দ্বিতীয় অধ্যায়। যুদ্ধ

দ্বিতীয় অধ্যায়। যুদ্ধ

সব শুনছ তো গণপতি? নিশ্চয়ই সবই শুনে নিয়ে লিখে নিয়েছ ঠিকঠাক করে। সেরকমই তো চুক্তি ছিল!

আমায় তুমি নিয়ন্ত্রণে রেখো। অনেক সময়ে বড় প্রগলভ হয়ে পড়ি। তবে জীবনের সায়াহ্নে এসে এটুকু বাঁধনছাড়া তো হতেই পারি, যাতে এতদিনের জমিয়ে রাখা বাছা-বাছা উক্তিগুলি উগরে দিতে পারি। এসব করতে গেলে অবশ্য ভারতীয় ইতিহাস রচনাকারীদের এতদিনের তৈরি করা রীতিনীতি ভেঙে তছনছ হয়ে যাবে। বুড়ো আর পাগলাটে লেখকেরা কিন্তু সব বিতর্কিত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন না। বরং চলতি প্রথা মেনে অনেক কিছুই চেপে যান। নীরদ সি চৌধুরিকেই দ্যাখো না! তাঁর ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’ কতটা বাস্তবকে তুলে ধরে?

তাহলে গণপতি? আমার পারিবারিক ইতিহাস খানিকটা বুঝলে তো? আমার ক্ষেত্রজ সন্তানেরা হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আর গঙ্গা দত্ত রাজত্বের তদারকি করছিলেন। তবে তিনি কতটা নিরাপদে ছিলেন বলতে পারি না। কারণ নতুন গুঁফো, গাড়ি-পাগলা ব্রিটিশ রেসিডেন্ট গঙ্গার রাজত্বের খবরাখবরে খুব খুশি ছিলেন না।

ছবিটা নিজেই কল্পনা করো না! হস্তিনাপুরের অভিভাবক গঙ্গাজি, শুকনো লাঠির মতো চেহারা, গোটা মাথায় টাক আর গোল গোল চশমার পিছনে চমকে যাওয়া প্যাঁচার মতো চোখ দুটো—সব মিলিয়ে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। এঁকে কি রাজত্বের কর্ণধার বলে মেনে নেওয়া যায়? কবেই তো তাঁর রাজতিলক মুছে গেছে, তিনি আবার তাঁর ইংরেজদের কায়দায় বানানো স্যুট-টাইগুলিও দান করে নেংটি ধরেছিলেন। অবশ্য রাজ্যের কিছু বড় অনুষ্ঠানে তাঁকে এখনও স্যুট পরে দেখা যায়। তাঁর পড়ার ঘরে হঠাৎ ঢুকে পড়লে নেংটি পরা অবস্থায় তাঁকে দেখা যেত। বইতে ডুবে গেছেন। মুখ তুলে একটু অপ্রতিভ হাসি হেসে বলতেন যে তিনি একটু প্রাচীন ন্যায়-নীতির চর্চা করছেন। কিন্তু এতে অনেকেরই বেশ তালগোল পাকিয়ে যেত।

ব্রিটিশ রেসিডেন্টের বাড়িটা ছিল রাজপ্রাসাদের উলটোদিকের পাহাড়ের ওপর। সেখানে প্রায় রোজই গঙ্গার এই সমস্ত বিচিত্র আচরণের কথা আতঙ্কের সৃষ্টি করত। গঙ্গার জীবনদর্শন নিয়ে অভিমতগুলি যথেষ্ট নাশকতামূলক বলেও ভাবা হত।

‘ভদ্রলোক সম্ভোগ সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছেন, এ কথা আমরা আগেই জেনেছি।’ নতুন রেসিডেন্ট তাঁর পার্ষদকে এক সন্ধ্যায় বললেন।

আমার একজন টিকটিকি আড়ি পাতছিল। ‘আমাদের নাম দেওয়া হয়েছিল দেশদ্রোহী ভবঘুরে ফকির। অন্তত গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল চার্চিল আর তার সরকার এই নামেই আমাদের ডাকত। আমার সব চেলারা ছাই মেখে ঘুরতে পছন্দ করত না। কিন্তু ভিক্ষে করার অছিলায় আমরা যত খবর জোগাড় করতাম, তা পরবর্তী যুগে স্বাধীন ভারতের মন্ত্রী হয়ে পারিনি।

‘সমস্যা হল এই যে ওই লোকটা এখন সাধারণ মানুষকে ভড়কে দিচ্ছে ন্যায়-নীতি আর সাম্যবাদ-এর কথা বলে। বড্ড বাড়াবাড়ি করছে ও। শোনা যায় যে নিজের কলঘর সে নিজেই পরিষ্কার করে। ভিস্তিকে ঢুকতে দেয় না।’

‘স্যার রিচার্ড, ওদের জমাদার বলে, ভিস্তি হল জল বয়ে আনার লোকগুলোর নাম।’

‘তাই নাকি? আমি ভাবতাম ওদের নাম লোটা।’

‘স্যার আপনি সে ছোট পাত্রগুলিতে জল ভরে আনেন, মাফ করবেন, ওরা আনে, সেগুলোকে লোটা বলে।’

‘মাই গড! তাহলে ভিস্তি নিশ্চয়ই মাথায় করে যেগুলো নিয়ে যায় সেগুলিকে বলে? কী শক্ত ভাষা এই হিন্দুস্থানি! প্রত্যেকটা কথার মানে আলাদা।’

‘হ্যাঁ স্যার…ইয়ে মানে না স্যার।’ পার্ষদটি কিছুতেই তাঁর অফিসারকে নিজের কথা না বোঝাতে পেরে বেশ মনমরা হয়ে পড়েছে। সে বলতে চেয়েছিল যে ভিস্তি হল মানুষ আর লোটা হল পাত্র।

‘স্যার, আমি বলছিলাম যে…’

‘এ ভাষার পুংলিঙ্গ-স্ত্রী লিঙ্গের ব্যাপারটাও আমার মাথায় ঢোকে না। টেবিল নাকি স্ত্রীলিঙ্গ আর খাট নাকি পুংলিঙ্গ। কেন রে বাবা?’

‘স্যার শব্দের শেষের ভাগটা লক্ষ করলেই বুঝতে পারবেন…’

‘আরে থামো থামো!’ স্যার রিচার্ড পার্ষদকে চুপ করিয়ে দিলেন।’ একটি বয়স্ক বেয়ারা খালি পায়ে, ট্রে হাতে করে ঘরে ঢুকল।

‘ও! সময় হয়ে এল?’

দিনের শেষে এবার স্নায়ুকে শিথিল করার সময় হয়ে গিয়েছিল। সূর্য ঢলে পড়েছিল আকাশের কোলে। তার লাল আভা ছেটানো চারিদিকে। আকাশটাকে মনে হচ্ছে কমলা রঙের জাফরান ছড়ানো সমুদ্র। আঁধার ঘনিয়ে এল আর চারিদিক থেকে নানান রকম পোকামাকড় বনবন, কিচকিচ আওয়াজ করতে করতে ধেয়ে এল সাদা চামড়ায় কামড় বসাতে।

এসময়ে সাহেবরা ডুব দিত মদের গেলাসে। গোধূলি ভারতবর্ষে খুব সংক্ষিপ্ত। সন্ধের মুখের এই বিষণ্ণ সুন্দর সময়টা এলেই সুরাপানের সরাইগুলি আপনা থেকেই খুলে যেত। আঁধার পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুরার নেশা তুঙ্গে ওঠে। চারিদিকের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে মদ-জিনের ঝাঁঝালো গন্ধে। ব্রিটিশ হান্টাররা কতরকমের মদ এদেশে আমদানি করেছিল, নিজেদের একাকিত্বের চিকিৎসা করতে। হাসনুহানার গন্ধ মিশত কাচের গেলাসে বরফ-এর টুকরোর রিনরিন শব্দের সঙ্গে। আমোদে বাধ সাধত শুধু মশার কামড় আর তার পরবর্তী চুলকুনি। ঠাস ঠাস করে মশা মেরেও শেষ করতে পারত না ফরসা সাহেবরা।

‘বেয়ারা! হুইস্কি লাও। ছোট হুইস্কি, বড় জল। হিসলপ, তুমি কি খাবে?’

‘আমিও ফিকে হুইস্কি খাব, স্যার।’

‘তাহলে দুটো হুইস্কি আনো। আর বড় একটা জগে জল আনো। ছোট লোটায় করে নয়। বড় ভিস্তিতে করে নিয়ে এসো।’ নিজের রসিকতায় বেশ সন্তুষ্ট হয়ে হেসে উঠলেন স্যার রিচার্ড।

বেয়ারাটি খানিক আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থেকে, সেলাম ঠুকতে ঠুকতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

‘বলছি যে স্যার…’

‘আরে বাবা, ঘাবড়িও না! এই নেটিভ ভাষাগুলো নিয়ে চর্চা করে লাভ নেই। আমি তো আর কবিতা লিখতে যাচ্ছি না। কয়েকটা শব্দ আর ইংরেজি গালগিলাজ জানলেই কাজ চলে যাবে।’ খানিকটা গলা নিচু করে এগিয়ে স্যার রিচার্ড বললেন, ‘জাহাজে আসতে আসতে কয়েকটা মজার জিনিস শিখেছি, যেমন, দেয়ার ওয়াজ আ ব্যান্ড ক্রো অথবা দেয়ার ওয়াজ আ কোল্ডডে…একটু টেরিয়ে বললেই দেখবে উর্দুর মতো শোনাবে। কিন্তু কোনটাতে যে দরজা বন্ধ করে আর কোনটায় খোলে, এটা মনে রাখাই কঠিন।’

পার্ষদটি মুখ খুলতে যেতেই স্যার রিচার্ড থামিয়ে দিলেন, ‘যাক গে, আমরা তো এখানে ভাষার ক্লাস নিচ্ছি না। আমরা আলোচনা করছিলাম হস্তিনাপুরের পাগলাটে গঙ্গাকে নিয়ে। ওকে তোমার কেমন লাগে?’

‘স্যার এখানকার লোক গঙ্গাজিকে বেশ ভক্তি শ্রদ্ধা করে।’

‘তা তো করবেই। সাম্যবাদ নিয়ে যতরাজ্যের কচকচি করছে। কলঘর পরিষ্কার করছে আর বলছে জাতপাত বলে কিছু হয় না। আরে ভারতীয় সমাজের গোড়ার কথাই হল জাতভেদ প্রথা। হঠাৎ এক রাজ্যের রাজপরিবারের সদস্য বলতে শুরু করেছেন, কেউ নাকি সমাজে অছ্যুৎ নেই। এই মহান কাজটি তিনি করবেন কী করে?’

‘গঙ্গাজি বিশ্বাস করেন নৈতিকতার জয় হবেই। তিনি নিজের কলঘর নিজে পরিষ্কার করে বোঝাতে চান যে-কোনও কাজই ছোট নয়।’

স্যার রিচার্ড কানে একটা চাপড় মেরে মশা তাড়ালেন, নাকি হিসলপকে বোঝাতে চাইলেন যে তিনি গঙ্গার হয়ে সালিশি শুনতে চান না। হিসলপ এবার একটু সাবধানে বললেন, ‘গঙ্গা মনে করেন, গরিব-দুঃখী মানুষের স্তরে গিয়ে তাঁদের মধ্যে কাজ করলে তিনি সমাজের অন্যদের মধ্যে একটা জাগরণ আনতে পারবেন। হস্তিনাপুরে কেউ অছ্যুৎ নেই। কিন্তু আজও মুচি-মেথররা মন্দিরে ঢুকতে পারে না। তাই গঙ্গা এই সব ‘হরিজনদের’ নিয়ে নিজের ঘরে খেতে বসেন। সবাই এসব নিয়ে আলোচনা তো করবেই।’

‘সবাই এতে খুশি হয়?’

‘সমাজের এক ভাগ গঙ্গাকে পুজো করে আর অন্য ভাগ তাঁর ওপর যারপরনাই অখুশি। অবশ্যই এরা সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষ।’

‘রাজপ্রাসাদে একে লোকে কী ভাবে মেনে নেয় বলো তো! এই সব কলঘর পরিষ্কার করা নিয়ে পাগলামি?’

‘ঠিকই ধরেছেন স্যার। অন্দরমহলের মহিলাদের নিজেদের কলঘর পরিষ্কার করতে বলায়, তারা তো কেঁদেই আকুল। গঙ্গাকে জেনানা মহলে আর ঢুকতে দেয় না। রাজপ্রাসাদের অন্যান্য ঘরে এই সব মুচি-মেথরদের খেতে বসা বারণ বলে গঙ্গা নিজের ঘরে এদের আসন পেতেছেন। যে পরিচারক খাবার বেড়ে দেয়, তার ওপরে নাকি হুকুম আছে এইসব পাতাগুলি নষ্ট করে দেওয়ার। যাতে কেউ ভুল করেও এই সব থালাবাটিতে খেয়ে না ফেলে।’

‘হুমম, আর ইংরেজদের যে প্লেটে খাওয়ানো হয় সেগুলোর কী হয়?’

‘সেগুলো কি আর ফেলে দেয়? আমি খোঁজ নিতে পারি স্যার।’

‘না হিসলপ, আমি জিগ্যেস করছি যে এই গঙ্গা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি কতটা অনুগত নাকি সে বিশ্বাসঘাতক?’

‘ঠিক জানি না।’ হিসলপ বেতের চেয়ারে একটু নড়েচড়ে আরাম করে বসলেন। স্যার রিচার্ডের গলা শুকিয়ে গেছে। আরেকটা হুইস্কি আসবে।

‘আগে তো খুবই অনুগত ছিলেন গঙ্গা। সব অনুষ্ঠানেই তাঁকে দেখা যেত। মহাযুদ্ধের সময় আমাদের অ্যাম্বুলেন্স অ্যাসোসিয়েশনের জন্য অনেক চাঁদা তুলে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ইদানীং তিনি কী সব স্বরাজ আর স্বদেশি নিয়ে কথা বলছেন। কেউ জানে না, কেন তিনি বদলে গেলেন। কেউ কেউ বলে তিনি নাকি খুব পড়াশোনা করেন।’

‘হিসলপ! তোমায় এই বলে রাখছি, বই একদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ধ্বংসের কারণ হবে। কলোনিগুলোতে বই পাঠিয়ে ইংরেজ প্রকাশকরা কী ভুল করছে, তা নিজেরাও জানে না।’

হিসলপ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। রেসিডেন্ট সাহেব হাত বাড়িয়ে গেলাসটা নিতে গিয়ে দেখলেন যে সেটা খালি।

‘বয়!’

কোনও উত্তর না পেয়ে স্যার রিচার্ডের ভ্রুতে ভাঁজ পড়ল, ‘এই যে লোকটা গঙ্গাদিন না কী যেন ওর নাম? সে কি আমাদের জন্যে সমস্যা সৃষ্টি করছে? তাহলে একে তো ছাড় দিয়ে রাখা যায় না। দেখি কী করতে পারি।’

‘ওঁর আচরণ নিয়ে আমার খুব একটা কিছু বলার নেই। সিংহাসনে তো ওনারই বসার কথা। আপনার পূর্বসুরি ওঁকে খুব পছন্দ করতেন। আক্ষেপ করতেন যে গঙ্গা দত্ত মসনদে বসতে পারল না তার বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর। অবশ্য গঙ্গা নিজেই এটা চেয়েছিলেন।’

‘আমি এ ব্যাপারে ফাইলের রিপোর্টগুলো পড়েছি। কিন্তু আমাদের হুইস্কির কী হল? বয়!’

বুড়ো বেয়ারাটি হাঁপাতে হাঁপাতে ধুলোবালি মেখে ঘরে এসে ঢুকল, ‘এসে গেছি সাহেব।’

‘হুইস্কি কই?’

‘আমি ভিস্তি নিয়ে এসেছি। অনেক খুঁজে ব্যাটাকে পেয়েছি। নিয়ে আসি?’

‘হ্যাঁ জল তো আনবেই!’ স্যার রিচার্ডের পার্ষদটি ততক্ষণে হাসি চাপতে গিয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজ বের করছিল গলা থেকে।

বেয়ারাটি তালি দিতেই একটি ময়লা পোশাক পরা লোক একটা জল বইবার রবারের ব্যাগ নিয়ে সারা বারান্দায় জল ফেলতে ফেলতে ঢুকল।

ম্যাজিশিয়ান যেমন টুপি থেকে খরগোশ বার করে, তেমনই একটা গর্বিত ভাব নিয়ে বেয়ারাটি বলল, ‘সাহেব, ভিস্তি।’

‘মানেটা কী? হতভাগা কোথাকার!’ হিসলপ পেটে হাত দিয়ে হাসতে লাগল।

আবার আসি আমার ছেলেদের গল্পে, গণপতি। এ তো তাদেরই কাহিনি। ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু আর বিদুরকে ঘিরে হস্তিনাপুরের একটা নবজাগরণ ঘটল। ফুলে, ফলে, ফসলে ভরে গেল চারিদিক। গমে যেন জুঁই ফুলের গন্ধ। মহিলাদের কলহাস্যে খেত খামার পূর্ণ হল।

সে যেন এক সোনায় মোড়া সময়, কোনও খরা হল না, কোনও বন্যা হল না। বৃষ্টি ঠিক সময়ে হত, ঠিক যখন চাষিরা বীজ বুনে দিয়ে প্রার্থনা করত তখনই। রোদের তেজে ফল আপনা থেকেই পাকত আর বাতাসে এমন জাদু ছিল যে ধীরে ধীরে পাপড়ি খুলে ফুলগুলি হেসে উঠত।

এমনকী খুশিতে কিচমিচিয়ে পাখিরা যখন তাদের বাসা বানাত তখন বিষ্ঠাটা কিন্তু ইংরেজ মহিলা ছাড়া কারুর ওপর ফেলত না। গরুর দুধে বালতি উপচে পড়ত। হস্তিনাপুরে অগুনতি ব্যবসায়ী, দোকানদার, কুলি, সাধু-সন্ন্যাসী আর ফেরিওয়ালার বাস ছিল। গণপতি, সেদিনের কথা বলতে গিয়ে জানো, আমার পদ্য লিখতে ইচ্ছে করছে।

সেই শিশুদের আগমনে

হস্তিনাপুরের দেহ মনে

 বইল খুশির বন্যা

জয় পতাকা উড্ডীন

 অভিনব সুদিন

 সৌভাগ্য অনন্যা…

গণপতি চুপ করে আছে।

সে তুমি যাই বলো না কেন গণপতি, আমার কবিতা এমন কিছু খারাপ হয়নি।

ফসল অফুরান

খেয়ে পরে বাঁচে প্রাণ

দুঃখে নেই কেউ

বৃষ্টি এল যেই

মলিন আর নেই

পাকা ফসলের ঢেউ

চাষি আর পাখি

স্বস্তিতে বোজে আঁখি

সুখের নেইকো বাকি।…

গণপতি চেষ্টা করে দ্যাখো এর চেয়ে ভালো পারো কিনা। না, না, চেষ্টা কোরো না। পারতেও পারো। সেটা মোটেই ভালো হবে না কারণ এটা আমার স্মৃতিচারণা হওয়ার কথা।

নাহি তিলধারণের ঠাঁই

ভয় বলেছে যাই

ঐশ্বর্যের বাহার

যদিও ব্রিটিশ রাজ

ধরে আছে তাজ

ভারতের জয়জয়কার

সবাই করে কাজ

কী সুদিন যে আজ

খাদ্যের সুগন্ধে ভরে দিক

শিশুদের আবির্ভাব

নিয়ে গেল অভাব

সুকর্মের ফল সার্বিক…

গঙ্গাজি আমাদের ছেলেদের, নিজের ছেলের মতো করে মানুষ করেছিলেন। নিজে সন্ন্যাসীর কৃচ্ছসাধন করলেও ছেলেগুলিকে দিয়েছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষা এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। প্রতিটি ছেলেই নিজের মতো করে এক-একটি রত্ন হয়ে উঠল।

ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত সুপুরুষ ছিল। একহারা গড়ন, চোখা নাক এবং রাজসিক চেহারা। অন্ধত্ব অবশ্য তার অন্তরায় ছিল কিন্তু অত্যন্ত ছোট বয়স থেকে সে ব্যাপারটাকে নিজের আয়ত্তে রাখতে শিখে গিয়েছিল। ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় সে স্বচ্ছন্দ বোধ করেনি বলেই তাকে বিলেতের পাবলিক স্কুল ইটনে ভর্তি করে দেওয়া হয়। তাকে শ্রেষ্ঠ দার্জিলিং চা সরবরাহ করা হত ফর্টনাম আর মেসন থেকে। সেই চা বানানো হত রুপোর সরঞ্জামে যাতে হস্তিনাপুরের ছাপ দেওয়া থাকত।

খুব শিগগির ধৃতরাষ্ট্র দু-ডজন স্যুট আর সপ্তাহের প্রতিদিনের জন্য আলাদা আলাদা জুতো কিনে ফেলল। তার সঙ্গে মুখস্ত করে ফেলল শক্ত শক্ত ইংরেজি শব্দ। উচ্চশিক্ষিত হওয়ার এক ভঙ্গি আয়ত্ত করল। এইসব বলে বলীয়ান হয়ে ধৃতরাষ্ট্র ভরতি হল কিংস কলেজ, কলেজ কেমব্রিজ-এ।

অন্যান্য শ্বেতাঙ্গদের মতো নাচগান-পার্টি-মচ্ছব বা জুয়া খেলায় মেতে যেতে না পেরে সে বিতর্ক এবং পড়াশোনায় মন দিল। এর পাশাপাশি সে আবার ফেবিয়ান সোস্যালিস্ট মতাবলম্বীদের সঙ্গে মিশে কিছুটা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করল। মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি সে আমাদের মতো চারিদিকটা দেখতে পেত তাহলে বোধহয় ভারতের ইতিহাসটা অন্যরকম হত।

বিবর্ণ পাণ্ডুর মা আমায় দেখে ভয়ে সাদা হয়ে গেছিল। তবুও তার ছেলে ছোট ভাইয়ের কিন্তু মানসিক শক্তি এবং সাহসের অভাব ছিল না। তার গোল গোল চশমায় তাকে বাঙালি স্কুলমাস্টার বা জাপানি নৌসেনার অধ্যক্ষ বলে মনে হত। পাণ্ডুর বিচারবুদ্ধির কিছু অভাব ছিল। কেউ কেউ অবশ্য বলে যে ভাগ্যদেবী তার প্রতি সদয় ছিলেন না। তাকেও ধৃতরাষ্ট্রের মতো ইংরেজি উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হত, কিন্তু সে তো ভারতীয় ন্যূনতম শিক্ষাটাও শেষ করে উঠতে পারল না।

অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে সে বলেছিল যে বিলিতি শিক্ষায় তার বিশ্বাস নেই। বোধহয় খুব একটা ভেবে বলেনি। তার কিছুদিন পর ভারতের সবথেকে নামকরা কলেজগুলোর একটা থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। কোনও এক সাহেব টিচার ভারতীয়দের ‘কুত্তা’ বলায় সে আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। অবশ্যই আমাদের সারমেয়দের কিছু গুণ ছিল বইকি। যেমন সাদা চামড়া দেখে ল্যাজ নাড়ানো। কিন্তু পাণ্ডু তার প্রফেসর কিপলিংকে কুকুরের আরেক বিরাট অস্ত্র তাঁর দাঁতটা দেখিয়ে দিয়েছিল। আগামী জীবনেও তার আচরণের পরিবর্তন দেখা গেল না।

শেষে বলি বিদুর ধর্মপুত্রের কথা। আমার এই সন্তান কিন্তু পাণ্ডিত্যে এবং রাজকৌশলে তার বড় দুই সৎভাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু সে জানত, সিংহাসনে তার কোনও উত্তরাধিকার নেই, তাই শুরু থেকেই তার মনোভাব ছিল খুবই লক্ষণীয়। এবং এতে কর্মজীবনে আমলা হিসেবে তার উন্নতিই ঘটেছিল। সে সারাজীবন প্রতিটি পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস-এ ঢোকার জন্য দরখাস্ত দাখিল করল।

রানি-ভিক্টোরিয়া সিপাই বিদ্রোহের পরেই ‘নেটিভদের জন্য আইসিএস-এর দরজা খুলে দিয়েছিলেন। ইংরেজ শাসকরা এতটা আশা করেছিল কিনা জানা নেই। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি আইসিএস হলেন। সুরেন ব্যানার্জি অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই নানা অভিযোগের শিকার হয়ে চাকরি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। বিদুর যতদিনে আইসিএস পরীক্ষায় বসে, ততদিনে বেশ কিছু ভারতীয় আইসিএস সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। লিখিত পরীক্ষায়, যেখানে পরীক্ষার্থীর নাম খাতায় লেখা থাকে না, বিদুর সর্বপ্রথম স্থান অধিকার করল।

কিন্তু মৌখিক পরীক্ষায় তার পরিচয় গোপন রইল না। ফল যখন বেরোল, দেখা গেল যে সে শ্রেষ্ঠ দপ্তরগুলো না পেয়ে স্টেটস ডিপার্টমেন্ট পেল যেটা রাজপরিবার দ্বারা পরিচালিত রাজ্যগুলির দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল। হস্তিনাপুর এরই মধ্যে একটি রাজ্য।

তাহলে গণপতি, এটা তো মানবে যে আমার বীজ খুব খারাপ নয়! লোকে যে যাই বলুক। আমায় রুমালটা দাও। আমার চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে।

১০

গল্পে ফিরি। আমরা কোথায় ছিলাম গণপতি? ও, হ্যাঁ। আমার ছেলেরা যখন বিবাহযোগ্য হল, গঙ্গাজি তাদের পড়ার ঘরে ডেকে পাঠালেন।

‘তোমরাই হস্তিনাপুরের ভবিষ্যৎ।’ তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের আমি এমনভাবে মানুষ করেছি যাতে তোমরা রাজ্যের দায়িত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে রাজপরিবারের গৌরব বৃদ্ধি করো। যতদিন না তোমরা সিংহাসনের ভার নিজেদের হাতে নিচ্ছ এবং নিজেদের যোগ্য উত্তরাধিকারী করে তুলছ, আমি আশ্রমে গিয়ে সন্ন্যাস জীবন পালন করতে পারব না। আমি ইতিমধ্যেই খোঁজ খবর নিয়ে তিনটি কন্যাকে পছন্দ করেছি তোমাদের বিয়ের জন্যে। তাদের সম্ভ্রান্ত পরিবার এবং সৌন্দর্য দুই-ই আশা করি তোমাদের মনোমতো হবে। তোমাদের কিছু বলার আছে?’

বিদুর প্রথম কথা বলল। সে সর্বদাই ঠিক কথাটা ঠিক সময়ে বলত।

‘আপনি আমাদের বাবা-মা দুই-ই। আমরা আপনার আজ্ঞার সর্বদা পালন করেছি। শাস্ত্রে শিখেছি যে গুরুর আজ্ঞা পালন করা আমাদের কর্তব্য। এবারেও তার নড়চড় হবে না। এই তিন কন্যাকে বিয়ে করে আমরা ধন্য হব।’

পাণ্ডু বিদুর-এর দিকে একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ধৃতরাষ্ট্রও বোধহয় মনে মনে তাই করল। কিন্তু ততক্ষণে বিদুরের কথার ওপর ভিত্তি করে খুশিতে ডগমগ গঙ্গাজি অনেক কিছু বলে চলেছেন।

‘ধৃতরাষ্ট্র। তোমার জন্য এলাহাবাদের অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের একটি মেয়ে গান্ধারীকে আমি পছন্দ করেছি। তার কালো ডাগর দুটো চোখ নাকি দেখার মতো। তার চেয়েও বড় কথা হল এই যে এই মেয়েটির মায়ের নয়টি সন্তান হয় এবং দিদিমার সতেরোটি। গান্ধারীকে মহাদেব বর দিয়েছিলেন যে সে নাকি একশো সন্তানের মা হবে।’ ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যে অতটা উৎসাহ না দেখে গঙ্গাজি ক্ষুণ্ণ হলেন, ‘ব্রিটিশের থেকে অত্যন্ত সাবধানে থাকতে হবে। হস্তিনাপুরের ওপর ওদের চোখ আছে বহুদিন ধরে।’

‘আপনি যা বলবেন, ভীষ্মজি।’ ধৃতরাষ্ট্র বললেন। ইচ্ছে করেই গঙ্গাজির এই নামটি ব্যবহার করলেন তিনি। আবার মনে করিয়ে দিলেন সেই ভীষণ প্রতিজ্ঞার কথা। বৃদ্ধ তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের অদ্ভুত ঠান্ডা চোখদুটির ওপর।

‘পাণ্ডু তোমার জন্য কুন্তি যাদবকে আমি পছন্দ করেছি।’ গঙ্গা খুশি হলেন পাণ্ডুর অভিব্যক্তি দেখে। কুন্তির কথা শুনেই পাণ্ডু একটা জোরে শ্বাস নিয়েছিলেন। তার সৌন্দর্যের কথা কে না জানে! কুন্তি ছিল দত্তক নেওয়া রাজকন্যা। কিন্তু তাও তার সঙ্গে সম্পর্ক পাতাতে অনেকেই চাইত। তবে কুন্তি নামের সঙ্গে জুড়ে আছে একটা পুরোনো কেলেঙ্কারির আভাস।

‘হ্যাঁ, মানে আমি খুশি, কিন্তু…’

‘কোনও কথা নয়।’ নেংটি পরা সাধু প্রকৃতির গঙ্গাজি পাণ্ডুকে থামিয়ে দিলেন, ‘অমন অপরূপ সৌন্দর্য থাকা সত্বেও কুন্তির জন্য কোনও বিয়ের প্রস্তাব আসেনি। হয়তো তার কুমারী জীবনের একটি পদস্খলন…’

পাণ্ডুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে গঙ্গাজির প্রতিটি কথা উৎকর্ণ হয়ে শুনছিল। ‘যা শোনা যায় সেটা হল, কুন্তি প্রণয়জালে জড়িয়ে পড়েছিল নিজের অজান্তেই। হাইপেরিয়ন হেলিওস বলে একাটি বিদেশি পর্যটক তাঁদের রাজ্যে অতিথি হিসেবে কিছুদিন ছিলেন। তার চোখ ধাঁধানো রূপ এবং অত্যন্ত পরিশীলিত আচরণ অপরিণত কুন্তিকে তার দিকে দুর্নিবার টানে টেনে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক কতটা গভীর হয়েছিল, ঠিক জানা যায় না। তবে এটা জানা যায়, হেলিওসকে রাজপ্রাসাদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

কুন্তিও এরপর বেশ কয়েক মাসের জন্য স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যায়। লোকে অনেক কথা বলে যাচ্ছে কুন্তির সুনাম নষ্ট করে। আমি সব দিক খতিয়ে দেখে এই মনে করি, কুন্তির খুব দোষ নেই। আমরা আমাদের অপরিণত বয়সের ভুলগুলির জন্য সারাজীবন যদি শাস্তি পেতে থাকি তাহলে পৃথিবীটা খুব সুখের জায়গা হবে কি? পরবর্তী যুগে কিন্তু তার সম্পর্কে কোনও গুজব শোনা যায়নি। তবু মনে হয় বিয়ের বাজারে তাকে কেউ এখনও ক্ষমা করেনি। আমরা হস্তিনাপুরবাসীরা কিন্তু অনেক শিক্ষিত। পাণ্ডু, তুমি কুন্তিকে গ্রহণ করবে না?’

‘আপনার যদি তাকে আমাদের পরিবারে নিয়ে আসতে অসুবিধা না থাকে, আমারও নেই।’ পাণ্ডু কাঠ-কাঠ উত্তর দিল।

‘তাহলে ওই কথাই রইল।’ গঙ্গাজি বললেন।

‘অবশ্য আমি তোমার ওপর আমার ইচ্ছেগুলো চাপিয়ে দিতে চাই না, যাতে কেউ না তোমার গায়ে এইরকম মেয়েকে বিয়ে করার জন্য কাদা ছেটাতে পারে। আমি ঠিক করেছি যে তোমার সঙ্গে আরও একটি মেয়ের বিয়ে দেব। তার কুন্তির মতো রূপ না থাকুক, সুনামের অভাব নেই।’ পাণ্ডুর উদগ্রীব মুখটার দিকে তাকিয়ে মজা পেলেন গঙ্গাজি। ‘ব্রিটিশরা আমাদের সতীদাহ প্রথা বন্ধ করেছে ঠিকই কিন্তু কে ক’টা বিয়ে করবে বা কত পণ দিয়ে এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তোমার দ্বিতীয় স্ত্রী হবে মাদ্রী। শল্য মহারাজের বোন। শল্য রাজপরিবারের একটা স্বতন্ত্র নিয়ম আছে। সেখানে কন্যাপক্ষ পণ নিয়ে থাকে, আর তাদের মেয়েরা একটু একরোখা হয়। কিন্তু তুমি এদুটো ব্যাপারকে অগ্রাহ্য করলে, আমিও এগোতে পারি।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।’ পাণ্ডু উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠল।

‘ভালো হল। আমি শল্য গিয়ে ব্যাপারটা পাকা করে আসি।’ তারপর কনিষ্ঠতম বিদুরের দিকে ফিরলেন তিনি। বিদুর মাত্র কয়েকদিনের ছোট ছিল অন্য ভাইদের থেকে। কিন্তু রাজপরিবারের প্রতিটি মিনিট-এর হিসেব রাখা হয়।

আমি কোনও রাজার যমজ সন্তান হতে দেখিনি। কিন্তু যদি হত তাহলে দ্বিতীয় শিশুটিকে সর্বদাই তার দেরিতে পৃথিবীতে আসার কথা মনে করিয়ে দেওয়া হত। বিদুর অবশ্য রাজকন্যা পাওয়ার যোগ্য ছিল না। ততদিনে অম্বিকার চালাকি আর আমার কামোন্মাদনার খবর কারও অজানা ছিল না।

‘বিদুর! মহারাজ দেবকের এক নিচু জাতের স্ত্রী আছেন যার সুন্দরী মেয়ে দেবকীর কথা আমি তোমার জন্য ভেবেছি। মেয়েটি লরেটো কনভেন্ট-এ পড়েছে এবং ঝরঝরে ইংরেজি বলে। তোমার অপছন্দ হওয়ার কথা নয়। যদি ওই নীচু জাতের ব্যাপারটা তুমি অগ্রাহ্য করতে পারো।’

‘আমি রাজি।’ বাধ্যছেলের মতো বিদুর বলল।

গঙ্গা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।

‘তাহলে ওই কথাই রইল। বিয়েগুলো ঠিকঠাক হয়ে গেলে আমি ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডুর হাতে হস্তিনাপুরের ভার তুলে দেব। বিদুর স্টেটস ডিপার্টমেন্ট থেকে তো হস্তিনাপুরের ওপরে চোখ রাখবেই। আমি তারপর জীবনের বৃহত্তর ব্যাপারগুলির জন্য নিজেকে সঁপে দেব।

‘পিতঃ! আপনি কী করবেন?’

‘অনেক কিছু। আমি সত্যের সন্ধান করব তা সে রাজনৈতিক এবং সামাজিকই হোক বা সম্ভোগ সংক্রান্তই হোক। আমি নিজেকে নিখুঁত করে তুলতে চাই। আমি বহু বছর আগেই অন্য পথে হাঁটতে শুরু করেছি বাবা, আমি মুক্তি চাই।’

১১

গণপতি, গল্পটা সত্যিই বড়, একেবারে মহাকাব্য যাকে বলে। গঙ্গার কথাই ধরা যাক। সত্যের পূজারি এই মানুষটা চাইত সবাই তাকে মান্য করবে। কিন্তু আবার আইন অমান্য করতে ইনিই ডাক দিলেন যাতে ব্রিটিশদের উৎখাত করা যায়। আমি কি এখানে অহিংসার অদ্ভুত ক্ষমতার জয়গান করব? স্লোগান দিতে দিতে কত স্বদেশি আন্দোলন করা মেয়েপুরুষ হাসিমুখে নিরস্ত্র অবস্থায় ব্রিটিশদের উদ্যত লাঠির মুখে পড়েছে, হাজারে হাজারে মানুষ হাসিমুখে কারাবরণ করেছে হাতকড়া পরে। গণপতি, আমি তোমায় অহিংসার আর শান্তির কী করে জয় হল, সে গল্প শোনাব। খালি পায়ে মানুষ দেখিয়ে দিল, কাঁটাওয়ালা যুগের চেয়ে তাদের জোর বেশি। আইন ভেঙে পড়ল সত্যাগ্রহী মানুষের ভীষণ প্রতিজ্ঞার সামনে।

গণপতি, তুমি কিছু বলছ না যে? তুমি কি শুধু ভ্রু কুঁচকে মনোযোগ সঞ্চয় করবে নাকি? তোমার লম্বা নাকটা যেন আমার মনের অলিগলি সন্ধান করছে! তুমি আমাকে আমার ভাবনা কেন নিজেই ভাবতে দিচ্ছ? তবে বোধহয় সেটাই ঠিক। এটা তো আমার বেদব্যাস-এর গল্প। আবার এটা ভারতবর্ষের নিজস্ব গল্প, তোমার-আমার দেশের গল্প। বোসো গণপতি, আমি বলে যাই।…যতই বয়স হোক না কেন।

গঙ্গাজি কী অদ্ভুত জীবন কাটিয়ে গেলেন! কিন্তু তার প্রতিটি ক্ষণের খবর আমাদের জন্য নথিবদ্ধ করে গেছেন। তাঁর ভয়, স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা সব কিছুর হদিশ তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন তাঁর নিজের লেখা জীবনীতে। অগুনতি চিঠি তিনি লিখেছিলেন তাঁর জীবদ্দশায়। কী করে সময় পেতেন অত লিখতে? কখনও শিষ্য, কখনও আমলা, অফিসার, কেউ বাদ যায়নি।

যখন মৌনব্রত নিতেন, তখন পেনসিলে উত্তর লিখে দিতেন কোনও রিপোর্টার বা লেখক প্রশ্ন করলে। কিছুই তিনি অজানা রাখেননি আমাদের কাছ থেকে। সেই শুরুর বছরগুলো, যেগুলো নিয়ে ব্রিটিশরা তাঁকে সন্দেহ করত, সেই থেকে শুরু করে শেষ অবধি যখন তিনি তাঁর নিজের সংযম-এর ওপর নানান পরীক্ষা চালাবার জন্য নগ্ন নারীদের পাশে রাতের পর রাত কাটাতেন, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রেখে গেছেন সবার জন্য। আমরা কতটুকুই বা তাঁর এইসব কথার মূল্য বুঝি!

গণপতি, তাঁর জন্মশতবর্ষে গোটা দেশ তাঁর পুজো করেছিল। কত বক্তৃতা, কত এগজিবিশন আর আলোচনা সভা হয়েছিল গঙ্গার জীবনদর্শনকে বোঝার আর বোঝাবার জন্য। লোকে বলেছিল তাঁর নিরামিষ হওয়ার পেছনের দর্শনের কথা। আমি অবশ্য জানি যে তিনি মৃত জীবজন্তু খেতেন না বলেই নিরামিষাশী ছিলেন। তাঁর অনেক ব্যাপারে অনেক মানুষ বক্তব্য রেখেছিলেন। অথচ সেসব সম্বন্ধে গঙ্গার খুব একটা জ্ঞান ছিল না। যেমন ধরো, সৌররশ্মি বা বিদেশ-সম্পর্ক। গঙ্গা ভাবতেন, বিদেশে বিয়ে করলে তবে এ ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়। তাঁর মরচে পড়া চরকাগুলোকে টেনে বের করে ছোট ছোট খাদির কাপড় বোনা হয়েছিল। তাঁর সময়ে চরকাটা ছিল প্রয়োজনের জিনিস। কে কাকে বোঝাবে সেটা? আজ সেটা প্রতীকী হয়েছে। যদি স্বামীহীন অম্বা তাঁর প্রতিহিংসার আগুন না জ্বালিয়ে দিতেন তাহলে হয়তো গঙ্গা নিজের একশো বছরের জন্মদিন দেখেই যেতেন।

ভারতীয়রা তাঁদের জীবনের দায়ভার বয়ে চলার দায়িত্ব যুবকদের ওপরে দিয়ে যান। গণপতি, তুমি যেমন আমারটা করছ। তাই গঙ্গার একশো বছরের জন্মদিন পালন করতে স্কুল-কলেজগুলিকে বলা হয়েছিল। তারা বক্তৃতা আর সেমিনারের পাশাপাশি মিছিল বার করল, প্যারেড করল। ছোট ছোট ফুটফুটে বাচ্চারা লিখল, কী করে গঙ্গাজি তাদের জন্য স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন।

তা এই সব রচনা থেকে কী প্রমাণ হল? দেখা গেল যে তাঁর মতো মহান নেতার সম্পর্কে বাচ্চারা কিছুই শেখেনি, যতই পাঠ্যবইয়ে তাঁর সম্পর্কে পাঠ ঢোকানো হোক না কেন।

‘গঙ্গাজি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বাবা ছিলেন। সেটাই তাঁর সবথেকে বড় পরিচয়।’ একটা দশ বছরের বাচ্চা লিখেছিল। ‘গঙ্গাজি একজন সাধু ছিলেন, যিনি গোপালন করতেন।’ আরেকটি বাচ্চা লিখেছিল, ‘গঙ্গাজি মহাভারতের একটি চরিত্র। তিনি এতই গরিব ছিলেন যে তাঁর কাপড় জুটত না।’

গণপতি, বাচ্চারা ভুল করতেই পারে। তারা তো একটা ব্রিটিশদের ফেলে রেখে যাওয়া একটা জারজ শিক্ষা ব্যবস্থার শিকার। কিন্তু আসল কথাটা হল, গঙ্গার মৃত্যুর কুড়ি বছরের মধ্যে মানুষ তাঁর সঙ্গে নিজেদের জীবনকে আর মিলিয়ে নিতে পারল না। তার চেয়ে তাকে মহাভারতের কালগর্ভে নিক্ষেপ করাই ভালো।

একটুও অসত্যকে অবলম্বন না করে বলতে পারি, গঙ্গাকে ভুলে যাওয়াই সুবিধের। যে আদর্শের কথা তিনি বলতেন আর যে শিক্ষা তিনি দিতে চেয়েছিলেন, তা দূর থেকে পুজো করা যায়, পালন করা খুব কঠিন। যতদিন ছিলেন, তাঁকে বাদ দেওয়ার কথা ভাবা যেত না। কিন্তু মারা যাওয়ার পরে তাঁর মতো হওয়ার কথা কেউ আর ভাবত না।

তিনি যখন তিনটি তরুণ যুবককে তাঁদের বৈবাহিক জীবনের কথা বলতে ডেকেছিলেন, কোনওরকম দ্বিচারিতা না করে তাদের সত্যের পথে নিয়ে যেতে চাইছিলেন। সত্যই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। সেই মাপকাঠিতেই তিনি সব কিছুর বিচার করতেন। সত্যেই ছিল তাঁর একমাত্র বিশ্বাস। তিনি মনে করতেন সত্যই হল জীবনের একমাত্র নির্মোঘ, সার্বিক। সত্যকে কোনওমতেই অসত্যের, অন্যায়ের বা হিংসার দ্বারা পাওয়া যায় না। তুমি কি বুঝতে পারছ, ধৃতরাষ্ট্র বা পাণ্ডুর পক্ষে গঙ্গার রাস্তায় চলা কতটা কঠিন ছিল?

গঙ্গা কিন্তু কোনওভাবেই বাস্তবকে অস্বীকার করেননি। ইংরেজরা তাঁর দেখানো রাস্তাকে পরোক্ষ লড়াইয়ের আখ্যা দিয়েছে। এটা খুবই দুঃখের। ওরা বুঝতেই পারেনি, সত্যাগ্রহ সম্মুখ সমর ছাড়া করা যায় না। অমোঘ সত্যকে পেতে গেলে রাস্তার বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতেই হবে! গঙ্গা বিশ্বাস করতেন, সব দুঃখ কষ্টকে হাসিমুখে আহ্বান করাটাই হল সাহসিকতার সব থেকে বড় পরিচয়।

গঙ্গা ভারতবর্ষের মহত্বের কথা বিদেশিদের বোঝাতে চেয়েছিলেন। এদেশে দর্শন হল, বিষে বিষক্ষয় করে। সব নেতিবাচক দিকেরই একটা ইতিবাচক পরিণতি আছে। অসহযোগিতা, অহিংসা…এর থেকে বড় শান্তির আর জয়ের পথ আমাদের জানা আছে কি?

‘ভি.ভি.’ একদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা সত্যের কাছাকাছি তখনই যেতে পারব, যখন অপরকে ছেড়ে নিজেরা দুঃখ-কষ্ট বরণ করে নেব।’ সেদিন তাঁর সঙ্গে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়েছিলাম। তিনি চরকা কেটে নিজের পরনের কাপড় তৈরি করছিলেন। আমি তাঁর পাশে মাটিতে বসেছিলাম।

আজ লোকে সেই দিনের কথা ভুলে গেছে। গঙ্গা তখন সবে হস্তিনাপুরের অভিভাবকপদ থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিয়ে নদীর ধারে একটা ছোট বাড়িতে গিয়ে বসবাস শুরু করেছেন। তিনি সেটিকে আশ্রম নাম দিয়েছিলেন। যদিও ব্রিটিশ রেসিডেন্ট সেটিকে কমিউন বা দল পাকাবার জায়গা বলে উল্লেখ করেছে বহুবার। এই আশ্রমে তিনি থাকতে শুরু করলেন হরিজনদের নিয়ে। তিনি রাজপ্রাসাদে যা পারেননি, তাই পারলেন শেষপর্যন্ত। সারাদিন তাঁর কাটত লিখে, বই পড়ে, চরকা কেটে আর সারাদেশের অতিথিদের সঙ্গে গল্প-আলোচনা করে। গঙ্গা এতদিন যেসব সাম্যবাদ আর অহিংসার বাণী দিয়েছিলেন, তা নিজের জীবনের দৈনন্দিন ওঠাবসার মধ্যে দেখিয়ে দিতে পেরেছিলেন এই আশ্রমে। সেটা প্রত্যক্ষ করতেই তো সবাই আসতেন! একদিন দুপুরে, যখন গঙ্গা তার নিরামিষ ভোজন শেষ করে রোজকার মতো খেজুর খাচ্ছিলেন, একটি লোক তাঁর পায়ে এসে পড়ল।

আমরা সবাই বারান্দায় বসে ছিলাম। কী দুর্দান্ত গরম পড়েছিল সেদিন। মাটি থেকে আকাশের দিকে ভাপ উঠছিল। আশ্রমের ছায়াময়তাকে কী শীতল মনে হচ্ছিল সেদিন। হঠাৎ একটি চাষি, তার চটি-জামাকাপড় ধূলিমলিন দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে সে বহুদূর থেকে এসেছে, ঠোট শুকনো হয়ে ফেটে গেছে, গঙ্গার দিকে কোনওমতে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে তার পায়ে পড়ে গেল।

প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম, সে ভক্তিতে গদগদ হয়ে এরকম করছে। ভারতীয়দের এরকম করার অভ্যাস আছে, আমরা জানি। কিন্তু গঙ্গা লোকটিকে কাঁধ ধরে তোলার চেষ্টা করতেই দেখা গেল, লোকটি জ্ঞান হারিয়েছে। তার চোখে-মুখে জলের ছিটে দেওয়ার পর সে চোখ খুলে ফিসফিস করে কিছু বলল। বোঝা গেল, সে একেবারে পরিশ্রান্ত আর প্রায় একশো মাইল হেঁটে এসেছে। তিনদিন পেটে কোনও দানাপানি পড়েনি।

প্রথমেই লোকটিকে কিছু খাওয়ানো হল। একটু সুস্থ হয়ে সে তার কথা বলতে শুরু করল। হস্তিনাপুরের একেবারে শেষ সীমান্তে তার গ্রাম। কিন্তু সেটা ব্রিটিশদের অন্তর্গত একটি অংশে, ঠিক হস্তিনাপুরের বাইরে। সে গঙ্গাজির কাছে প্রার্থনা নিয়ে এসেছিল, তিনি যেন একবার সেখানে যান, চাষিদের দুর্বিষহ জীবন নিজে প্রত্যক্ষ করেন।

‘আমি কেন?’ গঙ্গা বলেন, ‘আমি আর হস্তিনাপুরের রাজকীয় ব্যাপারে জড়িত নেই। তাই আমি রাজপরিবারকে বলে আপনাদের খুব একটা সাহায্য করতে পারব না।’

‘আমরা শুনেছি, আপনি ন্যায়-এর জন্য আজীবন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, আপনার কাছে সব মানুষই এক। আমাদের সাহায্য করুন।’

অনিচ্ছা থাকলেও গঙ্গা চাষিটির অনুরোধ ফেলতে পারলেন না। তার গ্রামে তাঁকে যেতেই হয়েছিল। সেখানে তিনি যা দেখলেন, তা গঙ্গার জীবনে এনে দিল এক আমূল পরিবর্তন।

১২

আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম গণপতি। সেই ট্রেনের থার্ড ক্লাস কমপার্টমেন্ট-এ তিল ধারণের জায়গা ছিল না। কিন্তু গঙ্গা এ ছাড়া অন্য কোনও ক্লাসে সফর করতেন না। ঘামে ভেজা মানুষ তাদের মলিন অথচ অত্যন্ত মূল্যবান পুঁটলিগুলি আঁকড়ে কোনওমতে বসে ছিল। বোঁচা নাক চ্যাপটা বুক আর এফোঁড় ওফোঁড় নাকে নাকছাবি পরা মহিলারাও ছিল তাদের সঙ্গে। লাল শার্ট পরা কুলিদের পেতলের নম্বর প্লেটগুলো বাহুতে বাঁধা। তারা স্টিলের ট্রাঙ্ক মাথায় বসিয়ে নিয়ে ছুটোছুটি করছে। খাবার জল নিয়ে ‘হিন্দু পানি’, ‘মুসলমান পানি’ হেঁকে চলেছে জল বিক্রিওয়ালারা।

তখনকার দিনে খাবার জলেরও ধর্ম ছিল, জাত ছিল। হকার, যাত্রী এবং তাদের আত্মীয়, ভিখিরি আর গার্ডের হুইসেল এসব মিলিয়ে এ যেন একটা বিরাট মেলা। আমি আমার নেংটি পরা ফকিরকে নিয়ে তারই মধ্যে পথ বের করে এগিয়ে চলেছি। অবশেষে কম্পার্টমেন্টটি দুলে উঠল। আমাদের লৌহদানবটি ধোঁয়া উদ্গার করে আমাদের পেটের মধ্যে পুরে নিয়ে এগিয়ে চলল হিস হিস করে।

মোতিহারি ভারতবর্ষের অনেক গরিব রুক্ষ জেলার মতোই একটি। বিপন্ন মানুষ বারংবার অনুর্বর জমি খুঁড়ে নিজের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে এখানে আজকাল। মোতিহারি জেলায় অনাহারের কারণ কিন্তু একমাত্র অনুর্বর জমি নয়। আসল কারণ ছিল ইংরেজ আইন। প্রতিটি চাষি তার বিরাট অংশের জমিতে নীল চাষ করতে বাধ্য ছিল। চাষিদের নীলের দর ঠিক করার অধিকার ছিল না। তাদের বাধ্য করা হত অনেক কম দামে ব্রিটিশদের বিক্রি করতে।

গঙ্গা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি। যতই সে সাম্যবাদী হোক না কেন, আর যতই সে গরিব মানুষদের মধ্যে সময় কাটাক না কেন, এতদিন তার চোখ কিন্তু হস্তিনাপুরের বাইরে বেশি কিছু দেখেনি। এই প্রথম সে দেখল ক্লান্তি আর যন্ত্রণা কেমন করে চোখের নীচে আর চোয়ালে ছাপ এঁকে দেয়। দেখল, এই প্রথম সারি সারি মহিলাদের, যাদের দ্বিতীয় কোনও শাড়ি না থাকায়, একই ময়লা কাপড় দিনের পর দিন পরে থাকতে হচ্ছে। শিশুদের খাবার, বই, খেলনা কিছুই ছিল না, তাদের ফুলে থাকা পেট মনে করিয়ে দিত সেখানে খাদ্য নেই। তারই পাশাপাশি প্ল্যান্টার্স ক্লাবে ব্রিটিশ এবং স্কটিশ সাহেবরা মদের ফোয়ারায় ডুবে আছে। তাদের পরনে দামি বেশভুষো আর চারিপাশে উপচে পড়া খাবারের ট্রে।

গঙ্গা বাইরে থেকে এসব দেখতেন। দারোয়ান তাঁকে ক্লাবে ঢুকতে দেয়নি। তিনি ক্লাবের সিঁড়িতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর উর্দি পরা ওয়াচম্যান তাঁর বাহু ধরে তাঁকে সেখান থেকে চলে যেতে বলে। গঙ্গা একটু রাগ করেননি। শুধু দারোয়ানটির দিকে ঠান্ডা শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকলেন। দারোয়ানটি লজ্জিত হয়ে হাত ছেড়ে দিল। গঙ্গা সিঁড়ি থেকে আস্তে আস্তে নেমে যান। পরদিন তিনি তাঁর প্রতিবাদ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করলেন।

সে আন্দোলনের স্রোতের কথা আজ বলে বোঝানো যাবে না। চারিদিকে যেন প্লাবন বয়ে গেল। আজকের মোতিহারি জেলার বাচ্চারা সে আন্দোলনের কথা পাঠ্যবইয়ে পড়ে। কিন্তু সাদা-কালো অক্ষর কি তাদের চোখের সামনে সেদিনের উন্মাদনার কথা ঠিকঠাক তুলে ধরতে পারে? গঙ্গাজি বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাষিদের কথা শুনেছিলেন। কখনও আবার সভা ডেকে গরিব চাষিদের সেখানে জড়ো করেছেন। সেই প্রথম চাষিরা এগিয়ে এল তাদের জীবনের না-পাওয়ার কাহিনিগুলিকে তুলে ধরতে। তারা শপথ নিল নীলচাষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে। গঙ্গা প্রতীকী হিসেবে একটা নীল গাছকে উপড়ে ফেলে দিয়ে সেখানে শস্য বুনে দিলেন।

আমরা সকলে প্রত্যক্ষ করলাম সেই নতুন যুগ। যুবক ছাত্ররা দলে দলে গঙ্গাজির সঙ্গে যোগ দিল। উকিলেরা তাদের মুনাফার কথা ভুলে গিয়ে তাঁর ভলান্টিয়ার হতে এগিয়ে এল আর সাংবাদিকেরা কাউন্সিল চেম্বারে ইংরেজদের তর্কবিতর্ক না শুনে চলে এল ভারতীয় রাজনীতির সূচনাকে নথিবদ্ধ করতে। ভারতের নবজাগরণ হল এক টাক মাথা নেংটি পরা সন্ন্যাসীর হাত ধরে।

তুমি নিজেই ভাবো না, গণপতি! একটা রোগা চশমা পরা টেকো লোক ওই শক্তিমান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে গ্রাহ্য না করে, এগিয়ে চলল গ্রাম থেকে গ্রামে। মানুষকে নীল চাষের বিরুদ্ধে মন্ত্র দিতে-দিতে। মৃত্যু থেকে জীবনে ফেরার মন্ত্র।

আমি আজও আমার মানসচক্ষে তাঁকে হাতির পিঠে দেখতে পাই। মোতিহারিতে হাতির পিঠে যাতায়াতের চল ছিল। অন্যান্য জায়গার গরুর গাড়ির মতো। গঙ্গাজির মুখে প্রশান্তির অভাব ছিল না। যেন তিনি হস্তিনাপুরের রোলস রয়েস-এ চড়ে চলেছেন। খুব গরম। সূর্যের হলকার সঙ্গে সঙ্গে আগুনের মতো গরম হাওয়া বিষাক্ত সাপের নিঃশ্বাসের মতো মুখে-চোখে ঝাপটা মারছিল। হাওদায় বসে গঙ্গা প্রতিটি চাষির দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ হাসির আশ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন।

ফিটন গাড়ির টগবগ শুনেও তাঁর ভাবান্তর নেই। ফ্ল্যাগ নাড়তে নাড়তে ইংরেজ-এর দূত সেই ঘোড়ার গাড়ি এনে হাতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। গঙ্গা হাতির পিঠ থেকে নেমে এলেন। দূতটি একটি চিরকুট এনে তাঁর হাতে দিল। জেলা পুলিশ তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তিনি আর এগোতে পারবেন না। তাঁকে থানায় তলব করা হয়েছে।

এতটুকু ভয় না পেয়ে হাসতে-হাসতে গঙ্গা চললেন থানায়। আর আমরা হইচই করতে করতে তাঁর পিছু নিলাম।

গঙ্গাজি আমাদের নিয়ে থানায় ঢুকলেন। পুলিশটিকে বেশ বিরক্ত দেখাচ্ছিল। সে কিছুতেই হস্তিনাপুরের সেই কর্তাব্যক্তিকে এরকম পোশাকে কল্পনা করতে পারেনি।

‘আপনাকে আদেশ দেওয়া হচ্ছে আপনি পরের ট্রেনে মোতিহারি ছেড়ে চলে যান। আমি আমার কর্তব্য করছি।’

‘বুঝলাম। আমার কর্তব্য আপনাকে জানিয়ে দেওয়া, আমি আপনার নিষেধাজ্ঞা মানছি না। আমি কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করছি, যেটা শেষ হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকব।’

‘কীসের জিজ্ঞাসাবাদ?’

‘আমি মোতিহারির মানুষের আর্থিক অবস্থার কথা জানতে এসেছি। আজ সকালে আপনি আমার কাজে ব্যাঘ্যাত ঘটিয়েছেন।’

গণপতি কী বলব তোমায়, গঙ্গাকে কোর্ট-এ পাঠানো হল বিচারের জন্য। তিনি তো প্রায় তারকার মতো হাসতে হাসতে, শয়ে শয়ে জড়ো হওয়া মানুষের প্রতি নমস্কার জানাতে জানাতে বিজয়ীর গর্ব নিয়ে আদালতে ঢুকলেন। সেই নেংটি পরা, রোগা টাক মাথার লোকটা কত বড় নায়ক সেদিন-ই বুঝে গিয়েছিলাম।

বিচারের সময়ে, সাধারণ মানুষ চিৎকার করে গঙ্গার জয়গান করতে লাগল। আদালতের ভেতরটা সেই দুপুরের রোদে কী গরম যে হয়ে উঠেছিল, কী বলব। বাইরে ইউনিফর্ম পরা পুলিশরা ছটফট করছিল। বিশেষ করে যাদের মাথায় হেলমেট পরা ছিল। যারা ঘোড়ায় চড়ে গোলমাল থামাবার জন্যে অস্থির হয়ে ঘোরাফেরা করছিল।

শেষে লালমুখো কমান্ডার আর থাকতে না পেরে নির্দেশ দিল জমায়েতের ওপর চড়াও হতে। নাল পরা ঘোড়াগুলি রুগ্ন মানুষগুলোকে পিষে দিতে ধেয়ে এল আর লাঠি-বর্শা হাতে। পুলিশগুলো নিরীহ মানুষগুলোর বুকেপিঠে মুহুর্মুহু আঘাত হেনে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিল।

গঙ্গাজির ভলান্টিয়াররা অবিচল দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সে অত্যাচার সহ্য করল। খানিকক্ষণ পরে যখন অফিসারদের হাত রক্তে রাঙা হয়ে গেল, তাদের মনের গভীরেও বোধহয় কোথাও ক্ষত তৈরি হল। হঠাৎ মনে তাদের সম্বিত ফিরল, তারা আগে কখনও এরকম দেখেনি।

গণপতি! তুমি ভাবছ বুড়োটা অত্যুক্তি করছে, বড্ড ভাবাবেগে ভুগছে। তুমি আর কী বুঝবে এ যুগের ছোঁড়া! তোমাদের যুগে কত সহজে রেশন কার্ড পাওয়া যায়, কালো বাজারের টাকায় সবার এখন লেজ মোটা, টাকা ছাড়া তোমাদের যুগের ছেলেমেয়েরা আর কিছু বোঝে কি? সে যুগে দেশের মানুষের মধ্যে নেমে পড়ে তাদের জাগিয়ে তুলে একটা বিপ্লব গড়ে তোলার পেছনে কী উন্মাদনা কাজ করেছে তা তোমরা বুঝবে না।

আমায় দ্যাখো। তাকিয়ায় হেলান দিয়ে তোমার অবিশ্বাস ফুটে ওঠা চোখ-ও দেখতে পাচ্ছি আবার মোতিহারির সেই আদালতও দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি, কীভাবে লাঠিবর্ষণ হয়েছিল সেদিন নির্দোষ মানুষগুলির ওপর। সেদিন সরকারি পক্ষের উকিলও ঘেমে নেয়ে চান করে গিয়েছিল। শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে জজকে গিয়ে বিচার পিছিয়ে দেওয়ার আবেদন করে।

কিন্তু আশ্চর্যের আরও বাকি ছিল। ম্যাজিস্ট্রেট সবেমাত্র বিচার পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু গঙ্গাজি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বিচার করুন মাই লর্ড। আমি যথার্থ দোষী কিনা।’

চারিদিকে হইচই পড়ে গেল। ম্যাজিস্ট্রেটের হাতুড়ি পেটানোর তোয়াক্কা কেউ করল না। গঙ্গাজি বলতে আরম্ভ করতেই সবাই কান খাড়া করে তাঁর শান্ত কঠিন কণ্ঠস্বর শোনার জন্য চুপ করে গেল।

‘মাই লর্ড, আমি নির্দেশ উপেক্ষা করে মতিহারিতে থেকে গেছি। আমার বক্তব্য আপনাকে পড়ে শোনাতে চাই। এটাই আমার সাফাই। তারপর আপনার বিচার আমি মাথা পেতে নেব।’

ম্যাজিস্ট্রেট বিপন্নভাবে এদিক-ওদিক দেখলেন। যেন কারুর সাহায্য বা পরামর্শের অপেক্ষা করছেন। ‘আপনি বলতে পারেন।’ নিরুপায় হয়ে শেষ অবধি গঙ্গাকে বললেন।

গঙ্গাজি এক মুখ হেসে, চশমাটা নাকের ওপর দিকে ঠেলে দিয়ে, খাটো ধুতির ভাঁজ থেকে দোমড়ানো মোচড়ানো একটা কাগজ বের করলেন। তাতে কালিতে কী সব লেখা। কাঠগড়ার রেলিং-এর ওপর সেটাকে যথাসাধ্য নিভাঁজ করে নিয়ে গঙ্গাজি বললেন, ‘আমার বক্তব্য।’ তারপর কাগজটিকে নাকের ডগায় ধরে পড়তে শুরু করলেন।

‘আমি এ জেলায় এসেছি কিছু সামাজিক উন্নতিকল্পের কাজকর্ম করতে। আমাকে এখানকার কৃষকরা জানিয়েছেন, ব্রিটিশ সরকার তাঁদের করুণ অবস্থার জন্য দায়ী। কারণ সরকার নীলকর সাহেবদের পক্ষে কাজ করছেন। আমি চাষিদের জন্য কিছু করার আগে এখানকার ব্যবস্থাপনা খতিয়ে দেখছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, স্থানীয় প্রশাসন এবং নীলকর সাহেবদের থেকে কিছু সাহায্য পাব। দুঃখের বিষয়, তাঁরা তা করেননি।’

এই শান্ত অথচ তির্যক ভাষা শুনে ম্যাজিস্ট্রেটের চোখ যেন কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল। কিন্তু গঙ্গা অবিচল। ‘আমি এখানে জনগণের হিতার্থে এসেছি, এখানকার শান্তি বিঘ্নিত করতে নয়। প্রশাসনগত কিছু অভিজ্ঞতা আমারও আছে।’

গঙ্গার বক্তব্যে কোনও দোলাচল নেই। জজ সাহেবের চোখে-মুখে অস্বস্তি দেখা দিল। চারিদিক নিস্তব্ধ। কোর্টরুমের হাওয়া থমথমে, ভারী। পাখা টানছিল যে লোকটি, সেও উদগ্রীব হয়ে শুনতে গিয়ে হাত থামিয়ে রেখেছে।

‘আমি এদেশের বাধ্য নাগরিক হিসেবে সরকারি নির্দেশ নিশ্চয়ই মানতাম। কিন্তু আমার বিবেক আমায় বলল, মোতিহারির মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করতে চেষ্টা করাটা আরও বেশি জরুরি। তবে আইন অমান্য করার জন্য যে-কোনও শাস্তি আমি মাথা পেতে নেব।’

আমরা গঙ্গাজির দিকে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আইন অমান্য করার প্রাথমিক উত্তেজনা তখন কেটে গেছে। এবার আইনের লাল চোখ দেখবার পালা। আজকের যুগের মতো তখন সহজে আইনকে ঘুষ দিয়ে কেনা যেত না। ব্রিটিশ জমানার জেল থাকবার জন্য খুব একটা সুখকর জায়গা ছিল না।

‘ন্যায় আর সত্যের স্বার্থে আমি সরকারি নির্দেশ অমান্য করছি। মোতিহারি ছেড়ে আমি আমার দায়িত্ব পালন না করে যাব না।’ এই বলে গঙ্গাজি সোজাসুজি ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে নির্ভীকভাবে তাকালেন। ‘আমি এটাও কিন্তু পরিষ্কার করে দিতে চাই, আমি দেশের আইন-এর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু আমার বিবেক এবং দায়িত্ব আমি এড়িয়ে যেতে পারছি না। আপনি আমায় শাস্তি দিন।’

চারিদিক স্তব্ধ হয়ে গেল। গঙ্গাজি কাগজটা ভাঁজ করে তাঁর খাটো ধুতির কোঁচড়ে পুরে ফেললেন। ‘আমার বক্তব্য শেষ। বিচার পিছিয়ে দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।’

ম্যাজিস্ট্রেট কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। চোয়াল ঝুলে রইল। তিনি বিপন্ন চোখে তাকিয়ে রইলেন সরকারি উকিলের দিকে। সে ভদ্রলোক ততক্ষণে ঘেমে নেয়ে চান করে গেছেন। শেষে জজসাহেব অতিকষ্টে গলা খাঁকারি দিলেন। কেমন ফ্যাসফ্যাসে গলায় কোনওমতে বলে উঠলেন, ‘আমি বিচার পিছিয়ে দিলাম। আজকের মতো কোর্ট ভেঙে দেওয়া হল।’

সমবেত সকলে উল্লাসে ফেটে পড়ল। কারণ তারা বুঝতে পারল, ম্যাজিস্ট্রেট কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না।

সব মানুষেরা রক্তঝরা কাঁধে গঙ্গাকে তুলে নিল। ঘোড়াগুলি সরে দাঁড়াল। সেপাইরা লজ্জায় মাথা নিচু করল, আমরা বিজয়ের গৌরব নিয়ে আমাদের নতুন আশার আলোকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গঙ্গার চোখে জল। তিনি চোখ ভরে দেখছেন সেই নিরস্ত্র মানুষগুলিকে। যারা বুক দিয়ে তাঁর আজ্ঞা পালন করেছে।

আমরা কী না পেরেছি সেদিন গণপতি! ভাগ্যিস ম্যাজিস্ট্রেট সেদিন তাঁর বিচার শোনাননি। খুব তাড়াতাড়ি খবর পৌঁছেছিল রাজধানীতে। লেফটেনান্ট গভর্নর নির্দেশ দিলেন গঙ্গার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ খারিজ করতে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় প্রশাসনকে বললেন, গঙ্গাজির কাজে সাহায্য করতে! ভাবতে পারছেন? একজন সত্যাগ্রহী একটা জেলায় এসে ন্যায়ের প্রার্থনা করলেন, সেখান থেকে চলে যাওয়ার সরকারি নির্দেশ অমান্য করলেন, সর্বসমক্ষে তাঁর বক্তব্য দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং দুর্বিনীতদের এমন লজ্জায় ফেললেন যে তারা তাঁর সঙ্গে মিলিয়ে একমত হয়ে নিজেদের কুকর্মের কাহিনি প্রকাশ করে দিতে বাধ্য হল। কী অভিনব কৌশল বলো তো?

তারপর চাষিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর্ব চলতে থাকল। গঙ্গাজি তাঁদের কথা শুনলেন, ইংরেজ অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে। শেষে রিপোর্ট যখন পেশ করা হল, লেফটেন্যান্ট গভর্নর একটা সরকারি তদন্ত করবার কথা স্থির করলেন। গঙ্গাজিকে সেই অনুসন্ধানের ভার দেওয়া হল। অনুসন্ধান কমিটি সরকারকে সর্বতোভাবে পরামর্শ দিলেন, নীল চাষ বন্ধ হোক আর চাষিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। আইন বদলানো হল। নীল চাষ আর বাধ্যতামূলক রইল না। গঙ্গাজির অহিংসার জয় হল, গণপতি।

মোতিহারির কাহিনি বারংবার দেখা যেতে লাগল ছোট ছোট গ্রামগুলিতে, গঙ্গাজির নেতৃত্বে। প্রত্যেকবার শাসক গোষ্ঠীর থেকে তিনি সাহায্য পাননি। আস্তে আস্তে ব্রিটিশরা গঙ্গার কৌশল বুঝতে পেরে গেল এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বাড়িয়ে তুলল। ম্যাজিস্ট্রেট এবং গভর্নররা তাঁকে আর ভয় পেত না। এসব ক্ষেত্রে তিনি চুপচাপ জেলে চলে যেতেন এবং অল্পদিনেই ইংরেজরা লজ্জায় তাঁকে ছেড়ে দিত।

গঙ্গাজির সহজ শান্তির নীতি-আদর্শের পথ যেন জাদু সৃষ্টি করল। যেখানে সংবিধানগত পথ কাজ করেনি, সেখানে গঙ্গাজি মানুষের কাছে পৌঁছে দিলেন স্বাধীনতার বাণী। সহজ ঠিক-ভুল, ন্যায় আর বিবেকের তর্কের সামনে ব্রিটিশদের পদ্ধতি ধোপে টিকল না। হিংসার পথ না বেছে তিনি সহজেই তাঁর শ্রেষ্ঠ এবং মহত্বের পরিচয় দিতে পেরেছিলেন। তিনি অহিংসা দিয়ে আইন অমান্য করে, আইনের গলদগুলি তুলে ধরেছিলেন। সব শাস্তি মাথা পেতে নিয়ে তিনি ইংরেজদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, যে তারা অত্যাচারী।

আর যখন কোনও অন্যায়ের প্রতিকার তিনি সহজে করতে পারতেন না, তখন নিজের ওপর শান্তভাবে আঘাত হানতেন। সে যে কী ভীষণ পথ তা যে না দেখেছে সে বুঝবে না। অবিচল পাহাড়কেও টলিয়ে দিতে পারত তাঁর শান্ত-কঠিন জেদ। সেসব গল্প আমি ধীরে ধীরে বলছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *