ষষ্ঠদশ অধ্যায়। সবই যখন ভুল হল

ষষ্ঠদশ অধ্যায়। সবই যখন ভুল হল

১০০

প্রিয়া দুর্যোধনীর প্রধানমন্ত্রীত্বের এক বছরের মধ্যেই দেশে চতুর্থবার ভোট হল। ফল যা হল তাতে আমরা আশ্চর্য হলাম। কৌরব পার্টি ক্ষমতাচ্যুত না হলেও, সারা দেশে অনেক আসন হারাল। অনেকগুলি বিরোধী দল তৈরি হয়েছে। তারা উল্লেখযোগ্য ফল করতে পেরেছে। ছ’টা রাজ্যে তারাই সরকার গঠন করল। সুযোগের অপব্যবহার না করে একজোট হয়ে তারা কৌরব পার্টির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। আমাদের ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগছিল।

‘যদি আমাদের নেতৃত্ব আরও সুযোগ্য হত, এ দুরবস্থা হত না।’ যুধিষ্ঠির কৌরব ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং-এ বলল। টাক মাথা আর রোগা চেহারায় তাকে প্রায় গঙ্গাজির মতো দেখাচ্ছিল। গঙ্গাজির মতো তার ছিল পড়ার নেশা। কিন্তু সেখানেই ওদের সাযুজ্যের শেষ। যুধিষ্ঠির গঙ্গাজির মতো ব্রহ্মচর্য পালন করত না। নিরামিষাশী হলেও তার আখরোট, পেস্তা আর বিদেশি চকোলেট-এর প্রতি আসক্তি তাকে গঙ্গাজির মতো মোহমুক্ত করতে পারেনি। আগেই বলেছি, যুধিষ্ঠির মনে করত, সে ঠিক রাস্তায় চলে যার ফলে সে আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগত।

‘তুমি কী বোঝাতে চাইছ?’ দুর্যোধনী ঝাঁঝিয়ে উঠল।

‘আমি বেশ পরিষ্কার করেই বলছি পার্টির নেতৃত্বে গলদ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তোমাকে সেটা মেনে নিতে হবে যদি না ভবিষ্যতে আরও খারাপ ফল আশা করো।’ যুধিষ্ঠির রেগে গিয়ে বলল। সে নিজে প্রচুর ভোটে জিতেছে। প্রিয়া দুর্যোধনী যদিও বাবার রেখে যাওয়া নিরাপদ আসনে দাঁড়িয়েছিল, তার জেতার ব্যবধান খুবই কম ছিল।

‘ভোটে বোঝা গেছে মানুষ পরিবর্তন চেয়েছে। আমি সেই পরিবর্তনের প্রতিনিধি। কৌরব পার্টিতে আমি অপরিহার্য।’

‘সেটা পরীক্ষণীয়।’ যুধিষ্ঠির বলল।

‘তোমরা এভাবে ঝগড়া করো না।’ আমি এবার বলে উঠলাম। ভোটে হেরে আমার অবস্থাও সঙ্গীন। একটা বাচ্চা ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আমাকে হারিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পার্টির প্রবীণ নেতা হয়ে আমি তো পার্টিকে টুকরো হতে দিতে পারি না!’

‘তোমরা দুজনেই ঠিক বলছ।’ আমি বললাম। ওরা জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকাল।

‘পার্টির সব শীর্ষ নেতাদের দায়িত্ব নিতে হবে এই খারাপ ফলের।’ আমি যুধিষ্ঠিরকে বললাম। তারপর প্রিয়ার দিকেও তাকালাম, ‘আবার এটাও বুঝতে হবে, যারা হেরেছে তারা প্রবীণ নেতৃত্বের প্রতিনিধি। প্রিয়া এর মধ্যে পড়ে না।’

‘সেটাই আমি বলছিলাম।’ দুর্যোধনী বলল। সে ভুলে গেছে যে সে আমাদের হাতেই তৈরি হয়েছে।

‘ধৃতরাষ্ট শিখিয়েছিলেন, গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠরা যা চায় সেটাই মেনে নিতে হয়। পার্টিতেও আমাদের তাই করা উচিত। পার্টির শীর্ষ নেতাকে এবার থেকে পার্টি নির্বাচন করে নিক। কয়েকজন বৃদ্ধের পছন্দের ওপর ব্যাপারটা ছাড়া উচিত নয়।’ যুধিষ্ঠির বলল।

‘কী বলছ যুধিষ্ঠির? পার্টির অভ্যন্তরীণ ব্যাপার সর্বসমক্ষে নিয়ে আসবে? পার্টি তো সংসারের মতো। সেখানে কে রান্না করবে তা নিয়ে লোক জানাজানি করে নাকি কেউ?’

‘ভি.ভি.জি আপনি কি বলতে চান যে আমরা গণতন্ত্রের কথা শুধু মুখে বলব কিন্তু কাজের বেলা পার্টির কয়েকজন বৃদ্ধের অঙ্গুলি হেলনে চলব?’

‘এই ক্ষেত্রে তাই হবে।’ আমি বললাম।

‘আপনি সংসারের উপমা দিতে পারেন না। আপনি সংসার ধর্ম পালন করেননি।’ যুধিষ্ঠিরের মুখের ওপর বলল।

কথাটা খারাপ লাগলেও আংশিক সত্যি। পাণ্ডুর ব্রহ্মচর্যের ফলে পাণ্ডবদের জন্ম বৃত্তান্তটা ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের থেকে খানিকটা আলাদা ছিল। ফলে পাণ্ডু আমার ছেলে হলেও পাণ্ডবদের সঙ্গে আমার সোজাসুজি যোগ ছিল না। কিন্তু প্রিয়া দুর্যোধনীর সঙ্গে ছিল।

‘আমার আপত্তি নেই। পার্টি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করুক, তাতে অন্তত কয়েকজন বয়স্ক মানুষ, যারা পার্টির মাথা হয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিল, তাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।’ দুর্যোধনী আমায় চমকে দিয়ে বলল। আমি প্রমাদ গুনলাম।

‘তোমরা দয়া করে ঝগড়া করা বন্ধ করো। এটা দলবদ্ধ হয়ে থাকার সময়। এ সময়ে আমাদের দুর্বল হলে চলবে না। ওতে শত্রুপক্ষের হাত শক্ত হবে। একটা মাঝামাঝি রাস্তা বের করা সম্ভব।’

‘সেটা কী?’ ওরা একসঙ্গে জিগ্যেস করল।

‘আমরা দুর্যোধনীকে প্রধানমন্ত্রী পদে বলীয়ান রেখে একটা ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার-এর আসন তৈরি করি।’ আমি বললাম।

তর্কের ঝড় উঠল। আমি জানতাম, ইতিহাস বদলানো যায় না। ঘটনাপ্রবাহের বেগ যতটা কমিয়ে দেওয়া যায়, ততই মঙ্গল।

‘যুধিষ্ঠিরকে ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার করা হোক।’

দু-পক্ষে তুমুল বিবাদ লাগল। শেষে তারা উপায়ান্তর না দেখে আমার কথা মেনে নিল। এ যেন বম্বের ছায়াছবি। ক্যামেরা সামনে থাকলে শত্রুরাও একসঙ্গে হেসে পোজ দেয়। প্রেস কনফারেন্স-এ যুধিষ্ঠির গম্ভীর মুখে বসে রইল। একজন সাংবাদিক জিগ্যেস করল, ডেপুটি পি এম-এর কাজটা ঠিক কী হবে? পার্টিতে কি তিনি চিফ একজিকিউটিভ-এর দায়িত্ব পালন করবেন? ‘ভালো করে ডিকশনারিটা পড়ুন। ডেপুটি মানেটা পরিষ্কার লেখা আছে সেখানে।’ যুধিষ্ঠির নীরস মুখে বললেন।

সুন্দরী দ্রৌপদী মোকড়াশি অল্প-অল্প মোটা হতে আরম্ভ করেছে।

১০১

আমি জানতাম এই ব্যাপারটা বেশিদিন চলবে না। প্রিয়া জানত, পরের নির্বাচনের পাঁচ বছর দেরি আছে। তার নিজের ক্ষমতার সদ্ব্যবহার শুরু করল। ভবিষ্যতে তার অধিনায়কত্ব নিয়ে যাতে প্রশ্ন না ওঠে সেদিকে সে কড়া নজর রাখল। দুর্যোধনী চিরকালই একরোখা মেয়ে। একবার যা ঠিক করে, তা করেই ছাড়ে।

সে প্রমাণ করে দিল যে সে একাই প্রধানমন্ত্রী। তার কোনও সহকারী নেই। তার বাহ্যিক ব্যবহারে এল আমূল পরিবর্তন। নিজের অনিশ্চয়তা বা না জানার ভীতি একেবারে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে এল এক সাহসী এবং দৃঢ়মনা নেত্রী। তরুণ বয়সের যেটুকু অপরিপক্বতা ছিল তার আচরণে, সেটাকে দুর্যোধনী ঢাকল ঔদ্ধত্য দিয়ে। পার্টির বয়স্কদের একেবারে পাত্তা দিত না। তাদের বাড়তি আবর্জনা হিসেবেই গণ্য করতে লাগল। বলা বাহুল্য, ডেপুটি পি এম যুধিষ্ঠিরকে সে অবহেলা করত।

‘এ কী অপমান, ভি ভি জি! আমার সঙ্গে একেবারে আগন্তুকের মতো ব্যবহার করছে প্রিয়া। কিছু বলতে গেলেই ভ্রু এমন বাঁকিয়ে তাকাবে যে আত্মসম্মানে আঘাত লাগে।’ যুধিষ্ঠির আমার কাছে এসে অভিযোগ করল, ‘আমি ডেপুটি পি এম। অথচ সরকারে কী হচ্ছে তা আমাকে জানতে দেওয়া হয় না। কোনও জরুরি ফাইল আমার কাছে আসে না। যেগুলো আসে, তাতে আমি আমার বক্তব্য লিখে দিলে তাতে কেউ আমল দেয় না।’

একদিন যুধিষ্ঠির শুনল, তাকে ছাড়াই একটা ক্যাবিনেট মিটিং হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর জানাল, যুধিষ্ঠিরকে সময়মতো আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এদিকে তার সেক্রেটারি বারে বারে বলল যে কোনো আমন্ত্রণ এসে পৌঁছোয়নি। যুধিষ্ঠির প্রিয়ার অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইল। তিনদিন পরেও সাক্ষাৎ হল না। রাগে-দুঃখে সে পদত্যাগ করল।

‘তুমি বোকামি করলে। এটাই তো ও চাইছিল।’ আমি হতাশ হয়ে বললাম।

‘এত অপমান সহ্য হচ্ছিল না।’

দুর্যোধনী সে রাত্রে বাড়িতে শ্যাম্পেনের বোতল খুলেছিল বলে পরিচারক মহল জানায়। সেটা গুজব হতেই পারে।

দ্রৌপদীর এদিকে জ্বর এল। সে বিছানা নিল। কখনো শীতে কাঁপছিল। কখনও অসহ্য গরমে ছটফট করছিল।

১০২

দুর্যোধনী এবার প্রকাশ্যে নিজের স্বপক্ষে সমর্থন জোগাড় করতে উঠে পড়ে লাগল। সে বক্তৃতা দিয়ে বোঝাতে লাগল তার বাবার আত্মত্যাগের কথা। সে আঙুল তুলে দেখাল পার্টির মধ্যের কিছু মানুষকে, যারা তার বাবার দেখানো পথ থেকে পার্টিকে বিচ্যুত করতে উদ্যত হয়েছে। সে ‘উন্নতমনস্ক’ পার্টি কর্মীদের পাশে চাইল। প্রথমেই তার আবেদনে সাড়া দিল জয়প্রকাশ দ্রোণের ছেলে। অশ্বত্থামা।

পাণ্ডবদের সঙ্গে গ্রামোন্নয়নের কাজে ছেদ পড়ার পর থেকে দ্রোণ এবং অশ্বত্থামাকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়নি অনেকদিন।

দ্রোণ নিজে প্রায় সন্ন্যাস নিয়ে একটা ছোট্ট আশ্রমে থাকে। রাজনীতি থেকে সে অবসর নিয়েছে। কারণটা বোঝা যায়নি। হতে পারে যে দেশের সার্বিক উন্নতির ধীরগতি তাকে অধৈর্য করে তুলেছিল। অবসর নেওয়া সত্বেও সে শারীরিকভাবে বেশ সচল ছিল। তার সেইসব বিশেষ শিক্ষা যার দ্বারা সে পাণ্ডবদের উদ্বুদ্ধ করেছিল, সেগুলো সে ভোলেনি। ইদানীং ভূমি সংস্কার বা মহাগুরুর অহিংসা ধর্ম নিয়ে মাঝে মাঝে বক্তৃতা দেয় দ্রোণ। প্রতিবছর মে মাসে খবরের কাগজে তার জন্মদিন উপলক্ষে দু-লাইন খবর থাকে। সাংবাদিকদের মনে পড়ে যায়, কিছুদিনের মধ্যে দ্রোণর স্মরণিকাও লিখতে হবে।

অশ্বত্থামা বাবার কাছ থেকে সামরিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সাম্যবাদের শিক্ষালাভ করেছিল। সে ক্ষমতালোভী ছিল না। ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক পার্টিগুলির অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য একটি সমাজতান্ত্রিক দল স্থাপন করেছিল। প্রিয়ার ডাকে যখন সে সাড়া দিল তখন অনেকেই অবাক হল। খবরের কাগজেও তার দাড়িওয়ালা মুখের ছবি ছাপা হল। অশ্বত্থামার সাহস, ব্যতিক্রমী চিন্তাধারা এবং সমাজ সেবার ইচ্ছা, সব মিলিয়ে তার মধ্যে এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল। কৌরব ওয়ার্কিং কমিটিতে অশ্বত্থামাকে রাখলেও সরকারের মধ্যে দুর্যোধনী তাকে রাখেনি।

দ্রোণের ছেলে কিছুদিনের মধ্যেই তার সাম্যবাদী ধ্যানধারণা পার্টির মধ্যে চারিয়ে দিয়ে পার্টির বৃদ্ধদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়াল। প্রিয়া এটাই চেয়েছিল।

‘আমরা আমাদের প্রাক্তন মহারাজাদের প্রিডিপার্স বা অনুদান কেন দেব? ব্যভিচার সিং-এর কর কেন মকুব করা হবে? সে তো গরিব চাষিকে শোষণ করে রোজগার করছে?’ অশ্বত্থামা যুধিষ্ঠিরকে বলছিল।

‘চাষিরা তো কর দেয় না।’ যুধিষ্ঠির উত্তরে বলল। সে আর অশ্বত্থামা এককালে কৃষি কর তুলে নেওয়ার জন্য আন্দোলন করেছিল। শিশুপাল তার শাসনের শেষেরদিকে সেই কর তুলে নেয়।’

‘এই কোটি কোটি টাকা গরিব কৃষকের কাজে লাগতে পারে। রাজাদের কেন দেওয়া হবে?’

‘কারণ তাদের রাজত্ব নিয়ে নেওয়া হয়েছিল।’

‘সে তো কুড়ি বছর আগে। এতদিনে তারা যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। আর না।’

‘সেটা কে ঠিক করবে? তারা তাদের রাজত্ব ত্যাগ করেছিল ভারতে যোগ দেবে বলে। তাদের নিজস্ব রোজগার এই অনুদানের চেয়ে ঢের বেশি ছিল।’

‘ভুলে যেও না যে হস্তিনাপুরকে স্বাধীনতার আগেই অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। আমরা অনুদান পাই না।’

‘আমি জানি। তবুও তোমার সহানুভূতি রয়েছে ওদের জন্য।’

‘সহানুভূতির প্রশ্ন উঠছে না।’ যুধিষ্ঠির রেগে উঠল, ‘আমরা ওদের লিখিত আশ্বাস দিয়েছিলাম। সেটাই পালন করছি। এটা ওদের সাংবিধানিক অধিকার!’

‘তুমি আমাকে সংবিধান শিখিও না। সাম্য এবং সামাজিক ন্যায়ের কথাও সংবিধানে আছে।’ এবার অশ্বত্থামার চোখ জ্বলে উঠল।

‘তুমি কি আমাদের প্রতিশ্রুতি ভাঙতে বলো?’

‘ভাঙার কী আছে? কৌরব পার্টির উচিত সর্বতোভাবে গরিবের পাশে দাঁড়ানো।’

‘অশ্বত্থামা ঠিক বলছে।’ প্রিয়া বলল, ‘আমার ইচ্ছে যে সংসদের আগামী অধিবেশনে এই ব্যাপারে বিল আনব।’

ওয়ার্কিং কমিটিতে সর্বতোভাবে অশ্বত্থামার পরামর্শ গৃহীত হল। পার্টি বুঝেছিল, এবার অঙ্গীকার ভাঙার সময় এসেছে। তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌরব পার্টির জনপ্রিয়তা বাড়বে।

যুধিষ্ঠির ওয়ার্কিং কমিটি থেকেও পদত্যাগ করল।

দ্রৌপদী মোকড়াশি টনিক আর ভিটামিন খেয়ে বাড়ির কাজকর্মে ফিরে এল।

১০৩

এর পরেই আবার ভূমিকম্প। আজকের দিনে ব্যাপারটা তুচ্ছ লাগবে গণপতি, কিন্তু সেইসময় ব্যাঙ্ক সরকারিকরণ নিয়ে কী প্রবল ঝড় উঠেছিল, তুমি ভাবতে পারবে না। আজ আমরা বুঝি যে এর ফলে অনেক ব্যাঙ্ক যারা লাভ করেছিল, তারা আমলাতন্ত্রের হাতে চলে গিয়ে অহেতুক কিছু নিয়মকানুন-এর বেড়াজালে আটকে পড়ে লোকসান করতে থাকল। কিন্তু তখন তো আর লাভ-লোকসানের কথা ছিল না। তখন মানুষের কাছে পরিসেবা পৌঁছোনোটাই লক্ষ্য ছিল।

অশ্বত্থামার পিছনে প্রিয়ার সম্পূর্ণ মদত ছিল। তারা মনে করত, প্রাইভেট ব্যাঙ্ক গরিব মানুষকে লোন দিতে চায় না। এত কিছু প্রমাণ আর সম্পত্তি জমা রাখতে বলে, যা গরিব মানুষের পক্ষে অসম্ভব। সরকারি ব্যাঙ্ক এই ঘাটতি পুরিয়ে দেবে তারা আশা করেছিল। আজকালকার সরকারি ব্যাঙ্ক আবার এসব ডকুমেন্ট চাইতে আরম্ভ করেছে। না হলে ব্যবসা লাটে উঠবে!

অশ্বত্থামা আর দুর্যোধনী, ব্যাঙ্ক ন্যাশনালাইজেশন-এর সঙ্গে সঙ্গে মাতৃত্ব এবং ডালভাত-এর স্লোগানও তুলল। অশ্বত্থামার তাগিদে ব্যাঙ্ক ন্যাশনালাইজেশন বিল এল সংসদে। দুর্যোধনীর সঙ্গে ওয়ার্কিং কমিটি একমত হতে পারল না। সে দুঃসাহস দেখিয়ে বিলটি সংসদে ভোটের জন্য পেশ করল। পার্টির হুইপ ছাড়া এবং বামপন্থীদের মদতে বিল পাশ হয়ে গেল।

গোটা দেশ জুড়ে তর্ক-বিতর্ক আলাপ আলোচনা চলতে লাগল। সবাই রাষ্ট্রপতির দিকে তাকিয়ে আছে তাঁর শেষ মতামতের আশায়। অতীব ভদ্র এবং শিক্ষক ব্যক্তি মেহেরবান ইমানদার তখন লর্ড ড্রুপ্যাড-এর প্রাসাদে থাকেন। তিনি সই করলে বিলটা অ্যাক্ট হয়ে আইন হিসেবে চালু হবে। একদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রিয়ার চাপ অন্যদিকে তাবড় তাবড় মাথারা ক্রমাগত তাকে সই না করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে চলেছে।

অবশেষে মৃত্যু এসে তাঁকে শান্তি দিল।

দ্রৌপদী মোকড়াশির মাথা হঠাৎ হঠাৎ ঘুরে যায়। সে চোখে অন্ধকার দেখে।

১০৪

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দ্রুত এগিয়ে এল। কৌরব ওয়ার্কিং কমিটি তার প্রতিনিধি ঠিক করবে বলে মিলিত হল। সংসদের সদস্যরা এবং রাজ্যের বিধানসভার সদস্যরা মিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। কৌরব পার্টির প্রতিনিধিই যে জিতবে, এটা সকলেই ধরে নিয়েছিল।

কৌরব পার্টির বৃদ্ধেরা দেখল, প্রিয়ার ওপর দখলদারি করার আবার একটা সুযোগ এসেছে। এমন একজন রাষ্ট্রপতি আনা দরকার যে প্রিয়ার সব কথা মেনে নেবে না। সে ব্যাঙ্ক ন্যাশনালাইজেশন বিলটা সই করবে না। এতে প্রিয়া জব্দ হবে।

ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং-এ ঝড় উঠল। দুর্যোধনী এক হরিজনের নাম ঘোষণা করল। বৃদ্ধেরা রে রে করে উঠে আমার নাম এগিয়ে দিল। যেদিন নমিনেশন ফাইল হল দেখলাম, আমাদের পার্টির একটি যুবক নিজেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড় করিয়েছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে। এ সব নির্বাচনে এরকম নাম না জানা ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রতিনিধি অনেকেই দাঁড়ায়। তাই বিশেষ মন দিয়ে তালিকাটা পড়ছিলাম না। হঠাৎ চোখটা আটকে গেল। এই ছেলেটির নাম একলব্য। তার নাম প্রপোজ করেছে প্রিয়া!

দ্রৌপদী মোকড়াশি চোখ পিট পিট করে বুঝতে চেষ্টা করল, কেন তার চোখে অন্ধকার নেমে আসছে।

১০৫

পার্টির বড়রা যখন অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে প্রিয়াকে এর কারণ জিগ্যেস করল, সে বলল একলব্যর নাম সে প্রপোজ করেছে বলেই যে তার পক্ষে ভোট দেবে সেটা নয়। আমার সঙ্গে সে ভোটের আগে কিছু বোঝাপড়ায় যেতে চায়।

‘তুমি আমাকে দিয়ে লিখিত অঙ্গীকার করাতে চাও যে আমি বিনা বাক্যব্যয়ে তোমার বিলগুলো সই করব?’ আমি জিগ্যেস করলাম।

‘ধরে নাও তাই।’

পরের দিনে কাগজে লোকে পড়ল, পার্টি একলব্যকে শো কজ করেছে ডিসিশন ভাঙার অপরাধে। দ্বিতীয় খবর হল, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে ভারতের যুবাদের হাতে শাসনভার তুলে দেওয়া হোক।

একলব্য শো কজের একটা স্বভাবসিদ্ধ উদ্ধত জবাব দিল। খবরের কাগজেও সেটার কপি পাঠিয়ে দিল।

আমরা বিপদ সংকেত দেখতে পেলাম। প্রিয়া রাষ্ট্রপতি রূপে একটা কলের পুতুল চায় যে তাকে রাজত্ব করতে সাহায্য করবে শুধু। কিন্তু কৌরব পার্টির বেশিরভাগ সদস্য কি এই চাইত? একলব্যকে পার্টির সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করা হল। পার্টি ঘোষণা করল যে আমাকে ছাড়া কোনও পার্টি সদস্য অন্য কাউকে ভোট দিতে পারবে না।

প্রধানমন্ত্রী ‘বিবেকের’ কথা শুনে সকলকে ভোট দিতে বললেন।

‘এখন দেশ গড়ার সময় আর সেটা পার্টি ডিসিশনের জুজুর চেয়ে অনেক বড়।’ প্রিয়া বলল।

ওয়ার্কিং কমিটি তার কাছ থেকে সদুত্তর চাইল। প্রিয়া মনে করিয়ে দিল, আমাদের দেশে গোপন ব্যালট-এর ব্যবস্থা আছে, তাই কে কাকে ভোট দিচ্ছে জানা যায় না। প্রিয়া সব উন্নতমনস্ক সদস্যদের ডাক দিয়ে বলল একলব্যকে ভোট দিতে। বামপন্থীরা তার সঙ্গে রইল।

কৌরব পার্টি দুর্যোধনীকে শোকজ করল। দুর্যোধনী পাত্তাই দিল না। এই মান-অভিমানের পালা চলল কিছুদিন। তার মধ্যে একলব্য অল্প ব্যবধানে জিতে গেল। সে হল ভারতের সবচেয়ে অল্পবয়সি রাষ্ট্রপতি।

পরদিন পার্টি প্রিয়াকে বহিষ্কার করল। কিন্তু সেদিনের মিটিং-এ বেশি লোক হয়নি। ফাঁকা চেয়ারগুলো যাদের জন্যে রাখা হয়েছিল, তারা ততক্ষণে প্রিয়ার বাড়িতে বসে নতুন কৌরব পার্টি তৈরি করছে। এই পার্টির নাম হল কৌরব পার্টি (আসল)।

খুব সহজেই একটা নির্বাচন আর কয়েকটা নীতিকে ঘিরে পৃথিবীর প্রাচীনতম দল, যা ব্রিটিশ শাসকদের দেশছাড়া করেছে, শতবর্ষের ষোলো বছর আগেই দ্বিখণ্ডিত হল।

বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু এটাই সত্যি প্রিয়ার কৌরব পার্টি-তে (আ) বেশিরভাগ সদস্যরা ভিড় করল। আমরা কৌরব পার্টি-তে (পুরোনো) পড়ে রইলাম। এই প্রথম দেশের প্রধানমন্ত্রী এমন একটি পার্টির প্রতিনিধি হলেন যার সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। কিন্তু বামপন্থীরা দুর্যোধনীকে সমর্থন করেছিল বলে সেটা সম্ভব হয়েছিল। বামপন্থীদের উদ্দেশ্য ছিল দুর্যোধনীকে হাতে রাখা। ওরা এটা বোঝেনি যে কাজ মিটে গেলে সে তাদের ছুড়ে ফেলে দেবে। বামপন্থীদের সাম্যবাদের বুলি কেড়ে নিয়ে প্রিয়া তাতে নিজের মোড়ক পরিয়ে দিল। এতে পরের নির্বাচনে তার অনেক সিট লাভ হল।

আমার তো অস্তিত্বই লুপ্ত হয়েছিল। একদিকে প্রিয়া বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর আঘাত হানল। অন্যদিকে হঠাৎ নির্বাচন ঘোষণা করে আমাদের একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ল। সে স্লোগান দিল, ‘গরিবি হঠাও’—যেন এর আগে কেউ সেটা জানত না! আমরা বুড়ো ভামেরা বোকার মতো তাকে নীচু করতে পালটা স্লোগান দিলাম, ‘দুর্যোধনী হটাও’, যেন গরিবির চেয়েও সে বড় দানব। পুরোনো পার্টির ধ্বংসস্তূপের ওপর দুর্যোধনী একা দাঁড়িয়ে রইল। একা হয়েও বিজয়িনীর হাসি তার গর্বিত চোখে মুখে। সে নির্বাচনে তাকে মদত করেছিল বহু ছোট বড় নেতা। ধৃতরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি আসনে জিতে সে সংসদে এল।

কী করে এটা সম্ভব হল তা নিয়ে চলতে থাকল তরজা। রাজনীতির পণ্ডিতেরা নানান মতবাদ জানাল। কেউ বলল প্রিয়া তার বাবার দেওয়া শিক্ষা সম্পূর্ণ কাজে লাগাতে পেরেছে। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র নয়, গান্ধারীর জেদ ছিল তার মধ্যে। কেউ বলল, পুরোনো রাজাদের সরকারি অনুদান বন্ধ করে দেওয়া এবং ব্যাঙ্ক-সরকারিকরণ ছিল এর প্রধান কারণ। কিন্তু আমাদের দেশের ভোটদাতারা কি অতশত বোঝে? আমার মনে হল এর প্রধান কারণ সারল্য। না প্রিয়ার নয়, তার সরলতা তো গান্ধারীর মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। আমি বলছি ভারতবর্ষের সারল্যের কথা। ‘গরিবি হটাও’ কথা দুটোর মধ্যে জাদু ছিল। ৩২০ মিলিয়ন ভোটার সরলভাবে বিশ্বাস করেছিল, প্রধানমন্ত্রী তাদের কথা চিন্তা করে কর্মসূচি নিয়েছে। তারা বোঝেনি, এর পেছনে এতটুকু দরদ কাজ করেনি প্রিয়ার। গরিবি হটাও না বলে সে ‘চাঁদে চলো’ স্লোগান দিলেও তার কিছু এসে যেত না। সরল ভারতবর্ষ ঠকে গিয়েছিল।

ভারতে আবার নতুন সম্রাজ্ঞীর অভিষেক হল। শেষ সম্রাজ্ঞী চলে যাওয়ার একশো বছর পরে। সে এসে এমন চোখ ধাঁধিয়ে দিল, মানুষের মনে ধন্দ লেগে থাকল। তারপর আস্তে আস্তে ছবিটা পরিষ্কার হতে থাকল, গণপতি।

দ্রৌপদী মোকড়াশির শ্বাসকষ্ট দেখা দিল। সে সারাক্ষণ হাঁপাচ্ছে। হাপরের মতো তার বুক ওঠা পড়া করে।

১০৬

কিন্তু দুর্যোধনীর কৌশল সর্বসমক্ষে মানুষ বুঝে ফেলার আগেই একটা জাতীয় আনন্দোৎসবের রোল উঠল। দুই দেশের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে।

ভারতের দুই কাঁধ কেটে যখন ইংরেজরা কর্ণস্থান তৈরি করে তখন তাদের পেনসিলের দাগ দেখেছিল শুধু দুটি মুসলমান প্রধান অঞ্চলকে। সে দুটোকে মাংসের মতো কেটে নিয়ে পরিবেশন করা হয়েছিল কর্ণকে। কিন্তু এই দুই মাংসপিণ্ডকে একভাবে রান্না করা হল না। রোস্ট করার পর দেখা গেল, একটা উপাদেয় এবং অন্যটা কাঁচা। পশ্চিম কর্ণস্থান যেটা কর্ণের নিজের বাসস্থান হয়, তার উন্নতির সীমা-পরিসীমা ছিল না। সেখানে তৈরি হল রাস্তা, খাল এবং কলকারখানা।

পূর্ব কর্ণস্থান ডুবে রইল অন্ধকারে। সেখানে জলা জমি আর ধানজমির মাঝে নিচু ভাঙা পায়ে চলা পথ ছাড়া ছিল শুধু বন্যা আর দারিদ্র্য। মানুষ এখানে শিল্প-সংস্কৃতি আর নিদ্রাকে উন্নতি এবং প্রগতির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিত। পূর্ব কর্ণস্থান ছিল গঙ্গাজির বিচরণক্ষেত্র। এখানে তিনি পার্টিশনের আগে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি স্থাপনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।

প্রায় পঁচিশ বছর ধরে পূর্ব কর্ণস্থানের মানুষরা বঞ্চনা আর প্রতারণা সহ্য করল। তাদের দোষ, তারা মুসলমান প্রধান অঞ্চল। তাই কর্ণস্থানের সঙ্গে জুড়ে যেতে হয়েছে। কর্ণস্থানের তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তাদের অংশের পাট উৎপাদনের পয়সায় পশ্চিম কর্ণস্থান গাড়ি চড়ে, তাদের দেওয়া ট্যাক্সে পশ্চিম কর্ণস্থানের কোষাগার ভরে, তাদের মহিলাদের পাচার করা হয় পশ্চিমের বেশ্যালয়ে। পশ্চিমের সৈন্য তাদের ধানখেত মাড়িয়ে নষ্ট করে। ভয় দেখিয়ে বশে রাখে।

পূর্ব কর্ণস্থান পশ্চিমের দেনার অংশ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। কিন্তু পূর্ব কর্ণস্থানের মানুষের ভাষা থেকে জীবনযাত্রা সবই পশ্চিমের কাছে হাসির খোরাকের বিষয়। পশ্চিমে একটা চালু রসিকতা ছিল, পূর্বের মানুষ একমাত্র প্রতিক্রিয়া এবং বংশবৃদ্ধি ছাড়া কিছুই বোঝে না।

মিলিটারি শাসনের দুই দশক বাদে, কর্ণস্থান-এর প্রধান, জেনারেল জরাসন্ধ খান হঠাৎ নির্বাচন ডাকলেন। তিনি ভুলে গেলেন, ভোটের ময়দানে সংখ্যাই ঈশ্বর। পশ্চিম কর্ণস্থানের প্রতিপত্তি বেশি হলেও পূর্বের মতো জনসংখ্যা তো নেই! ফলে নির্বাচন করা মানেই পূর্ব কর্ণস্থানের জেলাবিন পিপলস পার্টি সবথেকে বেশি ভোট পেয়ে কর্ণস্থানের সংসদকে দখল করা!

কার্যত তাই ঘটল। পশ্চিম কর্ণস্থান একেবারে বেকুব বলেন গেল। কর্ণস্থানের রাজনৈতিক নেতারা, তাদের মধ্যে জলি শাহ ঝুটা সর্বাগ্রে জরাসন্ধ খানকে দিয়ে নির্বাচনের ফল খারিজ করিয়ে দিল। পূর্ব কর্ণস্থানে মিলিটারি শাসন ঘোষিত হল। নেতাদের অন্যায় জুলুম করে কারাবন্দি করা হল। যারা পালাতে পেরেছিল, তারা জেলাবিকে কর্ণস্থান থেকে স্বাধীন করার ডাক দিল।

ভারতের নাক গলানো ছাড়া উপায় ছিল না। এক তো সমুদ্রে তিমি মাছ জেগে উঠে ঢেউদের যেমন সরিয়ে রাখে, তেমনি করে পশ্চিম ও পূর্ব কর্ণস্থানের মধ্যে তার অবস্থান। অন্যদিকে, কর্ণস্থান যখন জেলাবি দেশিদের ওপর অত্যাচার শুরু করল, তখন হাজারে হাজারে মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করল উদ্বাস্তু হয়ে।

এদের দেখে প্রিয়ার মন গলেছিল কিনা, তা জানি না গণপতি। ছেঁড়াখোঁড়া কাপড় পরা হাড় বের করা নারী-পুরুষ শিশু তাদের চোখে-মুখে হতাশা নিয়ে গাছতলায়, পাইপের মধ্যে বা তাঁবুতে কোনওমতে মাথা গুঁজে রয়েছে। সারা পৃথিবীর ক্যামেরার লেন্স সেদিকে তাক করা। সারা পৃথিবী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বের সমবেত ঘৃণা এমনিতেই জরাসন্ধকে জেলাবি দেশ থেকে হটিয়ে দিত।

প্রিয়া ততক্ষণে তার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে।

প্রিয়া জরাসন্ধ খানকে বলল, জেলাবি দেশিদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করতে। রিফিউজিদের ঘরে ফেরার ব্যবস্থা করতে। দুমুখোরা অবশ্য বলে, এই করে সে নিজের জন্য বিশ্বের দরবারে প্রশংসা কিনেছিল। জরাসন্ধ আর জলি শাহ ঝুটা এতটুকু পিছু হটতে রাজি হল না। তারা উলটে প্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ জানাল, সাহস থাকলে ভারত লড়াই করুক।

প্রিয়া সময় নষ্ট না করে ভারতীয় সেনাকে যুদ্ধের আদেশ দিল। মাঠ ঘাট পেরিয়ে নদী সাঁতরিয়ে সতেরো দিনের মধ্যে কর্ণস্থানকে হারিয়ে দিয়ে ভারতীয় সেনা জেলাবি দেশে স্বাধীনতা এনে দিল। প্রিয়াকে প্রায় দেবীর মতো পুজো করল সকলে—মা দুর্যোধনী বা দুর্যোধনী আম্মা বলে। শক্তিরূপিণী প্রিয়ার সে কী জয়জয়কার! গণপতি, আজও ভুলিনি।

আমি যেন স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। ফিরে গেলাম পৌরাণিক যুগে। পরিষ্কার শুনতে পেলাম, সংস্কৃত ভাষায় কথা হচ্ছে। দেখলাম কর্ণস্থানের জরাসন্ধ যেন রাজা বৃহদ্রতের ছেলে। তার দুই বউ-এর সন্তান হচ্ছিল না। ঋষি কৌশিক তাদের আম কেটে দু-ভাগ করে খেতে দেয়। দুই স্ত্রী অর্ধেক পুত্রের জন্ম দিলে সেই টুকরো দুটিকে জোড়া দিয়ে জরাসন্ধকে তৈরি করা হয়।

দুর্যোধন রাজসূয় যজ্ঞ করেছিল সম্রাট হবে বলে। জরাসন্ধকে হত্যা করেই সেটা সম্ভব। সে ভীম, অর্জুন আর কৃষ্ণকে পাঠাল জরাসন্ধকে শেষ করতে। ভীম তাকে ডুয়েল লড়তে আহ্বান করল।

ভীম তাকে মাঝখান থেকে চিরে দিতেই আবার সে জোড়া লেগে গেল। কৃষ্ণ একটা খড়কে দু-খণ্ড করে দু-দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ভীমকে বুঝিয়ে দিল কী করতে হবে। ভীম তাই করল।

কর্ণস্থান দু-টুকরো হয়ে গেল।

কোনও কোনও দিন দ্রৌপদী ভালো থাকে। তার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়, তার গালে সুস্থতার রং লাগে।

১০৭

সাধারণ আর গরিব মানুষের জীবনে কোনও উন্নতিই হল না গণপতি। তারা খিদে পেটে নিয়ে ছেঁড়া কাপড়ে কোনওমতে লজ্জা নিবারণ করে দিন কাটাতে লাগল। অনেকে বোধহয় রোগ আর অপুষ্টিকে ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছিল।

পৃথিবীর কাগজগুলিতে লেখা হল, ‘ভারতীয়রা না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে।’ ব্যাপারটা যদি তাই হত, তাহলে তো ক্ষুধার্ত মানুষের এই জনসংখ্যা শেষ হয়ে যেত। আসলে তারা খিদে, তৃষ্ণা আর রোগ সহ্য করেও বেঁচে ছিল। প্রিয়া কি তাদের খোঁজ রাখত? তার বক্তৃতা যারা লিখে দিত তারা সেগুলো ভরে দিত প্রিয়ার বুক ভরা বেদনার কথা দিয়ে। সর্বহারার নেত্রী প্রিয়া বাহবাও কুড়োত বক্তৃতা মঞ্চের নীচে বসে থাকা গরিব মানুষগুলোর থেকে।

প্রিয়া খবরের কাগজকে নিজের কবজায় রাখবে বলে নিউজপ্রিন্ট মেপে দিল। আদালতকে মনে করিয়ে দিল, সাধারণ মানুষের কথা মনে রাখতে হবে। প্রিয়া রাজ্যগুলিতে তার পার্টির নেতাদের নির্বাচিত হওয়া বন্ধ করে নিজে ঠিক করে দিল, কে কোথায় কোন কাজ করবে। ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের সারা দেশে গ্রেপ্তার করা শুরু হল। চাষিদের মিটিং মিছিল পিটিয়ে ভেঙে দেওয়া হল। নতুন নতুন আইন তৈরি করা হল মানুষের স্বাভাবিক স্বাধীনতায় আগল বসাতে।

তারপর সেই স্বপ্নটা দেখলাম আমি। যমুনার ধারে অর্জুন আর কৃষ্ণ বসে আছে। এক অতিকায় পুরুষ। তার গা থেকে চোখ ধাঁধানো জ্যোতি বেরোচ্ছে। হঠাৎ এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি ওই জঙ্গলকে জ্বালিয়ে ছাই করে দেব। তোমরা আমাকে সাহায্য করো।’ তারপর চলল সেই মারণ লীলা! আগুনের লেলিহান শিখা জঙ্গল গ্রাস করল। প্রাণভয়ে পলাতক পশু পাখিদের অর্জুন আর কৃষ্ণ জঙ্গলে ফিরে যেতে বাধ্য করল। তাদের মরণ আর্তনাদে কেঁপে উঠল পৃথিবী। পাখিদের ডানা ঝলসে গেল, বাঘের ডেরায় আগুন ধরে গেল, হরিণ চোখ বন্ধ করে আগুনে ঝাঁপ দিল, সাপেরা অর্জুন আর কৃষ্ণের তাড়া খেয়ে জ্বলন্ত ঘাসের মধ্যে জ্বলে কাঠ হয়ে গেল। চারিদিকে মৃত্যুর অগ্নিফাঁদ। সব শেষে অগ্নিদেব এল কৃষ্ণ আর অর্জুনকে অভিবাদন জানাতে।

‘বলো কী আশীর্বাদ চাও।’

‘যেমন ধ্বংস করেছি সহজে, তেমনি সৃষ্টি করার ক্ষমতা দিন আমাদের।’ অর্জুন কৃষ্ণের শিখিয়ে দেওয়া বুলি আওড়াল।

‘হবে। তবে এখনই নয়।’

সেই উজ্জ্বল অস্তিত্ব মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। আমার স্বপ্নভঙ্গ হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *