লা নুই বেঙ্গলী – ৯

আমাকে অফিসে পৌঁছতে হতো সকাল দশটার মধ্যে। রাত আটটায় চায়ের টেবিলে হাজিরা দিতে হবে। তাই সন্ধ্যা ছটার মধ্যেই বাড়ি চলে আসার চেষ্টা করতাম, যাতে অন্তত ঘন্টা দুয়েক সময় মৈত্রেয়ীর সঙ্গে গল্প করার সুযোগ পাই। সেই রাতে আমি ভালো করে ঘুমুতে পারিনি। বার বার দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। আমি স্বপ্নে দেখছিলাম, মৈত্রেয়ীকে হারাচ্ছি আমি। দাড়িওয়ালা এক স্বর্গীয় দ্রুত আমায় এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। নরেন্দ্র সেন নিঃশব্দে তাঁর টেরাস থেকে আমার চলে যাওয়া দেখছেন। ঘুম ভেঙে দেখি আমার কপাল ঘামে ভিজে গেছে। মনে হচ্ছিল, না-জানি কী ভীষণ পাপ আমি করে ফেলেছি!

যথা সময়ে মৈত্রেয়ীর সঙ্গে দেখা হলো। ওর পরণে ছিল ধবধবে সাদা শাড়ি, গায়ে হাল্কা ধোঁয়াটে রঙের শাল। বুঝতে পারছিলাম না আমার ঠিক কী ভাবে এখন ওর সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত। ওকে জড়িয়ে ধরবো, না শুধু মৃদু হাসবো অথবা কিছুই হয়নি এরকম ভান করবো? ভাবতে ভাবতে ওকে নমস্কার জানালাম। ও আমার কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করছে আন্দাজ করতে না পেরে প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি উল্টোপাল্টা সংলগ্ন কথা বলছিলাম। মৈত্রেয়ী ছিল শান্ত, স্থির, সমাহিত। ওর চোখের নিচে কালি, অনুমান করতে পারছি, আগের রাতটা ওর কেটেছে পুজো আর প্রার্থনার মধ্য দিয়ে। আমি ভুল করছি না ঠিকই শুনেছিলাম মনে নেই, ও একটা প্রার্থনা-সঙ্গীত গাইছিল গুন গুন করে। তারপর হঠাৎই গান থামিয়ে দিয়েছিল।

আমি ওর সামনের চেয়ারে বসে যন্ত্রচালিতের মতো বইয়ের তালিকা প্রস্তুতির কাজে লেগে গেলাম। কয়েক মিনিট পরে ওই জমাট বরফের মতো শীতল স্তব্ধতা কাটানোর জন্য আমি প্রশ করলাম, কাল রাতে ঘুম হয়েছিল?

—না। একদম ঘুমুতে পারিনি।

কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে আবার বললো, আমি ভেবে দেখলাম এখন আপনার এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। এই জন্যই আপনাকে আমি ডেকেছি।

আমি ওর কথার বাধা দেবার প্রয়াস করলাম। কিন্তু অনুনয়ের ভঙ্গি করে আমার থামিয়ে দিয়ে ওর কথা বলে যেতে লাগলো। কথাও বলছে, আবার একটা কাগজ টেনে নিয়ে তাতে পেনসিল দিয়ে একবার কিছু লিখছে, আবার তারপরে তা কেটে দিয়ে হিজিবিজি ছবিও আঁকছে, যার কিছুই আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম না। ওর এই খেলা সেই প্রথম দিককার ও ফরাসী শেখার দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। দুঃখে, অনুতাপে আমার মন ভেঙে যাচ্ছিল। ওর এই ধরনের মানসিক ক্ষুদ্রতা আমাকে হতবাক্ করে দিচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমার যা স্থির বিশ্বাস, আমার যা স্থির ধারণা তা সব যেন ভেঙেচুরে খসে খসে পড়ছে। বাস্তবিক প্রসঙ্গান্তরে না গিয়ে একটা বিষয় নিয়ে একটানা এতক্ষণ ধরে কথা বলতে আমি কখনই ওকে দেখিনি। আমার যে কিছু বলার থাকতে পারে, এ ব্যাপারটার কোনো গুরুত্বই ওর কাছে যেন ছিল না। মনে হচ্ছিল, যেন ও একাই এই ঘরে বসে রয়েছে।

সুতরাং এটাই ধরে নিতে হচ্ছিল, আমার যা ধারণা ছিল যে, আমি ওকে যেভাবে ভালোবাসতাম, ও-ও আমাকে সেই একইরকম ভালোবাসে, তা সম্পূর্ণ ভুল! তেরো বছর বয়স থেকেই ওর মন-প্রাণ বাঁধা পড়ে আছে রবীন্দ্রনাথের কাছে—যেদিন থেকে ওঁর সাহিত্যের সঙ্গে ওর পরিচয় হয়েছে। গতবছর ছাড়া প্রতিটি গ্রীষ্মই ও কাটিয়েছে শান্তিনিকেতনে তাঁর সমগ্র পরিবারবর্গের সঙ্গে। অনেক সন্ধ্যা-রাত্রি ও বৃদ্ধের পায়ের কাছে বসে তাঁর কথা শুনে কাটিয়েছে। তিনি ওর চুলে হাত বুলিয়ে আদর করতেন। তাঁর কথা, তাঁর স্পর্শ ওকে নিয়ে যেতো এই পার্থিব জীবনের ঊর্ধ্বে এক অতীন্দ্রিয় জগতে। প্রেম, ভক্তি নিয়ে এক আধ্যাত্মিক উপলদ্ধিতে ও মগ্ন ছিল। একদিন রবীন্দ্রনাথ ওর সঙ্গে জাগতিক প্ৰেম নিয়ে আলোচনা করলেন। শুনতে শুনতে ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। যখন ওর জ্ঞান ফিরেছিল তখন ও নিজেকে আবিষ্কার করেছিল রবীন্দ্রনাথের পালঙ্কে। ঘরের মধ্যে ভাসছিল জুঁই ফুলের সুবাস। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ওকে দিলেন সেই মন্ত্র যা ওকে রক্ষা করবে পাপ থেকে। মনকে করবে, পবিত্র, সুন্দর। তিনি ওকে বললেন সারা জীবন পবিত্র থাকতে, কবিতা লিখতে, ভালোবাসতে এবং তাঁকে ভুলে না যেতে। মৈত্রেয়ীও তাঁকে কখনো ভোলেনি, ভুলবেও না। বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁর লেখা ওঁর সব চিঠি একটা চন্দন কাঠের বাক্সে ও সযত্নে রেখে দিয়েছে। বাক্সটায় রয়েছে রবীন্দ্রনাথের একগুছ কেশও। বাক্সটা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরই উপহার দেওয়া।

শুনে আমার সেদিন মনে হচ্ছিল মানুষটি কী নিখুঁত অভিনেতা! তখন আমার তরুণ বয়স, সবকিছু বোঝবার বয়স আমার নয়, তাই আমি তখন হিংসা, ক্রোধ আর অক্ষম বিদ্রোহে জ্বলছিলাম। এই কি মানুষ? অতীন্দ্রিয়বাদের মোড়কে ভোগ-বাসনা, অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে প্রতারণা! এই যুবতীর শুচিতা সম্পর্কে আমি কি আর বিশ্বাস করতে পারি? কী করে আমি বিশ্বাস করবো আমিই ওর কাছে প্রথম ‘পুরুষ’? আমার প্রতীচ্য মন নিয়ে আমি সেদিন রোষে ফুলতে ফুলতে ভাবছিলাম ওর গুরু ওকে কখনও আলিঙ্গন পর্যন্ত করেননি, শুধুমাত্র চুলে হাত বুলিয়ে আদর করেই ছেড়ে দেন? অবশ্য বহুদিন ওদের আর দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। রবীন্দ্রনাথ সারা বছরই প্রায় বাইরে ঘুরে বেড়ান। তাহলে…তাহলে? হায় আমি কী করবো? মিসেস সেন বোধহয় ওঁর মেয়ের ব্যবহারে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেছিলেন। তাই তিনি আর ওকে ওর গুরুর কাছে যেতে দেননি। কিন্তু মৈত্রেয়ী ওর গরুকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে থাকতে পারেনি। সে চাইছিল আমরা এমনই বন্ধু হই, যাতে দুজনেই অতীন্দ্রিয়বাদে বিশ্বাসী হয়ে একযোগে রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসতে পারি। ও বন্ধুত্বের কথা ভেবেছিল, প্রেম নয়। ভালোবাসা, কিন্তু শরীর বাদ দিয়ে। ও এই কথাগুলো বলেছিল লজ্জায় লাল হয়ে, নিচু গলায় আর ইংরেজীতে অনেক ব্যাকরণ-ভুল করে। আমার প্রতি ওর ব্যবহারে কিন্তু আন্তরিকতা, সহানুভূতির কোনো অভাব ছিল না। আমাকে যথেষ্টই সময় দিতো। খুশি হতো, যখন চোখে চোখ, হাতে হাত রেখে আমরা বসে থাকতাম। ও বলতো আমি ওকে অন্যভাবে নেওয়ার জন্য ওর নিজের ব্যবহারই দায়ী। ওরই সব কথা খুলে বলা উচিত ছিল আর এমন কিছু করা ঠিক হয়নি, যাতে আমার ভাবনা চিন্তা অন্য দিকে বয়ে যেতে পারে।

সেদিন কথা বলতে বলতে ও ক্লান্ত হয়ে পড়লো। ওর কথা শেষ হতেই আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। আমার মাথা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। আমি সোজা ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর মুখ আমার দিকে তুলে ধরলাম। আমি জানতাম ও চিৎকার করতে পারবে না, কোনো সাহায্যও চাইতে পারবে না কারো কাছে। দুহাতে ওর মুখ ধরে ওর ঠোটে চুমু খেলাম। জানতাম, যে-কোন মুহূর্তে যে-কেউই দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে পারে এবং লাইব্রেরির দিকে চোখ পড়তেই পারে! কিন্তু বিপদের সম্ভাবনা যেন আমাকে আরও বেপরোয়া করে তুললো। গভীর চুম্বনে আমাদের শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো।

-কেন আপনি এরকম করছেন? আপনি জানেন আমি দুর্বল, আমার প্রতিরোধ শক্তি নেই। আপনি আমার জড়িয়ে ধরলে বা চুমু খেলে আমার কিছুমাত্র উত্তেজনা হয় না। আপনার ঠোঁটের সঙ্গে ছবুর বা কোনো শিশুর ঠোঁটের কোনো তফাৎ আমি করতে পারি না। আমি আপনাকে ভালোবাসি না।….

সেদিন কিছুই না খেয়ে অফিসে চলে গেলাম। মৈত্রেয়ীর স্বীকারোক্তি আমার মনে হিংসা, ঈর্ষা ও রাগের কিছুটা উপশম করলো। বুঝতে পারছিলাম এই নারী এমন যে নিজের প্রকৃতিকে কিছুতেই অতিক্রম করতে পারবে বলে মনে হয় না।

সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে ওর আর দেখা হয়নি। রাত্রে খাবার টেবিলে ও ওর নির্দিষ্ট আসনে অর্থাৎ আমার ডানদিকের চেয়ারে এসে বসলো। টেবিলে আমি ছাড়া ছিল মন্টু, নীলু আর মৈত্রেয়ী। আমরা রাজনীতি আলোচনা করছিলাম; মেয়রের গ্রেপ্তার, সরোজিনী নাইডুর বক্তৃতা ইত্যাদি। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি মৈত্রেয়ীর দিকে তাকাবো না স্পর্শও করবো না ওকে যদি না কোনো দুর্ঘটনাক্রমে তা ঘটে যায়। কিন্তু হঠাৎ‍ই অনুভব করলাম ওর উষ্ণ, নগ্ন পা আমার পায়ের ওপর আমার সারা শরীরের যে শিহরণ দেখা দিলো, তা আমাকে প্রতিজ্ঞার কথা ভুলিয়ে দিল। ওর মুখ ছিল ফ্যাঁকাশে, কিন্তু ঠোঁট দুটি লাল। নিদারুণ ভয়ের চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছিল ও। সে চোখে ছিল গভীর আমন্ত্রণও বটে। নিজেকে সংযত রাখার জন্য আমি আমার বুকে নখ বসিয়ে ছিলাম। কিন্ত এর পর থেকে টেবিলের নিচে পায়ে পা জড়িয়ে আদর করা আমাদের প্রাত্যহিক কর্ম হয়ে দাঁড়ালো। খাওয়ার পর সেই রাত্রে ও আমায় দরজায় আটকালো, বললো—আমার কাজ কতদূর এগুলো দেখবেন না?

ও লাইব্রেরির আলো জ্বালালো, কিন্তু কাগজপত্রে টেবিলের দিকে না গিয়ে অন্য একটা অন্ধকার ঘরে দিকে এগিয়ে গেল। এই ঘরটার কাছে এসে ও ঘুরে দাঁড়ালো। ওর ব্লাউজ ছিল কাঁধ অবধি, জামার হাতা স্বাভাবিক প্রচলিত মাপ অনুযায়ী, কনুই অবধি নয়। চারদিক ভালো করে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ওর নগ্ন বাহু আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, আপনার যা ইচ্ছে আমার হাতে করতে পারেন। অদর করুন, চুমু খান, যা ইচ্ছে করুন, দেখবেন আমার কিছু হবে না। আমি স্থির থাকবো, আমার মধ্যে কোনো উত্তেজনা জাগবে না।

বহুদিন আগে আমাদের মধ্যে ভোগবিলাস নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। আমি বলেছিলাম যে, যদি কেউ প্রকৃত ভালোবাসতে পারে, তবে তার সামান্য স্পর্শেই তার প্রেমিক বা প্রেমিকা সুখ পাবেই। আরও বলেছিলাম মানুষের পক্ষে কোনো মানুষকে তার শরীর-মনে সম্পূর্ণ অধিকার করার ব্যাপারটা আমরা যতটা সহজ ভাবে নিই, ব্যাপারটা ঠিক ততখানিই জটিল। যাকে মনে করি যে সে আমার সম্পূর্ণ অধিকারে আছে, আসলে হয়ত সে আদপেই তা নেই। ওই সব কথাগুলো দিয়ে আমি মৈত্রেয়ীর সূক্ষ্ম বিশ্বাসবোধ ভাঙার চেষ্টা করেছিলাম।

আমি ওর হাতে ধরলাম এবং সম্মোহিতের মতো কিছুক্ষণ ধরে দেখলাম। মনে হচ্ছিল কোনো মানুষের হাত নয়। মনে হচ্ছিল ওর ওই অনুজ্জ্বল বাদামী ত্বকের নিচে ওর বিশ্বাস আর আবেগ সঞ্চরমান। ও যেন হাতটা বাড়িয়ে ধরেছিল জ্বলন্ত আগুনের ওপর। পরীক্ষা করে দেখছিল নিজেল ইচ্ছা-শক্তি। আমি ওর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিলাম। ওর মধ্যে যে একটা শিহরণ উঠলো তা আমি পদে-পদে অনুভব করতে পারলাম। ও বুঝতে পারছিল না আমি কী করতে যাচ্ছি। আমি ওর হাত ডলে-পিষে দিচ্ছিলাম, আলতো করে হাত বুলোতে বুলোতে অসংখ্যবার চুমু খাচ্ছিলাম। ওটা শুধ একটা হাত নয়, ওটা সম্পূর্ণ মৈত্রেয়ীর শরীর! এই মনে করে সুতীব্র কামনায় হাতটা আমি জড়িয়ে ধরছিলাম, আদর করছিলাম। বুঝতে পারছিলাম ও ক্রমশই ইন্দ্রিয় সুখের কাছে আত্মসমর্পণ করছে। এবার ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ওর মুখ তখন ফ্যাকাশে, চোখ আধ-বোজা। আমার যে আঙুল, হাত ওর নগ্ন বাহুকে আদর করছিল, ক্রমশ তা ওর সমস্ত শরীরের দিকে ধাবমান হলো। অনুভব করতে পারছিলাম ওর পা থর-থর করে কাঁপছে, শরীরের ভার ক্রমশ আমার শরীরে এসে পড়েছে। ও ওর আরেকটি হাত দিয়ে আমাকে জোরে জড়িয়ে ধরলো। অব্যক্ত কান্নায় ওর শরীর ফুলে ফুলে উঠছিল। আমি ওর মুখে চুমু খেলাম। ওর ঠোঁট আপনিই খুলে গেল। দাঁত দিয়ে ও আমার ঠোঁট কামড়ে দিতে লাগলো। আমার কামনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে-ওঠা উত্তেজনারই বহিঃপ্রকাশ এটি! বুঝতে পারছিলাম ওর ভেতরে যে কামনা-বাসনা, পাপ-পূণ্যের বোধ এত দিন ধরে ওকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তা সন্ধ্যাবেলার সূর্যের আলোর মতো ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে, আর নতুন ঊষার আলোর মতো তার মধ্যে জেগে উঠছে ওর নারীত্ব। মনে হচ্ছিল সেই ক্ষণকাল যেন কোনোদিন না শেষ হয়!

একটা সময় নিজেকে ফিরে পেলো ও। নিজেকে ছাড়িয়ে টেবিলের দিকে এগুলো। মাঝে মাঝে দু হাত দিয়ে চোখ ঢাকছিল। টেবিলের কাছে গিয়ে যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরে বললো, আজকে এইটুকু কাজ করেছি দেখুন।

ঠিক এই সময়ে খোকা এসে হাজির হলো। সে জানালো, মিসেস সেন মৈত্রেয়ীকে তাঁর ঘরে ডাকছেন। আমি তাড়তাড়ি লাইব্রেরির আলো নিভিয়ে দিলাম। সেই মুহূর্তে আমার সৌভাগ্যে এতই বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম যে খোকাকে অন্তরঙ্গ বন্ধু মনে করে প্রায় সব খুলে বলতে যাচ্ছিলাম আর কী!

ঘরে ফিরে এসে কিছুতেই এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারছিলাম না। একবার জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিছানায় এসে শুলাম, আবার উঠে পড়ে ঘরে পায়চারি করতে শুরু করলাম। মৈত্রেয়ীকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিল। ওই ভাবে খোকা এসে পড়ায় ব্যাপারটা শেষ না হয়ে, একটা বিদায়ী চুম্বনে শেষ হলে হয়তো এরকম হতো না। মনে হচ্ছিল মৈত্রয়ী নিশ্চয়ই একই কথা ভাবছে। আমি ছাদের ওপর ওর হাল্কা পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।

বারান্দায় ওর ছায়া দেখতে পেলাম, কিন্তু ঠিক সেই সময়েই ও আলো নিভিয়ে দিলো, আর আমি প্রচণ্ড হতাশায় ভেঙে পড়লাম।

কিছুক্ষণ পরে, হঠাৎই একটা শিস্ দেওয়ার মতো আওয়াজ পেলাম। অন্তত আমার তাই মনে হলো। আমিও জানালার কাছে গিয়ে শিস্ দিলাম। কোনো সাড়া নেই। মনে হলো মৈত্রেয়ী দোতলার বারান্দায় আছে। আমি খুব সাবধানে আমার দরজা খুললাম, তারপর আরো সাবধানে সদর দরজা খুলে ফেললাম। রাস্তায় নামতে আমার সাহস হচ্ছিল না, কারণ রাস্তায় যথেষ্ট আলো ছিল। আমি আবার শিস্ দিলাম।

—অ্যালেন—অ্যালেন….

চাপা আওয়াজের ডাকটা দোতলার বারান্দা থেকে এলো। এই প্রথমবার ও আমার নাম ধরে ডাকলো। বারান্দার রেলিং-এ ঠেস দিয়ে ও দাঁড়িয়ে। গায়ে একটা শাল। গ্লিসিন ফুলের গুচ্ছের পাশে দাঁড়িয়ে ও। কালো এলো চুলে কোনো চোরা-পথে-আসা টুকরো টুকরো বিন্দু বিন্দু আলো এসে পড়েছে। রূপকথার গল্পের চরিত্রের মতো মনে হচ্ছিল ওকে।

আমি চুপ করে ওকে দেখছিলাম। ওকে খুবই ক্লান্ত, বিপর্যস্ত লাগছিল। হঠাৎই ও শালের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বুকের কাছ থেকে সাদা মতো জিনিস বের করে আমার দিকে ছুঁড়ে দিলো। হাতে তুলে নিয়ে দেখলাম, জুঁই ফুলের একটা মালা।

পর মুহূর্তেই মুখ তুলে দেখি ও আর ওখানে নেই। ভীষণ খুশি মনে ফিরে এলাম সাবধানে। বারান্দার শেষ দিকে আসতেই খোকার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। আমি ওকে কিছু বলার আগেই ও তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, আমি একটু জল খেতে এসেছিলাম।

সেই সময় আমার একবারও মনে হয়নি অত রাত্রে ও কী করছিল ওখানে বা একবারও সন্দেহ হয়নি ও আমাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করছে কি না। আসলে আমার মন তখন আনন্দে এতই অভিভূত ছিল যে মনে হয় আমার বুদ্ধি সঠিক কাজ করছিল না। জুঁই ফুলের মালা সম্পর্কে পরে জেনেছিলাম যে ওটা প্রায় বাগ্দানের সমান। সেই মুহূর্তে আমার ওসব কিছু জানার প্রয়োজনও হয়নি। মৈত্রেয়ী যখন ওটা আমাকে দিয়েছে তখন ওটা আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, এই ভেবে নিয়েই বহুবার চুম্বন করেছিলাম ওই ফুলের মালাটিকে। আমি খাটের ওপর বসে ফুলগুলো দেখতে দেখতে ভাবছিলাম পুরনো দিনগুলোর কথা। আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি এরকম কোনো ঘটনা আমার জীবনে কোনোদিন ঘটতে পারে। বুঝতে পারছিলাম ও চায় ওর সচেষ্ট ভূমিকা থাকলেও, যাতে

ওকে আমি প্রেমাস্পদ না ভাবি, কিন্তু ওকে ততদিনে মনেপ্রাণে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।

রাতটা কাটলো স্বপ্ন আর স্মৃতির আনাগোনার মধ্য দিয়ে। ফুলের সুবাস আমার স্বপ্নে এসে আমাকে যেন শোনাচ্ছিল বাংলার সমভূমিতে মরালের ডাকের কথা। মনে হচ্ছিল সৌভাগ্যের দরজা আমার সামনে খুলে গেছে। অদূরে এক রূপকথার জীবন আমার জন্য অপেক্ষমান।

পরের দিন অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যে আমার বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি হলো। মৈত্রয়ী আমার জন্য খাবার ঘরে অপেক্ষা করছিল। ও বর্ণ অনুযায়ী বই-এর নামগুলো এক একটা কাঠের বাক্সে শ্রেণীবদ্ধ করে রাখছিল। আমাকে দেখা মাত্র ছুটে গিয়ে আমার খাবার নিয়ে এলো। তারপর আমার কাছে এসে বসলো চেয়ার টেনে আমি বুঝতে পারছিলাম না কি দিয়ে কথা শুরু করবো। ও আমাকে এক দৃষ্টিতে দেখছিল। ভীষণ খিদে পেয়েছিল, তাই গোগ্রাসে গিলছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হওয়ায় খাওয়া থামিয়ে ওর দিকে তাকালাম। আমার দৃষ্টিতে আমি ওকে বলতে চাইছিলাম, ও আমার ভীষণ, ভীষণ প্রিয়

—আজ একবারও আমার কথা তোমার মনে পড়েছে?—হঠাৎ ও জিজ্ঞাসা করলো।

আমি জানতাম প্রেমিক-প্রেমিকারা পরস্পরকে এই ধরনের প্রশ্নই করে থাকে। কিন্তু আমি দেখলাম ওর চোখের কোণে জল।

—কাঁদছো কেন?

আমার কণ্ঠস্বরে হয়ত যথেষ্ট কোমলতা ছিল না। কিন্তু আমি তো ওকে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসতাম। তবু কেন ওর কষ্ট আমার মধ্যে একইভাবে সঞ্চারিত হলো না? কেন তখন আমার খিদে পাচ্ছিল?

ও কোনো উত্তর দিলো না। আমি হাত বাড়িয়ে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম। তারপর আবার খেতে শুরু করলাম।

—অ্যালেন, তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই।

ও বাংলায় কথা বলছিল যাতে সম্বোধনটা ‘তুমি’ করে বোঝানো যায়। ওর গলায় ওঠা নামা ছিল ভীষণ মিষ্টি।

ও আমায় রবীন্দ্রনাথের বাক্সটা দেখালো। বাক্সের মধ্যে সুবাসযুক্ত এক গাছা সাদা চুল ছিল।

—এটা নিয়ে তুমি যা খুশি করো। ছুঁড়ে ফেলে দাও। সব পুড়িয়ে ফেলো। আমি আর এটা আমার কাছে রাখতে পারছিনা। তোমরা ‘ভালোবাসা’ বলতে যা বোঝো আমি রবীন্দ্রনাথকে কোনোদিন সেরকম ভালোবাসিনি। ওঁর প্রতি আমার ছিল অসীম শ্রদ্ধা, ছিল প্রবল আবেগ। বলতে পারো সেই হিসেবেই সারা জীবন ওঁকে ভালোবেসে যাবো। কিন্তু আজ……।

ও আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যেন ও স্বপ্নের ঘোরে রয়েছে। ওর সামনে আমি যেন কোনো রক্ত-মাংসের মানুষ নই। কী এক প্রবল প্রত্যাশা, নিবিড় আসক্তি যে ছিল সেই চোখে, তা বর্ণনা করা যায় না।

—আজ আমি কেবলমাত্র তোমাকেই ভালবাসতে চাই। আমি কাউকে এভাবে ভালোবাসিনি। আজ সঠিকভাবে জেনেছি।

আমি ওকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিলাম কিন্তু মন্টুকে দেখতে পেয়ে ওর সঙ্গে করদমদনেই সন্তুষ্ট থাকলাম। আমি ওর বাক্স ওর হাতেই তুলে দিলাম। একগুচ্ছ নির্জীব সাদা চুলের ওপর হিংসা করা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়েছিল। জীবন জীবনই। অতীত স্মৃতিমাত্র। ওর বিগত জীবন নিয়ে যন্ত্রণা পাবার কোনো মানে হয় না। শুধু কষ্ট হতো, যখনই মনে হতো মৈত্রয়ী আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, অথবা ওঁর সঙ্গে আমাকে তুলনা করছে। তখন ডুবে যেতে চাইতাম এমন কোনো সদূর যুগের ভাবনায়, যখন আমার আর্ভিভাবই হয়নি। নিশ্চয় ও আমার এই ধরনের অবস্থার অন্য মানে করতো। হয়তো ওর আত্মত্যাগ, আর ওর আমার ব্যাপার ও যে ঝুঁকি নিচ্ছে, সেই ঝুঁকি পক্ষের অবমাননাকর মনে করতো। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে উদ্বেগের সঙ্গে বললো, তুমি এই চুলের সম্পর্কে কিছু বললে না তো?

—আমি কী করবো ওটা নিয়ে? তুমিই ওটা পুড়িয়ে ফেলো। সেটা আরও ভালো হবে।

—এখন আর ওটার কোনো মূল্য নেই আমার কাছে।

আমি অবাক্ হয়ে গেলাম। চুলটা নিয়ে কোটের পকেটে ফেলে রাখলাম। ঘরে ফিরে জামা- কাপড় ছেড়ে আমি স্নান করতে গেলাম স্নানের ঘরে। খোশমেজাজে আমি এত জোরে শিস্ দিচ্ছিলাম যে লীলু ওখান দিয়ে যাবার সময় দরজায় টোকা দিয়ে জিজ্ঞাসা করে গেল, গত রাত্রে আমি কোনো সুস্বপ্ন দেখেছি কি না!

তারপরে আমার ঘরে এসে আমি যখন জামা-কাপড় পরছি, তখন মৈত্রেয়ী এসে দরজায় টোকা দিলো। ও ঘরে ঢুকেই পর্দাটা টেনে দিলো, আর আমার বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো, মৃদু, অস্ফুষ্ট স্বরে বললো, আমি তোমায় ছেড়ে থাকতে পারবো না।

কিন্তু আমি ওকে জড়িয়ে ধরতেই ও ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে।

শিহরণজড়িত গলায় বললো, আমি কি কোনো পাপ করছি? আমার ভয় করছে কেন?

-ভয় কেন? আমরা কি পরস্পরকে ভালোবাসি না?

-কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা যেন বাবা-মা কেউই জানতে না পারে।

-আমিই একদিন বলবো।

সভয়ে ও এমন ভাবে আমার দিকে তাকালো, যেন আমি পাগলের প্রলাপ বকছি।

-এসব কথা বলা অসম্ভব।

—কিন্তু এটা তো করতেই হবে। আজ না হয় কাল। তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব তো আমাকেই করতে হবে। আমি বলবো আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি। তোমার বাবা নিশ্চয়ই আমাকে প্রত্যাখ্যান করবেন না। তুমি তো জানো, উনি আমাকে কতখানি ভালোবাসেন।

—তুমি একটা জিনিস বুঝতে পারছো না। আমাদের বাড়ির সবাই তোমাকে ভালোবাসেন। আমিও তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু তোমাকে আমায় ভালোবাসতে হবে ওঁদের মতো করে। অনেক আগে যেভাবে ভালোবাসতাম সে ভাবে…ভাই-এর মতো।

ওর হাতে একটা চুমু দিয়ে বললাম, ধ্যৎ! আমি তোমার ভাই বা দাদা! মোটেই নই। তা আমি ভাবতেও পারছি না। তোমার বাবা-মাও বোধ হয় এরকম ভাবেন না।

—না গো, সত্যিই তাই। তুমি কিছু বোঝো না!

—ও কাঁদতে শুরু করলো।

-হায়! ভগবান! এ আবার কী? কান্না কেন?

-তোমার অনুশোচনা হচ্ছে আমায় ভালবেসে?

ও আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। বললো, তুমি বেশ জানো যে যাই ঘটুক না কেন আমি তোমাকে ভালোবাসবোই। আমি তোমার। একদিন তুমি আমায় তোমার দেশে নিয়ে যাবে। আমি আমার দেশকে ভুলে যাবো। আমি ভুলতেই চাই…..

আমার শরীরের সঙ্গে মিশে ও কাঁদতে লাগলো। তীব্র আবেগ আর মনোযন্ত্রণায় ও ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল।

—ওঁদের কিছু বোলো না লক্ষ্মীটি! তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে ওঁরা কখনই মেনে নেবেন না। ওঁরা তোমায় ভালোবাসেন—ওঁরা চান তুমি ওঁদেরই একজন হও—ওঁদের ছেলে।

আমি অবাক্ হয়ে গেলাম। মৈত্রেয়ী বলেই চললো, ওঁরা আমায় বলেছেন। অ্যালেন তোমার দাদা হবে। ওকে তোমায় ভালোবাসতে হবে নিজের ভাইয়ের মতো। তোমাকে ওঁরা দত্তক পুত্র নেবেন। যখন বাবার অবসর নেবার সময় হবে আমরা সবাই তোমার দেশে চলে যাবো। আমাদের প্রচুর টাকা, কাজেই ওখানে রাজার হালে থাকবো। ওখানে এত গরম নেই, দাঙ্গা, হাঙ্গামা নেই। তোমার দেশের লোকেরা এখানকার ইংরেজদের মতো নয়। অত্যাচার, শোষণ কিছুই আমাদের সহ্য করতে হবে না। আমি ওঁদের কোনো কথা না শুনে তোমায় কীভাবে ভালোবেসে ফেললাম…

মৈত্রেয়ী উত্তেজনায় টলমল করছিল। ওকে ধরে না ফেললে হয়তো পড়েই যেতো। আমি ওকে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। আমি ওর কথাবার্তা শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। দুজনে চুপচাপ বসে রইলাম। বহুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলাম না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *