পঞ্চদশ অধ্যায়। পছন্দের স্বাধীনতা

পঞ্চদশ অধ্যায়। পছন্দের স্বাধীনতা

৯২

‘তোমার জন্য খারাপ খবর নিয়ে এসেছি।’ দ্রৌপদী মোকাড়াশির পালক পিতা বলল, ‘ধৃতরাষ্ট্র তাঁর উইলে তোমার জন্য কিছুই রেখে যায়নি।’

মেয়েটি শুধু তার বড় বড় চোখে বাবার দিকে অপলক চেয়ে রইল। দ্রৌপদী অসামান্য সুন্দরী হয়ে উঠেছে। টুকটুকে ফরসা নয়, অথচ তার পাকা গমের মতো গায়ের রঙে যেন জাদু আছে। দ্রৌপদীকে দেখলে পেতলের প্রদীপের ওপর জলন্ত শিখার কথা মনে পড়ে যায়। সে শিখা সকলকে আকর্ষণ করে। কাউকে জ্বালিয়ে দেয় না। কী করে ব্যাখ্যা করি আমি সে সৌন্দর্যের? এ এক অবর্ণনীয় রূপ! উদ্ধত নয়, চাপাও নয়, পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেন প্রতিফলিত হয়েছে দ্রৌপদীর অবয়বে।

দ্রৌপদী ম্লান হাসল। বলল, ‘তিনি বেঁচে থাকতে আমার জন্য অনেক করেছেন, মৃত্যুর পরে তিনি আর কত করবেন?’

‘আমার কাছে যে তোমাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই! তোমার বাবা আমাকে তোমার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি না করতে পারিনি। এখন তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে। একে আমাদের সমাজে পাত্র জোগাড় করে বিয়ে ঠিক করার রেওয়াজ নেই, তার ওপর তোমার বাবা-মা নিয়ে কোনও কথা বলা যাবে না। আমি খুবই মুশকিলে পড়লাম, দ্রৌপদী।’

‘তুমি চিন্তা কোরো না। আমি আমার বর ঠিক খুঁজে নেব।’

কিন্তু ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি হবে বোঝা যায়নি।

ধৃতরাষ্ট্র কৌরব পার্টিতে বটগাছের মতো বিরাজ করত। সে থাকতে অন্য কোনও নেতা জাতীয় পর্যায়ে উঠে আসতে পারেনি। তাই ধৃতরাষ্ট্রের পরে পার্টির হাল কে ধরবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিল। ঠিক হল, সবাই মিলে রাজকার্য চালনা করা হবে। ওয়ার্কিং কমিটি মাথার ওপর নজরদারি করবে। ঠিক হল, শিশুপালকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে।

আমি যুব নেতাদের উদ্বুদ্ধ করতে চেতনা-চিন্তন সভা বসালাম দিল্লিতে। ধৃতরাষ্ট্রের মৃত্যুর খবর পেয়ে পাণ্ডবরাও এসেছিল। প্রিয়া দুর্যোধনী আমায় সভা পরিচালনা করতে সাহায্য করছিল। কিন্তু সবার চোখগুলো যেন আপনা থেকে চলে যাচ্ছিল দ্রৌপদী মোকড়াশির দিকে।

সভা সফল হয়েছিল। গঙ্গাজি, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এদের সবার নীতিবোধ এবং দেশপ্রেম নিয়ে আলোচনা হল। যুবকরা ছোট-ছোট দলে বিভক্ত হয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ আর্থসামাজিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করল।

এখানেই পাণ্ডবদের সঙ্গে দ্রৌপদীর প্রথম দেখা হল। পাণ্ডবরা চমৎকৃত হল। এত বৃদ্ধ হয়েও আমি বুঝতে পারি গণপতি, সুন্দরী মহিলা দেখলে পুরুষ জাতি বিহ্বল হয়ে পড়ে। প্রিয়া দুর্যোধনী সেদিন সন্ধেবেলা আমার ঘরে এল। তার মুখে রাজ্যের বিরক্তি।

‘কিছু একটা করতেই হবে।’ সে ভণিতা না করে বলল, ‘ওই মেয়েটা সবার মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে। কেউ কোনও কথা শুনছে না, শুধু হাঁ করে ওকেই দেখছে। যত্ত সব।’

‘তা আমায় কী করতে বলো?’

‘ওর বিয়ে দিয়ে দাও।’ প্রিয়া স্পষ্ট জবাব দিল।

সে নিজে বিয়ে করেনি। বাবার কাজকর্ম দেখতে গিয়ে তখনও বিয়ে করার সময় পায়নি। প্রিয়ার কাছ থেকে আসা এই প্রস্তাবে আমি হকচকিয়ে গেলাম।

‘বিয়ে?’

‘হ্যাঁ। ওর বিয়ে ঠিক করে দেওয়ার কেউ নেই। তুমি তো সবার লোকাল গার্জেন, তুমিই কাজটা করে ফেলো। তাতে ওকে পোষ মানানো যাবে।’

সত্যিই তো, দ্রৌপদীর বিয়ে দেওয়ার দরকার আছে! কিন্তু মাত্র একজনের সঙ্গে এই অন্তহীন প্রাণকে বেঁধে দেওয়া মানে যে একরকমের হত্যা! এ তো সূর্যকিরণকে ঘরে বন্দি করার সামিল! যদি বিয়েই দিতে হয়, কার সঙ্গে দেব? একটা নামই মাথায় এল—অর্জুন। কিন্তু অর্জুনকে নিয়ে একটাই সমস্যা, সে বৈচিত্র্যপ্রেমী। কখনওই এক নারীতে আবদ্ধ থাকবে না। তাহলে?

‘তোমার কথা মাথায় রাখছি দুর্যোধনী। আমায় মেয়েটার জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজতে দাও। তোমার নজরে কেউ আছে?’

‘ওর জন্যে চাই একজন তরতাজা যুবক, যে বুদ্ধিমান এবং শিক্ষিত হবে। কৌরব পার্টিতে এরকম একজনকেই দেখছি। একলব্য।’

আমি চমকে উঠলেও প্রকাশ করলাম না। এ সেই ছেলে যে দ্রোণকে নিজের গুরু বলবার দুঃসাহস দেখিয়েছিল! হ্যাঁ, আমি ওকে লক্ষ্য করেছি আমাদের চিন্তনসভায়। অত্যন্ত সেয়ানা ধরনের যুবক। তার ঔদ্ধত্য লক্ষ করার মতো। সভার সুন্দরী মেয়েদের দিকে তার নজর।

হঠাৎ মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। একদিন বেশ রাতে আমি একলব্যকে প্রিয়া দুর্যোধনীর ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছিলাম। আমায় সামনে দেখে যেন একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল যেন।

‘আমি মিস দুর্যোধনীর থেকে গঙ্গাজির উক্তির বইটা নিতে এসেছিলাম। কিন্তু তিনি ঘরে নেই।’

আজ বুঝলাম, সেদিন প্রিয়া ঘরে ছিল। বাবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফাঁকে ফাঁকে সে এইভাবে নিজের মনোরঞ্জন করত। ‘একলব্য নীচু জাতের ছেলে। দ্রৌপদীরও ওই সমস্যা।’ প্রিয়া বলল।

‘তাহলে তুমিই ওদের দুজনের বিয়েটা করিয়েই দাও না। আমায় আর বুড়ো বয়সে এসবের মধ্যে টেনো না।’ প্রিয়া আমার দিকে সন্দিগ্ধ হয়ে তাকাল, ‘দ্রৌপদী আমায় বিশ্বাস করে না।’

‘তাহলে বলতেই হয়, তুমি সত্যিই পরোপকারী। আমি বিশ্বাস করি দ্রৌপদী নিজের সঙ্গী নিজেই খুঁজে নেবে।’

তারপর যা হয়েছিল, তার একটা ধোঁয়াশায় ভরা স্মৃতি থেকে গেছে। কতটা সত্যি আর কতটা যে স্বপ্নে দেখা বা বই-এ পড়া, আলাদা করতে পারি না। একটা প্রতিযোগিতা হয়েছিল। বিরাট এক সামিয়ানার নীচে শয়ে শয়ে রাজপুত্রেরা জড়ো হয়েছিল দ্রৌপদীর জন্য। সে একটা সাদা লালপাড় শাড়ি পরে হাতে জুঁই ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার স্বর্গীয় সৌন্দর্য বর্ণনায় বোঝানো যাবে না।

তারপর সেই অদ্ভুত প্রতিযোগিতা আরম্ভ হল। একটা বড় কাঠের বাক্স রাখা ছিল সামিয়ানার ঠিক মাঝখানে। তার ওপরে একটা অংশ চেরা। রাজপুত্ররা, নাকি কৌরবরা একে একে এসে সেখানে ছোট ছোট কাগজের টুকরো ফেলে দিল।

আমি বাক্সের পাশে জাদুকরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারপর দ্রৌপদী তার মালা নিয়ে বাক্সের ভেতর ঢুকে গেল আর আমি ঢাকনাটা বন্ধ করে দিলাম। এবার একে একে সবাই এসে ঢাকনাটা খোলার চেষ্টা করবে। যে খুলতে পারবে তার গলায় দ্রৌপদী মালা দেবে।

সবাই একে একে এগিয়ে এল। রাজা, রাজপুত্র, সাধারণ মানুষ, ধনী, জমিদার, শক্তিমান, লম্বা, বেঁটে, দুর্বল—সব। তাদের মধ্যে যেন একবার হিসলপকে দেখলাম। হাতে কীসব ফাইলপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা আমেরিকানকে বারমুডা শর্টস আর চকরাবকরা শার্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। চক্রর চেয়ারম্যানকেও যেন একঝলক দেখলাম। একলব্য বাক্সর কাছে গিয়ে ঢাকনায় হাত দিয়েই চমকে উঠল। দেখল, তার বুড়ো আঙুল নড়ছে না। ভয় পেয়ে সরে গেল। কর্ণ এগিয়ে আসছিল। আমি তাকে আঙুলের ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম, সে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে অক্ষম।

শেষে অর্জুন এগিয়ে এল। সবাই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। পরনে তার খদ্দর। আমার দিকে একঝলক তাকাল। শেষে শান্তভাবে বাক্সে চাপ দিতেই ঢাকনাটা আপনিই খুলে গেল।

দ্রৌপদী দাঁড়িয়ে উঠল সাদা লেলিহান শিখার মতো। সে অর্জুনের গলায় মালা দিয়ে বরণ করে নিল। পাণ্ডবরা তো বটেই সকলে একসঙ্গে আনন্দে চিৎকার করে উঠে হাততালি দিল।

ঘুম বা ঘোর যাই বলো না কেন, তার মধ্যেও লক্ষ করলাম, প্রিয়া সামিয়ানার মধ্যে থেকে রাগে গটমট করে বেরিয়ে গেল। তার চালে ভুল হয়ে গেছে।

৯৩

বাকিটা ঠিক স্বপ্ন ছিল না।

দ্রৌপদী মোকড়াশি তার পছন্দের পুরুষকেই বিয়ে করল। অর্জুনকে স্বামীত্বে বরণ করে সে বাড়ি গেল। সঙ্গে গেল বাকি পাণ্ডবরাও।

প্রথমেই তারা তাদের মাকে ফোন করল। তখনকার দিনে টেলিফোন লাইনে প্রচুর ঘড় ঘড় আওয়াজ হত, দুই পক্ষের মধ্যে কথাবার্তায় বিস্তর ফাঁক থেকে যেত।

ফোনটা যদি যুধিষ্ঠির করত, তাহলে একটা ছোট্ট বক্তব্যই দু-পক্ষের মধ্যে যথেষ্ট হত। কিন্তু ফোনটা করেছিল নকুল। সে তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিল, ‘মা! তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না, আমরা ফিরে আসছি! আর জানো? তোমার জন্যে আমরা একটা উপহার নিয়ে আসছি।’ এই আমরা কথাটাই ওদের জীবনে ধর্মসংকট এনে দিল।

‘আমার কিছু চাই না। তোমরাই ভাগ করে নাও সমানভাবে।’

‘কী বলছ মা?’

‘ঠিকই বলছি। তোমাদের ওই উপহার নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিও।’

দ্রৌপদীকে ভাগ করে নেবে পাঁচ ভাই? ওরা মায়ের কথা অমান্য করবে কী করে? ওরা যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ! গোটা পথটাই কাটল আলোচনার আর উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে। সমাজ কী বলবে? কিন্তু মনের কোণে দ্রৌপদীকে পাওয়ার আশাও কি ভাইদের মনে উঁকি দেয়নি?

যুধিষ্ঠিরই প্রথম বলল।

‘আমি বিয়ে করব আগে ভাবিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দ্রৌপদীকে বিয়ে করতেই হবে। ভীমকেও তো আবার বিয়ে করতে হবে। নইলে যে প্রতিজ্ঞা মিথ্যে হয়ে যাবে!’

কুন্তিরও দুশ্চিন্তার শেষ রইল না। অর্জুন-এর অবস্থা সবথেকে খারাপ। তার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। শুধু দ্রৌপদীকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। সে শান্ত অবিচল হয়ে রইল। প্রতিটি ভাইয়ের মন সে বুঝতে পারল। কুন্তি কেন দোটানায় পড়েছে তাও সে বুঝল।

‘একটাই উপায় এখন। নকুল তুমিই যেহেতু এসবের জন্য দায়ী, তুমিই যাবে বেদ ব্যাসকে ডেকে আনতে।’ কুন্তি বলল।

আমি আবার নাতিদের জীবনে ফিরে এলাম। আমাকে কুন্তি আসন পেতে বসতে দিল।

পাণ্ডবরা আমায় প্রণাম করতে এলে তাদের সরিয়ে দিলাম। এ ব্যাপারটা আমার অসহ্য লাগে। একে তো পায়ে ধুলোময়লা থাকে। তারপর প্রণাম করার অর্থ হচ্ছে, যে আমাকে প্রণাম করছে সে আমার পায়ের ধুলোর মতো তুচ্ছ।

যুধিষ্ঠির আমায় সমস্যাটা বোঝাল, ‘আমাদের বেদে কোথাও এক স্ত্রীর বহু পুরুষ বিয়ে করার কথা বা অনুমতি নেই।’

আমি বললাম, ‘কিন্তু মা বাবাকে দেওয়া প্রতিজ্ঞা ভাঙা আরও বড় অপরাধ। তাতে বেশি অধর্ম হয়। পুরাণে তো জটিলার গল্প আছে। সে সাতজন ঋষিকে বিয়ে করেছিল।’

তারপর দ্রৌপদীর দিকে ফিরলাম, ‘তুমি কি ভগবানের কাছে ভালো বর চেয়েছিলে, বাছা?’

দ্রৌপদী চোখ নাময়ে নিল, ‘হ্যাঁ।’

‘তুমি কি শিবের কাছে প্রার্থনা করেছিলে?’

‘শিব, জেহোভা, মেরি মা, আল্লাহ…আর আর্চ বিশপ অফ ক্যান্টারবারি।’ লাজুক হাসল দ্রৌপদী।

‘তাঁরা সবাই মিলে তোমায় আশীর্বাদ করেছেন।’ আমি আধ্যাত্মিক রং লাগিয়ে দিলাম ওদের সমস্যায়। সবাই মেনে নিল আমার কথা।

‘আর আইন?’ নকুল জিগ্যেস করল।

‘ধর্মীয় মতেই পাঁচবার বিয়ে হবে। আইনে সেগুলি রেজিস্ট্রি করাটা বাধ্যতামূলক নয়। এদেশের পুলিশের অনেক অন্য কাজ আছে। তারা এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে না।’

‘কী অসাধারণ বুদ্ধি আপনার।’ যুধিষ্ঠির বলল, ‘আমি এতদিন নিজেকে উকিল বলেছি বলে লজ্জা পাচ্ছি।’

পাঁচটি বিয়ে পরপর পাঁচ রাত্রে অনুষ্ঠিত হল। আমার বাবা পরাশরের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা প্রতি রাত্রে প্রয়োগ করল দ্রৌপদী। কুমারিত্ব অক্ষুণ্ণ রেখে প্রতি স্বামীর শয্যাসঙ্গিনী হল।

ভীমের সেই স্ত্রীর কী হল? সে তার শক্তিমান ছেলে ঘটোৎকচকে নিয়ে ভাই হিড়িম্বর কাছে চলে গেল। এই পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া তার পক্ষে বেশ কঠিন হচ্ছিল।

বিয়ের শেষে কুন্তিকে অভিনন্দন জানাই, ‘তুমি অত্যন্ত ভালো মা, কুন্তি। দ্রৌপদীকে এক স্বামীতে বেঁধে রাখা ঠিক হত না।’

৯৪

শিশুপাল অত্যন্ত ভদ্র এবং প্রজাপালক প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু শুরু থেকেই সবাই ধরে নিয়েছিল সে ঠেকা দিতে এসেছে, যতদিন না আরও ভালো কাউকে পাওয়া যাচ্ছে। এমনকী কর্ণস্থানীরাও শিশুপালকে দুর্বল মনে করে ফের মনিমির দখল করতে উদ্যত হল। সব ধারণাকে তুচ্ছ করে দিয়ে শিশুপাল পালটা আক্রমণ করতে বলে চমকে দিল। ভারতীয় সেনারা কর্ণস্থানের সব থেকে জনবহুল শহর লাসলুটের থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে পৌঁছে গিয়েছিল। তখনই ‘সিজ ফায়ার’ ঘোষিত হল। শিশুপাল কর্ণস্থানকে দয়া করে জমি ফেরত দিল।

‘শান্তির জন্য মাঝে মাঝে সমঝোতা দরকার পড়ে।’ শিশুপাল অস্ফুটে বলল।

পার্টি শিশুপালকে বিশ্বাসঘাতক বলল। কিন্তু সে নিজেকে ধর্মের পালক মনে করত। তার কাছে জীবনের দাম প্রতিহিংসার চেয়ে অনেক বেশি। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে ছটফট করে মারা গেল শিশুপাল। মারা যাওয়ার আগে সে শান্তি চুক্তি করে গিয়েছিল কর্ণস্থানের সঙ্গে।

আবার কৌরব ওয়ার্কিং কমিটি বসল পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর নাম বাছাই করতে। শেষে আমি মুখ খুললাম। যেদিন গান্ধারীর পাশে গিয়ে দেখেছিলাম, সে তার সদ্যজাতা মেয়ের দিকে ফিরেও তাকাল না, সেদিন থেকেই জানি একদিন এই কথাটা আমায় বলতে হবে।

‘আমাদের সব সমস্যার একটাই সমাধান। প্রিয়া দুর্যোধনী।’

‘সে তো মেয়ে!’

‘তো? তাতে কী এসে গেল? আমরা তার মধ্যেই পাব এমন এক প্রধানমন্ত্রী যে নিজের কাজে পারদর্শী হয়েও আমাদের ওপর নির্ভর করবে। মানুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হবে। এ সব প্রিয়া দুর্যোধনীকে দিয়ে হবে।’

দেশের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিল প্রিয়া।

৯৫

গণপতি তুমি স্বর্গের অপ্সরা তিলোত্তমার গল্প জানো? তাকে দেবতারা শুণ্ড-উপশুণ্ড নামের দুই যমজ অসুরদের খুন করতে পাঠিয়েছিল। সব কাজ তারা একইসঙ্গে করত। একে অপরকে তারা খুব ভালোবাসত। এই বর পেয়েছিল, তাদের মৃত্যু হবে দুজনের মধ্যে লড়াই করলে। দেবতারা তাই তিলোত্তমাকে পাঠিয়েছিলেন দুজনের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি করতে। তিলোতমা সফল হয়েছিল।

তাই পাঁচ ভাইকে নিয়ে দ্রৌপদী সম্বন্ধীয় কিছু আইন তৈরি করলাম। দ্রৌপদীকে ভাগ করে নেওয়া তো সহজ কাজ নয়। তাই প্রত্যেকের জন্য তৈরি হল তার প্রাপ্তির তালিকা। স্বাভাবিকভাবে বড়রা কিছু বাড়তি সুযোগের অধিকারী হলেন। মাসের কয়েকটা অসুবিধের দিন দ্রৌপদীর নিজস্ব। যদি কোনো ভাই অন্য ভাইয়ের সম্ভোগে বাধা দেয় তাহলে তাকে পরিবার থেকে বারো মাসের জন্য বহিষ্কার করা হবে।

কিন্তু পাণ্ডবরা তো আর যে সে নয়, গণপতি! ন্যায়নীতি বোধ সম্পর্কে স্কুলের পাঠ্যবইতে লেখা হওয়া উচিত। তাদের প্রত্যেকের কিছু দৃঢ়তা এবং কিছু দুর্বল জায়গা ছিল।

প্রথমে ধরা যাক যুধিষ্ঠিরের কথা। সে হস্তিনাপুরের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী। অত্যন্ত মেধাবী এবং গম্ভীর এই পাণ্ডব উকিল হয়েও রাজনীতিকেই নিজের পাথেয় করে নিয়ে এগিয়ে চলল। খুব শিগগির তার পার্টিতে উত্থান ঘটল। সে বড় বলে স্ব-নির্ভর। আবার আত্মসন্তুষ্টিতেও ভুগত।

সে মনে করত, সে যা বলছে ঠিক বলছে। ছোটদের তার আজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে। ভারতবর্ষের যে-কোনও পরিবারের বড় ছেলেরা বড্ড বেশি আহ্লাদ পায়। যুধিষ্ঠির নিজে ন্যায় নীতি মেনে চলত। চারপাশের অন্যায় অবিচার বা অরাজকতা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামত না।

ভীমের দিকে তাকালে দেশের সুরক্ষার ছবি চোখে ভেসে উঠবে। সামরিক পোশাক পরা এক বিপুল শক্তিশালী চেহারা দেশের সীমান্তকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছে। একদিকে তার দুর্জয় সাহস আর অন্যদিকে শিশুর সারল্য, দুই মিলিয়ে আমাদের অদ্বিতীয় ভীম। কুন্তি আর দ্রৌপদীর জন্য সুরক্ষিত ছিল তার হৃদয়ের স্পর্শকাতর দুই কুঠুরি। ভীম অধিনায়ক ছিল না। সে চাষের জমিতে বলদের মতো শক্তি প্রয়োগ করে কাজ করতে পারে অন্যের নির্দেশে।

অর্জুন যেন সৃষ্টিকর্তার সব চেয়ে প্রিয় সম্পদ দিয়ে তৈরি। তার চোখের দৃষ্টি যেমন স্বচ্ছ, তার শরীরও তেমনই মজবুত, ঋজু। অর্জুন যেন দেশের মানুষের সমবেত হৃদয়স্পন্দন। তার বলিষ্ঠ কলমে সে দেশের মানুষের মনের কথা নিরন্তর লিখে চলল সাংবাদিকের দৃষ্টিকোণ থেকে। আমাদের দেশের স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের সে ছিল অন্যতম প্রতিনিধি।

মাদ্রীর যমজ ছেলে, নকুল এবং সহদেবকে আলাদা করে ভাবাই যায় না। তারা যেন স্বাধীন ভারতবর্ষের দুই স্তম্ভ। প্রশাসন এবং কূটনীতি। নকুল অনেক বলেও যেন কিছুই বলত না। সহদেব বেশিরভাগ সময়টা ভাবনাচিন্তার পিছনে ব্যয় করত। যে-কোনও প্রশাসনিক সমস্যার সহজ সমাধান করে দিতে পারত। কিন্তু ভাগ্যের আর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ওপর কারও হাত আছে কি? তাই নকুল কূটনীতির দিকে না গিয়ে প্রশাসনের কর্তা হল। সহদেব ঠিক তার উলটো। কী আর করা, গণপতি?

এই হল দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামীর বৃত্তান্ত। এরা কঠিন পারিবারিক অনুশাসনে আবদ্ধ ছিল। এক ভাই কোনওভাবে অন্য ভাইয়ের সম্ভোগ সুখের সময়তে অনুপ্রবেশ করত না। করলেই এক বছরের জন্য ঘরছাড়া হতে হবে।

কিন্তু সবসময়ে যে কড়া আইন খুব ভালো হবে, তা নয়। কারণ ধরাবাঁধা গতের বাইরেও জীবন মাঝে মাঝে বইতে চায়।

একদিন আমিই অর্জুনকে বললাম, আমার সংশোধিত বক্তৃতার বয়ানটা চট করে এনে দিতে। আমার তাড়া ছিল। অর্জুন বয়ানটা শোওয়ার ঘরে রেখেছিল। আনতে গিয়ে দেখল, যুধিষ্ঠির আর দ্রৌপদী সেখানে রতি সুখে লিপ্ত। সে কয়েক মুহূর্ত ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবল, ঘরে ঢোকা মানেই পরিবার থেকে এক বছরের জন্য বহিষ্কৃত হওয়া। আবার ঘরে না ঢোকা মানে আমাকে অমান্য করা। মনে-মনে সে বোধহয় নির্বাসন চাইছিল।

অর্জুন চুপচাপ ঘরে ঢুকে কাগজটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। দুই নগ্ন নারীপুরুষ তাকে লক্ষ্য করল না। ঘরের বাইরে যুধিষ্ঠির যখন এল, তখন অর্জুন তাকে সত্যিকথা বলল।

‘তাহলে তোমায় এক বছরের জন্য বেরিয়ে যেতে হবে। দুঃখের কথা, কালকে তোমার দ্রৌপদীকে পাওয়ার দিন ছিল। ভীম যে নেই। কিন্তু তোমার কপাল খারাপ।’

‘আমার হয়ে তুমিই সঙ্গ দিও দাদা। তুমি তাকে বেশ সুখী করতে পেরেছ।’ অর্জুন বলল।

‘এ কী কথা! আমি এমনিতেই সব ভাইদের রুটিনে কিছু বদল আনার কথা ভাবছিলাম, যাতে সবাই দ্রৌপদীকে সমানভাবে পায়। অর্জুন, তুমি তোমার ভাষা মার্জিত করো।’ যুধিষ্ঠির কঠিনস্বরে বলল, ‘শুণ্ড-উপশুণ্ডের কাহিনি ভুলে যেও না।’

‘হ্যাঁ, জানি। দুঃখিত।’ অর্জুন লজ্জিতভাবে বলল। অর্জুন বিদায় নিল দ্রৌপদীর থেকে। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। নিয়ম ভাঙলে শাস্তি তো পেতেই হবে। তার মনের কোণে একটা প্রশ্ন কুরে-কুরে খাচ্ছিল, যুধিষ্ঠির কি স্বয়ম্বরে দ্রৌপদীকে জিততে পারত?

দ্রৌপদীর বড় নিঃসঙ্গ লাগল। সে পাঁচ জনেরই স্ত্রী! অর্জুনকেই সে সবথেকে বেশি ভালোবাসত। তার জন্যেই সে এই পরিবারের সদস্য হয়েছে। তাকে ছাড়াই সামনের একটা বছর কাটাতে হবে!

৯৬

অর্জুন তার নির্বাসনের দিনগুলো বিফলে যেতে দিল না। একদিকে সে তার কাগজের জন্য ভ্রাম্যমাণ সাংবাদিকের কাজ করল, অন্যদিকে বহু নারী সঙ্গ করল। খবরের জন্য যেখানে যেখানে সে রাত কাটিয়েছে, সেখানেই নতুন নতুন প্রেমকাহিনি রচনা হয়েছে।

হরিদ্বারে গঙ্গার ধারে সে পেয়েছিল উলুপিকে। এই নাগা সুন্দরী তাকে জলের তলায় রতিক্রিয়ার আনন্দ শিখিয়েছিল।

মণিপুরে সে পেয়েছিল চিত্রাঙ্গদাকে। যে নাচের বিভিন্ন মুদ্রা দিয়ে সম্ভোগের আনন্দের সন্ধান দিয়েছিল।

খাজুরাহো থেকে একদিকে অর্জুন খবর পাঠাল তার কাগজে। সে জানত, খাজুরাহো দেশের অন্যতম পর্যটক আকর্ষণ হয়ে উঠবে। ওখানেই সুন্দরী য়াগা অর্জুনকে আশ্চর্য করে দিল তার ভাস্কর্য নিয়ে পাণ্ডিত্যের গভীরতায়। তাদের তীব্র শরীরী প্রেম মন্দিরের গায়ের ভাস্কর্যের রূপ নিল।

অর্জুন এগিয়ে চলল।

তবে তার যাত্রাপথের সবটাই এতটা সুখের ছিল না। যেখানেই গেল দুঃখ, দুর্দশা, হতাশা এবং নৈরাজ্যের স্ফুলিঙ্গ চোখে পড়ল। বাংলার গ্রামে গিয়ে সে দেখতে পেল, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুবকরা তুলে নিয়েছে অস্ত্র। তাদের নিশানায় নিম্নবিত্ত পুলিশকর্মীরা, যারা নাকি সামাজিক শোষণের যন্ত্র! আবার এটাও সত্যি, পুলিশও কম অত্যাচার করেনি। তারা নকশালদের খুঁজে খুঁজে খুন করেছে। যারা বেঁচেছে, তাদের পচতে হয়েছে আরশোলায় ভরা জেলের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত তারা যখন ছাড়া পেয়েছে, তখন বিপ্লবের কথা ভুলে গিয়ে বড় বড় কম্পানিতে নিযুক্ত হয়েছে।

কলকাতার কফি হাউস আর কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানগুলোয় অর্জুনের আলাপ হল নকশালদের সঙ্গে। এক তরুণ নকশাল-কবি তাকে শুনিয়েছিল, ‘কলকাতা, আমাকে নির্বাসন দেওয়ার আগে অন্ধ করে দাও।’

তার চোখের জ্বলন্ত চাহনি, তার ছাগলদাড়ি আজও অর্জুন দেখতে পায়। সে বুঝেছিল সেই তরুণের যন্ত্রণা। কিন্তু অন্ধত্ব তাকে আবর্জনা দেখা থেকে মুক্তি যেমন দেবে, তেমনই সৌন্দর্য দেখার আনন্দও তো কেড়ে নেবে! কী হবে সে জীবন যা বসন্তের আগুনরাঙা গাছের রূপ দেখতে পায় না?

কালবৈশাখীর আকাশ যখন বাড়ির মাথাগুলো গ্রাস করে নেয়, বা যখন ছোট্ট নৌকোগুলো সূর্যাস্তের সময় গঙ্গার জলের ওপর নাচতে থাকে, সে সৌন্দর্য না দেখলে জীবন বৃথা হয়ে যাবে!

অর্জুন পথ চলতে থাকল। হিমালয়ের পাদদেশে সে দেখতে পেল, গরিব মহিলারা গাছের সঙ্গে নিজেদের বেঁধে আন্দোলন করছে কন্ট্রাক্টরদের কোদালের হাত থেকে গাছ বাঁচাতে। রাজস্থানের মরুভূমির বাজারে মেয়েদের কী সস্তায় কিনতে পাওয়া যায়, অর্জুন লিখে পাঠাল তার কাগজকে। সে নিজে ষাট টাকায় একটি মেয়েকে কিনে মুক্তি দিতে চাইল। মেয়েটি হতাশায় ভরা চোখে তাকে জিগ্যেস করল, কোথায় যাব।

মাদ্রাজে অর্জুন দেখল, মানুষ হিন্দিকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। হিন্দির বিরুদ্ধে আন্দোলন তুঙ্গে। বাস-গাড়ি জ্বালিয়ে মানুষ প্রতিবাদ করছে।

করমণ্ডল সমুদ্রতটে সাইক্লোনের ভয়াবহ রূপ থেকে বিহারের খরাপ্রবণ অঞ্চল অর্জুন পায়ে পায়ে ঘুরে দেখল। এক সময়ের উর্বর গাঙ্গেয় জমি খরায় ফুটিফাটা; যেমন মায়ের শুকনো বুকে নিষ্ফল দুধ টেনে যাওয়ার প্রয়াসে শিশুর।

অর্জুন-এর মনে পড়ে গেল, দু-হাজার বছর আগে এখানকার মগধ সাম্রাজ্যের বৈভব-প্রতিপত্তির কথা। হঠাৎ সম্বিত ফিরে দেখল একটা কঙ্কালসার গরু মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তাকে শেষ কয়েকফোঁটা জল খাইয়ে দিল এক গরিব গ্রামীণ মহিলা যে মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়ে সেই জল সংগ্রহ করে এনেছে। অর্জুনের বুক নিংড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল—’এই আমার দেশ।’

পরিব্রাজক অর্জুন এসে পৌঁছোল দক্ষিণ ভারতের একটি শহর গোকর্ণমে। অর্জুন শুনেছিল, এখানে কৃষ্ণ নামের একটি যুবক এক রাজনৈতিক মহীরুহ কংসকে ভোটের লড়াইয়ে হারিয়ে দিয়েছে।

সে ঠিক করল, কৃষ্ণকে নিয়ে একটা প্রতিবেদন লিখবে—’যে রাজা হতে চায়নি।’ কৃষ্ণ গৌকর্ণম-এর কৌরব পার্টির সচিব। সে এত বিপুল ভোটে জয়ী হয়েও জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নিতে চায়নি।

অর্জুন কৌরব পাটির অফিসে ঢুকে দেখল, এককোণে সাদা কাপড় পরা একজন কেরানিগোছের লোক বসে মাতৃভূমি কাগজ পড়ছে।

‘সচিব কাছের একটা গ্রামে পার্টির কাজে বেরিয়েছে। আপনি সেখানে যেতে চাইলে আমি রাস্তা বলে দিতে পারি।’ লোকটি বলল।

ঝড়ঝড়ে একটা বাসে চড়ে খানিকদূর গিয়ে অর্জুন নেমে পড়ল একটা ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের বোর্ডের সামনে। গ্রামটার নাম কানিরকোলাম। অর্জুন দেখল, কিছু মানুষ একটা চায়ের দোকানে জড়ো হয়েছে। তাদের কাছে গিয়ে জানবার চেষ্টা করল, কৃষ্ণকে ঠিক কোথায় পাওয়া যেতে পারে। ইংরেজি, হিন্দি এবং ইশারা এই তিনভাবে তাকে আপ্রাণ চেষ্টা করতে দেখে সবাই হেসে ফেলল।

‘কৃষ্ণ? পার্টি সচিব?’ চা দোকানের মালিক বলল, ‘ওট্টামথুলালে তাকে পাওয়া যাবে। ওই দিকে যান।’

অর্জুন দেখল। সামনে ধুলোর রাস্তা, দুপাশে সবুজ ধানক্ষেত। রাস্তা ধরে খানিকটা এগিয়ে তার চোখ জুড়িয়ে গেল। কেরলের অনবদ্য গ্রামীণ দৃশ্য কাকে না মুগ্ধ করে। সবুজ ধান-জমি, মাঝে মাঝে নারকেল গাছের সারি, সোনালি রোদ্দুর এবং তাজা হাওয়া সব মিলিয়ে যেন স্বর্গের কাছাকাছি। অর্জুন চলতে লাগল, তার পাশ দিয়ে হাসতে হাসতে যাচ্ছে স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের বা গরুর গাড়ি। একটু পরে একটা মাদলের শব্দ শুনতে পেল।

বাঁক নিয়েই স্টেজের একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়াল অর্জুন। সেখানে নাচ হচ্ছে। শ’খানেক লোক জড়ো হয়ে দেখছে। একটা লোক মুখোশ পরে স্টেজে মাদলের তালে তালে লাফাচ্ছে। তার কোমরে ঝোলানো ঘণ্টাগুলো টিং টিং করে বাজছে। তিনজন লোক তিন রকমের বাদ্য বাজাচ্ছে। একজন বাজাচ্ছে মাদলের মতো একটা জিনিস, একজন একটা কেটলির মতো ড্রাম আর তৃতীয়জন খঞ্জনি। একটা গম্ভীর সুরের গান হচ্ছিল। টেরিলিনের শার্ট পরা, পকেটে পেন গোঁজা একজনের কাছে গিয়ে অর্জুন জিগ্যেস করল, ওট্টামথুলাল কোথায়।

‘কোথায় আর? ওট্টামথুলালই তো দেখছেন। এটা এক ধরনের নাচের নাম।’ লোকটি অর্জুনের ভুল ভাঙাল। নাচটা শেষ হয়ে গেল। প্রবল বেগে হাততালি পড়তে লাগল।

হঠাৎ একজন সাদা শার্ট পরা লোক দর্শকদের মধ্যে থেকে উঠে একলাফে স্টেজে পৌঁছোল। দর্শকরা দ্বিগুণ জোরে হাততালি দিতে লাগল। বাজনা যারা বাজাচ্ছিল তাদের মুখেও হাসি ফুটল। লোকটি আগের নাচিয়ের মুখোশ, ঘণ্টা ইত্যাদি পরে নিয়ে বাজনার আর গানের তালে তালে নাচতে লাগল। অর্জুন-এর বেশ ভালো লাগছিল।

বাজনার তাল জোরে হতেই লোকটি হাতে পায়ের নানান রকম কঠিন খেলা দেখাতে লাগল মুগ্ধ দর্শকদের। তারপর গান ধরল। হাত-পা নাড়া দেখেই মনে হচ্ছিল সে কাউকে ব্যঙ্গ করছে। দর্শকরা হেসে গড়াগড়ি দিচ্ছে। অর্জুন অবাক হয়ে টেরিলিনের শার্ট পরা লোকটির দিকে ফিরল।

‘সাধারণত ওট্টামথুলাল-এ আমরা পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের গল্প দেখতে পাই।’ লোকটা বলল, ‘কিন্তু এখানে উনি প্যারডি করে দেখাচ্ছেন, ইংরেজি শিক্ষা আমাদের জীবনে কীরকম বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে।’

অর্জুন উত্তর ভারতের মানুষ। এখানকার ভাষা কিছুই বুঝল না। শুধু গানের মধ্যে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ আর ‘সরি’ কথাগুলো তার কানে এল। কিন্তু চোখের সামনে নাচিয়ের অবলীলায় শূন্যে উঠে লাফ এবং নৃত্যশৈলীর অনায়াস দক্ষতা অর্জুনকে মুগ্ধ করল। দেখতে দেখতে অর্জুনের কেমন মনে হল, তার মনের গভীরে ঘুমন্ত প্রাণ যেন জেগে উঠেছে। তার মনে হল, কেরালার সবুজ ধানখেত, নারকোল গাছ এবং সোনালি রোদ, এদের একত্রিত নির্যাস এই নাচের মধ্যে রয়েছে।

‘কেমন লাগল?’ লোকটা বলল।

‘দারুণ।’ অর্জুন তার মুগ্ধতা ঢাকার একটুও চেষ্টা করল না, ‘ওই লোকটি কি ওট্টামথুলালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত?’

‘মোটেই না। উনি তো আমাদের এমএলএ। কৌরব পার্টিরও সচিব। ওঁর নাম ডি. কৃষ্ণ পার্থ সারথি।’

অর্জুন বুঝল, সে ঠিক জায়গায় পৌঁছেছে।

৯৭

‘আমাকে কৃষ্ণ বলে ডেকো।’ পার্টির সচিব বলল, ‘সবাই তাই বলে। দ্বারভিটেলে কৃষ্ণানকুট্টি পার্থসারথি মেনন, এত বড় নাম বলা বেশ কঠিন।’

‘ঠিক আছে কৃষ্ণ। আমি অর্জুন।’

কৃষ্ণ খুশি হয়ে হাসল। কৃষ্ণর রং কালো। মাঝারি গড়ন, লম্বা কোঁকড়ানো চুল আর ঝকঝকে সাদা দাঁত চোখে পড়ার মতো। হাসলে মনে হয় মুক্তো ঝরছে। রাস্তায় যার সঙ্গেই দেখা হয়, তাকে দেখেই এক গাল হাসে কৃষ্ণ। সে অর্জুনকে নিয়ে বাস স্ট্যান্ড-এর দিকে হেঁটে চলল। তার পরনের কাপড়ের একটা কোনা হাতে ধরা, যাতে তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারে। গ্রামবাসীরা সবাই তাকে চেনে। সেও আন্তরিক।

সেই যে দুজনে একসঙ্গে ঝড়ঝড়ে বাসে চড়ে গোকর্ণম ফিরল, আর পথে এক গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেল তা স্থান, কাল, পাত্র, অতিক্রম করে অর্জুনের জীবনে নতুন মানে এনে দিল।

কৃষ্ণের বয়স বেশি না হলেও রাজনীতিতে সে যথেষ্ট প্রাজ্ঞ। তার বাবা-মা স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। তাঁরা ব্রিটিশদের হাতে বন্দি থাকাকালীন কৃষ্ণের কারাগারে জন্ম হয়। কৃষ্ণেরও রাজনৈতিক হাতেখড়ি হয়ে যায় শৈশবে। র‍্যালির ময়দানে সে খেলতে যেত। কমিকস-এর বদলে গঙ্গাজির জীবনী আর বক্তৃতা পড়ে সে বড় হয়েছে। ছোটবেলা থেকে তার স্বচ্ছ চিন্তাশক্তি এবং যুক্তির প্রয়োগ দেখে সকলের তাক লেগে যেত।

স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক সুযোগ তার জীবনে খুব তাড়াতাড়ি এসেছিল। কৌরব পার্টির ভোটের প্রচারে তাকে একেবারে কচি বয়স থেকে দেখা গিয়েছিল। মহিলাদের ভোট তো সব তার পকেটে আপনি চলে আসত।

যে-কোনও মহলে কৃষ্ণ নিজেকে সহজে মানিয়ে নিত। তা সে দুধওয়ালির পেছনে লাগাই হোক কি গণআন্দোলনের পক্ষে মাওবাদীদের সঙ্গে তর্কই হোক। শেষে হাসতে হাসতে সে সকলের মন জয় করত। তার যুক্তিতর্ক খণ্ডাবে কে? কৃষ্ণের অপার জ্ঞানের তল পাওয়া কঠিন, কিন্তু জ্ঞানী হয়েও তার মধ্যে শিশুর সারল্যের অভাব ছিল না।

অর্জুন মুগ্ধ হল। মুগ্ধতা থেকে জন্ম নিল ভক্তি। কাগজের জন্য রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়ে অর্জুন কিছুদিন গোকর্ণম-এ কৃষ্ণের সঙ্গে কাটাল। কখনো তার সঙ্গে মাঠেঘাটে ঘুরে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার অংশীদার হল। কখনও দুজনে মিলে স্নানরতা রমণীদের জামাকাপড় লুকিয়ে রেখে দুষ্টুমিতে মেতে উঠল। রাত্রে যখন সব শান্ত হয়ে যেত তখন কৃষ্ণের অপূর্ব বাঁশির আওয়াজ তার জীবনের সব কালিমা ধুয়ে মুছে দিত। সে সুরে যেন অসীমের ডাক ছিল, ছিল কোনও অন্তর্নিহিত অর্থ।

কৃষ্ণের জীবন নিষ্কণ্টক ছিল না। তার মামা ছিল তার জন্মশত্রু। কেরালার মাতৃতান্ত্রিক মারুমাকাট্টায়াম রীতি অনুযায়ী মামারা দোর্দণ্ডপ্রতাপের অধিকারী হতেন। কৃষ্ণকে তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে উঠে পড়ে লেগেছিল কংস। সাবালক হয়ে কৃষ্ণ ভোটে হারিয়ে তাকে উচিত শিক্ষা দিল। কংস ছিল স্থানীয় পার্টির দুর্জয় নেতা। কৃষ্ণ তাকে হাসতে হাসতে হারিয়ে দিল। কিন্তু এম এল এ হয়েই এত সম্ভাবনাময় যুবা কেন কাল কাটাবে, অর্জুন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। কৃষ্ণ জাতীয় রাজনীতির এত বড় যোদ্ধা হয়েও কেন স্থানীয় নেতা হয়েই থেকে যাবে?

‘দেশে তোমার মতো নেতা দরকার কৃষ্ণ।’ অর্জুন বলল।

‘আমি যেখানে আছি, খুব ভালো আছি। আমার জীবন, আমার কাজ—সব এ অঞ্চলকে ঘিরে। এর বাইরে আমি যেতে চাই না।’

‘কিন্তু বৃহত্তর রাজনীতিতে এলে তুমি গোটা দেশের হৃদয়ে বিরাজ করবে যে!’

‘তোমার কথা রাধাকে বলতে হবে।’ কৃষ্ণ হেসে বলল, ‘অর্জুন আমি এখানে কী আনন্দে আছি, তোমায় বলে বোঝাতে পারব না।’

‘তুমি বিবাহিত?’

‘না। আমার স্ত্রী বিবাহিতা।’

অর্জুন কেমন গোলোকধাঁধায় ঢুকে গেল। কৃষ্ণ অনেক সময়েই হেঁয়ালি করে। কখনও কিছু এড়িয়ে যায় না। সে জাতীয় রাজনীতিতে এখনি নাই বা এল, হয়তো সময়ে এটাও বদলাবে। জাতীয় রাজনীতিতে না আসা মানে তো আর দেশের দায়িত্ব নিতে না চাওয়া নয়! কৃষ্ণ সম্পর্কিত লেখাটা বেশ জটিল হয়ে উঠছে অর্জুন বুঝতে পারছে। হবেই তো!

৯৮

কৃষ্ণ নিজের দেশের সভ্যতা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম। নিজের জীবনদর্শনে একেবারেই রক্ষণশীল ছিল না।

‘ওই দারুণ দেখতে মেয়েটি কে?’ অর্জুন একদিন কৃষ্ণের পৈত্রিক বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করল।

‘কোনটা? সাতটা মেয়েকে তো দেখলাম, তাদের মধ্যে কোনজনকে তোমার মনে ধরল?’

‘বাকি ছ’জন ওই মেয়েটার দাসী। একজনকেই তো চোখে পড়ে। যে ফর্সা মেয়েটার গায়ে লাল পোশাক। তার গলায় যেন সুরের ঝঙ্কার আর চুলে যেন সূর্যকিরণ আটকে পড়েছে।’

‘বা-ব্বাঃ!’ বলে কৃষ্ণ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল, ‘অত সুর আর সূর্যকিরণের খবর জানি না, তবে লাল পোশাক পরা মেয়েটি, আমার বোন সুভদ্রা।’

অর্জুন-এর মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। ঠিকই তো। মেয়েটিকে অবিকল কৃষ্ণের মতোই দেখতে। শুধু সে ফরসা। সেই হাসি, কথা বলার আর ঘাড় ঘোরানোর ঢং—সব এক।

‘ওহো।’ অর্জুন লজ্জায় লাল হয়ে বলল, ‘কিছু মনে করো না।’

‘না, না। তা কেন? সুভদ্রাকে তোমার মনে ধরেছে?’

‘হায় ভগবান! হ্যাঁ। আমাকে বলে দেবে কী করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি?’

‘বলে দেওয়ার কী আছে? আজকের যুগের পুরুষ হয়ে এ কাজটা পারো না? তুমি বিবাহিত না?’

‘হ্যাঁ এবং না। আমার স্ত্রীকে আরও চারজনের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়। আমার বেশির ভাগটাই অবিবাহিত। সেই অংশটা তোমার বোনকে সমর্পণ করতে চাই।’

‘ভালো কথা। তবে সুভদ্রার মন পাওয়া কঠিন। তার ভারি দেমাক। কেউ নাকি তার যুগ্যি নয়। তুমি তাকে চুরি করো।’

‘বলো কী! চুরি করব?’

‘হ্যাঁ অপহরণ করো।’

গণপতি, চমকে গেলে নাকি? কৃষ্ণ ব্রিটিশের তৈরি করা ভিক্টোরিয়ান রীতিনীতি মেনে চলত না। সে আমাদের দেশের গভীরে যেসব প্রথা বা চলতি সামাজিক নিয়ম ছিল তা থেকেই নিজের জীবনদর্শন আহরণ করেছিল। সামাজিক গণ্ডির বেষ্টনিতে ওই জীবনস্ফুর্তিতে ভরপুর পুরুষকে কি বেঁধে রাখা যায়?

অর্জুন একটা সাদা অ্যাম্বাসাডার নিয়ে লুকিয়ে রইল রাস্তার ধারে। ওই রাস্তা দিয়েই সুভদ্রা গান শিখে ফেরে। কিছুক্ষণ পরেই বান্ধবীদের সঙ্গে তাকে দেখা গেল। খানিকটা গল্পগুজবের পর সুভদ্রা বাড়ির পথ ধরল।

অর্জুনের বুকে যেন হাতুড়ি পিটছে। সে গাড়ি স্টার্ট করতে গিয়ে দেখল, হচ্ছে না। আবার চাবি ঘোরাল।

অ্যম্বাসাডারের মতো দানব আর দুটো নেই। যেমন বিদঘুটে দেখতে, তেমনি ভারী আর তেলখেকো গাড়ি। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের আমল থেকেই এই অ্যাম্বাসাডার হল ভারতের স্বাধীনতার এবং শিল্পবিপ্লবের অন্যতম প্রতিচ্ছবি। বিদেশিরা অবাক হয়ে যেত, এই গাড়ি কিনতে নাকি দু-বছর লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতে হয়।

অর্জুন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লোহার হ্যান্ডেলটা বার করে গাড়ির সামনে গিয়ে সেটাকে ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট করল। তারপর গাড়ি নিয়ে সুভদ্রা কোন রাস্তায় যেতে পারে, আন্দাজ করে চালাতে লাগল।

এ গলি সে গলি দিয়ে ঘুরে বড় রাস্তায় পড়তে যাবে এসময় দাঁড়িয়ে পড়তে হল। রাস্তা আটকে একটা লরি দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে বেকায়দায় রাখা একটা গরুগাড়ি।

অর্জুন সময় নষ্ট না করে গাড়ি ব্যাক করে আবার এ-গলি সে-গলি ঘুরতে লাগল। কিন্তু সুভদ্রা কই?

হঠাৎ তাকে দেখতে পেল। আলো ছায়ার মাঝে হেঁটে চলেছে স্কার্ট পরা মেয়েটি। কোমর অল্প দুলছে। অর্জুন সময় নষ্ট না করে জোরে চালিয়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। গাড়ির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল।

যেই মেয়েটি কাছাকাছি এল, হঠাৎ লাফিয়ে পড়ে এক হাতে তার মুখ ঢেকে অন্য হাতে তাকে গাড়ির পেছনের সিটে তুলল। মেয়েটি প্রাণপণ কিল, চড়, লাথি চালাতে থাকল। অর্জুন তাকে চুমুতে ভরিয়ে দিতে দিতে বুঝল, মেয়েটি আর বাধা দিচ্ছে না। চুম্বন ফিরিয়ে দিচ্ছে। খানিকক্ষণের মধ্যেই অর্জুন তার স্কার্ট তুলে ফেলে প্যান্টি নামিয়ে এতক্ষণের টানটান উত্তেজনা থেকে মুক্তি লাভ করে স্বস্তি পেল।

‘তোমাকে ভালোবাসি সুভদ্রা।’ বলে তার বুকে অর্জুন মাথা রাখল।

‘তোমার খুব তাড়া না? আগে এইভাবে কখনও আমার হয়নি।’

গলাটা কর্কশ। অর্জুন-এর মনে হল, কে যেন এক বালতি বরফ জল তার গায়ে ফেলল। সে তাড়াতাড়ি গাড়ির আলো জ্বালিয়ে দিল।

‘চল্লিশ টাকা আমার রেট। একটা হোটেলঘরে গেলেই হত! আমার নাম কামেশ্বরী। সুভদ্রা নয়।’

৯৯

পরদিন কৃষ্ণ অর্জুনের পেছনে লাগল, ‘কী হে পুরুষ সিংহ? এমন অপহরণ করলে যে মেয়েটি বুঝলই না, সে অপহৃত হয়েছে?’

‘এর পরের বার শুধু দেখো, কী হয়।’

আর সত্যিই ক’দিন পরেই সুভদ্রা যখন মন্দির থেকে ফিরছিল, তখন অর্জুন তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল।

গোকর্ণম-এর বয়স্কজনেরা রেগে কাঁই। তারা পুলিশে খবর দিতে যাচ্ছিল। কৃষ্ণ বাধা দিল। বাবা বাসুদেবনকে বলল, ‘এর চেয়ে ভালো বর কি আমরা সুভদ্রার জন্য পেতাম? আমরা তো ঠিকই করেছিলাম, যে সুভদ্রার জন্য সারি সারি সম্বন্ধ দেখে তাকে হাটের মাঝখানে বেচার ব্যবস্থা করব না। পণ দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার চেয়ে অসম্মানের কিছু হতে পারে না।’

‘সুভদ্রার মত জানা উচিত আমাদের!’

‘তার যদি এতে মত না থাকত তাহলে অর্জুনকে নাস্তানাবুদ করে এতক্ষণে এখানে ফিরে আসত। আমরা বরং ওদের ডেকে পাঠিয়ে ব্যাপারটা পরখ করে নিই।’

ধুমধাম করে দুজনের বিয়ে হয়ে গেল। দিল্লি ফিরে যাওয়ার আগে অর্জুন আবারও একবার কৃষ্ণকে দিল্লি যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল।

‘আমি পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেব। তোমার ভবিষ্যৎ কিন্তু দিল্লি—’

‘না অর্জুন। সে জায়গা তোমার। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে তোমায় দেখে আসব। যখনি আমার উপদেশ চাইবে আমি পাশে থাকব। আমি গোকর্ণমের অন্তরাল থেকেই তোমার পথপ্রদর্শক হব।’ অর্জুন মেনে নিল, কারণ দিল্লির ইট কাঠ পাথরের মাঝে কৃষ্ণের মুক্ত প্রাণস্ফুর্তিকে বন্দি করা অন্যায় হবে।

অর্জুন বাড়ি ফিরে গেল। সুভদ্রাকে দ্রৌপদী কেমন ভাবে গ্রহণ করবে তা নিয়ে মনে একটু সংসয় দিল বই কি। দ্রৌপদীকে চিঠিতে মিথ্যা লিখেছিল অর্জুন। লিখেছিল, তার জন্য দাসী আনছে। কিন্তু এই মিথ্যাচারের আড়ালে সে সময় চেয়ে নিয়েছিল। সে চেয়েছিল দুই মহিলা মিলিত হয়ে তাদের মধ্যেকার বোঝাপড়া করে নিক।

গণপতি তুমি অর্জুনকে ভর্ৎসনা করছ দেখতে পাচ্ছি! তোমায় বুঝতে হবে যে অর্জুন আর দ্রৌপদী বাঁধা পড়েছিল বিধাতার এক অমোঘ বন্ধনে যার যাচাই শুধু বিবাহিত সম্পর্ক দিয়ে করা যাবে না। সুভদ্রার সঙ্গে ছিল শুধু আনন্দ এবং অনাবিল প্রেম। দুটোই ঘটেছিল এমন সব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে, যার ওপর অর্জুনের কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না।

কুন্তিকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়ে সুভদ্রা এবার দ্রৌপদীর দিকে ফিরল। ‘তোমার কথা কত শুনেছি।’

‘আমি এটা তোমায় বলতে পারছি না ভাই।’ দ্রৌপদী জবাব দেয়।

দুজন দুজনকে অপলক দেখতে লাগল। তারপর দুজনেই ছুটল বেসিনের দিকে। বমি করে ফেলল।

সুভদ্রার ছেলে অভিমন্যু আর যুধিষ্ঠিরের ছেলে প্রতিবিন্ধ্য তার নয় মাসের মধ্যেই জন্মগ্রহণ করে। সেই যে সুভদ্রা আর দ্রৌপদীর বেসিনে মাথা ঠুকে গিয়েছিল, তারপর থেকেই তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব হয়। এই দুই বোনের সম্পর্ক ঠিক শুণ্ড-উপশুণ্ডের মতো নয়, গণপতি। কোনও পুরুষ তিলোত্তমা এদের মধ্যে শত্রুতার বীজ বপন করতে পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *