লা নুই বেঙ্গলী – ৪

তখন রোজ সকালে আমার ঘুম ভাঙতো এক-একটা নতুন অনুভূতি নিয়ে। শোবার খাটটা ছিল দরজার পাশে। শুয়ে শুয়েই দেখতাম আমার অনুজ্জ্বল ঘরটাকে। এক দিকে উঁচুতে গ্রীল দেওয়া একটা জানালা। সবুজ রঙের দেওয়াল। পড়ার টেবিলের পাশে দুটো টুল আর বিরাট একটা আরাম কেদারা। বই-এর তাকে ডান দিকের দেওয়ালে ঝুলছে। কয়েকটা ছবি। প্রত্যেক দিনই ঘুমের আমেজ কাটাতে আমার বেশ কয়েক মিনিট লেগে যেতো। খোলা জানালা দিয়ে দালানের দিক থেকে যে সমস্ত আওয়াজ আসতো সেগুলো উৎস, আর আমি কোথায় আছি—এইটে বুঝতে বুঝতেই বেশ কিছুটা সময় কেটে যেতো। খাটের ওপর বসে থাকতো রক্তে ফোলা তুলতুলে কয়েকটা মশা। সেগুলোকে সরিয়ে খিল দেওয়া দরজা খুলে বেরিয়ে মুখ ধুতে যেতাম উঠোনের মাঝখানে একটা টিনের চাল দেওয়া ঘরে। সেই ঘরের মধ্যে ছিল একটা সিমেন্টের চৌবাচ্চা, যার মধ্যে বিকেলে বাড়ির চাকরেরা ডজন ডজন বালতি ভরে জল ঢেলে রাখতো। ঘটিতে জল ভরে আমি গায়ের ঢেলে স্নান করতাম। তখন ছিল শীতকাল, বাইরে উঠোনটা ছিল টালি-পাতা আর ভীষণ ঠাণ্ডা। শীতে আমার পা থেকে মাথা অবধি কাঁপতো বাড়ির অন্য লোকেরা স্নানের সময় এক বালতি করে গরম জল সঙ্গে আনতো। তারা যখন শুনতো যে আমি ওই ঠাণ্ডা জলেই রোজ স্নান সারি, তখন তারা এত অবাক হতো যে তা বলার নয়। কয়েক দিন ধরে সারা বাড়িতে আমার স্নান নিয়েই আলোচনা চলতো। মনে মনে আশা ছিল মৈত্রেয়ী নিশ্চয়ই এক দিন আমার ঠাণ্ডা জলে স্নান করার তারিফ করবে। রোজ সকালে তাকে আমি দেখতাম একটা অত্যন্ত সাধারণ শাড়ি পরে খালি পায়ে এদিক ওদিক করছে। একদিন সে আমায় বললো আপনাদের দেশে নিশ্চয়ই ধারুণ ঠাণ্ডা! সেই জন্যই আপনারা এত ফর্সা।

এই ‘ফর্সা’ শব্দটা সে উচ্চারণ করেছিল চা-এর টেবিলের ওপর রাখা আমার নগ্ন বাহুর দিকে তাকিয়ে। তার মনে ছিল যেন খানিকটা ঈর্ষার ভাব। তার এই ঈর্ষা আমাকে অবাক করেছিল। তাদের বাড়িতে আসার পর বলতে গেলে তার সঙ্গে সেই আমার প্রথম বাক্যলাপ। কিন্তু আমাদের সেই আলাপন বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না, কারণ মিঃ সেন এসে আমার সঙ্গে তখন কথা বলতে আরম্ভ করলেন।

অন্য লোকের অসাক্ষাতে মৈত্রেয়ীর সঙ্গে আমার কথাবার্তা খুব কমই হতো। তাকে দেখতে পেতাম যখন সে বারান্দা দিয়ে যাতায়াত করতো। কখনো কখনো শুনতে পেতাম তার গান। জানতাম দিনের বেশিরভাগ সময়টা সে কাটায় হয় শোবার ঘরে আর নয়তো লম্বা বারান্দার এক কোণে। ক্রমশ আমার কৌতূহল বাড়ছিল এই মেয়ের ওপর যে একই সময় এতো কাছের এবং এতো দূরের।

মনে হতো, সবসময় সে যেন আমাকে চোখে-চোখে রাখছে সন্দহক্রমে নয়, পাছে আমার কোনো অসুবিধা হয় এই ভেবে। একা একা থাকার ফলে কি না জানি না, এ বাড়ির অনেক কিছুই আমার কাছে অদ্ভুত আর দুর্বোধ্য ঠেকাতো, আর সম্ভবত বুঝতে না পারার জন্যই হাস্যকর মনে হতো। প্রায়ই খালি-গায়ে একটি চাকর আমার কাছ আসতো। সে সঙ্গে করে নিয়ে আসতো ফল, দুধ, নারকেলের শাঁস আর ঘরে তৈরি মিষ্টি। লক্ষ্য করতাম দরজার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে সে তীব কৌতূহল নিয়ে আমার ব্যবহারের জিনিসপত্রগুলো দেখতো আর অনর্গল আমায় প্রশ্ন করে চলতো, আমার বিছানাটা পছন্দসই কি না, মশারি ঠিক মতো লাগানো হয় কি না, আমার ক্ষীর খেতে ভালো লাগে কি না, আমার কত জন ভাই-বোন আছে ইত্যাদি। এর সঙ্গেই আমি কয়েকটা কথা হিন্দীতে চালাতে পারতাম আর আমি জানতাম আমার প্রতিটি উত্তর দো-তলায় মিসেস সেন এবং অন্যান্য মহিলারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানবার জন্য অপেক্ষা করছেন।

মৈত্রেয়ীকে আমার একটু বেশি মাত্রায় অহঙ্কারী মনে হতো তখন। খাবার টেবিলে খাওয়ার সময়ও তার মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি লেগে থাকতো। টেবিল থেকে সবসময়ই সে সবার আগে উঠে পড়তো আর পাশের ঘর ঢুকে যেতো পান খেতে। সেখান থেকে তার বাংলা ভাষায় বলা কথাগুলো ভেসে আসতো আর ভেসে আসতো তার উচ্চকিত ঝর্ণার মতো খিলখিল হাসির শব্দ। অন্য লোকের উপস্থিতিতে কখনই সে আমার সঙ্গে কথা বলতো না, আর আমরা যখন দুজনে আলাদা থাকতাম তখন যে তাকে কিছু বলবো, এ সাহস আমি পেতাম না। চুপ করে থাকতাম। ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে এই অকারণ নীরবতা অস্বাভাবিক মনে হতে পারে, কিন্তু আমার তখন মনে হতো, ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে এটাই নিশ্চয় ভদ্রতা আর সদাচারের লক্ষণ। তাই এটা নির্বিচারে মেনে নিয়ে নীরবেই নিজের ঘরে ফিরে যাওয়া আমার কাছে শ্রেয় বলে মনে হতো।

কখনো কখনো অবশ্য পাইপ খেতে খেতে তার কথা আমি চিন্তা করতাম। ভাবতে চেষ্টা করতাম আমার সম্পর্কে মৈত্রেয়ীর কি রকম ধারণা, কী ও ভাবে আমার সম্পর্কে! ওর মুখের ভাব দেখে কিছু বোঝার উপায় ছিল না। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, এক একদিন ওকে দেখে অসাধারণ সুন্দরী মনে হতো। এত সুন্দরী যে দেখে দেখে আশ আর মিটতো না। ভাবতাম, ওকি নিবোর্ধ না প্রকৃতই সরল স্বভাবের? নাকি আদিম যুগের ভারতীয় মেয়েদের সম্বন্ধে আমি যে রকম ভাবতাম, সেই তাদের মতো? কতগুলো বাজে ভাবনা মাথায় ঘুর ঘুর করছে ভেবে পাইপের ছাই ঝাড়ার মতো সেগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতাম, তারপরে আবার আমার বই-এর পাতায় ডুবে যাবার চেষ্টা করতাম।

মিঃ সেনের লাইব্রেরীটি ছিল একতলার দুটো ঘর জুড়ে। তাই নিত্য নতুন পড়ার বই-এর অভাব আমার ছিল না।

একদিন ভাবানীপুরে আসার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরে, বারান্দার নিচে মৈত্রেয়ীর সঙ্গে আমার মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। যন্ত্রচালিতের মতো আমি হাত কপালে তুলে, আমার টুপি খুলে, তাকে নমস্কার জানালাম। ওকে কোনোভাবে অসম্মান করে না ফেলি, এই ভয়েই আমি অত্যন্ত হাস্যকর ভাবে কাজটা করে ফেলেছিলাম। মৈত্রেয়ী জিজ্ঞাসা করলো, কে আপনাকে আমাদের নমস্কার করবার নিয়ম শিখিয়েছে?

সেদিন তার মুখে ছিল এক আশ্চর্য বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি।

আমি উত্তর দিলাম, আপনি

মোটর গাড়িতে আমাদের সেই মুখোমুখি হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা আমার মনে পড়লো। সে সময়ে তার মুখে যে অস্বস্তি বা অস্থিরতা দেখেছিলাম, হঠাৎ যেন তা মৈত্রয়ীর মুখে ফুটে উঠলো। সে আর কথা না বাড়িয়ে প্রায় দৌড়ে অন্দর মহলের দিকে চলে গেল। অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে আমি আমার ঘরে ফিরে গেলাম। অনভ্যস্ত নমস্কারের ভঙ্গি করে করে ওকে আমি অনর্থক বিরক্ত করলাম না তো? আমার ব্যবহারে ও কিছু মনে করলো না তো? ভেবেছিলাম ঘটনাটি মিঃ সেনকে জানাবো কিন্তু কি কারণে যে আর জানানো হয়ে ওঠেনি।

এই ঘটনার কয়েকদিন পরে একদিন অফিস থেকে ফিরে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে পড়েছিলাম। এমন সময় মৈত্রেয়ী এসে দরজায় টোকা দিলো। দরজার গায়ে ঠেস দিয়ে সে ভয়ে ভয়ে বললো, আমার বাবা কখন ফিরবেন, আপনি জানেন?

আমার দরজায় মৈত্রেয়ীকে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আজ স্বীকার করছি সেই মুহূর্তে তার সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করা উচিত ছিল, তা সেদিন ঠিক ঠাওর করতে পারিনি। তাকে ঘরের ভেতরে আসতে বলার বা বসতে বলার সাহস আমার হলো না। তার কথার উত্তর দিতে গিয়ে এত অসংলগ্ন কথা বলেছিলাম, যা আজ মনে পড়লে হাসি পায়। সে সোজা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমার মা-ই আমাকে এটা জিজ্ঞাসা করতে পাঠালেন। আপনি সারা দিন পরিশ্রমের পর ঘন্টার পর ঘন্টা একা এই ঘরে কাটান। আমাদের বাড়িতে আনন্দ করার মতোও কিছু নেই। সন্ধ্যের পরও যদি আপনি এইরকম ভাবে একা-একা কাটান, তাহলে আপনি তো আবার অসুখে পড়বেন!

-এ-ছাড়া আমি আর কী করতে পারি?

—আপনি যদি চান, তাহলে আমার সঙ্গে গল্প করতে পারেন, অথবা বাইরে কোথাও একটু বেড়িয়ে আসতে পারি আমরা।

দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে আমি বললাম, আমার তো কোনো চেনা লোক নেই এখানে, তাছাড়া এমন কোনো বন্ধুও নেই যার বাড়িতে গিয়ে আমি গল্প করতে পারি।

ও মৃদু হেসে উত্তর দিলো, সেই ওয়েলেলি স্ট্রীটে বুঝি এরকম ছিল না, না?

তারপরে হঠাৎ কী মনে করে বারান্দার দিকে চলে গেল, বলে গেল, দেখে আসি চিঠিপত্র কিছু এসেছে কিনা।

দরজায় ঠেস দিয়ে আমি তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সে গুন গুন করে একটা গানের সুর ভাঁজছিল। সুরটা শ্রুতিমধুর ছিল না। এ ধরনের সুর তার দোতলার শোবার ঘর থেকে প্রায়ই আমার কানে ভেসে আসতো। তার শোবার ঘরের একটা জানালা ছিল রাস্তার দিকে। আর দরজাটা ছিল বাড়ির ভেতরের দিককার বারান্দায়। সেই বারান্দায় লতিয়ে উঠেছিল একটা লাল ফুলের গাছ। প্রায়ই তাকে গান গাইতে অথবা ছোট বোনের সঙ্গে তর্কাতর্কি করতে শোনা যেতো। মাঝে মাঝে তাকে হঠাৎই খুব কাছের মানুষ বলে মনে হতো, যখন সে বারান্দা থেকে ঝুঁকে নিচের কারো ডাকের জবাবে মাথা নিচু করে ছোট্ট একটা চিৎকার করে বলতো, ‘যাচ্ছি’।

মৈত্রেয়ী কিছু চিঠিপত্র হাতে নিয়ে ফিরে এলো। আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কোণে চাবি বাঁধার চেষ্টা করছিল। সে খুব অহঙ্কারের সুরে বললো, চিঠির বাক্সের চাবি আমিই রাখি।

তারপর চিঠির ওপরের নামগুলো দেখতে দেখতে একটু দুঃখের সঙ্গেই বললো, কিন্তু আমাকে কেউ চিঠি লেখে না।

-আপনাকে কে চিঠি লিখবে?

—কেন, যে কেউ লিখতে পারে।

তার কথা বুঝতে না পেরে তার দিকে আমি একটু অবাক হয়েই তাকিয়ে রইলাম। সেও এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে স্থির হয়ে কী যেন ভাবতে লাগলো। বললো,

মনে হচ্ছে আমি ব্যাকরণে ভুল করলাম।

না, না, আপনি তো কোনো ভুল করেননি।

-তাহলে আপনি আমার দিকে ওইভাবে তাকিয়ে রইলেন কেন?

—তাকিয়ে রইলাম কেন? আমি বুঝতে পারছিলাম না, অচেনা কোনও লোক আপনাকে চিঠি লিখবে কেন?

—সত্যিই অসম্ভব, না? বাবাও ঐ কথা বলেন। বাবা কিন্তু আপনাকে খুব বুদ্ধিমান ভাবেন।

-সত্যি নাকি?

আমি ঠাট্টা করে উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেলাম। প্রত্যুত্তরে বোকার মতো হাসলাম। ও কিন্ত আগের কথার রেশ ধরে বলতে লাগলো, আপনি আমাদের বারান্দাটা দেখবেন?

আমি সানন্দে রাজী হলাম। আমার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিল ছাদের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে আকাশ দেখতে, সূর্যের আলো গায়ে মাখতে, পার্ক আর বাংলোওয়ালা পাড়াটাকে ভালো করে ওপর থেকে দেখতে। প্রথম প্রথম এই পাড়ায় এসে আমি প্রায়ই পথ হারাতাম।

—আমি কি এই পোশাকেই যেতে পারি?

আমার প্রশ্নে মৈত্রেয়ী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো দেখে বললাম, দেখুন আমার গায়ে কোট নেই, টাই নেই। পায়ে টেনিস খেলার জুতো, তাও আবার মোজাবিহীন।

সে আমাকে লক্ষ্য করতেই থাকলো, আর হঠাৎই প্রশ্ন করলো, আপনাদের বাড়িতে লোকে বারান্দায় যেতে গেলে কী করে?

—আমাদের বাড়িতে বারান্দাই নেই।

—সত্যি! একদম নেই?

–না, একটাও নেই।—খুবই দুঃখের কথা। তাহলে আপনাদের বাড়ির লোকেরা আকাশ কিভাবে দেখেন? সূর্য কিভাবে দেখেন?

-কেন? যেখানে খুশি, রাস্তায়, মাঠে, ঘাটে, যেখানে ইচ্ছে গিয়ে দেখে।

সে কিছুক্ষণ চিন্তা করলো, তারপর বললো, এই জন্য আপনারা এত ফর্সা আর সুন্দর। জানেন আমারও ভীষণ ফর্সা হতে ইচ্ছে করে। তা সম্ভব নয়, না?

-আমি জানি না…. পাউডার মাখলে বোধহয় হয় ….।

মৈত্রেয়ী রেগে গেল। বললো—পাউডার তো ধুয়ে যায়। আপনি যখন ছোট ছিলেন, তখন কি আপনাকে পাউডার মাখিয়ে ফর্সা করা হয়েছিল?

–না, ঠিক তা নয়।

—আপনাকে পাউডার মাখালে আপনি আর সুস্থ থাকতেন না। তলস্তয় বলেছেন।

আমি অবাক হলাম। তার মুখটা এখন পাল্টে গেছে। খুব গাম্ভীর্যের সঙ্গে সে বললো, আপনি তলস্তয়কে চেনেন না? বিখ্যাত রুশ-লেখক! জানেন, প্রথম জীবনে তিনি খুব ঐশ্বর্যের মধ্যে জীবন কাটিয়েও শেষ বয়সে সব ছেড়েছুড়ে বানপ্রস্থ নিয়েছিলেন, ঠিক ভারতীয়দের মতো। চলুন, বারান্দায় যাবেন তো?

আমার দুজনে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। আমার একটু ভয় ভয় করছিল যখন দোতলায় মেয়েদের ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। সে ইচ্ছে করেই জোরে জোরে কথা বলছিল যাতে সবাই আমার উপস্থিতি টের পায়। বিশেষ করে বোধ হয় তার মাকে জানান দেবার জন্যই।

বারান্দায় এসে আমার মনটা একেবারে অন্যরকম হয়ে গেল। বাড়ির ওপরতলা থেকে পাড়াটাকে একেবারে অন্যরকম মনে হচ্ছিল। অনেক শান্ত, আর অনেক সবুজ। রাস্তার ধারে গাছগুলো আমি লক্ষ্য করেছি, কিন্তু তারা যে সংখ্যায় এতো, তা ভাবতে পারিনি। রেলিং-এ হেলান দিয়ে নিচের উঠোনটা দেখলাম। মনে পড়ে গেল এ বাড়িতে আমার আসার সেই প্রথম দিনটিতে সিঁড়ির ধাপের ওপর মৈত্রেয়ীর হাসিতে-ফেটে-পড়া চেহারাটা। মনে হচ্ছিল সেই দিনটা কতো তাড়াতাড়িই পুরনো হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে কতো দিন পার হয়ে গেছে, আমি কতো পুরনো আর পরিচিত হয়ে গেছি। তখন মৈত্রেয়ী এসে আমার ঘরে দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে তার বাবা কখন ফিরবেন।

আমি ওকে ঠিক বুঝেও বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল ওর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে এক আদিম শিশু। ওর কথাবার্তা আমায় আকর্ষণ করতো। ওর অসংলগ্ন চিন্তাধারা, সরলতা আমায় মুগ্ধ করতো। নিজেকে তখন রীতিমত সেইরকম এক সভ্য, স্বাভাবিক মানুষ মনে হতো, যে কি না একজন প্রায় অসভ্য মানবীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করছে।

–আমার বোন ভালো ইংরাজী বলতে পারে না, কিন্তু জানেন ও সব বুঝতে পারে।

মৈত্রেয়ী নিজের বোনকে বারান্দায় এনে কথাটা বললো।

-ও আপনাকে একটা গল্প বলতে বলছে। আমিও গল্প শুনতে খুব ভালবাসি।

তখন আসন্ন সন্ধ্যার কাল। অনেক দিন পরের আশ্চর্য সুন্দর আকাশের নিচে আমি। প্রকৃতির পটপরিবর্তন হচ্ছে। সামনে দুটি মেয়ে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে। পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছিল। যেন হঠাৎই পর্দা সরে গিয়ে নতুন ভালোলাগা একটা দৃশ্য উন্মোচিত হয়েছে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকার পর আমি বললাম, অনেক কাল গল্প পড়িনি। তা ছাড়া আর একটা অসুবিধাও আছে, তা হলো আমি ভালো গল্প বলতে পারি না। ভালো করে গল্প বলতে পারার জন্য প্রতিভা থাকা দরকার। সকলের তা থাকে না।

কথাটায় ওরা খুব দুঃখ পেলো। ওদের দুঃখ এত স্বতঃস্ফূর্ত ছিল যে,-তা অনুভব করে আমার ভীষণ খারাপ লাগলো। ভালো হোক খারাপ হোক, ছোটবেলায় পড়া যা-হোক কিছু মনে করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুই মনে আসছিল না। নিজেকে তখন এত নির্বোধ আর অসহায় লাগছিল! পেরো, গ্রীম্, অ্যাণ্ডারসন, হার্ন, ‘এদের লালটুপি পরা ছেলে’ ‘ঘুমন্ত অরণ্যের সুন্দরী’ ‘যাদুকর ঐশ্বর্য’ এই সব গল্পগুলোর কথা মনে পড়লো। কিন্তু গল্পগুলো তখন এত খেলো মনে হলো যে, যদি শোনাতে গিয়ে হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়? তাই বাদ দিলাম। ইচ্ছে করছিল ওদের এমন কিছু বলি, যার মধ্যে দুঃসাহসিকতা, ঘটনার জটিলতা, এসব আছে। মনে হচ্ছিল এক কথায় এমন কিছু বলি, যা একজন বুদ্ধিমান, সংস্কৃতিবান, সপ্রতিভ যুবকের বলার পক্ষে উপযুক্ত আর যা ওদের মনে প্রভাব ফেলতে পারে অর্থাৎ যা ছোট মেয়েটির সঙ্গে সঙ্গে মৈত্রেয়ীকেও আনন্দ দিতে পারে, মৈত্রেয়ীকেও সমান কৌতূহলী করে তুলতে পারে। পরিতাপের বিষয় এই রকম কিছু আমার তখন মনে পড়লো না।

একটা গাছের গল্প বলুন আমাদের! ওর ছোট বোন ছবু বললো। আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো যা-হোক কিছু বানিয়ে বলি। ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে বলতে শুরু করলাম :

-অনেক, অনেক দিন আগে এক দেশে একটা গাছ ছিল, যার শিকড়ের নিচে ছিল গুপ্তধন। একদিন এক নাইট—।

ছবি জিজ্ঞাসা করলো—নাইট কী?

মৈত্রেয়ী তাকে বাংলায় বোঝাতে লাগলো ‘নাইট’ কাদের বলে। আর সেই সুযোগে আমি গল্পের বাকি অংশ ভাবতে শুরু করলাম। পরে যা বললাম, তা এই–

এক রাত্রে নাইট স্বপ্ন দেখলো যে এক পরী তাকে ওই ধনরত্নের জায়গাটা দেখিয়ে দিচ্ছে।

ওই রকম বোকা বোকা একটা গল্প বলতে গিয়ে এত লজ্জা হচ্ছিল, যে আমার আর ওদের দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছিল না, তাই অকারণে জুতোর ফিতে বাঁধতে শুরু করলাম। যাই হোক এক সময় গল্প আবার বলতে শুরু করতেই হলো–

-একটা ম্যাজিক আয়নার সাহায্যে নাইট সেই সব ধন-রত্ন উদ্ধার করতে গেল।

গল্পটা আর বাড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল মৈত্রেয়ী সবই বুঝতে পারছে। কিন্তু চোখ তুলে দেখলাম, সে গভীর মনোযোগের সঙ্গে আমার গল্প শুনছে …।

—কিন্তু নাইট দারুণ বিস্ময়ে দেখলো ধন-রত্নের ওপর একটা জ্যান্ত ড্রাগন বসে পাহারা দিচ্ছে; তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে আগুন …।

এই জায়গাটা বলতে গিয়ে লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে গেল।

—তখন …

হঠাৎ ছবু বাধা দিয়ে বললো—কিন্তু গাছটা? গাছটা কী বললো?

—গাছটা তো এমনি সাধারণ গাছ! জাদু গাছ তো নয়, তাই সে কথা বলতে পারতো না।

-কিন্তু কথা বলার জন্য তাকে জাদু গাছই বা হতে হবে কেন?

আমি মহা বেকায়দায় পড়লাম। মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগলাম।

—যাইহোক গল্পটা এরকমই। এই গাছটা কথা বলতে পাতো না। ওর প্রাণ ছিল না।

ছবু মহা উত্তেজিত হয়ে দিদিকে কিছু বলতে শুরু করলো। এই প্রথম বাংলা না জানার জন্য আমার প্রচণ্ড দুঃখ হলো। সুরেলা, মিষ্টি গলায় ছবু কিছু বলছিল।

—ও কী বলছে?

—ও আমাদের বাড়ির গাছগুলোর কথা তুলে জিজ্ঞাসা করছে যে, এই গাছটিরও প্রাণ আছে কিনা?

আমি বললাম সব গাছেরই প্রাণ আছে।

—ওর একটা প্রিয় গাছ আছে বুঝি?

-বড়োগাছ নয়। উঠোনের ধারে হয়েছে একটা চারা গাছ, যার ডালপালাগুলো দেখবেন রেলিং অবধি উঠে এসেছে—ছবু রোজ গাছকে খেতে দেয়—নিজে যা যা খায়, সব

যাক কথাবার্তা অন্য দিকে ঘুরে যেতে প্রাণে বাঁচলাম।

-খুব ভালো ছবু, খুব ভালো! কিন্তু তোমার গাছ তো পিঠে খায় না।

ছবি আমার মন্তব্য শুনে বললো,

ও হ্যাঁ—ওটা, আমিই খাই। অবিশ্যি ওকে একটু একটু দিই।

পাইপ খাবার ভান করে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিলাম। কাঠের খিলটা দিয়ে দরজা বন্ধ করে ডায়েরিতে পুরো ঘটনাটা টুকে রাখতে শুরু করলাম। বিশেষ করে, আমার সঙ্গে মৈত্রেয়ীর কথাগুলো। তার চিন্তার রূপ। বারান্দায় আমার গল্প বলার কষ্টকর অভিজ্ঞতা। ছবুর মানসিকতা—যে নিজের সঙ্গে জড় পদার্থের অনুভূতির পার্থক্য করে না, সে গাছকে পিঠে খেতে দেয়, কারণ সে নিজে পিঠে খায়, যদিও সে ভালোভাবেই জানে গাছটা পিঠে খায় না। ভারী মজা লাগছিল আমার।

একদিন সন্ধ্যাবেলা। অফিসের কাজ শেষ হয়েছে। মিঃ সেন আমাকে ছেড়ে দেবার সময় কাঁধে হাত রেখে বললেন—অ্যালেন, দেখো আমার স্ত্রীর তোমার ওপর খুবই সহানুভূতি আছে আমি লক্ষ্য করেছি। তুমি আমাদের বাড়িকে নিজের বাড়ি বলেই মনে করবে। তুমি যখন যে ঘরে ইচ্ছে যেতে পারো। আমরা গোঁড়া নই, আর বাড়িতে পর্দাপ্রথাও নেই। তোমার যখন যা দরকার আমার স্ত্রীকে বলবে অথবা মৈত্রেয়ীকে বলবে—আশা করি মৈত্রেয়ী তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পেরেছে।

তাঁর কথায় আমি আমার অভিজ্ঞতার কথা বললাম।

মিঃ সেন বললেন—কিছু মনে করো না। বিদেশী তুমি, ভারতীয় মেয়েরা এখনো সেকেলে রক্ষণশীলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই এদের ব্যবহারে কিছু মনে করো না।

এরপর তিনি মৈত্রেয়ীর ব্যাপারে দুটো সত্য ঘটনা শোনালেন। একদিন তাদের ইটালীয়ান কনসুলেটে চায়ের নিমন্ত্রণ ছিল। তখন বৃষ্টি পড়ছিল। কনসুলেট থেকে বেরিয়ে আসার সময় গাড়িতে ওঠার জন্য কনসাল তাদের সাহায্য করছিলেন। একটাই মাত্র ছাতা ছিল, মৈত্রেয়ী যাতে ভিজে না যায়, তাকে ভালোভাবে নিয়ে যাওয়ার জন্য কনসাল ছাতার তলায় তার হাতটা ধরলেন। মৈত্রেয়ী এত ভয় পেয়ে গেল যে, ছাতা থেকে দৌড়ে বেরিয়ে বৃষ্টি মাথায় করে লাফিয়ে মোটরে উঠলো। আর সেই তার কান্না শুরু হলো ভবানীপুরের বাড়িতে মার কোলে আশ্রয় নেবার আগে আর তা থাংলো না। ঘটনাটা বছর খানেক আগেকার। তখন মৈত্রেয়ীর প্রায় বছর পনেরো বয়স, ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ করে আই. এ. পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

আর একটা ঘটনা হলো, একটি ইওরোপীয় পরিবারের নিমন্ত্রণে তারা থিয়েটার দেখতে গিয়েছিল। অন্ধকারে বক্সে, একটি ফুলবাবু তার হাত ধরার চেষ্টা করায় মৈত্রেয়ী তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বেশ জোরেই বলেছিল, যাতে আশপাশের সবাই শুনতে পায়, ‘আপনার মুখে জুতোর বাড়ি মারবো।’ সমস্ত বক্সের লোকেরা উঠে দাঁড়াল। এক মহিলা (কলকাতার সবাই তাঁকে চেনে বলে নামটা গোপন রাখা হলো) মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। মৈত্রেয়ী তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আমার কি ইংরেজী ব্যাকরণে ভুল হয়েছে?’

কাহিনী দুটো শুনে আমার খুব হাসি পেয়েছিল। কিন্তু নিজের মনে একটা প্রশ্ন আমি এড়িয়ে যেতে পারিনি। সেটা এই যে, মৈত্রেয়ী বাস্তবিকই কি অত সরল, না কি রসিকতা দিয়ে তার স্বভাব ঢাকতে চেষ্টা করছে, আর আমাদের নিয়ে খেলা করছে। এই ধারণা আমাকে তাড়া করে ফিরতো যখনই বাড়িতে আশপাশের ঘর থেকে তার জোরে কথা বলার আওয়াজ বা উচ্চৈঃস্বরে হাসির শব্দ ভেসে আসত।

মিঃ সেন একদিন বলেছিলেন—জানো অ্যালেন, ও কবিতা লেখে।

—তাই নাকি! দেখুন, আমারও কেমন যেন সন্দেহ ছিল…!

এই ঘটনা জানার পর মৈত্রেয়ীর প্রতি আমার কিছুটা বিরাগ এলো। এদেশের সব মেয়েরাই কবিতা লেখে, সব প্রতিভাবান সন্তানরা কবিতা চর্চা করেন আর মিঃ সেন তাঁর মেয়েকে প্রতিভাময়ী বলে মনে করেন—এ চিন্তাগুলো আমার বিরক্তি উৎপাদন করতো। যতবার তিনি আমাকে বলতেনঃ ওর প্রতিভা আছে! তখনই মৈত্রেয়ীকে আমার মনে হতো মেয়েটা নির্বোধ।

মিঃ সেন আমাকে তির্যক দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে এ-ও বলতেন—হ্যাঁ হে, ও দার্শনিক, কবিতা লেখে। ওর কবিতায় প্রশংসা করেছেন অনেকেই।

আমি নিরাসক্তভাবে মন্তব্য করলাম—তাই নাকি!

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে সন্ধ্যাবেলা মৈত্রেয়ীর সঙ্গে আবার মুখোমুখি হয়ে গেলাম। ও লাইব্রেরি থেকে একটা বই হাতে করে বেরোচ্ছিল। ইচ্ছাকৃতভাবে পরিহাসের সুরে বললাম, জানতাম না আপনি কবি।

সে লজ্জায় লাল হয়ে গেল এবং দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো।

–অবশ্য কবিতা লেখা কোনো দোষের জিনিস নয়। তবে দেখতে হবে সে কবিতা যেন সুন্দর হয়–

—আপনি কি করে জানলেন আমার কবিতা সুন্দর নয়?

—দেখুন, কথাটা বোধ হয় বোঝাতে পারিনি। আসলে, বলতে চেয়েছি, আপনার কবিতায় সৌন্দর্য নিশ্চয়ই থাকতে পারে, তবে কবিতায় দর্শন—জীবনকে জানার অভিজ্ঞতা আপনার যথেষ্ট আছে?

সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো তারপর আবার তার স্বভাবসিদ্ধ হাসিতে উদ্বেল হয়ে উঠলো। লক্ষ্য করলাম, তার হাসির সঙ্গে মিশে আছে অদ্ভুত এক আন্তরিকতা। লজ্জা-জড়ানো এক আশ্চর্য ভঙ্গিতে সে তার হাত দুটো রেখেছিল নিজের বুকের ওপর

—হাসছেন কেন?

হঠাৎ সে থেমে গেল।

—কেন, হাসতে বারণ আছে?

-না তা নয়, যার যা ভালো লাগবে সে তাই করবে। কিন্তু শুধু আপনার হঠাৎ এই হাসির কারণটা যদি বলে দেন……

–বাবা আপনাকে খুব বুদ্ধিমান বলে মনে করেন…….

আমি অধৈর্য হবার ভঙ্গি করলাম।

ও বললে, ভয় হয় ভুল করে আপনার রাগের কারণ না হই।

এই কথার সঙ্গে সঙ্গে মৈত্রেয়ীর মুখে এমন একটা ভাব ফুটে উঠলো, যা দেখে আমার আনন্দ হলো। বললাম, আমি রাগ করলে আপনার ভয় হবার কারণ কি?

—কারণ আপনি আমাদের অতিথি। ভগবানই অতিথিকে পাঠিয়ে দেন।

-আর অতিথি যদি খারাপ লোক হয়?

যেমনভাবে মানুষ একটা শিশুকে প্রশ্ন করে সেইভাবেই তাকে প্রশ্ন করছিলাম। যদিও তার মুখ ক্রমশ গম্ভীর হয়ে উঠছিল।

-ভগবান তাকে ডেকে নেন—

–কোন্ ভগবান?

–তার ভগবান।

—কেমন করে? প্রত্যেকটা লোকেরই আলাদা ভগবান আছে নাকি?

শেষ কথাগুলোর ওপর আমি বেশ জোর দিয়েছিলাম। সে আমার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো, তারপরে চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবলো। তখন ওর চোখে ছিল, স্নেহময় কোমল নতুন এক অভিব্যক্তি!

-আমার কি কিছু ভুল হলো?

-আমি কী করে জানবো? আমি তো আপনার মতো দার্শনিক নই। -দেখুন, আমি ভালোবাসি স্বপ্ন দেখতে, চিন্তা করতে, কবিতা লিখতে … এই হচ্ছে দার্শনিকতা!—আমি নিজের মনে ভাবলাম এবং হাসলাম।

-আমি অনেকদিন বাঁচতে চাই। আমি রবি ঠাকুরের মতো বৃদ্ধ হতে চাই। যখন মানুষ বুড়ো হয় তখন সে বেশি ভালোবাসতে পারে, আর কম দুঃখ পায়। এইভাবে কথা বলতে বলতে লজ্জায় ও লাল হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবার জন্য উন্মুখ হলো। কিন্তু কি ভেবে আবার দাঁড়িয়ে পড়লো। ও বোধহয় বুঝতে পারছিল যে তার কথাগুলো আমি কিভাবে নেবো। সে তার বোধের অতীত ও তৎক্ষণাৎ বিষয়ান্তরে গেল। বললো—মা খুব চিন্তা করছেন। তিনি একটা বইতে পড়েছেন যে ইউরোপে রোজ লোকে সূপ খায়। আমাদের বাড়িতে তো সূপ হয় না, সেজন্য আপনি রোগা হয়ে যাচ্ছেন।

তাকে শান্ত করার জন্য বললাম, আমি সূপ ভালোবাসি না।

শুনে মৈত্রেয়ীর চোখ আনন্দে চকচক করে উঠলো

-কিন্তু আপনারা এত ভাবছেন কেন? এমন কি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এটা?

—মা ভাবছেন, তাই—

ও আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মত পাল্টালো। ওর এই অকস্মাৎ নীরব হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আমাকে খুব বেকায়দায় ফেললো। মনে হলো আমি কি তার মনে কোনো আঘাত দিয়ে ফেললাম!

—যদি কোনো অন্যায় করে থাকি ক্ষমা করবেন। আপনাদের সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করতে হয় তা আমার এখনো ভালো করে রপ্ত হয়নি।

সে চলে যাচ্ছিল। ঘুরে দাঁড়ালো। যেভাবে আমার দিকে তাকালো সে দৃষ্টির অর্থ আমি বোঝাতে পারবো না। আমি হতভ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বললো—কেন আমার কাছে ক্ষমা চাইছেন? আমায় আপনি কষ্ট দিতে চান?

আমি অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে বললাম—না না সেরকম কোনো ব্যাপার নয়। আমি ভাবছিলাম আপনি রেগে গেছেন তাই…

-একজন পুরুষমানুষ কি করে একটা মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইতে পারে?

—যখন সে ভুল করে…এটাই আমার অভ্যাস।

-একজন যুবতী মেয়ের কাছে?

-এমনকি একটা শিশুর কাছেও। এটা ঠিক যে…

-সব ইউরোপীয়ানরাই কি এরকম?

আমি ইতস্তত করছিলাম।

-প্রকৃত সভ্য ইউরোপীয়ানরা……

চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে ও কিছু চিন্তা করলো, তারপরে, ঝংকার দিয়ে হেসে উঠলো আর সেই আগেকার ভঙ্গীতেই তার দুহাত বুকের কাছে চেপে ধরলো।

–বোধ হয় বিদেশীরা নিজেদের মধ্যেই ক্ষমা ভিক্ষা করে থাকেন। কিন্তু আমার কাছেও কেউ ক্ষমা চাইতে পারে….!

—নিশ্চয়ই পারে।

-ছবুর কাছে?

—নিশ্চয়।

–হুবু তো আমার চাইতেও কালো।

—এটা কি সত্যি কথা?

মৈত্রেয়ীর চোখ দুটো জ্বলে উঠলো। বললো, হ্যাঁ, সত্যি কথাই। আমি আর মা, ছবু আর বাবার চাইতে ফর্সা। আপনি লক্ষ্য করেন নি?

—তাই না হয় হলো। তাতে কি যায় আসে?

-কেন? আপনি কি দুটো একই মনে করেন? জানেন কি, কালো বলে ওর বিয়ে দিতে খুবই অসুবিধে হবে আর অনেক টাকা লাগবে?

এই কথাগুলো বলতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল। লজ্জায় ও লাল হয়ে গিয়েছিল। আমি নিজেও খুব বিচলিত বোধ করছিলাম। হিন্দু বিবাহ ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রচুর তথ্য আমি লুসিয়্যাঁর কাছ থেকে পেয়েছিলাম। বুঝতে পারছিলাম একজন যুবতী মেয়ের পক্ষে ওই জাতীয় বেচাকেনার গল্প করতে কতখানি খারাপ লাগতে পারে। দুজনের পক্ষেই সৌভাগ্য বলতে হবে যে, মিসেস সেন সেই সময় ওকে ওপর থেকে ডাক দিলেন। মৈত্রেয়ী বইটা বগলে করে চেঁচিয়ে যাচ্ছি’ বলে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে ওপরে উঠে গেল।

আমি আমার ঘরে ফিরে এলাম। আজকের অভিজ্ঞতা মুগ্ধ হয়ে ভাবছিলাম। রাতের খাবার সময় এগিয়ে আসছিল। আমি হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। বাঙালীদের রীতি অনুযায়ী রাতের খাওয়া হতো খুব দেরিতে, রাত দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে। তারপরে আমরা শুতে যেতাম।

ডায়েরিতে কিছু লেখার জন্য সেটা খুললাম। ফাউন্টেন পেনটি শূন্যে ধরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তারপর ডায়েরিটা বন্ধ করতে করতে মনে মনে বললাম—’বোকামি’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *