৫
একথা আজ খোলাখুলি স্বীকার করবো, মৈত্রেয়ীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার প্রথম দিকে আমি কখানো ভালোবাসার কথা চিন্তা করিনি। বরং বলা চলে ওর রহস্যময় প্রকৃতির প্রতি আমি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। যখনই অবকাশ পেতাম, তার কথা চিন্তা করতাম। ডায়েরিতে একগাদা ঘটনাও আলোচনা লিপিবদ্ধ করতাম। মাঝে মাঝে যে অসুবিধায় পড়তাম না, তা নয়—ওর কাজলকালো চোখদুটির অদ্ভুত সৌন্দর্য, অবোধ্য ওর উত্তরগুলো, ওর বাঁধভাঙা হাসি। একথা অস্বীকার করে লাভ নেই যে, ঐ ষোড়শী তরুণীর প্রতি আমার কোন আকর্ষণ ছিল না। কিন্তু পদে পদে এ-ও বুঝতাম, ওর চলাফেরার মধ্যে এক মোহিনী আহ্বানের শক্তি লুকিয়ে ছিল। ভবানীপুরে থাকাকালীন দিনগুলো আমার কেমন অলৌকিক আর অবাস্তব বলে মনে হতো। এত তাড়াতাড়ি, আর এত স্বাধীনতা নিয়ে একটা ভারতীয় পরিবারের মধ্যে আমি প্রবেশ করতে পেরেছিলাম, যা বাস্তবিকই অবিশ্বাস্য বলে মনে হতে পারে। কোনো কোনো দিন, যখন মনে মনে আমার প্রকৃত জীবনে, অর্থাৎ আমাদের নিজস্ব জীবনধারার মধ্যে ফিরে যেতাম, তখন এই ভারতীয় স্বপ্নের জগৎ যে অলৌকিক বলে মনে হতো, তাতে সন্দেহ নেই। আশ্চর্য পরিবর্তন আমার! পুরোনো জগতের কিছুই আর ভালো লাগতো না। না জীবন-ধারা না বন্ধুবান্ধব। এখন আর পদার্থবিদ্যা, গণিতবিদ্যা আমাকে আকর্ষণ করে না। পলিটিক্যাল ইকনমি, ইতিহাস, আর কিছু রোমান্টিক উপন্যাস—এগুলোর মধ্যেই আমি ডুব দিয়েছিলাম।
একদিন মৈত্রেয়ী এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, আমি বাংলা শিখতে চাই কি না। তাহলে ও রাজী আছে আমার শিক্ষকতা করতে। এর আগে চলতি বাংলা কথোপকথনের দু’একটা বই আমি পড়েছিলাম। মৈত্রেয়ী যখন চিৎকার করে কিছু বলে অথবা যখন রেগে যায়, তখনকার ভাষা—এসব বোঝবার জন্যে গোপনে গোপনে এই বই আমি পড়তাম। আমি জানতাম ‘যাচ্ছি’ মানে ‘আমি যাইতেছি’। এ ছাড়া আর একটা শব্দ যা প্রায়ই শুনতাম, ‘কি ভীষণ’, যার অর্থ হলো ‘ইহা অস্বাভাবিক’। আমার ছোট্ট বইখানা এর বেশি কিছু আমাকে শেখাতে পারেনি, তাই মৈত্রেয়ী যখন আমাকে বাংলা শেখাবার প্রস্তাব দিলো, আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলাম। শর্ত ছিল, পরিবর্তে তাকে ফরাসী শেখাতে হবে।
সেইদিন থেকেই দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজনের অব্যবহিত পরে আমার শোবার ঘরে আমাদের পাঠ শুরু হলো। প্রথমে আমি বলেছিলাম লাইব্রেরিতেই বসবো, কিন্তু মিঃ সেন নিজেই আমার শোবার ঘরে আমাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে বললেন যাতে আরো নিরুপদ্রবে পড়াশোনা হয়। নরেন্দ্র সেনের তাঁর মেয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব স্থাপনে আগ্রহ এবং মিসেস সেনের এই উদার মনোভাব আমি ভালো চোখে দেখিনি। কখনো কখনো এরকম সন্দেহ যে মনে বাসা বাঁধেনি তা নয় যে, আমার আশ্রয়দাতারা আমার সঙ্গে তাঁদের মেয়ের বিয়ের কথা ভাবছেন না তো! যদিও এটা ছিল অসম্ভব, কারণ এতে তাদের সবাইকেই জাত খোয়াতে হতো।
প্রথম প্রথম পড়ার টেবিলে মৈত্রেয়ীর থেকে অনেক দুরে বসতাম আমি। ও আমার অসুবিধাগুলো শান্তভাবে বোঝবার চেষ্টা করতো, কিন্তু ভালো বুঝতে না পারার ফলে কয়েকদিন পর থেকে আমার কাছ ঘেঁষে বসতে শুরু করলো। কিন্তু এত নির্বিষ্ট মনে আমাকে লক্ষ্য করতো যে আমি পড়ায় মন দিতে পারতাম না। ‘হ্যাঁ’, ‘না’ ছোট ছোট মন্তব্যে পাঠের দায় সেরে তাকে আপাদমস্তক লক্ষ্য করতাম। আর নিজের মনটাকে যেন সমর্পণ করতাম আমার নিজের দৃষ্টির কাছে। আমার চোখ থেকে ফুটে বেরোতো এমন এক দৃষ্টি, যেন সেটা দৃষ্টি নয়। এক তরল ইচ্ছাশক্তির বহিঃপ্রকাশ! আমি নিবিষ্ট মনে তার মুখ দেখতাম। দেখতে দেখতে মনে হতো ও যেন ছাঁচে ঢালা সৌন্দর্যের বিরুদ্ধে মূর্তিমতী বিদ্রোহ। মৈত্রেয়ীর তিনটি ছবি সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম কিন্তু সেগুলোর মধ্যে এই মৈত্রেয়ীকে চিনতে পারতাম না।
বাংলা পড়ার শেষে আমাদের চুক্তি মতো ফরাসী ভাষার পাঠ আরম্ভ হলো। আমি তাকে বর্ণমালা ও বিভিন্ন সর্বনাম সম্পর্কে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ও আমাকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো- ‘আমি একটি যুবতী মেয়ে’ এটা ফরাসীতে কি হবে? আমি লিখে দিলাম। সে খুব খুশি হয়ে বারবার বলতে লাগল, ‘জ্য সুই য়ুন জ্যেন ফিই’।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম ও একেবারে সঠিক উচ্চারণ করছিল। কিন্তু ওকে যা শেখাতে যাচ্ছিলাম তা আমার মাঠে মারা গেল। পড়াতে গেলেই সে আমায় থামিয়ে দিতো আর ভিন্ন ভিন শব্দের ফরাসী অর্থ বলে দেবার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো—যেগুলোর মাথাও নেই মুণ্ডুও নেই।
ও এই প্রস্তাব করলোঃ আপনি অনুবাদ করে দিন, আমি বার বার বলে অভ্যেস করে নিই। যেন ভাষা শেখার এক সুন্দর পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে ও। আমাদের মধ্যে কৌতূহলী কথাবার্তার বিনিময় শুরু হলো। মৈত্রেয়ী বারবারই আমায় জিজ্ঞাসা করতো আমি ঠিক ঠিক অনুবাদ করছি কি না।
কিছুদিন যাবার পর ও আমার দিকে ওই অদ্ভুতভাবে তাকানোটাও বন্ধ করলো। কথা প্রধানত আমিই বলতাম। আর সেই সময় ওর নোট বুকেও হিজিবিজি কেটে চলতো। একদিন আমি যখন পড়াচ্ছিলাম, ও ওর নোট বুকে অন্তত বার দশেক রবীন্দ্রনাথের নাম সই করলো, তারপরে একটা ফুল আঁকতে শুরু করলো। ফুল আঁকা শেষ হলে ও লিখতে শুরু করলো, ‘কালকুতা’, ‘জরেগ্রেত’, ‘পুরকোয়া’। তারপর করলো কি, বাংলায় বানিয়ে বানিয়ে কবিতা লিখতে লাগলো। আমার তখন মনে হচ্ছিল বুঝি কোনো অপরিচিত লোকের সামনে বসে আছি। বিরক্ত হচ্ছিলাম কিন্তু ওকে থামিয়ে দেবার আমার সাহস হলো না। এই রকম চলছিল। হঠাৎই একদিন ও আমায় প্রশ্ন করলো—যখন আপনি পড়ান তখন যে আমি লিখি, এটা আপনি পছন্দ করেন না, না? তা কথাটা বলতে এত ইতস্তত করছেন কেন?
তাড়াতাড়ি করে কি উত্তর দিয়েছিলাম তা আর আজ মনে নেই, তবে আমি যে রেগে গিয়েছিলাম তা আমি স্বীকার করছি। আমি পড়ানো চালিয়ে গেলাম এবং যথারীতি ও লিখে চললো, ইল এ তার’, ‘ইল্ এ ত্রো তার’, ‘মে হিল ন্য পা ব্র্য তার।’ আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,—এসবের মানে কি?
—এই একটু মজা করছিলাম!—বলে সে প্রত্যেকটি শব্দ মুছে ফেলে সেই জায়গায় একটা করে ফূল আঁকতে শুরু করলো। আমার মাথায় একটু বুদ্ধি খেলে গেল, বললাম, তুমি ছবিকে ফরাসী শেখাও না!
বলেই আমি হেসে ফেললাম। আমার হাসিতে ও-ও মজা পেলো।
–আপনার মনে হচ্ছে আমি পারবো না? আমি আপনার চাইতে অনেক ভালো পড়াতে পারবো।
সে গম্ভীর হয়ে এই কথাগুলো বললো, আর তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে আমায় দেখতে লাগলো। আমি মৈত্রেয়ীর এই চেহারা আগে কখনও দেখিনি। এক আশ্চর্য আনন্দে আমি শিউরে উঠছিলাম। সেদিন ওকে পরিপূর্ণভাবে ‘নারী’ বলে মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ও একান্ত আপনার। এই সময়গুলোতে আমি ওকে যতটুকু বুঝতে পারতাম, যত গভীরভাবে বুঝতে পারতাম, ঠিক ততখানিই ওকে দুর্বোধ্য মনে হতো, যখন ও অন্যের মনোরঞ্জনে ব্যাপৃত থাকতো।
আমি ফরাসীতে কি উত্তর দিয়েছিলাম মনে নেই। অনুবাদ করে তার গুরুত্ব কমাতেও আমার · ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু ও লজ্জায় লাল হয়ে গেল এবং আমায় বললো, কথাটা আবার বলুন! তা শুনে নিয়ে বাক্যটার প্রতিটি শব্দ ও মুখস্থ করে টেবিল থেকে অভিধান নিয়ে সেই রহস্যময় বাক্যের অর্থ উদ্ধারে প্রবৃত্ত হলো। কিন্তু এতো করে কিছুতেই যখন বুঝতে পারলো না, তখন প্রচন্ড রেগে গেল। বললো, আপনি মজা করতে জানেন না।
—পড়ানোর সময় মজা করতে আমি ভালবাসি না।
যতখানি রাগের ভান এবং উচ্চারণে রুক্ষতা আমার আনার দরকার ছিল ততখানি বোধহয় হয়নি। ও কি বুঝলো তা ওই জানে। খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে কি যেন ভাবলো। ভাববার সময় ওর অভ্যেসই ছিল চোখ বন্ধ করা। আমি দেখলাম সারা মুখের তুলনায় চোখের পাতাগুলো একটু ফর্সা, তার ওপর হাল্কা একটা বেগুনি আভা। হঠাৎই সে উঠে পড়ে বললো, দেখি কিছু চিঠিপত্র এলো কিনা।
আমি ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ভাবছিলাম ও কি কিছুই শিখবে না বলে মনঃস্থ করেছে? মিঃ সেনের কাছে আমি কি কৈফিয়ৎ দোবো! মৈত্রেয়ী অবশ্যি তাড়াতাড়িই ফিরে এলো, হাতে চিঠির বদলে দু গুচ্ছ ফুল। বারান্দার লতানে গাছেরই ফুল বলে মনে হলো।
-পড়া কি আবার শুরু করবো? ‘জ্য সুই যুন্ জ্যেন ফিই’।
-ভালো হয়েছে। এ বাক্যটা তুমি আগেই শিখেছো। তারপর?
-‘জ্য প্রা লম্ব ফ্যাসে’।
-কিন্তু এগুলো তো গত সপ্তাহে পড়ানো শেষ হয়ে গেছে।
–সেই গাড়িতে যে মেয়েটাকে দেখেছিলাম, ওকেও কি ফরাসী শেখান?
হঠাৎই ও প্রশ্ন করে বসলো একটু যেন ভয়ে ভয়ে।
-আরে দূর! ও একটা গবেট। ওকে পাঁচ বছর ধরে পড়ালেও….
-পাঁচ বছর পরে আপনার বয়স কত হবে?
—তিরিশ একত্রিশ হবে।
—অর্ধেকেরও কম বয়স। যেন ও ওর নিজের জন্যই বললো।
তারপরে ও ওর খাতার ওপর ঝুঁকে আবার লিখতে শুরু করলো রবীন্দ্রনাথের নাম, বাংলায় এবং ফরাসীতে। তখন বাস্তবিকই আমার রাগ হচ্ছিল একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধের জন্য তার আদিখ্যেতা দেখে। এক সময় গারতির কথা বলেছিলাম যাতে ও একটু ঈর্ষান্বিত হয়। কিন্তু এখন ও গারতিকে ভুলেই গেছে। আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, ও আসলে যতটা সরল তার চাইতে বেশি সরল সেজে ও আমাকেই পরিহাস করতে চাইছে। একটা বছর-ষোল’র বাচ্চা মেয়ে আমাকে ঠাট্টা করছে এটা ভেবে আমার অসহ্য লাগছিল, বিশেষ করে যখন ওর ওপর আমর এতটুকু দুর্বলতা ছিল না।
আমি ওর উপস্থিতিতে আনন্দ পেতাম নিশ্চয়ই, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। বিভিন্ন ব্যাপারে ও আমার ভুল ধরার চেষ্টা করতো, আমার বিচিত্র হাস্যকর জীবরূপে প্রতিপন্ন করতে চাইতো। এই সব ছেলেমানুষীর জন্য ওর উপস্থিতির অন্যরকম কোনো গুরুত্ব আমার কাছে ছিল না। আমিই ছিলাম প্রথম যুবক যাকে মৈত্রেয়ী অত কাছ থেকে দেখার, চেনার সুযোগ পেয়েছিল। আমাকে মোহিত করার জন্য ওর চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। এই শেষের ব্যাপারটাই আমাকে মজা দিতো খুব। আমি জানতাম এই খেলার ব্যাপারটা খেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বেশি দূর গড়ানো থেকে নিজেকে বিরত রাখার, ঊর্ধ্বে রাখার প্রতিরোধ ক্ষমতা আমার আছে। সমকালীন ডায়োরির পাতাগুলো থেকে এ তথ্যই আমি পাচ্ছি যে, নিজের মানসিকতার ওপর তীক্ষ্ণ নজরও আমি রেখেছিলাম। অবশ্যই আমার নজর ছিল মৈত্রেয়ীর কলাকৌশলেরও ওপর। যেদিন থেকে ও তার প্রাথমিক ভীরুতা কাটিয়ে উঠে স্বচ্ছন্দে আমার সঙ্গে বকবক করতে আরম্ভ করলো, সেদিন থেকেই মনে হতো ও একটা নাটক করছে।
ও উঠে পড়লো। বই গুছিয়ে হাতে নিয়ে দু-গুচ্ছ ফুলের একটা গুচ্ছ টেবিলে রেখে অপরটি হাতে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো। যে ফুলের গুচ্ছটা টেবিলে পড়ে ছিল, সেটার দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম—এটা পড়ে রইলো যে!
মৈত্রেয়ী ফিরে এসে অপর ফুলের গুচ্ছটাও হাতে নিলো এবং পড়ানোর জন্য আমার ধন্যবাদ জানিয়ে দরজার দিকে রওনা দিলো। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ও ফিরে তাকালো, ঘুরে দাঁড়িয়ে ফুলের গুচ্ছটা আমার টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিলো। অপর গুচ্ছটা নিজের মাথার চুলে পরে নিতে নিতে সে দৌড়ে পালালো। ঘরে বসে বসে শুনতে পাচ্ছিলাম সে এক সঙ্গে দুটো করে সিঁড়ির ধাপ লাফ দিয়ে পার হতে হতে দোতলায় উঠে যাচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ লেগে গেল ঘটনাটাকে কি ভাবে গ্রহণ করবো এই ভাবতে ভাবতে। এটা কি প্রেমের প্রস্তাবনা? ডায়েরি খুলে একটা নির্বোধ মন্তব্যের সঙ্গে পুরো ঘটনাটা লিপিবদ্ধ করলাম।
পরের দিন সকালে চায়ের টেবিলে মৈত্রেয়ী জানতে চাইলো ফুলটা নিয়ে আমি কি করলাম?
—ফুলটা রেখে দিয়েছি, শুকনো হয়, হোক।
কথাটা বানিয়ে বললাম। আমি চাইছিলাম যে, ও মনে করুক আমার হৃদয়ে প্রেমের কবিতা লেখা শুরু হয়ে গেছে। দুঃখের সঙ্গে বললো যে ওর নিজের ফুলটা দোতলায় ওঠার সময় সিঁড়িতে পড়ে গেছে।
অফিসে সারা দিন ধরে এই ‘অভাবিত, অপ্রত্যাশিত এবং আকস্মিক ঘটনার জের চললো। একটা আশ্চর্য স্বপ্নময় অনুভূতি আমায় ঘিরে রইলো। বাড়ি ফিরে এসে আয়নায় মুখ দেখে জীবনে প্রথম নিজেকে আরও সন্দর দেখতে না হওয়ার জন্য দুঃখ হলো। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎই আমার সেই পুরনো অনমনীয় মনোভাব ফিরে এলো এবং অভিনেতাদের মতো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাঁদরামি করার জন্য প্রচণ্ড হাসি পেলো। হাসতে হাসতে আমি বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ভাবতে ভালো লাগছিল যে আমার এখনও কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে যায়নি। ঠিক সেই সময় মৈত্রেয়ী বইপত্র নিয়ে ঘরে ঢুকলো।
-আজ আমার পড়া আছে কি?
আমি বাংলায় উত্তর দিলাম এবং আমরা বাংলাতেই কথা বলতে শুরু করলাম। বাংলা আমি তাড়াতাড়ি শিখে নিচ্ছিলাম। এর আর একটা কারণও অবশ্য ছিল। প্রতিদিন বিকেলে আমি ছবুর সঙ্গে লেখা পড়া করতাম। মৈত্রেয়ী আমায় আনুবাদের জন্য একটা বাক্য দিলো। বাক্যটা যখন লিখে দিচ্ছিলাম তখন সে জিজ্ঞাসা করলো—ফুলটা কোথায় রেখেছেন?
—শুখোবার জন্য চাপা দিয়ে রেখেছি।
-দেখি একবার।
কি উত্তর দেবো ভেবে পেলাম না। কারণ আসলে ফুলটা আমি জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছিলাম। আমি রহস্য মাখিয়ে বললাম সেটা পাচ্ছি না।
-কেন, খুব গোপন জায়গায় রেখেছেন বুঝি?
মনে হচ্ছিল ধরা পড়ে গেছি। চুপ করে রইলাম যাতে ওর বিভ্রান্তি না কাটে। আমাদের লেখাপড়া শেষ হলো। মৈত্রেয়ী চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি উঠে গিয়ে বারান্দা থেকে এক গোছা ফুল তুলে নিয়ে এলাম। ফুলটাকে পাইপের গরম ছাই দিয়ে শুকিয়ে নিয়ে কাগজ চাপা দিয়ে রেখে দিলাম। তখন ফুলটাকে দেখে আর বোঝা যাচ্ছিল না যে, সেটা সদ্য তোলা। খাবার টেবিলে আবার দেখা ওর সঙ্গে। ওর চোখে তখন আশ্চর্য উজ্জ্বলতা। অনবরত হাসছিল মৈত্রেয়ী।
—মা বলছেন আমরা না কি ছেলেমানুষী করছি।
ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। মিসেস সেনের দিকে তাকালাম। উনি শান্তভাবে হাসলেন। হঠাৎই আমার খুব খারাপ লাগলো। আমাদের ভাবপ্রবণ ছেলেমানুষীগুলোও উৎসাহিত করা হচ্ছে দেখে মনে হলো যেন কোনো ষড়যন্ত্র চলছে আমায় নিয়ে যাতে আমি মৈত্রেয়ীর প্রেমে পড়ি।
এখন যেন বুঝতে পারছি কেন মৈত্রেয়ীকে আমার ঘরে পড়তে পাঠানো হয়েছিল, কেন মিঃ সেন ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়বার ছল করে সব সময় শোবার ঘরের দিকে রওনা দিতেন, কেন দোতলায় কোনো লোক আমাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে নিচে নামতো না। আমার মনে হচ্ছিল, আমি তক্ষুণি ওই বাড়ি ছেড়ে পালাই।
খাবার টেবিলে আমরা তিনজন। মিঃ সেনের বন্ধুর বাড়ি ডিনারের নিয়ন্ত্রণ আছে। মাথা নিচু করে আমি খেয়ে যেতে লাগলাম। মৈত্রেয়ী অনর্গল বকে যেতে থাকলো। লক্ষ্য করতাম মৈত্রেয়ীর মুখ ওর বাবা বা আর কোনো অপরিচিত লোকের সামনেই শুধু বন্ধ হতো। বাড়ির আর সকলের সামনেই ও বকে যেতো। আমায় বললো—মা বলছিলেন আপনার শরীরের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। সন্ধ্যাবেলা একটু বেড়ালে ভাল হতো।
জানিনা কি নিরাসক্তি আর অবজ্ঞা নিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম ও কথার
সঙ্গে সঙ্গেই মিসেস সেন যেন সেটা বুঝতে পারলেন। তিনি বাংলায় মেয়েকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন, আমি সঠিক বুঝতে পারলাম না। মৈত্রেয়ী মুখ গম্ভীর করে কি যেন উত্তর দিলো আর টেবিলের তলায় পা দিয়ে আমার পায়ের পাতায় চাপ দিলো। আমি কিছুই না দেখার না বোঝার ভান করে বসে রইলাম। কিন্তু সত্যিই খুব খারাপ লাগছিল মিসেস সেনকে ক্ষুন্ন হতে দেখে। ওঁকে আমি নিজের মায়ের মতো দেখতাম। খাওয়ার পর মৈত্রেয়ী বারান্দার শেষ অবধি আমার সঙ্গে এলো। এর আগে রাত্রে আমার শোবার ঘরের কাছে কখনও ও আসেনি।
—দয়া করে আমার ফুলটা ফেরৎ দিন।
আমি বুঝতে পারছিলাম ও অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কথা বলতে গিয়ে ইংরেজী ভুল করলো। আমি ওকে ঘরে ঢুকতে বলার সাহস পাইনি, কিন্তু ওইই চৌকাঠ পেরিয়ে প্রথম সুযোগেই ঘরে চলে এলো। আমি ওকে শুকনো ফুলটা দেখালাম।
—এই যে ফুলটা। আমার কাছে রাখি? আমি চাই ওটা আমার কাছেই থাকুক।
হয়ত কথাগুলো ঠিক এরকমই ছিল না। রহস্যময় অস্পষ্ট এক অনুভূতি তখন আমায় আচ্ছন্ন করে ছিল। সে ফুলটা হাতে তুলে নিলো, দেখলো, তারপর দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতেই বললো,
-এটা সেই ফুল নয়।
-কেন?
আমার ধরাপড়া ফ্যাকাশে মুখ সে বিজয়িনীর দৃষ্টি দিয়ে দেখলো।
-ওটাতে আমার একটা চুল জড়ানো ছিল।
সেদিন মধ্যরাত্রিতে ঘুম ভেঙে গেল। শুনতে পাচ্ছিলাম মৈত্রেয়ীর ঘর থেকে গুন-গুন করে গানের সুর ভেসে আসছে।