তার নির্বাচনী প্রচার যেন বাঁশির সুদূর সুর; শ্রোতাদের প্রেমে পাগল করে দিল।

কৃষ্ণের সবচেয়ে কঠিন কাজ হল অর্জুনকে বোঝানো। অর্জুন যথারীতি দুলছিল অনিশ্চয়তায়, ‘আমি কি সাংবাদিক হয়েই বেশি ভালো করে মানুষের কাছে সত্যের উন্মোচন করতে পারতাম?’

কৃষ্ণ বলেছিল, ‘এখন যদি লড়াই না করো তাহলে পরে তোমার লেখার আর কিছু থাকবে না।’

তারা অশোকা হোটেলে চা খেতে-খেতে এই আলোচনা করেছিল। আমি যে পাশের টেবিলে নিঃশব্দে বসেছিলাম, লক্ষ করেনি।

সম্রাট অশোক আমাদের দেশের মহান শাসকদের একজন। শুরুতে অত্যাচারী হলেও পরে তার আধ্যাত্মিক উত্তরণ ঘটে। তার প্রতিচ্ছবি এসে পড়ে অশোকের ন্যায়-নীতি বোধ এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায়। তার তিন সিংহের স্তম্ভ আজও ভারতের শাসনব্যবস্থার প্রতীক। দুঃখের বিষয় তার নামে শুধু পাঁচতারা হোটেল ছাড়া বেশি কিছু নেই এদেশে। তবু সেখানেই যে অর্জুনের জ্ঞানচক্ষুর উন্মেষ ঘটল, এটাই যথেষ্ট। কী বলো গণপতি?

১১৭

বাবা, কাকা জ্ঞাতি ভাই,

যুদ্ধে তারা এল সবাই

অর্জুনের প্রাণ উঠল কেঁদে

হে কৃষ্ণ! এ কী হল সবার জেদে?

এরা তো শত্রু নয়, সবাই পরিবার,

আমার কী অধিকার এদের মারবার?

মন আমার ভেঙে গেছে গলা কাঁপছে যে,

অদৃষ্ট আড়াল থেকে আমায় দেখে হাসে।

তির আর ধনুক নিয়ে হয়েছিলাম তৈরি,

এখন কিন্তু মন আমার হয়ে গেছে বৈরী।

পারব না যে এদের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে আমি,

এ সংশয়ে বাঁচাও আমায় কৃষ্ণ প্রাণস্বামী।

ওরা ওদের কাজ করেছে, যতই হই ক্রুদ্ধ,

তাই বলে কি দুর্যোধনীর সঙ্গে করব যুদ্ধ?

যতই হোক ধৃতরাষ্ট্রের একটিমাত্র মেয়ে;

প্রধানমন্ত্রী হয়েছে সে দাদাকে সঙ্গে নিয়ে।

মানছি যে তার রাজকার্যে রয়েছে ভুল ত্রুটি,

আমাদের বিশ্বাস ভেঙেছে সে করেছে বিচ্যুতি।

কিন্তু দেশের নেত্রীকে আঘাত করলে শেষে,

মহাগুরুর সদশিক্ষা সবই যাবে ভেসে!

পরের নেতার প্রতিও কি করতে পারব কর্তব্য,

তখনও না জানি কী করাবে আমার ভবিতব্য।

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে কৃষ্ণ বলে চলে,

তৈরি হয়ে পিছিয়ো না বাঁধো মনোবলে।

একটা জীবন একটা মৃত্যু শুরু—শেষ নয় চলার,

অনন্ত এক উত্তরণের কথাই এখানে বলার।

তুমি, আমি, ছিলাম থাকব আত্মা অবিনশ্বর,

জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্ম—খেলছেন ঈশ্বর।

আমরা সবাই খেলার পুতুল করে চলি কর্ম,

জাগো তুমি, বুঝতে পারবে এই জীবনের ধর্ম।

যা হওয়ার ছিল তা হবে, তুমি অতি ক্ষুদ্র,

অস্ত্র তুলে নাও হে অর্জুন, হও কাহিনির সূত্র।

কোনও কিছুই নয় স্থায়ী এ জীবনে,

শেষ হয়েও হয় না তাই যে মরণে।

দুঃখ, কষ্ট, দারুণ গ্রীষ্ম, হিমশীতল শীত—

হারজিৎ, ভবিষ্যৎ বর্তমান বা সুদূর অতীত।

সব আসে যায়, কিছুই না রয়;

থাকার যা থাকে, যা যাওয়ার যায়।

আত্মা শুধু অমর হয়ে বিরাজ করে মহাশূন্যে;

ধ্বংসে, জন্মে যায় না বাঁধা, অথবা পাপ-পুণ্যে।

মেঘের মতো ভেসে চলে শরীর থেকে শরীরে,

প্রতি জন্মের কারণ আছে বুঝবে তুমিও অচিরে।

শ্রদ্ধা ভরে মানবে এটা, অশ্রু দিয়ে নয়,

জীবন-মৃত্যু তুচ্ছ অতি করবে তুমি জয়।

যুদ্ধে যদি নিজের হাতে আত্মীয়দের হত্যা করো,

জানবে তুমি শেষ না সেটা, বিধির লিখন এমনতর।

জাগো অর্জুন, অস্ত্র ধরো সময় হয়েছে তার,

কর্তব্য পালন করো, দুঃখ ঘোচাও দেশ মা-র।

দুর্যোধনী দেশের শত্রু পরাস্ত করো তাকে;

নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো ডরাও তুমি কাকে?

পুরুষসিংহ সাহসী হও—অন্যায়ের মুখোমুখি,

দুর্যোধনীর সামনে দাঁড়াও করো চোখাচুখি।

মনের দ্বিধা এক লহমায় হটিয়ে দিয়ে তাই,

সাহস করে এগিয়ে চলো পিছনে আমরা সবাই।

হারজিৎ যাই হোক না কেন এখন চাই লড়াই,

মনে আনো অসম সাহস, আমরা কাকে ডরাই?

মহাগুরুর ধর্মশিক্ষা থাকুক এখন মুলতুবি,

যুদ্ধে এখনি না গেলে হবেই যে ভরাডুবি!

ভালো-মন্দ দুই-ই আছে, থাকবে চিরকাল,

তোমার কর্ম তুমি করো, নইলে দেশে আকাল।

বন্ধন যত মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলে দাও আজ,

প্লাবনের মতো গর্জে ওঠো সেটাই তোমার কাজ।

মঙ্গল হবে শান্তি আসবে সেই তো সঠিক পথ,

মনের দ্বিধা যাবেই সরে হও যদি তুমি সৎ।

কর্ম করো ফল চেয়ো না, পাবে মনে শান্তি,

অন্যেরা অনুসরণ করবে কাটবে তাদের ভ্রান্তি।

আকাঙ্ক্ষাকে ত্যাগ করে যদি করতে পারো কর্ম,

তার চেয়ে কিছু হয় না বড়, তাকেই বলে ধর্ম।

যোনি ভ্রুণকে, ধোয়া অগ্নিকে দেয় আচ্ছাদন,

তেমনি এই পৃথিবীতে মোহ-মায়ার আস্ফালন।

এসবের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে হও তুমি ত্যাগী,

তবেই হবে সত্যি নেতা, দেশ হবে বিবাগী।

আত্মত্যাগ, পরিশ্রমে জাগিয়ে তোলো দেশ,

দেখবে শেষে মনের মধ্যে জীবনবোধের রেশ।

প্রিয়াকে তোমায় নির্বাচনে করতে হবে জয়,

থাকবে তুমি পবিত্র, নেই একটুও ভয়।

তোমার মুক্তি লেখা আছে কর্মের অন্তরালে,

ক্ষমা নেই কোনও লুকোও যদি দুর্বলতার আড়ালে।

আমিই হিমালয়, আমিই পূজা আমিই আগুনের আহুতি,

আমার জন্যে কর্ম করতে নাও তুমি প্রস্তুতি।

আমিই পূজারি, আমিই মন্ত্র, আমিই যজ্ঞের আগুন,

আমিই শুরু, আমিই শেষ, আমিই শীত বা ফাগুন।

আমিই তোমার পরমাত্মীয়, দেশ অথবা আত্মা,

তোমার কর্ম আমার জন্যে জাগবে তবে সত্তা।

অর্জুন এবার উঠল জেগে, তার চোখে যোদ্ধার জয়,

কৃষ্ণ, আমায় পথ দেখালে, কাটালে আমার ভয়।

দুর্বল আমি, কেঁদেছিলাম যেন ভাঙা বাঁশি,

ভুলেছিলাম আত্মার মধ্যে রয়েছে বিরাজতার হাসি।

এবার আমি খুঁজে পেয়েছি এই জীবনের মানে,

লড়ব আমি নির্বাচনে, বিরোধীদের আনো এখানে।

আর দেরি নয় করতে হবে দুষ্টের বিতাড়ন,

যুগে যুগে এইজন্যেই তাই কৃষ্ণের অবতারণ।

১১৮

প্রিয়ার বিরুদ্ধে সমস্ত বিরোধীপক্ষ এক হয়ে গেল। তৈরি হল পিপলস ফ্রন্ট। প্রিয়ার জাহাজ ফুটো হয়ে গিয়েছিল। ইঁদুরবেশী পার্টি কর্মীরা পালাতে শুরু করেছিল। আবার অনেক বড় পার্টি কর্মীও ছিল তার মধ্যে, যেমন অশ্বত্থামা। যাকে গ্রেফতার করে জেল খাটিয়েছিল প্রিয়া। নির্বাচনী যুদ্ধ উঠল তুঙ্গে। আমিও আমার বুড়োহাড়ে লড়ে গেলাম সে যুদ্ধ।

দেশ দু-ভাগে ভাগ হয়ে যুদ্ধ করল। প্রিয়ার পক্ষে বা বিপক্ষে। শুধু আমলারা অপেক্ষা করতে থাকল। আমাদের দেশে, আমলাতন্ত্রের মতো এমন বালাই আর নেই। তারা নির্ভুল এক ব্যবস্থাপনা চালু করেছে ভারতবর্ষে, যাতে কোনও কাজই স্বাভাবিকের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি সময় না নিয়ে শেষ হয় না। কথায় আছে না যে সব কিছুর জন্যেই স্থান, কাল, পাত্রের সঠিক সমন্বয় চাই! এই প্রবাদকে আমাদের দেশের আমলারা একটা অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিটি কাজই আমাদের আমলারা পাঁচ হাত ঘুরিয়ে তবে শেষ করে। আমি মনে করি, আমাদের দেশে বেকারদের দুরবস্থা পাঁচগুণ কম হত যদি আমাদের আমলাতন্ত্রের পরিবর্তন হত।

আমলারা নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখল। নকুল-সহদেব বিদুরের মতো ইস্তফা দেবে বলে খেপে ওঠেনি। মনে আছে কীভাবে মহাগুরু বিদুরকে বুঝিয়েছিলেন যে চাকরিতে বহাল থাকাটা কত জরুরি? এসময়ে কৃষ্ণ তাদের বুদ্ধিদাতা ছিল।

ভীম চেয়েছিল, সামরিক বাহিনী ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। তাকেও নিরস্ত করা হয়েছিল। তবে আমার সন্দেহ হয়, সে বোধহয় একদিনের জন্য ছুটি নিয়েছিল। দুঃশাসনকে গাছে বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেল এক সকালবেলায়। তাকে কেউ মেরে আধমরা করে দিয়েছে। তার প্যান্ট খুলে গোড়ালির কাছে পড়ে রয়েছে। শার্ট শতছিন্ন। সারা গায়ে বেত মারার দগদগে দাগ। একটা ভিজে শাড়ির আঁচল কোনওমতে তার পুরুষাঙ্গ ঢেকে রেখেছে।

দুর্যোধনীর পার্টিতে প্রতিবাদ শোনা গেলেও, দুঃশাসন নিজেই ব্যাপারটা নিয়ে এগোতে চাইল না। ঘটনাটা সহজেই সকলে ভুলে গেল। শুধু দ্রৌপদীর মুখে একটা হালকা হাসি দেখা গিয়েছিল।

নির্বাচনের রাতে আরও একটা স্বপ্ন দেখলাম। আমি অর্জুনকে স্বপ্ন দেখলাম। যেন সে তখনও বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে দেশময় ঘুরতে ঘুরতে হিমালয়ে গিয়ে তপস্যায় বসেছে। পরনে কৌপিন, লম্বা চুলে জটা, হাড় বেরিয়ে গেছে অনাহারে, চোখ কোটরে বসে গেছে।

কিন্তু তার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে কোনও ভগবান দেখা দিলেন না। সামনে এল একটা হরিণ। অর্জুন তাড়াতাড়ি তিরধনুক বের করে হরিণটাকে মেরে ফেলল। তারপর সেটাকে যেই তুলতে যাবে, এমন সময় এক বিশালকায় বলশালী শিকারি সেখানে এসে হাজির হল।

অর্জুনের দিকে ব্যঙ্গ হেসে, হরিণটাকে কাঁধে ফেলে রক্ত দিল। রেগে গিয়ে অর্জুন সেই শিকারিকে তির মেরে আক্রমণ করতে সে হেলায় তিরগুলোকে এড়িয়ে এগিয়ে চলল। অর্জুন এবার তার ইষ্ট দেবতার কাছে প্রার্থনা করতে লাগল। হঠাৎ শিকারিকে মহাদেব শিব-এ পরিবর্তিত হতে দেখা গেল। অর্জুন নিজের ভুল বুঝতে পেরে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ল।

শিব তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলেন। অর্জুন শিবের ব্রহ্মাস্ত্র, পশুপাত চেয়ে নিল। এই বিধ্বংসী অস্ত্র কেউ আগে কখনও পায়নি। এই অস্ত্রের জন্য কোনও লঞ্চপ্যাড, কন্ট্রোল প্যানেল, বা কম্পিউটার চালনার দরকার পড়ে না। শুধু মনের কল্পনা, ইচ্ছাশক্তি এবং বাচনশৈলী প্রয়োগ করলেই এই মারণাস্ত্র হয়ে ওঠে অমোঘ।

‘আমায় পশুপাত দাও মহাদেব।’

শিবের তৃতীয় নয়ন খুলে গেল, ‘নাও। এটা এখন তোমার।’

হিমালয় কেঁপে উঠল, বন-জঙ্গল উত্তাল হয়ে উঠল ঝড়ের বেগে, হাওয়ার বিকট আওয়াজে মনে হল পৃথিবী ধ্বংস হতে চলেছে। একটা আগুনের রথে চড়ে শিব চলে গেলেন স্বর্গপথে। সেই আগুনের আভায় তৈরি হল আরেকটা রথ। অর্জুনের জন্য।

অর্জুন রথে চড়ল। আকাশ চিরে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা গেল, তারাগুলো যেন বিশালকায়, ঝকঝকে! আকাশ থেকে উল্কাপাত শুরু হল। অর্জুনের দৃষ্টি পৃথিবীর দিকে আটকে আছে। চারিদিকে ধ্বনিত হয়ে চলেছে, ‘ধ্বংস, ধ্বংস, ধ্বংস।’

১১৯

সহদেব ভিড় ঠেলে খবরের কাগজের অফিসটার দিকে এগোল। চারিদিকের আওয়াজে কানে তালা ধরে যাচ্ছে। একে একে নির্বাচনের ফলাফল চলে আসছে। রেডিয়োর চেয়ে মানুষ এখন খবরের কাগজকেই বিশ্বাস করে বেশি। রেডিয়ো…আকাশবাণী হল সরকারি বাহন। অথচ আমাদের দেশের আপামর জনতার নিজস্ব সংবাদদাতা হওয়ার কথা ছিল রেডিয়োর। যে দেশে অশিক্ষার শেষ নেই, সে দেশে খবরের কাগজের দৌলতে মানুষকে সত্যিটা কেন জানতে হবে?

জরুরি অবস্থার সময় প্রিয়া আকাশবাণীর কণ্ঠ একেবারে রোধ করে দিয়েছিল। ফলে ঝুমরি তালাইয়া এবং অন্যান্য জায়গা থেকে মানুষ একমাত্র গান শুনতেই রেডিয়ো চালাত।

একটি পিয়ন লম্বা মইয়ে চড়ে একটা বোর্ডে অক্ষর এদিক ওদিক সাজিয়ে খবরের শিরোনাম ঘোষণা করছিল। নীচে মানুষ অধীর অপেক্ষা করছিল। তখনও ‘ধনী’ অর্থাৎ দুর্যোধনীর নামের শেষটুকু বোর্ডে দেখা যাচ্ছিল।

ইংরেজি ‘ডি’ অক্ষরটা দেখা গেল। ‘ডিক্ল্যারস ভিক্টরি’ অর্থাৎ জেতার খবর দেখবার জন্য নকুল-সহদেব বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছে।

‘না ভাইসব! ওর হাতে অতগুলো অক্ষরই নেই!’ সহদেব যেন ধাঁধার উত্তর পেয়ে গেছে, ‘ডি ফর ডিফিট!’ সে সোৎসাহে বলল।

‘আমি জানতাম! জানতাম!’ নকুল চিৎকার করে উঠল।

বোর্ডের লেখা তাদের আন্দাজ অনুযায়ী পালটে গেল। ‘জনতা ফ্রন্ট জিন্দাবাদ, দ্রোণ জিন্দাবাদ, যুধিষ্ঠির জিন্দাবাদ।’

সে কী উন্মাদনা! সবাই পিয়নটির দিকে খুচরো পয়সা ছুঁড়তে লাগল।

১২০

যা হল, তার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। যা গেল তার ছায়া থেকেই গেল। যা এল, তার টিকে থাকার ক্ষমতা নেই। যা দেখলাম, যা মনের মধ্যে গেঁথে নিলাম, তা কিন্তু সেই জয়ের উন্মাদনা নয়! আশাহত হওয়ার বেদনা। এক স্বৈরাচারীকে হটিয়ে দিয়ে আমরা নিয়ে এলাম একগুচ্ছ নৈরাজ্যের প্রতীককে।

আমার আংশিক দায়বদ্ধতা ছিল বইকি! নির্বাচনের পরে কে কতটা ক্ষমতা পাবে, তা নিয়ে ফ্রন্টের অংশীদারদের মধ্যে যাতে লড়াই না হয়, তা নিয়ে আমরা সতর্ক ছিলাম। কেউ-ই চাইনি, নতুন শাসনকাল অশান্তি দিয়ে শুরু হোক। ঠিক হল, দ্রোণ এবং আমি যাকে প্রধানমন্ত্রী বলে ঠিক করে দেব, জনতা ফ্রন্ট তাকেই মেনে নিয়ে ‘নির্বাচিত’ করবে। তখন মনে হয়েছিল এটাই শ্রেষ্ঠ পথ। বুঝিনি, গণতন্ত্র রক্ষা করতে এহেন অগণতান্ত্রিক পথ নেওয়া উচিত হবে না।

আমরা দুই প্রাজ্ঞ এটাও বুঝিনি, পরীক্ষায় কঠিন প্রশ্নগুলো এড়িয়ে গেলে কোনওদিন ভালো ফলও করা যায় না।

আমরা দুজন, শরিক দল এবং তার নেতাদের সঙ্গে আলাদা-আলাদা ভাবে কথা বললাম। কত যে ছোটখাটো দল মিলে ফ্রন্ট গঠন হয়েছিল, তার ইয়ত্তা নেই। ভারতবর্ষে ব্যাঙের ছাতার মতো রাজনৈতিক দল গজিয়ে ওঠে। ফ্রন্টের শরিক দলের নেতারা কোনও না কোনও সময়ে কৌরব পার্টির সদস্য ছিল। তারপর প্রিয়ার সঙ্গে মনোমালিন্যে তারা বিভিন্ন সময়ে পার্টি ছেড়ে দিয়ে নিজেদের মতো করে দল গঠন করে। দ্রোণ আর আমি প্রত্যেকটি নেতার কথা বিচার-বিশ্লেষণ করলাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম, একমাত্র যার ওপর ভরসা করা যায়, যার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং বাহ্যিক পরিচিতি যথেষ্ট সম্মানজনক, সে হল যুধিষ্ঠির।

সে ছিল সৎ এবং দায়িত্বশীল। এই দুটি গুণ রাজনৈতিকভাবে অবশ্য অনেক সময়েই খুব জরুরি নয়। দ্রোণ একমত হল। কারণ সেও রাজনীতির চেয়ে নীতির দিকেই বেশি ঝুঁকে ছিল। আমরা জানতাম যে ওপরে মেনে নিলেও অনেকেরই যুধিষ্ঠিরের গোঁড়ামি নিয়ে আপত্তি আছে। তাই আমরা জনপ্রিয় অশ্বত্থামাকে ফ্রন্টের রাজনৈতিক কর্মসূচির কর্ণধার নির্ধারণ করলাম।

ফ্রন্টের নেতারা, দেশের সর্বোত্তম স্মৃতিসৌধ, তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে শপথগ্রহণ করল। দেশের হারানো মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়ার অঙ্গীকার। দ্রৌপদী সেই অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হয়ে নিমন্ত্রিত হয়েছিল। আবার তাকে হাসতে দেখা গেল। সেই ভুবনভোলানো হাসি। সে সবই ছিল বাহ্যিক আড়ম্বর। আমাদের রাজনৈতিক ভিত গোড়া থেকেই নড়বড়ে ছিল।

তাজমহলের সামনে শপথ গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে যেন সবার অজান্তে একটা অমোঘ সত্য বেরিয়ে এল। আমরা সবাই যাকে ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে জানি, তারই গহ্বরে শুয়ে আছে সেই মহিলা যে তেরোবার প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করে, চোদ্দোবারের চেষ্টার সময়ে মারা যায়। এই হল ভারতবর্ষ! এখানে অপরূপ সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখে গভীর বেদনা আর মৃত্যুর কাহিনিকে।

অনুষ্ঠানের পরে আনমনা হয়ে বসেছিলাম। দেখছিলাম কেমন করে সাদা মার্বেল আস্তে আস্তে সালফার ডাই-অক্সাইভ-এর ধোঁয়ায় হলদেটে হয়ে যাচ্ছে। কাছেই এক তেল রিফাইনারি দূষণ ছড়াচ্ছে।

আস্তে আস্তে রাত্রি নামল। তাজকে একটা কালো চাদরে ঢেকে দিল। প্রতিদিনের শেষে, শত শত বছর ধরে এমনি করে রাত নেমেছে তাজে। তবু সে তার সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে, নতুন দিনের জন্য। তার মর্মর বুকে কত যে আক্রমণ হয়েছে, তার ঠিক নেই। ভারতবর্ষও সব অত্যাচার সহ্য করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে।

যুধিষ্ঠির নিজের সততার প্রমাণ দিতে এতই ব্যস্ত থাকত, বুঝতেই চেষ্টা করত না সে কতটা হাস্যাস্পদ হচ্ছে। বহুদিন ধরেই কানাঘুষো চলছিল। সত্যিটা সর্বসমক্ষে বেরিয়ে এল।

যুধিষ্ঠিরের মন্ত্রীরা নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করলেও প্রধানমন্ত্রী নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকল। এক আমেরিকান টেলিভিশন সাংবাদিক সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে জিগ্যেস করে ফেলল, ‘প্রধানমন্ত্রী মহোদয়, আপনি কি নিজের মূত্র পান করেন?’

সে কী লজ্জা গণপতি! কোটি কোটি পৃথিবীবাসী সেই প্রোগ্রাম দেখেছিল সেদিন। যুধিষ্ঠিরের উত্তর আমাকে সেইদিনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল, যেদিন শকুনির পাশা খেলার আমন্ত্রণে রাজি হয়েছিল। টেলিভিশনে যুধিষ্ঠির অটো ইউরিন থেরাপি বা নিজ মূত্র পান করার গুণাবলি নিয়ে অবলীলায় বক্তৃতা দিল।

হইচই পড়ে গেল চারিদিকে। একদিকে মুত্রপান অন্যদিকে সুরাপানের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর মতামত দুয়ে মিলে ব্যঙ্গের রোল উঠল। কাগজে কার্টুন-এর পাশাপাশি পাবলিক টয়লেটগুলোর বাইরেও নানারকম ব্যঙ্গাত্মক আঁকা বা লেখা দেখা গেল। যেমন, ‘যুধিষ্ঠির জুস সেন্টার।’ যুধিষ্ঠির কিন্তু গম্ভীরমুখে নিজের মতো করে দিনযাপনে ব্যস্ত রইল। তার চারপাশের রাজনৈতিক কোন্দল নিয়ে তার কোনও মাথাব্যথা নেই।

শুরু থেকেই ফ্রন্টের একতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তিনজন পাকা মাথার রাজনৈতিক নেতা, যুধিষ্ঠিরের দুর্বলতার আভাস পেয়ে নিজেদের জাহির করতে লাগল। সমাজের ‘পিছিয়ে পড়া’ শ্রেণি আর ‘পিছিয়ে পড়া জাতপাত’ নিয়ে এমন বড় বড় বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করল যে মানুষ তাদের পার্টিকে ‘পিছিয়ে পড়া ফ্রন্ট’ বলে ডাকতে শুরু করল।

চারিদিকে নৈরাজ্য, মূল্যবৃদ্ধি আর হতাশা। শরিকরা নিজেদের কোন্দল একেবারে পথে নামিয়ে নিয়ে এল। সরকার কোনও সিদ্ধান্তই নিতে পারছিল না।

প্রিয়া দুর্যোধনী এই অপূর্ব সুযোগ একেবারে লুফে নিল, ‘এই ব্যাকওয়ার্ড ফ্রন্ট সরকার না এগোতে পারে, না পিছোতে পারে। শুধু নিজেদের হাস্যকর করে তোলে।’

বোঝা যাচ্ছিল প্রিয়া যাদের কাছে হেরেছিল তারা ওর চেয়ে অনেক দুর্বল। এদিকে কর্ণস্থানের লোকদেখানো নির্বাচনে টিকতে না পেরে জলিল শাহ ঝুটা দেশের সামরিক প্রধানদের হাতে বন্দি হয়েছে। তারা জলিলকে সর্বসমক্ষে বেত মারবে না ফাঁসি দেবে, নাকি দুটোই করবে, এই নিয়ে কর্ণস্থান উত্তপ্ত হয়ে ছিল।

প্রিয়াকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দেখে ফ্রন্ট ঠিক করল, সংবিধানের বিরুদ্ধাচারণ করার অপরাধে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে আদালতে টেনে নিয়ে যাবে। প্রিয়া যে অসাংবিধানিক মতে দেশ শাসন করার অপরাধ করেছিল, তার ভূরি ভূরি প্রমাণ ছিল। কিন্তু আমাদের দেশে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে আদালতে নিয়ে যাওয়া কি সোজা কথা? প্রিয়ার তাবড় তাবড় উকিলরা ফ্রন্টের নেতাদের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিল। তাদের মধ্যে শকুনি ছিল না।

ততদিনে সে নিজেকে গণতন্ত্রের রক্ষক প্রমাণ করতে গিয়ে, জরুরি অবস্থার বিপক্ষে স্লোগান দিচ্ছিল। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর কাজকর্মেরও সমালোচনা করছিল।

যাই হোক, দুই অসম পক্ষের মধ্যে ফের লড়াই শুরু হল। আইন আর ক্রিকেট, দুই-ই হল শহুরে ভারতীয়দের প্রিয় বিনোদন। দুই খেলাতেই লাগে অর্থ ও সময়। অতিক্রম করতে হয় প্রচুর জটিলতা। দুটিতেই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি লোককে ময়দানে দেখা যায়। দু-ক্ষেত্রেই পারদর্শিতার সঙ্গে সঙ্গে ছলনার প্রয়োজন হয় এবং প্রভূত অর্থ খরচ হয়। দুটো খেলাই প্রচুর আপিল বা আবেদনের পরে যখন শেষ হয়, তখন মনে হয় যে ফল আশাপ্রদ নয়। আদালতকে সঙ্গী করে প্রিয়ার অন্যায়ের বিচার করতে যাওয়ায় আগেই ফ্রন্ট তার কাছে হেরে বসে রইল।

আদালতের দরজা জনসাধারণের জন্য খোলা থাকলেও, প্রিয়ার বিচার চলাকালীন তারা ঢুকতে পারল না। সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সে নাকি তার শাসনদণ্ড ঘুরিয়েছিল। তাই ন্যায় বিচার চেয়েছিল ফ্রন্ট। অথচ তাতে সাধারণের কোনও ভূমিকা নেই! শুরুতে যথেষ্ট আলোড়ন পড়ে গেলেও, আস্তে আস্তে প্রিয়ার উকিলরা কেসটার মোড় ঘুরিয়ে দিল। তারা তাদের বক্তব্য এবং সাক্ষ্য প্রমাণের পরিমাণ এমন বাড়িয়ে তুলল যে মানুষ মনোযোগ হারাল। প্রিয়া ঠিক এটাই চেয়েছিল।

চোদ্দো মাস কেস চলার মধ্যেই ফ্রন্টের অন্তরদ্বন্দ্ব তুমুলে উঠল। বিবাদ লাগল গঙ্গাজির হরিজনদের নিয়ে। যুধিষ্ঠির এক সাধুর পাল্লায় পড়েছিল। তার কথাবার্তা, সাজপোশাক, কোনওটাই যুগের সঙ্গে মানানসই নয়।

সাধুসন্তের ব্যাপারে ভারতের জুড়ি মেলা ভার। বিদেশিদের কাছে এরা দুর্লভ বস্তু। কিছু কিছু সাধুর আবার দেশি ভক্তও আছে। এইসব জ্ঞানী পুরুষেরা আমাদের আধ্যাত্মিকতা আর মনের প্রশান্তি নিয়ে এমন সব বাণী দেয় যে তাক লাগতে বাধ্য।

এমনই এক সাধুর কবলে পড়ল আমাদের যুধিষ্ঠির। তার কথা বিশেষ লোকে জানত না। এই সাধুর এক জনসভায় যুধিষ্ঠিরকে দেখা গেল। সেই জনসভাতে সাধু হরিজনদের ‘অছ্যুৎ’ বলে আখ্যা দিয়ে নিজের এবং যুধিষ্ঠিরের কবর খুঁড়ে ফেলল।

লোকে দেখল, তার গুরু হরিজনদের অছ্যুৎ বলা সত্বেও যুধিষ্ঠির কোনও প্রতিবাদ করল না। সভা ত্যাগ করল না।

তুমি ভালোই বুঝতে পারছ গণপতি, কী হল এর পরে! ভারতবর্ষ এক মুখর দেশ। এখানে মানুষ সমস্যা নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। হরিজনদের যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তাতে তাদের আর্থ সামাজিক উন্নতির কী সম্পর্ক? কিন্তু ভারত এভাবে ভাবে না। তাদের নেতারা এভাবে তাদের ভাবতে দেয় না। আমরা সবাই ভগবানের সন্তান। তাহলে সমাজের সবচেয়ে নিচুতলার মানুষগুলোকেই কেন এই নামে চিহ্নিত করা হবে? যুধিষ্ঠির কেন প্রতিবাদ করল না সেটাই দেশে সবথেকে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল। প্রিয়া এই সরকারকে হরিজনদের শত্রু ঘোষণা করল।

অশ্বত্থামা গর্জে উঠল প্রতিবাদে। সে এই সরকারের সঙ্গে থাকতে চায় না, যারা জাতপাত ঘিরে বিভেদ সৃষ্টি করে। ফ্রন্টে যেসব নেতারা যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে গোষ্ঠী তৈরি করছিল তারাও রাশ ধরল। ফ্রন্ট কেঁপে উঠল।

একের পর এক সাংসদরা নতুন ফ্রন্ট গঠনের দাবি তুলল। স্বয়ং দ্রোণ ফ্রন্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিল।

১২১

দ্রোণ ঘোরতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। জরুরি অবস্থায় প্রিয়ার কারগারে থেকে সে রুগ্নতার শিকার হয়ে পড়েছিল। তার শরীর ভেঙে গিয়েছিল। তবে শরীরের চেয়েও দ্রোণের মন সব থেকে বেশি ভেঙে গিয়েছিল। ফ্রন্টের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ দেখে। একদিকে যে সরকার সে তৈরি করেছিল তার প্রতি টান আর অন্যদিকে ছেলে অশ্বত্থামার প্রতি তার কর্তব্যবোধ, দুটোর মধ্যে বিরাট টানাপোড়েন লেগে গেল।

‘আমি কোনওমতে দ্রোণজিকে অশ্বত্থামার দিকে যেতে দেব না। তাতে আমার রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটবে। অশ্বত্থামা দক্ষিণ থেকে ফেরার আগেই কাজটা সারতে হবে।’ যুধিষ্ঠির বলল।

আমি তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, দ্রোণের শরীরের যা অবস্থা তাতে যমরাজ অচিরেই এই টানাপোড়েন বন্ধ করে দেবেন। এ কথা যুধিষ্ঠিরের কানেই গেল না। সে সহদেবকে ডাকল, ‘তুমি দ্রোণের বাড়ি গিয়ে তাঁকে বলো, অশ্বত্থামার প্লেন দিল্লি পৌঁছোনোর আগেই ভেঙে পড়ে গেছে।’

একথা শুনে আমার গা হিম হয়ে গেল, ‘তুমি ও কী বলছ?’

‘তোমার পরে পরেই আমি ঢুকব দ্রোণের ঘরে। দ্যাখো, যেন আর কেউ না থাকে।’ যুধিষ্ঠির সহদেবকে বোঝাল।

‘কিন্তু যুধিষ্ঠির তুমি যে মিথ্যা বলো না!’

‘এবারেও বলব না ভি ভি জি।’

তার সঙ্গে দ্রোণের বাড়ি গেলাম। তার বিছানার চারপাশে ওষুধ আর মেশিন দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। সহদেব খবরটা দিল। মৃত্যুপথযাত্রী দ্রোণ পুত্রশোকে হাউহাউ করে কাঁদছে।

‘যুধিষ্ঠির, এ কি সত্যি? অশ্বত্থামা নিরাপদ তো?’

‘আমি দুঃখিত দ্রোণজি। অশ্বত্থামা হত হয়েছে।’ যুধিষ্ঠির মুখ কাঁদো কাঁদো করে বলল।

‘তাহলে আর আমার বেঁচে থেকে কী হবে?’ কাঁদতে কাঁদতে দ্রোণ দেওয়ালের দিকে মুখ ফেরাল।

‘দ্রোণ, এ অবস্থায় জিগ্যেস করা ঠিক নয়। তবুও…আপনি ফ্রন্টের সঙ্গে আছেন তো?’ যুধিষ্ঠির ফিসফিস করে বলল।

‘হ্যাঁ। নিশ্চয়ই।’ দ্রোণ, যাকে ততদিনে সংবাদ মাধ্যমগুলি ঋষিতুল্য বলে আখ্যা দিয়েছে, সে যুধিষ্ঠিরের দিকে না তাকিয়ে বলল।

যুধিষ্ঠিরের মুখে রাজ্য জয় করা হাসি ফুটল। দ্রোণের সময় ফুরোল।

আমার প্রাণ কেঁদে উঠল। দ্রোণের মতো সৎ মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। তাকে অনেক সময়ে মহাগুরুর সঙ্গে তুলনা করা হলেও আমি জানতাম, মহাগুরুর চাতুরি দ্রোণের মধ্যে ছিল না। ন্যায়-নীতি এবং আদর্শের প্রশ্নে দ্রোণের জুড়ি মেলা ভার। সে ক্ষমতা থেকে নিজেকে সবসময়ে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ধৃতরাষ্ট্রের পরে তাকেই মসনদে ভাবা গিয়েছিল। প্রিয়ার পতনের পরেও সে ক্ষমতা হাতে নিতে চায়নি।

‘জয়প্রকাশ দ্রোণ, আমাদের ঋষিতুল্য গুরু, আর নেই! তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল ফ্রন্টের একতা। সরকারের মধ্যেকার কোন্দল তাঁকে অত্যন্ত দুঃখিত করেছে। তিনি মনে গভীর শোক নিয়ে মারা গেছেন। তাঁর উত্তরাধিকার রেখে গেছেন ভারতীয় মানুষের মধ্যে।’ যুধিষ্ঠিরের গলা কেঁপে উঠল, ‘আমি ফ্রন্টের সকলের কাছে, বিশেষত অশ্বত্থামার কাছে ঐক্য ভিক্ষে করছি।’

‘অশ্বত্থামা? সে তো মারা গেছে তুমি বলেছিলে। তাই না যুধিষ্ঠির?’

‘হ্যাঁ।’

‘সে কি মিথ্যা?’

‘না। আমি মিথ্যা বলি না। দ্রোণের বাড়ি যাওয়ার আগে একটা আরশোলাকে অশ্বত্থামা নাম দিই। তারপর তাকে মেরে ফেলি। আমি দ্রোণকে একবারও তার ছেলে অশ্বত্থামার কথা বলিনি।’

‘তোমার কথাগুলো তো দ্রোণের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।’

‘আপনি অন্যায় কথা বলছেন ভি ভি জি। আমার সেই মুহূর্তে ফ্রন্টকে ভাঙতে না দেওয়াটা সব থেকে জরুরি ছিল। দ্রোণের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী নই। জন্ম-মৃত্যুর নির্ধারণ আগেই হয়ে থাকে। আমি যা করেছি গণতন্ত্রের খাতিরে করেছি। ধর্ম রক্ষার্থে করেছি।’

‘তুমি যাই বলো যুধিষ্ঠির, তুমি মিথ্যাচার করেছ। আমাদের জাতীয় প্রতিশ্রুতি, সত্যমেব জয়তে, তুমি তার এ কী দশা করলে? আজ থেকে আমাকে আর খুঁজো না। আমি তোমার সঙ্গ ছাড়লাম।’ বলে আমি লাঠি আঁকড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম।

১২২

ফ্রন্ট ভেঙে গেল। বেশিরভাগ এমপি ফ্রন্ট ছেড়ে দিতেই সরকার পড়ে গেল। আবার নির্বাচন হল। প্রিয়া দুর্যোধনী নতুন করে ফিরে এল ক্ষমতায়। তার বিরুদ্ধে যে কেস জ্বলছিল, সেই কেস তুলে নেওয়া হল।

১২৩

আর তো বলার খুব একটা বাকি রইল না গণপতি। এ কাহিনি এক আশাভঙ্গের কাহিনি। একটা গল্পের মধ্যে কত গল্প! কখনও কোনও নায়ক নেই, কখনও আবার কত নায়ক। যা বলার বাকি রইল আর যা বলা হল, তার মধ্যে খুব ফারাক নেই। আবার বিস্তর ফারাক!

গল্পের মূল রেখা থেকে আবার একটু সরে যাই, গণপতি। মাঝে মাঝেই ভারতের আর এক অবিস্মরণীয় রচনা, বাৎসায়নের কামসূত্রের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। বিদেশিরা ভারতের আর কোনও রচনার কথা জানুক না জানুক, কামসূত্রের কথা অবশ্যই জানে। অনেকেই বাৎসায়ন-এর এই কীর্তিকে পর্নোগ্রাফির সঙ্গে তুলনা করে। আসলে কামসূত্র প্রায় পাঠ্যবই-এর মতো এক রচনা, যেখানে চতুর্থ শতকের ভারতীয় সমাজের স্বাধীন চিন্তাধারা তার যৌনতার মাধ্যমে বোঝা যায়।

আজকের ভারত সেই যুগ থেকে অনেকটাই পিছিয়ে এসেছে। আমাদের আধুনিক সভ্যতা পর্দার আড়ালে যৌনতাকে ঢেকে দিয়ে তাকে নিয়ে নানারকম অশিক্ষা আর কুসংস্কারের জাল বুনে দিয়েছে।

অবশ্য কামসূত্রের সেই যৌনশিল্প বাস্তবে রূপায়িত করতে গেলে দেশে এত কম শোওয়ার ঘর থাকলে চলবে না গণপতি।

কামসূত্রের মতোই আমাদের মহাকাব্য মহাভারত বা রামায়ণকে আমরা বুঝিনি। কোথায় গেল রামের সে সত্য, নীতি আর আদর্শের জন্য আত্মত্যাগ? সীতার পবিত্রতা রক্ষার জন্য সেদিনের সেই জননেতার কী ভীষণ সংগ্রাম! আজকের নেতারা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধি আর চুরি-রাহাজানির চেয়ে বেশি কিছু বোঝে কি? আজকের এই গভীর হতাশাকে ভুলতে তাই আমরা হয় প্রাচীন ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে ভারতের হারানো ঐতিহ্যকে খুঁজে বেড়াই। নয়তো অদেখা ভবিষ্যতের কল্পনায় মত্ত থাকি।

আজকের ভারতে ধর্ম বা কর্তব্যের কোনও মূল্য নেই। আজকে ধর্মকে হাতিয়ার করে মানুষ মানুষকে খুন করে। প্রাচীন ভারত কোনওদিনই সেই সভ্যতার জন্ম দেয়নি যেখানে কেরোসিন গায়ে ঢেলে দিয়ে বধূকে হত্যা করা হয়, আত্মসম্মান খুব অল্পদামে বিক্রি হয়, মানুষকে সর্বসমক্ষে খুন করা হয় তার ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে। আমার গল্পে আমি এসব বলিনি। এমন ভান করেছি যেন এসব সত্যি নয়।

কিন্তু কতক্ষণ আর চোখ বন্ধ করে থাকা যায়? আমাদের দার্শনিকরা আমাদের বৈদিক সভ্যতা নিয়ে লম্বা চওড়া বক্তৃতা দেন। তারা কি ভুলে যান, এই আধ্যাত্মিকতার ঠিক পেছনেই রয়েছে কু-সংস্কার আর জাতপাতের বৈষম্য?

আমি হিন্দুধর্মের এই গোঁড়ামির সমালোচনা করছি, গণপতি। ভারতের ৮০ শতাংশ মানুষ হিন্দু। এই ধর্মের প্রতিচ্ছবি আমরা রাজনীতি এবং সমাজের সর্বত্র দেখতে পাই। কিন্তু এই ধর্মের আপাত উদারতার পিছনেই কুসংস্কারের অন্ধকার দেখতে পাই, দেখতে পাই গুরুদের দৌরাত্ম্য আর গরুপুজো নিয়ে বাড়াবাড়ি।

এই গল্প পড়ে মনে হবে, আমি একজন ভালো হিন্দু। আমি গল্পের মধ্যে আমাদের টানাপোড়েনের কথা বলিনি। আঞ্চলিকতা, বিচ্ছেদকারী শক্তিদের মাথা চাড়া দেওয়া এবং দেশকে টুকরো করার প্রচেষ্টার কথা বলা থেকেও বিরত থেকেছি। আমার মহান ভারত আজও আমার কল্পনার রামরাজত্বে বাস করে। কিন্তু চারিদিকের এই খুন-রাহাজানি, ধ্বংস, কালোবাজারি, ধর্মান্ধতাই বা আমি কতক্ষণ না দেখে থাকব, গণপতি? আমার ভারতে প্রিয়া দুর্যোধনীর মতো স্বৈরাচারীকে ফিরিয়ে আনতে হয়। কারণ তার চেয়ে ভালো কাউকে আমরা খাড়া করতে পারিনি। শেষে সেই ভুলের মাশুল তাকে দিতে হল। তারই দেহরক্ষীরা তাকে খুন করল।

ঠিক ভুলের বিচার করব না। আমি বয়সের ভারে তার ঊর্ধ্বে উঠে গেছি এখন। আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।

হস্তিনাপুর। কিন্তু কোথায় গেল আমার সোনার শহর? এ যে ধ্বংসের দেশে এসে পৌঁছেছি! চারিদিকে ভাঙাচোরা বাড়ি, পথঘাট ভেঙে গহ্বর হয়ে গেছে। বিবিঘরের সে শোভার জায়গায় পড়ে আছে পাহাড়প্রমাণ ময়লা-আবর্জনা।

তারপর এল সেই ভয়ংকর ঝড়। চারিদিকে ধুলো! তার মধ্যে দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে মাথাহীন, অজস্র হাতওয়ালা দৈত্যরা। বড় বড় দাঁতাল ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে চারিদিকে।

আকাশ থেকে অস্ত্র বৃষ্টি হয়ে পথে-ঘাটে শুয়ে থাকা মানুষকে ভয়ংকরভাবে আঘাত করছে, তারা লুটিয়ে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। ইঁদুরগুলো তাদের ওপর তাণ্ডব করছে, শস্য-সবজি নষ্ট করছে। দুধ উথলে পড়ে নষ্ট হচ্ছে ঘরে ঘরে। পোড়া চামড়ার গন্ধে টেঁকা যাচ্ছে না, রান্না করা খাবারে পোকা, পাতকুয়ো মজে গেছে…সে এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন, গণপতি! প্রকৃতি রেগে গেছে, প্রলয় এসেছে!

পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যায় না। কাকেদের ডাক যেন গাধাদের মতো শোনাচ্ছে, রাস্তায় শেয়াল দৌড়োচ্ছে। কিন্তু এই ধ্বংসের ছবির মাঝেই আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, গঙ্গাজি, ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডু হাসছে। ডাকছে আমাদের। তারপর হস্তিনাপুরের ভগ্নস্তূপ থেকে একে একে আমাদের গল্পের নায়করা দূরের বরফে ঢাকা পাহাড়ের দিকে চলতে লাগল। তারা মহাপ্রস্থানের পথে রওনা হয়েছে।

হঠাৎ কৃষ্ণ পড়ে গেল। তার পায়ের তলা থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে।

‘আমি আর যেতে পারব না।’ সে যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল। তার কালো চামড়া যেন যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেছে, ‘আমি এখানে বসে পড়ছি। আমি তোমাদের বুদ্ধি দিতে পারি, কিন্তু তোমাদের সঙ্গে হাঁটতে পারব না। তোমরা আমাকে ছাড়াই এগিয়ে যাও।’

পাণ্ডবদের মন খারাপ হয়ে গেল। কৃষ্ণের প্রাণ ধীরে ধীরে যেন আমার স্বপ্নের সঙ্গে মিশে যেতে লাগল। তারপর পাহাড়চুড়ো থেকে যেন কার গলার আওয়াজ পেলাম, ‘ও এই ধ্বংসলীলা থেকে সকলকে বাঁচাতে পারত, কিন্তু তা করেনি। ও নিজের নিরাপদ জায়গায় ফিরে গেছে। দূর থেকে দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। মাঝে মাঝে অর্জুনকে কবিতার মাধ্যমে জ্ঞান দেওয়াটাই কি যথেষ্ট? ও কখনওই পাহাড় চুড়োয় উঠতে পারবে না।’

অন্যরা উপত্যকা, পাথর আর নদী পেরিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছোল। এক ছোট্ট কুকুর যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। তাদের পা যেন ভারী হয়ে এসেছে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

দ্রৌপদী লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

‘ও কেন?’ আমি স্বপ্নের মধ্যে সেই দেবকণ্ঠকে জিজ্ঞাসা করে উঠলাম।

‘গণতন্ত্রের পতন সবথেকে আগে হয়। ও একা বাঁচতে পারবে না। ওর পতিদের ওপর নির্ভরশীল। তাদের দুর্বলতাই ওর কাল। ও ওপরে আসতে পারবে না।’

এর পর হাঁটতে হাঁটতে সহদেব পড়ে গেল। প্রশ্ন করার আগেই উত্তর এল।

‘ও তো দেশের বাইরে থেকে, ভেতরকার সমস্যাগুলো প্রত্যক্ষ করছিল মাত্র। দেশের এই করুণ পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছিল কি? ও কিছুতেই ওপরে যেতে পারে না।’

নকুল যখন পড়ল, তখন শুনলাম যে সে তার প্রতিষ্ঠান এবং চাকরিকে দেশের চেয়ে অনেক বড় করে দেখেছিল। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের বাইরে সে বেরোতে পারেনি। তাই সে পাহাড়ের চুড়োয় উঠতে পারবে না।

যখন অর্জুন পড়ে গেল আমার অবিশ্বাস্য লাগল। অর্জুন তো প্রিয়া দুর্যোধনীকে হারিয়ে দিয়েছিল। মানুষ তাকে সর্বান্তঃকরণে চেয়েছিল। তবে?

‘ও নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভেবেছিল। সেইজন্যে দম্ভ ওর চোখ অন্ধ করে দিয়েছিল। নিজেকে নিয়ে ও আত্মম্ভরিতায় ভুগত। ভারত এমন নেতা চায় না।’

পাহাড়ের মাঝামাঝি গিয়ে ভীম পড়ে গেল।

‘ও পাণ্ডবদের আর দেশের রক্ষাকর্তা হলেও, দ্রৌপদীর দুঃসময়ে নিজের শক্তির প্রমাণ দেয়নি। ভাইদের আদেশের অপেক্ষা করেছিল। ও পাহাড়চুড়োয় পৌঁছোবে না।’

যুধিষ্ঠির একাই চলতে লাগল। তার সঙ্গে চলল সেই ছোট্ট কুকুরটা।

আমি অবাক হলাম, ‘ওকে কেন যেতে দেওয়া হচ্ছে? ও তো ধর্মের নামে, সত্যের নামে অন্যদের প্রতি অন্যায় করেছে। ন্যায়নীতির কথা আক্ষরিক অর্থে বললেও ও তার মর্যাদা রাখেনি। নিজের স্ত্রীকেও পাশার দান করেছে।’

‘ও ধর্মের প্রতি, নিজের বিশ্বাসের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিল।’

যুধিষ্ঠির পাহাড় চুড়োয় পৌঁছোল। চারিদিক তাকিয়ে দেখল কী অপূর্ব সব উপত্যকা! অন্য সব পাহাড়ের সারি আর পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। একটা মেঘের ওপর সোনালি মুকুট পরা দৃপ্ত ভগবানের মতো দেখতে একজন পুরুষ বসেছিলেন। তিনি যুধিষ্ঠিরের কাছে নেমে এলেন।

‘আমি কাল, সময়ের ঈশ্বর। চলো আমার সঙ্গে ইতিহাসের দরবারে। তুমি সফল।’

‘আমি সম্মানিত। এই কুকুরটি আমার সঙ্গে আসবে তো?’

‘না। ও নোংরা জীব। ওকে ছেড়ে দাও।’

‘সেটা সম্ভব নয়। কুকুরটি প্রভুভক্ত। আমার সঙ্গে-সঙ্গে এতটা পথ এসেছে। ওকে ত্যাগ করতে পারব না।’

‘তাহলে তোমাকে আমি নিতে পারব না।’ কাল বেশ রাগের সঙ্গে বলল।

যুধিষ্ঠির তার সিদ্ধান্তে অনড়, ‘আপনি চলে যেতে পারেন। এ কুকুরটিকে ছেড়ে গেলে অধর্ম হবে। আমি তা পারব না।’

‘তুমি কালের ইতিহাসে নাম না লিখিয়ে একটা নোংরা জীবের প্রতি আসক্তি দেখাচ্ছ? তুমি না যুগপুরুষ যুধিষ্ঠির?’

‘আমি জীবনে কাউকে পরিত্যাগ করিনি। আপনাকে বিদায়।’

যুধিষ্ঠির দেখল, কুকুরটি আস্তে আস্তে ধর্মরাজে পরিবর্তিত হল। তিনি যুধিষ্ঠিরের আসল পিতা।

‘তুমি পরীক্ষায় সফল হয়েছ যুধিষ্ঠির। আমার সঙ্গে ইতিহাসের দরবারে চলো। সেখানে তুমি পুরস্কৃত হবে।’ ধর্মরাজ বললেন।

কালের রথে চড়ে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে সেখানে গেলেন। কিন্তু ও কী! এ যে প্রিয়া দুর্যোধনী! সোনার সিংহাসনে বসে রাজত্ব করছে এখানেও!

‘এই স্বৈরাচারী! দেশের মানুষের এতবড় শত্রু! এ এখানে কেন? আমার ভায়েরা, আমার স্ত্রী কোথায়?’ যুধিষ্ঠির হতাশা, রাগ, ক্ষোভ সব মিশিয়ে বলে উঠল।

‘ইতিহাসের বিচার একমুখী হয় না যুধিষ্ঠির। যাকে তুমি অত্যাচারী মনে করছ অনেকে তারই পুজো করে, তাকেই উদ্ধারকারী ভাবে। তারা ভাবে প্রিয়া এক সাধ্বী যাকে গণতন্ত্রের দরবারে হাঁড়িকাঠে চড়ানো হয়েছে। পুরোনো শত্রুতা ভুলে যাও যুধিষ্ঠির। এখানে রাগ-হিংসা-প্রতিহিংসার কোনও জায়গা নেই’, ধর্ম ঠান্ডাগলায় বললেন।

‘কিন্তু আমার পরিবারের অন্য সদস্যরা নেই কেন?’

‘তারা অন্য জায়গায় আছে। যদি তাদের কাছে যেতে চাও, আমি নিয়ে যেতে পারি।’

এরপর যুধিষ্ঠির এক অন্ধকার, সংকীর্ণ আর দুর্গন্ধময় কঠিন রাস্তা ধরে ধর্মের সঙ্গে চলতে আরম্ভ করল। কখনও পায়ে কাঁটা তার জড়িয়ে যায়, কখনও পচা শাক সবজি আর মরা মানুষ বা জন্তু! শরীরের ছোঁয়া লাগলেই শিউরে উঠতে হয়। দুর্গন্ধে যেন দম বন্ধ হয়ে আসে।

ধর্ম হঠাৎ থেমে যান, ‘আমরা পৌঁছেছি।’

কিছুই প্রথমে দেখা যায় না। শুধু চতুর্দিকের আর্তনাদ আর আর্তি যুধিষ্ঠিরের হৃদয় বিদীর্ণ করে দেয়। সে কেঁপে ওঠে। ওই তো! ওই তো তার ভায়েদের আর স্ত্রীর গলাও এই করুণ কান্নার আওয়াজের মধ্যে দিয়ে শুনতে পাচ্ছে!

‘আমি কি পাগল হয়ে গেছি? ওদের কেন এভাবে এখানে কষ্ট পেতে হবে? কোনও কিছুরই কি কোনও মানে নেই?’

‘তুমি ঠিক আছ যুধিষ্ঠির। চলো, চলে যাই এখান থেকে। এটা তোমার জায়গা নয়।’

‘এটা আমার পরিবারেরও জায়গা নয়। ওরা কী দোষ করেছে? কেন এভাবে কষ্ট পাচ্ছে? আমি ওদের দুঃখ-কষ্টের অংশীদার হব। আপনি চলে যান।’

অন্ধকারের আবরণ উঠে গেল। ঝলমলে আলো আর অপূর্ব সৌরভের মধ্যে আমার গল্পের সমস্ত চরিত্ররা একে একে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল—অপরূপা দ্রৌপদী, ড্রুপ্যাড, শক্তিমান ভীম, স্যার রিচার্ড, গম্ভীর গান্ধারী, মুখ বিকৃত করে শিখণ্ডিন, কর্ণস্থানীরা, কৌরবরা, ইংরেজরা, পাণ্ডু। পাণ্ডু তার দুই স্ত্রীকে আলিঙ্গন করছে। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র আর সোনালি চুলের জর্জিনা।

‘তোমার শেষ পরীক্ষায় তুমি উত্তীর্ণ হয়েছ যুধিষ্ঠির। তুমি এখানে দুর্ভাগ্যের বা দুঃস্বপ্নের জীবন কাটাবে না। দুর্যোধনীও চিরকাল বিজয়িনীর জীবনযাপন করবে না। সকলকে স্বর্গ ও পাতালের আনন্দ আর দুর্ভোগ দুই-ই ভোগ করতে হবে। কালকে অন্য একজন যখন এখানে আসবে, তখন তুমি এদের সঙ্গে বসে তাকে আবার অভিবাদন জানাবে।’

‘সকলকেই কি এমন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু সবাই উত্তীর্ণ হতে পারে না।’

‘কিন্তু এতে কী প্রমাণ হয়?’

‘এতে প্রমাণ হয়, ধর্মের ওপরে কেউ নেই। সে-ই চিরকালীন সত্য।’

‘কিন্তু সকলেই যদি এখানে আসে, তাহলে ধর্মের পথে চলে কী লাভ?’

‘ইতিহাসে সকলেরই স্থান হয়। জীবনের চলার পথে, ন্যায়-নীতি এবং সত্যের পথে যারা চলে, ইতিহাস তাকে মনে রাখে। তুমি এই পথের যাত্রী, যুধিষ্ঠির।’

‘কিন্তু ধর্মের পথে থেকে আমি আমার দেশ, আমার পরিবারের কোনও সাহায্যে এলাম কি? আমার দেশে কি ন্যায় চিরস্থায়ী হল?’

‘তুমি ভুল বলছ, যুধিষ্ঠির।’ ধর্মরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘ধর্মই একমাত্র সত্য। এটাই ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি। ধর্মহীন জীবনের কোনও অর্থ নেই।’

‘ভারতবর্ষই একমাত্র সত্য, ধর্মরাজ। কিন্তু ভারতের প্রবর্তনের বিভিন্ন ধাপে, ধর্মের এক এক রূপ আমরা দেখেছি। কোনও সনাতনী নিয়ম আমাদের দেশে সবসময়ের জন্য খাটেনি। আমি ব্যতিক্রমী হয়ে শুধু হেরে গেছি, লাঞ্ছিত হয়েছি। শেষে আমাকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আক্ষেপ করে লাভ নেই, আমার সময় শেষ হয়েছে। যুগের পর যুগ মানুষ মনে করেছে, ভারতের সভ্যতার গভীরে সব উত্তর আছে। কিন্তু আমরা তো প্রশ্ন করতেই শিখিনি!’

‘কী বলছ তুমি?’ ধর্ম আস্তে আস্তে আবার কুকুরে পরিণত হচ্ছিলেন যুধিষ্ঠিরের চোখের সামনে।

‘আমি বলছি কোনও একটি নিয়মের মাপদণ্ডে ভারতকে মাপ করা যায় না। সকলের আলাদা আলাদা জীবননীতি আছে। নীতি থাকলেই হল। এই জগৎ পালটে গেছে, আরও যাবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজের পথ বেছে নেওয়া উচিত। সনাতন, প্রাচীন বলেই যে সব ঠিক তা তো নয়। অনেক প্রাচীন গোঁড়ামি আছে যা অচল, বর্জনীয়। মানুষের হিতার্থে কাজ করাটাই হল একমাত্র করণীয় এবং একমাত্র নীতি। মনে রাখতে হবে সত্য এবং সঠিক—এই দুই লক্ষ্যে পৌঁছোবার অনেক রাস্তা থাকতে পারে। ধর্ম এবং কর্ম অভিন্ন নাও হতে পারে…’

একটা কুকুরের অবিরাম ঘেউ-ঘেউ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।

ঘুম ভেঙে আবার মুখোমুখি হলাম গোলমাল, রাহাজানি, কম্পিউটার আর সুটকেসধারী সেলসম্যানের ভারতবর্ষের। এই ভারত একবিংশ শতাব্দীর গভীর অনিশ্চয়তার হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে।

তোমার ভ্রু আর শুঁড় কুঁচকে প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করেছ কেন, গণপতি? ভাবছ আমার গল্প শেষ হয়েছে কিনা?

হাঃ! এ গল্প নিরন্তর। শেষ হওয়ার নয়। ভারতের পাহাড়ে, সমতলে, পরিবারের মধ্যে আর মানুষের মনের মধ্যে গল্পের নতুন নতুন সূত্র, বারবার তৈরি হয়ে চলেছে।

আমার শেষ স্বপ্ন কিন্তু আমায় বড় সমস্যায় ফেলেছে, গণপতি। এই দীর্ঘ গল্প বলার পর বুঝতে পারছি আমার বোঝাপড়ায়, জীবনদর্শনে গলদ থেকে গেছে। আমাকে এ গল্প আবার নতুন করে বলতে হবে।

গণপতি, তোমার মুখ দেখে তোমার অবিশ্বাস আর হতাশা ধরা পড়ছে। আমি খুবই দুঃখিত। ব্রহ্মার সঙ্গে কাল কথা বলব। চলো আবার শুরু করি।

ওরা বলে যে ভারতবর্ষ নাকি অনুন্নত দেশ…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *